সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

গল্প - আইভি চট্টোপাধ্যায়

ভদ্রা
আইভি চট্টোপাধ্যায়


আমি ভদ্রা । বরাহপর্বত থেকে যাত্রা শুরু করেছি । বরাহপর্বত মানে, সেই পশ্চিমঘাট পর্বতমালা । গঙ্গামুলা থেকে এতদূর এসে পড়েছি । চলছি তো চলছিই । চলাটা আমার ভালোবাসা, চলাটা আমার নেশা । যতক্ষণ না মাযের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারছি, আমাকে চলতেই হবে ।

আমার মা, কৃষ্ণা । মা যে কি সুন্দর, মাযের গায়ের গন্ধে কি যে টান । মাযের কোলে চড়ে আমি সাগরে যাব । আমি একা নয়, আমরা সব ভাইবোনেরা একসঙ্গে সেখানে যাব । এই তো কুদালি পৌঁছে গেলেই আমার বোনের সঙ্গে দেখা হবে আমার । আমার বোন তুঙ্গা । তারপর থেকে তো আমাদের আর আলাদা করে চেনাই যাবে না । তখন আমাদের দুজনের একটাই নাম । তুঙ্গভদ্রা । আমাদের কৃষ্ণা-মা আমাদের পথ চেয়ে বসে আছেন । মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তবে শান্তি । সাগরে যাবার জন্যেই যে আমার এতখানি পথ চলা ।

ভদ্রাবতী পৌঁছে বেশ ভয় হয়েছিল, এই বুঝি চলা শেষ হয়ে গেল । ভদ্রাবতী একটা মস্ত শহর, বড় বড় কারখানা । অনেক মানুষের ভিড় । মস্ত একটা ব্রীজ । অনবরত গাড়ি আসছে আর যাচ্ছে । ব্রীজের ওপর তলায় আবার রেললাইন। যখন ট্রেন যায়, ঝম ঝমাঝম বাজনা বাজে । ব্রীজটা কাঁপতে থাকে । আমার বুকের মধ্যে বান ডাকে ।

ব্রীজ পার হলেই লেভেল ক্রসিং । দুদিকে উপছে পড়া বাজার । আলু, পটল, কুমড়ো, কাঁচা লঙ্কা । একদিকে ছোট বড় মাছ । টপাটপ কেটে ফেলছে দোকানী । আরেকদিকে মুরগির গলা কাটছে মুরগির দোকানে । ছাল ছাড়ানো পাঁঠাগুলো দুলছে আরেক দোকানে । হার্ডওয়ারের দোকানে লোহার আওয়াজ । উল্টোদিকে সাইবার কাফে । কম্পিউটার আর ইন্টারনেট । শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ।

এদিকে মস্ত মুদির দোকান । ওহ না, মুদির দোকান না । শপিং মল । ওখানে মুদির দোকানের জিনিসপত্র থেকে সব্জী জামাকাপড় জুতো মোজা সব পাওয়া যায় । বড় বড় খাবারের দোকান থেকে বিউটি পার্লার । সব ।

শপিং মল ছাড়িয়ে আর একটু এগোলে শাড়ির দোকান । সোনার গয়নার দোকান । মেকী সোনা, ঝুটো পাথরের গয়নার দোকানও আছে একটা । পাশাপাশি । শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ।

রাস্তার ওপারে ঝাঁ চকচকে খাবার দোকান । কে-এফ-সি চিকেন । ম্যাক ডোনাল্ড । একটা শিঙারা কচুরির দোকান। বাজে ডালডায় গরম গরম জিলিপি ভাজা হচ্ছে । আমার নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে । নদীর ধার ঘেঁষে গড়ে উঠেছে সব । এত ভিড়, এত আওয়াজ, আমার কষ্ট হয় খুব ।

এইখানে এই ছোট্ট জায়গাটায় এসে আমি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি । এই জায়গাটার নাম আমি জানি না । কেউ বলে কালসা, কেউ বলে কাজরা । তবে ভদ্রাবতীর ভিড় ছাড়িয়ে এসে এখানে নিঝুম শান্তি ।

একদিকে বড় বড় সবুজ গাছ । গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ছোট ছোট কুঁড়েঘর, সবুজ সবুজ ক্ষেত । এদিকে একটা গ্রাম । বড্ড ইচ্ছে করে একবার গ্রাম দেখে আসি । আমার তো আর সে উপায় নেই । তবে গ্রাম দেখা না হলেও গ্রামের লোকজন সবাইকেই চিনি । সবাই আসে আমার কাছে ।

ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমার কাছে এসে খেলাধুলো করে । বর্ষাকালে ঘাসে আগাছায় ভরে যায় । তখন সাপখোপ এসে ঘোরাফেরা করে । পোকামাকড়, ফড়িং, প্রজাপতি । রঙ বেরঙের পাখি । ঘাসফুলে ভরে ওঠে জায়গাটা । আরেকদিকে অনেকখানি বালির চড়া । একটু উঁচু হয়ে ওদিকে ঢাল নেমেছে । তাই ওদিকটা দেখা যায় না । কে জানে ওদিকেও গ্রাম আছে কিনা । ওদিক থেকে লোকজনও তো বিশেষ আসে না । তবে মাঝে মাঝে কাঁসর শিঙা ঢোলক বাজে । মনে হয় কোনো আদিবাসী গ্রাম আছে । হয়ত কাছে নয় । হয়ত ওদিকে আর একটা নদী বা পুকুর আছে । তাই ওরা আমার কাছে আসে না ।

আমারই বা আছে কি ! ভদ্রাবতীতে বিশাল বাঁধ দিয়ে আমার তো সব নিয়েই নিয়েছে । ইচ্ছেমতো ঢেউ নিয়ে চলার স্বাধীনতা নেই আমার । এখানে এসে তো একেবারেই সব হারিয়ে আছি । এই যে মাঝে এতখানি চড়া পড়ে আছে, এই যে এদিকে কালো পাথরগুলো জেগে উঠেছে, এসব তো জলের নিচে থাকার কথা । ছোট মাছ, ব্যাঙাচি, ছোট ছোট জলের পোকাগুলো কি কষ্টে যে বেঁচে আছে ।

কাজরা গ্রামের ছোট্ট রাখাল ছেলেগুলো গরু চরাতে এসে যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে জলের মধ্যে, কি ভালো যে লাগে আমার । একমাত্র তখনই মনে হয়, আমি বেঁচে আছি ।

এমনি সারাদিন আমি একা একাই থাকি । রাজি ছাড়া কেউ এমন নেই, যে রোজ আমার কাছে আসে । গাঁয়ের লোক অবশ্য আসে নদীর ধারে । তবে তারা কেউ আমার কাছে আসে না । মেয়ে-বউরা জল নিয়ে যায়, গাঁয়ের মোড়ল ওই অশ্বত্থ গাছটার তলায় বসে কাজিয়া মেটায় । ছেলেরা কখনো কখনো খেলা করতে আসে । আর আসে গাঁয়ের গরু ছাগলগুলো ।

আজকাল মাঝে মাঝে একটা লম্বা ছায়া এসে দাঁড়ায় । মানুষটাকে অবশ্য দেখি নি । ও কোনোদিন আমার কাছে এসে বসে নি । ছায়ামানুষ এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখে আমি জানি । ও রাজিকে দেখতে আসে ।

রাজি । রাজশ্রী । নামে রাণী, নামে শ্রী । কিন্তু রাজির মুখে এক পৃথিবী বিষাদ ।

আমার মতই শীর্ণ, নিষ্প্রাণ, প্রায় গতিহীন জীবন । আমার বুকের মধ্যে এতখানি চড়া, বড় বড় কালো পাথর জেগে আছে । রাজির শিরা বের হয়ে যাওয়া হাতে কড়া । শুকনো মুখে চোয়ালের হাড় জেগে থাকে আমারই মত । রাজিকে দেখলেই আমি নিজেকে দেখতে পাই ।

সারাদিন যন্ত্রের মত খাটে মেয়েটা । কিন্তু কেউ খুশি হয় না । মা, বাবা, ভাই, বোন, একটা বিয়েওলা বড় দিদি আসে মাঝে মাঝে, সে-ও না । মারের দাগে ওর হাতে কপালে গালে কালশিটে । কেন যে ওরা অত মারে ওকে, কে জানে । মেয়েজন্মের অপরাধ কিনা কে জানে । রাজির অন্য বোনেরা, দিদি, বৌদিরা, মা .. তারাও তো মেয়ে । তবে কেন তারা সমব্যথী নয় ?

রাজি আসলে নিজের কথাটা বলতেই পারে না । যে আত্মবিশ্বাস থাকলে সংসারে নিজের জায়গা ধরে রাখা যায়, নিজের ভেতরে যে জোর থাকলে ‘আত্মদীপো ভব’ বলা যায়, রাজি তা জানে না । রাজির জীবন বয়ে চলেছে আমারই মত । গতিহীন, দিশাহীন ।

আমার চলার ওপর যেমন আমার কোনো হাত নেই । কোথাও মস্ত বাঁধ, কোথাও ঢাল কেটে রাস্তা বন্ধ । স্বছন্দে বয়ে চলার আনন্দ নেই । আমি আজ গতিহীন, দিশাহীন । রাজিরই মত ।

অথচ প্রবাহ রক্ষা করাই নদীর ধর্ম । তার প্রবাহ রক্ষার মধ্যে দিয়েই মানুষের স্নান, পান, ক্ষেতের কাজ । ঠিক মানুষের জীবনের নানা প্রবাহের মতই । জীবনের নিজস্ব গতির প্রবাহ । সম্পর্কের প্রবাহ । বর্ণে ছন্দে কাটানো দিনরাতের প্রবাহ।
রাজির জীবনে এ প্রবাহ থেমে গেছে । রাজিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে । রাজির কোথাও যাবার জায়গা নেই। তাই রাজি আমার কাছে আসে বারবার । বাড়ির লোকে রাগ করে । কাজে ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে ওকে শাস্তি দেয় ।

কিন্তু রাজি আবার আসে । ওর আর কোথাও জায়গা নেই । নইলে আমারই বা আছে কি ! এই তো শুকিয়ে যাওয়া নদী । জল নেই, ঢেউ নেই । কালো কালো পাথর জেগে আছে । গাঁয়ের বৌরা কাপড় কাচতে গিয়ে দেখেছে, সেই শীর্ণ রেখার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে রাজি । বিকেলে নদীর ধারে খেলা করতে গিয়ে ছেলেরা দেখেছে, নদীর জলে নিজের ছায়ার দিকে চেয়ে বসে আছে রাজি ।

ভোরবেলা যখন পাখিরা জেগে ওঠে, গাছে গাছে দোলা লাগে, তারও আগে রাজি উঠে পড়ে । আকাশ বাতাসের কথা বাদই দাও, গ্রামের রাস্তাটাও তখন মায়া মায়া ।

রাজি এসে নদীর জলে নামে । অঞ্জলি ভরে চোখে মুখে দেয়, মাথায় ছোঁয়ায় । পুবের আকাশ তখন লাল হয়ে উঠছে । জলের মাঝে দাঁড়িয়ে সেইদিকে তাকিয়ে থাকে রাজি । রাজির সঙ্গে সঙ্গে আমিও আকাশকে হেসে উঠতে দেখি । গাছে গাছে পাখিরা জেগে উঠে গান গায় । রাজির সঙ্গে সঙ্গে আমি সেই গান শুনি । ভোরবেলা এই স্নিগ্ধ শান্ত সময়ে কুরূপা রাজির মুখখানা সোনা আলোয় মায়া মায়া হয়ে থাকে ।

আর সেই মায়া মায়া সময়ে আমার নতুন করে সাধ জাগে, আবার চলা শুরু করি । এই যে বালির চড়া, তাকে পেরিয়ে যাই । আমার বুকের মধ্যে সাগর ডাক দেয় ।

কিন্তু রাজির মতই আমি নিরুপায় অসহায় । গ্রামের লোকে আমার একদিকে বাঁধ দিয়ে খাল কেটে দিয়েছে । যেটুকু জল আছে, তা খালের দিকেই বয়ে যায় । কি করে এগিয়ে যাব আমি ! কে পথ করে দেবে আমায় !

কে পথ করে দেবে রাজিকে !

অনেক রাতে, চারদিক নিঝুম হলে রাজি একবার আমার কাছে আসে । আকাশে মায়াবী চাঁদ । চাঁদের আলোয় আমার জলের ওপর চিকচিকে রূপোলী মায়া । সেই মায়ার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে রাজি ।

দুপুরবেলা সব কাজ শেষ করে গাঁয়ের বৌরা আমার কাছে এসে বসে । নদীর ধারে, গাছের ছায়ায় । সেখানে রাজিকে কেউ ডাকে না । রাজি তখন খালের মুখটায় বসে কাপড় কাচে । তখন আবার ছায়াটা এসে দাঁড়ায় । লম্বা ছায়াটার দিকে তাকিয়ে কেমন চমকে উঠে রাজি গায়ের কাপড় টেনে নেয় ।

শুধু একদিন চঞ্চল হয়েছিল । যেদিন মানুষের ছায়াটা একেবারে নদী পেরিয়ে এসে রাজির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল ।

‘চলে যাও । আর কক্ষনো এসো না তুমি ।‘

ছায়ামানুষ বুঝি রাজির চেনা মানুষ ! আমার কৌতুহল হলেও জানতে পারি না । সেদিন চলে গেলেও ছায়ামানুষ আবার আসে । আবার । বারবার ।

শুকনো দু’চোখ তুলে রাজি বলে, ‘কেন আসো বারবার ?’

‘না এসে পারি না যে । তুমি বুঝি সব ভুলে গেছ রাজি ?’

‘হ্যাঁ, ভুলে গেছি । তুমিও ভুলে যাও । বেশ তো সংসার করছ, কাজকর্ম করছ । সে নিয়ে থাকো না কেন? কেন বারবার আসো ? মায়া ? করুণা ?’

আমার মনে হয়, এইসময় যদি রাজির চোখে দু’ফোঁটা টলটলে জল আসত কিংবা আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকত রাজি, তবে ছবিটা সম্পুর্ণ হত । তা হয় না । রাজি যেমন হাসতে ভুলেছে, তেমনই কাঁদতেও ভুলে গেছে । গলার কাছে নীল একটা শিরা জেগে উঠে শুধু রাজির মুখটা আর কুরূপ হয়ে যায় ।

সেই নীল শিরাটার দিকেই মায়ার চোখে চায় ছায়ামানুষ, ‘আর একবার রাজি । আর একবার ..’

নদীতে জল নিতে এসে, কাপড় কাচতে এসে গাঁয়ের মেয়ে বউরা আজকাল রাজির দিকে আড়ে আড়ে চায় । কখনো বা হেসে গড়িয়ে পড়ে । ‘ও রাজি, কি রে ? এতদিন পর ফিরে এসেছে, তোর জন্যে নাকি ?’

‘ও রাজি, তাহলে তোকে বিয়ে করার ভয়ে পালিয়ে গেছিল কেন ? জিজ্ঞেস করিস নি ?’

রাজি উত্তর দেয় না ।

রাজির বৌদি সবার সামনেই রাজির চুল ধরে টানে, ‘নদীর ধারে এসে বসে থাকিস এই জন্যে ?’

রাজি মুখ নামিয়ে থাকে ।

‘বাড়ির লোক তাড়িয়ে দিয়েছে তো ওকে । ওর অসুখ হয়েছে না ? ওর রক্ত খারাপ হয়ে গেছে ।‘ কেউ কেউ খবর
আনে, ‘তাই তো একলা এখানে ঘর বেঁধে থাকে । এখন আবার পুরোনো ভালোবাসা জেগেছে তাই ।‘

অসুখের কথাটা বুঝি রাজি জানত না ! ওর ভাষাহীন চোখ অমন চমকে উঠল কেন !

আমি নিজে নিজেই একটা না-বলা গল্প বুঝে ফেললাম । রাজির সঙ্গে বিয়ের কথা উঠেছিল যার, সে গাঁয়ের কাউকে কিছু না বলে চলে গেছিল । অলক্ষুণে মেয়েকে সেই লগ্নেই বিয়ে দিয়ে পর করে দিয়েছিল রাজির বাড়ির লোক । আর রাজির কপাল যেমন । সে বাড়ি থেকেও একদিন চলে আসতে হয়েছিল । আজ অসুস্থ মানুষটা বুঝি সেদিনের দোষ মুছে ফেলতে চায় ।

অসুখ হোক, আর যা-ই হোক, এমন বিশ্রী ব্যাপার মানবে কেন কেউ ? দোষ তো রাজিরই । নইলে এত বছর পর একটা লোক আবার এমন নির্লজ্জ হয়ে ওঠে ? রূপ নেই, গুণ নেই, এমন মেয়ের টানে কোনো মানুষ আসবে কেন ? কখন আসে?
কুরূপা মেয়েরা কি সংসার করে না ? তাহলে রাজি কেন পারে নি ? কেন স্বামী রাজিকে ছেড়ে অন্য মেয়েকে ঘরে তোলে? সব দোষ রাজির । কিছু তো একটা কারণ আছেই, নইলে দিনের মধ্যে দশবার করে নদীর ধারে যাওয়া কেন ? ওই তো শুকিয়ে যাওয়া নদী । জল নেই, ঢেউ নেই ।

গাঁয়ের মেয়ে বউরা বলতে লাগল, ‘সারাদিন নদীর ধারে থাকে কেন রাজি ? বদ মতলব না থাকলে এমন হয় ?‘
গাঁয়ের মোড়ল বলল, ‘এই নদীটাই অপয়া । এই নদীর জলে শয়তান বাস করে ।‘

সবাই সায় দিল, ‘ঠিক । ঠিক । নদীতে জল নেই । ঢেউ নেই । একটা ব্যাঙাচিও বাঁচে না এ জলে । নদীর জলে বিষ আছে নিশ্চয় । নৌকো চলে না । চাষের কাজেই বা কতটুকু লাগে ? এ নদীটা বুজিয়ে দাও । তবেই শয়তানের মরণ হবে।‘

আরো অনেক কথা হল । গাঁয়ের বুড়োরা এই নদীর ধারে বসেই তো রাজনীতি করে । নেশাখোর ছেলেগুলোর নেশার ঠেকও তো এই নদীর ধারেই । শাশুড়ি-ননদের নামে নিন্দামন্দ এই নদীর ধারে এসেই বেশি হয় । গত বছর দু’ দু’জন কিশোর ডুবে গেল এ নদীতে । অথচ এমন কিছু ডুবে যাবার মত জল নেই । মাথাটা জলের মধ্যে পাথরে লেগে গিয়েই হল । ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এসে নদীর ধারে খেলা করে, নদীটা খারাপ বলেই ওদের শরীর খারাপ হয় । নদীর ধারে এত গাছ । ছেলেমেয়েদের মাথায় গাছের ডালও ভেঙে পড়তে পারে । গাছের ওপর বজ্রপাত হতে পারে ।

দরকার কি এত ঝামেলা রেখে ! নদী না থাকলেই কেউ আর এদিকে আসবে না । গাঁয়ের সব মানুষ সজাগ হয়ে উঠেছে এবার ।

খুব ভয় করছে আমার । তাহলে কি এখানেই যাত্রা শেষ ? আর দেখা হবে না বোনের সঙ্গে ? মাযের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়া হবে না ? মোহানার মুখে দাঁড়িয়ে সাগর দেখা হবে না ? সাগরের সঙ্গে সঙ্গম .. আহ, আর হবে না আমার ?

গাঁয়ের লোকেরা রাজ্যের নোংরা ফেলা শুরু করেছে । নদীতে বাসন মাজা, কাপড় কাচাও বন্ধ । কেউ আর স্নান করতে, জল নিতে নামে না । সরু ধারাটা বয়ে যাচ্ছিল, সেখানে গাছের গুঁড়ি ফেলে মাটি ফেলে রাস্তা বন্ধ হচ্ছে । আসল কথাটা জেনে ফেলেছি আমি । এই নদী, নদীর ধারের জমি সব নিতে চায় ওরা । এখান দিয়ে পাকা রাস্তা হবে । বড় বড় বাড়ি উঠবে । বাঁধ দিয়েও আশ মেটে নি মানুষের ।

এই নদীর জমি নিয়ে দু’ দল লোকের লড়াই লেগেছে । নদী নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই । নদী না থাকলেই বা কি ! জলের জন্যে ভাবনা নেই । ভদ্রাবতী থেকে জল আসছে । ওখানে বাঁধ দেবার পর জলের বড় পুকুর তৈরী হয়েছে যে । না না, পুকুর না । সরোবর । লেক । লেক ঘিরে চমত্কার বাগান । ওটা একটা ট্যুরিস্ট স্পট ।

বোতলে ভরে, বড় বড় ক্যানে ভরে আমার জল বিক্রী হয় এখন । রাস্তার নিচে দিয়ে পাইপ করে কত দূর পর্যন্ত আমার জল নিয়ে যাওয়া হয় । আমার এই শুকিয়ে যাওয়া নদী ওদের কাজে লাগবে না আর ।

রাতারাতি বদলে গেছে এ গাঁয়ের লোক । তাদের কারো চোখে লোভ, কারো চোখে ভয় । বিদ্বেষ, ঘৃণা ।

খুব কষ্ট হচ্ছে আমার । গভীর কষ্ট ।

রাজি এসে মুখ শুকনো করে বসে থাকে আমার কাছে । একদিন ফিসফিস করে বলেছে, ‘তোমার সঙ্গে সঙ্গেই আমারও যাত্রা শেষ হবে ।‘

এ কথাটার মানে কি, আমি বুঝি নি । কিন্তু একজন মানুষ, অন্তত একজন যে আমার কষ্ট বোঝে তা জেনে আমার বুকের মধ্যে থেকে জল উছলে উঠেছে ।

আমি অবশ্য জানতাম না, আরো একজন মানুষ আমাকে গভীর ভাবে দেখে । সেই দৃষ্টিতে লোভ, ভয়, বিদ্বেষ নেই । রাজির মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সে আমারই দিকে চেয়ে থাকে । সে দৃষ্টিতে মায়া, মমতা, ভালোবাসা । আর আজ এতদিন পরে ছায়ামানুষকে আমি চিনতে পারলাম ।

এ তো সেই ছেলেটা । হাফপ্যান্ট পরে খালি গায়ে আমার জলে দাপাদাপি করত । এই তো সেই ছেলেটা, যে একদিন ছোট্ট নৌকো করে রাজিকে নিয়ে আমার জলে ভেসেছিল ওই চাঁপা গাছের তলা থেকে । তখন তো আমার দুই ধারে কত নৌকো । সারাদিন ধরে কত পারাপার । তবু ওদের মনে আছে আমার । নৌকোয় বসে আমার জলে ভালোবেসে হাত দিয়েছিল রাজি । তারপর এই এতগুলো বছর কোথায় ছিল ও ?

কেন জানি না, বেশ স্বস্তি হল আমার । সেই যে হাফপ্যান্ট, সময়ে অসময়ে এসে গাছের ডালে চড়ে পাখির বাসা খুঁজে বার করত, তরতর করে নারকোল গাছে চড়ে পড়ত, নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে পারাপার করত, সে এখন কত শান্ত ভদ্র সুন্দর । আমি বেশ নিশ্চিন্ত হলাম ।

গাঁয়ের লোকের কাছে অন্য কথা বলতে লাগল সে । নদী ঈশ্বরের আশীর্বাদ । নদীর ধারে সারাদিন ধরে মানুষের মেলা। তা কোনো শয়তানের টানে নয় । নদী একজন মানুষকে আরেকজন মানুষের কাছে টেনে আনে । নদী মানুষকে সামাজিক হতে শেখায় ।

নদীর জলে আলো-ছায়ার খেলা । নদীর ধারে ধারে সবুজ ক্ষেত, চিরসবুজ বনানী । নদী সুন্দর । নদী প্রাণ দেয় । তাই না যত জলের প্রাণী, শামুক গেঁড়ি গুগলি থেকে ছোট বড় মাছ, না-দেখা অসংখ্য জলের প্রাণী বেঁচে থাকে । শুধু প্রাণী কেন, উদ্ভিদ নেই ? সবুজ শ্যাওলা থেকে রঙিন শালুক পদ্ম । আহা, বড় সুন্দর । এই যে কত হাঁস .. ওই একটা পানকৌড়ি ডুব দিয়ে উঠল .. সকালবেলা যে সাদা বকের সারি আকাশ আলো করে উড়ে উড়ে আসে .. নদী না থাকলে এমন হত ?
 
নদী সুন্দর । নদী ভালো । নদীর জল ভালো । নদীর হাওয়া ভালো । আমাদের ক্লান্তি দূর করে, অবসাদ বিষাদ দূর করে। নদী না থাকলে মানুষের অনেক ক্ষতি । নদীর জল নোংরা করলে মানুষের ক্ষতি ।

শুধু মুখে বলা নয়, আমার চলার রাস্তা থেকে সব বাধা দূর করার ইচ্ছেও জানিয়েছে সে । বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে আমার জল পরিষ্কার করা, কেউ যাতে নোংরা না ফেলে সে জন্যে পাহারা দেওয়া ।

গাঁয়ের লোকেরা এখন তিন ভাগে ভাগ হয়েছে । একদল লোক, যারা নদী শয়তান শুনে রাগ করেছিল, তারা নদীর এত গুণের কথা শুনে শান্ত । তারা আর নদী নিয়ে মাথা ঘামায় না ।

আর একদল লোক, রাজিও তাদের মধ্যে একজন, তারা ভালোবেসে রোজ আমার কাছে আসে । আমার চলার পথের বালি, পাথর, গাছের ডাল সরিয়ে দেয় ।

কিন্তু আরেকদল লোক নির্মম, নিষ্ঠুর । তারা প্রতিজ্ঞা করেছে, এই জমি তারা নেবেই । দরকার হলে রক্ত ঝরবে, লাঠি বল্লম সড়কি বন্দুক সবরকম দিয়ে তারা লড়াই করবে ।

নতুন করে ভয় হচ্ছে আমার । আমাকে নিয়ে মানুষে মানুষে এমন সংঘর্ষ হবে ?

সেদিন সারা বেলা ধরে সে কী হট্টগোল । একদল মাটি ফেলতে এসেছে । ট্রাক ট্রাক মাটি, বালি । নদী বুজিয়ে ফেলবে । আরেকদল সার দিয়ে নদীর ধারে বসে । মাটি ফেলতে দেবে না ।

পাখিরা ভয় পেয়ে এ গাছের মাথা থেকে ও গাছের মাথায়, তারপর ছটফটিয়ে আকাশে উড়ে গেল । একদল ছাগল এ পাশের সবুজ ঘাসে মাথা ডুবিয়ে ঘাস খাচ্ছিল, তারা ভয় পেয়ে ছুটে চলে গেল । বড় বড় কালো মোষগুলো ভয় পেয়ে জল ছেড়ে উঠে গেল । গাছের ডালগুলো মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে পাতা ঝরাতে লাগল । আশেপাশের বাড়িগুলো দরজা-জানলা বন্ধ করে নিঝুম হয়ে গেল ।

রাত হল । চারদিকে নি:সীম অন্ধকার । নিস্তব্ধ । নি:শব্দ । মাথার ওপর চাঁদ নেই আজ । আকাশের তারাগুলো কেমন ভয় পেয়ে তাকিয়ে আছে ।

রাজি বসেছিল আমার কাছে । ওপারে বসেছিল রাজির ছায়ামানুষ । নিশ্চুপ । তাকে নিয়ে রাজিকে নানা বদনাম দেবার পর থেকে সে আর রাজির কাছে আসে না । গাঁয়ের মেয়ে-বউরা অবশ্য অন্য কথা বলে । ওর অসুখের কথাটা জানাজানি হয়ে গেছে বলেই ভয় পেয়ে সরে গেছে ও । রাজিও নিশ্চয় সব বুঝতে পেরেছে ।

নিজের মনে ভাবছিলাম । দেখতে পাই নি । গাছের মাথায় পাখিগুলো অসময়ে কিচির মিচির করে উঠল । হাওয়া নেই, তবু পাতাগুলো দুলতে লাগল । হাতকাটা গেঞ্জি, শক্ত চোয়াল, নির্মম চোখ । হাতে ধারালো অস্ত্র । রাজিকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে একদল নির্মম মানুষ । নদীর বন্ধু হবার শাস্তি দেবে । কুরূপা হোক, আর অলক্ষুণেই হোক, মেয়ে তো । মেয়েদের শাস্তি দেবার অধিকার পুরুষের আছেই । এমন শাস্তি দেবে, গাঁয়ের লোক আর বাধা দেবার সাহস পাবে না ।

স্তব্ধ মুহূর্ত । অনিশ্চিত মুহূর্ত ।

আকাশের একটা তারা টুপ করে খসে পড়ল । আর কে যেন আমার জলে ঝাঁপ দিল । সাঁতার । ডুব সাঁতার । সাগর সঙ্গমে আমার যেমন গতি বেড়ে ওঠে, সেইরকম বেগে কে যেন জল সরিয়ে যেতে লাগল ।

তারপর বজ্রনির্ঘোষ । কী যে হল, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না ।

শুধু দেখতে পেলাম, রাজিকে ছাড়িয়ে নিয়েছে ছায়ামানুষ । এখন আর ছায়া নেই, চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তাকে ।

মুখোমুখি দুই দল ।

‘নদী থাকবে না । নদী শয়তান । ও মেয়েমানুষটাকে ছেড়ে দিচ্ছি, নদী আমাদের চাই ।‘

‘না । নদী জীবন । নদী না থাকলে জীবন থাকে না । আর মেয়েমানুষ আবার কি ? ও মানুষ । একজন আস্ত মানুষ ।
তোমাদের গায়ে বুঝি অনেক জোর ? তাই মানুষের ওপর সে জোর দেখাচ্ছ ?’

‘ও তো একটা নষ্ট মানুষ । ওর জীবনের দামই বা কি ? বেশ তো, ওকে তো ছেড়েই দিয়েছি । ওকে নিয়ে চলে যাও । আমরা নদী চাই না । নদী না থাকলেই জীবন । বড় বাজার, মাল্টিপ্লেক্স, বড় বড় বাড়ি । অনেক মানুষের জীবন । আমরা ওই কালো অন্ধকার কাটিয়ে আলো জ্বালাব । ঝলমলে আলো ।‘

‘কোথায় কালো ? অন্ধকারই বা কোথায় ? নদীর জলে ওই দ্যাখো, কেমন রূপোলী চাঁদের আলো । আকাশের তারাগুলো কেমন ঝিকিমিকি আলো জ্বেলে রেখেছে । নকল আলোয় কি আর আসল আলো আড়াল হয় ? সাদাকে কালো করে দেখলেই হল ? তাই তো আলো থাকলেও সব অন্ধকার দেখায় ।‘

‘তুমি বুঝি কালো দেখতে পাও না ? পৃথিবীতে বুঝি শুধুই আলো ? অন্ধকার নেই ?’

‘না, নেই ।‘

‘নেই ?’ হাত থেকে খসে পড়ল তীরধনুক, বল্লম বন্দুক । ‘কি করে বলছ এ কথা ? অন্ধকার একটা বাস্তব । অন্ধকার নেই ? কালো নেই ?’

‘না গো । নেই । বাস্তব অবাস্তব বলেও কিছু নেই । আমাদের জানার বাইরে আছে অনেকখানি । সব আলো, সব সুন্দর
.. কোথাও কালো নেই, কোথাও অন্ধকার নেই .. এমন কখন হয় জানো ? যখন নিজের ভেতরে আলো জেগে থাকে ।‘

এমন কথা তো কেউ বলে নি আগে ! কেড়ে নিতে হবে, ক্ষমতায় শক্তিতে বেড়ে উঠতে হবে, এই তো জেনেছিল সবাই । আলো জ্বালার কথা কেউ তো শেখায় নি । তাই তো । চারদিক আলো আলো হয়ে উঠলেই না ঠিক ঠিক দেখা যায় । নদীকে, প্রকৃতিকে, নিজেকেও ।

আমি দেখলাম দু’দল মানুষ একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছে । তাদের চোখে ভালোবাসা । বুকের মধ্যে আলো জেগে উঠলেই এমন চোখ হয় ।

এখন আর ভিড় নেই । শুধু দুজন মানুষ । একে অন্যের দিকে চেয়ে আছে ।

‘তুমি বাড়ি যাও রাজি ।‘

‘চলো ।‘ রাজি একদিকে এগিয়ে গেল ।

‘ওদিকে কেন রাজি ? তুমি বাড়ি যাও । আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি । আর বিরক্ত করব না তোমায় ।‘

‘তুমি যে বললে, নিজের ভেতর আলো জ্বালার কথা ? তাহলে বাধা দিচ্ছ কেন ? আমার বুঝি নিজের ভুল বোঝার কথা থাকবে না ?’

‘কিন্তু আমার অসুখের কথাটাও সত্যি । রক্ত খারাপ হয়ে গেছে আমার । ওরা বোধহয় ঠিকই বলেছে । অসুখ হয়েই মন দুর্বল হয়েছে আমার ।‘

‘তাই ?’ হাসলে যে রাজিকে এমন সুন্দর দেখায় আমি জানতাম না । ‘তাহলে কুরূপা অলক্ষুণে মেয়ের সঙ্গে অসুস্থ দুর্বল মানুষের জোড় । এক্কেবারে ঠিক ঠিক । না ?’

‘মায়া করছ রাজি ? অসুখ হয়েছে বলে করুণা ?’

‘তাই মনে হচ্ছে তোমার ? এই দ্যাখো, এই নদীর দিকে চেয়ে দ্যাখো । সব হারিয়েও বয়ে চলেছে । জীবনের অন্য নাম হল গতি । বারবার ওর কাছে এসেও আমি সেটা জানতে পারি নি । আজ তুমিই তো শেখালে আমায় । আমি বুঝি নিজের ভেতরে আলো জ্বালাব না ?’

সুন্দর করে হাসল সে । ‘এসো তাহলে । আমরা দুজন মিলে নদীকে ভালোবাসি ।‘

আমার বুকের মধ্যে বান ডাকল । উছলে পড়ল আলো । আর মানুষ নদী নিয়ে উদাসীন নয় । তাই বুঝি এতদিন পর নদীতে জোয়ার এল । আমার যাত্রা শুরু আবার ।

কুদালি পৌঁছে গেলেই আমার বোনের সঙ্গে দেখা হবে আমার । আমার বোন তুঙ্গা । তারপর থেকে আমাদের আর আলাদা করে চেনাই যাবে না । তখন আমাদের দুজনের একটাই নাম । তুঙ্গভদ্রা । আমাদের কৃষ্ণা-মা আমাদের পথ চেয়ে বসে আছেন । মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তবে শান্তি । সাগরে যাবার জন্যেই যে আমার এতখানি পথ চলা ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন