সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

গল্প - অনুপ দত্ত

মনের সঙ্গে খেলা
অনুপ দত্ত



দিন দুই আগে শীতটা একটু কমে এসেছিল৷ আজ সকাল থেকে আবার বেশ জাঁকিয়ে বসেছে৷ ভোরের ঝিলে স্নান করতে নেমে অন্তরা অনুভব করলো ঠান্ডাটা বেশ জবর৷ করতোয়া নদীর বাঁধের উপরে কয়েকটা লোক উঁবু হয়ে বসে আগুন তাপাচ্ছিল৷ পাশ দিয়ে যেতে যেতে অন্তরা টের পেল আগুন তাপানো মানুষগুলোর শরীর থেকে বেশ আগুন লাগা দৃষ্টি এসে ওর ভেজা কাপড়ের শরীরে পড়ছে৷.ভালই লাগছে অন্তরার৷ ভিজে কাপড় চোপর যদি অগ্নি দৃষ্টিতে একটু শুকিয়ে যায় আর কি৷

পরমেশের সকাল হয় বেলা আটটার পর৷ অনেককিছু শুধরেছে পরমেশ বিয়ের পর কিন্তু এটাকে আর শোধরাতে পারেনি৷ আজ যিশু আর পরমেশের ছুটির দিন৷ অনেকক্ষণ ধরে নিরিবিছিন্ন কাজ করল অন্তরা ঠাকুর ঘরে৷ এর মাঝে যিশু এসে একবার উঁকি দিয়ে গেল৷

-ও মা তোমার পুজো হোল ? প্রসাদ দেবে না?

যিশু, ছুটির দিনগুলোতে পারলে বিছানায় গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকে৷ঠিক যেন বেড়াল ছানা । শুধু লেজটাই নেই আরকি৷ এখানে পরমেশের প্রশ্রয় পায় যিশু৷ সাধারণত সংসারের কোনো কাজ পরমেশের জমে না৷ তার এই সংসারের প্রতি উদাসীনতা ছোট শিশু যিশু কেও স্পর্শ করে৷ সেটা পরমেশ বোঝে না৷ শাশুড়ী মা জীবিত থাকতে বলতেন --

- মা অন্তরা৷এটাতো ওদের বংশে৷ ভয় পাসনি মা৷ নিজেকে শক্ত কর৷.আমিও করেছি৷ তুই একা নোস৷ এটাই বোধ হয় জীবনের খেলা৷ মনের সঙ্গে খেলা৷ মন শক্ত কর৷

যিশুকে ঘিরেই সমস্ত স্বপ্ন রোজকার বেলার মতো আবর্তে ঘুরেছে৷গড়ে উঠেছে তার এক আবাসিক অস্তিত্ব৷ কোনো এক দুর্বল মুহুর্তে পরমেশকে জিগ্যেস করেছিল অন্তরা

-যিশু কে নিয়ে তোমার কোনো স্বপ্ন নেই?

ম্যাগাজিনের পাতা থেকে চোখ তুলে নীরবে হেসে বলেছিল পরমেশ

-দেখ অন্তরা, আমার নিজের কোনো স্বপ্ন সফল হয় নি৷ তাই কারো জন্য স্বপ্ন দেখি না, বরং বলি , ভয় পাই আমি৷ হতে চেয়েছিলাম কত কি৷ বিদেশ যাব৷.ডলারে টাকা ইনকাম করব৷ তা না হতে পেরে হলাম গিয়ে একটা ব্লকের বি ডি ও কেরানি ৷ যার না আছে কোনো আশা না ভরসা৷ রোজকার এই না পাওয়া মরার মাঝে আবার স্বপ্ন দেখে নতুন করে মরব নাকি কারো জন্যে৷

অন্তরা লক্ষ করলো৷.কথাটা বলে পরমেশ টবিলে রাখা যিশুর ফটোটার দিকে কেমন করে যেন চেয়ে রইলো৷

- তুমি কি স্বপ্ন দেখ অন্তরা, যিশু কে নিয়ে ? পরমেশ পাল্টা বলেছিল৷

অন্তরা আর উত্তর করেনি৷পরমেশের হাত থেকে শেষ হয়ে যাওয়া চায়ের কাপটা নিয়ে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেছে৷ জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দেখে নেয়৷যিশু খেলছে ঝিলের পাশের মাঠটাতে৷ যিশু বেশ রাজা সেজেছে৷

ঠাকুর ঘরে আজ অনেক্ষণ কাটাল অন্তরা৷ আলমারিতে বাসন গুলো সাজিয়ে রাখতে যাছিল৷ পেছন থেকে হঠাত যিশু এসে জড়িয়ে ধরলো৷ ছুটির দিনের আবদার৷অন্তরা বুঝতে পারল৷

পেছন ফিরে দেখে যিশুর মুখ ভর্তি ঘাম..জামাটাও প্রায় ভেজা৷

- হ্যাঁ রে যিশু৷এত ঘামছিস কেন? শরীর খারাপ নয় তো৷

- ও কিছু না মা৷ এত গরম পড়েছে তাই৷ ও মা শোনো না৷.ইস্কুলের মাঠে ক্লাস টেন'এর পিনাকিদা অবিরাম সাইকেল চালাচ্ছে ২৮ ঘন্টা ধরে৷ আগের বাদলদার ২৭ ঘন্টার রেকর্ড ভাঙবে বলে৷ ও মা , ওই যে শুনছো না মাইকে গান বেজে চলেছে৷বলতে বলতে জুতো হাতে নিয়ে এক দৌড় লাগালো যিশু৷দূর থেকে বলল--

-মা দুপুরে খেতে আসব৷ আজকে তো তুমি মাংস রাঁধবে বলেছিলে৷ তোমায় সব দেখে এসে পরে বলবো মা৷

খবরটা যখন এলো তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে৷ যিশুর ক্লাসমেট সুনিত প্রায় কাঁধে করে যিশু কে বাড়ি পৌছে দিলো৷ পেটের যন্ত্রণায় যিশুর মুখ কালো হয়ে আছে৷ শরীর কেমন বার বার কুঁকড়ে যাচ্ছে৷ কোলে টেনে নিতে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল যিশু--

-ও মা আর তোমার অবাধ্য হবো না৷ আমায় ভালো করে দাও মা৷ তুমি যেমন বলবে আমি তেমন হবো মা৷

বাড়িতে কেউ নেই ! পরমেশ ছুটির দিনে তাস পেটাতে গেছে বন্ধুদের সাথে৷ হাসপাতালে অন্তরা নিয়ে গেল একা৷ পাশের ফ্লাটের অর্ক'র বাবাকে রিকোয়েস্ট করলো একটু পরমেশকে খবর দিতে৷

পরমেশ যখন খবর পেয়ে এলো যিশু তখন ঘুমের ইন্জেকশনে ঘুমাচ্ছে৷ পরমেশ দেখে , মাথাটা বালিশের একপাশে হেলে পড়েছে৷ আস্তে করে সোজা করে দিলো পরমেশ যিশুর মাথাটা৷ সারা মুখটা কেমন কালচে হয়ে আছে৷

অন্তরা ডাক্তারের কাছে পরমর্শের জন্য গিয়েছিল৷ ফিরে এসে দেখে পরমেশ এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে যিশুর মুখের দিকে বেডের পাশে দাঁড়িয়ে৷

নিবিষ্ট মনে বড় পরমেশ দেখছে ছোট পরমেশকে৷ কেন জানি সমস্ত স্বপ্ন ভাঙ্গার কারণগুলো একসঙ্গে যেন প্রতিবাদ করে উঠলো পরমেশের ভেতরে৷ তবে কি এই স্বপ্ন দেখার স্বপ্নটাও তার ভেঙ্গে যাবে ? কি একটা ভয়ের আতঙ্ক নিয়ে দ্রুত সে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো ! পাগলা ঘোড়ার মতো মনটাকে ছুটিয়ে শেষ এক চাঙ্গর হাওয়া ফুসফুসে ভরে নিয়ে বাঁধের দক্ষিণ দিকে স্লুইস গেটের রেলিং'এ বসলো পরমেশ৷ তার একদা প্রিয় নদী করতোয়া’র দিকে তাকাতেও যেন ভয় পেল৷.কি জানি করতোয়া নদীর জল’ও যদি শুকিয়ে যায় তার মতো কিছু না পাওয়া মানুষের দৃষ্টিতে৷ ভেতরে ভেতরে একটা সুপ্ত পরমেশ যেন ছোট্ট পরমেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল৷

যিশুকে যখন অপারেশন থিয়েটারের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, .পরমেশ উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে ছুটে এলো৷ ডাক্তার মজুমদার ভ্রু কুঁচকে দেখলেন এই পাগলের মতো লোকটাকে৷ অন্তরা বললে, পরমেশ চক্রবর্তী৷.যিশুর বাবা৷

-ডাক্তার মজুমদার৷অস্ফুট উচ্চারণ করল পরমেশ৷

-ইয়েস৷পরমেশ বাবু৷

- .আমাদের মানে আমাকে কি অপারেসন থিয়েটারে থাকতে দেবেন ?

- না না তা হয় না পরমেশবাবু৷ এরকম নিয়ম তো নেই আমাদের৷

পরমেশের এই মানসিক অস্হিরতায় অন্তরাও স্তব্ধ হয়ে রইলো৷ এ কোন পরমেশ? মধ্যবিত্তের সমস্ত আশা ভঙ্গের নজীর পোড় খাওয়া উদাসীনতার ব্যাকুল পরমেশ৷ তা হলে যিশুর জন্য সে একা নয়৷

অন্তরার ভেতর এবার কেমন টিপ বাঁধা জল ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল তার সমস্ত সত্বাকে ! মার্জনা চাইবার লজ্জা হারিয়ে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলো৷ও'টির লাল আলোটা নিভে গেল হঠাৎ ! দরজা খুলে ডাক্তার মজুমদার বেড়িয়ে এলেন৷.পরমেশ আবার ছুটে এলো ! ডাক্তার একবার তাকালেন পরমেশের দিকে

- Don’t worry ...everything is alright৷যিশু খুব ভালো আছে৷ ঘন্টা তিনেক বাদে দেখা করতে পারেন৷ প্লিজ এখন যেন ডিস্টার্ব করবেন না৷

যিশুর বেডটা দুটো মেল নার্স আস্তে আস্তে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল কেবিনের দিকে৷.পরমেশ ঝুঁকে পড়ল যিশুর মুখের কাছে! স্পষ্ট অথচ অস্ফুট উচারণ করে বলল পরমেশ

-ভালো হয়ে ওঠ রে বাবা তাড়াতাড়ি৷ভালো হয়ে তোর মার মতো হোস যিশু৷ আমার এই আশা ভঙ্গের কপাল যেন তোর কপালে না লাগে বাবা৷ভালো হয়ে যা৷ভালো হয়ে যা....

আরো কিছু যেন বলতে যাচ্ছিল পরমেশ৷ নার্স দুটো যিশুকে তখন অনেকটা দূর ঠেলে নিয়ে গ্যাছে৷ এবার অন্তরার দিকে তাকালো একবার পরমেশ৷

ওর উদ্ভ্রান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে অন্তরার এতক্ষণ টিপ বাঁধা জল উপচে পড়ল অঝোরে৷ সমস্ত পরিবেশ ভুলে গিয়ে সে পরমেশকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে নীরবে৷ মনের ভেতরে এক কথা গুমড়ে গুমড়ে বেজে গেল তার৷

-ক্ষমা করো পরমেশ৷ক্ষমা করো আমায়৷

ওদের পাশ দিয়ে দুটো ফিমেল নার্স নতুন রুগী কে নিয়ে আবার ও'টির ভেতরে ঢুকে গেল৷

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন