বাংলা দেশের সাহিত্য ক্ষেত্র
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চোখে
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গেলেন । চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রটিকে এক বিশাল শূণ্যতায় ঢেকে দিয়ে । আমরা জানি একজন প্রকৃত শ্রষ্টা নব নব ভাবে আবিস্কৃত হন তাঁর মৃত্যুর পর । রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল , জীবনানন্দের ক্ষেত্রেও । সংশয় নেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও নব নব ভাবে আবিস্কৃত হবেন । সুনীলের মৃত্যু সংবাদ প্রচারে কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের ঘোষক তাঁকে ‘কথা সাহিত্যিক’ বলে উল্লেখ করায় এক তরুণ কবি আহত হয়েছিলেন, কেন তাকে ‘কবি’ বলে উল্লেখ করা হ’লনা এই ভেবে । এই আবেগ থেকে বুঝতে পারি তরুণ প্রজন্মের কাব্যকারদের কাছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কতটা আশ্রয়ের মত ছিলেন ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কত বড় কবি ছিলেন, কতবড় কথাকার ছিলেন, সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন যেমন বলেছেন ‘সুনীল অন্য ভাষায় লিখলে নোবেল পুরস্কার পেতেন’ কিংবা আতাহার খান যেমন বলেছেন ‘রবীন্দ্রনাথের পর এতো বড় সাহিত্যিক আর আসেন নি’, এই সবের মূল্যায়ন হতেই থাকবে , অন্য মতও পোষণ করতে পারেন কেউ কেউ । কিন্তু এই উচ্চারণে তো কোন সংশয়ের যায়গা নেই যে দুই বাংলায় এবং বিশ্বের যে প্রান্তেই বাঙালি মনন সেখানেই সুনীল এক পরিপূর্ণ আধুনিক মানুষ, ধর্ম নিরপেক্ষ যুক্তিবাদী মানুষ , বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মহীরুহ সম অভিভাবক, এবং তরুণ প্রজন্মের লেখকদের আশ্রয় হয়েই ছিলেন। না, সুনীল কোন বাংলাভাষী বিশেষ ভূখন্ডের মানুষ ছিলেন না । ‘পশ্চিমবঙ্গ’ ও ‘বাংলা দেশ’ দুটি পৃথক ভৌগোলিক ভূখন্ড মাত্র, বাংলা ভাষা ও বাঙালি মনন এই ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সীমানায় আটকে থাকেনি কোনদিন । তাই এপারের মত ওপার বাংলাতেও সমান জনপ্রিয় প্রয়াত কথাকার । আমার ধারণা তাঁর পাঠক সংখ্যা এখন এপারের চেয়ে ওপারেই বেশি , কারণ আমার মত অনেকেরই সংশয় নেই যে এখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশেষত কাব্য-চর্চার ক্ষেত্রটি এপারের চেয়ে ওপারেই বেশি গতিশীল ও সমৃদ্ধ ।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি লেখায় ‘পশ্চিমবঙ্গ পাবলিসার্শ এন্ড বুক সেলার্স গিল্ড’এর সম্পাদক ত্রিদীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন (‘আজকাল’ ২৬ অক্টোবর) “যেটুকু হিসাব পেয়েছি, তাতে দেখা যাচ্ছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইএর বিক্রি বছরে দুই কোটি টাকারও বেশি । আমি শুধু বাংলা ভাষায় এবং ভারতীয় এডিশনের কথা বলছি । এর সঙ্গে বাংলা দেশ সংস্করণ – বৈধ ও অবৈধ যদি ধরা হয় তবে তার অঙ্ক বোধয় পাঁচ কোটি ছাড়িয়ে যাবে” । তাহলে দেখা যাচ্ছে ওপারের বাঙালি পাঠকদের কাছে তার বইএর কি বিপুল চাহিদা – টাকার অঙ্কে তিন কোটিরও বেশি, এপারের চেয়েও বেশি । ওপারে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রটি গতিশীল, সমৃদ্ধ ও উদার নাহলে কি এটা কি সম্ভব হ’ত ?
বাংলাদেশের মানুষ ও সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক শুধুমাত্র এই জন্য নয় যে তিনি ফরিদপুরের ভূমি পুত্র ছিলেন। ওপারে সুনীলের জনপ্রিয়তা, বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চা বা ওদেশের মানুষকে নিবিড়ভাবে চেনার পেছনে ছিল বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর মমত্ব ও বাঙ্গালি জাতিসত্বার প্রতি তীব্র আবেগ । এপারে বাংলা ভাষার সঙ্গে আমাদের ক্রম অনাত্মীয়তা আমাদের ব্যথিত করে । তবুও এপারের বাঙ্গালির শান্তনা এই যে ‘বাঙ্গালি জাতিসত্বা’ আর তার ভাষার স্থায়ী ঠিকানা রয়েছে ওপারে। এই বাংলায় – বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে তিনি পথে নেমেছেন, ‘বাংলাবাজ’ বলে লাঞ্ছিত হয়েছেন এ আমাদের জানা । ১৯৭১এ লেখা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সেই কবিতার শেষ পংক্তিটা মনে পড়ে “আমাদের এক নজরুল, এক রবীন্দ্রনাথ । আমরা ভাষায় এক, ভালোবাসায় এক”। উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের ইতিহাস থেকে উপাদান নিয়ে নিনি লিখেছিলেন ‘সেই সময়’, তেমনই দেশ বিভাগের যন্ত্রণার ইতিহাস থেকে উপাদান নিয়ে রচনা করেছেন পুব-পশ্চিম’।
ওপারের বাঙ্গালিদের নিজ মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার কথা প্রয়াত কথাকার আমাদের জানিয়েছেন তাঁর অনেক লেখায় । ‘দেশ’ পত্রিকার ভাষা দিবস সংখ্যায় (১৯৯৮, ২১শে ফেব্রুয়ারি) লিখেছিলেন “বাংলা দেশের ছেলেরা প্রবাসে গিয়ে যখন অনেক কষ্ট করে গ্রাসাচ্ছাদন চালায়, তখনও কিন্তু তারা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ভোলেনা । ... নিজেরাই ভাত ডাল ফুটিয়ে খায়, তবু তাদের বাংলা বই পড়া চাইই”এই নিবন্ধে তিনি আর একটি প্রণিধান যোগ্য মন্তব্য করেছিলেন “...কিছুকাল পরে ঢাকাই হবে বাংলা সাহিত্য প্রকাশনা এবং সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র”। এপারের আমরা ওপারের সাহিত্য পড়ি খুব কম । ওপারের বাংলা সাহিত্য এবং তার গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে নিবিড় অধ্যয়ন না থাকলে এমন মন্তব্য করা যায়না ।
ওপারের সাহিত্য ক্ষেত্রটি আমি বুঝতে চাইবো প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাতেই । সুনীল লিখেছেন –
“গত নব্বই-একানব্বই সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ নিবাসী লেখকের গদ্য সাহিত্যের সঙ্গে আমার মোটামুটি পরিচয় আছে । সৈয়দ ওয়ালিউল্লার ‘লাল শালু’ আমার মতে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কয়েকটি উপন্যাসের অন্যতম । বর্ষীয়ান সওকত ওসমান আমার প্রয় লেখক । আবু ইসহাক’এর সূর্য দীঘল বাড়ি’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম ।
বাংলা দেশের উপন্যাসের ধারাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় । একদিকে আছেন হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও সেলিনা হোসেনের মত লেখকরা । এরা জীবনকে গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করেন, সামাজিক অবক্ষয় ও শ্রেণী বৈষম্য এদের প্রধান বিষয়বস্তু , ব্যক্তির বদলে সমষ্টিই এঁদের লক্ষ্য । হাসান আজিজুল হক পশ্চিম বাংলাতেও বিশেষ পরিচিত , কিন্তু তিনি লেখেন খুবই কম । আখতারুজ্জামান’এর ‘চিলে কোঠার শেপাই’ ও ‘খোয়াব নামা’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিখ্যাত হয়েছে । কিন্তু তাঁর ভাষা বিশেষত শেষ গ্রন্থটিতে অকারণ জটিল এবং নীরস । এই লেখকের অকাল মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের পক্ষে অপূরনীয় ক্ষতি । সেলিনা হোসেন গ্রাম বাংলার জীবনের যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরেছেন, ইদানিং তার তুল্য রচনা বিশেষ পাওয়া যায় না ।
অন্য ধারার প্রতিনিধি হুনায়ুন আহমেদ এবং ইমদাদুল হক মিলন । এঁদের ভাষা স্বচ্ছ ও সাবলীল । চলমান জীবন থেকে আহরণ করেন কাহিনি । মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, তাদের আকাঙ্খা, আবেগ , বেদনা ও হর্ষের চিত্র পাঠককে মুগ্ধ করে রাখে । অনেককাল আগে হুমায়ুন আহমেদ যখন অল্প পরিচিত প্রতিশ্রুতিমান তরুণ লেখক, তখন তাঁর ‘নন্দিত নরক’ নামে উপন্যাসটি সম্পর্কে আমি ‘দেশ’পত্রিকায় লিখেছিলাম । তাঁর ভাষা ও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে মুগ্ধ করেছিল । এখনকার হুমায়ুন আহমেদ (হুমায়ুন আহমেদ প্রয়াত হয়েছেন গত জুলাইএ) জনপ্রিয়তার রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন বলা যায় । হুমায়ুন আহমেদ সর্বকালের বাংলা ভাষার জনপ্রিয়তম লেখক, তাঁর এক একটি বইএর বিক্রির সংখ্যা শরৎচন্দ্রের চেয়েও বেশি । ইমদাদুল হক মিলন অতি অল্প বয়স থেকেই পাঠকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছেন, এখনও তিনি বয়সে তরুণ । তাঁর সহজ ও কাব্যময় ভাষা প্রথম থেকেই মনোযোগ দাবি করে । গ্রাম ও শহর যে-কোনও পটভূমিকাতেই তিনি কাহিনী নির্মাণ করতে পারেন, যেমন আবেগময় প্রণয় কাহিনী, তেমনই জীবনের নিষ্ঠুর দিক ফুটিয়ে তুলতেও সিদ্ধহস্ত” ।
সদ্যপ্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই পর্যবেক্ষণ থেকে বাংলা দেশের সাম্প্রতিক সাহিত্য সম্পর্কে, অসম্পূর্ণ হলেও একটা ধারণা পাওয়া যায়, যা নবীন লেখকদের মনোযোগ আকর্ষণ করবে । বাংলা ভাষার তরুণ লেখকদের কাছে সুনীল ছিলেন এক পরম ভরসার যায়গা । দুই বাংলা তো বটেই, দেশ-বিদেশের সাহিত্যের অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণ, তাঁর নিরপেক্ষ ও উদার মতপ্রকাশ, তরুণ লেখদের উৎসাহ দানে তাঁর অকৃপণতা তাঁকে সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের অভিভাবক’এর সম্মান দিয়েছিল।
ওপার বাংলার সাম্প্রতিক সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর এই পর্যবেক্ষণ ছিল নবীন প্রজন্মের লেখিকা নাসরীন জাহানের ‘সোনালি মুখোশ’ উপন্যাসের আলোচনা প্রসঙ্গে । এবং লেখটি শুধুমাত্র একটা বইএর নিয়ম মাফিক আলোচনা ছিলনা । দেশ পত্রিকার ১৯৯৮এর কলকাতা পুস্তক মেলা সংখ্যাটি সাজানো হয়েছিল ‘অধ্যয়ন প্রিয় চোদ্দোজন বাঙালি এবছর কোন বই পড়েছেন’ তার বিবরণ হিসাবে । অধ্যয়ন প্রিয় সুনীল বেছে নিয়েছিলেন তরুণ প্রজন্মের লেখিকা নাসরীন জাহা্ন আর তাঁর ‘সোনালি মুখোশ’ বইটিকে , আর অকপটে একথা বলতেও কুন্ঠিত হননি যে “সমগ্র বাংলা সাহিত্যে নাসরীন নিজস্ব স্থান দখল করার জন্য এসেছেন । পশ্চিম বাংলার পাঠিকরা যদি এঁর লেখা না পড়েন, তাহলে নিজেরাই বঞ্চিত হবেন” । এই হ’ল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অভিভাবকত্বের কথা ।
ধর্ম নিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী মনের ঐশ্বর্য নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেকে কখনোই শুধুমাত্র এপার বাংলার সাহিত্যিক মনে করেননি । বস্তুত, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ‘কে এপার-ওপার’ ভাগ করা তিনি ঠিক বলে মনে করতেন না, অন্যথা হলে তিনি তা স্মরণ করিয়েও দিতেন । এই আলোচনা প্রসঙ্গেই তিনি লিখেছিলেন “হাসান আজিজুল হক এক যায়গায় লিখেছেন “(পশ্চিমবঙ্গে) বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক সাহিত্যের উৎকর্ষ অপকর্ষ আলোচনার সময় এমন একটা অনপেক্ষ ও চূড়ান্ত মনোভাব দেখতে পাওয়া যায়, যাতে বোঝা যায় যে সগ্র বাংলা সাহিত্য বলতে কেবল মাত্র পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যকেই বোঝায় । ঠিকই লিখেছেন । আবার বাংলা দেশের পত্র-পত্রিকাতেও দেখতে পাই,যদিও সেখানেপশ্চিম বাংলায় রচিত সাহিত্য যথেষ্ঠই পড়া হয়, তবু সাহিত্যের ইতিহাস ধর্মী রচনায় শুধুমাত্র বাংলা দেশের সাহিত্য ধারারই উল্লেখ থাকে । আমি অন্তত এখনও , যে যেখানে বসেই বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করুন না কেন, তা সমগ্র বাংলা সাহিত্যের অন্তর্গত মনে করি”
এই ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এপার-ওপারের সীমানা তুচ্ছ করতে পেরেছিলেন, আমাদের তুচ্ছ করতে শিখিয়েছিলেন ।