সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

মঙ্গলবার, ২০ নভেম্বর, ২০১২

সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা

সম্পাদকের কলম থেকে

আবার বেরোল আপনাদের প্রিয় ব্লগজিন ‘সৌকর্য’।

সুনীল গাঙ্গুলী রবীন্দ্রোত্তর যুগে বাংলা সাহিত্যে একটি প্রবাদ-প্রতিম নাম। নবমীর ভোরে তিনি একটি অসমাপ্ত বিজয়া সেরে চলে গিয়েছেন।যা আর কোনদিন ‘আসছে বছর আবার হবে’ না। আমরা এবার তাঁর চলে যাওয়াকে (যদিও আমরা মনে করি, তিনি আমাদের সাথেই আছেন) স্মরণে রেখে ব্লগজিনের একটি অংশ তাঁর নামে উৎসর্গ করেছি। এই সংখ্যাকে আমরা সাজিয়েছি আগেরবারের চেয়ে আরও একটু চিত্তাকর্ষক করে। এবার আছে গল্প, রম্যরচনা, প্রবন্ধ ও বেশ কিছু কবির কবিতা।

এই সংখ্যাটি যেহেতু একটি বিশেষ সংখ্যা, তাই আমরা আমাদের ব্লগজিনের যে মূল উদ্দেশ্য, অপরিচিত অথচ শক্তিমান কোন একজন কবিকে বিশেষ ভাবে তুলে ধরা, সেটি এইবার করিনি। সাধারণ সংখ্যাতে আমরা তাই পালন করব। তবে, আমরা, এবার বহু নতুন কবির ও সাহিত্যিকের লেখাকে অগ্রাধিকার দিয়েছি, প্রতিষ্ঠিতদের পরিবর্তে। আমরা আশা রাখি, প্রত্যেকের লেখাই আপনাদের ভালো লাগবে।

এইবার, আমরা পত্রিকাটিকে দুটি বিভাগে সাজিয়েছি, একটি সুনীলবাবুর উপর, সুনীল গাঙ্গুলীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে, অপরটি অন্যান্য, যেখানে স্থান পেয়েছে, নবীন কবি ও লেখকদের লেখা। আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি, নির্ভুল ভাবে ব্লগজিনটিকে উপস্থাপন করতে, তা সত্তেও ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতেই পারে, সেটুকু নিজগুণে মার্জণীয়।

প্রতি পাঠক-পাঠিকাকে আমাদের পক্ষ থেকে অনুরোধ, তাঁরা নিজেরা পড়ুন ও সাহিত্যপ্রেমী মানুষকে পড়ান, প্রত্যেকের মূল্যবান মতামত আমাদের কাছে শিরোধার্য, কারণ আমরা মনে করি, প্রকাশ হবার পর , ব্লগজিনের অধিকার তাঁদের, তাঁরা প্রত্যেকেই আমাদের কাছে সম্মানীয়।

সৌকর্য সকলের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠুক।

ধন্যবাদান্তে,
বৈজয়ন্ত রাহা, সম্পাদক

শ্রীশুভ্র

নীললোহিতের জগৎ থেকে নীরার ভূবন


রবীন্দ্রউত্তর কালের বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক চলে গেলেন মহাপ্রস্থানের পথে! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই যাত্রায় তাঁকে একাই এগোতে হল!  কয়েকজনকে নিয়ে নয়, একাই তিনি কিংবদন্তী হয়ে রইলেন বাংলার লেখালিখির ইতিহাসে। অনেকেই এই চলে যাওয়াকে বলছেন ইন্দ্রপতন! অপূরনীয় ক্ষতি মনে করে শোকার্ত অধিকাংশ! কিন্তু লেখক আসেন, লেখক যান! রয়ে যায় তাঁর সৃষ্টি! কালের কষ্টি পাথরের চৌহদ্দীতে! সেই চৌহদ্দী পেড়িয়ে অনেকেই শতাব্দী পাড় হন না! যাঁরা হন তারা ছাড়িয়ে যান অন্যান্যদের! শতবর্ষ পড়েও রবীন্দ্রনাথের মতো সুনীল প্রাসঙ্গিক থাকবেন কিনা সেটা ভাবীকাল বলবে! সুনীল যদিও সেটা নিয়ে ভাবিত ছিলেন না কোনোদিন!

সুনীল কোনোদিনও ভাবীকালের দিকে তাকিয়ে লেখেননি! তাঁর সময়কে তাঁর লেখার মধ্যে ধরার প্রয়াস ছিল তাঁর! যে নাগরিক জীবন বাস্তবতায় স্বাধীনতা উত্তর বাঙালির জীবন পরিব্যাপ্ত হয়ে চলেছে, সুনীল টের পেয়েছিলেন তার নাড়ির স্পন্দন! সেই স্পন্দনকেই বিম্বিত করলেন তাঁর লেখনীর জাদুতে! বিশেষ করে গ্রাম বাংলার ঘেরাটোপ পেড়িয়ে ক্রমাগত শহরমুখী নাগরিক বাংলার এই যুগান্তরের মানসিকতাকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ঠিক সময়মত! এবং নন্দিত হলেন পাঠকের বরমাল্যে! সুনীলসাহিত্য সেই নাগরিক জীবনের সপ্রতিভ মানসের সমৃদ্ধ প্রতিফলন! বাঙালি পাঠকের বিমুগ্ধতায় তাই অর্জন করলেন অফুরান ভালোবাসা!

যে কোনো বড়োমাপের সাহিত্যিক খুব অল্প সময়েই তাঁর নিজস্ব একটি ধারা সৃষ্টি করে তোলেন! সেই ধারারই ভক্ত হয়ে পড়ে একটা নির্দিষ্ট পাঠক শ্রেণী।এবং দিনে দিনে যার কলেবর বাড়তেই থাকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য জীবনেও ঠিক তাই হয়েছে। এই যে আধুনিক নাগরিক জীবন বাস্তবতায় আবর্তিত রোজকার জীবন, সেই জীবনের বিশ্বস্ত রূপকার সুনীল! ফলে তাঁর সাহিত্যে পাঠক তার চেনা জানা প্রতিদিনের জীবনের অনুষঙ্গগুলি খুব স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করতে পারে। বাংলার পাঠক তাই তাঁর সাবলীল লেখনীর পরতে পরতে আবিষ্কার করল বহমান সময়ের প্রতিদিনের কথোপকথন থেকে উঠে আসা জীবন অভিজ্ঞতার বিশ্বস্ত অনুলিখন। পাঠক পেল লেখকের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখালিখি শুরু দেশের এক বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণে! সদ্য স্বাধীন দেশ! দূর্বল অর্থনীতি! দেশভাগের কারণে ছিন্নমূল মানুষের জীবন সংগ্রাম! জীবিকা সঙ্কট! তীব্র খাদ্য সঙ্কট! সদ্যজাত গণতন্ত্র তখনো আঁতুর ঘরে। চারিদিকে একদিশাহীনতা। অস্পষ্ট ভবিষ্যৎ! মানুষ জীবনে স্থিতু হওয়ার জন্যে হন্যে হয়ে দৌড়াচ্ছে! কিন্তু পথের পুরো হদিশ নেই হাতের নাগালে! শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজের ভিতে ধরেছে ফাটল! একান্নবর্তী পরিবারের আশ্রয় ছেড়ে মানুষ শহরমুখী! রাবীন্দ্রিক স্থিতপ্রাজ্ঞ বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে আস্থার জল সিঞ্চন ক্রমেই দূরূহ হয়ে পড়ছে! তিরিশের কবিরাও স্থির কোনো প্রত্যয়ের নিশানা তুলতে পারছেন না!

এইরকম এক যুগ সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে তিনি এলেন! একা এবং কয়েকজন! প্রতিদিনের জীবনের সীমাবদ্ধ পরিসরটাকে ভেঙ্গে ফেলে প্রচলিত সমস্ত জীবন প্রকরণের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে অগ্রসর হলেন! শুরু হল বাংলাসাহিত্যে নবকল্লোল! শুরু হল কৃত্তিবাস যুগ! শুধু লেখার মধ্যে দিয়েই নয়, জীবনচর্চার প্রাত্যহিকতার মধ্যে দিয়েও প্রচলিত চেনা ছকের জীবন ও সাহিত্যের দিকে ছুঁড়ে দিলেন বলিষ্ঠ ও প্রত্যয়ী চ্যালেঞ্জ! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী ধ্যান ধারণায় মানুষ যখন তার পরিপার্শ্বের সমসাময়িক সামূহিক বিপর্যয়গুলিকে আর ব্যাখ্যা করতে পারচ্ছে না, অথচ চেষ্টা করে যাচ্ছে; সেই অক্ষমতার ক্ষোভ ভাষা পেয়ে গেল এই নবধারার কালাপাহাড়ী সঙ্গীতে!

আর ঠিক এইখান থেকেই শুরু হল বাংলা সাহিত্যের এক নবপর্যায়! সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন সুনীল! একদিকে তিরিশের কবিদের
প্রবল আন্তর্জাতিক মনন ও একধারে রবীন্দ্রনাথের শাশ্বত আধ্যাত্মিকতার সর্বব্যাপী প্রভাব! এইদুইয়ের মধ্যবর্তী প্রতিদিনের আটপৌরে জীবন বাস্তবতার নিবিড় কথোপকথনের পরিসর থেকে উঠে আসতে থাকল বাংলা সাহিত্যের নব প্রকরণ! শহরমুখী নাগরিক জীবনের অনুষঙ্গগুলির প্রতিফলনে প্রতিবিম্বিত হতে থাকল আধুনিক সাহিত্যের নির্যাস! আর ঠিক এইখানেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমে বাংলাসাহিত্যের পাঠক পেয়ে গেল একান্ত আপন নিবিড় এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর নিবিড়তর সঙ্গ! যে সঙ্গ রোজকার পায়ে চলা জীবনের পদধ্বনির সাথে সামঞ্জস্যে সংহত! সমৃদ্ধ!

সুনীলসাহিত্যে নাগরিক জীবনের যে বিস্তার তার পরিধিতে বাঙালি পাঠকের এক বৃহত্তর অংশ খুঁজে পেল তার প্রতিদিনের চেনাজানা পরিচিত জীবনের খণ্ড খণ্ড কাব্যগুলির অখণ্ডজীবনের এক গল্প! এবং রোজকার জীবন যাপনের আশা নিরাশার দ্বন্দ্ববিধুর প্রেম অপ্রেমের ভাষাগুলির একান্ত সহচর হয়ে উঠল তাঁর লেখনী। এই সহজআড়ম্বরহীনভাষারজাদুতেসুনীল তাঁর পাঠককে যে গল্প বলেন, তাঁর গদ্যে আর পদ্যে; সেই গল্পের সাথে পাঠক খুব সহজেই সংযোগ স্থাপন করে নেয় নিজেদের জীবনবাস্তবতার।এখানেইতাঁর এই বিপুল জনপ্রিয়তার মূল ভিত্তি! আর সেই সূত্রেই তিনি দুই বাংলার সাহিত্যমোদী পাঠককে টেনে নেন সুনীলবৃত্তে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য আবহের গভীরতম অন্তরে রয়েছে এক অম্লান উন্মুক্ত উদাসীনতা! যে উদাসীনতায় যেমন, কোনো কিছুর প্রতিই নেই কোনো উপেক্ষা বা অবহেলা! ঠিক তেমনি নেই কোনো কিছুকেই একান্তে আঁকড়ে ধরে সংকীর্ণ গণ্ডীবদ্ধ হয়ে পড়ার কোনো প্রবণতা! এইখানেই তাঁর সাহিত্যের আঁতুরেই রয়ে গেছে এক অমলিন নির্লিপ্ততা! যে নির্লিপ্ততার পথে রয়ে যায় অফুরান মুক্তির স্বাদ! আমাদের প্রতিদিনের জীবনের বাঁধাধরা প্রাত্যহিকতার ঘেরাটোপের মধ্যেই সেই মুক্তির স্বাদ নিয়ে হাজির হল নীললোহিত! যে নীললোহিত আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেকার ঘুমিয়ে থাকা নীললোহিতকে জাগিয়ে রেখেছে চারদশকের ওপর সময় ধরে! হয়ত এইখানেই তাঁর সাহিত্যিক ঋদ্ধি।

বাংলা সাহিত্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই এক মস্ত অবদান! নীললোহিত! তাঁর নীললোহিতের মধ্যে তাই বাংলার পাঠক পাঠিকা পেয়ে গেল অন্তরের অন্তরতম এক সহচরকে, যে জনঅরণ্যেরই একজন! সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এক অম্লান বন্ধু! যে ঘরোয়া হয়েও উন্মুক্ত বিশ্বপ্রাণের সাথে অনায়াস সামঞ্জস্যে সমৃদ্ধ! যার মধ্যে বিপ্লব না থাকলেও আছে স্বাধীন ব্যক্তিসত্তার নিরুচ্চার ঔদ্ধত্য! চরিত্রের সেই অনায়াস দৃঢ়তায় বাঙালি পাঠকের নয়নের মণি হয়ে উঠল তাই নীললোহিত! নীললোহিতের এই জগত, যেখানে আত্মবিসর্জনের ব্যাকুলতা নেই! আছে আত্মোপলব্দির অনায়াস প্রয়াস! যেখানে সমষ্টির মধ্যে ব্যাক্তিসত্তার একান্ত উদ্ভাসন! সেখানেই পাঠক পেয়ে গেল পরম নির্ভর।

লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও হয়ে উঠলেন পাঠক এবং প্রকাশক দুইয়েরই পরম ভরসা স্থল! দীর্ঘ চারদশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা সাহিত্যে এমন এক নির্মেদ ঋজুতা জুগিয়ে গেলেন সুনীল, যা সংবেদনশীল কিন্তু আবেগতারিত নয়! আধুনিক যুগের কণ্ঠস্বরে প্রত্যয়ী তবু ঐতিহ্যের সাথে সম্বন্ধহীন নয়! দেশীয় শিকড়ে ঋদ্ধ হয়েও আন্তর্জাতিক! এবং এইখানে তাঁর নীললোহিতের জগতের মধ্যেই তাঁর পাঠক তাঁকেই যেন নতুন করে আবিষ্কার করে নেয়! নীললোহিতের জগত থেকে নীরার ভূবনে তাদের প্রিয় লেখককে অর্দ্ধশতাব্দী ব্যাপী অনুভব করে চলেছে বাংলার পাঠক! সেই অনুভবের পরিসরেই পুষ্ট হয়েছে আধুনিক বাংলা সাহিত্য তার সুনীলায়নে।

নীড় আর নারী! পুরুষের জীবনের দুই কেন্দ্রবিন্দু! আবহমান পুরুষ সত্তা এই দুই কেন্দ্রকে ঘিরে আবর্তিত! কিন্তু সত্যিই কি নীড় আর নারী দুইটি ভিন্ন কেন্দ্র পুরুষের অনুভবী জীবন যাপনের সংগ্রাম বিক্ষুব্ধ সংশয় আর সঙ্কটে! বিশ্বাস আর প্রত্যয়ে! ভালোবাসা আর মমতায়! নাকি তা মূলত এককেন্দ্রিক অস্তিত্বের দুই ভিন্ন মুখ! পরস্পরের মধ্যে বিলীন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই এককেন্দ্রিকতাকে বেঁধে ফেললেন তাঁর নীরার মধ্যে!
সেই কেন্দ্রের অভিমুখেই নীললোহিতের বৃত্তায়ন! বৃত্তায়ন বাংলার পাঠককুলেরও! তাই নীরার জন্যে বাংলাসাহিত্যে অমরতার দাবী করতেই পারেন সুনীল! নীরার ভূবনে আবর্তিত আধুনিক বাংলার সাহিত্যমানস! হয়ত এখানেই সুনীল এক মহীরুহ।

তাই নীরার ভূবন, লেখক সুনীলের শুধু আত্মনির্মাণের পরিসরই নয়; তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তার ভরকেন্দ্রও বটে! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্যসাহিত্য এবং কাব্যসাহিত্যর অন্তর্লোকের পরিসরে নীরা বা নীললোহিত উভয় অঞ্চলেই পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে! গদ্য থেকে কাব্যে! কাব্য থেকে পদ্যে! বাংলার সাহিত্যমোদী তাঁর পাঠকবর্গও তাই নীললোহিতের জগত থেকে নীরার ভূবনে ধরে রেখেছে সমগ্র সুনীল সাহিত্যের সারাৎসার! আর সেই সূত্রেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে ওঠেন তাঁর জীবদ্দশাতেই জীবন্ত কিংবদন্তী স্বরূপ!আর এখানেই তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সমসমায়িক সাহিত্য রথীদের! বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ইতিহাসে তাই নীললোহিতের জগত থেকে নীরার ভূবন এক পরিব্যাপ্ত সত্য!

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

বাংলা দেশের সাহিত্য ক্ষেত্র
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চোখে



সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গেলেন । চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রটিকে এক বিশাল শূণ্যতায় ঢেকে দিয়ে । আমরা জানি একজন প্রকৃত শ্রষ্টা নব নব ভাবে আবিস্কৃত হন তাঁর মৃত্যুর পর । রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল , জীবনানন্দের ক্ষেত্রেও । সংশয় নেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও নব নব ভাবে আবিস্কৃত হবেন । সুনীলের মৃত্যু সংবাদ প্রচারে কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের ঘোষক তাঁকে ‘কথা সাহিত্যিক’ বলে উল্লেখ করায় এক তরুণ কবি আহত হয়েছিলেন, কেন তাকে ‘কবি’ বলে উল্লেখ করা হ’লনা এই ভেবে । এই আবেগ থেকে বুঝতে পারি তরুণ প্রজন্মের কাব্যকারদের কাছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কতটা আশ্রয়ের মত ছিলেন ।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কত বড় কবি ছিলেন, কতবড় কথাকার ছিলেন, সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন যেমন বলেছেন ‘সুনীল অন্য ভাষায় লিখলে নোবেল পুরস্কার পেতেন’ কিংবা আতাহার খান যেমন বলেছেন ‘রবীন্দ্রনাথের পর এতো বড় সাহিত্যিক আর আসেন নি’, এই সবের মূল্যায়ন হতেই থাকবে , অন্য মতও পোষণ করতে পারেন কেউ কেউ । কিন্তু এই উচ্চারণে তো কোন সংশয়ের যায়গা নেই যে দুই বাংলায় এবং বিশ্বের যে প্রান্তেই বাঙালি মনন সেখানেই সুনীল এক পরিপূর্ণ আধুনিক মানুষ, ধর্ম নিরপেক্ষ যুক্তিবাদী মানুষ , বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মহীরুহ সম অভিভাবক, এবং তরুণ প্রজন্মের লেখকদের আশ্রয় হয়েই ছিলেন। না, সুনীল কোন বাংলাভাষী বিশেষ ভূখন্ডের মানুষ ছিলেন না । ‘পশ্চিমবঙ্গ’ ও ‘বাংলা দেশ’ দুটি পৃথক ভৌগোলিক ভূখন্ড মাত্র, বাংলা ভাষা ও বাঙালি মনন এই ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সীমানায় আটকে থাকেনি কোনদিন । তাই এপারের মত ওপার বাংলাতেও সমান জনপ্রিয় প্রয়াত কথাকার । আমার ধারণা তাঁর পাঠক সংখ্যা এখন এপারের চেয়ে ওপারেই বেশি , কারণ আমার মত অনেকেরই সংশয় নেই যে এখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশেষত কাব্য-চর্চার ক্ষেত্রটি এপারের চেয়ে ওপারেই বেশি গতিশীল ও সমৃদ্ধ ।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি লেখায় ‘পশ্চিমবঙ্গ পাবলিসার্শ এন্ড বুক সেলার্স গিল্ড’এর সম্পাদক ত্রিদীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন (‘আজকাল’ ২৬ অক্টোবর) “যেটুকু হিসাব পেয়েছি, তাতে দেখা যাচ্ছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইএর বিক্রি বছরে দুই কোটি টাকারও বেশি । আমি শুধু বাংলা ভাষায় এবং ভারতীয় এডিশনের কথা বলছি । এর সঙ্গে বাংলা দেশ সংস্করণ – বৈধ ও অবৈধ যদি ধরা হয় তবে তার অঙ্ক বোধয় পাঁচ কোটি ছাড়িয়ে যাবে” । তাহলে দেখা যাচ্ছে ওপারের বাঙালি পাঠকদের কাছে তার বইএর কি বিপুল চাহিদা – টাকার অঙ্কে তিন কোটিরও বেশি, এপারের চেয়েও বেশি । ওপারে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রটি গতিশীল, সমৃদ্ধ ও উদার নাহলে কি এটা কি সম্ভব হ’ত ?

বাংলাদেশের মানুষ ও সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক শুধুমাত্র এই জন্য নয় যে তিনি ফরিদপুরের ভূমি পুত্র ছিলেন। ওপারে সুনীলের জনপ্রিয়তা, বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চা বা ওদেশের মানুষকে নিবিড়ভাবে চেনার পেছনে ছিল বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর মমত্ব ও বাঙ্গালি জাতিসত্বার প্রতি তীব্র আবেগ । এপারে বাংলা ভাষার সঙ্গে আমাদের ক্রম অনাত্মীয়তা আমাদের ব্যথিত করে । তবুও এপারের বাঙ্গালির শান্তনা এই যে ‘বাঙ্গালি জাতিসত্বা’ আর তার ভাষার স্থায়ী ঠিকানা রয়েছে ওপারে। এই বাংলায় – বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে তিনি পথে নেমেছেন, ‘বাংলাবাজ’ বলে লাঞ্ছিত হয়েছেন এ আমাদের জানা । ১৯৭১এ লেখা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সেই কবিতার শেষ পংক্তিটা মনে পড়ে “আমাদের এক নজরুল, এক রবীন্দ্রনাথ । আমরা ভাষায় এক, ভালোবাসায় এক”। উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের ইতিহাস থেকে উপাদান নিয়ে নিনি লিখেছিলেন ‘সেই সময়’, তেমনই দেশ বিভাগের যন্ত্রণার ইতিহাস থেকে উপাদান নিয়ে রচনা করেছেন পুব-পশ্চিম’।

ওপারের বাঙ্গালিদের নিজ মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার কথা প্রয়াত কথাকার আমাদের জানিয়েছেন তাঁর অনেক লেখায় । ‘দেশ’ পত্রিকার ভাষা দিবস সংখ্যায় (১৯৯৮, ২১শে ফেব্রুয়ারি) লিখেছিলেন “বাংলা দেশের ছেলেরা প্রবাসে গিয়ে যখন অনেক কষ্ট করে গ্রাসাচ্ছাদন চালায়, তখনও কিন্তু তারা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ভোলেনা । ... নিজেরাই ভাত ডাল ফুটিয়ে খায়, তবু তাদের বাংলা বই পড়া চাইই”এই নিবন্ধে তিনি আর একটি প্রণিধান যোগ্য মন্তব্য করেছিলেন “...কিছুকাল পরে ঢাকাই হবে বাংলা সাহিত্য প্রকাশনা এবং সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র”। এপারের আমরা ওপারের সাহিত্য পড়ি খুব কম । ওপারের বাংলা সাহিত্য এবং তার গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে নিবিড় অধ্যয়ন না থাকলে এমন মন্তব্য করা যায়না ।

ওপারের সাহিত্য ক্ষেত্রটি আমি বুঝতে চাইবো প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাতেই । সুনীল লিখেছেন –

“গত নব্বই-একানব্বই সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ নিবাসী লেখকের গদ্য সাহিত্যের সঙ্গে আমার মোটামুটি পরিচয় আছে । সৈয়দ ওয়ালিউল্লার ‘লাল শালু’ আমার মতে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কয়েকটি উপন্যাসের অন্যতম । বর্ষীয়ান সওকত ওসমান আমার প্রয় লেখক । আবু ইসহাক’এর সূর্য দীঘল বাড়ি’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম ।

বাংলা দেশের উপন্যাসের ধারাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় । একদিকে আছেন হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও সেলিনা হোসেনের মত লেখকরা । এরা জীবনকে গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করেন, সামাজিক অবক্ষয় ও শ্রেণী বৈষম্য এদের প্রধান বিষয়বস্তু , ব্যক্তির বদলে সমষ্টিই এঁদের লক্ষ্য । হাসান আজিজুল হক পশ্চিম বাংলাতেও বিশেষ পরিচিত , কিন্তু তিনি লেখেন খুবই কম । আখতারুজ্জামান’এর ‘চিলে কোঠার শেপাই’ ও ‘খোয়াব নামা’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিখ্যাত হয়েছে । কিন্তু তাঁর ভাষা বিশেষত শেষ গ্রন্থটিতে অকারণ জটিল এবং নীরস । এই লেখকের অকাল মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের পক্ষে অপূরনীয় ক্ষতি । সেলিনা হোসেন গ্রাম বাংলার জীবনের যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরেছেন, ইদানিং তার তুল্য রচনা বিশেষ পাওয়া যায় না ।

অন্য ধারার প্রতিনিধি হুনায়ুন আহমেদ এবং ইমদাদুল হক মিলন । এঁদের ভাষা স্বচ্ছ ও সাবলীল । চলমান জীবন থেকে আহরণ করেন কাহিনি । মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, তাদের আকাঙ্খা, আবেগ , বেদনা ও হর্ষের চিত্র পাঠককে মুগ্ধ করে রাখে । অনেককাল আগে হুমায়ুন আহমেদ যখন অল্প পরিচিত প্রতিশ্রুতিমান তরুণ লেখক, তখন তাঁর ‘নন্দিত নরক’ নামে উপন্যাসটি সম্পর্কে আমি ‘দেশ’পত্রিকায় লিখেছিলাম । তাঁর ভাষা ও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে মুগ্ধ করেছিল । এখনকার হুমায়ুন আহমেদ (হুমায়ুন আহমেদ প্রয়াত হয়েছেন গত জুলাইএ) জনপ্রিয়তার রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন বলা যায় । হুমায়ুন আহমেদ সর্বকালের বাংলা ভাষার জনপ্রিয়তম লেখক, তাঁর এক একটি বইএর বিক্রির সংখ্যা শরৎচন্দ্রের চেয়েও বেশি । ইমদাদুল হক মিলন অতি অল্প বয়স থেকেই পাঠকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছেন, এখনও তিনি বয়সে তরুণ । তাঁর সহজ ও কাব্যময় ভাষা প্রথম থেকেই মনোযোগ দাবি করে । গ্রাম ও শহর যে-কোনও পটভূমিকাতেই তিনি কাহিনী নির্মাণ করতে পারেন, যেমন আবেগময় প্রণয় কাহিনী, তেমনই জীবনের নিষ্ঠুর দিক ফুটিয়ে তুলতেও সিদ্ধহস্ত” ।

সদ্যপ্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই পর্যবেক্ষণ থেকে বাংলা দেশের সাম্প্রতিক সাহিত্য সম্পর্কে, অসম্পূর্ণ হলেও একটা ধারণা পাওয়া যায়, যা নবীন লেখকদের মনোযোগ আকর্ষণ করবে । বাংলা ভাষার তরুণ লেখকদের কাছে সুনীল ছিলেন এক পরম ভরসার যায়গা । দুই বাংলা তো বটেই, দেশ-বিদেশের সাহিত্যের অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণ, তাঁর নিরপেক্ষ ও উদার মতপ্রকাশ, তরুণ লেখদের উৎসাহ দানে তাঁর অকৃপণতা তাঁকে সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের অভিভাবক’এর সম্মান দিয়েছিল।

ওপার বাংলার সাম্প্রতিক সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর এই পর্যবেক্ষণ ছিল নবীন প্রজন্মের লেখিকা নাসরীন জাহানের ‘সোনালি মুখোশ’ উপন্যাসের আলোচনা প্রসঙ্গে । এবং লেখটি শুধুমাত্র একটা বইএর নিয়ম মাফিক আলোচনা ছিলনা । দেশ পত্রিকার ১৯৯৮এর কলকাতা পুস্তক মেলা সংখ্যাটি সাজানো হয়েছিল ‘অধ্যয়ন প্রিয় চোদ্দোজন বাঙালি এবছর কোন বই পড়েছেন’ তার বিবরণ হিসাবে । অধ্যয়ন প্রিয় সুনীল বেছে নিয়েছিলেন তরুণ প্রজন্মের লেখিকা নাসরীন জাহা্ন আর তাঁর ‘সোনালি মুখোশ’ বইটিকে , আর অকপটে একথা বলতেও কুন্ঠিত হননি যে “সমগ্র বাংলা সাহিত্যে নাসরীন নিজস্ব স্থান দখল করার জন্য এসেছেন । পশ্চিম বাংলার পাঠিকরা যদি এঁর লেখা না পড়েন, তাহলে নিজেরাই বঞ্চিত হবেন” । এই হ’ল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অভিভাবকত্বের কথা ।

ধর্ম নিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী মনের ঐশ্বর্য নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেকে কখনোই শুধুমাত্র এপার বাংলার সাহিত্যিক মনে করেননি । বস্তুত, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ‘কে এপার-ওপার’ ভাগ করা তিনি ঠিক বলে মনে করতেন না, অন্যথা হলে তিনি তা স্মরণ করিয়েও দিতেন । এই আলোচনা প্রসঙ্গেই তিনি লিখেছিলেন “হাসান আজিজুল হক এক যায়গায় লিখেছেন “(পশ্চিমবঙ্গে) বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক সাহিত্যের উৎকর্ষ অপকর্ষ আলোচনার সময় এমন একটা অনপেক্ষ ও চূড়ান্ত মনোভাব দেখতে পাওয়া যায়, যাতে বোঝা যায় যে সগ্র বাংলা সাহিত্য বলতে কেবল মাত্র পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যকেই বোঝায় । ঠিকই লিখেছেন । আবার বাংলা দেশের পত্র-পত্রিকাতেও দেখতে পাই,যদিও সেখানেপশ্চিম বাংলায় রচিত সাহিত্য যথেষ্ঠই পড়া হয়, তবু সাহিত্যের ইতিহাস ধর্মী রচনায় শুধুমাত্র বাংলা দেশের সাহিত্য ধারারই উল্লেখ থাকে । আমি অন্তত এখনও , যে যেখানে বসেই বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করুন না কেন, তা সমগ্র বাংলা সাহিত্যের অন্তর্গত মনে করি”

এই ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এপার-ওপারের সীমানা তুচ্ছ করতে পেরেছিলেন, আমাদের তুচ্ছ করতে শিখিয়েছিলেন ।

বৈজয়ন্ত রাহা

তুমি না রাখলেও, কেউ কথা রাখবেই, সুনীলবাবু


উষালগ্নে জেগে উঠি আমি, আমার শরীর,

সুবর্ণরেখায় পাড়ভাঙ্গা পদ্মাসনে,
দিদিমার ভস্মকলস, নাকি বরুণার?
চোখ বুজে ছুঁয়ে থাকি নেবানো চুল্লী, ধীরস্রোতা রুপসার ধারা,
বেতলার জঙ্গলে পিছু পিছু হাঁটি, শ্বাসরোধী কৈশোর
অমলতাসের ঘোরে চুপ---
শুধু পড়ে থাকে সাদা পৃষ্ঠা প্রতিশ্রুতিময়,
এখনও অক্ষরের জন্ম হয়নি, কুমারির মতো, নাদেরের মতো।


ইসমাইলদাদু তখনও নিয়ে আসতেন নারকেল, চাল আর ঘি,
খুব ভোরের বেলায় ভ্যান-এ চাপিয়ে তিনি ঢুকতেন আমাদের বাড়ি, সঙ্গে থাকতো সানাই--
আমাদের ঘরের পিছনের জানলার পাশে যে নারকেলগাছ,
তার মাথার উপর দিয়ে কমলা আভা ঘরে ঢুকত,
দাদু ইসমাইলদাদুকে জড়িয়ে ধরতেন,
ইসমাইলদাদু সানাই বের করে ধরতেন আজানের সুর, আর দাদু,
তালে তাল মিলিয়ে সূর্যমন্ত্র,'ওঁ, জবাকুসুম সঙ্কার্ষনং, কাশ্যপিয়ং মহাদ্যুতিং...'
সুনীলবাবু, কোথায় যেন তোমার পূর্ব-পশ্চিম এক হয়ে যেত।

মনে পড়ে,

ইস্কুল থেকে ফেরার পথে, সুরকী পথের দুধারে, কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার গল্প,
তিনবার বাঁক ঘুরে শেষবাঁকের কিনারে রাধাচূড়ার কথা--
কি হলুদ ফুল তার!!
তার নীচে দাঁড়িয়ে
আমি যেই বলেছি, 'পাগলা পাগলা...'
অমনি ট্রেনের ভেঁপু বেজে উঠেছে--আর কি ছুট ছুট---
দিকশূণ্যপুর এসে গেলো বুঝি...নামতেই হবে এবার......
সারাজীবন নীলুদা তোমার সাথে যেতে চেয়েছি ,
কখনও তুমি কথা রাখোনি, কেবলই ফাঁকি দিয়েছো,
আর দৌড়ে চলে গেছো নীরার কাছে,
যত ফস্টিনষ্টি--শুধু স্বপ্নের কথা,
যেন, আমরা কেউ স্বপ্ন দেখিনা, স্বপ্ন দেখতে জানিনা,
যেন নীরা তোমার একার,
যেন ঠোঁটে আঙ্গুল ছোঁয়াতে একা তুমিই জানো,
আজ দেখো , তোমার সাথে আমিও বিষপান করি,
শোক কুলকুচো করি, বিশুদ্ধ স্তাবকতা দিয়ে দাঁত ব্রাশ,
দক্ষিণ-শহর জুড়ে ভুবনডাঙ্গা ফেটে ফেটে পড়ে,
পাহাড়-চূড়ায় দাঁড়িয়ে
পদতলে রাখি সমূহ পৃথিবী,
আর তারস্বরে ঘোষণা করি--
সম্রটের কনিষ্ঠপুত্র, তুমি হে সুনীল-সুবাস--
কতদূর যাবে তুমি, পালাবে কোথায়?
যতই বলোনা কেন,
ও আকাশে ও মাথা আর ঠেকতেই দেবো না,
তোমার বিনাশ নেই...আগুনের মতো
বুকের ভিতর ধক ধক জ্বলে,
সেই-সময়...এই সময়;

কেউ একজন কথা রাখে ঠিক, আমি জানি,

কেউ একজন--
একেবারে শুরুর দিকে, বলে গিয়েছিল,
আসবই ফিরে,
অপেক্ষায় থেকো।
মন যখন বৃষ্টির অপেক্ষায় ছিল,
বৃষ্টি আসেনি,
শঙ্খধ্বনি দিয়ে কান্না এসেছিল,দুই চোখে...
আমি কি যুবক হবো?
যৌবন? আমি কি তোমায় চিনি, শরীরে-শরীরি...
তবু তুমি কথা রাখলেনা, সময়ের সাথে ভেসে চলে গেলে
দুঃখ ও সুখের দিনে, স্মৃতিসঙ্গিনী...
তবু,
তবু আমি জানি,
কেউ একজন কথা রাখবেই...

হে মৃত্যু, সে তুমি, শুধু তুমি।

অনুপম দাস শর্মা

অদম্য সুনীল ...


চৈত্রের কোন এক সন্ধ্যায় প্রতিপদ চাঁদে

জোৎস্না ছটফটাত যখন
শিরায় শিরায় তখন উঠতি উৎসাহে খুঁজে পাওয়া যেত
আবিষ্কারের আনন্দ।
বোধের কাঁচা জমিতে তখনও পড়েনি সমঝদারী নৈপুণ্য
তবু কৈশোরের কাব্যপ্রীতি অনায়াসে টেনে নিল
নীললোহিত কে।
জীবনদর্শনের সারল্যপ্রভা চরিত্র ব্যপ্তিতে ধরা দিত
অবিকল্প গল্প, উপন্যাসে,
হৃদয়ের দোলনায় সেদিন আলো ফুটল যখন নীরার ওষ্ঠে
প্রেমিকের আঙ্গুল স্পর্শ করালো সুনীল।

দরাজ খোলামনা মানুষটার মাথায় অবিরত পুষ্পবৃষ্টি

তবে আপামর শ্রদ্ধা ভালবাসার মোড়কে,
বাঙালীর বৈঠকখানায় সুনীলের সৃষ্টি আছড়ে পড়েছে যখনই
সমগ্র উপমহাদেশ সমৃদ্ধ হয়েছে সর্বাঙ্গে।

তবুও ছেড়ে যেতে হয় মহাকালের অটুট ডাকে,

ছড়ান টেবিলে বই খাতা কলম আর সারি সারি
বইয়ের স্তুপ নির্বিকার,
হেলান কাঠের চেয়ার তবুও দুলে ওঠে শুন্যতার হাতে
কী অসম্ভব কষ্টেও দৃশ্যমান সাহিত্যপুরুষ।

বাইরের দরজায় কেউ নাড়া দিল?

কে এলো?
বিবর্ণ মুখে কে তুমি নারী?
নীরা বলল, 'বাহান্ন তীর্থের' জলেও ভাসবে না সুনীল অস্থি।

পৃথা রায় চৌধুরী

নীল, তোমাকে...


নীল, তুমি ভাবো কিছুই বুঝি না,
তোমার অপলকে লুকিয়ে চেয়ে থাকা
সিঁড়িতে এমনি তো দাঁড়িয়ে থাকি নি
ছিলাম সেই সাতাশ বা সাঁইত্রিশের
তোমার অপেক্ষায়!

সামান্য দূরত্বের সেই সহস্র আলোকবর্ষ
চকিতে পার হয়ে আসে
তোমার কবিতার সমস্ত লাইন
যতি চিহ্ন সমেত
জানতে পারি,
তুমি টের পাও না — এদের চুম্বন মেখেই
আমি ঘুমিয়ে থাকি
এদের আদরে সোহাগেই ভোর হয়ে যায়...

আমার দুঃখের সাথে তোমার দুঃখ মেশাও
তোমার ঘোরতর স্বপ্নের ভেতরে একা আমি
আত্মঘাতী সমুদ্রে
ছোঁও আমার বাঁকা টিপ
শতাব্দীর সেই বাঁশবনে
তোমার রঙ্গিন সাবান শরীরে
হঠাৎ নীল ভয়ঙ্কর হাতের আবেগে
মনখারাপি বহুক্ষণ।

সব বুঝেছো তাই উঠে এসো
সেই অসম্ভব দূরত্ব পেরিয়ে
ব্যথাসরিৎসাগর স্পর্শ করো
পৃথিবী তোলপাড় করে চলেছে
চোখের অনেক নিচে
তোমার নীরার চোখের জল।

ঋতুপর্ণা সরকার

প্রতিবিম্ব


আমি উঠবো ব্রাহ্মমুহূর্তে।

দামোদরের পাড়ে বসে পদ্মাসনে
হাতে আমার ঠাকুমার চিতাভষ্মের কলস
চোখ বুজে ছুঁয়ে যাই ক্ষীণাস্রোতা শিতলক্ষ্যার বয়ে যাওয়া
অবিরাম অতীতের গতিতে...
আমাদের বসতবাতির কবরে গড়ে ওঠা মাদ্রাসায়
কিংবা পদ্মার পাড়ে ডালপালা মেলা বুড়ো বট
হয়ত শালুকের গন্ধ ছুঁয়ে যাবে আমায়,
অফুরান বন্যায় ডিঙ্গি করে যাতায়াত
আঁশটে গন্ধে কলার ভেলা!
ঘুরে ফিরি রমনার মাঠ , রমনার কালীবাড়ি...
মসজিদের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে
সোজা আমার বাবার ইস্কুলের দিকে,
খালি পায়ে ছুটে জাব গর্ভের সন্তান হয়ে
বঙ্গবন্ধুর বাড়ি।
আমার নিখোঁজ ঠাকুরদার ছেঁড়া খড়ম
আর খড়ের চালে পড়ে থাকা হলুদ হয়ে যাওয়া বন্সলতিকাই
যদি সম্বল
তবে আজ দামোদরের পাড়ে বসে
খুঁজে নেব আমার ঠাকুমার হারিয়ে যাওয়া বাজুবন্ধ
আর বিয়ের লাল চেলি...
তোমার পূর্ব পশ্চিমের পাতায়
সুনীলবাবু!!!

শঙ্খ ভৌমিক

Do Androids Dream?




...তারপর অনুষ্টুপ মরে গেল। কুষ্টিতে ইচ্ছামৃত্যু ছিল। ১১-১১-১১ -তে রাত বারোটার সময় ফেসবুকে স্টেটাস আপডেট করল অনুষ্টুপ- " অদ্যই শেষ রজনী"। তারপর বেডসাইড ল্যাম্প জ্বালিয়ে "Do androids dream of electric sheep " বইটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লো। ফেসবুকে অনুষ্টুপের ১৯৮৪ জন বন্ধুদের মধ্যে ২০৫০ জন এই "স্টেটাস" "লাইক" করল। কিছু চনমনে বন্ধু বিভিন্ন "কমেন্ট" করলো। যার সারমর্মে অভিনেতা রজনীকান্তের উইল থেকে রজনী নামের লাস্যময়ী নারীর সংসর্গের উল্লেখ পাওয়া গেল। সেগুলো অনুষ্টুপের স্ক্রীনসেভার ভেদ করে ওর কাছে আপেলের নতুন Apps মারফত পৌঁছেছিল ঠিক-ই, কিন্তু স্টীভ জবসের অকাল মৃত্যুতে সেটা upgrade না হওয়ায় ওর খুলি ভেদ করে ব্রেনকোষে বৈদুত্যিক তরঙ্গ সঞ্চারে ব্যর্থ হল।

অনুষ্টুপের মাঝে মধ্যেই মরে যেতে ইচ্ছে করত। সবার যেমন বেড়াতে বা ময়দানে হাওয়া খেতে যেতে ইচ্ছে করে; অনুষ্টুপের সেরকম মরে যেতে ইচ্ছা করত। খুব ছোট বয়সেই ও মা-বাবা-কে হারায়। ওর মন খারাপের মুহূর্তে স্মৃতির অন্ধকার হাতড়ে এক দুটো ফ্রে্মের বাইরে মা-বাবা সম্বন্ধে বিশেষ কিছু খুঁজে পায় নি অনুষ্টুপ। ওর কেমন যেন মনে হত যে আলাদা একটা জগৎ আছে, যেখানে সবাই যেতে পারে না, যেখানে গেলে ওর মা-বাবা সঙ্গে দেখা হবে; আরো অনেক বন্ধু হবে।

শেষ দিনে ওর কি মনে হয়েছিল, সেটা ওর দিনপঞ্জি থেকে ঠিক বোঝার উপায় নেই। অনুষ্টুপের অন্তিম দিনটা নির্বিঘ্নেই কেটেছিল। ওর গানের সিডির জন্য শেষবার আবার রেকর্ড কোম্পানীকে যোগাযোগ করেছিল। এবং একই উত্তর পায়; এখনও তোমার সময় আসে নি-মাস্তুল মজবুত কর; পাল তোল; পশ্চিম থেকে পরিবর্তনের হাওয়া লাগলেই......... অনুষ্টুপ ফোন কেটে দিয়েছিল। তারপর মাস্তুলে চড়ে নির্বিকারভাবে শহরের ধোঁয়া ঢাকা অস্তিত্ত্বহীন স্কাইলাইনের দিকে তাকিয়ে খানিকটা কোক্‌নাসিকাসেবন করে তৃপ্তি পায়। শেষ বিকেলে শহরের জ্যামজট এড়িয়ে সে এসেছিল তার মন্দিরে- গানঘরে। সেখানে দীর্ঘ অনুশীলন শেষে সে ফ্ল্যাটে ফেরে রাত করে।




একসময় শহরে সকাল হল। সূর্য উঠলো নিজের গতিতে কিন্তু কেউ দেখতে পেলো না। অন্যান্য দিনের মতন কাকের ডাক ও কুকুরের চিৎকার ক্রমশ পরিণত হল গাড়ির কর্কশ হর্ন আর মানুষের হ্রেষাধ্বনিতে। টিভিতে সেই ধ্বনি আরো জোরালো হল বিদ্যা বালানের বিকিনির আলোচনায় আর পুন্‌ম পান্ডের আন্তউন্মোচনের ভাইরাল এমএমএস-এ। এই বিষয় বাবা রামদেব থেকে আন্না হাজারে পর্যন্ত সবাইকে গনতান্ত্রিক মতামত প্রকাশের অধিকার দেওয়ার জন্য সমস্ত টিভি চ্যানেলে ভীষণ হুটোপুটি লেগে গেল।

অনুষ্টুপের ফ্ল্যাটের অন্যান্যদের এই 'বিশেষ' সকাল আলাদা কোন স্বাদ এনে দিল না। আর পাঁচটা দিনের মতন রাতের বাঞ্ছিত ও অবাঞ্ছিত রতিস্বপ্ন সেরে সবাই ছুটলো তাদের অলীক স্বপ্নের দিকে। তবে দোতলায় মিস্টার ও মিসেস কাকাতুয়ার বাড়িতে এক চাপা শোরগোল শোনা গেল। মোহনের মা হঠাৎ কাজে না আসায় তাদের দৈনন্দিন জীবনে এক হ্যাঁচকা টান লেগেছে। মলম হিসেবে বাড়িতে দুধ দিতে আসা সুবলকে খুব একচোট বকে তাকে মোহনের মা-কে ধরে আনার হুকুম দেওয়া হল। সুবলের অপরাধ বছর চারেক আগে প্রেগনেন্ট মিসেস কাকাতুয়ার বাড়িতে কাজের লোক হিসাবে মোহনের মাকে সেই জোগাড় করে দেয়। কাকাতুয়াদের সকালের রোষ এড়ানোর জন্য সুবল বাধ্য হয় কিছুক্ষণের জন্য গা ঢাকা দিতে।

কিন্ত পাড়ার মোড়ে লিচুদার দোকানে সকালের প্রথম ধোঁয়া ছাড়ার মুহুর্তে পাঁচ মণের এক থাপ্পড় এসে পড়লো সুবলের ঘাড়ে। ঘুরে দেখলো যে পাড়ার হাতি শুড় উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিতীও থাপ্পড় পড়ার আগে, সুবল কোনমতে 'এক্ষুণি আসছি' বলে আবার উলটো মুখে হাঁটলো। ওর মনে পড়ে গেল, অনুষ্টুপের কাছে মাসখানেক কোকের বকেয়া টাকা জোগাড় করতে হবে। আবার যাতে কাকাতুয়াদের মুখোমুখি না হয়, তাই সন্তর্পনে সিঁড়ি বেয়ে অনুষ্টুপের ফ্ল্যাটের দিকে উঠতে লাগলো।

একই সময় 'পাগলা' মহিমও সিঁড়ি বেয়ে অনুষ্টুপের ফ্ল্যাটের দিকে উঠছিল। যদিও শহরে আর কেউ খেয়াল করে নি, সূর্য কিন্তু এই বিশেষ দিনের ইঙ্গিত দিয়ে যায় মহিমকে। রেলব্রিজের নিচে ত্রিপল দিয়ে বানানো ওর অচিন ঘরে আজ ভোরে সূর্য এক মুহুর্ত বেশিক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ায়। মহিম চমকে জ়েগে উঠেছিল। বাইরে বেড়িয়ে গভীর নিঃশ্বাস নিয়েই বুঝতে পারলো, আজ ইথারের প্রত্যেক তরঙ্গে অনুষ্টুপ। মহিমের মন হুহু করে ওঠে। কুয়াশার গায়ে এক হাল্কা চাদর জ়রিয়ে মহিম দ্রুত বেড়িয়ে পড়ে।

মহিম অফিসিয়ালি পাগল ঘোষিত হওয়ার পর রেলব্রিজের তলায় বাসা বাঁধে। সেখানেই ও প্রথম দেখে এক তরুণ কখনো গিটার, কখনো বেহালা বা কখনো একতারা বাজিয়ে গান গাইছে। নিজের মনে। মহিমের দেখে মনে হত ছেলেটা যেন নিজের জন্যই গাইছে। ওর পাশ দিয়ে ব্যস্ত শহর চলে যেত- কেউ ওর টের পেত না। শুধু ওকে ঘিরে নাচতো হাওয়া। ওর শরীরের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে হাওয়া খেলা করতো- অনুষ্টুপ যখন খুব উঁচুতে গান ধরতো, তখন হাওয়ার কি আনন্দ- ওর চুলে বিলি কেটে দিত। মহিমের অর্থহীন সামিজিক জীবনে এটা ছিল একমাত্র সুখের সঞ্চার। এইভাবে ক্রমশ অনুষ্টপের সঙ্গে মহিমের এক অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হয়।




মহিম ও সুবল প্রায় একই সময় অনুষ্টুপের ফ্ল্যাটে পৌঁছোয়। দরজ়া অল্প খোলা। ভেতর থেকে এক অদ্ভুত আলো আসছে। আলোর এই রঙ ওরা কেউ কখনো দেখে নি। সাহস করে যখন অনুষ্টুপের শোয়ার ঘরে পৌঁছোয়ে, তখন ওরা যে দৃশ্যের মুখমুখি হয় সেটা ব্যাখা করা অসম্ভব। এক বহুতলক শুয়ে থাকা অনুষ্টপের মাথার কাছে শূণ্যে উড়ছে; তার মধ্যে থেকে যে আলো বেরোচ্ছে সেটা পুরো ঘর ভরে দিয়েছে। তার মধ্যে মহিম এবং সুবল সন্মোহিত হয় দাঁড়িয়ে থাকে- ওদের চিৎকার থেকে কোন শব্দ বেরোয় না। এই অবস্থা কতক্ষণ চলেছে কেউই ঠিক বলতে পারে নি, কিন্তু সুবলের পরিত্রাহি চিৎকারে প্রথম অনুষ্টুপের অকাল দেহধারনের কথা পৃথিবী জানতে পারে।

পুলিশ আসে; দেহ পরীক্ষা করে ডাক্তাররা জানায় মৃত্যু স্বাভাবিক। থানায় দেহ সনাক্ত করতে অনুষ্টুপের কোন আত্মীয়-বন্ধু যখন এল না, মহিম পাগলা ও সুবল শেষ কাজের জন্য অনুষ্টুপকে নিয়ে শ্মশ্বানে পৌঁছোয়। এই সব সময় খুব স্বাভাবিক কারণেই শ্মশ্বানে বৃষ্টি পড়ে। অনুষ্টুপের বডি নিয়ে ইলেকট্রিক চুল্লির সামনে অপেক্ষা করতে করতে মহিম ধ্যানস্ত হয়; কিন্তু সুবল হঠাৎ ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো। ওর কান্না ক্রমশ বাড়তে থাকায়, বিরক্ত লালকেরা অন্য মাত্রা ভেদ করে মর্তে পদার্পন করলো। একজন এগিয়ে এসে বলল, "চুপ কর শালা!" সুবল তাও ফুঁপিয়ে যেতে লাগলো। তখন টেনে এক চড় কষিয়ে লালক বলল," চুপ করবি বে! বলছি তো অনুষ্টুপ দিব্যি আছে।" এবার সুবল বাচ্চাদের মতন হাঁউমাউ করে কেঁদে বলল ,"আমার কি হবে?" লালক সুবলের হাতে এক তারা নোট গুঁজে দিয়ে বলল, " ফোট শালা! তোর কিছু হবে না!" সুবল সুর-সুর করে কেটে পড়ল। রেলব্রিজের ওপর উঠে সুবল শেষ বারের জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে শ্বশানের দিকে তাকালো। শীতের বৃষ্টিভেজা অন্ধকারেও সুবল স্পষ্ট দেখতে পেলো সেই অশরীরি আলো, যা অনুষ্টপকে ঘিরে ছিল ওর শোয়ার ঘরে। সেই আলো শ্বশান ছেড়ে আকাশে উড়ছে! আর সেই আলোয় জ্বলজ্বল করছে এক সিংহাসন- যার ওপর হাসিমুখে বসে অনুষ্টুপ- ওকে ঘিরে নাচছে লালকেরা।

উদয়ন

দ্যাশের লোক


উত্তরে যাও। আস্তে আস্তে গ্রাম-টাম ভ্যানিস হয়ে আসবে। আমাদের শহর থেকে নাক বরাবর ৩০০ কিমি উত্তরে রাস্তার ধারে শেষ একটা গ্যাস স্টেশন। চকোলেট-ক্যান্ডি-র তাকে পসরা কিছু আছে, তবে ধুলো পড়া। একটাই রেফ্রিজেটারে দুধের ক্যান কিছু, আর কোক, রুটবীয়ার, রেডবুল-এর পুরোনো ক্যান। তারিখ দেখিনি এক্সপায়ার করা কিনা। ৪০ লিটার গ্যাস ভরে, কাউন্টারে দাম চুকিয়ে এলাম। কাউন্টারের মেয়েটা ফ্রাস্টনেশন। মানে অ্যাবরিজিনাল। মানে আদিবাসি। এই গ্যাস স্টেশন থেকে বাঁদিকে রাস্তা গেছে, ওয়াস্কেসু, বনের মধ্যে লেক, তার ধারে বনভোজনের যায়গা। শহুরে মানুষ আসে, ক্যাম্পিংকরে, শিকার-টিকার করে, মাছ ধরে। মার্চ থেকে অক্টোবর। আমরা যাব আরো উত্তরে। আরো ৩০০ কিমি। কানাডা-র উত্তরের শেষ টাউন, 'লা-রঙ্গে'। তার-ও পরে আছে জল, জঙ্গল, অসমতল জলাভুমি, এস্কিমোদের জায়গা ন্যুনাভট। তারপর বাফিন বে।

তো, গ্যাসস্টেশন ছাড়িয়ে আসার কিছু পরে থেকে উঁচু-নীচু অসমতল বন-জ্‌ঙ্গল সুরু হয়ে গেল। বাঁদিকে একটা টিলা, ডানদিকে হঠাত পরিখা, হঠাত ঘন জ্‌ঙ্গল, হঠাত ঢিপির মত খোলা উঁচু জমি। এখন জুলাই মাস তাই জ্‌ঙ্গল। অক্টোবরের শেষ থেকে বরফে ঢেকে যাবে নিশ্চই। রাস্তা আর খোলা জমি চেনা যাবে না মনে হয়। রাস্তাটা মোটামুটি খারাপ নয়। মাঝে মাঝে খানা খন্দ পীচ উঠা আছে বটে, তবে এই কৌরব বর্জিত রাস্তায় এর চেয়ে ভাল আশা করা মুশকিল। কিছুদুর গিয়ে আচম্‌কা ব্‌ষ্টি। বেশ চড়া রোদ ছিলো, আধা মিনিটে ভ্যানিস হয়ে গিয়ে ব্‌ষ্টি সুরু হয়ে গেল। এমন জোরে যে, দশ ফুটিয়া সামনে সব ঝাপসা। যদিও এখন পর্যন্ত্য উলটো দিকে একটা-ও গাড়ি দেখিনি, তাও সবার টেনশনে মুখ গম্ভীর। প্রবল বিক্রমে ওয়াইপারটা সপাত সপাত করছে বটে, কিন্তু ব্‌ষ্টির যা তেজ, উইন্ডস্ক্রীন, তেমন-ই ঘোলাটে। পিতার নাম স্মরণ করতে করতে আরো তিরিশ মিনিট মতন চলার পর, হঠাত যেমন ব্‌ষ্টি এসেছিলো, তেমনি হঠাত থেমে গেল। দশ সেকেন্ডে ঝাঁঝাঁ রোদ আবার।

লা-রঙ্গে পৌঁছুতে বেলা চারটে বেজে গেল। লেকের ধারে ছোট্ট টাউন। যারা থাকে তারা সবাই মুলতঃ, ঐ, ফ্রাস্টনেশন। মানে অ্যাবরিজিনাল। মেতিস। এস্কিমো মিক্স। বাড়ী ঘরদোর যা আছে, সবই মোবাইল হোম যাকে বলে। ট্রেলারের উপর। ফাউণ্ডেশন নেই। এই শেষ একশো কিমি রাস্তা শীতে বন্ধ থাকে। বা শুধু স্নো ট্রলারের জন্য খোলা থাকে। যা লোকজন আসে, তাই এই গরম কালে-ই। লেকে ফিসিং কত্তে। বা ক্যাম্পিংএ। তাও খুবই কম। লেকের ধারে একটাই হোটেল। সেটাও ট্রেলারের উপর। সামনে কোনোরকমে পীচ বাঁধান পার্কিংলট। সামনে লা-রঙ্গে লেক। প্রায় হাজার স্কোয়ার কিমি। গ্লেসিয়ার আর আর্টিক বরপ গলা জলে তৈরী। তলদেশ অসমতল পাহাড়ি। তাই এদিক ওদিক অসংখ্য দ্বীপ মাথা বের করে আছে। হাউস বোট আছে কিছু। ভাড়া করা যায়। নিজেই চালিয়ে নিয়ে যেতে হয়। কোথাও নোঙর করে রাত কাটান যায়। এটাও একটা, ঐ, কি বলে, বড় রিক্রিয়েশন।

তো খাবার দোকান খুঁজতে গিয়ে দেখি এট্টা কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন আছে। বাপরে। আমেরিকান ফুড চেন এই গোবিন্দপুরেও ব্যবসা ফেঁদেছে। দোকানটা অবশ্য ঐ ট্রেলার হাউসের ভিতরে। কাউন্টারের মেয়েটাও ফ্রাস্টনেশন। বলল, এটা নাকি কেবল জুলাই-আগস্ট খোলা থাকে। খাবার বিশেষ কিছু ভ্যারাইট না দেখে বউ-এর পছন্দ হল না। বেরিয়ে একটু এদিক-ওদিক করে দেখি, একটা ট্রেলারের উপর লেখা 'এসিয়ান ফুড'। বলে কি ? ইয়ার্কি নাকি ? তড়িঘড়ি ঢোকা হল। মলিন কিছু চেয়ার টেবিল। টেবিলে চীনে নক্সা করা টেবিল ক্লথ, তার উপর ছেঁড়া প্লাস্টিক। দেওয়ালে পুরোনো রং। তাতে চীনে বা জাপানি পাখা পিন দিয়ে আঁটা। টেবিলে বসার পর, একজন বুড়োটে লোক, চেহারায় চীনে বা জাপানী বা ভিয়েতনামি হবে, বয়স সত্তর-ও হতে পারে আশি-ও হতে পারে, শতছিন্ন মেনু কার্ড, আর খাবার জলের জাগ নিয়ে এল। মুখটা হাসি হাসি হলেও, ঠিক হাসছে কিনা বোঝার উপায় নেই। তো, ভয়ে ভয়ে, হাক্কা চাউ, চিকেন পাইনাপেল অর্ডার দেওয়া হল। কুড়ি-পঁচিশ মিনিট সময় নিয়ে টেবিলে খাবার এসেও গেল। খেয়ে দেখলাম। মন্দ নয়। মানে চাইনিজ-এর মতন-ই চাইনিজ। আধা সেদ্ধ কিছু নয়। তো খাবার খাওয়া আর আড্ডা মারা শেষ করে শরীরটা একটু চাঙ্গা হল।

বিল দেওয়ার সময় দেখি একটা কাউন্টার মতন আছে। তার ময়লা টেবিলটপের পেছনে একটা বুড়ি। ঐ বুড়োটে লোকটার বৌ-ই হবে মনে হয়। আমাদের দেখে খুব একগাল হাসল। দাম্‌টাম দিচ্ছি, আর বুড়ি দেখি আমাদের দিকে দেখেই চলছে। মুখে মিটিমিটি হাসি। শেষে মনে হয় থাকতে না পেরে-ই বলল, 'আর ইউ ফ্রম, কালকুতা ?' আমার তো প্রায় বিষম-টিষম লেগে হেঁচকি খেয়ে টেয়ে যাতা অবস্থা। একে কানাডা-র কৌরব-বর্জিত উত্তরের গাঁ। তায় আবার চাইনীজ না ভিয়েতনামি। তায় কলিকাতা বলে এট্টা শহর আছে, তা জানে। আবার আমরা যে কলিকাতায় টিকি বাঁধা রেখে এসেছি, সেটাও বুঝে নিয়েছে ! একি কোনো ডাইন নাকি ? বাপরে। তার্পর বুড়ি শোনাল নিজের কথা। কলকাতায় জন্ম। চায়না টাউনে সম্ভবতঃ। বাবার রেস্টুরেন্ট ছিলো। ওর পনের বছরে বাবা দোকান বেচে চায়্‌না ফিরে যায়। তার্পর সেখানেই পড়াশুনা-বিয়ে ইত্যাদি। বর কোনো তেলের কোম্পানিতে ওভার্সিয়ার ছিলো। তেলের খোঁজেই কম্পানীর দলের সাথে উত্তর কানাডা আসা। ন্যুনাভট, ইক্যুলাইট। তার্পর, তেলের সন্ধান বন্ধ হয়ে গেলে, ওর বরের কোম্পানী পাত্তারি গোটালেও, ওরা থেকে-ই যায়। ঠান্ডা, বরফ আর বাফিন-বে ততদিনে ওদের মজ্জায় সেটেল করে গেছে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে, সাস্কাটুন, ক্যালগেরি, ভ্যাঙ্কুবার। ওরা বুড়ো-বুড়ি থেকেই গেছে উত্তরে। ইক্যুলাইট-এর আস্তানা ছেড়ে দিয়েছে অবশ্য। এখন এই লা-রঙ্গে। ট্রেলার হাউসে-ই থাকে সারাবছর। মাঝে মাঝে সাস্কাটুন আসে ছেলের কাছে। বা সাপ্লাইস কেনার জন্য।

একথা-সেকথার বুড়ি বলে , ছেলেবেলায় বাংলা জানত ভালই। বলতে তো পারতই, লিখতেও নাকি পারত একটু একটু। এতদিনের অনভ্যাসে বলতে ভুলেই গেছে প্রায়। কিন্তু ছেলেবেলার কান-টা জিয়ন্ত রয়ে-ই গেছে। তাই বাংলা কিছু কিছু বুঝতে পারে। নিদেনপক্ষে ধ্বনি শুনে বুঝতে পারে ভাষাটা বাংলা। সেভাবেই চিনতে পেরেছে আমাদের কুলকাতার টিকি। এখনো কালে ভদ্রে, এই যেমন ৪/৫ বছরে একবার ইন্ডিয়া যায়। কলকাতার টানে নয়। বুদ্ধগয়ায় তীর্থ করতে। পঞ্চাশ বছরের চীনে সংস্ক্‌তি, বুড়ো-বুড়ির, ধর্মবিশ্বাসে বেড়া দিতে পারেনি। তিন বছর আগে গেছিলো ইন্ডিয়া। কলকাতা-ও ঘুরেছে সেইবার। চায়ানাটাউন দেখে চিনতে পারেনি। ওর বাবার হোটেল কোথায় ছিল সেসব-ও দিশা করতে পারেনি। তবে ঘুরেছে খুব। পার্কস্ট্রীট, ধর্মতলা, বেকবাগান। এসব জায়গায় নাম করতে করতে বুড়ির চোখ চকচক করে। সত্তর বছরের প্ঞ্চাদশী কিশোরী।

আসার সময় একটা প্যাকেট দেয় বুড়ি। উপহার। বাড়ীতে বানানো কুকি। ভালই লাগে বুড়িকে। খোলমেলা। আমুদে।

গাড়ীতে উঠে, ব্যাক গিয়ার দিয়ে টার্ন নেওয়ার সময় একটু চোখ পরে সাইন বোর্ডএ । 'এসিয়ান ফুড'। বুকটা একটু টনটন করে।

হাজার হোক, দ্যাশের লোক। আমাগো।

***

সুদেষ্ণা ব্যানার্জী

অ্যামিবার মৃত্যু



তোরা


সেদিন তোদের দেখেছিলাম,

রঙীন সব রাংতা মোড়া।
খোলসের আচ্ছাদনে,মিষ্টি
হাসির শিষ্ট ঝলক।

তোদের দেখে অবাক কবি।

হয়না হয়ত অন্য কেউ!এই তোদের
দৈন্দদিন-কাগজের নৌকা স্রোতে,
জোয়ার ডাকা মেঘলা ঢেউ।।

তুই


এবার তবে তোকে বলি,সেদিন তোর

ধোঁয়াশা ছায়া,ছুঁয়েছিল আমার দামাল
ছবি।নদীর মতো স্বচ্ছ জলে,চোখে নুনের
দাঁত কপাটি।বল না,কেন,বিষাদ চোখ
ঢাকলি নিছক পাগলামিতে?কি হয়েছে?

আমি


আমিও তোর আর তোদের মতো,

রক্ত ঢাকি পায়ের চাপে।।
দিঘির ধারে বর্ণমালা,কৈশোর
মন দিয়েছে ভোকাট্টা জীবনস্রোতে।

মিলন


তোর সাথে মিলন ক্লেশে,

স্বপ্ন আঁকি কল্পনাতে।

আর তোদের কথা

বলতে গেলে?অপেক্ষা কর।
অ্যামিবারও মৃত্যু আছে।।

কচি রেজা

রেডক্রুশ



তাতারীয় ধরনের চুম্বন খুঁচিয়ে দিলো ঠোঁটের তিল,

তুমি বললে, ওভাবে নয়, এভাবে--
আমিতো ঠিক জানি, গ্রামান্তের মাঠে মাঠে সব চড়ুই
আজ ভিজে যাবে চোখের জলে,

সংসদে ফাটে দাম্ভিক হাসি, ব্যাকডো্র দিয়ে ঢুকে পড়ে
ব্যাকডেটেড পাখি, এক কবির স্মরন সভায় শুধু চিকন ফুলের মালা,
হাতবাক্সে সেধোবার আগেই শর্ট স্কার্ট দুলিয়ে হেঁটে চলে যায় তিল
কোথাও শানিয়ে ওঠা জলে,

এগিয়ে আসে লেফটেন্যান্ট
এগিয়ে আসে রেডক্রশ

পার্টিজান অফিসের এক লিষ্টিতে কিছু পাকা জাদুকরের নাম।

রোহণ কুদ্দুস

বনবাসের পরবর্তী নস্টালজিয়া



খোসা ছাড়ানো কিছু মাছি রাখা আছে ক্যানভাসে চলমান

হাতের ওপর মেলে রাখা হল অভ্যস্ত রোদাভাস অথচ
এসবের অনেক ওপর দিয়ে শরৎ ঘুরেও দেখছে না
সমগ্র বেঙ্গালুরু শহর এবং পার্শ্ববর্তী বিমানপোত

কান বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে কনফারেন্সের উচ্ছিষ্ট আর
বিরক্ত সহযাত্রীদের বোর্ডিং পাসের অর্ধেক শার্ট পিছলে
ক্রমাগত বেড়ে চলেছে ফোকাস দূরত্বের অনুরাগ এবং
কারোর হঠাৎ চলকে পড়া ঝুমকার বাসন্তী অভিযোগ

পরবর্তী কিছু নিরুদ্দিষ্ট রিলের শোকে মগ্ন হয়ে রইল
এয়ার হোস্টেসের নিরাপত্তাসূচক ঘোষণার মাইম

জুবিন ঘোষ

সিন্ধুসূচনা



হঠাৎ উড়ছে , উড়তে উড়তে কী বিশাল অক্ষ

যা দেখছে অশ্ব পৌরুষ সশব্দ, উঠছে সিন্ধুগাছ, উঠছে অগ্নি
হঠাৎ উড়ছে অবাক, অবাক দেবোত্তর সন্ধি
ওই যে বাজছে ঢাক, বাহান্নতম পীঠ
হঠাৎ বুঝেছে বলি পশুজ বৈদিক
উড়ছে যাগযজ্ঞ, উড়ছে স্বাহা সঙ্ঘ
ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় তেজ , চক্ষু সংলগ্ন
সামনে দেখি চেয়ে পেছনে কিছু নেই
সওয়ার হওয়া শ্রেয় এই গণ্ডি হাতড়েই
উড়ছে কালো তিল, অগ্নি বলে স্তব
অগ্নি বলে জল, আয় নির্মাণ আয়
অট্টহাসি খল, খলিয়ে সে হাসি, খলিয়ে পিলসুজ
আমিও দেখি দেবী তুমি দাঁড়িয়ে নির্ভুল
কী অপূর্ব সে লাল, কী অপূর্ব সে কূট
ভরিয়ে অস্পর্শা ভরিয়ে অদ্ভুত
অগ্নি বলে সর অগ্নি বলে ক্ষণ
আমার নাভীজন্ম - কবে আঁকড়ে ধরবি বল
আজকে রাতে দেবী ভারতবর্ষে চল

আমি জানি সে অগ্রজ, আমি জানি সে কুন্তল

ভোলা রায়

আগুনলতা


তোমায় জ্বালিয়ে দেওয়া আগুন

পরতে পরতে সঞ্চয় করেছ বুকের লকারে
টেবিলের উপর চিবুক ঠেকিয়ে
আতপ মেখেছ অনিমেষ কাল
জানি আরেকটা ভিসুভিয়াস কথা বলতে চায়
নিশ্চুপ সলিলে অঙ্গুরীয় দ্বীপমালা।

অথচ আমার কোন হাত ছিল না


চেনা ঘরে রেলিং বেয়ে সুর্য্য ওঠে রোজ

দেওয়ালে তবু আগুনের আধার
বলতে পার কীভাবে জ্বলো নির্নিমেষ?
ক্ষমা কর,বুঝতে পারিনি কীভাবে
ওই মেহেন্দি হাতের শিরা দিয়ে
ঘৃণার নদী ছুঁয়েছে হৃৎপিন্ডের মাটি,-পরিপটি,
উত্তুঙ্গ বিকেলে উড়ন্ত যে চুমু
ছুড়ে দিয়েছিলাম লাজুক লাজুক মুখের পাতা ওড়নায়
নীলনকশার পিরামিডে সে আজ
একফালি আধমরা ধুমকেতু।
ছায়াপথ গ্রাস করেছে করাল অপছায়া
আকন্ঠ পঙ্কিল,ক্লান্ত আমি,হে ঈশ্বর
হে দুর্বোধ্য শীতলগ্রহ

একটু বলে দেবে

দুই বিন্দুর অভিসারে
কি করে গড়ে ওঠে
আগুনলতার কোণ !

দুর্গা রায়

নির্বাণ


একটি তৃষ্ণা যেন সুস্মিত আজ

কোন স্রোতস্বিনীর কাছে তৃষ্ণার্ত অভিসার নয়
পরাভূত ভূপতিত রাত্রির মসি
তপস্বিনী হবো ? পারিজাত তৃষ্ণা ভুলে ?
বিষ সলিল স্নিগ্ধ হলেও
রানের পানীয় হবে কি?
রাকা শশী হবো নিশ্চিত
গরল সুধায় আঁকব পূর্ণ উপাখ্যান
আকাশ হারাবে নীলিমা , গোলাপ সুবাস
সমুদ্র তরঙ্গ হারা হবে
যৌবন আসক্তিহীন ধ্রুব।
অযুত বিলাপ বিসর্জন আকাশ গঙ্গায়
প্রেমে অপ্রেমে জ্বলছি আজ
আকাশ লীনা উত্তরফাল্গুনী হয়ে

একাকীত্ব আমার জারজ সন্তান...



শোভ বাবর

শৈল্পিক পাথরের ক্রীতদাস


আমার শরীর জুড়ে শৈল্পিক পাথর তুমি ভাস্কর্য করবে এসো
আমি নির্বাক হতে চাই পর্যটকের চোঁখে ,
শিল্পি তুমি হাতুড়ি ভাঙ্গো ,ক্ষুরধার চেনি চালাও
মুগ্ধ দ্বীপ নির্ভয়ে নিঃসঙ্কোচে
রক্তের শিরায় শিরায় লোলুপ নীল নক্সা মূর্তি গড়ো
তোমার জাদু স্পর্শে শকুনীর ধারালো ঠোঁট
বধ্যভূমিতে মাতৃক্রোড়ে শিশুর হৃদপিন্ড খোঁজো ,
মহামূল্যবান তৈজস শষ্যক্ষেত্রে চাষাবাদ করো সহস্রাব্দের নিষ্ঠুরতা
শিরদাঁড়াটা সোজা করে দাঁড়াও ,মুখে শেকল ভাঙ্গার পট্টি বাঁধো ।

আমার ভিতর বপন করো পাক পবিত্র বীজ ,
তুমি শিল্পীর আঁচড়ে অন্ধদৃষ্টি তুলে দাও
আমার দুটো শ্রান্ত আঁখি তন্দ্রাচ্ছন্ন বীভৎস স্বপ্ন দেখে
আমি ঘুমুতে পারি না কত ক্ষত চোখের রাত ৷
আমাকে অনুক্ষণ ক্ষত-বিক্ষত করে তোমার কবিতা ৷
ভাস্কর্যের প্রথাগত নিয়ম-নীতি ভেঙ্গে
আমাকে সুদীপ্ত কণ্ঠ দাও ,আমি তোমার প্রেমের কবিতা হবোনা ।

সেই রাতের নষ্টদের চিৎকারে দলিত তীব্র ঘৃনার প্রতিবাদ করতে চাই
আমাকে দৃষ্টি হীনতার আত্মকথনের চোখে
করুণ দৃষ্টির বাক স্বাধীনতা করে দাও
আমাকে অনাঙ্কাখিত শ্রেষ্ঠ গল্প বলতেই হবে ,এই যুদ্ধের ময়দানে ৷
আমায় একা দাঁড়িয়ে থাকতে দাও
আমাকে অহেতুক কৃষ্ণবর্ণের বীর্য দিয়ে ক্রীতদাস করোনা ৷

আমাকে অপলক দেখতে দাও শিল্পীর অনবদ্য সেই সৃষ্টি
আমি নিস্পলক অভিবাদন জানায় নির্বাক পাথরের চোঁখে
সাদাকালো নিসর্গ অস্তিত্বের অস্ফুট মোহময় ঐতিহ্যমুখীন কান্না
তোমার সেই প্রাচীন নগরের দুই পথের ফাঁকে ফাঁকে ঘন জঙ্গল
আমাকে আদিম গুহাবাসীদের কোনো ভাস্কর্য মনে করে
আনাদার অবহেলায় কোন জরাজীর্ণ পথের মোড়ে দাড়িয়ে রেখোনা ৷

পাভেল আল ইমরান

তিমির দ্রোহ

আমার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস পাঠালে তোমার রংচঙা তাঁবুর দিকে

কয়টা মাতম সামলাতে পারে ভঙ্গুর বালির বাঁধ
কতবার তুমি উঠে দাঁড়াবে আজানু তপ্ত সিকতা ফেরিয়ে
তুমি ধূলিসাৎ হবে
নিঃশ্বাসের মতো ক্লান্তিহীন ধেয়ে যাবে
কালো হতে হতে বিষাক্ত ঘূর্ণিবায়ুতে রুপান্তিত
আমার দীর্ঘশ্বাসেরা, একেকটা লড়াকু জলকোড়ার ক্ষিপ্রতায়

তুমি ধূলিসাৎ হবে

উটের পিঠের মতো তোমার উঠোনে রোদের ঝিঁঝিঁরা ডাকলেই

আমি ঝড়ের আভাস পাই
ঢুকে যাও সুনসান ঘন জঙ্গল- ঊরুতে বা ফটকহীন গুহে
সেখানে আধারের ভরা যৌবনে সঙ্গম গেঁথে দাও প্রায়শ্চিত্তে
তখন আমার বাগান- বাড়ির পদ্ম-পুকুরে ভাসাবো পানকৌড়ি

কেন এখনো চরম লোডশেডিংয়ের মাঝেও তুমি থাকো আই পি এসের

ঘ্রাণের আত্মায়
এই নাগরিক শীতের রাতেও উষ্ণ গল্প স্বামীর কম্বলে
বা বাচ্চাকে গাল টিপে ইস্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছো, উনুনে আগুন দাও
আয়নার পাশে বসা সজ্জিত কেশবাহিনী, এই সব, সব
বেদখল হবে হাসির খামার বাড়ি, রাতে ফিসফিসে কথা, আর
সকালের স্নানে ভেজা হালকা শরীর......

তছনছ করে দেবে আমার অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র দীর্ঘশ্বাসের আক্রমণে


উঠে দাড়াতেই পারবে না, তুমি ধূলিসাৎ হবে......

রূপময় ভট্টাচার্য

হেমন্তে


হেমন্তর চৌকাঠ পেরিয়ে নিঃসঙ্গ ভোর -


শেষ রাতের হিমশ্রদ্ধা নিয়ে

পাহারা দেয় কারশেড

আলো খুব চুপচাপ পা রাখল,

পা রাখল বটে কুয়াশায়

যেন প্রেমিকার গভীরে অভিযান -

ঠিক যতটা গভীরে তলালে

উষ্ণ বলা যায়;

আঁচ এবং হিম, ক্রমে ক্রমে

ঘনিষ্ঠ হয়

তারপর অভিসার ||

পৃথ্বী বোস

অনন্যা ,আবার 


অনন্যা ,

তোমাকে হয়ত চাইতাম খুব কোনো এক কালে ,
যে কাল এসেছিল কালবৈশাখীর মত ,
আবার ,যে কাল তুমি নিজেই হারালে ..
সম্পূর্ণ তুমিও দায়ী নও
এ আমার কপালের দোষ ,
দিনে -রাতে সাড়া দেয় ,আজ প্রায়
একরাশ আফসোস
আমার বুকের ভিতর ..

বিশ্বাস নাও করতে পর ,

তবু জেনে রাখো --
আমার কানের কাছে আজ ,
তোমার রেখে যাওয়া প্রতিটা আওয়াজ ,
হটাত করেই জীবন্ত --
অফুরন্ত চুম্বনের ভান্ডার ,এ শরীর
স্পর্শ করে বেঁচে থাকতে চায় ..
হায় !এই পোড়া কপালে
আজকের দিনেও তা কি সম্ভব ?

অনন্যা ,

আমি আজও অপেক্ষায় আছি -
হয়ত তোমার কাছে নেই ,
হয়ত বা তোমার 'ই কাছাকাছি ..
কে জানে ??
মনে কর ..কিছু মাস পর ,
কোনো জাদুকর ,
হটাত যদি মিলিয়ে দেয় তোমার সাথে ..
নির্জন কোনো এক বসন্তের রাতে -
অথবা বসন্তেরই কোনো এক বিকেলবেলায় --
যে অবহেলায় ,
আমাকে ফিরিয়েছিলে তুমি বহু যুগ আগে ,
সেই ভাবে ফিরিয় না আর ..
বিংশ শতাব্দী জুড়ে ,যে ভুল করেছি তুমি আমি ,
সব শেষ হোক এইবার ||

সৌরভ ভট্টাচার্য্য

অভিনয়



মুখ উল্টে দীকবাজি খাচ্ছে চাবি দেওয়া গাড়ি...

                             প্লাস্টিকের বিল্ডিং সেট,
আসেপাসের ঝুল থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছে ।
আমার আর ওদের মধ্যে একটা লম্বা ঢালু রাস্তা ।


মধ্যবর্তী—

          কাগজের ইতিহাস...কম্পাসের দিকপরিবর্তন...
গড়িয়ে আসছে বাতিল হওয়া শব্দরা---
          একদিন তোদেরও অভিনয় শেষ...!

সৌরভ ব্যানার্জী

ক্লান্ত হাতে...


অপেক্ষা কখনও কলমের কালির সঙ্গি হয়ে
বকের সারির পায়ে সুতো বাঁধতে পারে।
আই-প্যাড যদি ক্লান্ত না-ও হয় ক্লান্তি মেটাতে,
ঝুপ করে রাত তবু নেমে আসতে পারে
সহযাত্রীর কাঁধে ভর দিয়ে।।
দিন-শেষে বাড়ির পাপোশের শিশিরে ভেজানো পা দু'টো,
সাহস হয়ে কখনও,
অপেক্ষার বিদ্রোহের কারণও হতে পারে।।

অন্য দিন

ব্যূহ


এখন এই মুহুর্তে তুই কি ভাবছিস?

আকাশের নিচে যেমন বৃষ্টি, তোর খুব হাইলাইটেড
হবার লোভ ছিল, ভুলেছিলি রোদেরাও জীর্ন হয়। আশপাশে
ভ্রমরের বিচরণ, তুই খুব উপভোগ করতি, আর
আমিই জানতাম তুই কি বড্ড ভীতু রে! আত্নবিশ্বাসের
অভাবে কেঁপে কেঁপে উঠতি সামান্য আড়ালে। চারপাশে
আজ অনেক ভিড়, তোকে নিয়েই যাবতীয় আলোচনা;
পাড়া-পড়শি এমনকি রামুর চায়ের দোকানেও
তুই-ই আজ টক অব দ্যা সিটি।
আচ্ছা, তুই দেখতে পাচ্ছিস?

অযুত-নিযুত কতো আকাঙ্খা অবেলায় ঝরে পড়ে,

কাঁদে মানুষ শতাব্দীর চৌকাঠে মাথা রেখে, সবুজের নিচে
যেমন ঘুমপ্রবণ ঘাস। এসবতো স্বাভাবিক। আর তুই কিনা
ঝুলে আছিস সিলিং ফ্যানে! ক্লান্ত ময়ালের মত!
তোর সেই বোকা বোকা বন্ধুরাও আছে দু’চারজন এদিক সেদিক,
যাদের তুই ভাঁজ খুলে আনন্দে ভাসিয়েছিস নিত্য, ওই বোকারাই
স্মার্ট তোকে কি চমৎকার শুষে নিল, তারপর আলোর পথে পা
বাঁড়িয়ে অন্ধকারে কি ভীষন টপকে গেল! সব ক’টা
এস্কেপিস্ট।

লুকিয়ে রাখা যেসব অভিমান তার চাইতে চিৎকার ভাল, জেনেও
এতোকাল আমার কাছে সঞ্চিত আছে তোর শতনাম, মনের
গহীনে কোনো বিধৌত নগর পেরিয়ে আবার চুপচাপ
কোনো ধূসর বোতলে ঢুকে পরে-
প্রেম
কিংবা
শরীর মন্থনের শ্লোক।

মামনি দত্ত

ইচ্ছেমত বাঁচার ইচ্ছা


আলো

তোমার পদক্ষেপ আমার চেতনাতে দেদীপ্যমান,
জমজমাট উপস্থিতি তে ক্রমেই নিজের কাছে
নিজেকে পরাশ্রিতা মনে হতে হতে আমি
আঁজলা ভরে চুরি করে নিয়েছি তোমার মুক্তধারা!
অবিষহ্য অন্ধকারের স্নায়ুতে অতর্কিতে হানা দেবো বলে!!

হাওয়া
এক দেশ ছুঁয়ে অন্য দেশ পাড়ি দাও ,
নিভাঁজ নিয়ন্ত্রণ কম্পাস মেপে !
বিদগ্ধ সারবত্তা তে সেজে ওঠো হাজার
অনু পরমানুকৃতির আদলে, সেই রূপে
ডুব সাঁতার দিয়ে আমি তুলে নিয়েছি
এক মুঠো চঞ্চলতা! স্থবিরতায় ছড়িয়েছি
নতুনত্বের সফর শুরুর আশায়!

জল
রং এর বিলাসিতায় পরোয়া করোনা,
আকারে ভাসিয়ে দাও নিজের সত্বা!
উৎসের অলিন্দ থেকেই নির্ঝর তরঙ্গে পরোয়ানা
লিখে দাও স্বাধীনতার, আমি ছিনিয়ে নিয়েছি
তার মূল মন্ত্র, পরাধীন প্রাণে লহরী চিহ্ন আঁকার বাসনায়!!!

দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায়

রাত



তিরতির কেঁপে ওঠে ঘড়ি
দিগন্ত ছুঁয়ে আসে চাঁদ
চোখ চিরে ঘুম নেমে আসে
গলা চিরে জন্মায় পাপ।

সম্বিৎও নেই আর কিছু

রাস্তাও ধূধূ হয়ে আসে
দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখি বাতি।
ঘুমকে জড়িয়ে রাখি পাশে

নেশাকে আদর করি খুব

নেশাও ঠাণ্ডা হয়ে থাকে
ঘুমায় আলোর নিচে আলো
ঘুমায় শরীরবাহী গাড়ি।

অনন্যা ভট্টাচার্য্য

আমার Cliché 



এ সব কি ?

Fake and Fiscal –

আজ আর কাল ৷

There is Love.

কোণাঘরে এক কোণে
Let it be, - half.

Mode of Attraction

তত্ত্বকথা থাক
Lie where they live
book-পোকা কুরে কুরে খাক ৷

Where are You?

আজ থেকে কতদূরে –
In which Direction ?
অতীত থেকে ভবিষ্যতে ?
Or Reverse !

I won’t Lie Anymore

তোমার জন্য সবকিছু
Vacant is Nothing
Therefore, Nothing is Vacant.
তাহলে সবকিছু – পি পু ফি সু ৷
আদিখ্যেতা, নিজেকে ৷

আলিস্যি –

But I –
Must Not be Spoilt.
নিজেকে নিজেই প্রশ্রয় দিয়ে
শেষে ....
Word Play – World Play
বোধ যায়, খায় দায় ঘুমায়, মন চায় মা ৷

ধুস্ –

এতকিছু করে - এই ?
Everything Eats.
Except –
মা-বোধ ৷
আমি শুধু বোধ হ’ব ৷
A White Kite Lurks
Over Thousands of Dead Feelings.. Senses.. Consciences..

অমৃতা দাস

প্রণাম তোমায়



দিনের শুরু , রাত ফুরানোর সুর

তালের কোলে মিল ছোঁয়াবার টুকরো উৎসাহ
তবুও হাসির মুখে চুন কালি
দুঃখের আবির্ভাব ফাঁকা , দিন যায় সাদা
কালও তো রঙ্গিন ছিল?
রাতের তারার মাঝে জ্বলছিল ঝকঝকে হয়ে !
আজ সকালেই শোনা গেল ,
তারা তো আবার দিনে দেখা দেবে না!
অবাক করা দুঃখের হাত ধরে--
অক্লান্ত চোখের জল-ফড়িং কে দিয়েছি রুমাল
তবে বহু দিন পরে
জানি মনের কোণে লুকালেও ব্যথা বাড়ে
বেড়েই চলে - শুধু অন্তহীন অন্ধকারে
তা-রা-রা কথা বলে !!!!

জ্বলে অথই দীপ শিখা শ্যামার আঁচলে

রাতের আকাশ ফুঁড়ে , আশ্বাস মেলে
অস্থির চিত্তে ব্যস্ততার মানুষ এল ফিরে,-
সারা রাত তা-রা-- দেখবো !
চোখ ভরে;
মন ভরে;
আঁচল ভরে;
পিপাসা ভরে;-
নেব বুলিয়ে হাত চরণে
রাত শেষে তারা যে আবার চলে যাবে
সূর্য তাকে লুকিয়ে রেখে আলো দেবে ,
তবু - আমরা তো পড়ে রইলাম অন্ধকারে !
সকলে মোমবাতি জ্বালে ,
সাদার শুভ্রতা ভরায় আসর -
আমার তো কিছুটি নেই!, কিছু দেবার মতো !
তবুও রাতের সেই তারা দেখা দিলে
মনের কোলে মন মাথা রেখে দিত??



রোহণ ভট্টাচার্য

যে সব গল্পে তখনও ভোকাট্টা আসেনি


স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে কৃত্রিমতার একটা অদ্ভূত সম্পর্ক আছে । যে সম্পর্কটা আসলে একটা ঘুড়ির গল্প । যেসব গল্পের ঘুড়িরা লাটাই থেকে সুতো টানতে টানতে অনেকদূর চলে যায় । তারপর যথারীতি ঐ লাটাইটা দেখা যায়, ঘুড়িকেও দিব্যি দেখতে পাওয়া যায় ; শুধু মাঝের সুতোটা কিছুদূর যাওয়ার পর কোথায় যে মিলিয়ে যায়…


এই যেমন একটা কৃ্ত্রিম ফ্লাইওভার যার ওপর দিয়ে অনবরত চলে যাচ্ছে গোল গোল কালো রঙের চাকা । ছোটো বড় বা মঝারি , এরকম আকারগত পার্থক্য বাদ দিলে চাকারা মাত্র দু’রকম । এক, যারা চলে যাওয়ার পর কোনো দাগ থাকে না ; দুই, যারা চলে যাওয়ার পরেও…

অথচ ঐ ব্রীজটাকে ছুঁয়ে যেটুকু বাতাস আছড়ে পড়ছে এদিক সেদিক কিংবা চারপাশ থেকে যেটুকু শূণ্যতা ঘিরে ধরছে ইট-সিমেন্টের শরীরটাকে ; সেইসব দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছে এই ব্রীজটা তৈরীর আগে একটা ঘুড়ি ওরানো হয়েছিল শুধু এয়ার ভলিউমটুকু মাপার জন্য । ব্রীজ তৈরীর ক্ষেত্রে যেটা খুবই স্বাভাবিক এবং বিজ্ঞানমনষ্ক ঘটনা । তবু ঘটনাটা আশ্চর্যজনক এইজন্যই যে বাতাসের চলাফেরার ওপর কিন্তু মানুষের কোনো হাত নেই । অথচ হাতেই তৈরী ঘুড়িটার আকাশে স্বতঃস্ফূর্ত খেলে বেড়ানোর কারণ কিনা একটা ইচ্ছে । খানিকটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে সেখানে সেতু বানাবার ইচ্ছে । অনেকটা একটা অসীম শূন্যতা পাওয়ার পর তাকে ভরাট করতে চাওয়ার মতো । যেভাবে আমাদের ঘুড়ি ও লাটাইয়ের গল্পে মধ্যবর্তী হঠাৎ মিলিয়ে যাওয়া সুতোটি ঝুলে আছে এক অনন্ত খালিতে ।।

তপব্রত মুখার্জী

তপব্রতর মুখার্জীর গদ্য...


যন্তরমন্তর বহুদিন হল বন্দো আচে। না না কলকেতার টা না, সেখানে কল্কে টানচে লোকে ভালই... এই যেখানার কতা বলচি, সেখানা এইখেনে থাকে, এই বুকটুকু কেটে ছিঁড়ে দেকতে হয়। যাক গে যাক, তোমরা সে কতা বুঝবে নি।

ঐ সেদিন ছিল বিসটি-বাদলার দিন। হুঁকো-মুখো আমাশা হয়েছে বলে মুখ আরও বিচ্ছিরি করে বসেছিল। তাকে শুধোতেই সে বলল, বড়মন্ত্রী নাকি কাজ ছেড়ে দিয়েচেন, গুলিসুতো খেয়ে অম্বল হয়ে গিসলো বলে। আর রাজকন্যে এখন ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। সামনের মাসে রাজা বলেচেন দিঘ্রাংচুর সাথে তার বে...

হুঁকো কে জিজ্ঞেস কল্লুম, কে কে আসছে? সে বললে, সক্কলে; মায় প্যাঁচা পর্যন্ত। এই কতা শুনে আমার আবার ঢেঁকুর উঠলো... কিন্তু হজম হল না! প্যাঁচা তো যদ্দুর জানতাম এখন হাইকোর্টে যায়... সে আসবে? ও বাবা, জিজ্ঞেস করতেই হুঁকো হঠাৎ রেগে গাছের কোটরে ঢুকল, আর বিচ্ছিরি গলায় একটা দেড়েল ছাগল বলতে বসলো, "অঙ্ক জানো, অঙ্ক? জানো না, জানো না, কিসসু জানো না..."

বিপদ বুঝে পালাতে গিয়ে দেকি, ও রামঃ, মিছিল বেরিয়েচে! তার সামনে হাঁটচে বিড়াল, পেছনে সব্বাই কেমন কিম্ভুতকিমাকার!!! এদিকওদিক তাকিয়ে দেখি, এক এক করে ট্যাঁসগোরু এসে ঢুঁ মেরে যাচ্ছে সমস্ত হাঁ হয়ে থাকা লকজনের পিছনে!!! আমি সামলালুম...

খানিক পরে পাঁজরে একখান খোঁচা খেয়ে দেকি, উরিব্বাস, গেছোদাদা! শুধোলেন, কি বুজছ ভায়া??? আমি তো হাঁ!!! তিনিই বল্লেনঃ "বুজলে, এই জন্যই ভাগলুম... আর পোষাচ্ছে না! কি সব ছিরি!!! ধুর..."

খ্যাক খ্যাক হাসি শুনে দেখি পাঁচিলের উপর বসে শেয়াল হাসছে!!!

নাহ... আর না... আমি তারপর পালালুম। দুঃখু রইল কিচু, তবু, তোমরা তো বুজবে নি, তাই একা একাই যন্তরমন্তর এর সামনে দে ঘুরে আসি বারকতক... দেকি, যদি কিচু হয় কোনদিন!!!