সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

মঙ্গলবার, ২০ নভেম্বর, ২০১২

উদয়ন

দ্যাশের লোক


উত্তরে যাও। আস্তে আস্তে গ্রাম-টাম ভ্যানিস হয়ে আসবে। আমাদের শহর থেকে নাক বরাবর ৩০০ কিমি উত্তরে রাস্তার ধারে শেষ একটা গ্যাস স্টেশন। চকোলেট-ক্যান্ডি-র তাকে পসরা কিছু আছে, তবে ধুলো পড়া। একটাই রেফ্রিজেটারে দুধের ক্যান কিছু, আর কোক, রুটবীয়ার, রেডবুল-এর পুরোনো ক্যান। তারিখ দেখিনি এক্সপায়ার করা কিনা। ৪০ লিটার গ্যাস ভরে, কাউন্টারে দাম চুকিয়ে এলাম। কাউন্টারের মেয়েটা ফ্রাস্টনেশন। মানে অ্যাবরিজিনাল। মানে আদিবাসি। এই গ্যাস স্টেশন থেকে বাঁদিকে রাস্তা গেছে, ওয়াস্কেসু, বনের মধ্যে লেক, তার ধারে বনভোজনের যায়গা। শহুরে মানুষ আসে, ক্যাম্পিংকরে, শিকার-টিকার করে, মাছ ধরে। মার্চ থেকে অক্টোবর। আমরা যাব আরো উত্তরে। আরো ৩০০ কিমি। কানাডা-র উত্তরের শেষ টাউন, 'লা-রঙ্গে'। তার-ও পরে আছে জল, জঙ্গল, অসমতল জলাভুমি, এস্কিমোদের জায়গা ন্যুনাভট। তারপর বাফিন বে।

তো, গ্যাসস্টেশন ছাড়িয়ে আসার কিছু পরে থেকে উঁচু-নীচু অসমতল বন-জ্‌ঙ্গল সুরু হয়ে গেল। বাঁদিকে একটা টিলা, ডানদিকে হঠাত পরিখা, হঠাত ঘন জ্‌ঙ্গল, হঠাত ঢিপির মত খোলা উঁচু জমি। এখন জুলাই মাস তাই জ্‌ঙ্গল। অক্টোবরের শেষ থেকে বরফে ঢেকে যাবে নিশ্চই। রাস্তা আর খোলা জমি চেনা যাবে না মনে হয়। রাস্তাটা মোটামুটি খারাপ নয়। মাঝে মাঝে খানা খন্দ পীচ উঠা আছে বটে, তবে এই কৌরব বর্জিত রাস্তায় এর চেয়ে ভাল আশা করা মুশকিল। কিছুদুর গিয়ে আচম্‌কা ব্‌ষ্টি। বেশ চড়া রোদ ছিলো, আধা মিনিটে ভ্যানিস হয়ে গিয়ে ব্‌ষ্টি সুরু হয়ে গেল। এমন জোরে যে, দশ ফুটিয়া সামনে সব ঝাপসা। যদিও এখন পর্যন্ত্য উলটো দিকে একটা-ও গাড়ি দেখিনি, তাও সবার টেনশনে মুখ গম্ভীর। প্রবল বিক্রমে ওয়াইপারটা সপাত সপাত করছে বটে, কিন্তু ব্‌ষ্টির যা তেজ, উইন্ডস্ক্রীন, তেমন-ই ঘোলাটে। পিতার নাম স্মরণ করতে করতে আরো তিরিশ মিনিট মতন চলার পর, হঠাত যেমন ব্‌ষ্টি এসেছিলো, তেমনি হঠাত থেমে গেল। দশ সেকেন্ডে ঝাঁঝাঁ রোদ আবার।

লা-রঙ্গে পৌঁছুতে বেলা চারটে বেজে গেল। লেকের ধারে ছোট্ট টাউন। যারা থাকে তারা সবাই মুলতঃ, ঐ, ফ্রাস্টনেশন। মানে অ্যাবরিজিনাল। মেতিস। এস্কিমো মিক্স। বাড়ী ঘরদোর যা আছে, সবই মোবাইল হোম যাকে বলে। ট্রেলারের উপর। ফাউণ্ডেশন নেই। এই শেষ একশো কিমি রাস্তা শীতে বন্ধ থাকে। বা শুধু স্নো ট্রলারের জন্য খোলা থাকে। যা লোকজন আসে, তাই এই গরম কালে-ই। লেকে ফিসিং কত্তে। বা ক্যাম্পিংএ। তাও খুবই কম। লেকের ধারে একটাই হোটেল। সেটাও ট্রেলারের উপর। সামনে কোনোরকমে পীচ বাঁধান পার্কিংলট। সামনে লা-রঙ্গে লেক। প্রায় হাজার স্কোয়ার কিমি। গ্লেসিয়ার আর আর্টিক বরপ গলা জলে তৈরী। তলদেশ অসমতল পাহাড়ি। তাই এদিক ওদিক অসংখ্য দ্বীপ মাথা বের করে আছে। হাউস বোট আছে কিছু। ভাড়া করা যায়। নিজেই চালিয়ে নিয়ে যেতে হয়। কোথাও নোঙর করে রাত কাটান যায়। এটাও একটা, ঐ, কি বলে, বড় রিক্রিয়েশন।

তো খাবার দোকান খুঁজতে গিয়ে দেখি এট্টা কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন আছে। বাপরে। আমেরিকান ফুড চেন এই গোবিন্দপুরেও ব্যবসা ফেঁদেছে। দোকানটা অবশ্য ঐ ট্রেলার হাউসের ভিতরে। কাউন্টারের মেয়েটাও ফ্রাস্টনেশন। বলল, এটা নাকি কেবল জুলাই-আগস্ট খোলা থাকে। খাবার বিশেষ কিছু ভ্যারাইট না দেখে বউ-এর পছন্দ হল না। বেরিয়ে একটু এদিক-ওদিক করে দেখি, একটা ট্রেলারের উপর লেখা 'এসিয়ান ফুড'। বলে কি ? ইয়ার্কি নাকি ? তড়িঘড়ি ঢোকা হল। মলিন কিছু চেয়ার টেবিল। টেবিলে চীনে নক্সা করা টেবিল ক্লথ, তার উপর ছেঁড়া প্লাস্টিক। দেওয়ালে পুরোনো রং। তাতে চীনে বা জাপানি পাখা পিন দিয়ে আঁটা। টেবিলে বসার পর, একজন বুড়োটে লোক, চেহারায় চীনে বা জাপানী বা ভিয়েতনামি হবে, বয়স সত্তর-ও হতে পারে আশি-ও হতে পারে, শতছিন্ন মেনু কার্ড, আর খাবার জলের জাগ নিয়ে এল। মুখটা হাসি হাসি হলেও, ঠিক হাসছে কিনা বোঝার উপায় নেই। তো, ভয়ে ভয়ে, হাক্কা চাউ, চিকেন পাইনাপেল অর্ডার দেওয়া হল। কুড়ি-পঁচিশ মিনিট সময় নিয়ে টেবিলে খাবার এসেও গেল। খেয়ে দেখলাম। মন্দ নয়। মানে চাইনিজ-এর মতন-ই চাইনিজ। আধা সেদ্ধ কিছু নয়। তো খাবার খাওয়া আর আড্ডা মারা শেষ করে শরীরটা একটু চাঙ্গা হল।

বিল দেওয়ার সময় দেখি একটা কাউন্টার মতন আছে। তার ময়লা টেবিলটপের পেছনে একটা বুড়ি। ঐ বুড়োটে লোকটার বৌ-ই হবে মনে হয়। আমাদের দেখে খুব একগাল হাসল। দাম্‌টাম দিচ্ছি, আর বুড়ি দেখি আমাদের দিকে দেখেই চলছে। মুখে মিটিমিটি হাসি। শেষে মনে হয় থাকতে না পেরে-ই বলল, 'আর ইউ ফ্রম, কালকুতা ?' আমার তো প্রায় বিষম-টিষম লেগে হেঁচকি খেয়ে টেয়ে যাতা অবস্থা। একে কানাডা-র কৌরব-বর্জিত উত্তরের গাঁ। তায় আবার চাইনীজ না ভিয়েতনামি। তায় কলিকাতা বলে এট্টা শহর আছে, তা জানে। আবার আমরা যে কলিকাতায় টিকি বাঁধা রেখে এসেছি, সেটাও বুঝে নিয়েছে ! একি কোনো ডাইন নাকি ? বাপরে। তার্পর বুড়ি শোনাল নিজের কথা। কলকাতায় জন্ম। চায়না টাউনে সম্ভবতঃ। বাবার রেস্টুরেন্ট ছিলো। ওর পনের বছরে বাবা দোকান বেচে চায়্‌না ফিরে যায়। তার্পর সেখানেই পড়াশুনা-বিয়ে ইত্যাদি। বর কোনো তেলের কোম্পানিতে ওভার্সিয়ার ছিলো। তেলের খোঁজেই কম্পানীর দলের সাথে উত্তর কানাডা আসা। ন্যুনাভট, ইক্যুলাইট। তার্পর, তেলের সন্ধান বন্ধ হয়ে গেলে, ওর বরের কোম্পানী পাত্তারি গোটালেও, ওরা থেকে-ই যায়। ঠান্ডা, বরফ আর বাফিন-বে ততদিনে ওদের মজ্জায় সেটেল করে গেছে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে, সাস্কাটুন, ক্যালগেরি, ভ্যাঙ্কুবার। ওরা বুড়ো-বুড়ি থেকেই গেছে উত্তরে। ইক্যুলাইট-এর আস্তানা ছেড়ে দিয়েছে অবশ্য। এখন এই লা-রঙ্গে। ট্রেলার হাউসে-ই থাকে সারাবছর। মাঝে মাঝে সাস্কাটুন আসে ছেলের কাছে। বা সাপ্লাইস কেনার জন্য।

একথা-সেকথার বুড়ি বলে , ছেলেবেলায় বাংলা জানত ভালই। বলতে তো পারতই, লিখতেও নাকি পারত একটু একটু। এতদিনের অনভ্যাসে বলতে ভুলেই গেছে প্রায়। কিন্তু ছেলেবেলার কান-টা জিয়ন্ত রয়ে-ই গেছে। তাই বাংলা কিছু কিছু বুঝতে পারে। নিদেনপক্ষে ধ্বনি শুনে বুঝতে পারে ভাষাটা বাংলা। সেভাবেই চিনতে পেরেছে আমাদের কুলকাতার টিকি। এখনো কালে ভদ্রে, এই যেমন ৪/৫ বছরে একবার ইন্ডিয়া যায়। কলকাতার টানে নয়। বুদ্ধগয়ায় তীর্থ করতে। পঞ্চাশ বছরের চীনে সংস্ক্‌তি, বুড়ো-বুড়ির, ধর্মবিশ্বাসে বেড়া দিতে পারেনি। তিন বছর আগে গেছিলো ইন্ডিয়া। কলকাতা-ও ঘুরেছে সেইবার। চায়ানাটাউন দেখে চিনতে পারেনি। ওর বাবার হোটেল কোথায় ছিল সেসব-ও দিশা করতে পারেনি। তবে ঘুরেছে খুব। পার্কস্ট্রীট, ধর্মতলা, বেকবাগান। এসব জায়গায় নাম করতে করতে বুড়ির চোখ চকচক করে। সত্তর বছরের প্ঞ্চাদশী কিশোরী।

আসার সময় একটা প্যাকেট দেয় বুড়ি। উপহার। বাড়ীতে বানানো কুকি। ভালই লাগে বুড়িকে। খোলমেলা। আমুদে।

গাড়ীতে উঠে, ব্যাক গিয়ার দিয়ে টার্ন নেওয়ার সময় একটু চোখ পরে সাইন বোর্ডএ । 'এসিয়ান ফুড'। বুকটা একটু টনটন করে।

হাজার হোক, দ্যাশের লোক। আমাগো।

***

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন