সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১২

সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা

সম্পাদকের কলম থেকে


প্রিয় পাঠকজন,

আবারো বেরোল আপনাদের প্রিয় পত্রিকা সৌকর্য।

এটি সৌকর্যের তৃতীয় সংখ্যা। আমরা চেষ্টা করেছি, এবারের সংখ্যাকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলতে। গতবারের সংখ্যাটি ছিল একটি বিশেষ সংখ্যা, তাই আমাদের যে মূল উদ্দেশ্য, তা সেটিতে প্রতিফলিত হয় নি। কিন্তু এবারের সংখ্যাতে, আমরা আবার আমাদের পুরোন দিশাতে ফিরেছি।

এই সংখ্যার কবি রুদ্রশংকর (সব্যসাচী), আশা করি তার লেখা আপনাদের যথেষ্ট তৃপ্তি দেবে। এবারের সংখ্যায় আমরা অনেক প্রতিভাধর লেখকের গল্প পেয়েছি, পাঁচ-পাঁচটি গল্প ও দুটি রম্যরচনা দিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের সৌকর্য। সাথে আছে, অগুন্তি ভালো কবিতা..ও নন্দিতা ভট্টাচার্য্যর অনুবাদ কবিতা। আপনাদের মতো সাহিত্যপ্রেমী মানুষের অকুন্ঠ ভালবাসায় আমরা আপ্লুত। অনেক স্বনামধন্য মানুষ নিজে থেকে লেখা পাঠাবার অনুরোধ করায় আমি মুগ্ধ। খুব দ্রুতগতিতে কাজ করায়, ভুলত্রুটি অনেক থাকতে পারে, সেটুকু, নিজগুণে মার্জনা করে দেবেন।

যাদের কথা না বললে, আমি অকৃতজ্ঞ প্রতিপন্ন হব, তারা হলেন সুমিত রঞ্জন দা, রুপময় ভট্টাচার্য, সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়। এদের তিনজনের অকুন্ঠ পরিশ্রমে, বিশেষ করে সুমিত রঞ্জন দাসের নিরলস তাড়ায় ও আমার সাথে শেষদিনের প্রচন্ড পরিশ্রমের ফসল এই সংখ্যাটি। সেইসব কবি ও লেখকদের আমি শ্রদ্ধা জানাই, যাঁরা এককথায়, আমার অনুরোধে এক নয়, একাধিক লেখা সঠিক সময়ের মধ্যে পাঠিয়েছেন, এঁনাদের সহযোগিতা ছাড়া এই সংখ্যাটি বের করা সম্ভব হোত না।

আমরা মনে করি, সাহিত্যচর্চা একটি নিরন্তর প্রয়াস, এক বহতা নদির মতো, আমরা বহু মানুষ তাতে ঘটি ডোবাচ্ছি, আবার দুঘটি জলও ঢালছি, কোন নির্দিষ্ট ঘটনা ভিত্তিক সংখ্যা বের করাটাই আমাদের শুধু উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য বহু প্রতিভাবান লেখক ও কবিদের একটা সুস্থ মঞ্চ দেওয়া, যাতে তারাও নিরন্তর এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকতে পারে।

আশা রাখি, এই সংখ্যাটিও আগের গুলির মতো, আপনাদের মনের নিরবিচ্ছিন্ন সঙ্গী হয়ে উঠতে পারবে।


নমস্কারান্তে,


বৈজয়ন্ত রাহা,
সম্পাদক, সৌকর্য।



গল্প - গাঙ্গেয় অধিবাসী

সঘন গহন রাত্রি





হাতিবাগানের এই রাস্তাটা সন্ধের দিকে বেশ নির্জন।

সবকটা ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলেও না। অহনা একটু পা চালিয়েই হাঁটে এ সময়টা। ভিতরে ভিতরে গা ছমছমও করে বোধহয়।

পূর্ণশ্রী সিনেমা ছাড়িয়েই ডানদিকে গীতবিতান, ঠিক সন্ধে ছ’টায় গানের ক্লাস। সুরমাদি খুব কড়া, দেরি হলে বেশ বকাবকিও করেন। অহনা অবশ্য কোনদিনি লেট করে না। প্র্যাক্টিকাল ক্লাস শেষ হয় সাড়ে পাঁচটায়। ও ঠিক ছটা বাজতে পাঁচেই রুপবানী স্টপে এসে নামে। আর ঠিক ছটায় ক্লাসে ঢোকে। তাছাড়া শনিবারের এই ক্লাসটা ওর মিস করতে ইচ্ছেও করে না।

প্রতিদিনের মতো আজো ছেলেগুলো বসে আছে রকে।

পূর্ণশ্রীর পাশে একটা গ্যারেজ, আর তার লাগোয়া একটা রক। চার-পাঁচটা ছেলে প্রত্যেকদিন এখানে আড্ডা দেয়। অবশ্য প্রত্যেকদিন কিনা অহনা জানেনা, ও তো শুধু শনিবারি আসে।

বখাটে টাইপ চেহারা, গলায় চেন, হাতে বালা, অবশ্য আজ অবদি ওরা কেউ অহনাকে কিছু বলেনি, তবুও ওর যেনো কেমন কেমন লাগে।

একবার আড়চোখে দেখে হন হন করে অহনা ক্লাসে ঢুকে যায়।

আজ সুরমাদি ওই ‘সঘন গহন রাত্রি...’ টা তোলাবেন, আগেরদিনই বলে দিয়েছিলেন। ওটা অহনারি অনুরোধে। কিশোরকুমারের কন্ঠে ঐ গানটা অহনার ফেভারিট।

কি আশ্চর্য্য!! আজ দিদি এসে পৌঁছোন নি। দিদি তো সাধারণতঃ লেট করেননা। অহনা একটু অবাক ই হয়। এখনও কেউ আসেনি। ও স্বরবিতান ওল্টাতে শুরু করে।

আজ আবার আকাশে খুব মেঘ করেছে। একটু একটু বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। বাসেই মায়ের ফোন এসেছিল, ‘আজ কিন্তু দেরি করিস না, বৃষ্টি আসতে পারে’ । হাতঘড়িটা একবার ওল্টায় ও। সওয়া ছটা বাজল।

খুব জোর হাওয়া দিচ্ছে, ঘরের পর্দা উড়ে যাচ্ছে, সোঁদা হাওয়া, কোথাও কি বৃষ্টি নামল? বৃষ্টি অহনার খুব প্রিয়, ও উঠে জানলার কাছে এসে দাঁড়ায়, আচমকা বৃষ্টি-ছাঁটে অহনার সারামুখ ভিজে যায়, আর ঠিক তখনি, বাইরে কোথাও থেকে একটা গানের কলি ভেসে আসে।। কে যেনো গাইছে...”সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবণ ধারা...”।।কোন উদাত্ত পুরুষ কন্ঠ। কেনো কে জানে, অহনার সমস্ত শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়...





আজ সকাল থেকেই শ্রাবণের মনটা ভাল নেই।

খুব ভোরে উঠেই ও মালা কিনে এনে মায়ের ফটোতে লাগিয়েছে, সামনে ধূপ জ্বালিয়েছে।

ফি-বছরি ও এটা করে, কিন্তু মায়ের এই মৃত্যদিনেও দাদা কথা শোনাতে ছাড়েনি। ওর কানে এসেছে, দাদা বৌদিকে বলছে, “চার বছর হয়ে গেলো , এম এ পাস করে বসে আছে, মাতৃভক্ত হনুমানকে একটু বোঝাও , চাল-ডালের দাম, গ্যাসের দাম এখন অনেক বেড়েছে, একজনের পেট চালাতে কম খরচ হয় না”।

গায়ে খুব লাগে, সত্যি এখন গায়ে খুব লাগে। একেকবার ভাবে, গ্রামে ফিরে গিয়ে বাবার সাথে জমি চাষই করবে, চাকরি-বাকরি তো কিছু হবে না। কত জায়গায় কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিল, হোল তো নাই, যে দুটো জায়গায় হোল, সেখানেও তো টাকা চায়, দেড়-দুলক্ষ টাকা কে ধার দেবে ?

ওর আজ খুব বেশী করে মায়ের কথা মনে পড়ছে।

নাথপুরের বাড়িতে ওদের পিছনদিকের উঠোন ছুঁয়ে পাড়বাঁধানো পুকুর, মা সেই উঠোনে তুলসীতলায় পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়েই হারমোনিয়ম নিয়ে বসতেন। পুকুরের অন্যপার থেকে ভেসে আসত হাওয়া, বুনোফুলের গন্ধ, মা হারমোনিয়ম বাজিয়ে গান ধরতেন...“তোমাকেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা...”, বাবা খুব চুপচাপ এসে বসতেন উঠোনে, একটা উঁচু পিঁড়ি নিয়ে, চোখ বন্ধ করে শুনতেন মায়ের গান, সারাদিনের চাষের ধকলটা তাঁর মুখ থেকে এক নিমেষে উধাও হয়ে যেতো। ও গুটিগুটি মায়ের কোলের কাছে গিয়ে বসত। আর দাদা এসে বসত বাবার পিঁড়ির পাশে। আর খানিক গেয়েই মা বলতেন, “ ধর শুবু, আমার সাথে ধর”...আর অমনি ও কচি কচি গলায় ...

আর গান শেষ হলেই মা, দুগাল ধরে চুমু খেতেন...আর বাবাকে বলতেন, “ ঈশ্বর এ ক্ষমতা সকলকে দেননা, শুবুর কি আশ্চর্য্য ক্ষমতা দেখো, একটা গান একবার শুনে হুবহু সুরে গেয়ে দেয়, কে জানে, ঠাকুর কি লিখেছেন ওর কপালে!”

আর কি লিখেছেন!!

বাউন্ডুলে হয়ে গেছে শ্রাবণ।

না, গান শেখার বিলাস ও স্বপ্নেও ভাবেনি, আর দশটা ছেলের মতো শহরে এসে পড়াশুনা করে একটা ভাল চাকরি...ব্যাস!।।এছাড়া আর ও কিছু ভাবতেও পারেনি। বাবা একবার বলেছিলেন...একটা ছেলে শহরে থাকলে, আরেকজন কে তো জমিজমার দেখাশুনা করতে হয়। কিন্তু শ্রাবণ শোনেনি। ও কখনও ভাবতে পারেনি, ও সারাজীবন বাবার মতো চাষবাস করে কাটাবে।

নদীয়ার ইছামতির তীরে এই গ্রাম, নাথপুর। সেখানে দশবিঘা জমির উপরে ওদের দখলদারি। বাবা নিজেও চাষ করতেন, প্রান্তিক চাষীও লাগাতেন।

কিন্তু বারো ক্লাসে পড়ার সময়ই, মায়ের রোগটা ধরা পড়ল। প্রথমে কৃষ্ণনগর, তারপর কলকাতা...হাসপাতাল-বাড়ি করতে করতে কবে যে দশ বিঘা জমি দশ শতকে নেমে এলো, তা আজ আর শ্রাবণ মনেও করতে পারেনা।

এখন বাবা ওই টুকু জমিতে একাই চাষ করেন, আর দাদা যেটুকু টাকা পাঠাতে পারে, তার উপর ভরসা।

মাঝে মাঝে নিজের উপর খুব ঘেন্না হয়। একেবারে অপদার্থ মনে হয় নিজেকে। আর দাদা যখন এইসব বলে, একেকবার মনে হয়, রেলের তলায় গিয়ে গলা দেয়।

আর তখনি মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে।

মৃত্যুর আগেরদিন মায়ের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শেষবারের মতো শ্রাবণের গাল দুটো ধরে বিড়বিড় করেছিলেন মা, আর কেউ বোঝেনি, কিন্তু শ্রাবণ বুঝেছিল মা কি বলছেন। খুব আস্তে আস্তে উনি বলেছিলেন “শুবু, যখন খুব কষ্ট হবে, তখন আমার মুখটা ভাববি, আমি তোকে ছেড়ে যাচ্ছি না, আমি তোর সঙ্গেই আছি...এবার গা, ওই গানটা”...শ্রাবণ কাঁদেনি, শ্রাবণ জানত কোন গানটা... খুব আস্তে ও শুরু করেছিল “আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে, তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে...” , মা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

পরেরদিনি মা মারা যান, কিন্তু না, শ্রাবণ তবুও কাঁদে নি।

আজ খুব কষ্ট হচ্ছে, আজ খুব বেশী করে মায়ের কথা মনে পড়ছে শ্রাবণের।

আকাশটা আজ ভোর থেকেই মেঘলা।

সারাদিন দাদা থাকে না, ও তবু বাড়িতে একটু নিশ্চিন্ত থাকে। বৌদির ফাই-ফরমাস খেটেও দেয়, তারপর যে কোন চুলোয় ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, নিজেই তার হদিস দিতে পারে না...আর নিজের দু-চারটে টিউশন তো আছেই বিকেল চারটে থেকে রাত দশটা পর্যন্ত।

কিন্তু আজ যেনো কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না ওর।

হাতিবাগানে ওদের বাড়ির গলিটার পর একটা গলি ছেড়ে পরের গলিটায় একটা গানের স্কুল আছে, গীতবিতান। ওর যখন খুব বেশী করে মায়ের কথা মনে পড়ে, ও ওই স্কুলটার উল্টোদিকের রকে গিয়ে বসে সন্ধেবেলায়। ভিতর থেকে গান ভেসে আসে, আর ওর মনে হয়, ওর মা গাইছেন...রবীন্দ্রসংগীত।

আরো তিন-চারটে ছেলে এসে বসে ওখানে, ওর মতোই, তবে ওরা কিছু না কিছু করে, এজেন্সী, দোকানের সেলসম্যানের চাকরি...ওকেও বলেছে শিবু, বুড়োরা, কোনো দোকানে লাগিয়ে দেবে, কিন্তু ওর মন সায় দেয় নি, তাহলে এতো কষ্ট করে টিঊশনের পয়সায় এম এ করে কি লাভ হোল?

ও বাউন্ডুলেই রয়ে গেছে।

আজ রকে বসে থাকতে থাকতেই আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি এল।

আর অনেকদিন পর যেনো নিজের কষ্টটা চাপতে না পেরেই ও গেয়ে উঠল...“সঘন গহন রাত্রি...ঝরিছে শ্রাবণ ধারা...”




বৃষ্টিটা থামছেনা কিছুতেই। অহনা আনতে চায়নি, তবু জোর করে মা ছাতাটা ভাগ্যিস ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তাই বাঁচোয়া। ছাতাটা খুলেই ও হনহন করে হাঁটতে শুরু করে। একটু বাদেই ও লক্ষ করে ওর পিছু পিছু কেউ যেনো আসছে, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, ঠিক, যা ভেবেছে, তাই। ওই ছেলেটা তো ওই রকেই বসে। এতোদিনে তবে নিজের রূপ দেখাচ্ছে , পেছু নিয়েছে। ভাবতে ভাবতেই ছেলেটা সামনে এসে পড়ে।

“একটা কথা ছিল...”

অহনা একটু বিরক্তির সুরেই যেনো বলে, “আমার সাথে?...আপনি কি আমায় চেনেন?...আমিতো আপনাকে চিনিনা। আর এখন কোন কথা বলার সময় নেই, আমায় বাড়ি যেতে হবে” ...বলছে আর ভাবছে, এই অন্ধকারে ছেলেটা কিছু করবে নাতো?

“ না , মানে আপনি কড়ি-মা লাগালেন, ওটাতো শুদ্ধমধ্যম...আমি...মানে এটা বলতে এলাম...” চারবার ঢোক খেয়ে কথা শেষ করে শ্রাবণ, “সঘন গহন রাত্রি.তে কোথাও কড়িমা নেই তো...”।

অন্ধকার রাস্তা বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে, দূরে ল্যাম্পপোস্টের কালচে হলুদ আলোয় একবার ছেলেটাকে দ্যাখে অহনা স্তম্ভিত হয়ে; প্রায় ছ’ফিটের কাছাকাছি লম্বা, অন্ধকারেও বেশ বোঝা যায়...ফরসা গালের উপর খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথার চুলগুলো অবিন্যস্ত, উস্কোখুস্কো, নাকটা, খরগের মতো বেরিয়ে আছে। সারা শরীর বেয়ে জল ঝরছে। আর চোখ দুটো!!...

অহনা শুধু বলতে পারে, “ আপনি বৃষ্টিতে ভিজে এই বলতে এলেন?” আর ভাবে, এরকম চোখ মানুষের হয়!! এত পবিত্র চোখ!!

খুব লজ্জা পায় শ্রাবণ। “ হ্যাঁ...,মানে আমার মা...আমায় শিখিয়ে ছিলেন তো...তাই”

কি ভাবে অহনা একবার, তারপর বলে, “ দিদিকে জিজ্ঞেস করে ঠিক করে নেব, অনেক ধন্যবাদ। আমি এখন যাই”।

শ্রাবণ দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকে, অহনা হাঁটতে থাকে, একটু পরে, কি ভেবে অহনা ছাতাটা বন্ধ করে দেয়।

বৃষ্টি পড়তেই থাকে।




পরের শনিবার, ক্লাসে ঢুকবার আগে অহনা ভাল করে লক্ষ্য করে, না, আজ তো সেই ছেলেটা নেই। বাকিরা তো আছে। তবে কি ও রোজ আসে না?

আগের দিনের গানটাই আজকেও গাওয়া হচ্ছে...অহনা কি ভেবে দিদিকে বলে, “ আজ আমার তাড়া নেই দিদি, আমায় পরে ছাড়লেও চলবে”। সুরমা অবাক হয়, যে মেয়েটা এসে ইস্তক যাই যাই করে, তার হল কি?কিন্তু মুখে তিনি কিছু বলেননা, শুধু বলেন, “ঠিক আছে”।

এই প্রথমবার, ক্লাস থেকে বেরোনর সময় অহনা পূর্ণ দৃষ্টিতে রকটার দিকে তাকায়।

তারপর একটু সঙ্কুচিত ভঙ্গীতে রকটার সামনে এগিয়ে যায়। ওকে দেখেই চওড়া রকের ভিতর থেকে শ্রাবণ বেরিয়ে আসে।

অহনা বলে, “ একটু কথা ছিল...”

শ্রাবণ ওর সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে থাকে-- “বলুন”

---“আজকে ঠিক আছে...গানটা?”

---“একদম পারফেক্ট”

---“সেদিন বাড়ি গিয়ে আমি শুদ্ধমধ্যমেই প্র্যাকটিস করেছি”

---“দিদিকে জিজ্ঞেস করলেন না?”

---“না, স্বরবিতান খুলে দেখলাম, আপনি ঠিক বলেছেন, আর আজ দিদিও সেটাই বললেন, অথচ আগেরদিন বলেননি, কেনো কে জানে?...আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

---“করুন”

---“অত মেয়ের ভিতর আমার গলা কোনটা, আপনি কি করে বুঝলেন সেদিন?”...বলে আর ভাবে, ছেলেটা চুল আঁচড়ায় না কেনো? ঠিক করে দাড়ি কামায় না কেনো?...একটুও কি পরিচ্ছন্ন থাকতে ইচ্ছে করে না?

---“আমি লাস্ট তিনমাস ধরে আপনার গলা শুনছিতো, আমি আপনার গলা চিনি, এই ব্যাচের মধ্যে আপনার গলাই সবচেয়ে ভালো”

---“তার মানে?...আপনি আড়ি পেতে মেয়েদের গলা শোনেন?”

অহনা দেখে, ছেলেটার ফর্সা কানদুটো লজ্জায়, অপমানে লাল হয়ে উঠছে, মনে মনে খুব হাসি পায় অহনার।

শ্রাবণ বলে, “ এমা!! নানা, আমি তো শুধু আপনার গলাই...”...কথা আটকে যায় শ্রাবণের, জীভ কেটে দাঁড়িয়ে যায় শ্রাবণ।

এবার অহনা সটান শ্রাবণের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়, “কেনো? আমার গলাই কেনো?

শিশুর মতো উত্তর দেয় শ্রাবণ, “জানি না তো”

---“জানেন না? আশ্চর্য্য..আমার গলাই শুধু শোনেন, অথচ জানেন না কেনো?”

---“সত্যি ই জানিনা , বিশ্বাস করুন”

বিশ্বাস করে অহনা, করতে বাধ্য হয়, শ্রাবণের কন্ঠস্বর থেকে, শ্রাবণের চোখ থেকে একটা কিছু বেরোয়, অহনা টের পায় সেই সোঁদা হাওয়ার গন্ধ, বৃষ্টির গন্ধ, প্রকৃতির গন্ধ, শ্রাবণের শরীর থেকে বেরিয়ে এসে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে,

অহনা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়, সামনের এই মানুষটা কোন মিথ্যে বলতে পারেনা, এই মানুষটা আদ্যপান্ত সৎ।

অনেকক্ষণ দুজনে হাঁটতে থাকে চুপচাপ।

হঠাৎ শ্রাবণ খুব বিমর্ষভাবে বলে ওঠে, “জানি , আপনি আমাকে বিশ্বাস করলেননা, কিন্তু যেদিন আপনাকে প্রথম দেখেছি, সেদিন থেকে আমি প্রতি শনিবার আপনাকে একবার দেখবার জন্য, আপনার গলাটা একবার শোনবার জন্য এখানে আসি, জানি আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, হয়তো আমাকে লোফারও ভাবছেন...কি করব?”

অহনা কোন উত্তর দেয় না, চুপচাপ হাঁটতে থাকে, তারপর আচমকাই বলে—

“সেদিন স্কুলের উল্টোদিক থেকে কেউ একজন ঐ গানটা গাইছিল, আপনি শুনেছেন?...ঐ সঘন গহন ...গানটা”

শ্রাবণ বলে, “হ্যাঁ”

---“কে গাইছিল বলুন তো?”

এবার শ্রাবণ খুব লজ্জিত গলায় বলে, “আমি”

খুব টানটান গলায় অহনা বলে, “ এই রকে বসে আপনি কি করেন?...চাকরিবাকরি করেন না কেনো? এটাকি আপনার উপযুক্ত জায়গা?”

---“কি করব? এম এ করার পর চার বছর শুধু পরীক্ষা দিয়ে গেছি, চান্স পেয়েও টাকা দিতে পারিনি বলে চাকরি হয় নি...কি করব বলুন? বাড়িতে থাকলে দাদার অপমান সহ্য হয় না...একটু গান শুনব বলে...মানে, গান শুনলে ভিতরের জ্বালাটা...মানে...” গলা কিরকম ভারি হয়ে আসে শ্রাবণের...

---“তবে ব্যবসা করুন...কিছু একটা করুন...এভাবে সময় নষ্ট করবেন না”

---“আমার পুঁজি কই?...টিউশন করে যা পাই তার প্রায় সবটাই বৌদিকে দিয়ে দিই, নিজের কাছে শুধু যাতায়াতের খরচাটা ছাড়া কিছুই থাকে না”...ম্লান হাসে শ্রাবণ।

---“নিজের পুঁজিটা নিজেই চেনেন না? ঘটে আছে কি?”...এতক্ষণে হাসে অহনা।

---“পুঁজি? আমার?”...ফ্যালফ্যাল করে অহনার দিকে তাকিয়ে থাকে শ্রাবণ।

---“ আপনি গান শিখেছেন?” অহনা জিজ্ঞেস করে।

---“ছোটবেলায়, মায়ের কাছে”

---“তবে এখন আবার শিখুন”

---“হাসালেন, খাবার পয়সা থাকেনা পকেটে, আর গান?...আপনি যদি শেখান, বিনিপয়সায়, তবে শিখতে পারি”...রসিকতার চেষ্টা করে শ্রাবণ।

অহনা খুব কাছে এগিয়ে আসে শ্রাবণের, বলে, “উপায় থাকলে শেখাতাম, বিশ্বাস করুন” তারপর একটু থেমে বলে, “কিন্তু ওটাই আপনার পুঁজি, জেনে রাখুন...ঈশ্বর দিয়েছেন আপনাকে”।

বাসে উঠে যায় অহনা।

শ্রাবণ তাকিয়ে থাকে চলে যাওয়া বাসটার দিকে...জানলা দিয়ে অহনা একবার হাতটা নাড়ে...অহনার মুখের উপর দিয়ে ভেসে ওঠে মায়ের মুখ, অহনার যুঁইফুলের মতো সুন্দর মুখখানা আর নিজের মায়ের মুখখানা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় শ্রাবণের চোখে।




বৌদির সাথে শ্রাবণের সম্পর্কটা বেশ সখ্যতার। অসীমার বাপের বাড়ি জয়েন্টফ্যামিলি। অনেক ভাইবোন। তাই একটা মাত্র দেওর তার কাছে খুব বেশী বোঝা বলে মনে হয়নি কোনদিনই। কিন্তু অর্পনের একার রোজগার, তার থেকেও কিছুটা দেশের বাড়িতে পাঠাতে হয়, তাই অর্পন যখন শ্রাবণের ব্যাপারে কিছু বলে, সে মেনে নিতেই বাধ্য হয়। কারণ তার ছেলেটাও বড় হচ্ছে, তার লেখাপড়া, শখ আহ্লাদ, এসবের জন্য খরচ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তা সত্ত্বেও অসীমা শ্রাবণের জন্য একটু আধটু ভাবে। তাই শ্রাবণ যখন হঠাৎ এসে বলে , “বৌদি , ভাল খবর আছে”। অসীমা ভাবে, কোন চাকরির খবর এসেছে, ভীষণ খুসি হয়ে হাঁকডাক করতে থাকে, “শুনছ, শুনছ, শুবুর এতদিনে ভাল খবর এসেছে...কবে থেকে জয়েন করতে হবে শুবু?”

---যাচ্চলে! সেখবর নয় বৌদি...এটা অন্য কেস।।

---সে যে কোন জায়গায় হলেই হোল, এরপরে একটা বিয়ে দিয়ে দেব, এরকম রাজপুত্তুরের মতো চেহারায় নইলে নজর লেগে যাবে।

---হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, সেই চেষ্টাটাই আগে করোতো

---মানে?

---মানে চাকরি নয়, একজনের সাথে আলাপ হয়েছে

---এতক্ষণ তুমি আমার সাথে ঠাট্টা করছিলে?

---কি সুন্দর দেখতে বৌদি!! সে বলেছে , আমার নাকি গানটাই হবে, তুমি জানো...মাও তাই বলেছিল...

---ওও...প্রেরণা!!! তা সে প্রেরণাদাত্রীর নামটা কি শুনি?

---এই যাহ!! নামটা জিজ্ঞেস করতেইতো ভুলে গেছি

--- তবে আর কি? চাকরি বাকরির চেষ্টা ছেড়ে এখন ঐ গানের স্কুলে ভর্তি হও।

---চেষ্টা কি করছিনা বৌদি? কিন্তু কিছুই তো হচ্ছে না...দেখি না একটু গানের লাইনটায়, যদি কিছু হয়? আচ্ছা বৌদি, তোমার বাপের বাড়িতে তো তোমার তানপুরা, হারমোনিয়ম সব আছে, তুমি কতদূর গান গেয়েছিলে?

---সেতো আমি পিওর ক্লাসিক ও শিখেছি, বাংলা আধুনিকো শিখেছিলাম...কিন্তু বিয়ের পর গত বারো বছরে সব মর্চে ধরে গেছে।

---মরা হাতি লাখ টাকা, আমি কালই তোমার ওবাড়ি থেকে সব নিয়ে আসব। তুমি দুপুর বেলায় আমায় একটু একটু করে শেখাতে পারবে না? তুমি দেখো, যে কোন গান, আমি একবার শুনলেই...

---শুধু গান তুললেই হবে না শুবু, রেগুলার রেওয়াজ করতে হবে, দুপুর বেলায় তুমি কোথায় কোথায় টই টই করে বেড়াও...ওসব করলে এটাও হবে না...আর অন্য সময়ে তোমার দাদা থাকবে, তার সামনে এসব করা যাবে না, তুমি একটা চাকরি পেয়ে গানবাজনা করো, সে সেটা মেনে নেবে, কিন্তু এই অবস্থায় না।

---আচ্ছা, শুধু দুপুর বেলাটুকু করব, এখন থেকে আর কোথাও যাবো না...তাহলে হবে তো? কাল তবে তোমার জিনিসগুলো নিয়ে আসি?

---আচ্ছা নিয়ে এসো।




অসিতরঞ্জন ভট্টাচার্য্য , হিন্দুস্থান অ্যালয় স্টীলের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার, স্বভাবতই খুব রাশভারি প্রকৃতির মানুষ। একমাত্র মেয়েকে তিনি সবরকম সুখ ও স্বাচ্ছ্যন্দেই মানুষ করেছেন। কিন্তু মেয়ের অনেক দেরি করে বাড়ি ফেরাটা তিনি মোটেই বরদাস্ত করেন না। অহনাকে বরাবরি বলা আছে, যতই দেরি হোক, পড়া থেকে বা গানের ক্লাস থেকে, রাত আট টার মধ্যে বাড়ি ঢুকতেই হবে। রাত সোয়া নটায় তাকে ফিরতে দেখে তিনি যথেষ্ট রুষ্ট হয়েছেন, কিন্তু তা সত্তেও গলার স্বরকে স্বাভাবিক রেখেই জিজ্ঞেস করলেন,

----“ কি ব্যাপার? এতো দেরি?”

----“ আসলে বাবা, আজ তো দিদি অনেক দেরি করে ছাড়লেন, কোন ট্যাক্সিও পেলামনা, বাসেই আসতে হোল, আর তাছাড়া...”

---“তাছাড়া?”

---“আসলে গানের স্কুলের সামনে একটি ছেলের সাথে আলাপ হোল, কি ভীষণ ভালো গায় বাবা, কিন্তু গান টান শেখে নি...ওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই...”

---“তুমি কি আজকাল রাস্তার ছেলেদের সাথে আলাপ করতে গানের স্কুলে যাচ্ছ?”

চড়াৎ করে কথাটা অহনার গায়ে লাগে, “ও রাস্তার ছেলে নয় বাবা, ও এম এ পাস করে চাকরি খুঁজছে”

---“ ওওও...কি নাম তার?”

এতক্ষণে অহনার খেয়াল হয়, ও তো তার নামটাই জানে না, এই দুদিনে জিজ্ঞাসাও করা হয় নি...বোকার মতো বলে, “জানি না তো বাবা”

---“বেশ, এখন শোন, তোমার ফাইনাল এক্সাম এসে গেছে, নেক্সট দিন গানের ক্লাস এ গিয়ে বলে দেবে আর যাবে না তুমি এখন, আরো শোন, তোমার এক্সাম কমপ্লিট হলেই মিহির আসবে অনির্বাণ কে নিয়ে, তোমার মনে আছে তো? আমি ফাইনাল কথাটা সেরে নিতে চাই”।

অনির্বাণ গাঙ্গুলী। মিহির গাঙ্গুলীর একমাত্র ছেলে। আর মিহির গাঙ্গুলী হলেন অসিতরঞ্জনের আবাল্যসুহৃদ, ক্রিমিনাল ল’ইয়ার। অনির্বাণকে চেনে অহনা ছোট থেকেই। বিয়ের সম্বন্ধটা হয়েছে গত ছমাসে। অনির্বান আছে ইনফোসিসে। বাঙ্গালোরে। সফট-ওয়ার এঞ্জিনীয়ার। এর মধ্যে কয়েকবার ফোন ও করেছে সে অহনাকে। অহনার কোন আপত্তিও ছিলনা। তাই অহনা চুপই করে থাকে।

এ বাড়িতে মা হোল অহনার সবচেয়ে বড় বন্ধু, আজ অবধি কোন কথা সে মাকে গোপন করে নি। খেয়ে দেয়ে নিজের ঘরে যাবার আগে মাকে বলে অহনা, “আচ্ছা মা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

মা বলেন, “কি রে?”

---“ তোমার তো অ্যারেনজড ম্যারেজ?...তুমি বিয়ের আগে কারোর প্রেমে পড়েছিলে?”

---“ এ আবার কিরকম প্রশ্ন?”

---“বলো না...বলো না মা”

মা একটু চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, “আমাদের বাড়ি খুব গোঁড়া ছিল। কাস্ট মানতো খুব। তাই প্রবুদ্ধরা দাসগুপ্ত ছিল বলে আমার মা বাবা মেনে নেননি। আমি মা বাবার অমতে কোন কাজ করব ভাবতেই পারতাম না। তাই.........”

---“ আচ্ছা , মা, তুমি সুখী হয়েছো?”

---“তোর মতো মেয়ে যার আছে, সে সুখী না হয়ে পারে?...নে অনেক বকবক করেছিস, এখন আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়”...মা চলে গেলেন।

অহনা বুঝলো মা কি সুন্দর কথাটা এড়িয়ে গেলেন...ও ভাবতে লাগল...আচ্ছা সুখ কি? আগে যা হোত না এখন তার হচ্ছে কেনো?...বুকের ভিতরটা এরকম জ্বালা জ্বালা করছে কেনো? অথচ শারীরিক কোন তো কষ্ট নেই...কত কিছু ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ল, আর ঘুমের ভিতর তার কপালের উপর একজোড়া ভীষণ পবিত্র শিশুর মতো চোখ জ্বল জ্বল করতে থাকল, করতেই থাকলো...




শনিবারদিন একটু আগে থেকেই শ্রাবণ গিয়ে বসেছিল রকে। অহনাকে দূর থেকে আসতে দেখে উঠে কাছে এলো।

অহনার , ওকে দেখেই কেনো জানিনা, একটা ভীষণ রাগ বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে,

“ কি? কি চাই আপনার? কেনো আমাকে এভাবে ডিস্টার্ব করেন আপনি?”

---“ আমি? ডিস্টার্ব করি?”...শুকিয়ে পাংশু হয়ে গেলো শ্রাবণের মুখ... “আমি শুধু বলতে এসেছিলাম , আপনার কথা মতো আমি গানের রেওয়াজ আর চর্চা ...” শেষ করতে পারলনা সে, অহনা ওকে ধাক্কা দিয়ে স্কুলের গেটে ঢুকে গেলো...

হতভম্বের মতো শ্রাবণ দাঁড়িয়ে রইলো বাইরে।

সেদিন সুরমাদি একটা নতুন গান তোলাচ্ছিলেন, “ তিমির অবগুন্ঠনে বদন তব ঢাকি ...কে তুমি মম অঙ্গনে দাঁড়ালে একাকি...”...না , কোনকিছুই কানে যাচ্ছিল না অহনার, বুকের ভিতর ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিল, মাথাটা কিরকম খালি খালি লাগছিল, সুরমাদি জিজ্ঞেস করলেন ,“ শরীর খারাপ করছে নাকি তোমার?”...অহনা বলল, “ কৈ , নাতো?”

---“নাহ।।আজ তোমার কিছু একটা হয়েছে। আজ তুমি বাড়ি যাও”।

অহনা ব্যাগটা তুলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো স্কুল থেকে। রকের দিকে তাকালো। না সে নেই। হটাৎ দেখল নিজের দুচোখের পাতা জুড়ে জল জমা হয়েছে। জলটা মুছে, ও রকের দিকে এগিয়ে গেলো। একজনকে বলল, “উনি নেই?”

সে বলল, “কে? শ্রাবণ?...নাতো আজ একটুখানি ছিল। কিন্তু কি যেনো একটা হয়েছে ওর। কিরকম লাগছিল ওকে। ছটফট করতে করতে চলে গেলো”

...শ্রাবণ শ্রাবণ , ওর নাম তবে শ্রাবণ... “আচ্ছা ওনার কোনো নাম্বার আছে?”

---আছে, তবে ল্যান্ড নাম্বার, ওর নিজের কোন মোবাইল নেই।

---সেটাই দিন।

---সেটাতো আমাদের কাছে নেই।

---ও আচ্ছা। হতাশ হয়ে ও পা চালায় রূপবানীর দিকে।

আজ আর পা যেনো চলছে না অহনার। কেনো এরকম হচ্ছে...বুকের ভিতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে কেনো?

রুপবাণী অবধি যেতেই মনে হচ্ছে রাত ফুরিয়ে যাবে। সিনেমার সামনের লাইটপোস্টে হেলান দিয়ে কে দাঁড়িয়ে আছে? কে?

---“আমি.”..শ্রাবণ এগিয়ে আসে। “ আমার সাথে আজ তুমি এরকম ব্যবহার করলে কেন? আমি কি করেছি বলো?।।আমি কি করেছি?”...শ্রাবণের গলা দিয়ে যেনো আর্ত চিৎকার বেরোয় ।

অহনা অতিকষ্টে নিজেকে সামলায়, যতটা পারে, গলাটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে, “ তুমি কিচ্ছু করোনি, আমার কথাটা মন দিয়ে একটু শোন। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, অনির্বাণ গাঙ্গুলী বলে একজনের কাছে আমি বাগদত্তা , সে বাঙ্গালোর-এ চাকরি করে, যোধপুর পার্কে বিশাল ফ্ল্যাট, ওখানেই আমার শ্বশুরবাড়ি হতে যাচ্ছে, আমার পরীক্ষা আগামী সপ্তাহ থেকে শুরু, পরীক্ষা শেষ হলেই আমার বিয়ে। আমি এই গানের স্কুলে আর আসব না। আজকেই আমার শেষদিন ছিল”...একদমে বলে গেলেও গলাটা কেমন করছিল অহনার...আর শ্রাবণ কোন কথা বলছিল না, একদৃষ্টিতে অহনার দিকে চেয়েছিল...একটা ট্যাক্সী এসে দাঁড়াল সামনে, অহনা গেট খুলে ভিতরে উঠে গেল। জানলা দিয়ে মুখটা বাড়িয়ে বলল, “ তুমিতো আমার নামটাও জানোনা শ্রাবণ, আমি অহনা”...ট্যাক্সীটা ছেড়ে দিল...একটু বাদে মিলিয়েও গেলো।

না। শ্রাবণ কাঁদে নি। শ্রাবণের চোখ থেকে একফোঁটাও জল পড়েনি। শুধু ও ভিতরে ভিতরে পাথর হয়ে গেলো।




এক আশ্চর্য্য পরিবর্তন হয়েছে ছেলেটার, এখন দাদার সামনে পিছনে মানছেনা, শুধু ঘুমটুকু বাদ দিয়ে উন্মত্তের মতো রেওয়াজ আর রেওয়াজ করে চলেছে শ্রাবণ সেন, যেনো এই সাতাশ বছরে যে রেওয়াজ হয় নি, এক বছরে তা করে ফেলবে, যেনো ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়েছে সে, উন্মত্ত গতিতে সংগীতের সমুদ্রকে গিলে ফেলতে হবে তাকে, যেনো তার হাতে সময় খুব কম...দাদাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছে, “ দাদা, আমায় শুধু পাঁচটা বছর সময় দাও, কথা দিচ্ছি, তোমায় এই হাতিবাগানের ভাড়া বাড়িতে থাকতে হবে না, যোধপুর পার্কে যদি আমি তোমায় ২৫০০ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট কিনে না দিতে পারি, আমি গ্রাম এ গিয়ে চাষ করব, বাবাকে জানিয়ে দাও, মায়ের চিকিৎসার জন্য যত জমি তাঁকে বিক্রি করতে হয়েছে, সব জমির এখনকার দাম হিসেব করে রাখতে, আমি কথা দিচ্ছি পাঁচ বছরের মধ্যে সব জমি তাঁর কাছে ফিরে আসবে”।।সে বলেছে আর তার সেই চোখ দুটো ধ্বক ধ্বক করে জ্বলেছে...দাদা বিশ্বাস করেছে, বলা যায় বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে।




অহনার সামনের ফোনটা বেজে উঠল...

ফাইলটা দেখতে দেখতেই অন্যমনস্ক ভাবে ফোন টা কানে লাগাল সে...

---“হ্যালো, কে অহনা? আমি বলছি রে...শর্মি, শর্মিষ্ঠা”...একটা প্রানোচ্ছল কন্ঠ ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এল।

---“আরে তুই?, এতদিন বাদে?...বিয়ের পর গত দুবছর যে কোথায় গেলি?” অহনাও খুসিটা চেপে রাখতে পারল না।

---“আসলে ওর তো বাঙ্গালোর হয়ে দিল্লি তে ট্রান্সফার হোল...আর আমার মোবাইল্ টাও হারিয়ে গেলো, ব্যাস, সব নাম্বার গায়েব, শোন আমি দুদিন হোল কলকাতায় এসেছি, অল্প কদিন থাকব, আজি চলে আয় আমার বাড়ি, কত কষ্ট করে যে তোর ফোন নাম্বারটা পেলাম কি বলব!!” শর্মিষ্ঠা কলেজ লাইফের সবচেয়ে প্রিয়বান্ধবী ছিল অহনার।

---“ এই নারে। আজ পারব না, আজ অফিস ক্লোজিং এর পর অফিস কালচারাল ক্লাবের মিটিং আছেরে, অ্যাটেন্ড করতেই হবে, কাল চলে যাব সন্ধেবেলা...ওকে?”

---“ তুই কি বিয়ে টিয়ে করবিনা ঠিক করেছিস নাকি রে?”

---“ তোদের সকলের এই একটাই কথা...করবনা বলিনিতো...কিন্তু যাকে করব, তাকে পাই আগে। ..জানিস তুই? বাবার মৃত্যুর পর যখন বাবার চাকরিটা পেলাম, সেই থেকে বাবার বন্ধুরা আর মা মিলে অন্তত একশ সম্বন্ধ এনেছে...এই সাড়ে চার বছরে। যাকে তাকে বিয়ে করে নিলেই হোল?”

---“ কিন্তু তুই যে কেনো আল্টিমেটলি কার্ড ছাপিয়ে বিলি করার পরো বিয়ের একুশদিন আগে অনির্বাণের সঙ্গে বিয়েটা ভেঙ্গেছিলি তা কিন্তু আজো আমি জানিনা, মনে হয় মাসীমাও জানেন না, আর তুই যতই অস্বীকার করিস, সেটা কিন্তু একটা বড় কারণ মেশোমশাইএর হার্ট-ফেলিওরের, যাকগে, এসব কথা বললেই তো তোর আবার গোঁসা হবে, কাল আয়, বাকি ঝাড় কালকের জন্য ডিউ রইল...এখন ছাড়ি”

---“হাহাহা, তুই আর বদলালি না, আচ্ছা যাব ঝাড় খেতে...কিন্তু কিছু খেতেও দিস...রাখি”।

......কিকরে বলে অহনা, ঐ বিয়ে না ভেঙ্গে তার আর কোন উপায় ই ছিলনা, সারা শরীর এর ভিতর যদি কারোর সোঁদা হাওয়ার গন্ধ থাকে, বৃষ্টির গন্ধ থাকে , প্রকৃতির গন্ধ থাকে, সে কিকরে , যে কাউকে বিয়ে করতে পারে? অহনার তো তাকেই চাই, সমস্ত মন, শরীর , আত্মা জুড়ে সেই অবয়বটা...আর তার সেই অদ্ভুত পবিত্র দুটো চোখ......




এখন বৌদিকেই সেক্রেটারির কাজটা করতে হচ্ছে, প্রতিদিন ই প্রায় প্রোগ্রাম শ্রাবণের। ডেট মাথায় রাখতে পারে না সে, সারা পশ্চিমবঙ্গের কোথায় না অনুষ্ঠান...ঘরে তো তার থাকাই হয়ে ওঠে না। মিন্টুর সঙ্গে খেলাও হয়না। তবে যেখানেই যায়, তার কাকুর জন্য খেলনা আনাটা বাঁধা। আর কলকাতায় থাকলে তো কথাই নেই, প্রতি সন্ধেই তার বুকড। মধুসূধন মঞ্চ, রবীন্দ্রসদন, বিড়লা সভাঘর দৌঁড়োতে দৌঁড়োতে জানান্ত।

পরপর দুটো এলবামো হিট। প্রথম প্রথম অনুষ্ঠান গুলোতে বৌদি , মিন্টুকে নিয়ে যেতো। এখন আর পারেনা। প্রতিদিন ঘর-সংসার ফেলে কাঁহাতক আর ছোটা যায়?

কলকাতার দিনগুলোতে, ফিরতে প্রত্যেকদিন রাত এগারোটা...বৌদি জেগেও থাকে খাবার বেড়ে দেবার জন্য। কখনো কখনো খারাপ লাগে শ্রাবণের। সারাদিন বৌদি এত কাজ করে, মিন্টুর দেখভাল, দাদার যাবতীয় খুঁটিনাটি, তার ওপর তার জন্য এই রাত বারোটা অবধি জেগে বসে থাকা, ভোর পাঁচটায় ওঠে বৌদি। কোনকোনদিন বলেও ফেলে সে, “খাবারটা ঢাকা রেখে শুয়ে পড়লেইতো পারো বৌদি, তোমায় অত ভোরে উঠতে হয়”!

---“ সেইজন্যই তো বলছি, এবার একজনকে নিয়ে এসো, কতদিন আর আমি এই হ্যাঁপা সামলাব?”

---“নাহ, ঐটা বাদ দিয়ে বলো বৌদি, ওসব পাট আর আমার জন্য নয়”

---“ কেনো? কারোর জীবনে কি কোন মিস-হ্যাপ ঘটে না? সে কি সারাজীবন ধরে তার জন্য দেবদাস হয়ে বসে থাকে, তাও এই যুগে?”

---“ একটা ভাল মেয়েকে নিয়ে এসে সারাজীবন ধরে দগ্ধাবার কি মানে হয় বৌদি? সেতো কিছুই পাবে না”...

---“কিন্তু তোমার দাদা বলছিল, যোধপুর পার্কের নতুন ফ্ল্যাটে যাবার আগে একেবারে তোমার বৌ সমেত গেলেই ভালো”

---“কিন্তু আমি তো দাদাকে ফ্ল্যাট দেবো বলেছিলাম, বৌ দেব তো বলিনি”

---“তোমার সাথে কথায় পারা খুব মুসকিল”...বলতে বলতে বৌদি উঠে যায়;

চেনে তার এই দেওরটিকে অসীমা। এই কথোপকথোন প্রায়ই হয় দেওর বৌদির। আর মুখে যাই বলুক , অসীমা মনে মনে সেলাম করে তার এই দেওরটিকে, এই ডিজিটাল যুগে যখন সম্পর্ক বদলে যাচ্ছে প্রতি আধ-ঘন্টায়, সেখানে একটা স্মৃতি আঁকড়ে বছরের পর বছর...নাহ ছেলেটা এই যুগের না।

আজো খেতে খেতে সাড়ে এগারোটা বাজল, বৌদির সাথে কথা বলতে বলতেই ওয়াল-ট্রের ওপর রাখা টেলিফোনটা ডেকে উঠল তারস্বরে।

---“এতো রাতে?” একটু অবাকি হোল শ্রাবণ।

---“ওওওও, তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, আজ দুপুরবেলা একটা ফোন এসেছিল, একটা প্রোগ্রামের, আমি একটু বেশি রাত করে করতে বলেছিলাম, দেখো, হয়তো সেই ফোনটাই”...বৌদি রান্নাঘর থেকে বলে ওঠে।

---“আমি কি শ্রাবন সেনের সাথে একটু কথা বলতে পারি?”, ওপাশ থেকে ভারি সুন্দর গলার এক মহিলার কন্ঠস্বর ভেসে আসে ।

---“হ্যাঁ, বলছি , বলুন”...কিন্তু কিছুই শোনে না শ্রাবণ, এ কার গলা? কার গলা? কোন ভুল হচ্ছে না তো তার? এই গলাটা যেনো বহু বছরের ওপার থেকে ভেসে এলো!!

---“ আগামী ১৮ ই জানুয়ারী কিন্তু...কলামন্দিরে, একটু দেখুন না, আপনি ফ্রী আছেন কিনা? আমি আপনার গানের ভীষণ ফ্যান, আমিই আপনার কথাটা আমাদের অফিস রিক্রিয়েশন ক্লাবকে বলেছিলাম্‌, আপনার দুটো এলবামই দারুন, আচ্ছা আপনার কোন ছবি নেই কেন এলবামে”...বলেই চলেছে ওপাশের বামাকন্ঠ।

“দেখছি, এক মিনিট”... , ডায়রী উলটে বলে, “ কাল কাউকে পাঠিয়ে দিন অগ্রিম সমেত, আমি ফ্রী আছি, চারটের আগে পাঠাবেন, আর প্রথমটা রিমেক আর পরের টা রবীন্দ্রসংগীত, নিজের গান যখন গাইব, তখন নিজের ছবি দেব”

ফোনটা রেখে দেয় ও। কার গলা ছিল ? নামটাও তো জিজ্ঞেস করতে পারত? কখনই কি ঠিক কাজটা ঠিক সময়ে করতে পারবে না সে? দূর!!! এখন আর জেনেই বা কি হবে? খামোখা নিজের কষ্টটাকে আবার খুঁড়ে বের করার কিই বা মানে হয়? নাহ ভুলও হতে পারে, এখানে তো তার থাকারই কথা না। নিজেই নিজেকে স্তোক দিয়ে ঘরে ঢুকে যায় শ্রাবণ।

আজ রাতে আর ঘুম আসবে না তার, সে বুঝতে পারে......


১০

মিন্টোপার্কের জ্যামে শ্রাবণের ভ্যাক্স-ওয়াগনটা দাঁড়িয়ে ছিল ডানদিকের ফুটপাথ ঘেঁষে। এখানে অন্ততঃ পাঁচ-মিনিট। অফিস টাইমের জ্যাম শুরু হয়ে গেছে। বিকেলের আলো এখনও ফুরোয় নি। শহরের বুকে এই সন্ধে নামাটা দেখলে এখনও তার মনে পড়ে যায় মায়ের সেই সন্ধে-বিকেলের আলোয় তুলসিতলায় পঞ্চ-প্রদীপ জ্বালানোর কথা, পুকুর পার থেকে হাস্নুহানার গন্ধ ভেসে আসার কথা, অকারণেই চোখে জল আসে তার, সেটা এড়াতেই, স্টীয়ারিং এর উপর হাত রেখে ডানদিকে মুখটা ঘোরালো শ্রাবণ। আর, মরা বিকেলের আলো জীবন্ত হয়ে উঠল।

কে দাঁড়িয়ে ঐ ফুটপাথে? অহনা না?

অহনাও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে শ্রাবণের দিকে । যেনো বিশ্বাস করতে পারছেনা নিজের চোখ কে।

হাজার যোজন নৈঃশব্দ ভেঙ্গে শ্রাবণই বলল, “ কি দেখছ? উঠে এসো গাড়িতে, সিগ্ন্যাল ছেড়ে দেবেতো এখুনি”...অহনা যেনো মন্ত্রমুগ্ধের মতো গাড়িতে এসে বসল।

তাকিয়েই আছে অহনা, এমনও হয়, কি সুন্দর দেখতে হয়েছে মানুষটাকে, সেই উস্কোখুস্কো চুল, খোঁচাখোচা দাড়ির ছেলেটা নেইতো আর...তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ও টের পেল বহুবছর আগের সেই গন্ধটা ভেসে আসছে পাশ থেকে, এটা স্মৃতি নয়, এটা টাটকা, ও কিরকম আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে, আর টের পেল, নিজের শরীর থেকে , বুকের ভিতর থেকে ফুলের গন্ধ বেরিয়ে আসছে, ফুলের সবকটা পাপড়ি খুলে যাচ্ছে, ভিতর থেকে এক প্রবল জলস্রোত ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে আর কিছু পাওয়ার নেই, এটুকুর জন্যই ও অপেক্ষা করেছিল এতো বছর।

---“তুমি কি এখন কলকাতায়? যোধপুরের সেই ফ্ল্যাট-এ”? নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো শ্রাবণ

---“যোধপুরের ফ্ল্যাট? কৈ নাতো? আমিতো সেই শিয়ালদার বাড়িতেই থাকি।”

---“আর অনির্বাণ?”

---“অনির্বাণ? তোমার মনে আছে? সে বিয়ে তো হয়নি আমার”

---“হয়নি???কেনো?”

---“আমি ভেঙ্গে দিয়েছিলাম, বিয়ের একুশদিন আগে”

---“কেনো?”

কোন উত্তর দেয়না অহনা, মুখটা বাঁদিকে ঘোরায়, শ্রাবণ লক্ষ্য করে অহনার চোখ দিয়ে আস্তে আস্তে জলের ধারা নেমে আসছে...একটু পরে অহনাই বলে, “ গাড়িটা তোমার?”

---“হ্যাঁ”,

---“ চাকরি না ব্যাবসা? কি কর এখন?”

---“ ঐ ফ্রী ল্যান্সিং বলতে পারো”

কথা বলতে বলতে গাড়িতে সিডি চালিয়ে দেয় শ্রাবণ, নিজের। অহনা এতোক্ষনে হাসে, সেই যুঁইফুলের মতো হাসি, বলে “ কি অপুর্ব গান না ভদ্রলোক? দুটো সিডিই কিনেছি, ওনার গান শুনলে মনে হয় আমি কোথাও ভেসে যাচ্ছি, আমার গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে যায়”

---“ তেমন কিছু তো লাগেনা আমার। ঐ মোটামুটি আর কি”

---“ জেলাস? নিজের গান হয়নি বলে?”

অট্টহাস্য করে ওঠে শ্রাবণ। জেলাসই বটে।

হঠাৎ ই জিজ্ঞেস করে অহনা “বিয়ে করেছ?

---“ সেতো কবেই করেছি, কতদিন আগে!!”

---“ওহ...” চুপ করে যায় অহনা। মুহূর্তের পূর্ণতা আচমকাই অপার শূন্যতায় ঢাকা পড়ে যায়।

ইতিমধ্যেই গাড়ি যে কখন যোধপুর পার্ক এরিয়ায় ঢুকে পড়েছে অহনা খেয়ালো করেনি। সম্বিত ফিরে পায় শ্রাবণের কথায়, “ একবার নামোতো এখানে”

অহনা বলে ------“একি? এতো যোধপুর পার্ক। এখানে এলাম কেনো”?

উল্টোদিকের এপার্টমেন্টএর দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় শ্রাবণ, “ঐটার ফোর্থ ফ্লোরে আমার নতুন ফ্ল্যাট, পছন্দ?”

---“ আমি পছন্দ করে কিকরব? তোমার আর তোমার স্ত্রীএর পছন্দ হলেই হবে। শোন, ভালই করেছ এদিকটায় নিয়ে এসে, আমার এক বান্ধবীর বাড়িতে যাওয়ারো ছিল, একবার ঘুরে যাব ওদের বাড়ি, তুমি চলে যাও শ্রাবণ...আমি পরে বাড়ি ফিরব”

---“শোন অহনা, শোন...”...শ্রাবণ কিছু বলতে যায়...কিন্তু অহনা আর দাঁড়ায় না...হনহন করে হাঁটা লাগায়।


১১

১৮ই জানুয়ারীর অনুষ্ঠানটায় দাদা নিজে থেকে বলল “এবার আমি শুনতে যাব”...তারমানে বৌদি আর মিন্টুও যাবে। শ্রাবণ ভীষণ খুসি হয়েছে তাই, অনেকদিন পর তার কোন অনুষ্ঠানে পুরো পরিবার যাচ্ছে। ও সেটা আগে থেকেই অর্গ্যানাইজারদের জানিয়ে দিয়েছিল। অনুষ্ঠান শুরু হবার আগে ঘোষক সেটা আবার জানিয়েও দিল। অহনা বসেছিল সেকেন্ড রো তে। নিজেদের অফিসের প্রোগ্রাম বলে কথা, পুরোটায় থাকতে হবে। ঘাড় উঁচু করে সে একবার দেখল , তার মানে শ্রাবণবাবু এখনো বিয়ে করেননি। মঞ্চে শ্রাবণ এসে হারমনিয়মে হাত রাখল, আর অহনার বিশ্ব অন্ধকার হয়ে গেলো, ও কাকে দেখছে!!, এই শ্রাবণ মানে ওই শ্রাবণ, মনে হোল সে আর বসে থাকতে পারবে না, সে এবার পড়ে যাবে, কোনমতে ব্যাগ থেকে একটা চিরকূট বের করে খস-খস করে দুটো কথা লিখে স্টেজে পাঠিয়ে দিল। তারপর টলতে টলতে বেরিয়ে গেলো।

টানা দুঘন্টার অনুষ্ঠান শেষে সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে কলামন্দিরের গাড়ি পার্কিং জোন এ নিজের গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ায় শ্রাবণ। দূরে সিমেন্টের বেঞ্চিতে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে অহনা। খুব আস্তে আস্তে ওর দিকে এগিয়ে যায় শ্রাবণ। কাছে গিয়ে ডাকে, “অহনা”

ছিলার মতো উঠে দাঁড়ায় অহনা,

অহনার ঠোঁট কাঁপছে, সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে...অস্ফুটে বলে, ---“চীটার”

শ্রাবণ হাসে, এই প্রথমবার তার কান লাল হয়না, প্রশান্তির হাসি ছড়িয়ে পড়ে ওর মুখে। অহনা খামচে ধরে ওর দামী পাঞ্জাবীটা, আবার বলে , “চীটার, চীটার, চীটার”।।আর অহনার শরীর ভেঙ্গে আসতে থাকে, বিবশ হয়ে যেতে থাকে, সেই ভয়ঙ্কর মাতাল বৃষ্টির গন্ধ, সোঁদা হাওয়ার গন্ধে সারা শরীর ভিজে যেতে থাকে, অহনার শরীরের কোন ভর থাকে না, শ্রাবণ খুব আলতো করে ওকে জড়িয়ে ধরে এক হাত দিয়ে , আরেক হাত দিয়ে থুতনিটা তুলে ধরে, মুখটা অহনার মুখের খুব কাছে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে , “আমাকে বিয়ে করবে অহনা?”

অহনা বেতস পাতার মতো লুটিয়ে পড়ে শ্রাবণের বুকের উপর, আর ফিসফিস করে , “ না, আমার বিয়ে তো কবেই হয়ে গেছে”।

কলামন্দিরের নির্জন গাড়িবারান্দা এক অভুতপূর্ব ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে থাকে।



**********









































































গল্প - আইভি চট্টোপাধ্যায়

জৈব


সুবোধ খানিক আগে থেকেই এসি মেশিন চালিয়ে গাড়ির ভেতরটা ঠান্ডা করে রাখে । বিনায়ক অফিস ছেড়ে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে ফাইল আর ল্যাপটপ নিয়ে এগিয়ে গিয়ে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দাঁড়াল । বিনায়ক মাথাটা একটু হেলিয়ে একটা দরাজ হাসি উপহার দিলেন আজ । একটু অবাক হল সুবোধ । মুখার্জিসাহেবের হাসিমুখ দেখা যায় না । ততক্ষণে আয়েসে শরীর ছেড়ে বসেছেন বিনায়ক । এসির ঠান্ডা হাওয়া মনটা আরো ঠান্ডা করে দিল । আহ । দীর্ঘ সাত বছরের লড়াই ।

বুকপকেটেই আছে চিঠিটা । বন্ধ খাম । এখনো খোলেন নি । নন্দিনীকে খুলতে বলবেন । নন্দিনী অবশ্য এসব নিয়ে তেমন চাপে থাকে না । বরং মিসেস গান্ধী বা মিসেস শর্মা কেমন স্বামীদের অফিস, প্রোমোশন, বিদেশ-ট্যুরের গল্প করেন, তা নিয়ে বিনায়কের সঙ্গে গোপনে হাসিঠাট্টা করে । ক’দিন আগে মিসেস বাসুর কথা বলছিল, ‘কাল পার্টিতে মিসেস নায়েকের সঙ্গে মিসেস বাসু কেমন আঠার মত লেগে ছিলেন দেখেছ ? আমি ভাবছি, কি না জানি গল্প করছেন । ওমা শুনি, বলছেন নায়েকসাহেবের বিজনেস ট্যুর বেশ ভালো হল এবার, না ? পঁচিশকোটি টাকার অর্ডারটা পেয়েছেন শুনলাম।‘ খুব হেসেছিলেন দুজনেই । নায়েক আর বাসু হয়ত জানেনই না, তাঁদের অর্ধাঙ্গিনীদের আড্ডাতেও কেমন অফিসের অর্ডার, সাপ্লায়ার, বিজনেস ডীল মিশে থাকে ।

মিসেস বাসু নন্দিনীকে একদিন বলেছেন, ‘মিস্টার মুখার্জির চাকরি, আবার আপনার চাকরি । কি করে সামলান সব? এই তো অফিসে সাবস্টাফ রিক্রুটমেন্ট নিয়ে কদিন রাতের ঘুম নেই আমার ।‘ বাইরের কেউ শুনলে মনে করবে, মিসেস বাসুই কাজটার দায়িত্বে আছেন । সুবিমল বাসুর কাজের দায়িত্ব এইভাবেই ভাগ করে নেন মিসেস দীপা বাসু ।

বাসু একদিন বলছিলেন, ‘বুঝলেন মুখার্জি, বাড়িটা ফার্নেস হয়ে আছে । এবারেও যদি চিফ ম্যানেজারের প্রোমোশনটা না পাই, বউয়ের কাছে প্রেস্টিজ থাকবে না । এক একসময় কি বলতে ইচ্ছে করে জানেন? বেশ তো সারাদিন আরামে খাচ্ছদাচ্ছ, বেড়াচ্ছ । দুপুরে বিউটিস্লিপ, বিকেলে জিম, সন্ধেবেলা পার্টি, উইকেন্ডে ক্লাব । আর কত চাও বাবা? অশান্তির ভয়ে বলতে পারি না ।‘

উদয় ঘোষাল প্রায়ই বলেন, ‘পুরুষমানুষের দুঃখ কেউ বোঝে না । অমুক কি করে তোমার আগে প্রোমোশন পেল, তমুক কি করে কোম্পানির গাড়ি পেল, ক-বাবুকে অফিস থেকে মোবাইল ল্যাপটপ সব দিল, খ-বাবু প্রতিমাসে ট্যুরে যাচ্ছে, গ-বাবুর বউ অফিসের মহিলা সমিতির সেক্রেটারি হল । তোমাকে কেন কিছু দেয় না অফিস? মাথা গরম হয়ে যায়, জানেন?’

* * * *

না, বিনায়ক সত্যিই ভাগ্যবান । নন্দিনী কোনদিন এমন বলে না । বরং অফিস নিয়ে চাপের সময় নন্দিনীর একটা কথা, ‘জীবনের জন্যেই জীবিকা, জীবিকার জন্যে জীবন নয়’, বিনায়ককে খুব শক্তি দেয় । তবু … চাকরি করতে এসে ত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে থাকা যায়? নিজের প্রাপ্য সম্মানটুকুর লড়াই ছেড়ে দিলে হয়?

ম্যানেজমেন্টের পড়ায় ম্যাসল’জ হায়ারার্কি নীড খুব মনে ধরেছিল । আব্রাহাম ম্যাসল-র হায়ারার্কি মডেল । একটা পিরামিড । জীবনযাপনে প্রয়োজনের শ্রেণীবিভাগের সূত্র । পিরামিডে পরপর পাঁচ ধাপ । সবচেয়ে নিচের ধাপ ‘সার্ভাইভাল’; বেঁচে থাকার জন্য অবশ্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা । খাদ্য, বস্ত্র .. শারীরিক সব চাহিদা । নিতান্ত জৈব চাহিদাগুলো না মিটলে পরের ধাপে পৌঁছনো হয় না ।

দুই, ‘সেফটি’; সুরক্ষা । আশ্রয় । মাথার ওপর ছাদ ।

তিন, ‘সোশাল’; সামাজিক অবস্থান । যে মুহুর্তে প্রথম দুটি চাহিদা পূরণ হয়, সামাজিক অবস্থান এবং সামাজিক স্বীকৃতির প্রয়োজন অনুভব করে মানুষ । স্বজনবন্ধুর সঙ্গে, প্রতিবেশীর সঙ্গে মিলেমিশেই মানুষ ভালো থাকে । একা একা কেউ ভালো থাকে না ।

চার, ‘এস্টিম’; শ্রদ্ধা । এই চাহিদা খুব গভীর এবং সুক্ষ্ম অভাববোধ থেকে তৈরি হয় । আশপাশের মানুষের শ্রদ্ধা, সম্মান । তীব্র আত্মসম্মানবোধ । স্বীকৃতি চাইই চাই ।

বিনায়কের এই প্রোমোশনটা যেমন । হায়ারার্কি নীডের মডেল মেনেই এই প্রয়োজন । এই চাহিদার তীব্রতায় অনেক নির্ঘুম রাত কেটেছে ল্যাপটপ আর কাজ নিয়ে । কাজের স্বীকৃতি চাই । পরিশ্রমের, মেধার স্বীকৃতি চাই ।

সবচেয়ে ওপরের ধাপে ‘সেলফ-আকচুয়ালাইজেশন’; মোক্ষ ।

নন্দিনী বলেন, যেহেতু নিচের চারধাপ পার না হয়ে মোক্ষলাভের কথা নেই, তাই কেরিয়ারের সিঁড়িটায় বড্ড চড়াই । বিনায়ক তা মনে করেন না । লড়াইটা আছে বলেই না জীবনের তাপ টের পাওয়া যায় !

* * * *

বাড়িতে ঢোকার জন্যে দুজনের কাছে দুটো চাবি আছে । রোজ নিজের চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢোকেন বিনায়ক । সন্ধেবেলা নন্দিনী টুপুরকে নিয়ে বসে ।স্কুলের পড়া হোমটাস্ক প্রোজেক্ট । এসময় নিজের কোনো কাজে নন্দিনীকে না ডাকাই ভালো ।

আজ কলিংবেলে হাত রাখলেন । প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেল । মুখবন্ধ খামটা বাড়িয়ে ধরলেন । হাসলেন । নন্দিনীর মুখেও হাসি, ‘হয়ে গেল ?’

ভেতরের ঘর থেকে দৌড়ে এসেছে টুপুর । আস্তে হেঁটে আসা টুপুরের ধাতে নেই । চোদ্দ বছর বয়স হল, এখনো ছেলেমানুষ খুব । দৌড়ে এসে ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়েছে, ‘কি হয়ে গেল ? প্রোমোশনটা?’

হেসে মাথা নাড়লেন বিনায়ক ।

‘ওয়াও । পার্টি চাই বাবা । কনগ্র্যাটস ।‘ শেকহ্যান্ডের ভঙ্গিতে হাত বাড়াল টুপুর ।

খুব মজা লাগে এসব সময় । ছোট্ট টুপুর, লাল কম্বলের ঢাকনি থেকে বেরিয়ে আসা টুকটুকে ঘুমন্ত মুখের টুপুর । বড় হয়ে গেল মেয়েটা! দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন টুপুরের হাত, ’আজই পার্টি । চলো । সেইজন্যেই তো তাড়াতাড়ি বাড়ি এসেছি ।‘

‘যাবে ? রেডি হই ? ও মাম, রেডি হই ?’

‘আজ থাক । উইকেন্ডে যাব নাহয় ।‘

এতক্ষণে নন্দিনীর দিকে ভালো করে তাকালেন বিনায়ক । কি হয়েছে ? এত নিষ্প্রাণ কেন নন্দিনী ?

‘চলো না মাম । উইকেন্ডে আবার অন্য প্রোগ্রাম হয়ে যাবে বাবার ।‘ টুপুর জোর করতে লাগলো ।

‘আচ্ছা । যাও, রেডি হয়ে নাও’, বিনায়কের দিকে ফিরলেন নন্দিনী, ‘তুমিও চেঞ্জ করবে তো? করে নাও, আমি চা আনছি ।‘ ধীর পায়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল ।

কি হল নন্দিনীর ? শরীর খারাপ ? এমন স্বভাব নন্দিনীর, শরীর খারাপ হলেও কাউকে জানাবে না । কম খাটুনি পড়ে ? অফিস থেকে ফিরেই টুপুরকে নিয়ে আজ গানের ক্লাস, কাল নাচের ক্লাস, পরশু আঁকার ক্লাস । একদিন সাঁতার, একদিন টেনিস । আবার সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে রোজ নতুন নতুন জলখাবার করে খাওয়ানো, তারপর পড়াতে বসা ।

টুপুরের জন্যে বিনায়কের একটাই কাজ । সকালে টুপুরকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া । ব্যস । স্কুল থেকে বাড়ি নিয়ে আসার কাজটা ইলা করে । সকালে নন্দিনী অফিস বেরোবার আগেই ইলা আসে । সারাদিন টুপুরকে নিয়ে নিশ্চিন্ত । অফিসের পর বাকি সময়টা নন্দিনী টুপুরকে জড়িয়ে থাকে ।

* * * *

টুপুরের চারবছর বয়স পযর্ন্ত কোন অসুবিধে হয় নি । মা ছিলেন । দশহাতে আগলে রেখেছিলেন টুপুরকে । নিশ্চিন্তে চাকরি করেছেন নন্দিনী-বিনায়ক । তিনদিনের জ্বরে মা অচিনদেশে পাড়ি দেবার পর নন্দিনী বলেছিল, ‘চাকরি ছেড়ে দিই । টুপুর একা থাকবে কি করে?’

ভালো কাজের লোক পাওয়া যাচ্ছিল না । বয়স্কা মহিলা হলে ভালো । একটাও ভালো লোক পাওয়া যাচ্ছিল না । কেউ নেশা করে, কেউ চুরি করে । কেউ বাড়ির দরজায় বাইরে থেকে তালা দিয়ে টুপুরকে একলা বাড়িতে রেখে আশেপাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে আড্ডা দেয় । শেষপযর্ন্ত এক বিধবা মহিলাকে পাওয়া গেল । তিনকূলে কেউ নেই ।

‘তুমি সারাজীবন আমাদের বাড়ি থেকো মাসি ।’ নন্দিনী বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছিল । বেশ ছিল মহিলা, রান্নার হাতটিও ভালো ছিল, বিনায়ক-নন্দিনীকে ‘ছেলে’ আর ‘বউ’ ডাকে আপন হয়েছিল । টুপুরও ‘দিদা’ বলতে পাগল । নিজের সংসার ছিল না, এ সংসারে বেশ অভিভাবকের মত ছিল পারুলমাসি ।

চারমাস নিশ্চিন্তে কাটার পর নন্দিনী যেদিন বলল, ‘পারুলমাসির টুপুরের ওপর খুব মায়া পড়ে গেছে’, তার ঠিক পরের দিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই টুপুর নালিশ করল, ‘দিদা মেরেছে ।’

খেলনার ঝুড়ি উলটে পড়ে আছে, ঘরময় ছড়ানো গাড়ি, খেলনাট্রেন, পুতুল, টেডিবিয়ার ।

নরম ফরসা গালে আঙুলের লাল দাগ, চোখের জলে মাখামাখি মুখ, নন্দিনীও কেঁদেই ফেলেছিলেন, ‘কেন মেরেছ ওকে, মাসি ? এতটুকু মেয়ে, মারতে পারলে তুমি ? কি এমন করেছে টুপুর ?’

‘দস্যি মেয়ে । সারা দুপুর একটু ঘুমোতে দেয় না । একটু চোখ লেগেছে, আর অমনি সারা রাজ্যের নোংরা এনে জড়ো করেছে । তোমাকে তো সারাদিন তো রাখতে হয় না, এখন এসে তাই সোহাগ দেখাচ্ছ ।’ পারুলমাসির এ রূপ আগে দেখেন নি নন্দিনী ।

খুব রাগ হয়েছিল নন্দিনীরও, ‘ওর জন্যেই রাখা হয়েছে তোমায় । আর কোনদিন ওকে মারবে না তুমি ।‘

‘আমার টাকাপয়সা দিয়ে দাও, আমি এবাড়িতে আর কাজ করব নি ।’ এক কথায় কাজ ছেড়ে চলে গেল । পরে খবর পেয়েছিলেন, পাশের বাড়ির উদিত ঘোষের মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কাজে লেগেছে সে । পাড়ার লোক যেন কাজের লোক ভাঙিয়ে নেবার জন্যে তক্কে তক্কে থাকে ।

আবার যত দিন লোক না পাওয়া যায়, কি অশান্তি ।

রাস্তায় অচেনা কাজের মেয়ে দেখলেই ‘আমার বাড়ি কাজ করবে ?’

অফিসের পিওনদের ডেকে ডেকে বলা । দুধ আনতে গিয়ে ডিপোর ছেলেটাকে বলা । বাজারে দোকানে রিকশাস্ট্যান্ডে মিস্টি মিস্টি হেসে ‘একটা কাজের লোক দেখে দাও না গো’ .. ‘একটা ভালো লোক দিতে পারো ?’

শেষ অবধি পাওয়া গেল ইলাকে ।

সব সময় থাকবে না । ওরও বাড়িতে বাচ্চা আছে । পাঁচ পাঁচটা ছেলেমেয়ে । বড় তিন ছেলে স্কুলে যায় । তারপর মেয়ে । কোলের ছেলে মাত্র আট মাস । মেয়েটা টুপুরেরই বয়সী । বর রাজমিস্ত্রীর কাজ করত, ভারা থেকে পড়ে গিয়ে একটা পা কেটে বাদ দিতে হয়েছে । ইলাকে তাই কাজে বেরোতে হয়েছে ।

আট মাসের কোলের ছেলে, তাই চব্বিশ ঘন্টার জন্যে থাকতে পারবে না । সকালে আসবে, সারাদিন থাকবে । শান্ত নম্র শীর্ণ রুগ্ন চেহারা, কালোর ওপর মুখখানা ভারি সুন্দর, মায়া মায়া দুটি চোখ মেলে বলেছিল, ‘আপনি কিছু ভাববেন না দিদি, আমি সব সামলে নেব ।‘

ওইটুকু কোলের ছেলে ছেড়ে থাকতে পারবে ? রোজই হয়ত কামাই করবে । সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না নন্দিনী ।

ইলা বলল, ‘আমার শ্বশুরবাবা আছেন বাড়িতে, সুবল-মুন্নী ওঁর কাছে থাকবে । ওদের বাবাও তো ঘরেই থাকে সারাদিন । আমি পারব । কাজটা আমার খুব দরকার দিদি ।‘

বিনায়কও বললেন, ‘ওকেই রাখো মণি । সারাদিন থাকছে তো । তাতেই হবে ।‘

ইলার মত লোক পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের কথা । যত দিন গেছে, ইলা এ সংসারে আপন হয়ে উঠেছে । টুপুরকে জড়িয়ে রেখেছে তো বটেই, সংসারকেও দশ হাতে জোগান দিয়েছে ।

ঠিকে কাজের মাসি আসে নি । বাসনমাজা, ঘরমোছা করবে কে? ইলা ।

রান্নার জন্য জোগাড় দেওয়া, কুটনো কোটা, মিক্সিতে দোসা ইডলির জন্যে চাল-ডাল বেটে দেওয়া করবে কে? ইলা ।

ছুটির দিনে দশবার চা কফি কে করে দেবে? ইলা ।

রোজ সমস্ত আসবাবপত্র মুছে রাখা, ছুটে ছুটে কাজ করা, কে করবে? ইলা ।

টুপুরকে ‘মামণি’ বলে ডাকে ইলা । খুব মায়ায় আদরে সে ডাক । ছুটির দিন তেলমালিশ করে নিমপাতা জলে দিয়ে কুসুম কুসুম জলে চান করানো । সর্দিকাশি হলে তুলসিপাতা-মধু খাওয়ানো । বুকে গরম তেলমালিশ করে দেওয়া । নন্দিনী নিজেও এত পারত না ।

বিনায়ক খেয়াল করেছেন, ‘বস্তীতে থাকা মানুষদের মত নয় ইলা, দেখেছ মণি ? ও টুপুরকে কক্ষণো তুই করে কথা বলে না । এত ভদ্র মেয়েটা, কেন যে কাজের লোক হল ! বাড়ির মধ্যে দশ হাতে সংসার করবে, এইটাতেই ঠিক ঠিক মানায় ওকে, না ?’

শুধু টুপুরকে কেন, নিজের ছেলেমেয়েদেরও ইলা ‘তুমি’ করে কথা বলে । ভালো সংস্কার । লেখাপড়া শিখেও এইটা শেখা হয় না সবার । বাজার করতে গিয়ে সব্জীবিক্রেতাকে, রিক্সাচালককে, বাড়ির কাজের লোককে ‘তুই’ ‘তুই’ করে কথা বলেন যে সব তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ, তাঁদের ডেকে ডেকে ইলাকে দেখাতে ইচ্ছে হয় নন্দিনীর ।বস্তীতে থাকা একটি মেয়ের এই মানসিক উত্তরণের এই ঘটনা সত্যি আলো দেখায় ।

* * * *

এমনি করে দশ বছর কেটেছে ।

টুপুর এখন চোদ্দ । ইলার মুন্নীও তাই । বড় তিন ছেলে কাজ করছে । কেউই স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে নি । আগ্রহই নেই । কাজ করছে ফার্নিচারের দোকানে, মুরগী কাটার দোকানে, কেবল টিভির কাজে । ওদের গোটা পরিবারের সঙ্গে মায়ার জড়িয়েছে নন্দিনীও । মুন্নী সুবল স্কুলে পড়ছে, নন্দিনীর জন্যেই । এই নিয়ে ইলার গোটা পরিবার কৃতজ্ঞতায় জড়িয়েছে । মনের কোণে লুকোনো নেই, নন্দিনী জানে এই কৃতজ্ঞতা প্রাপ্য নয় তার ।

টুপুর তখন ক্লাস সিক্স । হঠাত আসা বন্ধ করেছিল ইলা । পাঁচদিন আসে নি, কোনো খবরও দেয় নি । ‘আবার লোক খুঁজতে হবে মনে হচ্ছে’, বিনায়ক বলেছিলেন ।

আবার নতুন লোক ! আবার নতুন একজনের সঙ্গে টুপুরের মানিয়ে চলা । ইলার মত এত ভালো একটা কাজের লোক আর কি পাওয়া যাবে ?

অনেক ভেবে, বিনায়কের সঙ্গে পরামর্শ করে ইলাদের বস্তীতে গিয়েছিল নন্দিনী ।

‘আমি আর কাজ করতে পারব না দিদি’, ইলার শরীর শীর্ণতর, গালে চোখের জলের দাগ । মুন্নী সুবল সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়, বুড়ো শ্বশুরবাবা চোখে দেখেন না আজকাল । সেদিন গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচেছে সুবল ।

‘সারাদিন থাকা হবে না আমার । সুবল মুন্নীকে কে দেখবে ? মামণির জন্যে মনখারাপ করছে দিদি । কিন্তু আপনি চিন্তা করবেন না, আমার বোনের মেয়েকে খবর পাঠিয়েছি, মামণির কোনো অসুবিধে হবে না ।‘

ইলার পরনের জীর্ণ শাড়ি, খড়িওঠা হাত, মাটির দেওয়াল, মলিন বিছানার দিকে চেয়ে নন্দিনীর বুকের মধ্যে ব্যথা করেছিল সেদিন । ইলা কাজ না করলে ওদের চলবে কি করে ?

ইলাকে ছাড়া নন্দিনীরই বা চলবে কি করে ?

‘মুন্নী সুবলকে আমি স্কুলে ভর্তি করে দিই ? তাহলে আর সারাদিন ওদের দেখার ভাবনা থাকবে না । তুমি ভেবো না, দুজনের পড়ার সব খরচ আমার ।‘ আবেগতাড়িতা নন্দিনী বলেছিল ।

দু’হাত জোড় করে ইলা আর তার প্রতিবন্ধী স্বামী । চোখ বুজলেই ছবিটা ভেসে ওঠে । ইলাদের বস্তীতে সবাই ধন্যি ধন্যি করে । এমন কাজের বাড়ি পাওয়া ইলার ভাগ্যি, সে কথা বলে ।

শুধু বিনায়ক –নন্দিনী জানেন, ইলাকে কাজ ছাড়তে না দেওয়ার জন্যে এটুকু অর্থমূল্য কিছুই না ।

* * * *

‘কি হয়েছে ? আমায় বলবে না মণি ?’

‘আমি কি করব কিছু বুঝতে পারছি না গো’, নন্দিনী দু’হাতে মুখ ঢাকলেন, ‘এত অসহায় লাগছে আমার । খুব অপরাধী লাগছে । কি যে করি আমি ! ওহ ভগবান !’

নন্দিনীকে এত বিপযর্স্ত আগে কোনদিন দেখেন নি বিনায়ক । মায়ের অসুখ, ভাইয়ের চাকরি, বোনের বিয়ে, বিনায়কের মায়ের সব দরকারে নন্দিনী একাহাতে সামলে নিয়েছে । ওর নিজের বাবা মারা গেলেন যেদিন, শক্তহাতে মাকে জড়িয়ে ছিল । নন্দিনী শক্তি । নন্দিনী সব সময় শান্ত । স্থির ।

সেই নন্দিনী এত ভেঙে পড়েছে ! বিনায়কের কেমন ভয় ভয় করল । টুপুরকে নিয়ে কিছু হল নাকি!

ক’দিন আগেই নন্দিনী বলেছে, যত ব্ল্যাঙ্ককল আসে ফোনে । টুপুর ব্যলকনিতে দাঁড়ালে কেউ কেউ রাস্তা থেকে ইশারা করে । ইলাও বলেছে, স্কুল থেকে ফেরার পথে মোটরবাইক নিয়ে ইচ্ছে করে টুপুরের গা ঘেঁষে যায় দুটো ছেলে । অফিস গিয়েও চিন্তায় থাকে নন্দিনী । মেয়ে বড় হচ্ছে, আগলে রাখতে হয় বেশি করে । ইলাকে বলা আছে, অচেনা কাউকে দরজা না খোলার কথা । স্কুলবাস আসার অন্তত দশমিনিট আগে থেকে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকার কথা । টুপুরকে নিয়ে বাড়ি ফিরেই নন্দিনীকে ফোন করার কথা । ব্ল্যাঙ্ককল এলে কোনো রাগারাগি না করে শান্ত হয়ে ফোন নামিয়ে রাখার কথা ।

নিশ্চয় এই নিয়েই কিছু হয়েছে । বিনায়কের বুকের মধ্যে শিরশির করে উঠল ।

‘কি হয়েছে মণি ? আমায় বলো ।‘

‘মুন্নী । মুন্নীর সবর্নাশ হয়ে গেছে ।‘

মুন্নী ! কে মুন্নী ! কি সবর্নাশ হয়েছে তার ?

‘আমার মেয়েকে সবর্ক্ষণ আগলে রেখেছে ইলা, ওকে আমি কি করে মুখ দেখাব ?’

আরো গুলিয়ে গেল । ইলা এর মধ্যে এল কোথা থেকে? ইলার কাছে নন্দিনীর মুখ দেখাবার কথাই বা উঠছে কেন? চাপা কান্নায় ফুলে ফুলে উঠছে নন্দিনীর পিঠ । পাশের ঘরে টুপুরের কানে না যায় তাই কান্নার আওয়াজ চেপে রাখার চেষ্টায় মুখে হাত চাপা ।

‘মুন্নী, ইলার মেয়ে । ছোটবেলায় কত আমাদের বাড়ি আসত, টুপুরের সঙ্গে খেলা করত, মনে নেই তোমার ?’

* * * *

সত্যিই মনে ছিল না । এখন মনে পড়ল । হাঁড়িকড়াই নিয়ে রান্না রান্না খেলা .. টুপুর ‘মা’ হয়ে রান্না করছে, মুন্নী ‘ইলা’ হয়ে রান্নার জোগাড় দিচ্ছে । গাছের পাতা কুচিকুচি করে কাটা, ছোট্ট গ্যাসওভেনে ছোট্ট প্রেশার কুকার, ছোট্ট থালায় আটার গোল্লা ।

হাতে চকপেন্সিল, চশমা চোখে ‘টিচার’ টুপুর, খাতা পেন্সিল নিয়ে ‘স্টুডেন্ট’ মুন্নী ।

কানে খেলনা-স্টেথো হাতে খেলনা-থার্মোমিটার ‘ডাক্তার’ টুপুর । বিছানায় শুয়ে ‘পেশেন্ট’ মুন্নী । জোর করে ইঞ্জেকশন দেবেই টুপুর । আর মুন্নী কেঁদে কেঁদে নন্দিনীর কাছে নালিশ করছে, ‘মাসি, টুপুর আমায় ব্যথা দিচ্ছে ।‘ ইলা বলছে, ‘দেখছেন দিদি, কেমন বুদ্ধি । জানে, মামণিকে আমি বকব না, তাই আপনার কাছে নালিশ করছে ।‘

নন্দিনীর মা এসেছিলেন একবার, বিরক্ত হয়েছিলেন । ‘কাজের লোকের মেয়ের সঙ্গে টুপুরের এত খেলা কিসের, মণি?’

‘চুপ চুপ’, নন্দিনী মায়ের মুখে হাত রেখেছিলেন, ‘ইলা শুনতে পাবে । মুন্নী খুব ভালো মেয়ে, কাজের লোকের মেয়ে তো কি হয়েছে ? বাচ্চারা ওসব বোঝে না ।‘

বিনায়কেরও তাই মত । শিশুমনে শ্রেণীসচেতনতা না থাকাই ভালো ।

মুন্নীও স্কুলে পড়ছে তখন, দিব্যি স্কুলের গল্প করত টুপুরের সঙ্গে । ছুটির দিন হলেই এবাড়িতে চলে আসত ।

কবে থেকে যেন আসা বন্ধ করেছিল মুন্নী । ইলা বললেও আসতে চাইত না । টুপুরও আর মুন্নীর কথা বলত না । নিজে থেকেই শ্রেণীসচেতন হয়েছে টুপুর-মুন্নী ।

নন্দিনীও ঠিক এই কথাটাই ভাবছিল তখন ।

বারবার বলেছে ইলা, ‘দিদি, আমাকে দিন পনেরো ছুটি দেবেন ? মেয়েটা সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় । সুধীর সেদিন ওকে বড়বাজারের মোড়ে একটা ছেলের সঙ্গে দেখেছে।‘

সুধীর, ইলার বড় ছেলে । কেবল টিভির কাজ করে ।

‘আমি কদিন বাড়িতে থেকে ওকে চোখে চোখে রাখি দিদি । বস্তীর মেয়েগুলো ভালো নয় ।‘

আর একদিন বলেছে, ‘দত্তবাবুরা সারাদিনের লোক খুঁজছে, মুন্নীকে দিয়ে দিই দিদি ? তাহলে আর বাইরে বাইরে ঘোরা হবে না ওর ।‘

প্রবল প্রতিবাদ করেছেন নন্দিনী, ‘না ইলা । মুন্নীকে একটা কাজের মেয়ে কোরো না । ক্লাস এইটে পড়ছে, আর তো দুটো বছর, ম্যাট্রিক পাশ করলেই মুন্নী বদলে যাবে । ও বুঝবে, ও বস্তীর অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা ।‘

‘তাহলে আমি কদিন বাড়িতে থেকে ওকে চোখে চোখে রাখি দিদি ।‘

বিরক্ত হলেও প্রকাশ করে নি নন্দিনী । ‘বাড়িতে বসে থেকে কদিন মেয়েকে সামলাবে ইলা ? তোমার বর তো সারাদিন বাড়িতে বসে থাকে, ছেলে মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিতে পারে না ? মেয়েকে চোখে চোখে রাখতে পারে না ?’

‘ওর কথা শোনে না দিদি । সে তো জানতেই পারে না । মুন্নী বাপকে বলে, স্কুলে যাচ্ছি । স্কুলে না গিয়ে ঘুরে যে বেড়াচ্ছে তা সে বুঝবে কি করে ? আমার যে কি জ্বালা দিদি ।‘

‘তাহলে সুধীরকে বলো । বসন্তকে বলো । বোনের প্রতি ওদেরও তো দায়িত্ব আছে । তুমি একা কতদিক সামলাবে?’

মনের কাছে গোপন নেই, ইলা ছুটি নিলে যে নন্দিনীর সংসার অচল । টুপুরকে সারাদিন আগলাবে কে ? মেয়ে বড় হচ্ছে, এখন অতিরিক্ত সাবধান হতেই হয় । পড়া, প্রোজেক্ট, টুপুরের নাচের ক্লাস, গানের ক্লাস, সাঁতার । কতরকম ভাবনা । সেইসঙ্গে নিজের অফিস । বাপের বাড়ি । বিনায়কের অফিসের নানা টেনশন । ইলার সমস্যা নিয়ে ভাবার সময় কই ?

বরং মনে মনে স্বস্তি, ভাগ্যিস ইলা আছে । ভাগ্যিস ইলা কামাই করে না !

* * * *

একদিন ইলা বলেছে, ‘মুন্নীকে সেলাইস্কুলে ভর্তি করে দিই দিদি ? স্কুল থেকে ফিরে সময়টা একলা থাকে, তখন বস্তীর মেয়েগুলোর সঙ্গে মেশে । মামণিও তো স্কুলের পর কত কিছু শেখে ।’

বিনায়ক বিরক্ত হয়েছেন, ‘ইলার চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে মণি । খাবার জোগাড় নেই, শখ বাড়ছে।‘

নন্দিনীরও মনে হয়েছে, টুপুরকে এত ভালোবাসে ইলা, তবু টুপুরের নাচ-গান-সাঁতার নিয়ে মনে মনে নিজের মেয়েকে নিয়ে প্রতিযোগিতা করছে নাকি ! আরো বিরক্ত হয়েছে, যখন শুনেছে, সেলাইস্কুলে কাটিং এমব্রয়ডারী নয়, সফট-টয় বানানো শিখছে মুন্নী । পাশের ফ্ল্যাটের বাবলিবৌদির মেয়ে শেখে, বাবলিবৌদি একদিন বলছিলেন, ‘কি খরচ, কি খরচ । এক একটা পুতুল তৈরি হয়, তিনশ’ টাকা মিটার কাপড়, নরম তুলো, সিল্কের সুতো ।‘

ইলাকে বলেছিল নন্দিনী, ‘সফট-টয় না শিখে মুন্নীকে সেলাই শেখালে না কেন ? শাড়ির ফলস লাগানো, ব্লাউজ পেটিকোট তৈরি করা, বাচ্চাদের ফ্রক তৈরি করা, সালোয়ার কামিজ বানানো শিখুক । আমি তোমায় ইনস্টলমেন্টে একটা সেলাই মেশিন কিনে দেব নাহয় ।‘

ইলা গম্ভীর হয়ে জবাব দিয়েছে, ‘মেয়ের শখ দিদি । আমার ছেলেরা খরচ দেবে ।‘

ইলা বুঝি ভাবল, খরচের ভয়ে নন্দিনী কথাটা বলেছে । নাকি বাবলিবৌদির মেয়ে আর মুন্নীকে একরকম দেখা হল না কেন, সে নিয়ে অভিমান । ক’দিন মুখ গম্ভীর করে কাজ করেছে ইলা । নন্দিনীই সেধে মান ভাঙিয়েছে । ইলা ছাড়া সংসার অচল । পুরোনো সিল্কের শাড়ি দিয়েছে ইলাকে । টুপুরের সোয়েটার দিয়েছে মুন্নীর জন্যে । সুবলের জন্যে পুরোনো জিনসের জ্যাকেট ।

অফিস, সংসার নিয়ে ব্যস্ত নন্দিনী বেশ কিছুদিন ইলার সংসারের খবর নিতে পারে নি । অফিসফেরত পাড়ার মোড়ের দোকানটায় টুকিটাকি কেনাকাটা করতে ঢুকেছিল, মুন্নীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল । পরনে লাল সালোয়ার কামিজ, খুব হেসে হেসে গল্প করছিল দোকানের ছেলেটার সঙ্গে, নন্দিনীকে দেখে আড়ষ্ট ।

ভারি সুন্দর হয়েছে তো মেয়েটা । ‘পড়াশোনা ঠিক হচ্ছে তো মুন্নী ?’হেসে জিজ্ঞেস করল ।

ইলাকেও বলেছিল পরের দিন, ‘কি সুন্দর হয়েছে তোমার মেয়ে । লেখাপড়া শিখলে মুখে একটা ছাপ পড়ে । খুব ভালো লাগল আমার ।‘

ইলা মাথা নিচু করে ফেলেছে, ‘মুন্নী আর ইশকুলে যায় না দিদি । পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে ।‘

‘সেকি ! আমায় বলো নি তো !’

‘কিছুতেই কথা শোনে না দিদি । জানি না আমি কি করব । ভালো একটা ছেলে পেলেই বিয়ে দিয়ে দেব ।‘

‘না না । বিয়ে দিয়ে দেবে কি ? মাত্র চোদ্দ বছর বয়স । মুন্নীকে নিয়ে এসো কাল, আমি কথা বলব ।‘

মুন্নী আসে নি । ইলাও মুন্নীর কথা উঠলে অস্বস্তিবোধ করে । মুন্নীর স্কুলের মাইনে হিসেবে টাকাটা নেওয়া বন্ধ করে নি ইলা । নন্দিনীও বলতে পারে নি চক্ষুলজ্জায় । বারবার মুন্নীর স্কুলের কথা তুললে ইলা না ভাবে, নন্দিনী টাকার জন্যেই বলছে । তাই এড়িয়ে থেকেছে ।

অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে ইলারও দেরি হয়ে যায় । তড়িঘড়ি বেরিয়ে যায় । কথা বলার সময়ই বা কই !

তার মধ্যেই দু’চার বার ইলা ছুটির কথা বলেছে । মুন্নীর জন্যে দুশ্চিন্তার কথা বলেছে ।

‘কদিন বাড়িতে থেকে মেয়েটাকে আটকে রাখলে ভালো হত’, বারবার বলেছে । নন্দিনী বিরক্ত হয়েছে । এত করেও কাজের লোকের মন পাওয়া যায় না ।

তিনতলার ফ্ল্যাটের মৌসুমীর জন্মদিনের পার্টিতে এই নিয়ে আলোচনায় নন্দিনী সব গৃহিণীদের সঙ্গে একমত হয়েছে । মৃদুলা বলছিল, ‘এ সংসারে কে যে কাকে শোষণ করে ! এই কাজের লোকদের অত্যাচারে আমরা কম শোষিত হই?’

বাবলিবৌদিও বলেছেন, ‘গরীবের জন্যে দরদে সবাই কাঁদে, শোষণের আসল শিকার তো আমরাই । যতই দাও ওদের, কিছুতেই মন পাবে না । যখন খুশি কামাই, কিছু বলতে গেলেই কাজ ছেড়ে চলে যাবে ।‘

নন্দিনীও ইলার কথা বলেছে । ছুটি না দিলেই কেমন মুখ ভার করে । বাড়িতে চাপা অশান্তি ।

তারপর গত রবিবার থেকে কাজে আসছে না ইলা । আগামী সপ্তাহে পুজোর ছুটি । না বলেকয়ে এ সময় কামাই করা মানে নন্দিনীকেই ছুটি নিয়ে বাড়িতে থাকতে হবে । সবই জানে ইলা । তবু আসে নি ।

দু’দিন রাগ করে থেকে আজ বিকেলে ইলার বস্তীতে গিয়েছিল নন্দিনী ।

‘জানো, কি রকম অসহায়ের মত কাঁদছিল ইলা । মেয়ের এমন বিপদ, অথচ গলা ছেড়ে কাঁদতে পারছে না । জানাজানি হলে পরে মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে না ।‘

যাক, টুপুরের ব্যাপার নয় । বিনায়ক আলগোছে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন ।

হ্যাঁ, ঘটনাটা খারাপ ঠিকই । তবে এ নিয়ে নন্দিনীর এত উতলা হবার মত ব্যাপার কিছু নয় । বিনায়ক একটু বিরক্তই হলেন । আজ এমন একটা আনন্দের দিন, জয়ের দিন । নন্দিনী জানে, এই লড়াইটা বিনায়কের কাছে কতখানি । এই সাফল্য বিনায়কের কতখানি তৃপ্তি । তবু এই সামান্য কারণে নন্দিনী সেটায় বিনায়কের অংশীদার হল না ! সামান্য একটা বস্তীর ঘটনা নিয়ে শোকার্ত হয়ে রইল !

ওরা তো ওইরকমই । যখন তখন যার তার সঙ্গে .. বস্তী টস্তীতে ওইরকমই হয় । কম তো করা হয় নি ওদের জন্যে । বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে । যথেচ্ছ টাকা বিলোনো হয়েছে । ইলার জন্যে বছরে তিনবার শাড়ি, বিছানার পুরোনো চাদর, পুরোনো পর্দা, মেয়েটা তো টুপুরের পুরোনো জামা পরেই বড় হয়ে গেল । আবার কি ! ওদের বাড়ির সমস্যাতেও মাথা ঘামানোর মত সময় নেই বিনায়কের । নন্দিনীরও থাকা উচিত নয় ।

মাইনে দাও, কাজ নাও । এটাই প্রোফেশনাল দুনিয়া । হ্যাঁ, কাজ করতে গেলে ইন্টারপার্সোনাল সম্পর্কটাও জরুরী । সহানুভূতি নিয়ে কথা বলো, মাঝে মাঝে খোঁজখবর নাও, দরকার পড়লে টাকাকড়ি দাও ।

ব্যস, মিটে গেল ।

এর চেয়ে বেশি জড়াবেই বা কেন ? তোমার একটা ডিগনিটি নেই ? একটা সম্মান নেই ? বস্তী টস্তীর কেচ্ছা কেলেঙ্কারিতে জড়ানো মানায় ?

মনে মনেই একচোট ঝগড়া করে ফেললেন বিনায়ক ।

* * * *

‘আমি ইলাকে বেশি করে ধরে রেখেছি, আমার মেয়ের জন্যে, নিজের স্বার্থে । বেশি টাকা দিয়েছি । ওর লোভ বাড়িয়েছি, বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করে, সংসারের বিপদ আপদে টাকা দিয়ে । ইলা নিজের সংসার দেখতে সময় পায়নি । সেই ফাঁকে ওর মেয়ের এত বড় সবর্নাশ হয়ে গেল । কত কাঁদছিল ইলা, জানো ? আমার নিজেকে এত অপরাধী লাগছে ..’

‘শোনো মণি, এত ইমোশনাল না হলেই ভালো । নিজেকে অপরাধী ভাবছই বা কেন ?’

পলকে সিধে হয়ে বসেন নন্দিনী, ‘তুমি এই কথা বলছ ? তুমিই না বলেছিলে, ইলা শ্রীময়ী মাতৃমুর্তি ? ওকে কাজের লোক হিসেবে মানায় না, ঘর সংসারে জড়িয়ে থাকা মানায় ? অভাবে পড়ে কাজ করতে বেরিয়েছে, আমার কাছে কাজ করছে, ওর এত বড় বিপদের দিনে আমি ইমোশনাল হব না ? … তুমি জানো, আমাকে কতবার বলেছে ইলা ? দিদি আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি যাব .. দিদি, মেয়েটাকে চোখে চোখে রাখতে হবে .. দিদি, ক’দিন ছুটি দিন, মেয়েটাকে সামলাতে হবে .. দিদি, আমি কাজ ছেড়ে দিই । বলে নি ? আমরা ছুটি দিয়েছি? আমরা কাজ ছাড়তে দিয়েছি ? আমরা চাইনি । কারণ তাতে আমাদের অসুবিধে । আমি ভুলে গেছি, ইলাও আমারই মত একজন মা । টুপুর আর মুন্নী, এই এক জায়গায় দুজনেই সমান ।‘

‘টুপুরকে এর মধ্যে একদম জড়াবে না’, উত্তেজিত হয়েছেন বিনায়কও, ‘ইট’স হার প্রবলেম । ইলা কেন ঘর আর বার ঠিক ঠিক ব্যালান্স করে চলতে পারে নি ? তুমি আমায় একটা কথা বলো । তুমি তো সবসময় বলো, তুমি আর ইলা একই গোত্রের মানুষ, কারণ তোমাদের দুজনকেই সংসারের প্রয়োজনে ঘর ছেড়ে বাইরে কাজ করতে বেরোতে হয়েছে । তোমার কথা ধরেই প্রশ্ন করি, তোমার সংসারের কোনো অঘটনের জন্যে কি তোমার অফিস দায়ী থাকে?’

বিনায়ক চিরকালই যুক্তিবাদী । নন্দিনী আর কথা বাড়াল না । কিছু কথা থাকেই, যা যুক্তি-বুদ্ধির বাইরে ।

ছোট্ট মুন্নীর হাত ধরে প্রথমদিন এবাড়িতে এসেছিল ইলা । টুপুরের খেলার সঙ্গী মুন্নী । নীল-স্কার্ট সাদা-শার্টের স্কুলড্রেসের মুন্নী । লাল সালোয়ার-কামিজের মুন্নী । ছবির মত ভেসে ওঠে সব ।

হয়ত বিনায়কের কথাটাই ঠিক । ইলা এবাড়িতে কাজ না করলেও ঘটনাটা ঘটতে পারত । পরিবেশটাই ভালো নয় যে । তবু মনখারাপটা কিছুতেই কাটানো হচ্ছে না ।

বারবার বলেছে ইলা, ‘আমাকে কদিন ছুটি দিন দিদি, ছেলেগুলো আজকাল আমাদের বাড়ির বাইরের গাছতলায় বসে সারাদিন আড্ডা দেয়, যদি কোন দিন ঢুকে আসে ?’

তাই তো হল । আজকাল রোজ অফিসে দেরি হচ্ছিল, ইলারও বাড়ি ফিরতে রোজ ছ’টা বেজে যাচ্ছিল । সেই সুযোগ নিয়েই তো বদ ছেলেটা মুন্নীর সবর্নাশ করল ।

সেই দায়টা নন্দিনীর নয় ? বিনায়ক যতই বলুন, নন্দিনীর অপরাধবোধ কাটবে না ।

* * * *

সাত দিন কেটেছে তারপর । ইলা কাজে আসছে না । ছুটি নিয়ে বাড়িতে আছে নন্দিনী । অফিস থেকে বারবার ফোন আসছে ।

‘চাকরিটা ছেড়েই দিই’, আবার বলল নন্দিনী ।

‘এই সামান্য কারণে এত ভালো চাকরি ছাড়ে কেউ ? আমি কয়েকজনকে বলেছি কাজের লোকের কথা । চাকরি ছাড়ার কথা ভেবো না তুমি ।’ বিনায়ক বলে উঠলেন ।

‘আর দু’বছর পর আমি বাইরে পড়তে চলে যাব ।তখন তো আর আমার জন্যে বাড়িতে থাকতে হবে না তোমায় । এইটুকু সময়ের জন্যে তুমি চাকরি ছেড়ে দেবে মাম ? ভেবো না, আমি একলাই থাকতে পারব ‘, টুপুর বলল ।

‘তুমি বরং ঠিকে কাজের মেয়েটাকে বলো, টুপুর স্কুল থেকে ফেরার পর দু’ঘন্টা এবাড়িতে থাকুক । স্কুলবাসের দরকার নেই, সুবোধ আমার গাড়ি নিয়ে টুপুরকে স্কুলে দেওয়া নেওয়া করবে’, বিনায়ক বললেন ।

‘আর ছুটির দিনে ? গরমের, শীতের লম্বা ছুটিতে ? পরীক্ষার সময় ?’

‘সে যা হয় ব্যবস্থা হবে । তোমার মাকে নাহয় সে সময় এনে রেখো । আপাতত এই ব্যবস্থা থাক ।‘

হঠাৎ খেয়াল করল নন্দিনী, ইলার সমস্যাটা নিয়ে এ বাড়িতে আর ভাবনা করছে না কেউ । ইলা কাজে আসবে না, এটাই ভাবনা । ‘আমরা কি মানুষ ?’ তীব্র আক্রোশে বলে উঠল নন্দিনী ।

কেউ শুনতে পেল না অবশ্য । কিন্তু কথাগুলো বুকের মধ্যে ধাক্কা খেয়ে ফিরতে লাগলো ।

ইলা । দশ বছর ধরে মমতায় যত্নে শ্রমে নন্দিনীর সংসারে শ্রী গড়ে তোলা ইলা । মামণি-ডাকে মায়ায় স্নেহে যত্নে টুপুরকে লালন করা ইলা । সেই ইলার এত বড় বিপদের দিনে মুখ ঘুরিয়ে থাকবে নন্দিনী ? যা হোক দূরে দূরে, আমার গায়ে যেন আঁচ না লাগে ?

বস্তী টস্তীর সমস্যার সঙ্গে একটা ডিগনিফায়েড দূরত্ব রাখা উচিত, বিনায়ক বারবার বলেন ।

নিজেদের প্রয়োজনের সময় আমরা ইচ্ছে করে সে দূরত্বের কথা ভুলে যাই । ওদের লোভ দেখাই । বেশি টাকার

লোভ । পুরোনো জামাকাপড়ের ঘুষ দিই । আর কাজ শেষ হলেই ডিগনিফায়েড দূরত্বে সরে আসতেও পারি । এই কি মানুষের সমাজ ? আহা, কি করবে ইলা এখন ? একা একা ?

‘সুধীর বলেছে মুন্নীকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে । ও এসব ঝামেলা নেবে না ।’ ইলা বলেছিল । ‘ওদের বাপ বলছে, ওই ছেলেটার সঙ্গেই মুন্নীর বিয়ে দিয়ে দিতে । কি করে দেব দিদি ? তার একটা বৌ আছে, তিনটে বাচ্চা আছে ।‘

মুন্নী সামনে আসেনি । দাদারা খুব মেরেছে ওকে । ইলা বলছিল, ‘আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে দিদি । আর কাজ করব না আমি । কিসের জন্যে কাজ? কার জন্যে কাজ? মেয়েটাকে নিয়ে আমি গ্রামের বাড়িতে চলে যাব ।‘

ইলার কান্নাভেজা কথাগুলোর প্রতিধ্বনি নন্দিনীর বুকের মধ্যে ।

সত্যিই তো । কিসের জন্যে কাজ ? কার জন্যে কাজ ?

বিনায়ক বলেছেন, ‘তেমন হলে কিছু টাকা দিয়ে দাও । নিজেকে জড়িও না । তোমার নিজের সংসারেও ক্রাইসিস এখন । আর একটা সারাদিনের লোক রাখতে হবে । টুপুর একলা থাকবে বাড়িতে । সেসব নিয়ে ভাবো ।‘

এইরকমই তো করি আমরা । সমাজে অপরাধ ঘটে, তার আঁচ যেন নিজের সংসারে না লাগে । পাশের বাড়িতে কেউ অসহায় হয়ে কাঁদলে জানলা বন্ধ করে নিই । ইলার সমস্যা নিয়েও তাই করাই নিয়ম । তবু কেন বুকের মধ্যে এমন ভার হয়ে আছে ?

একসঙ্গে ম্যানেজমেন্ট পড়েছিলেন দুজনে । বিনায়ক আর নন্দিনী । বিনায়কের সঙ্গে আলাপের সেই সব দিন । একসঙ্গে জীবনের পথে পা বাড়ানো । অনেকদিন পর সেই দিনগুলো মনে পড়ল । ম্যানেজমেন্টের পড়ায় ছিল ম্যাসল-র হায়ারার্কি নীডের কথা । পরপর পাঁচ ধাপ । সার্ভাইভাল, সেফটি, সোশাল, এস্টিম, সেলফ-আকচুয়ালাইজেশন । সবচেয়ে ওপরের ধাপে সেলফ-আকচুয়ালাইজেশন, মোক্ষ ।

জীবনের সবর্ক্ষেত্রে তাই । জীবনের জন্যেই জৈবিক চাহিদা । আর এই নেহাত জৈব প্রয়োজনে সবচেয়ে অবহেলিত হয় মনুষ্যত্ব ।

আহা ইলা । অশিক্ষিত ইলা । জন্মসূত্রে বস্তীতে থাকতে বাধ্য হওয়া ইলা । যে ইলা শ্রীময়ী মাতৃমূর্তি । যার সুন্দর সংসার জড়িয়ে থাকার কথা ছিল । পিরামিডের একধাপ পেরিয়ে আসতে আসতে জীবনের লড়াই শেষ করে ফেলবে ইলা ?

নন্দিনীও কি তাই ? শিক্ষা আর সামাজিক অবস্থানে উন্নত নন্দিনী কি স্বচ্ছন্দে পিরামিডের ধাপগুলো অতিক্রম করে ফেলতে পারবে ? ইলাদের বাদ দিয়ে ?

পিরামিডের সবচেয়ে ওপরের ধাপটা কেমন ? পাহাড় চূড়োর মত ? বড় একটা একলা পাহাড়, তার চারদিকে শুধুই আলো, শুধুই শান্তি । সেইখানে চড়তে গিয়ে আপনা থেকেই খসে পড়ে সব শৃঙ্খল । সেইখানে উঠতে গেলে সবাইকে ভালোবেসে ফেলা হয় । নতুন করে জীবনের মানে বোঝা যায় । জীবন । মানুষের জীবন । জৈব চাহিদার থেকে তা অনেক বড় ।

ম্যানেজমেন্টের পড়ায় ব্যক্তিগত উত্তরণের মন্ত্র । জীবনের নিয়মে একটু অন্যরকম হবে না ?

আনমনে মাথা নাড়ল নন্দিনী । জীবনের নিয়ম হল পরিপার্শ্বকে নিয়ে উত্তরণ । ইলাদের সুরক্ষা সম্পূর্ণ না হলে নন্দিনীদের পিরামিডে চড়ার পথ মসৃণ হবে কি করে ? জৈব প্রয়োজনে ইলার ভূমিকা কম নাকি ?

বিনায়ক যা-ই বলুন, নন্দিনী দায়িত্ব অস্ব্বীকার করবে না । ইলার পাশে দাঁড়াতেই হবে । হাত ধরে তুলে আনতে হবে মুন্নীকে, ইলাকে ।

কোনো অপরাধবোধ আর ক্ষত-বিক্ষত করবে না । নিজেদের বাঁচাতে গিয়ে, নিজের সন্তানের জীবন আলোময় করতে গিয়ে ইলার মত কারো জীবনে আঁধার এনে ফেলার দায় বইতে হবে না । আজই যাবে ইলার কাছে । যা যা করার সব করবে ইলার হাত ধরে, ইলার সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে ।

এবার উঠতে হবে । অনেক কাজ । বাইরের অন্ধকারটা ঘরে ঢুকে পড়ার আগেই সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বেলে নিতে হবে ।