সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১২

ছোটগল্প - উদয়ন রায়

বাস্তুমাটি আর মুখগুলো



কুন্তলের ডায়ারী,
মধ্য কানাডার এক প্রেইরী শহর, কানাডা, সেপ্টেম্বর, ২০০৮

হাইওয়ে ৫ দিয়ে পশ্চিমে ২০ মাইল মত গেলে, পাইক লেক। দুমাস বসন্তের পর আড়াই মাসের গরম এবার যাই যাই করছে। লাল-হলুদ পাতা আর শুকিয়ে যাওয়া ঘাসে হেমন্ত-এর গন্ধ বাতাসে। তবু, ছেলে বুড়ো মেয়ে-মদ্দ, ধাড়ি-কুচো বাচ্চারা, ফি শনিরবিবার, গাড়ী বাগিয়ে, কাঁচা চিকেন-পর্ক-হ্যাম-কাঠকয়লা-সতরঞ্চি- নিয়ে চলেছে শহরের এদিক ওদিক, লেকের ধারে বার্বিকিউ করতে। পাইক লেক তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। মসৃন হাইওয়ে ৫ -এর হলুদ রং-এ আঁকা ডিভাইডার লাইন -এর উল্টোদিকে ভারি ভারি ট্রলার আর গাড়ীর চলমান লাইন। তার মধ্যে হাইওয়ের সাইন বোর্ডে , পাইক লেক, দেখে, ডান দিকের এবড়ো-খেবড়ো রেঞ্জরোড ২০০৫ -এ যখন ঢুকলাম, তখন বেলা একটা। এই রেঞ্জরোড দিয়ে আরো মাইল দেড়েক গিয়ে হোয়াইট বার্চ আর জ্যাক পাইন গাছে ঘেরা সমতল পিচ বাঁধানো পার্কিং লট। সেখানে এদিক-ওদিক আনতাবরি প্রায় পঞ্চাশটা গাড়ী পার্ক করা। একটা ঢাউস সাইজের হোন্ডা ট্রাকের পাশে পার্ক করে, ইগনিশন বন্ধ করতেই পেছনের সীট থেকে বৌ আর মেয়ে লাফিয়ে নামে। ওরা যখন পেছনের ট্রাঙ্ক খুলে জলের বোতাল, স্যালাডের বাক্স, মাংসের ট্রে, তোয়ালে, এসব নিয়ে ব্যস্ত, আমি একটু এগিয়ে এলাম একটা কোনো টয়লেটের আশায়। দেশে হলে, একটা বার্চ গাছের আড়ালে, অন্য বার্চ গাছের গায়ে জলত্যাগ করা যেত, কিন্তু এখানে পুলিশ বা ফরেস্ট গার্ডের লালবাতি লাগনো গাড়ীর ভয়। পীচ বাঁধানো সেই পার্কিং লটের একেবারে শেষ প্রান্তে, সবুজ রং করা লোহার সাইন বোর্ডে, হলুদ র-ংএ টয়লেট লেখা আর পুরুষ-মেয়ের ছবি আরে অ্যারো চিহ্ন দিয়ে জঙ্গলের ভেতর তাক করা। বার্চ গাছের ফাঁক দিয়ে পায়ে চলা পথে, অল্প কাদাজল আর গাছের ঝরাপাতা-র গালিচা পেরিয়ে একটা কাঠের গুমটি মত, অ্যালুমিনিয়ামের ডোরনব আর উপরে টয়লেট লেখা। সেই প্রায়ান্ধকার গুমটিতে, কোনোদিন না ধোয়া সাদা কোমোডে জলত্যাগ করে আর মশার (এখানকার মশারা অ্যানোফিলিক্স নয়, ম্যালেরিয়ার ভয় নেই, এই যা রক্ষে) কামড় খেয়ে বেরিয়ে এসে মনে হল এর চেয়ে বার্চ গাছ-ই ভাল ছিলো।

ফেরার পথে খেয়াল করলাম, সেই পায়ে হাঁটা জঙ্গলের রাস্তায়, ডানদিকে বনের মধ্যে একটা পুরোনো, জিএম-কে৫ দাঁড়িয়ে। এতো পুরোনো আর অবহেলিত যে পুরোটাই মর্চে ধরা, লাল রংটা আর বোঝার উপায় নেই। তবে, ওটা চলে, আর সদ্য চালিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে, মাটিতে এখনো ভারি টায়ারের গভীর ক্ষত। নীচুস্বরে কথাবার্তা শুনে গাছের ফাঁক দিয়ে আরো একটু উঁকি দিয়ে দেখি একটা মেয়ে আর একটা পুরুষ, একটা ময়লা হতশ্রী কম্বল পেতে বসার তোড়জোড় করছে। জায়গাটা একটু লোকচক্ষুর আড়ালে। গাছের আড়ালে আড়ালে রোদ্দুর আর ছাওয়া-র জাফ্রি কাটা। পুরুষ আর মেয়েটার দুজনের পরনেই বিবর্ণ জ্যাকেট, নোংরা জিন্স, এই গরমেও গোবদা স্নোবুট। লোকটার ঝাঁকড়া চুল-দাঁড়িতে কস্মিনকালেও সাবান পড়েছে বলে মনে হয় না। মেয়েটার উড়নচন্ডি চুল। চেহারায় বোঝা যায়, দুজনেই ফ্রাস্ট-নেশন কানাডিয়ান বা অ্যাবরিজিনাল, বা চলতিতে আমরা যাকে বলি, (রেড)ইন্ডিয়ান। তামাটে রং। চওড়া চোয়াল। চর্বিবহুল বড় মুখ। ক্ষুদে চোখ। লোকটার মাথায় আবার পশমের হেয়ারব্যান্ড। দুজনের হাতেই সিগারেট। আর আমি হলপ করে বলতে পারি সিগারেটে, তামাকের বদলে হাসিস। আরো একদম চোখ বুজেই বলাযায়, ওদের পকেটে ইন্টারভেনাস সিরিঞ্জ, আর তাতে 'ক্রিস্টাল মিথ'। এরকম অ্যাবরিজিনাল মেয়ে পুরুষ অবশ্য কোনো বিচিত্র দর্শন নয়। শহরের আনাচে-কানাচে হরদম-ই দেখা যায় এদের। বড় ব্যাঙ্ক বা অফিশ বিল্ডি-ংএর তলায়, চৌরাস্তার মোড়ে, দিনের বেলায় গজল্লা করে এরা। বা টুপি পেতে পয়সা চায়। আর সন্ধে হলে অফিশ পাড়ার প্রায়ান্ধকার গলিতে আড়াল খোঁজে। ড্রাগ অ্যাডিকশন-প্রস্টিটুশ্যন এদের নিত্য সঙ্গী।

কিন্ত, যেটা মনে হল, যে এই মেয়েটাকে আমি অনেকবার দেখেছি। অফিশের নীচের ফুটপাথে। মুখ চেনা। প্রায়ই হাত বাড়ীয়ে একটা ডলার চায়। বলে নাকি, কফি খাবে। গরমের বিকেলে দেওয়ালে হেলান দিয়ে গীটার বাজিয়ে গান করে। সামনে গীটারের খোলে ছড়িয়ে ছিটেয়ে খুচরো সেন্ট। সেই উড়নচন্ডে চুল। ময়লা টিসার্ট। তালি মারা প্যান্ট। গীটারে ঝমঝমিয়ে মেঠো সুর, কথা বিশেষ কিছু বোঝা যায় না, তবে আমি জানি ওটা ওর নিজের ভাষা মেতিস আর ইংরাজি মেশানো। গানের মধ্যে কেমন যেন তিরতির করে মন নাচানো উদাস ভাব আছে। তবে কেন জানি না মনে হয় ওর গানে ইংরাজিটা জোর করে ঢোকানো। দুটো বাচ্চা সাথে থাকে ওর। একটা বছর চারেক, আর একটা দুই-আড়াই। ময়লা সার্ট আর গ্যালিস দেওয়া প্যান্ট দুটো বাচ্চার, শীতে ময়লা জ্যাকেট আর মাঙ্কি ক্যাপ। মিডটাউন মলের ফূডকোর্টের উচ্ছিস্ট সসেজ চিবায় বাচ্চাদুটো, কোনোদিন শুকনো পাঁউরুটি। এখানেও দেখলাম বাচ্চা দুটো খেলে বেড়াচ্ছে জঙ্গলের মধ্যে, একটু দুরে ওদের হুটোপাটি শোনা যাচ্ছে। এখনো ওরা ড্রাগ চেনেনি। তবে চিনতে হবেই একদিন। মা-ই একদিন হয়তো চিনিয়ে দেবে, বা সঙ্গের লোকটা, যে ওদের বাবা হতেও পারে, আবার নাও পারে।

নভেম্বর, ২০০৮

বাতাসে এখন ভরপুর শীতের গন্ধ। দিন ছোটো হতে হতে এখন পাঁচটায় সূর্য্য ডুবে যায় ঝুপুস করে। বড় রাস্তায় ঝরা পাতার কোলাজ। হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে যায় আরো। বারো তলা স্কসিয়া সেন্টারের দশ তলায় আমার অফিশ। সন্ধ্যের আগে কম্পিউটার বন্ধ করে, মাঝারি ভারী, উলের জ্যাকেট গলিয়ে এলিভেটারে নীচে নামি। আজ শুক্কুর বার। বড় রাস্তার ওপারে, মিডটাউন মল আজ রাত দশটা পর্জন্ত খোলা। বড়দিনের বাজার পাঁয়তারা কষছে, অফিশ ফেরত বা মধ্যবিত্ত কানাডিয়ান সবাই মলমুখো। তিড়িং লাফানো বাচ্চা কাঁধে বাবা-মা, কলেজ পাশ করা সদ্য তরুণ-তরুণি, হাসিহাসি মুখে মন্থর হেঁটে উইন্ডো সপিং করা দাদু-দিদিমা-র ভীড় মলের ভেতরে।

ঠিক মলে ঢোকার গেটের পাশে, সেই মেয়েটা। পাশে, কুড়িয়েপাওয়া স্ট্রলারে হলদে রং-এর ফুলকো জ্যাকেটে মোড়া ছোটো বাচ্চাটা, মাটিতে দেওয়ালে ঠেসদিয়ে বড়টা। দুজনের হাতেই আধা খাওয়া চকোলেটের রাংতা, ফোলা ফোলা গালে নাকের সিকনি আর চকোলেট মাখামাখি। মেয়েটার হাতে আজ-ও গীটার, আরে সেই ঝং-ঝং-ট্রিংট্রাং সঙ্গে, মেঠোসুর। আজকে অনেক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, কথা গুলোর শব্দ বিভাজন বোঝার চেষ্টা করি, অনেক্ষণ ধরে, মন:সংযোগ করে, কান পেতে পেতে। তিনটে মাত্র লাইন, ঘুরে ঘুরে আসে,

ডোরে ডাকে, আইবাকোনো, কিমোছি টোডোকু ......

ডোরে ডাকে, সুকুসেবা, কিমোনি টোডোকু .....

ডোরে ডাকে, নো ওমনি বাট্‌সুকেরাইইই ......


পরের দিন, আমার কানশোনা আর অসম্ভব উচ্চারনের গুনে, অপিশের আমার যে মেতিস সহকর্মি আছে, সে গানের মর্ম উদ্ধারে হিমসিম। তাও আমার বার বার অনুরোধে, অনেক কষ্টকরে মোটামুটি অনুবাদ করে দেয় ......

মাই ব্রোকেন হার্ট, হোয়েন ইউ ডিডিন্ট ওয়ান্ট টু বি উইথ মি .....

মাই ব্রোকেন হার্ট, আল দিস টাইম, আই ওয়াস ফুল ইন লাভ .....

তবে,কেন জানিনা আমার মনে হতেই থাকে ইংরাজি অনুবাদটা ঠিক সুললিত হচ্ছে না, কানেও .... , মনেও।

*****

আদিবাসীদের খাদ্য ও পুষ্টি নিয়ে, এক সরকারি গবেষকের ডায়ারী, গাজিগান রেস্টসেড, কোরাপুট জেলা, উড়িষ্যা,

১৯৬৮, নভেম্বর

চাম্পিকোটা, খন্দদের (সিথাখন্দ আদিবাসী) গ্রামে, রোজকার মত খাদ্যের ওজন ও নমুমা সংগ্রহ, বাচ্চাদের ওজন বড়দের খাদ্যাভ্যাসের তালিকা -র কাজ করে রেস্ট সেডে ফিরছি। অতি সাধারণ খাদ্য এদের। ভাত আর তেঁতুলের ঝোল। মাঝে মাঝে কিছু বন্য শাকসব্জি বা একটা বেগুন। তাও এখন ফসল কাটার মরশুম, তাই রোজ ভাত জুটছে ওদের। অন্য সময়ে আধাপেটা বা আমের আঠির আর তেঁতুল বিচির শাঁস। মেয়েপুরুষ সবাই অপুষ্টিতে ক্ষয়িষ্ণু দেহ। নামমাত্র পরিধান। হত দরিদ্র, হতশ্রী। আগে এ অঞ্চলের জমি, খন্দদের-ই মালিকানা ছিলো, এখন সব-ই শাহুকারদের খপ্পরে। নিজেদের জমিতে খন্দরা এখন ক্ষেত মজুরের কাজ করে।

মাঠের আল ধরে অনেকখানি পথ হেঁটে এলাম। সূর্য্য এখন পশ্চিমে। তবে বিকাল বোধহয় এখনো আছে । বাঁদিকে, মাইল তিন-চার দুরে ঝাপসা শৈল রেখা। পূর্বঘাট। শীতের সুরুর পরিস্কার আকাশে সাদাটে ছোপানো মেঘ, আবছায়ায় মিশে গেছে শৈলরেখায়। এদিকটায় ফসল কাটা প্রায় শেষ, ক্ষেতগুলো প্রায় সবটাই ন্যাড়া, তবে একটা-দুটোতে এখোনো কাটারি পরেনি। কয়েকটা ন্যাড়া জমিতে আবার লাঙ্গল চলছে। লাল লাল, ভেজামাটি আলগা হচ্ছে। জমি তৈরী হচ্ছে পরের ফসলের জন্য। মান্ডিয়া বোনা হবে এবার। ইরিগেশন ক্যানেল থেকে নালা দিয়ে জল আসছে তিরতির করে। কোনো জমিতে আঁখের চারা গজিয়েছে। একদম নবীন চারা। বর্ষায় পরিপূর্ণ গাছ হবে। আমার সাথে স্থানীয় স্কুলের মাস্টার। আমার দোভাষি। আমার তোবরানো হিন্দী, তোবরানো উড়িয়া আর আঙ্গুল ডোবানো খন্দিভাষায় দখল, আর মাটারের সেই হোঁচোট খাওয়া হিন্দী আর নিজের ভাষা উড়িয়া-খন্দি সাম্‌ঞ্জস্য রেখে কাজ চলে যাচ্ছে আমার। মাটার, গ্রাম্য উড়িয়া। বেঁটেখাটো গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। পরনে পাত্‌লুন আর সাদাজামা, খালি পা, আর মাথায় একটা হোগলার টুপি।

প্রায় মিনিট তিরিশেক ক্ষেতের আলপথে হেঁটে এসে সড়ক রাস্তায় পড়ি। এখান থেকে আর চারমিনিট চললেই রেস্ট শেড। আলপথ আর পাকা সড়কের কোনায়, আঁখ ক্ষেতের মাঝে একটা মাচান মত, তার উপরে পাতার ঝুপরি। মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করি, 'মাচানে কি হবে ? পাহারা ? এখন তো সবে আঁখের চারা বেরিয়েছে, চুরি যাওয়ার ভয় কি ?', মাস্টার বলে, 'নেহী, নেহী জী,আদমী নেহী, বেয়ারস, ভালু ভালু, ভালু এসে সব সাবাড় করে দিবে', তাই পাহারার ব্যবস্থা। সড়ক রাস্তায়, বাঁশের মচকানো চা দোকান। সেখানে আদিবাসী নারী-পুরুষের ভীড়, এরা মুলত: ক্ষেতের কুলি-কামিন। ভাঙাচোরা ধুলো ওড়া সড়ক রাস্তায় মোষের পাল। দুতিনটে লেংটি পরা নয় দশ বছরের ছেলে, কঞ্চি হাতে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। ধুলো আর মোষের গোবোরে মাখা মাখি রাস্তা।

একটু এগিয়ে পথের ধারে দেখি একটা লোক, লেংটি পরা, ক্ষীণদেহ দেখে, খন্দ বুঝতে অসুবিধা হয় না। সঙ্গে একটা বছর পাঁচেকের উলঙ্গ ছেলে। লোকটা উবু হয়ে বসে, ছেলেটার পায়ে কি মাখাচ্ছে। আরো একটু কাছে গিয়ে বুঝলাম, মোষের টাটকা গোবর। শীতের সুরুতে পা ফেটেছে ছেলটার, কষ্ট হয়, কাঁদে।

তাই তার বাবা ধন্নন্তরী ওষুধ লাগাচ্ছে ছেলের পায়ে, ..... পরম মমতায়।

******

'আর সেদিন তোমরা নাকি, তুমি তুমি তুমি মিলে সভা করেছিলে, আর সেদিন তোমরা নাকি অনেক জটিল ধাঁধা, না বলা অনেক কথা, কথা তুলেছিলে .... '


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন