কাকুমণি
আইভি চট্টোপাধ্যায়
-এক-
বাবা অচিন পথে পাড়ি দিয়েছিলেন, অপর্ণাবৌদি তখন সাত বছর । বাবার অভাব বোঝার অবশ্য সুযোগই হয় নি । কাকা তাঁদের মা-মেয়েকে আগলে রেখেছেন । ব্যারাকপুরে গঙ্গার ধারে কাকার বাড়িটাই নিজের বাড়ি ছিল । সেই বাড়ি, যার বারান্দায় দাঁড়ালে গঙ্গা দেখা যায় আর ছাদে উঠলে গঙ্গার ঢেউ । যে বাড়িটায় সারাক্ষণ নদীর বাতাস ঠান্ডা করে রাখে ।
বিয়ে পর্যন্ত করেন নি কাকা । পাছে 'পরের মেয়ে' এসে তাঁর বৌদিকে, ভাইঝিকে অবহেলা করে ।
আজ অপর্ণাবৌদির ভরা সংসার । কর্পোরেট স্বামী, ইঞ্জিনিয়ার ছেলে । তিনটে গাড়ি, বাংলো বাড়ি, সবুজ লনে সাদা দোলনা । বাগানে পাম ক্রোটন ঝাউ । ঋতুর হিসেবে মরশুমি ফুল । মালী সারাবছর বাগান ঝলমল করে রাখে । রোজ বিকেলে লনের দোলনায় বসে অপর্ণাবৌদি চা আর মাছের চপ খেতে খেতে বাগানের তদারকি করেন । লম্বা কান দুলিয়ে লুসি বাগানে খেলা করে । সন্ধে হলে লুসিকে কোলে নিয়ে হণ্ডা সিটি চেপে বৌদি বেড়াতে যান ।
মাকে কাছে এনে রেখেছেন । মেয়ের সুখ দেখে মাযের চোখ জুড়োয় । মা সঙ্গে থাকায় রান্নাবান্নার দিকটা মসৃণ । আরেকদিকেও সুবিধে হয়েছে । শ্বশুরবাড়ির কেউ পাকাপাকি থাকতে চায় নি । বৌদির সংসারে সর্বক্ষণ ঠান্ডা বাতাস ।
কিন্তু অপর্ণাবৌদির মনে শান্তি নেই ।
বন্ধুদের কাছে আক্ষেপ করেন, ‘কি মুশকিলে যে পড়েছি ! সামনের জানুয়ারীতে কাকু রিটায়ার করবে । বলছে, আমার তো আর কেউ নেই .. তোর কাছেই শেষ জীবনটা কাটাব ।‘
‘ভালোই তো । এত বড় বাড়ি তোমার, এমনিই তো তিন চারটে ঘর খালি পড়ে আছে । ছেলে বাইরে, সোমেনদা মাসের মধ্যে পনেরোদিন ট্যুরে । মুশকিল কেন ? কাকা খুব মেজাজী বুঝি ? খুব বায়নাক্কা ?’
‘না, তা নয় । কাকু চুপচাপ মানুষ, নিজের কাজ নিজেই করে । দেখেছ তো তোমরা ।‘
‘হ্যাঁগো, দেখেছি তো । সেবার এলেন, সারাদিন তোমার বাগানে থাকতেন । কতরকম গোলাপ, ডালিয়া করেছিলেন । রবিবার হলেই টাটকা সব্জি কিনতে বাজারে । নাতি খাবে বলে মাংস, জামাই খাবে বলে ইলিশ । খুব ভালোবাসেন তোমাদের । তাছাড়া এমনিও তোমার আউটহাউসে এতগুলো কাজের লোক । কাকুর কাজে তোমায় লাগবেও না । তাহলে ? সোমেনদা আপত্তি করছেন ?’
‘না, তা নয় । আপত্তি আমারই । তোমাদের সোমেনদা আমার কোনো কাজে বাধা দেয় না । ও তো উল্টে আমাকেই বলছে, কাকু যখন নিজে আসতে চাইছে তখন আপত্তি কোরো না । ভালো দেখায় না । আসলে কাকুর সব সম্পত্তি, টাকা পয়সা আমিই পাব যে । তাই তোমাদের সোমেনদার সঙ্কোচ । যদিও এ সঙ্কোচের কারণই নেই । কাকুর আর কে আছে যে সম্পত্তি দাবী করবে ? কি করে যে ঝামেলাটা ঘাড় থেকে নামাই !’
বৌদির মাও বিরক্ত, ‘একে আমি জামাইবাড়িতে আছি, আবার ঠাকুরপো আসতে চাইছেন । একটু যদি সাংসারিক বুদ্ধি থাকত !’
সাংসারিক বুদ্ধি থাকলে আজ কাকুরও যে ভরা সংসার থাকত, সে কথাটা অবশ্য কারো মনে আসে না ।
ভাবতে ভাবতেই জানুয়ারী এসে গেল । কাকুর অবসর জীবন শুরু হল । অপর্ণাবৌদি আর সোমেনদা গিয়ে টাকাপয়সার সব ব্যবস্থা করে এলেন । পোস্ট-অফিসের এম-আই-এস, ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিট, সিনিয়র সিটিজেন ডিপোজিট । সব কাকুর খুকুর সঙ্গে জয়েন্ট । তাছাড়া বাড়ির নমিনেশন, পেনশনের নমিনেশন । কাজ কি একটা ! সাতদিন থেকে সব ব্যবস্থা করে বৌদি ফিরে এলেন ।
কাকু বলেছিলেন, ‘একেবারে তোদের ওখানে গিয়েই নাহয় অ্যাকাউন্টগুলো খুলতাম খুকু । আবার সব ট্রান্সফার করার ঝামেলা ..’
খুকু হেসে হেসে বলেছে, ‘এখন কদিন এখানে থেকে সব গুছিয়ে নাও কাকুমণি, তারপর ..’
তা ঠিক । বাইশ বছর কাজ করছিল রঘু, দেশে তার বাড়িঘর কাকুই করে দিয়েছিলেন, এবার ছুটি দিলেন । চোখের জল মুছতে মুছতে রঘু দেশের বাড়ি চলে গেল । পাড়ায় একটা লাইব্রেরী করার কথা দিয়েছিলেন, এবার সে কাজটাও শুরু হল ।
শান্তিপুরে মাসিমার মেয়ের বিয়ে, নৈহাটির পিসতুতো দাদার চিকিত্সার ব্যবস্থা । কাকু রিটায়ার করেছেন খবর পেয়ে কত ভুলে যাওয়া সম্পর্কই যে নতুন হয়ে উঠেছে ।
ভালোবেসে করার কাজও অবশ্য আছে । পাড়ায় মশামাছির উপদ্রব, লোক ধরে নালা নর্দমা পরিষ্কার । শ্রীরামপুরে বাড়ি করেছে দীর্ঘদিনের সহকর্মী বিনয়, তার গৃহপ্রবেশের ব্যবস্থা । ছোটবেলার বন্ধু পলাশ বৃদ্ধাশ্রমে আছে, দেখা করে এলেন একদিন । পাকাপাকিভাবে খুকুর কাছে যাবার আগে এদিকের সব মিটিয়ে নেওয়াই ভালো ।
কিন্তু খুকুর কাছ থেকে ডাক আসে না । কাকুমণি অপেক্ষায় রইলেন । ছ’মাস .. আটমাস .. এক বছর । খুকুরা নিজে থেকে খবর না পাঠালে আসেন কি করে ? তবু একবার নিজে থেকেই এলেন । কি হল কে জানে, আবার ফিরেও গেলেন ।
পাড়ার লোক বলে, ‘ফিরে এলেন যে ?’
‘এই ব্যাঙ্কের কাজ আছে একটু ।‘
‘আমরা ভাবলাম, নতুন জায়গা, তাই বুঝি অসুবিধে । তাহলে খুকুর কাছেই থাকবেন ? থাকতে পারবেন নতুন জায়গায় ?’
কাকুমণি হাসেন, ‘স্নেহ নিম্নগামী, জানো না ?’ কি কথার কি উত্তর !
হঠাত্ একদিন সকালে বৌদির বাড়িতে ফোন । পুলিশের ফোন ।
ক’দিন ধরে কাকুকে বাইরে দেখা যায় নি । বাড়ির বন্ধ দরজায় তিনদিনের খবরের কাগজ, তিনদিনের দুধের প্যাকেট । মর্নিংওয়াকে গিয়ে রোজ যে কুকুরছানাটাকে রুটির টুকরো খাওয়াতেন, সে নাকি দরজার কাছে বসে চিত্কার করেছে খুব, তারপর আশেপাশের বাড়ির দরজায় দরজায় গিয়ে চিত্কার করেছে । কুকুরটার কান্ড দেখে লোকের সন্দেহ হয়েছে। তারপর পাড়ার ছেলেরা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকেছে । পাড়ার ছেলেরাই পুলিশকে খবর দিয়েছে ।
ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক । একলা ঘরে একা একা । কে জানে কেমন ছিল সে যাত্রা, নিকটতম প্রতিবেশীকেও ডাক দিতে পারেন নি ।
কাকুর হিমশীতল শরীর তিনদিন ধরে কোনো আপনজনের অপেক্ষায় ছিল ।
ব্যারাকপুরের একলা বাড়িটা, কাকুর একাকী জীবনের সঙ্গী বাড়িটা নিঝুম । শুধু গঙ্গার দিকে বারান্দাটা, যে বারান্দায় বসে জলের দিকে চেয়ে আর গঙ্গার বাতাস মেখে একাকী সময় কাটাতেন, সেই বারান্দার দিকের খোলা দরজাটা আপনমনে কপাটে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে কিসের যেন প্রতিবাদ করছিল । পুলিশ দরজাটা বন্ধ করে তালা দিয়ে দিল ।
পুলিশ, পোস্টমর্টেম । দাদা-বৌদি গেলেন, সত্কার করে এলেন । বন্ধুরা সমবেদনা জানাতে গিয়ে অপ্রস্তুত । অপর্ণাবৌদি খুব বিরক্ত, শুধু শুধু কাকা ঝামেলায় জড়িয়ে গেছেন । কাকার বাড়ি, ব্যাঙ্কের টাকা, সম্পত্তি পেয়েও ঝামেলাটা ভুলতে পারছেন না ।
বৌদির মাও বিরক্ত, ‘কোন জন্মের শত্রুতা ছিল কে জানে । থানা পুলিশ মর্গ পোস্টমর্টেম .. কত ঝামেলায় জড়িয়ে দিল।‘
দিন কয়েকের মধ্যে বন্ধুদের কাছে ফোন এল বৌদির, ‘বেনারস থেকে গুরুজি এসেছেন, বাড়িতে নামগান হবে । চলে এসো বিকেল বিকেল, পুজো আছে । অবশ্যই এসো সবাই, বিশেষ পুজোর ব্যাপার ।‘
বিশেষ পুজো ! কী ব্যাপার ! এখন তো কোনও বিশেষ তিথি নেই । অমাবস্যা গেল এই দুদিন আগে । কৌতুহলী বন্ধুরা সবাই এলেন ।
বৌদি ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করলেন, ‘শান্তি-স্বস্তত্যয়ন করাচ্ছি, বুঝলে ? অপঘাত মৃত্যু । ভূত প্রেতকে আমার খুব ভয়, কখন ঘাড়ে চেপে বসে ! ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি । কদিন ধরে কি সব কান্ড হচ্ছে, জানো ? এই রান্না করে রেখে এলাম, কে যেন সব খেয়ে নিচ্ছে । কাল মালাই চিকেন করেছিলাম, কে যেন ওপর থেকে মালাইটা খেয়ে নিয়েছে । তোমাদের সোমেনদা সেদিন বাগানে দাঁড়িয়েছিল, কে এসে পিঠে দুমদুম করে কিল মেরে গেছে । লুসি তো সর্বক্ষণ ভয় পেয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে থাকছে । ওরা সবার আগে অপদেবতাকে টের পায়, জানো তো ? কাকু যে আমাদের কি সর্বনাশ করে গেল !’
-দুই-
মুম্বাইতে ছেলের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন অপর্ণাবৌদি ।
বেড়াতেই । ছেলে-বউয়ের সংসারে থাকা তাঁর না-পসন্দ । বউ নিয়ে অবশ্য সমস্যা নেই । দেখেশুনে বড়লোকের একমাত্র মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন । রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী । ইন্দিরা মেয়েটা বেশ বাধ্যও । যদিও সাজ পোশাকে তেমন সাব্যস্ত নয় মেয়ে । হয় ঝুলুর ঝুলুর একটা সালোয়ার কামিজ, নয় যেমন তেমন একটা শার্ট আর জিনস প্যান্ট । ব্যস । একটু বেভুল আছে মেয়েটা । সে একদিক দিয়ে ভালোই । বেশি বায়নাক্কা নেই বউয়ের ।
তবু বৌদি শান্তিতে নেই ।
সমস্যা বৌদির মা । স্বামী গত হবার পর মাঝে মাঝেই এ বাড়িতে এসে থাকেন । ছেলেটা ভ্যাবলা । বোঝেই না যে শাশুড়ির দায় ঘাড়ে চাপছে । একমাত্র মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে শ্বশুরবাড়ির উটকো ঝামেলা বাবাইকে বইতে না হয় । যোধপুর পার্কের অত বড় আর সুন্দর বাড়ি ছেড়ে মহিলা এই দু’কামরার ফ্ল্যাটে এসে থাকতে চাইবেন কে জানত । কার সঙ্গে যে এ নিয়ে আলোচনা করেন !
দাদাকে বলতে গেলেই .. ‘আহা, মেয়ে মাকে একা একা থাকতে দেবে না, তাই নিয়ে এসেছে । ভালোই তো । তোমার ছেলেরও তো বেশ যত্ন হচ্ছে । যাই বলো, বেয়ানের হাতের রান্না কিন্তু দারুণ । আমারই খাওয়া বেড়ে যাচ্ছে..’
বৌদির মুখের দিকে চোখ পড়তেই শুধরে নেবার চেষ্টা, ‘তোমার মাও তো সারাজীবন আমাদের সঙ্গে থেকেছেন । কিছু অসুবিধে হয়েছে, বলো ?’
এই লোকের সঙ্গে মন্ত্রণা করা যায় !
ভেবে ভেবে এই উপায় করেছেন বৌদি । মাঝে মাঝে এ বাড়িতে এসে থাকা । তিনি এলে ও মহিলার বাধো-বাধো লাগে । নিজের বাড়িতে ফিরে যান । শত হোক, মেয়ের মা । চক্ষুলজ্জা তো আছে ।
মাকে তো এইভাবে সামলানো যাচ্ছে, তবু শান্তি নেই । মেয়ে আরেক কাঠি বাড়া । মাকে নিয়ে মেয়ের আদিখ্যেতার শেষ নেই ।
এই তো আজ যেমন । অফিস কামাই করে মেয়ে চললেন পোস্ট-অফিস থেকে মাযের টাকা তুলতে । পোস্ট-অফিস থেকে টাকা তুলে সে টাকা কলকাতায় মাযের ব্যাঙ্কে পাঠাবে ।
কেন বাপু ! কলকাতার পোস্ট-অফিসে কি কাজ হয় না ? এত দূরে মুম্বাই শহরে পোস্ট-অফিসে টাকা রাখার দরকার কি ? নাকি মেয়ে দেখাশোনা না করে দিলে নিজের টাকাপয়সা সামলানোর ক্ষমতা নেই ?
কই, বাবাইকে দিয়ে তো নিজেদের কাজ করান না বৌদি । বাবাইও তাঁদের একমাত্র ছেলে । তার তো বাড়ি নিয়ে, বাপমা নিয়ে এত মাতামাতি নেই । রীতিমতো প্র্যাকটিকাল ছেলে তৈরি করেছেন বৌদি ।
মুখে অবশ্য বলেন নি কিছু । কায়দা করে ইন্দিরার সঙ্গী হয়েছেন । মেয়েটাকে চোখে চোখে রাখতে হবে । এইভাবে অন্যের জন্যে, হোক না নিজের মা, সময় নষ্ট করা কি আজকের দিনে মানায় ? সময় বুঝে ব্যাপারটা মেয়ের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে । প্র্যাকটিকাল হবার শিক্ষা দিতে হবে মেয়েটাকে । নইলে বাবাইটার কপালে দু:খ আছে ।
পোস্ট-অফিসে লম্বা লাইন । বসে বসে বিরক্ত লাগছে । এক সময় কাজ শেষ হল । ‘চলো মা, আজ তোমায় কেএফসিতে খাওয়াব । বাবার জন্যেও নিয়ে যাব ।‘
ভালোই হল । ওই কেএফসি-তে বসেই ইন্দিরাকে বোঝাবেন আজ । বাড়িতে তো সর্বক্ষণ প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়ায়, এইবার একলা পাওয়া যাবে ।
পোস্ট-অফিসের দরজার কাছটায় বেশ ভিড় । ইন্দিরা শক্ত করে হাত ধরে আছে, বৌদি যেন ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাবেন । মনের কাছে লুকোনো নেই, মেয়েটার এইভাবে আগলে রাখাটা বেশ লাগছে । বৌদি যেন ছোট মেয়েটি, আর এই মেয়েটা যেন তাঁর মা ।
বেরিয়ে আসছেন .. হঠাত্ দাঁড়িয়ে পড়ল ইন্দিরা । ‘মা, একটু দাঁড়াও তো । এসো, এইখানে বসো । আমি আসছি ।‘
ভিড় ঠেলে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে ধরে ধরে এনে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিল, ‘আপনি এখানে বসুন, আমি দেখছি ।‘ ভদ্রলোকের হাতের পাশবই আর কাগজপত্র নিয়ে অন্য একটা লম্বা লাইনে দাঁড়াল ।
অচেনা মানুষের সঙ্গে গল্প করা বৌদির স্বভাব নয়, তবু পাশাপাশি বসে কতক্ষণ আর চুপ করে থাকা যায় ! যে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েছে ইন্দিরা, ঘণ্টাখানেক সময় লাগবেই । পনেরো মিনিটেই বৃদ্ধের নানা গল্প শোনা হয়ে গেল । একা থাকেন, কাছেই ফ্ল্যাট । নিজের রান্না নিজেই করেন, ঠিকে কাজের মেয়ে বাসন মেজে ঘর মুছে যায় । দোকান বাজার, ব্যাঙ্ক পোষ্ট-অফিস, সব একা একা ।
‘যতদিন হাত পা চলছে, চিন্তা নেই । করুণাময়ের কাছে একটাই প্রার্থনা, বিছানায় পড়ে থাকার অবস্থা যেন না হয় । আর সব তবু হয়ে যাচ্ছে, রাতের বেলায় আজকাল সাহস পাই না । একলা ঘরে কবে মরে পড়ে থাকব, কেউ খবরও পাবে না । একলা জীবন, অভিশপ্ত জীবন ।‘
‘একলা কেন ? বাড়িতে আর কেউ নেই ? মানে .. আপনার স্ত্রী .. ছেলেমেয়ে ..’
‘না, সেসব পাট নেই । সংসারে নিজের বলতে এক ভাইঝি । দাদা অল্পবয়সে চলে গেলেন, কাকু কাকু বলে মেয়েটা বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁদেছিল । সে-ই আমার সব । সে-ই একমাত্র । বিয়ে করলে ওকে কি আর এমন করে দেখতে পারতাম ?’
‘সে কোথায় ? আপনার ভাইঝি ? তার কাছে গিয়ে ..’ বলতে গিয়ে কেন কে জানে বৌদির গলা ধরে এল ।
উজ্জ্বল হাসলেন বৃদ্ধ, ‘চেন্নাইতে আছে আমার ভাইঝি । খুব ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে । তার সংসারে থাকা তো উচিত নয় আমার ।‘
একটু থামলেন, তারপর চোখ তুলে তাকালেন লম্বা ভিড়ের লাইনটার দিকে, ‘ভাবছি একটা বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাব । ভাইঝিকে একবার আসতে বলেছি । টাকাপয়সা সব বুঝিয়ে দিয়ে, ফ্ল্যাটটা ওর নামে করার ব্যবস্থা করে ..’
‘ভাইঝি বলে না ওর কাছে থাকার কথা ?’ বলতে গিয়ে বুকের মধ্যে চাপ ।
‘ওর সংসারে আমার থাকা উচিত নয়, না ?’ উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে হেসে ফেললেন বৃদ্ধ মানুষটি, ‘আপনার মন খারাপ করে দিলাম, না ? আপনার চিন্তা নেই । ভারি ভালো মেয়ে আপনার । মাযের সঙ্গে সঙ্গে পেনশন তুলতে এসেছে কেমন । একজন অপরিচিত মানুষের জন্যেও ওর মায়া । আজকের দিনে এমনটা দেখা যায় না ।‘
তারপর কেমন অন্যমনস্ক হয়েই বুঝি বলে ফেললেন, ‘আমার ভাইঝিও যদি এমন করে ..’ কথা শেষ না করেই চুপ করে গেলেন ।
‘কি ? ভাইঝিও যদি ..? কি ?’
‘কিছু না । স্নেহ নিম্নগামী, জানেন না ?’ বৃদ্ধ আবছা হাসলেন । বড় বিষন্ন হাসি ।
ঘর্মাক্ত কলেবরে উজ্জ্বল হাসি নিয়ে ফিরেছে ইন্দিরা । প্রজাপতির উপমাটাই ঠিক । পলকে ঝলমল করে উঠল চারধার । উলোঝুলো মাথাটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল, ‘এই নিন কাকু, আপনার টাকা । চলুন, আপনাকে অটো রিক্সায় তুলে দিই । আমরাও তো অটো স্ট্যান্ডে যাব, না মা ?’
কাঁপা কাঁপা হাতখানা মাথায় রাখলেন বৃদ্ধ । মুখে কিছু বললেন না । কিন্তু অনুচ্চারিত আশীর্বাণী স্পষ্ট শোনা গেল, ‘কল্যাণ হোক তোমার ।‘
বৃদ্ধকে অটো-রিক্সায় তুলে দিয়ে এল ইন্দিরা । কিছুক্ষণ চুপচাপ দুজনেই । তারপর বৌদির হাত ধরল ইন্দিরা, ‘রাগ করলে, মা ? তোমার অনেক দেরি করিয়ে দিলাম । আসলে এরকম মানুষ দেখলেই বাবার কথা মনে পড়ে । প্রতি মাসে বাবাও এমনি লাইন দিয়ে টাকা তুলতে যেত । আমি তো কলেজ যেতাম, সব মাসে বাবার সঙ্গে যেতে পারতাম না । হার্টের পেশেণ্ট ছিল তো, খুব কষ্ট হত ভিড়ে ।‘
মেয়ের গলাটা ছলছল করতে লাগল ।
আর কেন কে জানে, অপর্ণাবৌদির দু’চোখ ভরে জল এলো । রাস্তার ভিড়, মানুষের অনর্গল কথার শব্দ, গাড়ির শব্দ । কোলাহল ।
হঠাত্ কেমন নি:শব্দ হয়ে গেল চারপাশ ।
কে যেন বহু দূর থেকে ডেকে উঠেছে, ‘খুকু .. খুকু উ উ উ ..’
‘খুকু .. খুকু .. আমার খুকুমণি .. এই নাও রংপেন্সিল ..’
‘জ্যামিতি নিয়ে ঝামেলা ? কোনো চিন্তা নেই .. আয় খুকু, তোকে জ্যামিতি বুঝিয়ে দিই ..’
‘খুকু কলেজ যাবে, বাসে তুলে দিয়ে আসি ..’
‘মিত্রার বাড়ি যাবি ? চল খুকু, আমি পৌঁছে দিয়ে আসি .. মাকে আমি ম্যানেজ করছি ..’
‘খুকুর বিয়েতে অন্তত তিরিশ ভরি গয়না দিতে হবে বৌদি ..’
‘মধ্যমগ্রামের সম্বন্ধটা বারণ করে দিই বৌদি .. অত বড় পরিবার .. খুকুর কষ্ট হবে ..’
স্কুলের ছুটির পর বাইরে এসেই দেখতে পায় খুকু, কাকুমণি দাঁড়িয়ে আছে । খুকুকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে এসে মাথায় ছাতা ধরবে । বন্ধুদের সামনে কি লজ্জাই যে পায় খুকু !
কথা নেই, বার্তা নেই, ডজনখানেক শাড়ি কিনে আনবে কাকুমণি, খুকু নাকি রোজ একই শাড়ি পরে কলেজ যাচ্ছে । মাঝে মাঝেই মনে হয় কাকুমণির, খুকুর মুখটা যেন শুকনো শুকনো লাগছে । অমনি রাশি রাশি ফল, হরলিক্স, মাল্টিভিটামিন ।
মা নিশ্চিন্ত, খুকুর কাকুমণি আছে ।
কাকুমণির জন্যে কিন্তু খুকু ছিল না । কাকুমণির কেউ ছিল না । এই বৃদ্ধ মানুষটির মত । দুই বৃদ্ধে কি অসম্ভব মিল !
সমবয়সী হলেই বুঝি মিল হয় ? এই ইন্দিরার মতই বয়স ছিল না খুকুর ? তাহলে ? মস্ত অমিল হল কি করে ?
বড্ড ভয় । বুকের মধ্যে জমাট বাঁধা ভয় । এই বুঝি সংসারে অঘটন ঘটল । এই বুঝি সংসারের ছন্দ কেটে গেল । প্র্যাকটিকাল হতে গিয়ে, শুধু নিজেরটুকু বাঁচাতে গিয়েই কি এত বড় ভুল হয়ে গেল ? না না, ভুল নয় । অন্যায় । নিষ্ঠুরতম অপরাধ ।
নইলে কাকুমণিকে হারিয়ে ফেলা হয় ? আজ ইচ্ছে হলেই খুকু বারবার হিমালয়ে ফিরে যেতে পারে, ফিরতে পারে সাগর সঙ্গমে । কিন্তু কাকুমণিতে ফেরার উপায় নেই আর ।
আহা ইন্দিরা । ওকে কোনো ভয় নিয়ে, কোনো অপরাধবোধ নিয়ে বাঁচতে হবে না । মায়ায়, মমতায়, ভালোবাসায় সবরকম ভয় মুছে ফেলার মন্ত্র জানে ও । ইচ্ছে হলেই ওর নিজের বাবার কাছে ফেরার সুখ আছে । দু’দন্ড বাবার কাছে বসার শান্তি আছে ।
রাস্তায় কড়া রোদ্দুর । লম্বা লম্বা সবুজ গাছগুলো নিশ্চল, নিস্তব্ধ । একটা পাতাও হাওয়ায় দুলছে না । কালো পিচের রাস্তা থেকে গরম হলকা ।
চোখে কালো চশমা পারে নিলেন বৌদি । চোখের জলটা লুকোতে হবে । এমন করেই যদি নিজের কাছ থেকেও লুকিয়ে থাকা যেত !
ইন্দিরার মায়াময় হাতখানা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন । এই হাত ধরেই নিঝুম রাস্তাটা পার হতে হবে । কি করলে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হয় কে জানে । যত কষ্টকর হোক, তাই করবেন এবার । কাকুমণির কাছে ফিরতেই হবে ।