সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

শুক্রবার, ২১ জুন, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ ৮ম সংখ্যা

সম্পাদকের কলম থেকে



প্রিয় সুধীবৃন্দ,

বেরোতে চলেছে আপনাদের প্রিয় সৌকর্যের অষ্টম সংখ্যা।

এই মুহূর্তে, আমাদের পায়ের তলার মাটি, আর অগ্নিবলয় প্রায় সমকক্ষ। এই মুহূর্তে আমরা পরিবর্তনের চরমসীমা দেখে চলেছি, আমাদের ঘরের মেয়েদের গতকালও কোন নিরাপত্তা ছিলনা, আজো নেই, আমরা শুনতে পাচ্ছি, বুদ্ধিজীবিরা পর্নোগ্রাফির ব্যাবসা করেন, যা আমরা বিগত পঞ্চাশ বছরে কোন রাষ্ট্রনেতার মুখে শুনিনি, আমরা আর খুঁজে পাচ্ছিনা সেই পরিবর্তনকামী মোমবাতি ওয়ালাদের, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে ভাষণ ছুটে আসছে বারংবার, আর আমরা ভেবে চলেছি, আমরা ঠিক কোন পথে হাঁটব?

সেইরকম একটা সময়ে, আমরা নিজেরাই যেখানে দ্বিধাগ্রস্ত, আমরা বের করতে চলেছি এই সংখ্যাটি।

সঙ্গে রেখেছি, পূজা মৈত্রর এক অসাধারণ একালীন ও আইভী চ্যাটার্জীর এক চিরকালীন মর্মন্তুদ গল্প, সঙ্গে রেখেছি এক প্রবীন নবীন কবি, অনুপ দত্তর গুচ্ছ কবিতা, রেখেছি ওয়ার্ডস ওয়ার্থ এর অনুবাদ, আর এক ঝাঁক তরুন ও অভিজ্ঞ কবির কবিতা।

এই সংখ্যার এক বিশেষ আকর্ষন সমকালের পর্যালোচনা, যা উঠে এসেছে শ্রীশুভ্রর কলমে।

আশা করব, আপনারা সকলে আগেও যেরকম সঙ্গে ছিলেন , এবারেও তাই থাকবেন...

ধন্যবাদান্তে,

সম্পাদক
সৌকর্য

কবিতা - কচি রেজা

মুদ্রাদোষে
কচি রেজা

মুদ্রাদোষে ঝরে পড়ল ক'য়েকটা আপেল। ঝরে পড়া নিয়ে মৃদুস্বরেও বললো না কিছু কেউ, যখন সূত্র আবিষ্কার হয়, নিউটনের আগেই কিন্তু জন্মেছিল আপেল, রোজ কিছু ফাঁদ, কিছু গর্ত,বালিকার ভোরের ফ্রক ঠেলে উঠলে উচ্চতার চাপে চোখে সামান্য নিউটন, টেনে রাখা বাহু উড়ে উড়ে চালেঞ্জ করে গালের টোলের পতনরেখা, রিলেটিভিটির ফেমাস আর দরকারি সত্যটা রয়ে গেল অজানাই, মুদ্রাদোষে এইভাবে আমিও আপেল ।

বৃহস্পতিবার, ২০ জুন, ২০১৩

গুচ্ছ কবিতা - অনুপ কুমার দত্ত

গুচ্ছ কবিতা
অনুপ কুমার দত্ত




তোর ওড়না ভেজা বৃষ্টি বুকের ত্রাসে

এমন যে তোর সুন্দরতার ভান
মায়ের চোখে সবাই একই তান ৷
বিষাদ মুখে বিষন্নতার ঢেউ
আমার চোখে ভীষন আপন কেউ ৷৷

ভয় পাস নে নেবে না কেউ কেড়ে
বাড়া ভাত দেবে না নোতুন করে বেড়ে ৷
তু হি মেরী, …ও তু হি মেরী জান
থাক না ঠোঁটে মেরিজুয়ানার ঘ্রান ৷৷

ঠোঁট ছোঁয়ালে আকাশ ভাঙ্গে আমার
প্রথম চুমু’র আনন্দ তাই অপার ৷
তারপরে কত রাতজাগা চোখ ভাবে
একটু হাসি তোর বসন্ত ফুল পাবে ৷৷

গোলাপ নিয়ে আদিখ্যেতা ভীষণ
সে রকম’ই তোর মনটা ভাবে যখন ৷
বুকের উপরে শক্ত দু হাত ঠুকে
কল করেছি তোর বন্ধ ফোন বুকে ৷৷

দেখিস আবার অন্য কিছু না ভাবিস
সোনা বুকুল সঙ্গে আমার থাকিস ৷
পদ্যে গদ্যে মিলে ছন্দ যেমন হয়
এস এম এস’এ মন নিরূদ্দেশ ভয় ৷৷

বুক ব্লাউজে ব্লুটুথ লাগিয়ে রাখিস
ঘরে যদি হৃদয় উদাস থাকিস ৷
মেঘলাকাশে যদি সিগন্যল না থাকে
শব্দ ভাইব চলবে এঁকে বেঁকে ৷৷

বার বার তোকে বলেছি ঘনিষ্ঠ বেশে
সব রাস্তাই শেষ তোর বাড়ি এসে ৷
রবিঠাকুর থাকুন দু লাইন ভালবেসে
তোর ওড়না ভেজা বৃষ্টি বুকের ত্রাসে ৷৷



বুকের জমানো লতা


তোমার বুকের জমানো লতারা কি বলে ? সামন্য শান্তির জন্যে যদি চুরি হয়ে যাই লতারা কি বেঁধে ফেলবে আমায় ।
কেন ? হিংসুটেপনা । হিংসের নামে বড়াই ।
আমার তুমি’কে দজ্জাল আয়ত্ত করেছি কেমন …
পরবাসী চোর ভো কাট্টা হয়ে যায় ..লাটাই গুটিয়ে লাঙল-হাটায়
রেল লাইনের দুপাশে নারীর দুকুল তুলে দিয়ে অনায়াসে ফিরে আসে বুকের জমানো লতায়

নতুন পাখীরা কি বলে ?
পাখীরা তো নির্বিশেষ আলাপ ভালবাসে ।নতুন পাখীর সঙ্গ হলে বয়েস উচ্ছিসিত কমে আসে
আজলা ভরা জল যেন ঊপচে পড়ে সমুদ্র সৈকতে …সমুদ্র লজ্জা পায় ।
মনের চার কোনের বন্ধ দরজা খুলে নারী পাখী বসে তাতে
যৌবন আজলা ক’রে টিন এজেড নারী পাখী
পায়ে আঁটো সাটো জিনস ..
বুকে don’t dare to touch me টপ
চুল মুঠো করে বাঁধা পেছনের দিকে …যেন ঘোড়া ছূটে চলেছে সারাক্ষণ
চোখে রঙ্গিন সুরমা…না না ভুল হলো বুঝি
অনুপ দত্ত …বুড়ো হয়ে গেছ..correct করো….ওটা eye liner….

আবার হিংসুটে বুকের লতারা ফিরে জড়ো হয় । একটা বেশ গোল টেবিল হয়
বর্ষিয়ান শক্ত বট লতা বলে…
-লতা সঞ্জিবিনী…তোমার ফুটফুটে পাখী যে ডালে বসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সাপের মতন
রং চঙ্গা জিনস প্রেরনায়
বুড়ো বট তাই হেলেছে কোল জাগায়… চুলবুলে পাখীটাকে বাঁধো এবার খাঁচায়
বয়েসের কি দোষ ….বয়েস বাড়ে যে নিতান্ত সবুজ তাড়নায় ।



বেলা পড়ে যায়

তুমি যদি আমায় না রাখো কাছে ৷ না রেখো!
দেখি মনে প্রানে তোমার ছায়া রেখে ঘরে
একা বেঁচে থাকতে পারি কিনা?

একা জীবনের দাম তো বেশী বই তো নয়
তুমি সাথে থাকলে দোগর হতাম…
ভিন্ন কথা বলা বুলবুল, ল্যাকি জোড়া শালিকের মতো ৷
ছায়া তো নিলাম হয় না…..আর
ছায়ার যে কি দাম তাও জানি না৷

একুশ বছর কুয়াশা বিবাহ বাসরের… কিছু নেই
কিছুই তো নেই!
অন্ধকার সমাস হয়ে জড়িয়েছে বেদনা৷
বেদনাবিভাসশোকপাপীতাপী চেঁচিয়ে বলেছে –
ও পৃথিবী তুমি কি একাই ধর্ষন দায়িত্ব নিয়েছো ?
কুয়াশা বিবাহ যে একবার রোজ ক্ষয়ে যাওয়া ধর্ষন
সে তুমি জানো!
না হলে একুশ বসন্ত কূয়াশা আবেগে নিঃশব্দ সহবাসে
সবেগ মিলনের একপেশী আকাঙ্খা কি পরিমিত ধর্ষন নয় ?

কিছু নেই … কিছুই তো নেই !
মন পড়ে আছে…মন সেখানে নেই
উলঙ্গতা যেখানে সেজেছে…মনের ভেতর
কাপড় প্রাচুর্য্য শরীর জড়িয়ে ফুলটুসি সাজে ৷

দ্যাখো এতো কথা বলা
সে তো তোমার’ই জন্য…জেনে যাও…জেনে যাও
একান্ত ভাবে জেনে যাও
তোমার ছায়া করে, ঘরে রেখে খিল দিলে
সংসার উন্মুক্ত খোলা বেদ হয়ে যায় ৷

কিছু নেই …কিছুই তো নেই !
কিছু থাকে না কোথাও…
একুশ কুয়াশা বসন্ত পেরিয়ে..বেলা পড়ে যায় ৷



সুনীল শুন্য পারাবার

নবমী গুঞ্জন ছেড়ে...তিনি চলে গেলেন ইহলোকধামে ।
যাঁর কবিতা পড়ে আবার জন্ম নিয়ে
পা জমিয়েছিলাম কবিতার আসরে ।

হে অনন্ত বাহূ আকাশ
হে দূরন্ত সবুজ পৃথিবী
পথিকৃত চিত্রকরের আনন্দ সুবাসে শান্তি দিও তাঁকে ।

হে ঈশ্বর তুমি তো অন্তরযামী

তুমি দেখো......
তাঁর যাবার পথে বৈতরনী পুন্যজলে স্নাত হোক
যে ভাবে মাঙ্গলিক শ্লোক ভেসে আসে পবিত্র গঙ্গাজলে
সেই ভাবে তাঁর মঙ্গল শব ব্যথাকাঠে মহাশয়ান
যেন প্রভু যিশুকে বইতে দেয়া ব্যথামহান ।

তুমি দেখো.....
গঙ্গা থেকে যমুনা..গোদাবরী সিন্ধু হয়ে স্বরস্বতী থেকে পদ্মা জলে
তাঁর ক্লান্ত মুখ যেন ধুয়ে দেয়া হয়
তাঁর কমল নরম শরীরে যেন বর্ষন করো নির্ঝরের সুখে অমৃত বারি ।
হে মহা নিম কৃঞ্চচূড়া শাল সেগুনে বন মহাক্রম

তুমি আদেশ দাও......
তাঁর যাত্রা পথে সমস্ত গাছেরা যেন তাঁকে দেয়
শান্ত গন্ধবিতান মহানির্ঝর ছায়াঘুম ।
মহানিম শান্ত বটের পাতার মৃদুল হাওয়ায়
সে শান্ত ঘুমায়....সে শান্ত ঘুমায়
তাঁর শেষ যাত্রা পথ মহীহান হোক আবর্ও সুখের সুখমহানে ।

তুমি দেখো.....
তাঁর যেন কোনো আঘাত না লাগে ।
সে পুরূষ বিশাল এক দেশ পরিবার নিয়ে হেঁটেছেন
পৃথিবীর পথে আটাওর কাল
শত কবিতা পথিকবরকে পথিকৃত করেছেন
কবিতার অঙ্গনে ভালবাসা শব্দ চয়নে
আজ শবানুগামীর পিছে তারা একাকী দু:খে দাঁড়িয়ে ।

আজ পঁচিশে অক্টোবর কাল দুহাজার বারো
জানুক.......

তাঁর মুখে গহীন সমুদ্র আলো
তাঁর শরীর নীলাদ্রী মৃত্যুহীন ।




দেশাদেশ সেই বাঙ্গলাদেশ

প্রতিটি গ্রাম প্রত্যেক অপরুপা মায়ের মমতা উপমা
মায়ের লম্বা আঁচল ফেলা আচুম্বি মমতা ভিতে
মা আসে পাশে বাপ মা মরা ছেলেকে করুনা আঁচল দিতে
প্রতিটি গ্রাম শান্তি প্রতীক—যেন দিগন্ত বড় উৎসব নমুনা ।

সেই একবার সব কিছূ ফেলে রেখে আসা রেশ
বারবার অপরুপ সেই দেশাদেশ বাঙ্গলাদেশ ।

ফেলে আসা দেশ.. ফেলে আসা স্মৃতি বেড়ে ওঠা গল্প
প্রতিবেশী শৈশব পরিজন..কিশোর পরিযায়ী হরমোন
কিশোর বেহিসেবী পাখী আত্রেয়ী শঙ্খ উলঙ্গতা জলে
ভালোবাসা বেশ, আধুরী স্মৃতি উন্মেষ
সব কিছু ফেলে রেখে আসা দেশাদেশ ... সেই বাঙ্গলাদেশ ।

কিশোরীর হাঁটু মোড়া বসা লক্ষে অলক্ষে
ফ্রকের সীমানা ঘেরাটোপ ছোট হয়ে এলে
সযত্ন শাড়ীর শরীরে গাছ কোমড় বাঁধা
উন্নত বুক উন্নিত আঁচলে ঢেকে রাখা অহঙ্কার সুখ-মুখ
চোখে এক অজানা ভাষা যেন ..এক এক শব্দকোষ
কত কথা ..না বলে যাওয়া ..না বলা কথা
কিছু অস্ফুট অটুক্তির মেলমশা হর্ষ স্বর
হ্রেষার মতো সারা রাত জাগায় সকালের প্রতীক্ষায়
সব কিছু ফেলে রেখে আসা দেশাদেশ সেই বাঙ্গলাদেশ ।

সেই সব অবহিত ..অকথিত..অবনমন ক্ষন
বট গাছের ঝুড়ি আত্রেয়ী নদী জল ছুঁয়ে ফেলে
ছাঁচা বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে চোখের আধারে
ঢুকে পড়ে দুপুর নব বরবধুর মধুর আপন
রাত ফুরালে আবার ভাল লাগা ফরসা ভোর
উঠোনে শালিক চড়ুই ডাক ..চিক চিক
দেশভাগা দেশ ..স্মৃতি কান্না স্তব্ধতা
সব কিছু ফেলে আসা দেশাদেশ সেই বাঙ্গলাদেশ ।




কবিতা - অমলেন্দু চন্দ

বেঁচে থাকে বেঁচে থাকা
অমলেন্দু চন্দ



বায়ান্ন ভাতারি মৌচাকে
সাপের খোলসের মত সঙ্গম পড়ে থাকে
এক ফালি দরমাঘেরা বিছানায়
উঠোনে কি বারান্দায়
সমস্ত সুমিত আবেগ বনিতার তোরঙে বন্দী

কক্ষচ্যুত উচ্ছনের উল্লাসে ক্রীতদাস
ইয়ার মাতাল
পোস্টারে ঢিল ছুঁড়ে ছবির ব্লাউজ ছিঁড়ে
মেয়েমানুষের ছবি ঠিক ঠাক মেয়েছেলে নয়
বলে চিরকাল আসে যারা
চিরকাল
ওরা সেই জানু ভানু কৃশানুর রক্তের ক্ষিদের নালিমুখ

ওরা সব ভিনদেশী কামাক্ষী মোহনা
অনেক ঘেন্নার টুঁটি চেপে
ওদের সমস্ত মধুমাস
নিলাজ আয়েনার বুকে প্রতিবার সাজে
রোহিণী শঙ্খিনী দেয়ালায়
মধ্যবর্তী সময়ের ফাঁকে

কবিতা - রুদ্রশংকর

ইচ্ছে হল মৃন্ময়ী
রুদ্রশংকর



ক্রমশ ব্রহ্ম অস্তিত্বের উপর উড়ে এল মহাসেন ঝড় ...
আর সেই সঙ্গে প্রেমের কবিতা লেখার তেলচিটে ইচ্ছেরা
হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়ল জুম্মার মজলিশে ।
অমনি আটকে পড়ি উভচর জন্মের বারান্দায়,
আধুনিক স্বপ্নগুলো সমুদ্র-ঝিনুকের মধ্যে হামাগুড়ি দেয়
টগবগ করে ফুটে ওঠে রাজপথের বন্ধুত্ব
ছাইচাপা আগুনে পুড়ে যায় আমার আধময়লা চুম্বন...

এইভাবে ঝুলন্ত গল্পের মধ্যে বেঁচে থাকে ভালবাসা
দুরন্ত ধমক দিয়ে যায় রাস্তার বৈশাখী ধুলো
বইয়ের পুরনো ভাঁজে হাতচিঠি পড়তে পড়তে
নিজেকে নিবিড় করে ডুব-সাঁতার শিখেছে যুবক,
আর একটু এগোলে
নাভীমূলের আড়মোড়া ভেঙে আছড়ে পড়ে স্বাভাবিক ঢেউ;
এখনো জুম্মাবার এলে
বিদ্যুৎ স্পর্শের মতো তোমাকে মনে করি ।




গল্প - আইভি চট্টোপাধ্যায়

কাকুমণি
আইভি চট্টোপাধ্যায়



-এক-

বাবা অচিন পথে পাড়ি দিয়েছিলেন, অপর্ণাবৌদি তখন সাত বছর । বাবার অভাব বোঝার অবশ্য সুযোগই হয় নি । কাকা তাঁদের মা-মেয়েকে আগলে রেখেছেন । ব্যারাকপুরে গঙ্গার ধারে কাকার বাড়িটাই নিজের বাড়ি ছিল । সেই বাড়ি, যার বারান্দায় দাঁড়ালে গঙ্গা দেখা যায় আর ছাদে উঠলে গঙ্গার ঢেউ । যে বাড়িটায় সারাক্ষণ নদীর বাতাস ঠান্ডা করে রাখে ।

বিয়ে পর্যন্ত করেন নি কাকা । পাছে 'পরের মেয়ে' এসে তাঁর বৌদিকে, ভাইঝিকে অবহেলা করে ।

আজ অপর্ণাবৌদির ভরা সংসার । কর্পোরেট স্বামী, ইঞ্জিনিয়ার ছেলে । তিনটে গাড়ি, বাংলো বাড়ি, সবুজ লনে সাদা দোলনা । বাগানে পাম ক্রোটন ঝাউ । ঋতুর হিসেবে মরশুমি ফুল । মালী সারাবছর বাগান ঝলমল করে রাখে । রোজ বিকেলে লনের দোলনায় বসে অপর্ণাবৌদি চা আর মাছের চপ খেতে খেতে বাগানের তদারকি করেন । লম্বা কান দুলিয়ে লুসি বাগানে খেলা করে । সন্ধে হলে লুসিকে কোলে নিয়ে হণ্ডা সিটি চেপে বৌদি বেড়াতে যান ।

মাকে কাছে এনে রেখেছেন । মেয়ের সুখ দেখে মাযের চোখ জুড়োয় । মা সঙ্গে থাকায় রান্নাবান্নার দিকটা মসৃণ । আরেকদিকেও সুবিধে হয়েছে । শ্বশুরবাড়ির কেউ পাকাপাকি থাকতে চায় নি । বৌদির সংসারে সর্বক্ষণ ঠান্ডা বাতাস ।

কিন্তু অপর্ণাবৌদির মনে শান্তি নেই ।

বন্ধুদের কাছে আক্ষেপ করেন, ‘কি মুশকিলে যে পড়েছি ! সামনের জানুয়ারীতে কাকু রিটায়ার করবে । বলছে, আমার তো আর কেউ নেই .. তোর কাছেই শেষ জীবনটা কাটাব ।‘

‘ভালোই তো । এত বড় বাড়ি তোমার, এমনিই তো তিন চারটে ঘর খালি পড়ে আছে । ছেলে বাইরে, সোমেনদা মাসের মধ্যে পনেরোদিন ট্যুরে । মুশকিল কেন ? কাকা খুব মেজাজী বুঝি ? খুব বায়নাক্কা ?’

‘না, তা নয় । কাকু চুপচাপ মানুষ, নিজের কাজ নিজেই করে । দেখেছ তো তোমরা ।‘

‘হ্যাঁগো, দেখেছি তো । সেবার এলেন, সারাদিন তোমার বাগানে থাকতেন । কতরকম গোলাপ, ডালিয়া করেছিলেন । রবিবার হলেই টাটকা সব্জি কিনতে বাজারে । নাতি খাবে বলে মাংস, জামাই খাবে বলে ইলিশ । খুব ভালোবাসেন তোমাদের । তাছাড়া এমনিও তোমার আউটহাউসে এতগুলো কাজের লোক । কাকুর কাজে তোমায় লাগবেও না । তাহলে ? সোমেনদা আপত্তি করছেন ?’

‘না, তা নয় । আপত্তি আমারই । তোমাদের সোমেনদা আমার কোনো কাজে বাধা দেয় না । ও তো উল্টে আমাকেই বলছে, কাকু যখন নিজে আসতে চাইছে তখন আপত্তি কোরো না । ভালো দেখায় না । আসলে কাকুর সব সম্পত্তি, টাকা পয়সা আমিই পাব যে । তাই তোমাদের সোমেনদার সঙ্কোচ । যদিও এ সঙ্কোচের কারণই নেই । কাকুর আর কে আছে যে সম্পত্তি দাবী করবে ? কি করে যে ঝামেলাটা ঘাড় থেকে নামাই !’

বৌদির মাও বিরক্ত, ‘একে আমি জামাইবাড়িতে আছি, আবার ঠাকুরপো আসতে চাইছেন । একটু যদি সাংসারিক বুদ্ধি থাকত !’

সাংসারিক বুদ্ধি থাকলে আজ কাকুরও যে ভরা সংসার থাকত, সে কথাটা অবশ্য কারো মনে আসে না ।

ভাবতে ভাবতেই জানুয়ারী এসে গেল । কাকুর অবসর জীবন শুরু হল । অপর্ণাবৌদি আর সোমেনদা গিয়ে টাকাপয়সার সব ব্যবস্থা করে এলেন । পোস্ট-অফিসের এম-আই-এস, ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিট, সিনিয়র সিটিজেন ডিপোজিট । সব কাকুর খুকুর সঙ্গে জয়েন্ট । তাছাড়া বাড়ির নমিনেশন, পেনশনের নমিনেশন । কাজ কি একটা ! সাতদিন থেকে সব ব্যবস্থা করে বৌদি ফিরে এলেন ।

কাকু বলেছিলেন, ‘একেবারে তোদের ওখানে গিয়েই নাহয় অ্যাকাউন্টগুলো খুলতাম খুকু । আবার সব ট্রান্সফার করার ঝামেলা ..’

খুকু হেসে হেসে বলেছে, ‘এখন কদিন এখানে থেকে সব গুছিয়ে নাও কাকুমণি, তারপর ..’

তা ঠিক । বাইশ বছর কাজ করছিল রঘু, দেশে তার বাড়িঘর কাকুই করে দিয়েছিলেন, এবার ছুটি দিলেন । চোখের জল মুছতে মুছতে রঘু দেশের বাড়ি চলে গেল । পাড়ায় একটা লাইব্রেরী করার কথা দিয়েছিলেন, এবার সে কাজটাও শুরু হল ।

শান্তিপুরে মাসিমার মেয়ের বিয়ে, নৈহাটির পিসতুতো দাদার চিকিত্‍সার ব্যবস্থা । কাকু রিটায়ার করেছেন খবর পেয়ে কত ভুলে যাওয়া সম্পর্কই যে নতুন হয়ে উঠেছে ।

ভালোবেসে করার কাজও অবশ্য আছে । পাড়ায় মশামাছির উপদ্রব, লোক ধরে নালা নর্দমা পরিষ্কার । শ্রীরামপুরে বাড়ি করেছে দীর্ঘদিনের সহকর্মী বিনয়, তার গৃহপ্রবেশের ব্যবস্থা । ছোটবেলার বন্ধু পলাশ বৃদ্ধাশ্রমে আছে, দেখা করে এলেন একদিন । পাকাপাকিভাবে খুকুর কাছে যাবার আগে এদিকের সব মিটিয়ে নেওয়াই ভালো ।

কিন্তু খুকুর কাছ থেকে ডাক আসে না । কাকুমণি অপেক্ষায় রইলেন । ছ’মাস .. আটমাস .. এক বছর । খুকুরা নিজে থেকে খবর না পাঠালে আসেন কি করে ? তবু একবার নিজে থেকেই এলেন । কি হল কে জানে, আবার ফিরেও গেলেন ।

পাড়ার লোক বলে, ‘ফিরে এলেন যে ?’

‘এই ব্যাঙ্কের কাজ আছে একটু ।‘

‘আমরা ভাবলাম, নতুন জায়গা, তাই বুঝি অসুবিধে । তাহলে খুকুর কাছেই থাকবেন ? থাকতে পারবেন নতুন জায়গায় ?’

কাকুমণি হাসেন, ‘স্নেহ নিম্নগামী, জানো না ?’ কি কথার কি উত্তর !

হঠাত্‍ একদিন সকালে বৌদির বাড়িতে ফোন । পুলিশের ফোন ।

ক’দিন ধরে কাকুকে বাইরে দেখা যায় নি । বাড়ির বন্ধ দরজায় তিনদিনের খবরের কাগজ, তিনদিনের দুধের প্যাকেট । মর্নিংওয়াকে গিয়ে রোজ যে কুকুরছানাটাকে রুটির টুকরো খাওয়াতেন, সে নাকি দরজার কাছে বসে চিত্‍কার করেছে খুব, তারপর আশেপাশের বাড়ির দরজায় দরজায় গিয়ে চিত্‍কার করেছে । কুকুরটার কান্ড দেখে লোকের সন্দেহ হয়েছে। তারপর পাড়ার ছেলেরা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকেছে । পাড়ার ছেলেরাই পুলিশকে খবর দিয়েছে ।

ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক । একলা ঘরে একা একা । কে জানে কেমন ছিল সে যাত্রা, নিকটতম প্রতিবেশীকেও ডাক দিতে পারেন নি ।

কাকুর হিমশীতল শরীর তিনদিন ধরে কোনো আপনজনের অপেক্ষায় ছিল ।

ব্যারাকপুরের একলা বাড়িটা, কাকুর একাকী জীবনের সঙ্গী বাড়িটা নিঝুম । শুধু গঙ্গার দিকে বারান্দাটা, যে বারান্দায় বসে জলের দিকে চেয়ে আর গঙ্গার বাতাস মেখে একাকী সময় কাটাতেন, সেই বারান্দার দিকের খোলা দরজাটা আপনমনে কপাটে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে কিসের যেন প্রতিবাদ করছিল । পুলিশ দরজাটা বন্ধ করে তালা দিয়ে দিল ।

পুলিশ, পোস্টমর্টেম । দাদা-বৌদি গেলেন, সত্‍কার করে এলেন । বন্ধুরা সমবেদনা জানাতে গিয়ে অপ্রস্তুত । অপর্ণাবৌদি খুব বিরক্ত, শুধু শুধু কাকা ঝামেলায় জড়িয়ে গেছেন । কাকার বাড়ি, ব্যাঙ্কের টাকা, সম্পত্তি পেয়েও ঝামেলাটা ভুলতে পারছেন না ।

বৌদির মাও বিরক্ত, ‘কোন জন্মের শত্রুতা ছিল কে জানে । থানা পুলিশ মর্গ পোস্টমর্টেম .. কত ঝামেলায় জড়িয়ে দিল।‘

দিন কয়েকের মধ্যে বন্ধুদের কাছে ফোন এল বৌদির, ‘বেনারস থেকে গুরুজি এসেছেন, বাড়িতে নামগান হবে । চলে এসো বিকেল বিকেল, পুজো আছে । অবশ্যই এসো সবাই, বিশেষ পুজোর ব্যাপার ।‘

বিশেষ পুজো ! কী ব্যাপার ! এখন তো কোনও বিশেষ তিথি নেই । অমাবস্যা গেল এই দুদিন আগে । কৌতুহলী বন্ধুরা সবাই এলেন ।

বৌদি ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করলেন, ‘শান্তি-স্বস্তত্যয়ন করাচ্ছি, বুঝলে ? অপঘাত মৃত্যু । ভূত প্রেতকে আমার খুব ভয়, কখন ঘাড়ে চেপে বসে ! ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি । কদিন ধরে কি সব কান্ড হচ্ছে, জানো ? এই রান্না করে রেখে এলাম, কে যেন সব খেয়ে নিচ্ছে । কাল মালাই চিকেন করেছিলাম, কে যেন ওপর থেকে মালাইটা খেয়ে নিয়েছে । তোমাদের সোমেনদা সেদিন বাগানে দাঁড়িয়েছিল, কে এসে পিঠে দুমদুম করে কিল মেরে গেছে । লুসি তো সর্বক্ষণ ভয় পেয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে থাকছে । ওরা সবার আগে অপদেবতাকে টের পায়, জানো তো ? কাকু যে আমাদের কি সর্বনাশ করে গেল !’



-দুই-


মুম্বাইতে ছেলের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন অপর্ণাবৌদি ।

বেড়াতেই । ছেলে-বউয়ের সংসারে থাকা তাঁর না-পসন্দ । বউ নিয়ে অবশ্য সমস্যা নেই । দেখেশুনে বড়লোকের একমাত্র মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন । রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী । ইন্দিরা মেয়েটা বেশ বাধ্যও । যদিও সাজ পোশাকে তেমন সাব্যস্ত নয় মেয়ে । হয় ঝুলুর ঝুলুর একটা সালোয়ার কামিজ, নয় যেমন তেমন একটা শার্ট আর জিনস প্যান্ট । ব্যস । একটু বেভুল আছে মেয়েটা । সে একদিক দিয়ে ভালোই । বেশি বায়নাক্কা নেই বউয়ের ।

তবু বৌদি শান্তিতে নেই ।

সমস্যা বৌদির মা । স্বামী গত হবার পর মাঝে মাঝেই এ বাড়িতে এসে থাকেন । ছেলেটা ভ্যাবলা । বোঝেই না যে শাশুড়ির দায় ঘাড়ে চাপছে । একমাত্র মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে শ্বশুরবাড়ির উটকো ঝামেলা বাবাইকে বইতে না হয় । যোধপুর পার্কের অত বড় আর সুন্দর বাড়ি ছেড়ে মহিলা এই দু’কামরার ফ্ল্যাটে এসে থাকতে চাইবেন কে জানত । কার সঙ্গে যে এ নিয়ে আলোচনা করেন !

দাদাকে বলতে গেলেই .. ‘আহা, মেয়ে মাকে একা একা থাকতে দেবে না, তাই নিয়ে এসেছে । ভালোই তো । তোমার ছেলেরও তো বেশ যত্ন হচ্ছে । যাই বলো, বেয়ানের হাতের রান্না কিন্তু দারুণ । আমারই খাওয়া বেড়ে যাচ্ছে..’

বৌদির মুখের দিকে চোখ পড়তেই শুধরে নেবার চেষ্টা, ‘তোমার মাও তো সারাজীবন আমাদের সঙ্গে থেকেছেন । কিছু অসুবিধে হয়েছে, বলো ?’

এই লোকের সঙ্গে মন্ত্রণা করা যায় !

ভেবে ভেবে এই উপায় করেছেন বৌদি । মাঝে মাঝে এ বাড়িতে এসে থাকা । তিনি এলে ও মহিলার বাধো-বাধো লাগে । নিজের বাড়িতে ফিরে যান । শত হোক, মেয়ের মা । চক্ষুলজ্জা তো আছে ।

মাকে তো এইভাবে সামলানো যাচ্ছে, তবু শান্তি নেই । মেয়ে আরেক কাঠি বাড়া । মাকে নিয়ে মেয়ের আদিখ্যেতার শেষ নেই ।

এই তো আজ যেমন । অফিস কামাই করে মেয়ে চললেন পোস্ট-অফিস থেকে মাযের টাকা তুলতে । পোস্ট-অফিস থেকে টাকা তুলে সে টাকা কলকাতায় মাযের ব্যাঙ্কে পাঠাবে ।

কেন বাপু ! কলকাতার পোস্ট-অফিসে কি কাজ হয় না ? এত দূরে মুম্বাই শহরে পোস্ট-অফিসে টাকা রাখার দরকার কি ? নাকি মেয়ে দেখাশোনা না করে দিলে নিজের টাকাপয়সা সামলানোর ক্ষমতা নেই ?

কই, বাবাইকে দিয়ে তো নিজেদের কাজ করান না বৌদি । বাবাইও তাঁদের একমাত্র ছেলে । তার তো বাড়ি নিয়ে, বাপমা নিয়ে এত মাতামাতি নেই । রীতিমতো প্র্যাকটিকাল ছেলে তৈরি করেছেন বৌদি ।

মুখে অবশ্য বলেন নি কিছু । কায়দা করে ইন্দিরার সঙ্গী হয়েছেন । মেয়েটাকে চোখে চোখে রাখতে হবে । এইভাবে অন্যের জন্যে, হোক না নিজের মা, সময় নষ্ট করা কি আজকের দিনে মানায় ? সময় বুঝে ব্যাপারটা মেয়ের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে । প্র্যাকটিকাল হবার শিক্ষা দিতে হবে মেয়েটাকে । নইলে বাবাইটার কপালে দু:খ আছে ।

পোস্ট-অফিসে লম্বা লাইন । বসে বসে বিরক্ত লাগছে । এক সময় কাজ শেষ হল । ‘চলো মা, আজ তোমায় কেএফসিতে খাওয়াব । বাবার জন্যেও নিয়ে যাব ।‘

ভালোই হল । ওই কেএফসি-তে বসেই ইন্দিরাকে বোঝাবেন আজ । বাড়িতে তো সর্বক্ষণ প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়ায়, এইবার একলা পাওয়া যাবে ।

পোস্ট-অফিসের দরজার কাছটায় বেশ ভিড় । ইন্দিরা শক্ত করে হাত ধরে আছে, বৌদি যেন ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাবেন । মনের কাছে লুকোনো নেই, মেয়েটার এইভাবে আগলে রাখাটা বেশ লাগছে । বৌদি যেন ছোট মেয়েটি, আর এই মেয়েটা যেন তাঁর মা ।

বেরিয়ে আসছেন .. হঠাত্‍ দাঁড়িয়ে পড়ল ইন্দিরা । ‘মা, একটু দাঁড়াও তো । এসো, এইখানে বসো । আমি আসছি ।‘

ভিড় ঠেলে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে ধরে ধরে এনে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিল, ‘আপনি এখানে বসুন, আমি দেখছি ।‘ ভদ্রলোকের হাতের পাশবই আর কাগজপত্র নিয়ে অন্য একটা লম্বা লাইনে দাঁড়াল ।

অচেনা মানুষের সঙ্গে গল্প করা বৌদির স্বভাব নয়, তবু পাশাপাশি বসে কতক্ষণ আর চুপ করে থাকা যায় ! যে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েছে ইন্দিরা, ঘণ্টাখানেক সময় লাগবেই । পনেরো মিনিটেই বৃদ্ধের নানা গল্প শোনা হয়ে গেল । একা থাকেন, কাছেই ফ্ল্যাট । নিজের রান্না নিজেই করেন, ঠিকে কাজের মেয়ে বাসন মেজে ঘর মুছে যায় । দোকান বাজার, ব্যাঙ্ক পোষ্ট-অফিস, সব একা একা ।

‘যতদিন হাত পা চলছে, চিন্তা নেই । করুণাময়ের কাছে একটাই প্রার্থনা, বিছানায় পড়ে থাকার অবস্থা যেন না হয় । আর সব তবু হয়ে যাচ্ছে, রাতের বেলায় আজকাল সাহস পাই না । একলা ঘরে কবে মরে পড়ে থাকব, কেউ খবরও পাবে না । একলা জীবন, অভিশপ্ত জীবন ।‘

‘একলা কেন ? বাড়িতে আর কেউ নেই ? মানে .. আপনার স্ত্রী .. ছেলেমেয়ে ..’

‘না, সেসব পাট নেই । সংসারে নিজের বলতে এক ভাইঝি । দাদা অল্পবয়সে চলে গেলেন, কাকু কাকু বলে মেয়েটা বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁদেছিল । সে-ই আমার সব । সে-ই একমাত্র । বিয়ে করলে ওকে কি আর এমন করে দেখতে পারতাম ?’

‘সে কোথায় ? আপনার ভাইঝি ? তার কাছে গিয়ে ..’ বলতে গিয়ে কেন কে জানে বৌদির গলা ধরে এল ।

উজ্জ্বল হাসলেন বৃদ্ধ, ‘চেন্নাইতে আছে আমার ভাইঝি । খুব ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে । তার সংসারে থাকা তো উচিত নয় আমার ।‘

একটু থামলেন, তারপর চোখ তুলে তাকালেন লম্বা ভিড়ের লাইনটার দিকে, ‘ভাবছি একটা বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাব । ভাইঝিকে একবার আসতে বলেছি । টাকাপয়সা সব বুঝিয়ে দিয়ে, ফ্ল্যাটটা ওর নামে করার ব্যবস্থা করে ..’

‘ভাইঝি বলে না ওর কাছে থাকার কথা ?’ বলতে গিয়ে বুকের মধ্যে চাপ ।

‘ওর সংসারে আমার থাকা উচিত নয়, না ?’ উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে হেসে ফেললেন বৃদ্ধ মানুষটি, ‘আপনার মন খারাপ করে দিলাম, না ? আপনার চিন্তা নেই । ভারি ভালো মেয়ে আপনার । মাযের সঙ্গে সঙ্গে পেনশন তুলতে এসেছে কেমন । একজন অপরিচিত মানুষের জন্যেও ওর মায়া । আজকের দিনে এমনটা দেখা যায় না ।‘

তারপর কেমন অন্যমনস্ক হয়েই বুঝি বলে ফেললেন, ‘আমার ভাইঝিও যদি এমন করে ..’ কথা শেষ না করেই চুপ করে গেলেন ।

‘কি ? ভাইঝিও যদি ..? কি ?’

‘কিছু না । স্নেহ নিম্নগামী, জানেন না ?’ বৃদ্ধ আবছা হাসলেন । বড় বিষন্ন হাসি ।


ঘর্মাক্ত কলেবরে উজ্জ্বল হাসি নিয়ে ফিরেছে ইন্দিরা । প্রজাপতির উপমাটাই ঠিক । পলকে ঝলমল করে উঠল চারধার । উলোঝুলো মাথাটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল, ‘এই নিন কাকু, আপনার টাকা । চলুন, আপনাকে অটো রিক্সায় তুলে দিই । আমরাও তো অটো স্ট্যান্ডে যাব, না মা ?’
কাঁপা কাঁপা হাতখানা মাথায় রাখলেন বৃদ্ধ । মুখে কিছু বললেন না । কিন্তু অনুচ্চারিত আশীর্বাণী স্পষ্ট শোনা গেল, ‘কল্যাণ হোক তোমার ।‘

বৃদ্ধকে অটো-রিক্সায় তুলে দিয়ে এল ইন্দিরা । কিছুক্ষণ চুপচাপ দুজনেই । তারপর বৌদির হাত ধরল ইন্দিরা, ‘রাগ করলে, মা ? তোমার অনেক দেরি করিয়ে দিলাম । আসলে এরকম মানুষ দেখলেই বাবার কথা মনে পড়ে । প্রতি মাসে বাবাও এমনি লাইন দিয়ে টাকা তুলতে যেত । আমি তো কলেজ যেতাম, সব মাসে বাবার সঙ্গে যেতে পারতাম না । হার্টের পেশেণ্ট ছিল তো, খুব কষ্ট হত ভিড়ে ।‘
মেয়ের গলাটা ছলছল করতে লাগল ।

আর কেন কে জানে, অপর্ণাবৌদির দু’চোখ ভরে জল এলো । রাস্তার ভিড়, মানুষের অনর্গল কথার শব্দ, গাড়ির শব্দ । কোলাহল ।

হঠাত্‍ কেমন নি:শব্দ হয়ে গেল চারপাশ ।

কে যেন বহু দূর থেকে ডেকে উঠেছে, ‘খুকু .. খুকু উ উ উ ..’

‘খুকু .. খুকু .. আমার খুকুমণি .. এই নাও রংপেন্সিল ..’

‘জ্যামিতি নিয়ে ঝামেলা ? কোনো চিন্তা নেই .. আয় খুকু, তোকে জ্যামিতি বুঝিয়ে দিই ..’

‘খুকু কলেজ যাবে, বাসে তুলে দিয়ে আসি ..’

‘মিত্রার বাড়ি যাবি ? চল খুকু, আমি পৌঁছে দিয়ে আসি .. মাকে আমি ম্যানেজ করছি ..’

‘খুকুর বিয়েতে অন্তত তিরিশ ভরি গয়না দিতে হবে বৌদি ..’

‘মধ্যমগ্রামের সম্বন্ধটা বারণ করে দিই বৌদি .. অত বড় পরিবার .. খুকুর কষ্ট হবে ..’

স্কুলের ছুটির পর বাইরে এসেই দেখতে পায় খুকু, কাকুমণি দাঁড়িয়ে আছে । খুকুকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে এসে মাথায় ছাতা ধরবে । বন্ধুদের সামনে কি লজ্জাই যে পায় খুকু !

কথা নেই, বার্তা নেই, ডজনখানেক শাড়ি কিনে আনবে কাকুমণি, খুকু নাকি রোজ একই শাড়ি পরে কলেজ যাচ্ছে । মাঝে মাঝেই মনে হয় কাকুমণির, খুকুর মুখটা যেন শুকনো শুকনো লাগছে । অমনি রাশি রাশি ফল, হরলিক্স, মাল্টিভিটামিন ।

মা নিশ্চিন্ত, খুকুর কাকুমণি আছে ।

কাকুমণির জন্যে কিন্তু খুকু ছিল না । কাকুমণির কেউ ছিল না । এই বৃদ্ধ মানুষটির মত । দুই বৃদ্ধে কি অসম্ভব মিল !

সমবয়সী হলেই বুঝি মিল হয় ? এই ইন্দিরার মতই বয়স ছিল না খুকুর ? তাহলে ? মস্ত অমিল হল কি করে ?

বড্ড ভয় । বুকের মধ্যে জমাট বাঁধা ভয় । এই বুঝি সংসারে অঘটন ঘটল । এই বুঝি সংসারের ছন্দ কেটে গেল । প্র্যাকটিকাল হতে গিয়ে, শুধু নিজেরটুকু বাঁচাতে গিয়েই কি এত বড় ভুল হয়ে গেল ? না না, ভুল নয় । অন্যায় । নিষ্ঠুরতম অপরাধ ।

নইলে কাকুমণিকে হারিয়ে ফেলা হয় ? আজ ইচ্ছে হলেই খুকু বারবার হিমালয়ে ফিরে যেতে পারে, ফিরতে পারে সাগর সঙ্গমে । কিন্তু কাকুমণিতে ফেরার উপায় নেই আর ।

আহা ইন্দিরা । ওকে কোনো ভয় নিয়ে, কোনো অপরাধবোধ নিয়ে বাঁচতে হবে না । মায়ায়, মমতায়, ভালোবাসায় সবরকম ভয় মুছে ফেলার মন্ত্র জানে ও । ইচ্ছে হলেই ওর নিজের বাবার কাছে ফেরার সুখ আছে । দু’দন্ড বাবার কাছে বসার শান্তি আছে ।

রাস্তায় কড়া রোদ্দুর । লম্বা লম্বা সবুজ গাছগুলো নিশ্চল, নিস্তব্ধ । একটা পাতাও হাওয়ায় দুলছে না । কালো পিচের রাস্তা থেকে গরম হলকা ।

চোখে কালো চশমা পারে নিলেন বৌদি । চোখের জলটা লুকোতে হবে । এমন করেই যদি নিজের কাছ থেকেও লুকিয়ে থাকা যেত !

ইন্দিরার মায়াময় হাতখানা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন । এই হাত ধরেই নিঝুম রাস্তাটা পার হতে হবে । কি করলে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হয় কে জানে । যত কষ্টকর হোক, তাই করবেন এবার । কাকুমণির কাছে ফিরতেই হবে ।



কবিতায় কোলাজ - মৌ দাশগুপ্তা

কবিতায় কোলাজ - প্রসঙ্গ: মেয়েলী কলম



প্রেমের মুখোশ
মৌ দাশগুপ্তা


আমি খুব ঘনঘন প্রেমে পড়ি।

কৈশোরে চেয়েছিলাম, “আমি হব তোমার জীবনের একমাত্র নারী।“
এ শর্ত আদৌ গ্রাহ্য হল না।
প্রেম খারিজ।

তরুণী আমি বলেছিলাম”“আমি হব তোমার জীবনের প্রথম নারী।“
মিথ্যার সাথে সহবাসে রাজি হই নি।
প্রেমে অসফল।

যৌবনে চেয়েছিলাম “আমি হব তোমার জীবনের সর্বশেষ নারী।“
পরিপাটি সহাবস্থানের ফাঁক দিয়েও ভুলের বিষাক্ত সংক্রামন,
এড়ানো গেল না।প্রেমে ব্যর্থ।

কবি বললেন, শর্ত মেনে প্রেম হয় না।প্রেম নিঃশর্তেই ছড়িয়ে যায়।
বাদলা হাওয়ার স্পর্শের মত,
সুখের গভীরে লুকিয়ে থাকা অসুখের মত।

অনেকটা পরাজয় মেনে আজ মধ্যবর্তিনী নিঃশর্ত প্রেমিকার ভূমিকায়,
কারো জীবনের একমাত্র,প্রথম বা শেষ নারী নই,
আজ আমিও একটার পর একটা মুখোশ পাল্টাই ,
আরো একটা… আর ও একটা!!!

প্রবন্ধ - শ্রীশুভ্র

মা মাটি মানুষ
শ্রীশুভ্র



মা মাটি মানুষ! পরিবর্তনের রথের চাকায় দুই বছর পার করার মুহূর্ত্তে সারদা ম্যাজিক! সেই মা মাটি মানুষের কষ্টার্জিত সঞ্চিত অর্থ; টাকা মাটি মাটি টাকা মন্ত্রে সত্যিই মাটি হয়ে গিয়েছে! বাস্তববাদী পোড় খাওয়া রাজনীতিবীদ আজীবনের লড়াকু আপোষহীন সংগ্রামী মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং তার সততার পরিচয় রেখে সত্যই বলেছেন , যা গেছে গেছে....! খুবই সত্যি! যা গেছে অর্থাৎ সেই কমবেশি বাইশ হাজার কোটি টাকা তো আর ফিরে আসবে না! এ তো পি সি সরকারের ম্যাজিক নয় যে, যা ভ্যানিশ হয়, তাই আবার পুরোপুরি মঞ্চে ফিরে আসবে? এ রাজনৈতিক মঞ্চ! এখানে ভ্যানিশটাই বাস্তব! কমিশন বসিয়ে হারানো প্রাপ্তিটা নয়! তবু কমিশন বসেছে! মা মাটি মানুষের রাজত্বে!

পরিবর্তনের দুই বছরেই এইভাবে সর্বস্বান্ত হতে হবে এটা হয়ত মা মাটি মানুষের সরকারে বিশ্বাস করে ভরসা করা বিপুল সংখ্যক মানুষের কল্পনাতেও আসেনি! কিন্তু সেই সরকারেরই হেভিওয়েট রাজনীতিবীদ সোমেনবাবু অনেক আগেই সরকারকে সাবধান বাণী শুনিয়েছিলেন, রাজ্যে মৃত্যু মিছিল শুরু হয়ে যাবে বলে! বারবার সাবধান করার চেষ্টা করে গিয়েছেন বামফ্রন্ট নেতৃত্ব! কিন্তু তবু যে মুখ্যমন্ত্রীকে পয়েলা বৈশাখের সকালে "তারা মিউজিক"কে কাঁদতে দেখে চিট ফাণ্ডের মোহিনী মায়ার ফাঁদের কথা জানতে হল সেটা জেনে রাজ্যবাসী যথেষ্ট অস্বস্তিতে! রাজ্যবাসীর এই অস্বস্তি ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছাল সুদীপ্ত দেবযানী গ্রেফ্তার নাটকের পর্ব থেকে পর্বান্তরে!

যা গেছে তা গেছে! তবু কমিশন বসেছে! জনগন কি পরিবর্তনের স্বরূপটা বুঝেছে? হাওড়ার উপনির্বাচনের ফলাফল দেখে বোঝা যায় কিছু মানুষের অন্তত সম্বিত ফিরেছে! হ্যাঁ এটা নিশ্চিত, কিছু মানুষের এই সম্বিত ফেরায় তৃণমূল নেতুত্ব যথেষ্ট সচকিত! আর সেটা উপনির্বাচনের অনেক আগে থেকেই পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কমিশন ও রাজ্য সরকারের বাকবিতণ্ডায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে! যার আতঙ্কিত বিস্ফোরণ ঘটে গেল অনুব্রত মণ্ডলের দেওয়া ফতোয়ায়! পঞ্চায়েত নির্বাচনে শত্রু সিপিএম কংগ্রেসেকে মনোনয়ন পত্র জমা না দিতে দেওয়ার বিষয়ে! বাম আমলে ২০০৮এ পঞ্চায়েত নির্বাচনের সাফল্যের ওপর নির্ভরতা যে ক্রমহ্রাসমান সেটা তৃণমূল নেতৃত্বের মুখভঙ্গী থেকে স্পষ্ট!

রাজ্য সরকার যে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে রাজ্যবাসীর সাথে একটু লুকোচুরি খেলতে চাইছেন, সেটা গত ২১শে জুলাইয়ের জমায়েতে বোঝা না গেলেও এখন অনেকের কাছেই স্পষ্ট! পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে সন্ত্রস্ত তৃণমূল নেতৃত্ব ভোটের আগেই বিপক্ষ শিবিরে ত্রাস ছড়িয়ে দিতে মরিয়া কেন সেটা বুঝতে গেলে গ্রাম বাংলার গত পাঁচ বছরের পঞ্চায়েতের সাফল্য ব্যর্থতার হিসেবটা জানতে হবে! যেটা আমাদের নাগরিক পরিসরে সহজসাধ্য নয়! কিন্তু তৃণমূল নেতৃত্ব যে সেই খতিয়ানের বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল সেটা অনুব্রত মণ্ডলের ফোতোয়াতেই স্পষ্ট! এবং নির্বাচনের প্রথম পর্বের মনোনয়নপত্র জমাদেওয়ার পর্বেই যে হিংসার সূত্রপাত হল, তাতেই তৃণমূল নেতৃত্বের আত্মবিশ্বাসের অভাবটা স্পষ্ট!

রাজ্য সরকারের কর্মকাণ্ডে সরকারী দলের এই আত্মবিশ্বাসের অভাব সেই কার্টুন কাণ্ড, পার্কস্ট্রীট কাণ্ড থেকেই স্পষ্ট ধরা পড়েছে! ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর রাজবাসীর আশীর্বাদধন্য এই সরকার সঠিক নেতৃত্বের অভাবে দিশাহীন ছুটে চলেছে! সম্পূর্ণ এক ব্যক্তির দল হওয়াতে কোনো সাংগঠনিক পরিকাঠামো এবং দায়বদ্ধতার সৃষ্টি হয়নি দলীয় কর্মসংস্কৃতিতে! যার ফলে একদিকে দলের ভিতরেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং অন্যদিকে ব্যক্তিগত ভাবে দলীয় সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে খুশি করে কাছে পৌঁছানোর ইদুঁর দৌড়ে ব্যাতিব্যস্ত তৃণমূলের অন্দরমহল! দলীয় নেতৃত্বের সকলস্তরেই যেন একটা অস্থিরতা, সরকার থাকতে থাকতে নিজের খুঁটিটা যত বেশি পাকাপোক্ত করা যায়!

স্বভাবতই এই অবস্থায় দলীয় নেতৃত্বের সকল স্তরেই নিজের নিজের আখের গুছিয়ে নেবার তাগিদে এক তীব্র অস্থিরতার সৃষ্টি হওয়ার কথা! আর সেই কারণেই সমাজবিরোধীরা অতি সহজেই নীচু তলার নেতৃত্বের হাত ধরে আভ্যন্তরীন গোষ্ঠীগুলির সম্পদ হয়ে উঠতে থাকে! আর তখনই জনগণ থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে দল! এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বদলে দলীয় সর্বোচ্চ নেতৃত্বের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়, অবস্থা ক্রমশই জটিল করে তুলেছে! যার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে যত্রতত্র! বিপুল জনপ্রিয়তার ভোটব্যাঙ্কের উপর নির্ভর করে এখনই এই জটিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে, অচিরেই তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়বে জনপ্রিয়তার সুউচ্চ মিনার!

মা মাটি মানুষের স্লোগানের ভিত্তিই ছিল পরিবর্তনের প্রত্যয়ী শপথ! মানুষ বিশ্বাস করছিল বামফ্রন্টের শেষ পর্বের অপশাসন থেকে মুক্ত হয়ে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন! ব্যক্তি মানুষের মৌলিক অধিকারগুলি সুরক্ষিত হবে! অথচ কার্টুন কাণ্ডে মানুষের স্বপ্নভঙ্গ হল! মানুষ ভেবেছিল প্রশাসন দলতন্ত্র মুক্ত হবে! অথচ রায়গঞ্জ ও মাজদিয়া কলেজের ঘটনায় প্রশাসনের দুই ভিন্ন মুখ দেখে স্তম্ভিত হল রাজ্যবাসি! প্রশাসনের শীর্ষব্যক্তিত্ব একজন লড়াকু নারী বলে, রাজ্যে মহিলাদের অবস্থার উন্নতির আশা করেছিল মানুষ! অথচ এরাজ্যে নারীই আজ সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত পথেঘাটে!

সবচেয়ে পরিতাপের কথা, যে পশ্চিমবঙ্গকে ট্যুরিজিম মানচিত্রে এক নম্বর দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে তোলার শপথ ছিল, সেই পশ্চিমবঙ্গ আজ ভারতবর্ষের এক নম্বর ধর্ষনীয় স্থান হয়ে উঠছে! এবং রাজ্যনেতৃত্ব এই ব্যাপারে ক্ষতিপূরণের বিভিন্ন স্কেল ঘোষনা করেই দায়িত্ব সারতে তৎপর! গ্রামবাংলা থেকে শহর নগরের গলিপথ থেকে রাজপথ মহিলাদের কাছে আতঙ্কসরূপ হয়ে উঠেছে! সমাজবিরোধীদের দৌড়াত্ম বৃদ্ধির বড়ো কারণ প্রশাসনের উপর দলতন্ত্রের প্রভুত্ব! আর এই সত্যটা কার্টুন বিতর্ক থেকেই প্রকট! ফলে দুস্কৃতীদের কাছে স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠছে পশ্চিমবঙ্গ! প্রোমটার রাজ সিণ্ডিকেট দৌরাত্ম থেকে শুরু করে এলাকা দখলের রাজনৈতিক লড়াইয়ে সর্বত্র একই চিত্র!

পরিবর্তনের শপথের অন্যতম শর্তই ছিল দলতন্ত্রমুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসন! অথচ পরিবর্তনের মাত্র দুই বছরেই সেই শপথের হয়েছে অকালমৃত্যু! আর এই বিষয়ে রাজ্যপুলিশের ভাবমূর্ত্তী দিনে দিনে তলানিতে! যার শুরু হয়েছিল পার্কস্ট্রীট ও কার্টুন কাণ্ডের মধ্যে দিয়ে! বামফ্রণ্ট আমলে যে পুলিশ প্রশাসন স্থানীয় ক্যাডার বাহিনীর অনুমতি ছাড়া ফাইল নাড়াতে পারতো না, আজ তারাই তৃণমূল নেতৃত্বের তর্জনী অনুসরণ করে চলেছে! পরিবর্তন হয়েছে ঠিক এইখানেই! প্রশাসনের প্রভুত্বের হাতবদল হয়েছে মাত্র! পরিবর্তনের মুখোশের আড়ালে এইটাই পরিবর্তনের আসল মুখ! আর এই মুখোশ সরে মুখের আদল যত প্রকাশিত হচ্ছে, তৃণমূল নেতৃত্ব ততই আত্মপ্রত্যয় হারিয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছ!

রাজ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে পরিবর্তনের মুখোশের আড়ালে পরিবর্তনের মুখ কেবলই প্রকাশিত হয় পড়ছে! সারদা কেলেঙ্কারির পর আজ অব্দি রাজ্য সরকারের সারদার বিরুদ্ধে এফআইআর না করা, সিবিআইএর হাতে তদন্ত ভার তুলে না দেওয়া, এবং চিটফাণ্ড সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স বিলকে বিলম্বিত করে দেওয়ার প্রয়াসের মধ্যেই স্পষ্ট; সারদা কেলেঙ্কারীর অন্তরালে থাকা কুশীলবদের আড়াল করা, এবং হাতসাফাই হওয়া বাইশ হাজার কোটি টাকা দিনের আলোর অন্তরালেই লুকিয়ে রাখার প্রাণান্তকর প্রয়াস! এই যদি মা মাটি মানুষের সরকারের স্বরূপ হয়, তবে তার ফল যে পঞ্চায়েতের ব্যলটে পড়তে পারে, সে কথা ভেবেই আতঙ্কিত সরকারী দল মনোনয়নপত্র জমা দিতে আতঙ্ক সৃষ্টির পথ নিয়েছে!

বদলা নয় বদল চাই স্লোগান যে স্লোগান সর্বস্ব ক্যাচওয়ার্ডেই রয়ে গেল, সে বিষয়ে দলীয়নেতৃত্ব মোটেই চিন্তিত নয়! তাদের চিন্তা বিরোধী পক্ষের নীচুতলার কর্মীসমর্থকদের মধ্যে রীতিমতো ভীতি ও ত্রাসের সঞ্চার করে নিরঙ্কুশ জমি দখল করা! এবং সে বিষয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব অনেকাংশেই সফল! কিন্তু এইবিষয়ে ভূতপূর্ব বাম আমলের সিপিএম ক্যাডার বাহিনীর যে সুশিক্ষিত সাংগঠনিক দলীয় সংহতিজনিত রাজনৈতিক রণকৌশল ছিল, তৃণমূলের তা না থাকার কারণে পরিবর্তনের মুখোশ অটুট রাখা সম্ভব হচ্ছে না! মুশকিলটা এখানেই! এর সাথে সাংগঠনিক দূর্বলতায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রাজ্যের শান্তি শৃঙ্খলা বিপর্যস্ত করে চলেছে! ফলে মানুষের মোহভঙ্গ হতে শুরু হয়েছে একটু একটু করে!

একথা অনস্বীকার্য, সামান্য হলেও, হাওড়া উপনির্বাচনের ফলাফলে এই মোহভঙ্গের একটা স্পষ্ট প্রতিফলন পড়েছে! এখন দেখার এই হাওয়াটাকে বামফ্রন্ট কতটা কাজে লাগাতে পারবে পঞ্চায়েত নির্বাচনে! মনে রাখতে হবে সারদাগোষ্ঠীর সাথে তৃণমূলের দলীয় নেতৃত্বের একটা প্রধানতম অংশের ঘনিষ্ঠ যোগসাজগের উপর ভরসা করেই অধিকাংশ মানুষ নিজেদের সর্বস্ব সারদায় আমানত করে ছিলেন! তাদের কাছে কিন্তু পরিবর্তনের মোহভঙ্গ হওয়া শুরু হয়েছে! কিন্তু দুঃখের বিষয়, বামফ্রন্ট নেতৃত্ব এই অবস্থা থেকে প্রতারিত মানুষগুলিকে রক্ষা করার দাবীকে একটা গণ আন্দোলনের রূপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে! তখনই সন্দেহ হয় চিটফাণ্ডের গুড় বামফ্রন্টের পার্টিফাণ্ডেও একটুআধটু লেগে নেই তো?

বাম ফ্রন্টের এই ব্যর্থতা সত্ত্বেও স্বস্তিতে নেই তৃণমূল! দলের অভ্যন্তরে অন্তরকলহ, মাঠ পর্যায়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, দুস্কৃতীদের সাথে নেতাদের প্রকাশ্য যোগাযোগ রাজ্যবাসীর চোখে তৃণমূলের স্বরূপ ক্রমেই স্পষ্ট করে দিচ্ছে! আর এখানেই অবাক করে দিচ্ছেন সেই পরিবর্তনকামী বুদ্ধিজীবী মহল! বাম অপশাসনের বিরুদ্ধে যারা যথার্থ কারণেই সেদিন পথে নেমেছিলেন নাগরিক দায়িত্ববোধে; আজ তারাই রাজ্য জুড়ে অন্যায় অবিচারে মুখে কুলুপ এঁটে যে যার নিজের জায়গায় অবিচল! এখানেই সফল মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং! পুরস্কার থেকে সরকারী পদ, সম্মান থেকে উপঢৌকন দিয়ে বুদ্ধিজীবীমহলকে নিজের গ্রীণরুমে বসিয়ে রাখতে পেরেছেন তিনি অনায়াস দক্ষতায়!

বামজামানার শেষ পর্বে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে এই পরিবর্তনকামী বুদ্ধিজীবীরাই বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদেরকে সরকারীদলের তল্পি বহনের জন্য দোষারপ করতেন! সেই অভিযোগের সারবত্তা নিয়ে আজো বিতর্ক নাই, কিন্তু আজ যখন পরিবর্তনের ফানুস ফেটে যাচ্ছে, রাজ্য জুড়ে আইন শৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতিতে সহিংস নৈরাজ্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে সর্বত্র; মানুষের মৌলিক অধিকার আহত হচ্ছে, প্রশাসনের উপর সরকারী দলের প্রচ্ছন্ন প্রভুত্ব স্পষ্ট অনুভুত হচ্ছে দুর্নীতির লাগামছাড়া দৌরাত্ম মানুষের শান্তি কেড়ে নিয়েছে, চিটফাণ্ডের জাদুতে লক্ষ লক্ষ লোক পথে বসেছে, নারী নির্যাতনে পশ্চিমবঙ্গ দেশে শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে, তখন তাদের নীরবতা লজ্জাস্কর!

বুদ্ধিজীবীদের এই নৈতিক দেউলিয়া অবস্থান তৃণমূল নেতৃত্বকে অনেকটা স্বস্তিতে রাখলেও জনগণের ব্যালট যে স্বাধীন চিন্তা করতে পারে সেটা আশঙ্কা করেই আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেবার সময় বিরোধী প্রার্থীদের সন্ত্রস্ত করে প্রথম দফাতেই প্রায় সাড়ে ছয় হাজার আসনে তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে রেকর্ড করেছে! এই হল বদলা নয় বদল চাইয়ের সরূপ! মধ্যেখান থেকে মা মাটি মানুষের বাইশ হাজার কোটি টাকার ভ্যানিশিং ম্যাজিকে যারা আজ পথে বসলেন তাদের জন্য কোনো রাজনৈতিক দলই কোনো আশার আলো হাতে এগিয়ে না এসে পরস্পর দোষারপে নিজের নিজের মুখ রক্ষায় ব্যস্ত! এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে রাজ্যবাসী আজ সত্যিই দিশাহারা!

৩৪ বছরে সমাজের সর্বস্তরে, সরকারের সমস্ত দপ্তরে বামফ্রন্ট তথা সিপিআইএম দলতন্ত্রের একটা প্রচ্ছন্ন নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিল! তিনদশকের রাজত্ব দলতন্ত্রের এই সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণেই সম্ভব হয়েছিল! তৃণমূল ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিয়ে বামফ্রন্ট যে নিয়ন্ত্রণ তিনদশক ধরে গড়ে তুলেছিল সুদৃঢ় সাংগঠনিক দক্ষতায়, সেই একই দলীয় নিয়ন্ত্রণের আওতায় রাজ্যবাসীকে বেঁধে ফেলতে চাইছে মাত্র দুই বছরের সময়সীমায়! গণ্ডগোলটা এখানেই! আর ঠিক সেই কারণেই পেশীশক্তির আস্ফালনের এমন খোলা প্রদর্শন চলছে সর্বত্র! পরিবর্তনের এহেন পরিণতি থেকে রাজ্যবাসীকে উদ্ধার করতে পারে একমাত্র রাজ্যবাসীই! এখন অপেক্ষা সেই পরিবর্তন আসতে আর কত দেরী?




ছোট গল্প - পূজা মৈত্র

না মেলা অঙ্ক
পূজা মৈত্র



তারার মেইলটা এসেছে। অফিসে গিয়ে প্রথমেই মেইল ইনবক্স চেক করে প্রতীক। বরাবরের অভ্যাস। আজকেও করল। তবে আজকের চেক করাটা রোজকারের মত ম্যাড়মেড়ে নয়। একটা উত্তেজনা মেশানো কৌতূহল প্রতীকের কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম হয়ে জমা হয়েছে। হবে না-ই বা কেন? নীরস কেজো মেইল নয় এটা। তারা যদিও ওর কলিগ, ওদের কোম্পানির ক্যালিফোর্নিয়া অফিসের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। ঠিক যেমনটা প্রতীক কোলকাতা অফিসের। কিন্তু আজকের মেইলটা কোন প্রব্লেম সলভের রিকোয়েস্ট বা কোন নতুন আইডিয়া নিয়ে নয়। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। তারা আর প্রতীকের কি প্রেম চলছে? না, তা কেন হবে? প্রতীক বিবাহিত, তৃষার সাথে ছয় বছরের সুখী দাম্পত্য আর অনেক সাধ্যসাধনা করে পাওয়া দাম্পত্যের ফল দুই বছরের ফুটফুটে মেয়ে আনিশাকে নিয়ে দিব্যি আছে ও। তারা ওর কলিগ কাম বন্ধু অতিরিক্ত কিছু নয়। মাস তিনেকের একটা ট্রেনিং এর জন্য প্রতীক ক্যালিফোর্নিয়া গিয়েছিল। সেখানেই আলাপ, পরিচয়, বন্ধুত্ব। তবে আজকের মেইলটা নিয়ে প্রতীকের এত উৎকণ্ঠা কেন? দিন সাতেক হল ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ফিরেছে। চাইলেই আরও মাস তিনেক অনায়াসে কাটিয়ে আসতে পারত, কিন্তু তৃষা আর আনিশাকে খুব মিস করছিল।

আজকেই তো তারার ডক্টর ম্যাক্লারেনের ক্লিনিকে যাওয়ার কথা ছিল... হ্যাঁ, আজ, এখানে টিউস ডে মর্নিং, ওখানে মান ডে নাইট। মান ডে আফটারনুনেই তো যাওয়ার কথা ছিল। কি হল? তারা কি কনসিভ করেছে? আজকেই কি সেটা জানা যাবে? ইনসেমিনাইজেশন ঠিকঠাক হয়েছে তো? তারা আসলে সিঙ্গল মাদার হতে চেয়েছে। তাই পূর্ব সংগ্রীহিত বীর্য কৃত্রিমভাবে তারার মধ্যে দিয়ে, ওর ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার নির্ধারিত দিন ছিল আজ। আজ ওর ডিম্বাণু নিঃসরণ বা ওভ্যুলেশন এর দিন। আগের তিনটে ঋতুচক্র লক্ষ্য করে জানা গেছে যে, প্রতি ঋতুর চৌদ্দতম দিনে ওর ডিম্বাণু নিঃসরণ হয়। নিঃসৃত ডিম্বাণু ৩৬ থেকে ৭২ ঘণ্টা অবধি নিষেক যোগ্য থাকে। আবার শুক্রাণু স্ত্রী দেহে ৪৮ ঘণ্টার বেশি বাঁচেনা। সব মিলিয়ে আজই ইনসেমিনাইজেশনের উপযুক্ত দিন। আজকের দিনে বীর্য গেলে নিষেকের সম্ভবনা সর্বাধিক। ডক্টর ম্যাক্লারেন এতে সিদ্ধহস্ত। তারা কনসিভ করবেই। তারার জন্য এই সন্তান খুব জরুরী। ওর স্বামী সিদ্ধার্থ দুর্ঘটনায় মারা গেছে, প্রায় দেড় বছর হতে চলল। তারা সিদ্ধার্থকে খুব ভালবাসত। দ্বিতীয় বিবাহ ও করবে না। মা-বাবা অনেক বুঝিয়েছেন, তাও নারাজ। তারারা অনেক দিন থেকেই আমেরিকায়। তারার জন্ম নিউ ইয়র্কে। বাবা,মা দুজনেই আমেরিকার নামী ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন। উনারা এখন নিউ ইয়র্কেই থাকেন। তারা উদারমনা হাসি খুশি মেয়ে। ভারতীয় সংস্কার এখনো ওর মধ্যে প্রবল। আরও প্রবল একটা ইচ্ছা। মা হওয়ার ইচ্ছা। তারা মনেপ্রানে মা হতে চায়। কিন্তু বিয়ে করবে না। অগত্যা এই পন্থা।

প্রতীক চায় তারা যেন মা হতে পারে। তারার সাথে মিশে ওর মা-বাবার সাথে কথা বলে প্রতীকের মনে ওদের পরিবারের জন্য আলাদা সম্ভ্রম সৃষ্টি হয়েছে। তারার এই সিদ্ধান্তে ওর মা-বাবাও শরিক। কত কম জটিলতা উনাদের মনে। এদেশে হলে... প্রতীকের মনে পড়ে সেইদিনগুলোর কথা। তৃষা কনসিভ করতে পারছিল না বলে পরিবারে, পাড়ায়, আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কত কানাঘুষোই না শুরু হয়েছিলো। তৃষা নাকি বাঁজা! এমন কথাও শুনতে হয়েছিলো। তৃষার জন্য খারাপ লাগত খুব। মনমরা হয়ে থাকত মেয়েটা। লুকিয়ে কাঁদত। প্রতীকও কি কষ্ট পেত না? সন্তান তো সবাই চায়। অথচ তৃষাকে নিজের কষ্ট দেখাতে পারত না। পাছে ও কষ্ট পায়! আনিশা যেদিন হল, সেদিন তৃষাকে যতটা খুশি দেখেছে, আর কখনো দেখেনি। নিজেও তো খুশিতে পাগলপারা হয়ে গিয়েছিলো। তারার একটি অবলম্বন দরকার। মা-বাবা আর কত দিন? মানুষের কাউকে চাই, যে কিনা একান্ত নিজের হবে।

অথচ সমস্যা ছিল অন্য খানে। ডক্টর ম্যাক্লারেনের দুটি শর্ত ছিল। শুক্রানু দাতাকে তারার সম-দেশীয়, সমধর্মীয় এমন কি সম জাতীয় হতে হবে। আর সেই শুক্রানু দাতার নিজের একটি সন্তান থাকতে হবে। এতে সন্তানের সাথে তারার সাদৃশ্য থাকার সম্ভবনা সর্বাধিক। ভবিষ্যতের অহেতুক জটিলতা এতে কম হবে। ডোনারের নিজের সন্তান থাকলে ইন সেমিনাইজেশনের ফেলিওরের সম্ভবনা কম। কিন্তু ডক্টর ম্যাক্লারেনের শুক্রানু ব্যাঙ্কে এমন কোন দাতার শুক্রানু নেই। তারাও ভারতীয়,হিন্দু, বাঙালি এবং সন্তানের পিতা এমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছিল না, যাকে এই রিকোয়েস্ট করা যায়। প্রতীকের সাথে পরিচিত হয়ে ওর খোঁজার শেষ হয়ে ছিল। সংকোচের সাথেই প্রতীককে বলেছিল কথাটা। প্রতীকও তারার, তারার মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারেনি। অর্থের প্রলোভনে নয়, বন্ধুত্বের দাবিতেই রাজি হয়ে গিয়েছিল।আজ অফিসে আসার পথে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। তৃষা আর আনিশার সাথে অন্যায় করেছে ও। কিন্তু তাতে কি? ওরা তো জানবেই না কখনো। তারাও কনসিভ করার পর আর যোগাযোগ রাখবে না বলেছে, যাতে প্রতীক দুর্বল না হয়ে পরে। প্রতীকও আর যোগাযোগ রাখবে না। তবুও কনসিভ করল কিনা জানতে মনটা উতলা হয়ে পড়েছে। বাপ রে বাপ! তৃষার কনসিভ করার সময় কি হ্যাপা! কত গাইনি দেখিয়ে, ওষুধ পত্তর খাইয়ে, শেষে তৃষার ডাক্তার বন্ধু কুণাল কেসটা হাতে নিলে, ওর সিনিয়ারকে দেখিয়ে তবেই...তারাও না কোন হ্যাপায় পড়ে। যদিও গোটা তিনেক সিমেন স্পেসিমেন দিয়ে এসেছে প্রতীক...

মেইলটা চেক করল প্রতীক। ছোট মেইল... “ প্রতীক ইওর সিমেন ইজ azoosparmic.মিনস দেয়ার আর নো স্পারম ইন ইট। বাট হাউ ইট ক্যান বি?

হাউএভার আই অ্যাম অ্যাটাচিং ডক্টরস রিপোর্ট উইথ ইট। ” মাথাটা ঘুরে গেল প্রতীকের। রিপোর্টটা ওপেন করল। প্রতীক সেনেরই রিপোর্ট। থার্টি ফোর। মেল। সিমেন হ্যাজ নো স্পারম!!!!! তৃষা, আনিশার মুখ দুটো ফ্ল্যাশ করল প্রতীকের মাথায়...। আর একটা মুখ কার? গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। বরাবর অঙ্কে একশোয় একশো পাওয়া প্রতীক এই অঙ্কটার সমাধানে শূন্যই পয়াবে, বলা যায়।








কবিতা - মিলন চ্যাটার্জী

অস্পৃশ্য
মিলন চ্যাটার্জী



কলমের মুখে
কোথা থেকে জেদি এক পাথর জমেছে !
লিখতে পারিনা আর
তবু পাগলের মত আঁকড়ে ধরছি তোমায় !

নিরালা খুঁজেছি চিরকাল
শুধু দাবী ছিল-- হাত ধর তুমি ।
জানি, খুব বেশী চাওয়া ছিল
কর্ণভাগ্য নিয়ে যারা আসে-- পায়না কিছুই ।

এখন ডুবে যাই , ঝাপসা হতে হতে
আলোহীন একাকী নগরে ।
শব্দ'রা দৌড়ায়, তরী বায়, নেমে আসে জল হয়ে
ধীরে ধীরে পাগলামি বাড়ে ।

ভয় পাই --
ধুতুরা ফলের মত কবিতা তোমাকে !


কবিতা - রুপময় ভট্টাচার্য







পরবর্তী মেঘ -২
রুপময় ভট্টাচার্য



বিব্রত ...
বড় বিব্রত হই -

যখন প্রশ্ন করো -

"তুমি কতবার 'শুয়েছ' ? "

একটু মাথা চুলকোই ,একটু স্মৃতির পথে হাঁটি

তারপর এড়িয়ে যাই

"আমি তো রোজই অন্তত একবার শুচ্ছি "

তুমি হেসে ওঠো খিলখিলিয়ে -

আর আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে ভাবতে থাকি

শোওয়াটা বড় কথা না,

কে কিভাবে কোথায় শুলাম সেটাই আলোচ্য ...

কবিতা - মেঘ অদিতি

শেষ দৃশ্যে
মেঘ অদিতি



সাদা-কালো মোড
ক্যামেরা ফোকাস..
ইতিহাস ধরা থাকে গ্রন্থিত পাতায়
পরিত্যক্ত শহরের নেপথ্যে তখন বেহাগ
সুরে ও সুরায় ঘর, বাড়ি, আঙিনা ভাসে
ছোটো হয়ে আসে বর্ণ পরিচয়
পিছনে পাতার দোহার
কুর্চি ফুল উড়ে উড়ে যায়

ক্লোজ শট..
স্পষ্ট হয় রতিক্লান্ত মুখ
অস্পষ্ট অবয়বে সন্ধ্যা নামে
ঘূর্ণনশূন্যতার লেন্সে জমে স্বেদ বিন্দু


কাট টু
শেষ দৃশ্যে
সমবেত আত্মহত্যার পর
বাতাসে ডানা মেলে অসংখ্য চিঠি

কবিতা - বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

বিচ্ছিন্ন করণ সুত্র
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়




শুভেচ্ছা                                         প্রলাপ

                  লিখি দুই তীরে

       মাঝখানে বীতশোক অশ্রুর ধারণা

                                   বয়ে যাচ্ছে লবনাক্ত জলচিহ্ন

ধারা প্রবাহ

দুফসলি ধানক্ষেত মিলন বিহ্বল

                         জ্যোতির্ময় খনিজ অক্ষর গুলি

                                                  লিপিবদ্ধ বমি

আকরিক গন্ধে উঠে আসে



বিচ্ছিন্ন করন সুত্র কেবল তুমি ই জানো নীলকণ্ঠ


কবিতা - নাশিদা খান চৌধূরি

গড়মিল
নাশিদা খান চৌধূরি



অঙ্গীকার সেবন করেছি স্বেচ্ছাচারিতার নামে,
মুল্লুক সব আমার;
শুনবো না কিছু, মানবো না আবেগ
প্রশ্রয় নেই কথা দেবার।

স্বেচ্ছাচারিতা আমার, জীবনটাও -
তবে কেন পরাভূত হওয়াই নিমিত্ত !
খেয়াল খুশিতে উড়বে জীবন
ভেসে যাব অনর্গল ইচ্ছাশক্তির ভেলায়।

জানিতো,

জীবন শেষে ডানা ঝাপটানো পাখি
জবাব দেয় গড়মিলের খেরো খাতায়।।


Top of Form




Bottom of Form


কবিতা - সৈয়দ রায়হান বিন ওয়ালী

আমি কবি নই শব্দ বাহক
সৈয়দ রায়হান বিন ওয়ালী



আমি কবি নই
তারাই কবি যারা শব্দের চারিধার,
ডান বাম সামনে পেছন দেখতে জানে,
যাদের শব্দকে নিয়ত দেখার আছে এক ধ্যানী অভ্যাস;
শব্দ যাদের কাছে নিছক শব্দ নয়
কান্নার মহৎ জল, শোকের চাদর, অনুভব অনুভুতি চিত্র অফুরান;
মৃত্তিকা যেমন কুমোরের কাছে শুধু মাটি নয় রূপসী তৈজস !
সুতো যেমন তাঁতির কাছ শুধু সুতো নয় দেহশোভা, বডিআর্ট !
মাছ যেমন জেলের কাছে শুধু মাছ নয় প্রেম, জীবিকা, সংগ্রাম, জীবনের সারৎসার।
তেমনি কবির কাছে
শব্দ মানে পাপ, পুণ্য
শব্দ মানে ভূতভবিষ্যৎ, ব্রহ্ম!

আমি কবি নই
কবি তিনি যিনি-
প্রিয়ার মুখের সাথে রূপালি চাঁদের মুখ
মেলাতে জানে
কবি তিনি যিনি-
শ্রমিকের ঘামের ভেতর বিপ্লবের তরুণ বারুদ
মেশাতে জানে
কবি তিনি যিনি
নিকষ পাপের ভেতর অফুরান পুন্যের খোঁজ
নিয়ত রাখে;

আমি কবি নই শব্দ বাহক, বোঝা টানি, হরকরা দীনহীন
.................................




কবিতা - রণি ভট্টাচার্য

নন্দিনী
রণি ভট্টাচার্য



ছাই চাপা সমঝোতার আস্তরণ গায়ে মেখে
অস্থির মন অজান্তে, চিৎকার করে বলে,
এ অসহনীয়, যন্ত্রণাময় - বাস্তবহীন স্মৃতি
অবাস্তব-অবান্তর কত প্রশ্নের ঝড় তোলে।

তুলির টানে জেগে ওঠা কোনো স্নিগ্ধ রূপকথা
নীরবতার আধার ছুলো,আরও গভীর নীরবতা।
আমিতো স্তব্ধ , শত যোজন পথ, হয়েছে অতিক্রান্ত
তাই ভ্রান্ত হয়েছে আজ, অকৃএিম সততা ।।

হাজার দ্বন্দ্ব,তোলে ছন্দ , বলে মন্দ , বারে বারে...
তুই নির্বাক হয়ে ব্যর্থ , আজ রিক্ত অহংকারে ...।।



কবিতা - শমীক সেনগুপ্ত

একটি কবিতা
শমীক সেনগুপ্ত



চারিদিকে রব উঠেছে কবি গিয়েছে মরে....
বন্ধ দরজা, অন্ধ জানলা.... রাস্তা অনেক দূরে...
ও পথ দিয়ে আলো আসে না,
ও পথ ভীষণ সোজা
ধন্দ লাগে
"ওটাই কি ঠিক???"
যায় না তবু বোঝা-
চারিদিকেই হুলুস্থুলু
মিটিং সমাবেশ-
সমাবর্তন প্রত্যাবর্তন
নাড়ছি দাঁড়ি কেশ।।
অনেক লোক হল জড়ো-
আসছে আরো শ'য়ে-
মন্ত্রী সান্ত্রী ষড়যন্ত্রী...
আসছে ভয়ে ভয়ে-
গোলাপ হাতে,জোলাপ নাকে
ঝুমকো ঝোলা কানে
আসছে মানুষ
বাড়ছে ভিড়
মরণ অভিযানে-
তার মধ্যেই বাদাম ভাজা
ফুচকা ঘুগ্নী-মুড়ি...
ক্লান্ত পাব্লিক শান্ত করে...
এমন বাহাদুরী!!
এলেন শেষে রাজামশাই..
করলেন ফরমান তার...
"আড়াই টাকা পেনশন পাবে
কবির পরিবার...
দুটো টাকা ফি বচ্ছর মোচ্ছবেতে যাবে....
হারাণ-কবির পরাণপ্রিয়
ফিলিম ইস্টার পাবে.."
সবই হল তবু দেখ
পূবের জানলা বোজা-
কোথায় গেল কবির লাশ-
হয়নি তাকে খোঁজা।
মাটি হল চাটি হল
এল হাতে বাটি
নাটক হল
ফাটক এল
মজলিশ জম-জমাটি...।।
ভিড়ের মাঝে সবাই যখন
মগ্ন কোলাহলে...
পাতা ঝরা কৃষ্ণচূড়া দূরের অঞ্চলে
ছড়িয়ে দিল লাল কার্পেট
আকাশ ধরল ছাতা
বাতাস দোসর হল সাথে
আর ছোট্ট একটা খাতা-
সঙ্গী হল কবির সাথে
বেঁচে ফেরার পথে....
মৃত্যু তাকে ছোঁয়নি-

যেমন ছোঁয় না বিপন্নতা ।।


কবিতা - কালপুরুষ

দুঃখিনী চুম্বন
কালপুরুষ



তুমি থাকো
চিবুক ফিরে যাও

একাকী একটি দুঃখিনী চুম্বন বহুদিন
পড়ে আছে জানালায়
তুমিও কি লীনা ?
প্রত্যূষ আলো, মধ্যরাতের গোপন অন্ধকারের মতো
আগুন জ্বেলেছিলে রক্তে?
মনে পড়ে?
শীতের সে রাত- কেমন বৃষ্টি নেমেছিল!

প্রেম— যদিও— ব্যক্তিগত
কখনও তবু
জনসমুদ্রে প্রকাশ্যে ৭১টি প্রদীপ জ্বেলে
সূর্যের নিচে আমাদের— চুমু— আলিঙ্গন...

প্রকৃতপক্ষে সবুজ বারান্দাই আমার প্রিয়
অল্প জলে ভেসে থাকা নৌকো; প্রাচীন প্রাসাদের
ভাঙ্গা ঘর- আকাশ যেখানে ছাঁদ; যাবে লীনা?

তুমি নও
তোমার আশ্চর্য চক্ষুদ্বয়—যা ভুলতে গিয়ে
প্রতিবার আমি ভুল প্রেমের জন্ম দেই

রেখে যাও
কিছু ঋণ আছে অপরিশোধ্য

মুক্তগদ্য - তপব্রত

মুক্তগদ্য
তপব্রত



সমস্ত পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা শান্তি-র স্থৈর্য বাঁধা... হেমলক বিষের মতো একটা নরম সুগন্ধ অথচ দূর থেকে দূরে যাবার সবটুকু পথ জুড়ে একটা শব-চেতনা কেন যেন তাড়িয়ে বেড়ায়। একটা গভীর, কিংবা গোপন অথচ একক ভয়, ক্রমশ ভয় পেতে পেতে একটা নিশ্চিন্ততা আসে... কেন যেন মনে হয় পাশে শোওয়া মানুষটা ঠিক সে-ই যদি না হয়ে আর কেউ হত... অথবা দাঁড়ি টেনে দেবার পরও যদি আরও একটা-বার...? অথবা সবটুকু ভুল, মিথ্যে টেনে ছিঁড়ে ফেলে যদি নগ্ন করে...

যদি। সমস্ত শান্তির শেষ পাতায় একটা যদি-র ভরসায় ঘুম আসে... অথবা ভয়। ক্রমশ ক্লান্তি এলে স্বপ্নের গায়ে তারা আঁক কেটে যাবে বোধহয়...


মনে করি, যুদ্ধ করব; কিংবা ভালোবাসব শুধু...
এই দুয়েই নাকি দোষ ধরে না কোনও!

ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে গিয়ে সামনে এলেন তার পালিকা...
কি ভাগ্য কি ভাগ্য ও পশু তোর শালীন যন্ত্রণা পাস...

আমি অশালীন একক,
চোখ দিয়ে পড়ে নিতে নিতে যে নদী হয়ে যায় ও শরীর তার নীচে ডুব দিতে চাই...

সে খুঁজবে শান্তি কল্যাণ,
সে খুঁজবে গৃহস্থকোণ...

আমি মজুর, কুলি, খনির পর খনি খুঁড়ে গভীর থেকে আগুন তুলে এনে
খনি ফেলে চলে যাব আবার...

সে খুঁজবে যাযাবর...

কতদূর, কত, কত আরও...

থামতে জানিস না?... জানিস না? তবে মর...


ইংরাজী কবিতা - মোনামি ঘোষ

Where I Stand
Monami Ghosh



You designed the soil,
Where I am now planted.
My days, perpendicular to the seething grants of breath.
Behold the woes of gradient
At my slightest inclination.

Grains enrapture my spine, as I strive to live;
And melt at the breeding pulse
Of stolid arms you so extend, that –
Mellows turn to quivers;
And slide down the enormous slope of strength.
My feet grounded in the fragment,
Drink the drizzlebits of life.

I seldom noticed the shadows of the sky
On mourning grounds, and its changing shades of grey.
My fingers, glistenning stalk of dew
Turn feeble, fragile, forlorn-
As I try, and try, and try, to bend, and seek-
Where I stand !

অনুবাদ কবিতা - ইন্দ্রানী সরকার

A Night-Pieceইন্দ্রানী সরকার

The sky is overcast

At length a pleasant instantaneous gleam
Startles the pensive traveller while he treads
His lonesome path, with unobserving eye
Bent earthwards; he looks up--the clouds are split
Asunder,--and above his head he sees
The clear Moon, and the glory of the heavens.
There, in a black-blue vault she sails along,
Followed by multitudes of stars, that, small
And sharp, and bright, along the dark abyss
Drive as she drives: how fast they wheel away,
Yet vanish not!--the wind is in the tree,
But they are silent;--still they roll along
Immeasurably distant; and the vault,
Built round by those white clouds, enormous clouds,
Still deepens its unfathomable depth.
At length the Vision closes; and the mind,
Not undisturbed by the delight it feels,
Which slowly settles into peaceful calm,
Is left to muse upon the solemn scene.

William Wordsworth



অনুবাদ । ইন্দ্রানী সরকার



মেঘাচ্ছন্ন আকাশ
উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ
নিবিড় ঘন মেঘে ঢাকা তমসাবৃত
আকাশ শুভ্র চাঁদের আলোয় ভরা |
অস্পষ্ট সঙ্কুচিত গোলাকার চাঁদ মৃদু
আলো ছড়ায় যা পাথর, গাছপালা আর
মিনারের নকশা মাটিতে এঁকে দেয় |

সুদূরে চিন্তারত একাকী পথিক সুমধুর
চাঁদের আলোয় সচকিত হয়ে অবনত
মুখ তুলে উপরে তাকিয়ে দেখে মেঘ
সরে গেছে আর মেঘের ফাঁক দিয়ে
ফুটে ওঠে সুস্পট চাঁদ আর স্বর্গের দীপ্তি |

নীলাভ আঁধারে বাঁকা চাঁদ ভেসে যায় ,
কত শত ক্ষুদ্র অথচ স্পষ্ট অগুন্তি নক্ষত্র
সুগভীর নীহারিকায় চাঁদের পথসঙ্গী হয়,
কত দ্রুত তারা বৃত্তাকারে ঘুরে যায় কিন্তু
অদৃশ্য হয় না, গাছে গাছে ঝরো বাতাস
বয়ে যায় কিন্তু তারা পথভ্র্যষ্ট না হয়ে বহু
যোজন দূরে থেকেও; মেঘেদের সারি সারি
তোরণ অপরিমিত গভীরতায় গাড় হতে থাকে |

দূরে মন আর দৃষ্টি ক্রমশঃ শান্ত হতে থাকে,
চারিদিকের সুন্দর আর পবিত্র পরিবেশে মন
হয়ে যায় অচঞ্চল, ধ্যানমগ্ন ||