সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

সোমবার, ২০ মে, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ, ৭ম সংখ্যা


সম্পাদকের কলম থেকে -

তোমার জন্য রাজা সাজা
তোমার গানে ভালোবাসা,
তোমার কথায় রক্তকরবী
তোমার লেখায় কাঁদা হাসা।


সময়ের হাত ধরে নতুন দুনিয়ায় সবুজ ধানের মেঠো গন্ধ আর পল্লীসরলতা নিয়ে যখন হাতছানি দেয় গ্রামবাংলা, যখন প্রাণের মধ্যে শব্দের আকুলতা আর ঝড় বয়ে যায়, মুঠোভরা আনন্দের ডালি এক লহমায় ভরে যায় মনে-প্রাণে, ঠিক তখনই কে যেন বলে ওঠে -

কত কি দিয়েছো তুমি কত কি পেয়েছি হৃদয়ের ঘাটে
তোমার স্মৃতিচারনেই জ্বলে ওঠে মম সন্ধ্যপ্রদীপ তটে।

প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ, তাঁর ১৫৩তম জন্মদিন, তাঁরই রচনা পাঠ করে, তাঁরই সুরারোচিত গান গেয়ে পালন করলাম গত ২৫শে বৈশাখ। আসলে আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিটি পলে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রচেতনা, রবীন্দ্রভাবনা। আলাদা করে তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ জানানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। তবুও তাঁর অন্তরঙ্গ উপলব্ধিতায় উৎসর্গীকৃত এবারের সৌকর্যের ৭ম সংখ্যা - রবীন্দ্রশ্রদ্ধার্ঘ।


সৌকর্যের এবারের সংখ্যা 'রবীন্দ্রশ্রদ্ধার্ঘ'-এ রয়েছে কবি অমিতাভ দাশের দুটি কবিতা, শ্বান্তনু মৈত্রের কবিতা, ইন্দিরা দাশ এবং রিঙ্কু দাশের কবিতা, অদিতি চক্রবর্তীর 'দাড়িবুড়ো', শ্রীশুভ্রের 'বিশ্বপথিক', শীবাশিষ রায়ের লেখা। নিয়মিত কবিতার ডালি নিয়ে এসেছেন, রণদেব দাশগুপ্ত, আকাশ দত্ত, বিদিশা সরকার, ভোলা রায়, ইলা, সৈকত ঘোষ, মামনি দত্ত, সূর্যস্নাত বসু। গল্প লিখেছেন মৌ দাশগুপ্তা এবং অমলেন্দু চন্দ। অনুবাদ কবিতায় রয়েছেন ইন্দ্রানী সরকার। আশা করি সকলের ভাল লাগবে। আমরা সাগ্রহে অপেক্ষা করব আপনাদের মন্তব্যের জন্য, আপনাদের অভিমতই আমাদের সৌকর্যকে আগামীদিনে সমৃদ্ধ করে তুলবে সকলের দরবারে।




সৌকর্য সম্পাদকমন্ডলীর পক্ষে
সুমিত রঞ্জন দাস

রবীন্দ্রশ্রদ্ধার্ঘ - অমিতাভ দাশ

রবীন্দ্রশ্রদ্ধার্ঘ
অমিতাভ দাশ



রবীন্দ্রশ্রদ্ধার্ঘ - অদিতি চক্রবর্তী

কোলিয়ারির দাড়িবুড়ো
অদিতি চক্রবর্তী


কে বটি? হঁ আইগ্যা! ত কে বটেন উনি? /ইত্য বড়ো দাড়ি বুড়ো? পেন্নাম লাগি মুনি।/ উ...উহুঁ ইতো হামার কত্তা বাবার ...বাবার পারা! গতর টাও খাসা/ ডজন খানেক পানবিবি লিয়ে তেনার হুড়হুড়াই ফূর্তি ছিল ঠাসা ।/ তবে তার ফটুতে মালা... গায়েন, ছড়া কাটা কিনে,/ কি বইললে , রবি ঠাকুর? ই' কথা জানে গাঁয়ের সব্বজনে?/ ত ...হামার পঁচানি কপাল! লিখাপড়া টো কইরে কি হবেক হে!/ ইঃ, কুথাকার কে তো পান্তাভাতে দে.../কিসকু গুনিন বটি আমি, তাগদ মোষের পারা/ আমার সাথে লইরবেক উ ? নাফা হবেক সারা !/ কি বইললি? ঠাকুর বটে, ত সে কি ওই কোলিয়ারির মহাজনের গুরু!/ ই'ট তুমার লতুন সাজ? পেন্নাম হই মারাং বুরু!/আমার ফুলমণি ডাগরটি ইখন, সাঙ্গা টো তার দিতে লারি/ হাজারি বাবুর লজর সিঁচে বাঁচবে কি ও হতচ্ছারি!/ কি বইলছ হে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর...মস্ত কবি বটে! /হঁ ... ইত বড় কবি আর পয়দা হয়নি কো এ তল্লাটে.../ ইয়ার পূজা কইরলে বিদ্যা হবেক্, বুদ্ধি হবেক্, মিয়াছিলা ইজ্জত পাবেক্?/ তবে তো পুঁটির মায়েও গতরখাগী নাম হারাবেক।/ পাপ লিবি নাই তো হে রবি ঠাকুর,তু যদি সত্যি ঠাকুর বটিস্ / তো হামার টুকচেক জমিন ফিরিয়ে দে কিনে ...বা হাতের লগদ দিবো দশ-বিস।/কি বলইছিস তুরা? ই ঠাকুর সি ঠাকুর লয়? মানুষ ঠাকুর ? পড়া জানে, গায়েন জানে,পণ্ডিত মশাই?/ তাই তুরাও তার ধর বাদে মুণ্ডটাতেই মালা দিলি! ইমন কসাই!/ হঁ আইগ্যা রবি ঠাকুর ...আমি ছ'ট লোক/তুমি যদি ভদ্দর লোকের তবে আজ থেক্যা ওদের বিদ্যাবুদ্ধি হোক ।

রবীন্দ্রশ্রদ্ধার্ঘ - শান্তনু মৈত্র

বৃষ্টিপাত আর এলোমেলো রবীন্দ্রনাথ
শান্তনু মৈত্র


অঝোর বৃষ্টিপাতে এক পলক তোমায় দেখা ,
সেটাই বুঝি গল্পের শুরু !!
নাকি সেটাই শান্ত আকাশে এক চিলতে বিদ্যুৎ ??
পৃথিবী তোলপাড় করেছি আমি মুক্তির আশায় ...
একটু একটু করে লিখে রেখেছি ধ্বংসের আলাপ
নিস্তব্ধ আষাঢ়ের দুপুরে ... কলঙ্কের শেষ পৃষ্ঠায়।


অত্যাচারীর বন্য সোহাগ, শুধু তোমার জন্য
হারিয়ে যায় নির্বিরোধী স্কাইস্ক্র্যাপারের আড়ালে ,
দুঃখের সন্তাপ আর নিঃসীমতায় হারিয়ে যেতে যেতে
সৃষ্টি হয় আমাদের অলিখিত মৃত্যুরহস্য ।
এমন বৃষ্টিতে মুছে যেতে থাকে শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ ...
বদলে যায় একটা বেরঙ্গীন সম্পর্কের ইতিবৃত্ত

আমরা রাস্তা ভুলে চলতে থাকি নিরুদ্দেশে
অক্ষমতায় খুঁজি রবীন্দ্রনাথের গান , অঝোর শ্রাবণে
হারিয়ে যেতে থাকা “বজ্র মানিক দিয়ে গাঁথা” আষাঢ়ের মালা ।।

রবীন্দ্রশ্রদ্ধার্ঘ - ইন্দিরা দাশ

পঁচিশে বৈশাখ ... দেখা দিক আরবার
ইন্দিরা দাশ


বহু বর্ষ আগে
বৈশাখ দাবদাহে-
জন্মিল শিশু এক,
সেদিনের রবি সমস্ত কিরণ তার দিয়েছিল ঢেলে, শিশু রবি শিরে
আশীর্বাণী হয়ে তারে ঘিরে।

গীতি, ছন্দ তার
ভরেছে মোদের মনন বারবার
বিরহের বর্ষায়, মিলন বসন্তে-
পূজার প্রেমেতে, মৃত্যুতে।

কবি চলে গেছে, তবু রয়ে গেছে গান
কবিতার একটি অক্ষরও হয়নি তো ম্লান।
যতবার মানুষের মন আনন্দে ব্যথায় ঠাঁই নেবে
তাঁর লেখনী আশ্রয়ে,
ততবার জন্ম নেবে আমাদের রবিকবি-
নুতন নুতনতম হয়ে।

আজিকার দ্বিধা দ্বন্দ্ব মাঝে,
যবে মানুষে মানুষে কত হানাহানি আর-
মাতৃশরীরে বিকৃত স্পর্শের দুন্দুভি বাজে-
অসহায় খুঁজে ফেরে আকুল আশ্রয়
কবি আজ আরও একবার
ফিরে এসো সবার হৃদয়ে

নিয়ে অতন্দ্র অভয়। 

রবীন্দ্রশ্রদ্ধার্ঘ - রিঙ্কু দাশ

রোমন্থন
রিঙ্কু দাশ


রোমন্থনের আর এক নাম জীবন ! "চুকিয়ে দেব বেচাকেনা, মিটিয়ে দেব লেনাদেনা, বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাতে" - সারা ঘরে রজনীগন্ধার দীর্ঘশ্বাস - "তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে" - তখনই তো মনে পড়ে যখন থাকাটা হয়ে যায় না-থাকা - 'যেদিন চলে যাব বুঝবি সেদিন, আমি ছিলাম - জুড়ে ছিলাম - ভরে ছিলাম'' ।

আজ বুঝি । আর এই পবিত্র ধূপের ধোঁয়ায় তোমায় খুঁজি - তোমার দহনকে ছুঁতে চাই তোমার মত করে _ _ _ _

সেদিনও ছিল বর্ষবরণ। আকাশে ছিল তুমুল মেঘ - "তবু বৃষ্টি তখনো হয়নি"। তোমার চোখের ঝড়ের অশনি আমার মনের আয়নায় একটা আঁচড় ও কাটতে পারেনি ! 'খোকা, আকাশের অবস্থা ভালো না, আমার শরীরটাও কেমন কেমন করছে - আজ একটু থাকবি আমার কাছে?' তোমার অস্থিরতায় ছুঁড়ে দিয়েছিলাম একরাশ অসহ্য বিরক্তি - 'তুমি চাও না আমি নিজের মত করে ভালো থাকি - সুখি হই' - কিচ্ছু বলনি আর। তাকিয়েছিলে অপলক। তারপর দেওয়াল ধরে শরীরটা সামলাতে সামলাতে চলে গিয়েছিলে নিজের ঘরে। তোমার আমূল কেঁপে ওঠা কোন ছায়া ফেলেনি আমার মনের ক্যানভাসে ! তোমার সেদিনের নীরব কথা আজ শুনতে পাই আপাত বধির কানে - সেদিনের তোমার নিজেকে সাম্লে নেওয়া আজ অনুভব করি জীবনের ভার বইতে বইতে _ _ _ _

চলে গিয়েছহিলাম। যেতে তো আমাকে হতই। নন্দিনীর সামনে নিজেকে সংস্ক্রিতি-মনস্ক আঁতেল প্রমাণ করার তাগিদ ছিল যে ! "দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ _ _ ব্যাক্ত হোক জীবনের জয়_ _ মোর চিত্ত মাঝে" _ _ তারপর_ _ চোখে চোখে নীরব সম্মতি _ _ ।

আর ঠিক তখনি আর এক পৃথিবীতে এক বুক যন্ত্রণা - আকণ্ঠ পিপাসা আর এক জীবন শূন্যতা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলে তুমি !

মানতে পারিনি কিছুতেই। পালাতে পারিনি নিজের কাছ থেকে । আমার ভুলেই তুমি নেই হয়ে গেলে !

তারপর _ _ পাঁচ বছর _ _ হৃদয়পুরের 'হৃদয়-বারতা' - মানসিক আরোগ্য নিকেতন । নন্দিনই এখন প্যারিসে । না, ওকে কোন দোষ দিইনা । তুমি আমায় পৃথিবীতে এনেছিলে, সেই তোমাকেই যখন চোলে যেতে হল আমার ভুলের মাসুলে _ _ নন্দিনী বরং বেঁচে গেছে চলে গিয়ে ।

"সবাই ছেড়েছে, নাই যার কেহ, তুমি আছ তার, আছে তব স্নেহ" - সবাই ভাবে পাগলের প্রলাপ । তুমি আমায় ঘিরে আছ তুমুল না-থাকা নিয়ে _ _ ছেয়ে আছ আমার শূন্যতা জুড়ে _ _ মিশে আছ আমার একলা থাকার অভ্যেসে _ _ _ _
খোলা জানলা দিয়ে প্রথম বৈশাখী হাওয়া এসে দুলিয়ে দেয় রজনীগন্ধার মালা - ফটো ফ্রেম থেকে নেমে আসো তুমি জ্বলন্ত সিঁদুরের টিপে জীবন্ত _ _ সাধের তানপুরাটার ধুলো ঝাড়ো _ _ টেবিলের 'গিতবিতান' টা উল্টেপাল্টে দেখে বুকে চেপে ধরো চোখ বন্ধ করে _ _ তারপর আমার মাথার কাছে বসে রুক্ষ চুলে আলতো হাত বুলতে বুলতে - 'রাত জাগলে শরীর খারাপ হবে খোকা, ঘুমিয়ে পড়' ।

বাইরে প্রবল বৃষ্টি এল বোধহয় - কালবৈশাখী - "কাটবে গো দিন আজো যেমন দিন কাটে, _ _ _ _ ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী _ _ _ _ চরবে গোরু_ _ _ _ খেলবে রাখাল ওই মাঠে_ _ " _ _ _ _

রবীন্দ্রশ্রদ্ধার্ঘ - শিবাশিস রায়

রবীন্দ্রশ্রদ্ধার্ঘ
শিবাশিস রায়


আমার বেঁচে থাকার শীর্ণতায় যদি সে সত্যি থেকে থাকে তবে আমি বুঝবো আমার জীবন স্বার্থক!! অনেকে অনেক কিছু ভাবে, ভাবায় !! লেখে কালবৈশাখীর নামে প্রেমের দস্তাবেজ, শুধু দলিলটা তখনো বন্দক থেকে যায় যার নামে, যার কাছে, তাকে ভাঙ্গাতেই তো আধুনিকতার চায়ে চুমুক মারা! তাই না...

একবিংশ শতাব্দীর রোদ্দুর ক্রমশ ঢলে পরছে, তোমাকে যে সবাই মহর্ষি বলছে হে কবি!!! তুমি ও কি তবে আমার থেকে ক্রমশ দুরে সরে গেলে, তুমিও কি তবে তোমার আঙুল ছারিয়ে আমাকে ঠেলে দিলে নিঠুর বাস্তবে অজানা কিছু সাব্যস্ত করার আশায়...

কিন্তু, কিন্তু আমি তো তোমাকে ছারিনি সখা,আমার আনন্দ থেকে দুঃখ, প্রেম থেকে বিরহে! আমি তোমাকে পাশ ছাড়া করিনি একটি বারও আমার আজন্মকৈশোর যৌবনে ...তবু কেন এই বিচ্ছেদ দিলে নীরব বিবর্ণতায়!!

তুমি তো সব ই জানো, যখন বন্ধুরা ডাক্তার হতে চেয়েছে, ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছে, হতে চেয়েছে কারুর স্বামী, প্রেমিক, পিতা...আমি তখন রবিন্দ্রনাথ হতে চেয়েছি তোমার ছায়ায়, তোমাকে দেখে! লোকে আমায় পাগল বলেছে,উন্মাদ বলেছে,হেঁসেছে আমাকে দেখে আর চোখে চেয়ে, আর আমি নির্বাক নিরুত্তর থেকে চোখ বন্ধ করে শুধু তোমার মুখখানা মনে করেছি যে ভাবে তুমি ধরা দিতে ঘুমের নৈমিষারণ্যে!! কানে কানে তুমি ই তো আমায় ওদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে শিখিয়েছিলে- হ্যাঁ হ্যাঁ আমি উন্মাদ, আমি পাগল আমি উন্মাদ, কারন আমার জীবন থিতিয়ে যায়নি ধুসর বাঁচার পসরা সাজাতে সাজাতে!! আমি স্বীকার করি আমি উন্মাদ কারন এখনো আমার মধ্যে বাঁচার উন্মাদনা আছে!!! তবে কেন আজ ভানু দাদা এই ভাবে মুখ ফেরালে আমার মননে!! তবে কেন আজ আমায় আর আগের মত ভালোবাসো না, কেন আমার কলমের কালিকে শাসন করতে আজ তোমার আজ উদাসিনতা...

এক এক করে আমায় ছেরেছে আমার প্রিয় শৈশব,আমার স্মৃতিভেজা কৈশোর, যৌবনের রং বেরংএর উচ্ছ্বাস!!কিন্তু তুমি পাশে থেকেছো অনুক্ষন!!! প্রিয় বন্ধু দের মুখ বদলেছে সময়ের দাবী মেনে, কিন্তু তুমি সাড়া দিয়েছো "চির সখা" সম্বোধনে!! প্রিয়তম প্রেমিকা যখন অহ রহ বিরহ মালা জপতে আমায় ফেলে রেখে গেছে একা,আমার সেই রাত জাগার প্রহরে এই শহরে আমি তোমাকেই পেয়েছি পাশে, আমার বেড়ে ওঠার অবকাশে। দিনযাপনের পর্বের প্রশ্বাসে তখন শুধুই সুনীল,শক্তি, সুবোধ, আর জয়... আর কত কবি এগিয়ে এসেছিলো আমার জোলো অনুভুতিতে, তবু আমি একটি বারও ছারিনি তোমার তর্জনি!! তবে কেন নাথ, আজ তোমার এই অভিমান আমার প্রতি?? আমার এই জীবনতো তোমারই উপজাত, আমার ভাষা, অনুভুতি, প্রেম সবই তো তোমার মেঘের ই ধারাপাত...

মনে পরে, যখন বিধাতা পুরুষ আমায় ভাষা নির্বাচনের স্বাধীনতা দিয়েছিল, তখন তো আমি তোমাকেই ভালোবেসে বাংলাকে ছুঁয়েছিলুম চোখ বন্ধ করে!! চোখ বন্ধ করে তোমার হাত ধরেছিলুম চিরমুক্তির জীবন সেবনে এক দুর্গম পথে পা বাড়িয়ে! ফুরিয়ে যাওয়া অন্তরে যে ঢেলে ছিল মৃত সঞ্জিবনি সুধা, সে তো শুধু তুমি...

আমি আজো ঠিক তেমন ভাবেই দাঁড়িয়ে সবার পিছনে ,যেভাবে দাঁড়িয়ে শুনতাম বিদ্বদজনেদের মুখে তোমার স্তুতি, ভজনা, সমালোচনা আর ............!! কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করেছি তোমার অবাধ্য হয়ে, কারন থাকতে পারিনি!!আবার নিজেকে বুঝিয়েছি তোমার আয়নায়!! কিন্তু তুমিই বল মিনি কি সইতে পারে কাবুলিওালার অপমান, কিম্বা ফটিক কি বাঁচতে পেরেছিল তার ওই দমবন্ধ করা শহুরে জীবনে...
বিশ্বাস কর, আজ আমারও এক বাঁও মেলে না...দুই বাঁও মেলে না...
তোমাকে ছাড়া আমার এই জীবন এক মাত্রা হীন, অর্থ হীন শব্দের মত...
আমি শব্দ জব্দ যেমন মুহূর্তে মেলাই, আমাকে অভাবনীয় ভাবে তুমি জব্দ করলে যে শব্দের বন্ধনে,সেই বাঁধনের সাধনে শুধু সেইটুকু শব্দ কেই মন্ত্র করে তোমার পায়ে দিয়ে গেলুম আমার ভালোবাসার বিহ্বলতা ...অনুরোধ শুধু-
চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না ।
সংসারগহনে নির্ভয়নির্ভর, নির্জনসজনে সঙ্গে রহো ।।
অধনের হও ধন, অনাথের নাথ হও হে, অবলের বল ।
জরাভারাতুরে নবীন করো ওহে সুধাসাগর ।।
ভালো থেকো... শেষের বেলায় জানায় পাগল শুভ জন্ম দিন!!!

রবীন্দ্রশ্রদ্ধার্ঘ - শ্রীশুভ্র

পথের সাথী - বিশ্বপথিক
শ্রীশুভ্র


বড়ো বিস্ময় লাগে বলেছিলেন কবি! আকাশ ভরা সূর্য তারা আর বিশ্বভরা প্রাণের মাঝে নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করে! অনাদী অনন্ত এই বিরাট বিপুল বিশ্বে মানুষের আবির্ভাব এক বড়ো রহস্য! কি বা এর উদ্দেশ্য কিই বা এর শেষ পরিণাম! বড়ো বিস্ময় লাগে,কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালায় মানুষের ভালোবাসা তার আনন্দসরূপে বিশ্বের অভিপ্রায়কেই কেমন সহজ স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণ প্রবাহে সার্থক করে তোলে! বড়ো বিস্ময় লাগে, জন্মমৃত্যুর মাঝখান দিয়ে জীবনের অনন্ত পথের আভাসে ইঙ্গিতে হাতছানিতে!
বিস্ময়ে কখনো কখনো অভিভূত হই আমরা এই বিশ্বের অপার রহস্যে! রহস্যের সেই পথে, জীবনের সেই পথে বহুদিন ধরেই সাথী হয়ে সাথে চলেছেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ!

কবির কথায়, "কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে-/ সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়" সত্যিই কোন অনাদি অতীত থেকে বিশ্বাত্মার গান জীবাত্মার চলার পথে বেজে চলেছে, সে পথেরও শেষ নেই, সে চলারও শেষ নেই; শেষ নেই সে গানেরও! সেই পথেই চলেছি আমরাও! চলেছেন পথের সাথী রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বপথিক কবি! যে পথে স্বয়ং বিশ্বপথিক বিশ্বাত্মা নিজেই জীবাত্মার পথের সাথী! বড়ো বিস্ময় লাগে!
অনুভবের পরতে পরতে সে বিস্ময় রূপ হয়ে অপরূপ হয়ে ওঠে কবির জীবনবেদে! কবির দর্শনবোধের দ্বান্দ্বিকতায়! কবির সৃজনশীল সৃষ্টি প্রবাহের উৎসরণের উৎসবে! সেই বিস্ময়ের সংগীত মূর্ছণা রবীন্দ্রজীবনের ভরকেন্দ্রে সতত ঊর্মিমুখর! সতত আশ্রয় আমাদের মত পরবর্তীদের জন্য!

শান্তিনিকেতন গ্রন্থে কবি বললেন, "আমদের যথার্থ তাৎপর্য আমাদের নিজেদের মধ্যে নেই, তা জগতে সমস্তের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে! সেই জন্য আমরা বুদ্ধি দিয়ে, হৃদয় দিয়ে, ও কর্ম দিয়ে কেবলই সমস্তকে খুঁজছি! কেবলই সমস্তের সাথে যুক্ত হতে চাচ্ছি; নইলে যে নিজেকে পাইনে! আত্মাকে সর্বত্র উপলব্ধি করব, এই হচ্ছে আত্মার একমাত্র আকাঙ্খা!" বড়ো গূঢ় কথা বললেন কবি! সমস্তের সাথে যুক্ত হতে না পারলে জীবাত্মা মিলবে কি করে বিশ্বাত্মার সাথে! সেই মিলনের অভিসারই তো সেই পথ, যে পথের পথিক মানবাত্মাও! সেই যাত্রায় জ্ঞানযোগ প্রেমযোগ ও কর্মযোগ আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি! এই সহজ সত্যটিই ধরিয়ে দেন পথের সাথী রবীন্দ্রনাথ তাঁর আপন জীবনের গতিপথ দিয়ে!

পারিবারিক সূত্রে পিতা দেবেন্দ্রনাথের সান্নিধ্য কবিকে বেদান্ত দর্শনের অভিমূখী করে তোলে অনেক অল্প বয়সেই! জীবনের প্রথম দিকেই উন্মেষপর্বে তিনি প্রবল ভাবে প্রভাবিত হলেন বিভিন্ন উপনিষদ দ্বারা! বেদান্ত দর্শনের মূল আধার এই উপনিষদ গুলির সাহচর্য্যেই কবি উপলব্ধি করলেন বিশ্বপ্রকৃতির অন্তরস্বরূপকে! এই জগত সংসার ব্যাপী প্রচ্ছন্ন অনাদি অনন্ত বিশ্বসত্ত্বাকে কবি উপলব্ধি করলেন জ্ঞানযোগে
! বড়ো বিস্ময়ে অভিভূত হলেন জগত সত্যের অনন্ত আলোয়! কিন্তু সেই আলোকিত সত্যকে জ্ঞানযোগে জেনেও পরিতৃপ্ত হল না রবীন্দ্রমনন! নৈর্ব্যক্তিক জানা বৈজ্ঞানিকের কাম্য হতে পারে! হতে পারে দার্শনিকেরও! কিন্তু কবির পরিতৃপ্তি নৈর্ব্যক্তিকতায় নয়!

কবির কাজ রসতত্ব নিয়ে! দর্শনতত্ব বা তথ্যজ্ঞান নিয়ে নয়! তাই বিশ্বাত্মাকে জ্ঞানযোগে তাঁর নৈর্ব্যক্তিক সরূপে জেনেই, শুধু জানার মধ্যেই থেমে গেলেন না রবীন্দ্রনাথ! বিশ্বসরূপকে ব্যক্তিরূপে প্রেমের শক্তিতে প্রীতির সূত্রে অন্তরে পেতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথ! নৈর্ব্যক্তিক বিশ্বদেবতা তাই দেখা দিলেন ব্যক্তিরূপী জীবনদেবতা হয়ে ভক্তের মননে! বিশ্বাসে! প্রেমে! যিনি ছিলেন জ্ঞেয় তিনি হলেন প্রেয়! যাঁকে জেনে ছিলেন জ্ঞানের আলোতে, তাঁকে কাছে পেলেন বিশ্বস্ত প্রেমের অনুভবে! উপলব্ধির পরিসর থেকে পৌঁছে গেলেন অনুভবের বাস্তবতায়! এই ভাবেই উপনিষদের সত্যকে কবি জীবনের সত্যে উদ্ভাসিত করে তুললেন তাঁর স্বকীয় অনন্যতায়!

এইখানেই কবি একেবারে নতুন একটি সত্যকে আলোকিত করলেন! তাঁর জীবনদেবতা বা মানবাত্মার ঈশ্বর ভক্তের আগমনের অপেক্ষায় বসে থাকেন না! বরং তিনি নিজেই চলেছেন ভক্তের সাথে মিলনের আকাঙ্খায়! ২৮শে আষাঢ় ১৩১৭-এ লিখলেন অবিস্মরণীয় সেই গান; "তাই তোমার আনন্দ আমার পর/ তুমি তাই এসেছ নীচে-/ আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হতো যে মিছে!" ভক্তের জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে ঈশ্বরেরই আকাঙ্খা বাসনা রূপ নিচ্ছে ক্রমাগত! ভক্তের অন্তরে যে রসের খেলা, সে তো ঈশ্বরেরই আপন লীলা! ভক্তের প্রেমে জীবনদেবতার প্রেমের সম্মিলনেই বিশ্বাত্মার পূর্ণ বিকাশ! তাই তো জীবনদেবতা কবিতায় লিখলেন, "মিটেছে কি তব সকল তিয়াষ আসি অন্তরে মম?" (২৯শে মাঘ ১৩০২)

একদিন আগে ২৭শে আষাঢ় ১৩১৭, কবি লিখেছিলেন; "সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর-/ আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর!" এই যে সীমার মধ্যেই অসীমের প্রকাশ এটি শাশ্বত সত্য! নৈর্ব্যক্তিক সত্ত্বার ব্যক্তিরূপের প্রকাশের মধ্যে যে রসের খেলা, যে মধুর সৌন্দর্য্য, যে অপরূপ পরিতৃপ্তি সেটি রবীন্দ্রনাথের একান্ত উপলব্ধি! কবির এই উপলব্ধির নেপথ্যে উপনিষদের বৈদান্তিক দীক্ষার প্রভাব ছিল না, ছিল বৈষ্ণব ধর্মের ভক্তিরসের প্রভাব! তাই রূপের লীলায় অরূপের মধুর মিলনে বিশ্বসাগর দুলে ওঠে প্রাণের স্পন্দনে! এই পথেই কবি বিশ্বসত্ত্বার নৈর্ব্যক্তিক সত্যকে জীবনদেবতার ব্যক্তিগত প্রীতির মিলনের মধ্যে দিয়ে হৃদয়সুধায় আত্মস্থ করলেন!

পথের শেষ কোথায়? এখানেই কি থেমে যাবেন কবি? অন্তরের প্রীতিতে জীবনদেবতার সাথে পরিপূর্ণ মিলনের তৃপ্তিতেই কি ব্যক্তি জীবনের পূর্ণতা? হয়তো! হয়তো নয়! কারণ ব্যক্তিগত এই তদাত্মতার মধ্যে এই পরিতৃপ্তির মধ্যে নিজের অন্তরতমের সাথে যোগ হলেও নিজের অনাদী অনন্ত বিকাশের সিংহ দরজাটা খুলে যায় না! সেটা খুলতে গেলে বিশ্বজনীন প্রাণের সেবার মধ্যে দিয়ে বিশ্বমানবতায় পৌঁছাতে হবে!
অর্থাৎ বিশ্বাত্মার সাথে জীবনদেবতার সূত্রে অর্জিত একাত্মতাবোধে বিশ্বমানবের প্রেমে বিশ্বজনীন কর্মে আত্মনিয়োগে যে আনন্দ, সেই আনন্দেই আমাদের ব্যক্তি স্বরূপের পূর্ণ প্রকাশ!
তাই বিশ্বমানবের মধ্যে প্রীতি এবং সেবার মধ্যে দিয়েই আত্মার পূর্ণ বিকাশ সম্ভব!

"বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো"

বিশ্বমানবের সাথে প্রীতির সম্বন্ধে সেবার আনন্দে তিনি বিশ্বাত্মার সাথে মিলবেন! নিরালা নির্জন ব্যক্তি জীবনের একান্ত আরাধনায় কেবল একান্ত নিজের করে নয়, বিশ্বমানবতায় প্রতিদিনের জীবনসংগ্রামে, নিরন্তর সেবায়, দূর্বার কর্মে সকলের একজন হয়ে! উপনিষদে যেমন বলা হয়েছে সর্বজীবে ব্রহ্মের উপলব্ধির সত্যে বিশ্বমানবতাবোধের একাত্মতায় সকলের মধ্যে নিজেকে একবার খুঁজে পেলে পরার্থে স্বার্থত্যাগ সহজ হয়, আনন্দদায়ক হয়!

সেই রকমই পূর্ণজ্ঞান থেকে মানব প্রেমের সঞ্চারে সর্বজনীন কল্যাণ কর্মে আত্মনিবেদনেই মানুষের পূর্ণ উদ্বোধন! জ্ঞানে প্রেমে এবং কর্মেই মনুষ্যত্বের প্রকাশ!

এপথেই বিশ্বকবি জ্ঞানযোগে প্রেমযোগে এবং কর্মযোগের আনন্দে চলেছেন তাঁর পথেরসাথী জীবনদেবতার সাথে! টেনে নিয়েছেন আমাদেরকেও, আমাদের পথেরসাথী বিশ্বপথিক কবি! এই বিরাট বিপুল বিশ্বের বিশ্বপথিক ঈশ্বর যে পথে সকলেরই পথেরসাথী, সেই পথই সকলের পথ! শুধুই জ্ঞানযোগ নয়, শুধুই প্রেমযোগ নয়, সেবার যোগে কর্মের যোগে, আনন্দের উৎসরণই সেই পথের ঠিকানা! যে পথে " শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ পরে ওরা কাজ করে" (ওরা কাজ করে/ ১৩ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪১) যেখানে, "যেথায় মাটি ভেঙ্গে করছে চাষা চাষ- / পাথর ভেঙ্গে কাটছে যেথায় পথ, খাটছে বারো মাস!" (ধুলামন্দির/ ২৭শে আষাঢ় ১৩১৭) -- সেখানেই কবি আমাদের ডাক দিয়েছেন সকলের সেবায় জীবনের পূর্ণ উদ্বোধনে!

"To be truly united in knowledge; love; and service with all beings; and thus to realise one's self in the all-pervading God is the essence of goodness; and this is the keynote of the teachigs of the Upanishads: LIFE IS IMMENSE!"
(The Relation of the Individual to the Universe/ SADHANA)

উপনিষদের এই দীক্ষায় উদ্দিপ্ত করলেন কবি! আধ্যাত্মিক উপলব্ধিকে জীবনবাস্তবতায় সার্থক করে তোলার পথ দেখালেন পথেরসাথী কবি তাঁর "ছোট আমি ও বড়ো আমির তত্বে!" আপন ব্যক্তিত্বের সংকীর্ণ পরিসর থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্বমানবের ব্যক্তিত্বে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার পথের, পথেরসাথী কবি!

"When a man does not realise his kinship with the world; he lives in a prison-house whose walls are alien to him. When he meets the eternal spirit in all objects; then is he emancipated; for then he discovers the fullest significance of the world into which he is born; then he finds himself in perfect truth; and his harmony with the all is established." (The Relation of the Individual to the Universe./SADHANA)

এই যে ছোট আমির সংকীর্ণতা থেকে বড়ো আমিতে মুক্তি, এই প্রসঙ্গেই ১৩৩৮ এর আষাঢ়ে দার্জিলিং থেকে হেমন্তবালা দেবীকে এক পত্রে নিজের সাধনার দৃষ্টান্ত দিয়ে লিখছেন কবি:--

"চিরন্তন বিরাট মানবকে আমি ধ্যানের দ্বারা আপনার মধ্যে গ্রহণ করার চেষ্টা করি- নিজের ব্যক্তিগত সুখদুঃখ ও স্বার্থকে ডুবিয়ে দিতে চাই তার মধ্যে, অনুভব করতে চাই, আমার মধ্যে সত্য যা কিছু, জ্ঞানে প্রেমে কর্ম্মে, তার উৎস তিনি! সেই জ্ঞানে প্রেমে কর্ম্মে আমি আমার ছোটো আমিকে ছাড়িয়ে যাই, সেই যিনি বড়ো আমি, আমার মহান আত্মা, তাঁর স্পর্শ পেয়ে ধন্য হই, অমৃতকে উপলব্ধি করি! সেই উপলব্ধির যোগে আমার পূজা আমার সেবা সত্য হয়, আত্মাভিমানের কলঙ্ক থেকে মুক্ত হয়! কর্ম্মই বন্ধন হয়ে ওঠে এই উপলব্ধির সাথে যদি যুক্ত না হয়!" ছোট আমির দাসত্ব থেকে বড়ো আমির উন্মুক্ত পথে আত্মাকে মুক্তি দেওয়ার এই হলো পথ! যে পথে তিনিও পথেরসাথী!

এভাবেই কবি তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়াসে যে সাধনাকে সত্য করে তুলেছিলেন, সেই সাধনার পথে তিনি আমাদেরও ডাক দিয়ে গেলেন! বিশ্বজনীন মঙ্গলের শাশ্বত কল্যাণের সেই কর্মমুখর পথে- জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বমানবের আহ্বান ব্যক্তি মানুষের কাছে! বিশ্বপথিক ডাক দিয়েছেন পথের সাথী হয়ে! সেই পথ গিয়েছে চলে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে চিরন্তন প্রেমের বাঁশি বাজিয়ে! আর আমরা যদি আমাদের অন্তরাত্মায় সেই বাঁশির ডাক একবার শুনতে পাই, তখনি রমনীয় হয়ে ওঠে ব্যক্তিজীবন বিশ্বজনীন মানবাত্মার আত্মীয়তায়! সেই আত্মীয়তার সূত্রেই আমাদের জ্ঞানে প্রেমে কর্মে দূর হয়ে ওঠে নিকট! পর হয়ে ওঠে আপন! প্রত্যেকেই তখন বিশ্বপথিক পথেরসাথীর সাথে!



অনুবাদ কবিতা - ইন্দ্রাণী সরকার


অনুবাদ কবিতা
ইন্দ্রাণী সরকার



সমুদ্র



হে সমুদ্র, স্তব্ধচিত্তে শুনেছিনু গর্জন তোমার
রাত্রিবেলা; মনে হল গাঢ় নীল নিঃসীম নিদ্রার
স্বপ্ন ওঠে কেঁদে কেঁদে। নাই, নাই তোমার সান্ত্বনা;
যুগ যুগান্তর ধরি নিরন্তর সৃষ্টির যন্ত্রণা
তোমার রহস্য-গর্ভে ছিন্ন করি কৃষ্ণ আবরণ
প্রকাশ সন্ধান করে। কত মহাদ্বীপ মহাবন
এ তরল রঙ্গশালে রূপে প্রাণে কত নৃত্যে গানে
দেখা দিয়ে কিছুকাল, ডুবে গেছে নেপথ্যের পানে
নিঃশব্দ গভীরে। হারানো সে চিহ্নহারা যুগগুলি
মূর্তিহীন ব্যর্থতায় নিত্য অন্ধ আন্দোলন তুলি
হানিছে তরঙ্গ তব। সব রূপ সব নৃত্য তার
ফেনিল তোমার নীলে বিলীন দুলিছে একাকার।
স্থলে তুমি নানা গান উৎক্ষেপে করেছ আবর্জন,
জলে তব এক গান— অব্যক্তের অস্থির গর্জন।

1.
Oh ocean, I heard your roaring sound
in a silent night; as if a dream of endless
deep blue sleep is crying.
There is no consolation with a pain
of continuous creation.
The dark covering searches for an
exposure inside your mysterious hole.
In your fluid-like theater many large
islands and forests performed so many
songs and dance items for some time
and then vanished in the green room
with a deep silence.
Those lost design-less ages are
attacking your waves with blind agitation
periodically as if in a formless despair.
All of its forms and dances are oscillating
in your frothy blue.
You have piled up trashes of various songs,
and a different song vibrates in your body--
with restless loud words, unspoken.




হে সমুদ্র, একা আমি মধ্যরাতে নিদ্রাহীন চোখে
কল্লোলমরুর মধ্যে দাঁড়াইয়া স্তব্ধ ঊর্ধ্বলোকে
চাহিলাম; শুনিলাম নক্ষত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাজে
আকাশের বিপুল ক্রন্দন; দেখিলাম শূন্যমাঝে
আঁধারের আলোকব্যগ্রতা। কত শত মন্বন্তরে
কত জ্যোতির্লোক গূঢ় বহ্নিময় বেদনার ভরে
অস্ফুটের আচ্ছাদন দীর্ণ করি তীক্ষ্ণ রশ্মিঘাতে
কালের বক্ষের মাঝে পেল স্থান প্রোজ্বল প্রভাতে
প্রকাশ-উৎসব-দিনে। যুগসন্ধ্যা কবে এল তার,
ডুবে গেল অলক্ষ্যে অতলে। রূপনিঃস্ব হাহাকার
অদৃশ্য বুভুক্ষু ভিক্ষু ফিরিছে বিশ্বের তীরে তীরে,
ধুলায় ধুলায় তার আঘাত লাগিছে ফিরে ফিরে।
ছিল যা প্রদীপ্তরূপে নানা ছন্দে বিচিত্র চঞ্চল
আজ অন্ধ তরঙ্গের কম্পনে হানিছে শূন্যতল।


2.
O Ocean, in the middle of a sleepless
night I stood up in your wavy dessert
and looked up at the silent sky.
I heard a loud wailing from every pours
of the srars as well as the illuminating
excitement of the darkness.
So many illuminated abodes found
their homes in the bosom of time in
a bright morning, a day of celebration,
by tearing apart the hazy cover with
their sharp cosmic rays.
Their evening era came and vanished
under the deep water furtively.
The unseen and hungry beggars are walking
along your shore with a loud wailing.
Whatever was so delighted in various symphony,
today it is attacking the evacuated surface
blindly with its wavy vibrations.




হে সমুদ্র, চাহিলাম আপন গহন চিত্তপানে;
কোথায় সঞ্চয় তার, অন্ত তার কোথায় কে জানে।
ওই শোনো সংখ্যাহীন সংজ্ঞাহীন অজানা ক্রন্দন
অমূর্ত আঁধারে ফিরে, অকারণে জাগায় স্পন্দন
বক্ষতলে। এক কালে ছিল রূপ, ছিল বুঝি ভাষা;
বিশ্বগীতিনির্ঝরের তীরে তীরে বুঝি কত বাসা
বেঁধেছিল কোন্‌ জন্মে— দুঃখে সুখে নানা বর্ণে রাঙি
তাহাদের রঙ্গমঞ্চ হঠাৎ পড়িল কবে ভাঙি
অতৃপ্ত আশার ধূলিস্তূপে। আকার হারালো তারা,
আবাস তাদের নাহি। খ্যাতিহারা সেই স্মৃতিহারা
সৃষ্টিছাড়া ব্যর্থ ব্যথা প্রাণের নিভৃত লীলাঘরে
কোণে কোণে ঘোরে শুধু মূর্তি-তরে, আশ্রয়ের তরে।
রাগে অনুরাগে যারা বিচিত্র আছিল কত রূপে,
আজ শূন্য দীর্ঘশ্বাস আঁধারে ফিরিছে চুপে চুপে।



3.
O Ocean, I look deep down in my soul;
No idea where it has the beginning
and where is the termination!
Listen to the innumerable and indefinite
unknown tears wandering at formless night.
They make vibration in our hearts.
They might have forms and words
once upon a time.
On some incarnation they dwelt by the side
of the fountain of a musical world.
They were brightened by various colors
of glee and sorrow.
Long ago their stages suddenly knocked to
the ground of unsatisfied hopes.
They lost their shapes and homes.
Those forgotten and unsuccessful pains
are now infamous and wanders around
the corners of the secret fields of activities
to get forms and shelters.
Those who were so colorful and lovable,
today they are silently wandering with a vacant sigh.

·


গুচ্ছ কবিতা - মামনি দত্ত

গুচ্ছ কবিতা
মামনি দত্ত


এসো ফিরে

চলো, এক মুঠো স্বভাব বিরুদ্ধ পৃথিবী ফিরিয়ে আনি
সমস্ত ঋন পরিশোধের পর!

হারান মাঝির ছেলে আর স্কুল কামাই করেনা,
রানু মাসির অনূঢ়া মেয়ে চৈত্রের দহন বেলায়
বর্ষা নামায় নিরন্তর ভালোলাগার আবেশে!

জীর্ণশীর্ণ কোন প্রাণ -চোখের তারায়
মহাকাশ থেকে নামিয়ে আনে
দুয়ার ভাঙা নক্ষত্র আলো,

যেকোন ক্ষত তে আর কোন মাছিদের
হাতযশ খেলবে না অবলীলায়,
ধীরে ধীরে রঙ্গিন কোলাজে জ্যোতিষ্ক সাজিয়ে দেবে
ঈশ্বর কনা দের মহামিছিল!

তোমার আমার সামনেই, আমাদের স্বভূমি
জেগে উঠবে আলোকবর্ষ পাড়ি দিয়ে
আশ্চর্য এক সন্ধ্যায়, সংগীত মূর্ছনায়।।।


ইচ্ছামৃত্যু

এবং সেইসব দু :খের পায়ের কাছে
অপূর্ণ প্রেম নির্দ্বিধায় বসে আছে,
কি হবে বলো কাছে এসে, ভালোবেসে?

ঠোঁটের সীমারেখায় জোৎস্না ভাষা শিখিয়ে
চিনিয়েছিলাম ভেসে যাওয়া জলতান ব্যথা,

আর তুমি গভীরতা পেয়ে
অসুস্থ নিয়নবাতির জলস্রোত দিয়েছিলে
আপেক্ষিক আদ্রর্তা র অসম্ভবতায়,

ধূ ধূ মন আঙুল আভাসে তৃষ্ণার্ত যখন
তোমার ফেলে যাওয়া নুপুরে মুখ রেখেছি,
অন্তত একজীবন হাহাকার ওলোটপালোটের ইচ্ছায়,

আমি না হয় ভাঙাচোরা জীবনে স্বপ্ন মেখেছি,
সেই জীবন -যার পায়ে তীব্র ক্ষুধা রেখেছিলে
কি ভীষণ অসুখ সম্মোহে,

তুমিই বলো কি হবে ভালবেসে?
নীরব অভিমান ফেলে কাছে এসে।।


বিনিময়

এখানে এসে দুহাত পেতেছে নদী,
যে নদীর একাকিত্বে দুই পাড়
তিলতিল হাওয়ায় ধারালো শরীর মিলিয়েছে
সখ্যতায় অথবা নিশিথময়ী ছন্দ কারিগরী তে।

চাওয়া পাওয়ার গিরিপথে নীলাভ আলো
বিস্তার করে চলে মত্যুময় মায়া,

পথ হারানোর মুখে
দক্ষিণের বকুল গন্ধ ঝাঁকে ঝাঁকে
আলো হীন বিলাপ রেখে দিলে
নদী চোখে স্বপ্ন খেলা করে,

আদতে বিনিময় কাল পাথর গায়ে
এঁকেছিল দিগন্তরেখা,
সেইসব রেখাপথে ঘুমন্ত নদীর আলাপন
টুকরো টুকরো কোলাজ সন্ধ্যায়
তার একান্ত নিবিড় প্রার্থনায়।।


অবিশ্বাস্য সংকেত

এবং সেই কথাগুলো থেকে বিশ্বাস ঝরে গেলে
মাটির বুকে অন্তস্রোত হয়ে বয়ে যায়,
আকাশ বুকেও বৃষ্টিদানা অবসর পায়নি-

এক থেকে শত ঝলক অথৈই
ডুবে থাকে পশ্চাত্তাপ,

অদ্ভুত ধূলিকণা হয়ে উড়েছিলো বিশ্বাস যতো
-হয়তো অঝোরে ঝরে যাওয়া ফুলের পাঁপড়ি,
কোন একটায় একবিন্দু শিশির
প্রাচীনকাল রেখে ছিলো,

সেই সব কাল যা কিছু কথা
পাথর চোখে ভাসিয়েছিলো ফোঁটা ফোঁটা তাপ,
বস্তুত: দারুন দহন- নদীতল স্বীকার করেছে
তার ধর্মের জখম তীব্রতায়।।


একাকী

নক্ষত্র নক্ষত্র থেকে হরিণের হৃদয় ছুটে বেড়ালে
ঝুপ আঁধারে নেমে আসে বায়বীয় মগ্নতা,

একাকী যাপন কাল জীবন কড়চায়
খুচরো বিলাসি হিসেবে কোন দ্বন্দ্ব রাখেনি,

যতো মন্দ উপাখ্যান উপসংহার শেষের আগেই
সগর্বে আঙুলের ভাঁজে রাখে পিয়াসী মন,
যা মগ্নতা থেকে দৈবাৎ চুরি গেছে
অপার ঐশ্বরিক ক্ষমতায়।

গুচ্ছ কবিতা - সূর্যস্নাত বসু

গুচ্ছ কবিতা
সূর্যস্নাত বসু

 

কন্যাকুমারিকা


কুমারিকার দেওয়ানা ঠাঠা রোদে পুড়ে গেছে ;
সে রোদ ঠুকরানোর দায় নেই নির্ভেজাল রাতের নয়নতারার ।
'সম্ভবপর হয়েছি' --- বলেছে তখনই , যখন পর্দা ফেটেছে ।
কিংবা চোখের কোণে অঙ্গারের কিছু রূপভেদ আবিষ্কৃত হয়েছে ।
জন্মের সে দাগ ; ভুল বুঝোনা । ও যে কপালের চার আঙ্গুলে
ঠাঁই পেয়েছে বঙ্গেশ্বরের মুখে -'সুখে' ।
দেদার নেগেটিভিটির নির্ভাবনাময় বিহান যেন ছুটে চলেছে
রঙ্গিলা কিছু শব্দে --- কৌমার্যহরণের ।
(কখনও বা শীত্‍কারে শিলীভূত ) ।
#
বুকের ভেতরকার পিচ্ছিল নুড়িগুলো নীচে নামছে
অ্যাড্রিনালিন্ ক্ষরণের আশায় । সমুদ্ভব হয়ত একটাই ;
আর সেটা হল বাঁচতে না দেওয়া ।
#
এ বাঁচা সে বাঁচা নয় পথিক ; এ যে মৃত্যু- মর্দনও নয় ।
পত্রাঙ্ক খুঁজে পাওয়া বিরল ,শুধু তাই নয়;
চোখরাঙানো-ও একটা ম্যাটার ডোমেস্টিক কোলাহলে ।
এই বরদাস্তের বমাল যদি ধরা না পড়ে ; তবে সে কন্যা
কুমারিকা থাকবে না আর ।
#
বিসৃষ্ট হয়ে যাবে তার পরণের শেষ লজ্জাবস্ত্রটিও ।


আকাশের বাহারি পোষাকে এখনও আফিমের গন্ধ
ছুটে আসছে তীব্র বেগে । চোখ - কান- নাক - পাকস্থলী
ভেদ করে সে পৌঁছে যাবে যোনিদেশে ।
ন্যায্য প্রতিপন্ন করিনি এই আহ্বান । এ যেন
পেরিয়ে যাবার পরও থেকে যাওয়া ।
জমাট রক্তের ডেলা থেকে কিছু আকাঙ্ক্ষার ফেনার
স্বাধীনতা উদযাপন ।
#
ওগো সতী ; আমায় আলিঙ্গন করো
--- এ যে মন্ত্রপড়া রেপিস্টের বিজয় -পরব ।


মেকি তরলস্রোতে লাভ-লেটার লিখতে গিয়ে
বারবার নিজেকে জংলি ভেবেছে কুমারী । পুরুষ তাড়াবার
ধূপকে পরপতি ভেবে বালিশের নীচে রেখেছে ।
বালিশের উপজাতিকে ভেবেছে দেহ- কাঙাল । হাতঘড়িটাকে
গিলে ফেলে এলিয়ে দিয়েছে বিক্ষিপ্ত শরীর
ওই গোলাপি কম্বলের ভেতরে ।
#
কিছু সময় পরেই
ধূপ শেষ হবে । প্রলেতারিয়েত কম্বল হয়ে উঠবে লাল ।


সামনে 'রঙীন' ট্যাক্সি ছুটে আসছে । হাত দেখালেই
থেমে যাবে । কিন্তু ছুটবে নৃশংসতার ন্যাওটা , ছুটবে দেহ,
সুরিয়ালিজম্ , গুরু-চণ্ডাল , কালকেউটে আর ফাগুনমাস ।
গতানুগতিক সাফ করে দেওয়া মানেই শূন্যস্থান সৃষ্টি ;
- এ সৃষ্টিও স্রষ্টাকে ধ্বংস করে । উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতেও
নিম্নাকর্ষণ জহুরি । জায়গির দিয়েছে সে জাতকে ; আর
জমানত জাতিকে । নিষ্প্রাণ চেতনার বজ্জাত ঘড়িগুলো
গলে পড়ছে - ঠোঁট থেকে আরেক ঠোঁটের যোজনে ।


বেথোভেনের রিলাকসেশন সিমফোনি শোনেনি সে ।
নিজের পাঁজরকে পিয়ানো ভেবে ভুল করেছে বারবার ।
অলক্ষ্মীর সময়-স্রোতে কালান্তর রথকে থামিয়ে দিচ্ছে
কালচে পৌরুষ । হস্তরেখায় কামনার খিস্তি চিরাচরিত
'হোমারিক লাফটারে' ।
বুদ্ধের হাসিতে জীবাণুদের অক্ষয়মন্ত্র --- "ও কুমারী ;
তোমায় আমি ধর'ব না ; তোমার শিশমহলে
ভারিভুরি পারদার্য করব নিষ্কম্প বিছানার আবদারে ।"
#
(শরীর এলিয়ে দিও – নিষিক্ত পরলোকে )

ছোটগল্প - অমলেন্দু চন্দ

(মায়াবাড়ি) - অ্যাক্সিডেন্ট
অমলেন্দু চন্দ



সেই থেকে বুচু থম মেরে বসে আছে। কিছুক্ষন আগেই মুঠোফোন বেজেছিল - অনেক খোঁজ বীন করে শেষ মেশ ওই টিউনটাই রিং টোন করেছিল ওর জন্য - তোমাকে চাই। পুরনো সোফাটা অসীম মমতায় ওকে ডুবিয়ে নিচ্ছিল নিজের নরম গভীরে। ঘুন পোকাটাও কি একটা টের পেয়ে থম মেরে ছিল, নিজের কাজ ভুলে। নৈশব্দ এত ভারী হয় কেন! বাতাস নড়ে না বলে?

বুচুর ভাল নাম নিলুফার। ডাক নাম টা বাবার কল্যানে সেঁটে গেছে, ছোটবেলায় আদর করে ডাকতেন বুচকি মনি, আমার বুচকাটা, বুচু বুচু এইসব বলে। স্কুলে ঢুকবার সময় খেয়াল থাকে নি লোয়ার ইনফ্যান্ট এ শুরু হয়ে ক্লাস ওয়ান টু থ্রী - বাবাই আসত ছুটির পর নিয়ে যেতে, নিজের কাজের মধ্যে এটাকে রিলিজিয়াস প্রায়রিটী দিতেন, তো নামটাও বন্ধুদের গোচরে এসে গেলে, তারপর বড় ক্লাস,নাম আর পেছন ছাড়ে নি, আর একদিন বড় বুচুও জেনে গেছিল যে বাবার দেওয়া ডাকনামটা ওকে ব্যাতিব্যস্ত করে না আর ওর বন্ধুদের কাছে।

সেই বন্ধুদের মধ্যে বেনিয়মের ফেরে নিয়ম করেই একদিন সদাশিবন এসে গেল। দুরন্ত, হাসি খুসি, ঠান্ডা মাথা কিছুতে চটে না, অগাধ স্পিরিট আর চট জলদি কথা বলা - নিলুফার একটুতেই বেশ ইম্প্রেসড হয়ে গেল। ক্যান্টিনে নিলুফার তিন চার জনের সঙ্গে বসে ছিল, ছেলেটিকে সেদিনি ক্লাসে দেখেছে, থারড ইয়ার, ক্রপ করা চুল, এদিক ওদিক সপ্রতিভ ভাবে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। কাছে এসে বলল আমি সদাশিবন, আজকেই আমার প্রথম কলেজ এখানে, আপনারা আমায় সদা বলে ডাকতে পারেন। বলে সপ্রতিভ ভাবে একটা চেয়ার টেনে বসেছিল।

সেদিন আর আজকে - এরমধ্যে অনেক দিন চলে গেছে। মনে পড়ল একদিন ওরা দুজন এক শনিবার নামখানা ডায়মন্ড হারবারের দিকে চলে গেছিল, ওরা ওরকম চলে যেত এদিক ওদিক, সাধারনত সেদিনি ফিরে আসত, তো সেদিন এল বিরাট ঝড়। দারুন বৃষ্টি, আর হাওয়ার দমক, মাথার ওপরে রাস্তার ধারের গাছগুলো যেন বেঁকে চুরে বাসের ছাদ ছুঁয়ে টোকা মেরে জানান দিয়ে সোজা হচ্ছিল আবার অন্যদিকে ঝুঁকবে বলে, এরি মধ্যে লম্বা একটা ডাল ভেঙে দমাস করে বাসের ছাদে। বুচু তখন ফোঁপাতে আরম্ভ করেছে - শিব এ অবস্থায় - আমাদের কি হবে। ফিরব কি করে। তুই একদিন এমনি করেই মরবি আর আমাকেও মারবি। ঝড়ের কথা তো শুনেছিলি - তাও বেরুলি... সে অবস্থাতেও সদাশিবন সেই ঠাণ্ডা রসিকতা - ভ্রু পল্লবে ডাক দিলে ঝড় ওই ইশানের কোনে, আরে ভাবই না আমরা হলাম নোয়া'র মানব আর মানবী সবাই, পপুলেসান বেড়েছে তাই সঙ্খ্যা অনেক, আর এটা সেই ২০১২ র নৌকাটা।

আর তাঁর পরেই ধুম ধুম ধরাম, বাসটা একদিকে কাত, রাস্তায় গর্ত দুম করে সেই জল ঢাকা গর্তে চাকা পড়েছে। আতঙ্কে চিৎকার টা সবাই কোরাসে মন্দ ছাড়ে নি আর ডেসিবেল বোধহয় আকাশের কানেও বেজেছিল, কারন একটু পরেই বৃষ্টি থেমেছিল। ততক্ষনে ওরা বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশে এদিক ওদিক মাথার ওপর কিছু না নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, বিশেষ গাছ গুলোর থেকে দূরে, বজ্রাহত হবার সম্ভাবনা বাঁচিয়ে।

সবাই ব্যাস্ত হয়ে ঠেলেঠুলে বাসটার চাকা তুলল, বাতাসের গোঙানি কমে গেছিল, বাস চল্ল নামখানা, পৌঁছতে সময় লেগেছিল অনেক বেশী, ভাঙা ডাল পেরিয়ে সরিয়ে - ওরা উঠেছিল একটা লজে, ঝড় বাদলের মাতলামি সেরে বাতাস তখন ঠাণ্ডা, কিন্তু চিন্তায় বুচু'র মটকা গরম, আরও গরম সদা'র ঠাণ্ডা হাব ভাব দেখে। ফোন কাজ করছে না ঠিকমত, তারি মধ্যে বাবা কে ফোন করে সব বলেছিল তিন চার বারের চেষ্টায়। বাবা খালি বলেছিল সব শুনে - সদাকে ফোন টা দে। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল - তোমার কাছে থাকার টাকা পয়েসা আছে তো, যেন আর কোন কিছু চিন্তা করার নেই। আসলে সদার অ্যাক্সেপ্ট্যান্স লেভেল টা এরকমিই ছিল সবার কাছে, সদা মানে ভরসা করার মত একটা চরিত্র। আর বাবা - লোকটাই অদ্ভুত। লিভ টুগেদারের এর নিয়মে বুচু এসেছিল, মা জন্মের কিছু পরেই - অ্যাক্সিডেন্ট, গাড়িটা দুমড়ে গেছিল ট্রাকের ধাক্কায়, ভদ্রলোক সেই থেকে আজীবন একটাই তত্ত্ব বজায় রাখবার চেষ্টা করেছেন, বুচু অ্যাক্সিডেন্ট নয়। মা বাবা দুইই হয়ে থেকেছেন মাইকেল তথাগত বিশ্বাস।

আর একবার ওরা একটা প্ল্যাঞ্চেটের আসরে গিয়েছিল। নজন ছিল সেখানে, নটা মোমবাতি জ্বলছিল একটা গোল টেবিলের ওপর, আর একটাই ঢাকা আলো যাতে ছায়া বেশী পড়েছে আলোর থেকে, গুগগুলের ভারি গন্ধ। ভারী পর্দা ঢাকা ঘরটায় এক অশরীরী ঘেরাটোপ, আচ্ছন্নতার মেজাজ ছিল। সে রাতে ফিরে আসার পথে নিলুফার অসম্ভব শক্ত করে সদার হাত টা ধরেছিল, চাপের বহর দেখে সদাও বুঝি একটু অবাক হয়েছিল। অথচ তুক তাক ঝাড়ফুঁক এ সবে ওর কোন বিশ্বাস কোনদিন ছিল না, এর পরেও যে হয়েছিল তা নয়, কিন্তু অভিজ্ঞতা টা নাড়িয়ে দিয়েছিল।

এরপর একদিন নিয়মের ফেরেই কর্পোরেট জীবন। টান টোন হাড়িকাঠ, যে বুচু সাধারনত সালোয়ার কামিজ আর জীনস উইদ টপ পড়ত সে অঙ্গে তুলল শাড়ি, নিবিবন্ধের নীচে টান হয়ে থাকা ঘুমন্ত লাইটহাউসের মত নাভির নিসর্গ শোভা, অফিসে আসার আগে মুখ দেখা আয়নায় নানান টিপের বাহার সাটিয়ে রাখা - শেষ প্রসাধন ওই টিপটা। টান করে বাধা চুলের কপালে জাদুচিহ্ন, যেন শাড়ি আর ওই চিহ্ন টিহ্ন দেখে সব এক্কেবারে চিত বা কাত সুবোধ হয়ে পড়বে আর ও কেল্লা ফতে করে বেরিয়ে যাবে। না সেসব কিছুর দিকে ওর ঝোঁক ছিল না, কারন সেই সদা। সদার বাতিস্তম্ভ ঘিরে ওর সমুদ্দুরের পাড় বাঁচিয়ে রাখা, যেন কেউ ধাক্কা না খায়, কিন্তু ও যে আছে সেটাও যেন ভুলে না যায়। ওর বস কি বুঝেছিল, তাই মাঝে মাঝে রেসকোর্সের ব্যাল্কনিতে দূর দেখার যন্তর চোখে ওকে হাত নাড়তে দেখা যেতে লাগলো, আর হিল্লি দিল্লি কনফারেন্স পাচ তারা সাত তারা হোটেলের কম্ফি সফি আরামে।

সদা সদাই, ওকে যেন কিছুতেই কব্জায় আনা যায় না। এই যেমন সেদিন সবে কফি তফি সেরে প্রডাক্ট অ্যাদ্ভান্টেজ বোঝানোর প্রয়াসে মাথার ওপর চশমা টা তুলে দিয়ে ও গুটি দশ দিশি সাহেবকে মন্ত্রমুগ্ধ করে এনেছে প্রায়, মুঠোফোন বাজল - তোমাকে চাই। একটু ক্ষমা চাওয়ার লিপ সিঙ্ক করে ফোন কানে - ওপাড়ে সদার গলা - তোকে এখন কেমন লাগছে রে? কোন শাড়ীটা পরেছিস - হাল্কা নীল সাদা আচল? শোন একটা নতুন গজল লিখেছি, সুর দেওয়ার চেষ্টা করছি - ইসসে পেহ্লে কি ইয়াদ তু আয়ে / মুঝকো ঠুকরায়ে মেরা দিল তোড়ে - ওর মুখের বিব্রত অবস্থা দেখে ওর বস এগিয়ে এসেছিল, ফোনটা নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলেছিল সদা বজ্জাতি বন্ধ কর, কাজ করছে মেয়েটা - তো এই ছিল সদার গল্প, সবাইয়ের কাছে ছিল ওর অ্যাক্সেপ্টিবিলিটি, আর সেটার স্তর নেহাত ঠুনকো ছিল না, বিশেষ সদাশিবন সিনিওরের কাছে তো নয়ই, কর্পোরেট দুনিয়ার এক নিঃসন্তান হঞ্চো, যাকে বুচু বাপন বলে ডাকতো স্যার ছাড়া, প্রয়াত গ্রাম সম্পর্কের ভাই কাম বন্ধুর পিতৃহীন ছেলেটিকে হাড়ে হাড়ে চিনেছিলেন।

সেই হাড়গুলো বোধহয় গুঁড়িয়ে গেছিল। মাইকেল বিশ্বাস আর সদা দুজনেই গাড়িতে ছিল। প্রজেক্টের কাজে মাইকেল বিশ্বাস উত্তর বঙ্গের সফরে গেছিলেন। সদা ড্রাইভার। উল্টো দিক থেকে একটা গাড়ি হঠাৎ একটা শার্প ডব্লিউ বাঁকের মুখে - বাঁচাতে গিয়ে ল্যান্ডরোভার টা রাস্তার পাশের সিমেন্টের বার গুলো ভেঙে তিস্তার নুড়ি বেছানো জলহীন মাটিতে উল্টে গেছিল। মাইকেল আর সদা - দুজনেই... পুলিশ সদার ফোনের সবচাইতে বেশিবার বাজানো নম্বরটায় রিং করেছিল...তোমাকে চাই। সদা কি চেয়েছিল শেষ মুহূর্তে - আর মাইকেল বিশ্বাস - বুচু অ্যাক্সিডেন্ট নয় এটা তো সাব্যস্ত করেই ফেলেছিলেন, তাই কি অ্যাক্সিডেন্ট এতকাল নিশ্চুপে গুঁড়ি মেরে অপেক্ষায় ছিল, ভয়ঙ্কর বদলা নেবে বলে।

ফোনটা আবার বাজলো, অন্য রিং টোন, অভ্যেসে বুচু হাত বাড়াল। সিনিওর সদাশিবন - বুচু, মা - ভাঙা গলাটা এর বেশী কিছু বলতে পারে নি। বাপন... বুচুর অস্ফুট স্বর, শুধু ঘুন পোকাটাই শুনতে পেয়েছিল বোধহয়। বেনিয়মের যাবজ্জীবন কে ভাঙতে তাই বুঝি পোকাটা দারুন উল্লাসে মেতে উঠল বাতাস নাড়িয়ে।



ছোটগল্প - মৌ দাশগুপ্তা

আকাশ-কুসুম-কল্পনা
মৌ দাশগুপ্তা



আকাশরঞ্জন, কুসুমবিহারী আর কল্পনা, তিনজনে বড় ভাব। তিনজন সহপাঠী/ ও সহপাঠিনী। কল্পনারা বেশ বড়লোক। অতএব বাপের টাকার নিক্তিতে ওর রূপ মাপা যায়। আহা, কালী ঠাকুর-টাকুর অবধি নাই বা গেলাম, জনশ্রুতি যে, সে মহাভারতের দ্রৌপদীও তো কালোই ছিল বা ঐ চিতোরের রানী পদ্মিনী। কথাতে আছে না “কালো জগতের আলো”। আর নিন্দুকেরা চেহারাটা মোটাসোটা ,ট্যাবাটোবা বলে বটে তবে হিংসা করে। অবস্থাপন্ন ঘরের আদুরে মেয়ে, তার ঐ ইয়ে মানে সুখী সুখী গোলগাল ফিগার হবে না ?

কল্পনাকে নিয়ে আকাশ কবিতা লেখে, শুনে কল্পনা মুচকি হাসে। আকাশের মনের আকাশে রামধনু ওঠে। কুসুম ভুজিওয়ালার দোকান থেকে গাঁটের পয়সা খরচা করে হরেক কিসিমের আচার,মোরব্বা কিনে এনে কল্পনাকে দিয়ে বলে

- ‘মায়ের হাতের বানানো ‘।

কল্পনা টাগরায় আওয়াজ তুলে, আরামে খায়। কুসুম তাই স্বপ্ন দেখে।অর্থাৎ কিনা আকাশ-কুসুম কল্পনায় বুঁদ হয়ে থাকে। ফলে বন্ধুত্বে ভাঁটা পড়ে।

দুজনেই ভাবে, কে আগে কল্পনাকে মনের গোপনে লালিত ইচ্ছার কথাটা বলবে, কিভাবে বলবে

- ‘তোকে ভীষণ ভালোবাসি রে কল্পনা, দিব্যি করে বলছি । ‘

সেদিন ভ্যালেনটাইন্স ডে, পৃথিবীর তাবত প্রেমিককূলের ভালো বাসাবাসির দিন। ক্যালেন্ডারে শুভ মধুমাস। আকাশ-কুসুম-এর আগে কল্পনাই ওর কাঁধের ঢাউস ব্যাগটা থেকে দু’টো কার্ড বার করে এগিয়ে ধরে মুখে সলাজ হাসি মাখিয়ে বললো,

- ‘আগামী ২৭শে ফাল্গুন আমার বিয়ে, আসবি কিন্তু! ‘


কবিতা - ভোলা রায়

এজহার
ভোলা রায়



বিকেলের ডাকে ফেরত এসেছে চিঠি
সাথে ফরমান,চুমু নিষিদ্ধ
ফতোয়া জারি হয়েছে আপৎকালীন বসন্তের উপর
রাত করে বাড়ী ফিরছি
চার দেওয়ালের বন্দরে নোঙ্গর ফেলেছে সাদা সালোয়ার নাদিয়া
মুখে তার রা নেই,হ্যা নেই না নেই
স্বভাবসিদ্ধ সাংকেতিক চোখে অজস্র ইশারা
এ এমন খেয়ালি হাতে তার অভিযোগনামা
তবে কি ধরে নেবো সিনেমাটিক সমর্পন হতে যাচ্ছে?
কপট অভিযোগের তেপান্তরে অভিযুক্ত প্রেমিক আমি ছুটছি আর ছুটছি
ছুটছে ব্রিটিশ আমলের রাস্তা,মুলিবাঁশের আড়াল
ছুটছে মহানন্দা ক্যানেল,ছুটছে শব্দ,ব্ল্যাকবোর্ড চোখ
আরব্য দাস্তান যেন আর দুরে নয়
আমি কি 'না' বলেছি
ক্যাসিনোয় কাটাবো আজ সারারাত
ককটেলে চুমু খেতে খেতে সমস্ত অসন্তোষ জোনাকের আলোয় জ্বালিয়ে দেবো
পশ্চিমী ঝঞ্ঝায় উড়িয়ে দেবো প্রেম অপ্রেমের সঙ্গীত।
মাথার ভুগোলে তোলপাড় করে উড়ছে সাদাপাখি
নাদিয়া এখন জামা পাল্টাবে,পাশ ফিরে চোখ বুঁজি
মাথার নীচেও পাহাড় থাকে,দাঁত খিঁচিয়ে হেসে ওঠে
বন্ধনীর ভিতর উঁকিঝুকি দেওয়া শুরু করে সব উহ্যটুকু
প্রত্যুত্তর এটুকুই-
প্রতিরাতে প্রত্যেকটা রাত ফেরত আসে
ক্রমে এপাশ ওপাশ শুরু হয়
আমি ঘুমাবো না আজ নাদিয়া,অন্তর্লীন

বুঝি বুঝি,একরাত জল্পনার নাম কবিতা...



কবিতা - অলকেশ দত্তরায়

দুটি কবিতা
অলকেশ দত্তরায়


পথ

মৃত্যু থেমে থাকবেনা।
এখন গলির মুখ থেকে দুরে চলে গেলে আর ফেরা যায় না
হয়তো ঘুরে দেখবে সময়ের পিছুটান
আপনার আমার জন্য পথ চলা মানুষের নিখোঁজ জীবন

যে ছেলেটা দলীয় টানাহেঁচড়ায় পথে মিশে গেল
তার এপিটাফ হিসেবে গান কবিতা গল্প লেখা হবে
অথবা আরেকটা নতুন ছবি (নাম - “মৃত্যুর ভবিষ্যৎ” বা “যেখানে মৃত্যুর ভয়”)
আপনি আমি আবার ভবিষ্যতে ভোল পাল্টে ফেলব দিনের শেষে,
কারণ আমাদের গলির মোড়ে দুতিনটে পথের ডিরেকশন দেওয়া রয়েছে।

কিন্তু ওই ছেলেটার জন্য এখন শুধু ঘুমের দেশে যাবার একটাই পথ
(এই সময় ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা গান হোক - ‘এই পথ যদি না শেষ হয়”...)


প্রস্তুতিপর্ব

প্রভুকে স্মরণ করে এবার কিবোর্ড শাণ দেই।
আপগ্রেড হয়ে গেছে কালি ও কলম ছেড়েছুড়ে,
কোন ফন্ট কী বলবে নিবারণ চক্কোতি জানে
গোলাকার মুখশ্রী বর্শা ফলার মত ঋজু;
চরিত্র গঠনের দৈনিক প্রিকন্ডিশন -
তোমারও হইবে খাটো সোমবার থেকে রবিবার।
তবুও জেনারেশন গ্যাপ হল মুড়ি মিছরির

প্রবাসে দৈব-বশে জীবতারা যদি সত্যিই
খসে যায় টুক করে দেশ কাল দশ মূল থেকে
অতৃপ্ত কাজটাজ আড্ডা ও ঝারী মারা দিন
তাই কম্পিত হাতে সলিডিফায়েড টোকা মেরে
এবারের কথাগুলো বলে যাব শুধু তোমাকেই
প্রস্তুতিপর্বর অপেক্ষমাণ টাইমজোনে।

তারপর ইতিহাস বাকী কথা কবিতা বুঝুক

কবিতা - রণদেব দাশগুপ্ত

আবার ভোরের কবিতা
রণদেব দাশগুপ্ত



শিথিল স্নায়ুর প্রান্ত ছুঁয়ে
জেগে ওঠে ভোর ;
হয়তো বা এও এক অকাতর রহস্যসন্ধান ।
তোমার সামনে বসি,
দীর্ঘতর আলাপচারিতা--
তারও পারে অনন্য ভ্রুকুটি ,
নতজানু হব, তবু
আরো কিছু সম্পাদনা চাই-
তাই
তোমার চোখের থেকে
তুলে নিই বিপন্ন অক্ষর ।



কবিতা - ইলা

আত্ম-সমর্পণ
ইলা


সেই চেনা পথ.....সেই চেনা ভুল....
সব জেনে , নিজেই কবুল ।
অবহেলার বিন্দুতে মেশা ।
সেই চেনা....সব অপমান ।
অতল গভীর....এ কিসের টান..?
দাঁড়িয়ে , ধসে যাওয়া নদী-কূলে ।

কি ছিল চাওয়ার...?

নীরবতার কাছে আত্ম-সমর্পণ ।
কঠিন বাস্তব চেনায় জগৎ...
না পাওয়ার যন্ত্রনা....
আমারই চাওয়ার !
অবুঝের ডাক দেওয়া বাস্তব জীবন...!
হিসেব মেলাতে একদিন আসবে মরণ ।
মনের অতলে জমা....আবর্জনার স্তূপ ।
কে দেবে শান্তি..? কে করে হরণ ?



 

একনিষ্ঠ ব্রত



একাশ্রিত ভালবাসার দান
রক্তাক্ত___আঘাতের ক্ষত
পাকেচক্রে , হৃদয় অসমর্থ ।
দায় ভার সাগ্রহে গ্রহণ ।
আমার একনিষ্ঠ ব্রত......
খরস্রোতে অমূল্য সময় ।
মূল্যায়ন তোমার হাতে ।
সহানুভূতির আলতো ছোঁয়ায়....
হোত , শিখর স্পর্শ ।
সহস্র যোজন দূরে...
সুবাসিত স্বপ্ন চরিতার্থে
অবেলায় , আজ___স্নায়ুযুদ্ধে ।


নতুন দিন____নতুন তরঙ্গে..
সময়ের বর্তা__ কম্পিত পিন্জ্ঞরে !
অপমান-লজ্জা____স্বভাব বশে
মাটির আশ্রয়ে !


অলক মেঘের ফাঁকে মায়াবী আলো
বিষণ্ণ সন্ধ্যা নামালো
বজ্রাঘাতের অভিজ্ঞতা....ঝলসানো বৃদ্ধ বট
আজ-ও , প্রলয়ের মুখোমুখি
তবু-ও....আশা-নিরাশার শেকড় আঁকড়ে
সময়ের কথা বলে.....!!

কবিতা - আকাশ দত্ত

পাগলি
আকাশ দত্ত



এই পাগলি...
আমি বুঝিনি তোর অভিমান
কখন কবিতা হয়ে যায়
আমার তে'তলার বারান্দায় ।
স্নান সেরে আসা চুল চোঁয়া জল
ধরিনি কখনও...

এই পাগলি...
আমি অপরাধী তোর লালবাতির আলোয়..
সময়ের জ্যামিতি ধরে
আরও একবার তোর কুসুম স্পর্শ দে
আমার অপ্রেম অনু পরমানুতে ;
জেগে উঠি নিদ্রাতুর চোখে
ধ্রুপদী ভোরের শিশিরে
আমি যে এখনও সাগর হতে শিখিনি..

এই পাগলি..
হাতে হাত রাখা কলেজ দুপুর
নীল ওড়নায় ভুলেছি চুটিয়ে..
ঠিকানা বিহীন পোষ্টকার্ড প্রেম
ঠিকানা খুঁজেছে...
আমি যে ভিজতে ভালোবাসি
তুই কি বৃষ্টি হতে পারিস ??

এই পাগলি..
আয় তোর ঘুম ঘুম চোখে
তিতির কাজল সাজিয়ে দি
চাঁদ চাঁদ টিপে সাঁঝতারা হয়ে জ্বলি..
খোলা পিঠে ছিটিয়ে দি
দু'চার ফোঁটা সুর্য্য
আমার আকাশের !!





ফিরে যাও প্রেম



বন্ধ করেছি অনুপ্রবেশের দরজা
এখন জানালাটাও...
পারদপুরু ম্যাগনোলিয়ার নরম আস্তরনে
নস্টালজিক প্রেম আজ খুব দ্রুত অস্থির।

পাথরে পাথরে আগুন জ্বালিয়ে
লাভ কি বলো ?
তার চেয়ে প্রেম তুমি ফিরে যাও..
তোমার এলোচুল মাখা নিষিদ্ধ
মৌতাতে....
সবক'টা সুর বেসুরো হলে
আমার
অঙ্গে অঙ্গে নাচে প্রজাপতি ;
ধুসর কলজে জুড়ে আত্মাহুতি দেয়
ফিনিক্স পাখিরা...
অরণ্যের মাদল উত্সবের মতন
লালপাড় ভালোবাসা নিশ্চুপ হয়ে
আসে
নেশালু শীত্কারে ।

তোমার কাঁচা ঠোঁটের দু'চার
ফোঁটা জ্যোত্স্নায়
আমিও লোভী হই উষ্ণ হিমবাহের মত..
ইলশেগুঁড়ি জলধারায়
বিরহী কাদা মেখে চন্দ্রাহত !
সইব কি করে এ খোলা হাওয়া ?

আমায় প্রশ্রয় দিও না সখী...
একরাত আদর নিয়ে
তোমার বুকেও তুলতে পারি নষ্ট ঝড় !
চোখ লুকিয়ে বলতে পারি
হারাই
নি কিছুই !!

প্রিয়তমা..
পাটভাঙ্গাঁ আঁচলের গিটে লুকাও আগুন
বিপ্লবের শেষে তোমাকেই দেব হৃদয়টা !!

কবিতা - সৈকত ঘোষ

চার আঙ্গুলে রুপকথা
সৈকত ঘোষ


অলসতা কখনো কখনো
সময় কে ছুয়ে যায়, প্রায় প্রতিদিন
আমি তুলেআনি কিছু অক্ষর
আঙ্গুলের ডগায় লেপ্টে থাকা
রঙিন আবর্তে
শিলালিপিরা দাম্ভিকতা হারায়
তুমি নিরাকার ঈশ্বর হলে
কাঁচের বয়ামে বন্দী মানুষ খুজতাম না
ঘড়ির কাঁটায় যোতিচিন্ন
কখনো কখনো বাধ্যতামূলক...

#

আমার ইচ্ছেরা রং পাল্টে
ইকোফ্রেন্ডলি খড়- কুটোয় নতুন ঠিকানা বানায়
শয়ে শয়ে তরঙ্গেরা সমুদ্র পার কোরে
জড়ো হয়

তোমার গর্ভে আরতো কটা মাস
জন্ম হবে নতুন গ্রহের ...


কবিতা - বিদিশা সরকার

দুটি কবিতা
বিদিশা সরকার



প্রলাপ নির্ভর

আমার নাব্যতায় প্রশ্ন রেখোনা
আপেল জুসের রঙে টায়রা চুবিয়ে
ঝিম মেরে পড়ে থাকা প্রথম দংশন
ভূমিকায় কতোটুকু সক্ষম বলোনি

ওড়িশি মুদ্রায় মেঘ চাঁদের ভিলায়
কথা উড়ে যায় সবই প্রলাপ নির্ভর
ফুজিয়ামা মৃত নয় শতাব্দীর শেষে
গলন্ত লাভায় হোক নিষিক্তকরণ ।



নদী বৈতালিক



এ যেন দিগন্তলীন জ্যোৎস্নার ভাষা
পাহাড় ঘুমিয়ে পড়ে সন্ধ্যার গথিক
এখন নদীতে রঙ নাই বা লাগালে
নদী তো উজান সত্ত্বা নদী বৈতালিক

তবুও ডাকবে জানি এমন জমাট
কুয়াশা জড়ানো চোখে গরম কফি'র
প্রতীক্ষা , অবশ্য দেবো রুম হিটারের
কৃত্রিম উত্তাপ আর খোঁপার তিমির

আমরা হারাবো পথ ,অজস্র গলির
প্রথম দ্বিতীয় বাঁক কথায় কথায়
আমরা দাঁড়াবো শেষ ভাঙ্গনের পাড়ে
তুমিও সহজবোধ্য এমন ভিক্ষায়

অথবা নৌকায় এসো কুপির আলোয়
ছায়ায় সক্ষম হই, ছায়া অশরীরী
ঢেলে দাও মুদ্রা সবই নদীর গভীরে
স্রোতের বিপক্ষে নয় , স্রোত অভিসারী ।


কবিতা - ইন্দিরা দাশ

পলাতক ভগবান
ইন্দিরা দাশ


সোনার কৃষ্ণমূর্তি হোল প্রতিষ্ঠান
বড়, সেজ, মেজ বউ, সেবা ভার ভাগ করে দেওয়া
চৌধুরী মহাশয় ভক্ত মানুষ যে বড়
ধূপধুনো, চামর, সকাল বিকেল ভোগ
অজস্র উপাদান।

দ্বিতল প্রাসাদে বাস, দিনরাত বড় চিন্তা
বিষয় আশয়
বাড়িয়ে, বাঁচিয়ে চলা আজকের দিনে
পরিশ্রম বেজায়
তাই সেবাইত বামুনকে চমক-ধমক
কৃষ্ণ- মহারাজে যেন অযত্ন না হয়।

মালির ছেলেটা
বাড়েনাকো হাতেপায়ে খ্যে আধপেটা
একদিন কি ভেবে সে বৈকালী ভোগের থালায়
ছোট এক মুঠো ভরা ভোগ তুলে নেয়
আশায় আশায়।

এ মা, ছি ছি, অছ্যুৎ, একি অলক্ষণ
ধরা পড়ে বেদম প্রহার, উত্তম-মধ্যম
নতুন শিতলভোগ নৈবেদ্য শেষে
নারায়ণ নিদ্রা যায় মন্দিরেতে মৃদুমন্দ হেসে।

ভোরে হৈ-চৈ।
মূর্তি নেই মন্দিরেতে, কৃষ্ণমূর্তি কই?!
চৌধুরী মূর্ছা যায়
কেঁদে বলে, করলে পরিত্যাগ
কেন, কেন বল স্বামী?
স্বপ্ন মাঝে দেব হাসে
হাসে আর কয়
কোনদিন হৃদয়ে তোমার
ছিলাম কি আমি?