সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

সোমবার, ২০ মে, ২০১৩

ছোটগল্প - অমলেন্দু চন্দ

(মায়াবাড়ি) - অ্যাক্সিডেন্ট
অমলেন্দু চন্দ



সেই থেকে বুচু থম মেরে বসে আছে। কিছুক্ষন আগেই মুঠোফোন বেজেছিল - অনেক খোঁজ বীন করে শেষ মেশ ওই টিউনটাই রিং টোন করেছিল ওর জন্য - তোমাকে চাই। পুরনো সোফাটা অসীম মমতায় ওকে ডুবিয়ে নিচ্ছিল নিজের নরম গভীরে। ঘুন পোকাটাও কি একটা টের পেয়ে থম মেরে ছিল, নিজের কাজ ভুলে। নৈশব্দ এত ভারী হয় কেন! বাতাস নড়ে না বলে?

বুচুর ভাল নাম নিলুফার। ডাক নাম টা বাবার কল্যানে সেঁটে গেছে, ছোটবেলায় আদর করে ডাকতেন বুচকি মনি, আমার বুচকাটা, বুচু বুচু এইসব বলে। স্কুলে ঢুকবার সময় খেয়াল থাকে নি লোয়ার ইনফ্যান্ট এ শুরু হয়ে ক্লাস ওয়ান টু থ্রী - বাবাই আসত ছুটির পর নিয়ে যেতে, নিজের কাজের মধ্যে এটাকে রিলিজিয়াস প্রায়রিটী দিতেন, তো নামটাও বন্ধুদের গোচরে এসে গেলে, তারপর বড় ক্লাস,নাম আর পেছন ছাড়ে নি, আর একদিন বড় বুচুও জেনে গেছিল যে বাবার দেওয়া ডাকনামটা ওকে ব্যাতিব্যস্ত করে না আর ওর বন্ধুদের কাছে।

সেই বন্ধুদের মধ্যে বেনিয়মের ফেরে নিয়ম করেই একদিন সদাশিবন এসে গেল। দুরন্ত, হাসি খুসি, ঠান্ডা মাথা কিছুতে চটে না, অগাধ স্পিরিট আর চট জলদি কথা বলা - নিলুফার একটুতেই বেশ ইম্প্রেসড হয়ে গেল। ক্যান্টিনে নিলুফার তিন চার জনের সঙ্গে বসে ছিল, ছেলেটিকে সেদিনি ক্লাসে দেখেছে, থারড ইয়ার, ক্রপ করা চুল, এদিক ওদিক সপ্রতিভ ভাবে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। কাছে এসে বলল আমি সদাশিবন, আজকেই আমার প্রথম কলেজ এখানে, আপনারা আমায় সদা বলে ডাকতে পারেন। বলে সপ্রতিভ ভাবে একটা চেয়ার টেনে বসেছিল।

সেদিন আর আজকে - এরমধ্যে অনেক দিন চলে গেছে। মনে পড়ল একদিন ওরা দুজন এক শনিবার নামখানা ডায়মন্ড হারবারের দিকে চলে গেছিল, ওরা ওরকম চলে যেত এদিক ওদিক, সাধারনত সেদিনি ফিরে আসত, তো সেদিন এল বিরাট ঝড়। দারুন বৃষ্টি, আর হাওয়ার দমক, মাথার ওপরে রাস্তার ধারের গাছগুলো যেন বেঁকে চুরে বাসের ছাদ ছুঁয়ে টোকা মেরে জানান দিয়ে সোজা হচ্ছিল আবার অন্যদিকে ঝুঁকবে বলে, এরি মধ্যে লম্বা একটা ডাল ভেঙে দমাস করে বাসের ছাদে। বুচু তখন ফোঁপাতে আরম্ভ করেছে - শিব এ অবস্থায় - আমাদের কি হবে। ফিরব কি করে। তুই একদিন এমনি করেই মরবি আর আমাকেও মারবি। ঝড়ের কথা তো শুনেছিলি - তাও বেরুলি... সে অবস্থাতেও সদাশিবন সেই ঠাণ্ডা রসিকতা - ভ্রু পল্লবে ডাক দিলে ঝড় ওই ইশানের কোনে, আরে ভাবই না আমরা হলাম নোয়া'র মানব আর মানবী সবাই, পপুলেসান বেড়েছে তাই সঙ্খ্যা অনেক, আর এটা সেই ২০১২ র নৌকাটা।

আর তাঁর পরেই ধুম ধুম ধরাম, বাসটা একদিকে কাত, রাস্তায় গর্ত দুম করে সেই জল ঢাকা গর্তে চাকা পড়েছে। আতঙ্কে চিৎকার টা সবাই কোরাসে মন্দ ছাড়ে নি আর ডেসিবেল বোধহয় আকাশের কানেও বেজেছিল, কারন একটু পরেই বৃষ্টি থেমেছিল। ততক্ষনে ওরা বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশে এদিক ওদিক মাথার ওপর কিছু না নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, বিশেষ গাছ গুলোর থেকে দূরে, বজ্রাহত হবার সম্ভাবনা বাঁচিয়ে।

সবাই ব্যাস্ত হয়ে ঠেলেঠুলে বাসটার চাকা তুলল, বাতাসের গোঙানি কমে গেছিল, বাস চল্ল নামখানা, পৌঁছতে সময় লেগেছিল অনেক বেশী, ভাঙা ডাল পেরিয়ে সরিয়ে - ওরা উঠেছিল একটা লজে, ঝড় বাদলের মাতলামি সেরে বাতাস তখন ঠাণ্ডা, কিন্তু চিন্তায় বুচু'র মটকা গরম, আরও গরম সদা'র ঠাণ্ডা হাব ভাব দেখে। ফোন কাজ করছে না ঠিকমত, তারি মধ্যে বাবা কে ফোন করে সব বলেছিল তিন চার বারের চেষ্টায়। বাবা খালি বলেছিল সব শুনে - সদাকে ফোন টা দে। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল - তোমার কাছে থাকার টাকা পয়েসা আছে তো, যেন আর কোন কিছু চিন্তা করার নেই। আসলে সদার অ্যাক্সেপ্ট্যান্স লেভেল টা এরকমিই ছিল সবার কাছে, সদা মানে ভরসা করার মত একটা চরিত্র। আর বাবা - লোকটাই অদ্ভুত। লিভ টুগেদারের এর নিয়মে বুচু এসেছিল, মা জন্মের কিছু পরেই - অ্যাক্সিডেন্ট, গাড়িটা দুমড়ে গেছিল ট্রাকের ধাক্কায়, ভদ্রলোক সেই থেকে আজীবন একটাই তত্ত্ব বজায় রাখবার চেষ্টা করেছেন, বুচু অ্যাক্সিডেন্ট নয়। মা বাবা দুইই হয়ে থেকেছেন মাইকেল তথাগত বিশ্বাস।

আর একবার ওরা একটা প্ল্যাঞ্চেটের আসরে গিয়েছিল। নজন ছিল সেখানে, নটা মোমবাতি জ্বলছিল একটা গোল টেবিলের ওপর, আর একটাই ঢাকা আলো যাতে ছায়া বেশী পড়েছে আলোর থেকে, গুগগুলের ভারি গন্ধ। ভারী পর্দা ঢাকা ঘরটায় এক অশরীরী ঘেরাটোপ, আচ্ছন্নতার মেজাজ ছিল। সে রাতে ফিরে আসার পথে নিলুফার অসম্ভব শক্ত করে সদার হাত টা ধরেছিল, চাপের বহর দেখে সদাও বুঝি একটু অবাক হয়েছিল। অথচ তুক তাক ঝাড়ফুঁক এ সবে ওর কোন বিশ্বাস কোনদিন ছিল না, এর পরেও যে হয়েছিল তা নয়, কিন্তু অভিজ্ঞতা টা নাড়িয়ে দিয়েছিল।

এরপর একদিন নিয়মের ফেরেই কর্পোরেট জীবন। টান টোন হাড়িকাঠ, যে বুচু সাধারনত সালোয়ার কামিজ আর জীনস উইদ টপ পড়ত সে অঙ্গে তুলল শাড়ি, নিবিবন্ধের নীচে টান হয়ে থাকা ঘুমন্ত লাইটহাউসের মত নাভির নিসর্গ শোভা, অফিসে আসার আগে মুখ দেখা আয়নায় নানান টিপের বাহার সাটিয়ে রাখা - শেষ প্রসাধন ওই টিপটা। টান করে বাধা চুলের কপালে জাদুচিহ্ন, যেন শাড়ি আর ওই চিহ্ন টিহ্ন দেখে সব এক্কেবারে চিত বা কাত সুবোধ হয়ে পড়বে আর ও কেল্লা ফতে করে বেরিয়ে যাবে। না সেসব কিছুর দিকে ওর ঝোঁক ছিল না, কারন সেই সদা। সদার বাতিস্তম্ভ ঘিরে ওর সমুদ্দুরের পাড় বাঁচিয়ে রাখা, যেন কেউ ধাক্কা না খায়, কিন্তু ও যে আছে সেটাও যেন ভুলে না যায়। ওর বস কি বুঝেছিল, তাই মাঝে মাঝে রেসকোর্সের ব্যাল্কনিতে দূর দেখার যন্তর চোখে ওকে হাত নাড়তে দেখা যেতে লাগলো, আর হিল্লি দিল্লি কনফারেন্স পাচ তারা সাত তারা হোটেলের কম্ফি সফি আরামে।

সদা সদাই, ওকে যেন কিছুতেই কব্জায় আনা যায় না। এই যেমন সেদিন সবে কফি তফি সেরে প্রডাক্ট অ্যাদ্ভান্টেজ বোঝানোর প্রয়াসে মাথার ওপর চশমা টা তুলে দিয়ে ও গুটি দশ দিশি সাহেবকে মন্ত্রমুগ্ধ করে এনেছে প্রায়, মুঠোফোন বাজল - তোমাকে চাই। একটু ক্ষমা চাওয়ার লিপ সিঙ্ক করে ফোন কানে - ওপাড়ে সদার গলা - তোকে এখন কেমন লাগছে রে? কোন শাড়ীটা পরেছিস - হাল্কা নীল সাদা আচল? শোন একটা নতুন গজল লিখেছি, সুর দেওয়ার চেষ্টা করছি - ইসসে পেহ্লে কি ইয়াদ তু আয়ে / মুঝকো ঠুকরায়ে মেরা দিল তোড়ে - ওর মুখের বিব্রত অবস্থা দেখে ওর বস এগিয়ে এসেছিল, ফোনটা নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলেছিল সদা বজ্জাতি বন্ধ কর, কাজ করছে মেয়েটা - তো এই ছিল সদার গল্প, সবাইয়ের কাছে ছিল ওর অ্যাক্সেপ্টিবিলিটি, আর সেটার স্তর নেহাত ঠুনকো ছিল না, বিশেষ সদাশিবন সিনিওরের কাছে তো নয়ই, কর্পোরেট দুনিয়ার এক নিঃসন্তান হঞ্চো, যাকে বুচু বাপন বলে ডাকতো স্যার ছাড়া, প্রয়াত গ্রাম সম্পর্কের ভাই কাম বন্ধুর পিতৃহীন ছেলেটিকে হাড়ে হাড়ে চিনেছিলেন।

সেই হাড়গুলো বোধহয় গুঁড়িয়ে গেছিল। মাইকেল বিশ্বাস আর সদা দুজনেই গাড়িতে ছিল। প্রজেক্টের কাজে মাইকেল বিশ্বাস উত্তর বঙ্গের সফরে গেছিলেন। সদা ড্রাইভার। উল্টো দিক থেকে একটা গাড়ি হঠাৎ একটা শার্প ডব্লিউ বাঁকের মুখে - বাঁচাতে গিয়ে ল্যান্ডরোভার টা রাস্তার পাশের সিমেন্টের বার গুলো ভেঙে তিস্তার নুড়ি বেছানো জলহীন মাটিতে উল্টে গেছিল। মাইকেল আর সদা - দুজনেই... পুলিশ সদার ফোনের সবচাইতে বেশিবার বাজানো নম্বরটায় রিং করেছিল...তোমাকে চাই। সদা কি চেয়েছিল শেষ মুহূর্তে - আর মাইকেল বিশ্বাস - বুচু অ্যাক্সিডেন্ট নয় এটা তো সাব্যস্ত করেই ফেলেছিলেন, তাই কি অ্যাক্সিডেন্ট এতকাল নিশ্চুপে গুঁড়ি মেরে অপেক্ষায় ছিল, ভয়ঙ্কর বদলা নেবে বলে।

ফোনটা আবার বাজলো, অন্য রিং টোন, অভ্যেসে বুচু হাত বাড়াল। সিনিওর সদাশিবন - বুচু, মা - ভাঙা গলাটা এর বেশী কিছু বলতে পারে নি। বাপন... বুচুর অস্ফুট স্বর, শুধু ঘুন পোকাটাই শুনতে পেয়েছিল বোধহয়। বেনিয়মের যাবজ্জীবন কে ভাঙতে তাই বুঝি পোকাটা দারুন উল্লাসে মেতে উঠল বাতাস নাড়িয়ে।



0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন