সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ, ১০ম সংখ্যা

সম্পাদকীয়



সাহিত্যসাথীরা,

আশা করি ভালো আছেন সবাই। হেমন্তের পেলব পরশ গায়ে মেখে শীত এসে গেল,আর তারই সাথে পৌষের ডালি সাজিয়ে সৌকর্য আরো একবার আপনাদের কাছে হাজির। আপনাদের ভালবাসা ও সুন্দর সাহিত্যচিন্তা আমাদের এগিয়ে চলার পাথেয়। তাই আপনাদের কাছে আবারো ধন্যবাদ।

আমাদের এবারের বিভাগেও আগেরবারের মত গল্প,প্রবন্ধ, কবিতা বা ধারাবাহিক উপন্যাসের মত নিয়মিত বিভাগগুলো ছাড়াও আমাদের বিশেষ বিভাগগুলো রয়েছে -

১. স্মৃতিচারণ
২. অবিস্মৃত
৩. ভারতকথা
৪. পরম্পরা

আমাদের শীতকালীন এই সওগাত মিঠে রোদ্দুরে পিঠ ঠেকিয়ে উপভোগ করুন বন্ধুরা। ভালো থাকুন ও সঙ্গে থাকুন ।।

সম্পাদক মন্ডলী
সৌকর্য

প্রবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

নারী ও আমাদের সমাজ
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সম্প্রতি একটি সংবাদপত্রে লিখেছেন “...এই যে এখন প্রায় দিনই ধর্ষণ বা যৌননিগ্রহের ঘটনার কথা জানতে পারছি, এ সব আগেও প্রচুর পরিমানেই ছিল। তখন এমন জানা যেত কম । এখন এটা সম্ভব হচ্ছে মিডিয়া হাইপের জন্য । মিডিয়া এখন এগুলোকে নিয়মিত তুলে ধরছে । আমারতো বয়স অনেক হয়ে গেল । মেয়েদের ওপর অত্যাচার বরাবরই হতে দেখেছি । নতুন কিছু নয়” ।

খুব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার কারণেই অনেকেই এরকম মন্তব্য পছন্দ করবেন না । তারা মনে করতে পারেন এই রকম ক্যাজুয়াল মন্তব্য নির্যাতনকারীদের উৎসাহিত করারই সমতুল । আমার মনে আছে অনেক বছর আগে তখনকার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বানতলায় নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে সাংবাদিক দের প্রশ্নের উত্তরে ইংরাজিতে বলেছিলেন “ইয়েস,ইট হ্যাপেনস”। সাংবাদিকরা এর বাংলা অনুবাদ করে ছড়িয়ে দিলেন ‘হ্যা এরকম ঘটনা তো কতই হয়” জ্যোতি বসু নাকি বলেছেন । এবং প্রবাদের মত হয়ে গেলো উদ্দেশ্য প্রনোদিত ভুল অনুবাদ করা উক্তিটি । পাড়ার আড্ডায় কোন আলটপকা মন্তব্য আর শীর্ষেন্দুর মত সাহিত্যিকের কথার ওজনতো এক নয় ! না শীর্ষেন্দু ভুল কিছু বলেননি এবং নতুন কিছুও নয় । কিন্তু একটা তাচ্ছিল্য ভাব যে আছে এই মন্তব্যে তাতে সংশয় নেই । আসলে এ থেকে নারীর অবস্থান সম্পর্কে আমাদের সমাজের মনোভাবটাই প্রতিফলিত হয়েছে এরকম মন্তব্যে ।

সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই পুরুষের প্রয়োজনে নারী ব্যবহৃত হয়ে এসেছেন, মাতৃতান্ত্রিক সমাজও এর ব্যতিক্রম ছিল না । যাযাবর জীবন থেকে মানুষের সমাজ গঠনের প্রক্রিয়ায় নারীর ভূমিকাই তো ছিল প্রধান কেননা তাকে নিয়েই পরিবার , আর অনেক পরিবার নিয়েই গড়ে উঠলো সমাজ । এবং তখন থেকেই নারী হয়ে গেলো পুরুষের অধীন । মনুর বিধান ছিল ‘ন স্ত্রীস্বাতন্ত্র্যমর্হতি’ ।

স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয় । তারা কুমারী অবস্থায় পিতার অধীন, বিবাহের পর পিতার অধীন আর বার্ধক্যে পুত্রের অধীন” ।

তো এই বন্দোবস্তই তো প্রবহমান আজকের আধুনিক ভারতীয় সমাজেও । হ্যা,গত দু আড়াইশ বছরে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ও নানান আইন-কানুনের প্রণয়ন চোখে পরার মত অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু নারী সম্পর্কে সমাজের মনোভাব সেই বেদ-পুরাণ কথিত কাঠামোতেই আছে । লেনিন বলেছিলেন নারী সবচেয়ে আগে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়েছে আর তার শৃঙ্খল মুক্তি ঘটবে সবচেয়ে পরে ।

‘জোর যার মুল্লুক তার’ আমাদের সমাজ বন্দোবস্তের বেশ জনপ্রিয় প্রবাদ । শিশুকাল থেকেই আমাদের এইরকম শেখানো হয় । তসলিমা নাশরিন এই প্রবাদটিকেই অন্যরকম ভাবে তাঁর কবিতায় একটা পংক্তি লিখেছিলেন “হাতিয়ার যার মুল্লুক তার তখনো বোঝেনি নারী” । না, এখনো বোঝেনি, তাকে বুঝতে দেওয়া হয়না । এই আধুনিক সমাজে নারী স্বাধীনতাবাদীরা নিজের জন্য যে স্বাধীনতার সোচ্চার দাবী করেন তারা কি তাদের ঘরের কাজের মেয়েটির ক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতার দাবী মেনে নেন ? না নেননা । আসলে সমাজ বন্দোবস্তের মূল ভিত্তিটার বদল নাহলে তার উপরিসৌধের বদল হতে পারে না বড়জোর কিছু প্রসাধনী প্রলেপ দেওয়া যায় মাত্র । পুরুষ যেদিন অস্ত্রের দখল পেলো সেদিন থেকেই অস্ত্র বলে বলীয়ান পুরুষ নারীকে বসে রাখতে শুরু করলো । তারপর ধর্ম, আইন, লোকাচার ইত্যাদির সৌধ গড়ে উঠলো এই মূল কাঠামোর ওপর । আধুনিক সমাজে নারীকে বশে রাখার অস্ত্র যেমন রিভলবার ও শাণ দেওয়া ছুরি, তেমনই অখিলেশ যাদবদের রাজনৈতিক ক্ষমতাও । আদিযুগের অস্ত্রের ক্ষমতা এখন অর্থের ক্ষমতাও ।

পুরুষতান্ত্রিক আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান কোথায় সেই প্রশ্নেও পুরুষ দোদুল্যমান সেই বেদ-পুরাণের কাল থেকেই । নারী ‘নরকের দ্বার’ আবার সে শক্তি রূপিণী । তার বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণের অধিকার নেই কিন্তু দৈব আরাধনার সমস্ত উপাচার করবেন নারী । অসুর নিধনে প্রবল শক্তিধর দেবতারা স্মরণ নেন দেবী দূর্গার । কিন্তু অসুর নিধনে তার যাবতীয় প্রহরণ পুরুষ দেবকুল প্রদত্ত । তুমি দেবী বটে কিন্তু তোমার শক্তির উৎস আমরা পুরুষ দেবকুলই । এই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে নারীর ক্ষমতায়নের যত কথাই বলিনা কেন নারীর স্বাধীন মানবিক সত্বাকে পুরুষ স্বীকার করে না, নারীও ও এটা মেনে নেয় । সেই আদি যুহ থেকেই সমজে নারীর অবস্থন, প্রভাব ও ক্ষমতা নির্ভর করে এসেছে অর্থনীতির ক্ষেত্রে তার স্থানের উপর । আদর্শগত ভাবে একথা আমরা প্রায় সকলেই স্বীকার করে নিই যে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার মধ্যেই নারীর স্বাধিকার ও মুক্তির বীজটি নিহিত রয়েছে, কিন্তু নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কোন আমূল পরিবর্তন হয়েহে এমন কথাও বলা যাবে না । উনিশ শতকের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েহে সত্য । উনিশ শতকে যখন অনভিজাত নারী অন্দর মহল থেকে বাইরে বেরিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে, সমাজের চোখে তারা ছিল কুল কলঙ্কিনী । যাদের শ্রমশক্তির ওপর দাড়িয়েছিল সেকালের হিন্দু সমাজ তারা হয়ে গিয়েছিলেন গণিকালয়ের মালিকদের শিকার আর নতুন গজিয়ে ওঠা বড়লোকদের গৃহ পরিচারিকা । এযুগে শিক্ষিত মহিলারা অনেক উচ্চ ও প্রশাসনিক দায়িত্বে কিংবা ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে সাফল্যের শিখরে উঠছেন সত্য, কিন্তু প্রান্তিক নারীসমাজ, কৃষক রমণী, খণি শ্রমিক, আয়া, পরিচারিকারা নারীত্বের সম্মান থেকে বঞ্চিতই থেকে যান ।

ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথচলায় কত পরিবর্তন হয়ে গেছে – হয়ে চলেছে নিয়ত । আমাদের সমহ অ পরিবারের কাঠামোয় কত পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে, পরিবারের বন্ধন শিথিল হয়েছে, আমাদের মূল্যবোধগুলির কত রূপান্তর ঘটে গিয়েছে, কিন্তু নারীর প্রতি সমাজের মনোভাবের বিষয়টি সেই এক সনাতনী বিশ্বাসের অচলায়তনে বন্দি । নারী পুরুষের আশ্রিতা, পুরুষের ভোগ্যা সামগ্রী, লিঙ্গ-বৈষম্যের কারণে সে যেন এক আলাদা প্রজাতি । পিতৃপ্রধান যৌথ পরিবার ভেঙে এখন অনু পরিবার কিন্তু সেখানেও আধুনিক সমাজ কতটুকু স্বাধীনতা দিতে সম্মত নারীকে ? স্ত্রী তার পুরুষ স্বামীর আশ্রিতা – এ ভিন্ন অন্যকিছুই পুরুষ ভাবে না । সমাজ তাকে অন্য কিছু ভাবতে শেখায় না । নারী নিজেও এই ভাবনার অচলায়তনে বন্দি, ধর্মের বাঁধন তাকে অন্য কিছু ভাবতে দেয় না ।

এ বছর ‘আন্তর্জাতিক নারীদিবস’(৮ই মার্চ)এর কেন্দ্রীয় ভাবনা ‘লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান’। রাষ্ট্রসঙ্ঘের নির্দেশিকায় আহ্বান জানানো হয়েছে – ‘প্রতিশ্রুতি হ’ল প্রতিশ্রুতি, এবার লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান ভাবনাকে কার্যকরী করতে হবে’। রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রস্তাবে বা একটি বা কয়েকটি নারীদিবস পালনের মধ্য দিয়ে লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান ঘটবে এমনটা মনে করেননা কেউই । নারীমুক্তির দীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রধানতম অংশই হ’ল লিঙ্গ বৈষম্য ভাবনার অবসান, কারণ নারী-পুরুষের যৌন বিভাজনই মানব-ইতিহাসের প্রথমতম শ্রেণী বিভাজন । মানব সভ্যতার ঊষা লগ্নে মানুষ যেদিন থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা পেল সেদিন থেকেই শুধুমাত্র লিঙ্গ বৈষম্যের কারণেই নারী পরিণত হ’ল পৃথক এক ‘নিকৃষ্ট’, ‘নির্যাতিত’ প্রজাতিতে । মানুষের শ্রমেরও যৌন বিভাজন হয়ে গেল । আর ধর্মীয় অনুশাসনের নিগঢ়ে আবদ্ধ আমাদের সমাজ সেই ধারাকেই বহন করে চলেছে আজও ।

তাহলে শুধুই কি অন্ধকার ? নিশ্চিত ভাবেই তেমন মনে করার কারণ নেই । সমাজ রূপান্তরের যে প্রবহমান প্রক্রিয়া – লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান ভাবনা সেই প্রক্রিয়ারই অংশ । নারী নির্যাতন রোধে মানুষের ক্রমবর্ধমান সচেতনতা কিছু আশার সঞ্চার করে , নারীর অধিকারের স্বীকৃতি ও বৈষম্যের অবসানে নানান আইন প্রণয়ন হচ্ছে । আইন সমাজের মানসপটকে আমূল বদলে দিতে পারে না ঠিকই , কিন্তু আইন সমাজ মানসের পরিবর্তনের ধারাকে কিছু রক্ষাকবচ দিতে পারে যা নারী প্রগতির প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিও বটে ।

লেখা শুরু করেছিলাম এক খ্যাতিমান সাহিত্যিকের প্রাসঙ্গিক বয়ান উদ্ধৃত করে, আর শেষ করছি আর এক প্রবীণ সাহিত্যিকের মন্তব্যের উধৃতি দিয়ে । সম্প্রতি একটি দৈনিক সংবাদ পত্রে খ্যাতিমান সাহিত্যিক দেবেশ রায় লিখিত ‘কত উৎসব! কত টুকরো দেশ !! কত অখন্ড নারী ও বাজার !!!’ শিরোনামের নিবন্ধটির শেষ স্তবকটি এইরকম –
“আমাদে দেশের এক ব্যবসায়ী তাঁর স্ত্রীর পঞ্চাশ বছরের জন্মদিনে নিজের জেট বিমানে অতিথিদের নিয়ে যেতে পারেন দেশের আর এক প্রান্তর ঐতিহাসিক প্রাসাদে আর সেই একই দিনে কচি কচি মেয়েরা রাস্তায় মিছিল বের করে, তাদের ছোট ছোট হাতে প্ল্যাকার্ড তুলে – আমাদের ধর্ষণ করো না । মুকেশ আম্বানির স্ত্রী শতায়ু হোন । কিন্তু যে ছাত্রীটির স্কুল ব্যাগ পুকুরপাড়ে পড়ে থাকে আর তার ধর্ষিত শরীর পুকুরের জলে ভাসতে থাকে, তারা পৃথিবীর কোন সভ্য কল্পনায় এক দেশের মানুষ হতে পারে না” ।

ভ্রমণকাহিনী - অরিন্দম চক্রবর্তী





তিনদিন তিনকন্যের সঙ্গে

অরিন্দম চক্রবর্তী



পর্ব- ৪

জাগে রাত ভোর হবে ব'লে



গাড়ি ঢুকল সন্তর রিসর্টে। কেন রিসর্ট বলিনি? কেন অন্যরকম লেগেছিল বলি...

গাড়ির আওয়াজ পেয়ে অভিজিৎ বাবু বাইরে এলেন, সস্ত্রীক। লখা আর বউ ছুটে এল...অভিজিৎ বাবু এগিয়ে এসে স্পন্দনকে কোলে তুলে নিলেন(মানিকতলা থেকে ঘুরে এলেও, দরজা খুলেই বাবা এরকম করত স্পন্দনকে নিয়ে)...'বেটা কেমন লাগছে? বলে গাল টিপে দিলেন। আজ বাঘের গল্প হবে...হালুম!'

তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে...বাথরুমে গরম জল রেখে দিয়েছি হাত-মুখ ধুয়ে চলে আসুন। আমরাও চা খাইনি আপনাদের জন্য ওয়েট করছি।


অভিজিৎ বাবু প্রফেশনাল ... না আবেগ প্রবণ?

আসলে প্রফেশনাল কথাটা শুনলেই মনে হয় টাকা ছাড়া আর কিছু বোঝেনা...বোধহয় কোথাও ভুল হয় ভাবনার। একজন প্রফেশনাল মানুষ সবটুকু করে খুব নিখুঁত ভাবে এবং সে অতি অবশ্যি একজন আবেগপ্রবণ মানুষও বটে।


ঘরে ঢুকি। এই প্রথম ভাল করে ঘরটা দেখি... ভাবি, এত্তবড় বেডরুম হয়! আর সিলিং-এর উচ্চতা আকাশ ছোঁয়া। খাটের সামনে পিছনে নানা জীবজন্তুর মুখ। ডান দিকে ফায়ারপ্লেস। ফায়ারপ্লেসের পাশ দিয়ে একটা ছোট সিঁড়ি উঠে গেছে মাঝামাঝি জায়গায়। ঘরের মধ্যে ঝুল বারান্দা। ওখানে অক্সিজেন একটু বেশি...

কেন বললাম এই ক্থা? আসলে সেখানে আছে পড়ার টেবিল আর তার সামনের র‌্যাকে রাশি রাশি বই।

চার দেওয়ালের ফাঁক ফোকরে পেইন্টিংস। যা সবই একেঁছেন ডাঃ বৈদ্যনাথ গাঙ্গুলি। অজস্র ছোট বড় নানারকম কোয়েনার 'নুড়ি মূর্তি' ঘরের কোণে কোণে। টেবিলের ওপর কাচের ফুলদানিতে রাখা চন্দ্রমল্লিকা। সাদা ও হলুদ।



আমার স্বপ্নের বাড়িতে,আমিই অতিথি...



এভারেস্ট জয় করে এসে(ভাবটা সেইরকমই) শাশ্বতী বিছানায় এলিয়ে পড়ল প্রথমে। একে এক আমি, স্পন্দন ও পরে শাশ্বতী হাত-পা মুখ ধুয়ে নিলাম। পোশাক বদল করে নিলাম। শীতকালে বারবার পোশাক বদলানোর হ্যাপা আছে তাই এমন পোশাক পড়লাম সকলেই, যা পরে রাত্রে বিছানায় শুয়ে পড়া যাবে অনায়াসে।

বাইরে এসে দেখি সেই খড়ের ছাউনি দেওয়া জায়গাটায় সকলে জড়ো হয়েছে।

চা আর গরম গরম ফুলুরি সঙ্গে ফুলকপি বেসন দিয়ে ভাজা।

জমে গেল। ওদিকে স্পন্দনের জন্য দুধ এসেছে, সে মুখ ভেটকে বসে আছে(ভেবেছিল চিকেন মটন আসবে)।
অভিজিৎ বাবু বললেন- বেটা দুধ না খেলে'ত হবেনা। তুমি কী করে বন্দুক চলাবে, বাঘ মারবে !

কাজ দিল।

টুকটাক গল্প করতে করতে হুড়মুড় করে অন্ধকার নেমে এল। অভিজিৎ বাবু বল্লেন, 'চলুন,এইবার ঘরে গিয়ে বসা যাক...'

আর হাল্কা করে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,'লখা আপনার কথা সারাদিন জিজ্ঞেস করছিল, ও রান্নাঘরের দিকে আছে, যান একবার দেখা করে আসুন...'



শালা ছেলে তো ছেলে, বাপকেও জিতে নিল লোকটা...



লখা আমার হাতে বিশ্বকাপ তুলে দিল। এক লিটার মহুয়ার বোতল। সঙ্গে কয়েকটা মহুয়া ফুলও দিল।

গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে খাওয়া।

রাজা-বাদশার নেশা...



গল্পের সলতেতে আগুন লাগালাম। অভিজিৎ বাবুকে বললাম- আচ্ছা 'বাঘ কোচায়' গেছেন আপনি?

চিক্‌চিক্‌ করে উঠল অরণ্যপাগলের চোখ দুটো।

- আপনি পড়েছেন বাবার লেখা?

- হ্যাঁ পড়েছি তো...

শুরু হল গল্প। জানলাম, সারন্ডা অরণ্যে ফুলের বাহার নেই আছে সবুজের রকমারি। কোনটা হলুদ ঘেঁষা, কোনটা লাল ঘেঁষা আবার কোনটা কালচে ঘন। গুয়া পাহাড়ে চাকরিসূত্রে ছিলেন ডাঃ বৈদ্যনাথ গাঙ্গুলি। মাঝেমাঝে বাংলোতে এসে পড়ত চিতা। কখনও কখনও আসত ডোরাকাটা নেকড়ে।



সকলে মিলে- বাপরে! বলেন কী!!!

বুড়ো বিস্ময়ে বলল- হায়না আসত!!



মহুয়ার প্রথম কিস্তি দিলাম...

'হায়্না তো চায়নায়'

হাসির রোল উঠল ঘরে। থিতিয়ে গেল। আবার গল্প গড়াল...



-আমাদের বাংলো থেকে বাঘকোচা ছিল দেড়মাইল পথ। গোটা পথটাই খাদানের মধ্যে দিয়ে গেছে। দু'পাশে খাদান, মাঝখানে ট্রাম লাইন। এক জায়গায় এসে সকলেই শেষ। খাদান, ট্রাম লাইন, অরণ্য।



থাবা দিলাম...

বললাম ,আচ্ছা জায়গাটার নাম বাঘমারি না হয়ে বাঘকোচা হল কেন?



- কোচা মানে অন্ধগলি। আর এই পথ দিয়ে বাঘ যাতায়াত করে(সব জন্তুদের নাকি এইরকম নির্দ্দিষ্ট পথ থাকে)তাই বাঘকোচা।

তারপর সেই গল্প...মাকড়ায় বসার আগের মুহূর্তে দেখা বাঘের সঙ্গে। চোখাচোখি , দুজনেই দু'জনকে মাপল। তারপর আকাশ কাঁপানো চিৎকার। আসলে বাঘটি এমন জায়গায় চলে গিয়েছিল ওখান থেকে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য জায়গাটা উপযুক্ত ছিলনা। পায়ের নীচে মাটি ছিল নরম। আর বাবাও ভয় পেয়েছিলেন। তবু গুলি ছুটল...



ফল তো জানা...



এতক্ষণ অভিজিৎ বাবুর স্ত্রীকে দেখছি কিন্তু মুখে কোন কথা শুনিনি। শুধু জেনেছি ও একজন শিক্ষিকা। এইবার শুনলাম...



-কত রাত হল খেয়াল আছে? ওরা ঘুরে এসেছেন; একটু জিরোতে দাও। কাল তো আবার বেরোবেন...

প্রায় জোর করেই অভিজিৎ বাবুকে নিয়ে চলে গেলেন।



প্রথামত..এরপর ঘরের লোকেরা বলে উঠল(মেয়েরা)- বাবা ! কী জায়গা না।!! কত জানেন ভদ্রলোক!

স্পন্দন বলল, ' বাবা আজ যদি চিতা আসে এখানে'



কোন ফাঁকে বোতল খালি হয়ে গেছে...মহুয়ার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বলল্লাম- ভয় পাস না! চিতা ভি পিতা হ্যায়...



বাইরে জ্যোৎস্নার সুনামি আর ঠান্ডার বাঁদরামি বাড়ছে...তবু বাইরে এলাম। চিরকালই কিছুক্ষণের জন্য একা থাকতে মন চায়।

প্রিয়কে আরও নিবিড় ভাবে পাব বলে...



-মা এই এতক্ষণে টাওয়ার এল...শুনতে পাচ্ছ! শুনতে পাচ্ছ...আমরা ঠিক আছি। তোমরা?



-দাদু ঠিক আছে তো? তোর গলাটা ধরাধরা কেন...ঠান্ডা লাগিয়েছিস?



বুঝলাম ঠিক আছে।



মঞ্জুদি গান ধরল- আজ যেমন করে গাইছে আকাশ...



আমি একটা লিরিক্যাল সিনেমার নাম ঠিক করে ফেল্লাম- A Time to Love and Time to Die



নায়িকা হিসেবে কাকে বাছলাম জানেন...রিনা ব্রাউন। আত্ম-অবগাহনের ভঙ্গিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে চাঁদের কাস্তেতে আস্তে আস্তে ধার দিচ্ছে।

অহঙ্কারী নারী...

(শালা! ট্রাজেডি আর কাকে বলে! এক রবীন্দ্রনাথের কবিতা, দুই সুচিত্রা সেন কাউকে কোনদিন জ্ঞানত আমি ভালো বলিনি, তবুও আজ তারাই এল সামনে...)



পর্ব-৫ 

স্কার্ফ ওড়ে....বিকেল গ'লে মোম




দু'একবার ঘুম ভাঙে রাতে। গা ছমছম করে। রুপোলি আলোয় দেওয়ালের ছবি আর জীবজন্তুর মুখগুলো জীবন্ত । শার্সিতে চোখ রাখি। জ্যোৎস্না আঠায় দৃষ্টি আটকে যায়। এমন জ্যোৎস্না কলকাতায় দেখিনি কোনদিন।



নিয়্ম করে সকাল আসে। সন্তুরের সামনের বাগানে পায়চারি করি। পাখির ডাক, পায়ের নীচে শিশিরের হিম আর ফুলদের 'সুপ্রভাত' বার্তা নতজানু হয়ে গ্রহণ করি।

হঠাৎ দেখি সন্তুরের গেট দিয়ে বিদ্যুৎদা ঢুকছে।

- কীরে কোথা থেকে এলি?

- এই একটু ঘুরে এলাম। কয়েকটা গান রেকর্ড করে নিয়ে এলাম।

হেসে, হাতের ছোট্ট রেকর্ডারটা দেখাল। বিদ্যুৎদা কোথায় ঘুরতে গেলে সঙ্গে করে ঐ ছোট্ট রেকর্ডারটা নিয়ে যায়। ওতে গান তোলে। ওর মতে পৃথিবীতে চতুর্দিকেই গান। পাতা ঝরার শব্দে, ভোরের পাখির চিকন গলায়, হাওয়ার ফিসফিসানিতে। আর কলকাতায় ফিরে মাঝেমাঝে রাতে এইসব গান শোনে।

অ-সময় নিয়ে খেলা...



সেদিন সকলেই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে। সকাল আটটার মধ্যে আমরা প্রাতরাশ শেষ করে গাড়ির কাছে। আজকে আমাদের অনেকগুলো জায়গা ঘোরার আছে...

জিপ ছুটল মনোহরপুর-কিরিবুরু রোড ধরে। প্রায় ৩০ কিমি গাড়ি ছোটার পর দেখলাম দুটি পথ দু'টি দিকে গেছে বেঁকে। আগের দিন বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে ফিরেছিলাম। আজ ডান দিকের রাস্তা ধরলাম। তুলনামূলক ভাল রাস্তা গতকালের চেয়ে। গাড়ি ছুটছে। রাস্তার বাঁদিকে অরণ্যের সবুজ ঢেউ আর ডানদিকে হলুদ। সুরগুঞ্জা(ছোট্ট সূর্যমুখী) ফুলের ক্ষেত। ওপরে শীতকালের ঘন নীল আকাশ...সব মিলিয়ে মিশিয়ে এক অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ(যাকে শব্দে আঁকার ক্ষমতা আমার নেই)।

আমাদের দেখে দু একটি বাচ্চা ছেলে ছুটে এল সঙ্গে খেতের চাষীভাই। ওর হাতে 'মারফি রেডিও ট্রানজিস্টার'।

শ্রুতির স্মৃতি নড়ে ওঠে।

গাড়ি ছুটছে। বাঁকগুলো ছোট হয়ে আসছে; সুতরাং বুঝতে সমস্যা হয় না আমরা খাড়াই পাহাড়ের দিয়ে উঠছি।

চাষী ভাইয়ের হাতে মারফি ট্রানজিস্টার দেখে আমাদের টুকটাক স্মৃতিকথকতা...

বিদ্যুৎদা রসিকতা বলে- 'ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা সকলে ভাল আছ?'

আমরা সকলে মিলে বলি - হ্যাঁ আ আ আ...

স্পন্দন গলা মেলায় কিন্তু ওর চোখ দেখে বুঝি ও হৃদয় মেলাতে পারছে না।

গাড়ি ছুটছে,একটু এগিয়ে একটা কালভার্টের ওপর গাড়ি দাঁড়াল। তলা দিয়ে কোয়েনার জল বইছে। ছেলেরা নদীর(নালা বলা ভাল) জল সামান্য বাড়াল। টুকটাক ছবি উঠল।

বুড়ো বলল- অরিন্দমদা, এ কিন্তু নালা, নদী নয়।

আমি বললাম- ফ্রান্সে এইরকম ছোট ছোট নালাকেই নদী আখ্যা দেয়, আর দুই পার কী সুন্দর সাজানো!

ল্যুজ বল।

- ওমা তাই! বিয়ের আগে অনেক বছর তুমি ফ্রান্সে ছিলে না গো!

- অরিন্দম, ওই সময়ে মার্গারেটের সঙ্গে তোর একটা সম্পর্ক হয়েছিল, তাই না!



হাসির রোল উঠল গাড়িতে। ল্যুজ বল পেলে সকলেই মাথার ওপর দিয়ে ছক্কা হাঁকাবে...হাঁকিয়েছিল।



গাড়ি ছুটছে... ধীরে ধীরে ডানদিকের ক্ষেত-খামার অদৃশ্য হয়ে গেল। দু'পাশেই তখন অরণ্যের প্রাচীর।

বেশ কিছুটা পথ পার হয়ে বাঁ দিকে নজরে এল মাইলস্টোন। আর তাতে লেখা কিরিবুরু ৬০ কি.মি , চাইবাসা, বড়জামদা ৬০ কি.মি।

বড়জামদা ও চাইবাসার রাস্তা বাঁ দিকে ফেলে আমরা ডান দিকে ঘুরে গেলাম।



চাইবাসা যাওয়া হল না তবু বাঁ দিকে তাকিয়ে একবার ডেকে নিলাম...

'অবনী বাড়ি আছো?'



গাড়ি ছুটছে। শাল-মহুয়ার ভিড় বাড়ছে। পাতা ঝরার সময় তখন, তবুও পরজীবী লতাপাতার ঘন বুনট পর্দায় রাস্তায় আলোর জাফরি। গাড়ির স্পীড হাল্কা করে লক্ষ্মণ...বাঁদিকে একটা ভাঙাচোরা সিমেন্টের বসার জায়গা দেখাল। লক্ষ্মণ বলল,

- জানেন, এইখানে হয়েছিল এক বীভৎস খুন।

- খুন তো বীভৎসই হয়, লক্ষ্মণ।

- না! এমন খুন আগে হয়নি এ তল্লাটে।

- কী রকম?

- মঙরা আর সোনারী এইখানে প্রেম করছিল। সোনারীর বর আছে দুটো বাচ্চাও ছিল, তবু শালীর প্রেমের লেশা কাটেক লাই...সোনারীর বাপ এতেয়া এইখানে ওদের দুজনকে টাঙি দিয়ে মাথাটাকে শরীর থেকে ছুটায় দেয়...

মঞ্জুদি আর শাশ্বতী, ' ইস্‌ ! কী হৃদয়হীন' বলে চোখ বন্ধ করে দিল। বিদ্যৎদা আর বুড়ো চুপচাপ।

আমি ঘটনাটা আগেই জানতাম তাই সেই জায়গায় দঁড়িয়ে ঘটনাটা ভিস্যুয়ালাইজ করতে চেষ্টা করি। আপনাদের একটু বলি...

ওদের খুন করে এতেয়া এই রাস্তা ধরে দুটো কাটা মাথাকে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে গিয়ে থানায় আত্মসমর্পন করে। ইচ্ছে করলেই পারত ওখানে ফেলে রেখে যেতে, বাঘ-নেকড়ে খেয়ে নিত। প্রমাণ লোপাট। কিন্তু এতেয়া তা করেনি। ঝুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আর যখন ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তখন নিশ্চয়ই টুপটুপ করে তাজা রক্তের ফোঁটা পড়েছে রাস্তায়...



নাহ্‌ ! এখন রাস্তায় রক্তের দাগ নেই। পরিষ্কার।তবুও বাতাসে কত প্রশ্ন..

হৃদয় বস্তুটি কী? হৃদয় কাদের থাকে?

হৃদয়ের জন্যই কী জীবনভর এত অশান্তি...?

গলায় কাফ সিরাপ ঢাললে এক নিমেষে উত্তর পাওয়া যায়। পেলাম...

হৃদয় শালা এক বর্ণময় শয়তান।



শহুরে বাবু-বিবিদের নিয়ে গাড়ি ছোটে... ৮০ কি.মি পথ উজিয়ে হাজির হই কিরিবুরু চেকপোস্টে।







গল্প - সুজাতা ঘোষ

শিকারের টোপ
সুজাতা ঘোষ



অপরূপ সান্যাল অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরটাকে মেলে দেয় সোফার উপর। স্ত্রী এসে টিভি চালিয়ে চা দিয়ে যায়। অভ্যস্থ হাত অনিচ্ছা সত্বেও চায়ের কাপটা তুলে নেয় মুখের সামনে। চাতে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজটার পাতা অমনযোগী হয়ে ওলটাতে থাকে সে। নানা রকম একঘেয়ে খবর ভেসে উঠছে টিভির পর্দায়। হাতের পাতাগুলো ওলটাতে ওলটাতে তিন নম্বর পাতার ছোট করে লেখা একটা খবর চোখে পড়ে – সুন্দরবনে নদীর পারে একটি বাঘ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। আবার সেই গ্রামেরই গেস্ট হাউসের চৌকিদারের ছেলে নিখোঁজ। ঘটনাটি দুদিন আগে ঘটেছে। পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। এই দুই খবরের ভিতর কোন যোগাযোগ আছে কিনা তাও পুলিশ খতিয়ে দেখছে। অপরূপের হাতের কাপ মুখের সামনে ধরা আছে, চোখের সামনে খবরের কাগজ খোলা। এমন সময় স্ত্রী রশ্মি ঘরে ঢুকে চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে বলল – দেখো, সুন্দরবনের গ্রামে দুদিন আগে বাঘ ঢুকেছিল, তখন তোমরা ওখানে ছিলে না? টিভিতে দেখাচ্ছে, দেখো না ...

অপরূপ নড়েচড়ে বসল। সত্যিই টিভিতে দেখাচ্ছে। প্রচুর লোক জড়ো হয়েছে নদীর ধারে। বাঘটা তখন অবশ্য সেখানে নেই, নিয়ে যাওয়া হয়েছে পরীক্ষা করার জন্য। এরপর আরও অনেক খবর চোখের সামনে নড়াচড়া করেছে, তবে অপরূপ সমানে বাঘ আর চৌকিদারের ছেলের নিখোঁজের যোগাযোগ খুঁজে চলছে মনে মনে। কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছে না।

এখন অনেক রাত, প্রায় পৌনে তিনটে। অপরূপের চোখ দুটো বাক্সে বন্দী ‘মমি’ র মত খোলা। পাশে রশ্মি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ছটফট করতে করতে অপরূপ উঠে গেল রাস্তার দিকের বারান্দায়। এখানে বেশ শান্তি পায় সে। রাতের অন্ধকারে দুয়েকটা গাড়ি, আবার মাঝে মধ্যে লোকজনও চলাফেরা করে। অপরূপ রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ঠাণ্ডা হাওয়া ওর সমস্ত বিক্ষিপ্ত মন আর শরীরকে শান্ত করে দিয়ে যাচ্ছে। ঘুম পাচ্ছে আস্তে আস্তে অপরূপের, চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসছে। সেদিনও তো এরকমই দু চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছিল ঘুমের নেশায়।

অপরূপ আর সন্দীপ, দুজনে বেড়াতে গেছিল সুন্দরবন। অফিসের গেস্ট হাউসে উঠেছিল। দুই রাত আর তিন দিন, বেশ আনন্দের সঙ্গেই কাটিয়েছে ছুটিটা। থাকা খাওয়ার কোন অসুবিধাই হয় নি, চৌকিদার সম্পূর্ন নজর রেখেছিল ওদের আপ্যায়ন করার জন্য। যা কিছু পাওয়া যেত না গেস্ট হাউসে তা সবকিছুই চৌকিদার এনে দিত বাইরে থেকে, ওদের শুধু কষ্ট করে মুখ থেকে অর্ডারটা দিতে হত।

সন্দীপ একটু অন্য ধরনের মানুষ। অপরূপের শান্ত নির্ভেজাল জীবনের সাথে ওর কোন মিলই নেই। সন্দীপ জঙ্গলে ঘুরতে ভালোবাসে, জংলী প্রানী শিকার করে খেতে ভালোবাসে। জংলী মেয়েরা ওর ভীষণ পছন্দের। বলে রাখা ভালো – ওর স্ত্রী স্মিতা উচ্চ শিক্ষিতা, রুচি সম্পন্ন, বেশ আধুনিক। ওরা কি করে যে এত বছর ধরে একসাথে আছে বলা মুশকিল। সন্দীপ সবসময় একা একাই বেড়াতে যায়, ওর নাকি পোষায় না ওর স্ত্রীর সাথে। আর অপরূপ ওর স্ত্রীকে বাদ দিয়ে বাজার করতে যাওয়ার কথাও ভাবতে পারে না। সন্দীপের জোরাজুরিতে একরকম বাধ্য হয়েই প্রায় এসছে সুন্দরবন বেড়াতে। এ একেবারে অন্যরকম অভিজ্ঞতা স্বীকার না করে উপায় নেই। কোন কিছুর সময় ঠিক নেই, কোন পরিকল্পনা নেই, যেমন ইচ্ছা ঘুরে বেড়াও। সেই ইচ্ছাটাও আবার সন্দীপের ইচ্ছা অনুযায়ী। এক কথায় আদিম আনন্দ।

অপরূপের ঘুমের নেশা ভাঙছে আস্তে আস্তে; সেদিন ওখানে কি ছিল? যেটা সন্দীপ বাঘের খাবার বলে ওদের বসার টিলার থেকে বেশ কিছুটা দূরে বেঁধে রেখেছিল অন্ধকারে? ছটফট করছিল নিজেকে ছাড়ানোর জন্য, অপরূপের খুব কষ্ট হচ্ছিল দেখে। সন্দীপ ওকে বলেছিল – চুপচাপ বসে থাক। কথা বললে আমার কন্সেনট্রেশন

নষ্ট হবে। ঐ খাবার খেতে বাঘ আসবে আর আমি তাঁকে এখান থেকে গুলি করে মারব।

অপরূপ আঁতকে উঠে বলেছিল – তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে সন্দীপ! বাঘ মারবে, তোমাকে পুলিশে ধরবে। সন্দীপ বিরক্ত হয়ে বলেছিল – আঃ, চুপ করো তো, শিকার করতে না পারো, অন্তত দেখে আনন্দ নাও। তাছাড়া আমি না মারলে গ্রামের লোকেরা মারবে। তার চেয়ে আমি মারি। অপরূপ আর কোন কথা না বলে চুপচাপ বসে ছিল টিলার উপর। বাঘের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমে চোখ দুটো জড়িয়ে আসছিল ওর। প্রায় ঢুলতে শুরু করেছে এমন সময় একটা অস্বাভাবিক শব্দ আর ধস্তাধস্তির মত নড়াচড়া অপরূপের দুচোখ খুলে দিয়েছিল। কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না তার, ঐ দূরে জলের কাছাকাছি এক মূহুর্তের মধ্যে কি ঘটে গেল। অন্ধকার থাকার জন্যই আরও বেশী করে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর অপরূপ বুঝতে পারল বাঘটাকে সন্দীপ গুলি করেছে, তবে সাইলেন্সার থাকার ফলে ও শব্দটা বুঝতে পারে নি। সামনের দুটো প্রানীই ছটফট করছে। বাঘের পায়ে গুলিটা লেগেছে। বাঘটা পালানোর চেষ্টা করছে আবার শিকারও ফেলে যাবে না। তাই আহত অবস্তাতেই মুখে করে অন্য প্রাণীটাকে টেনে হিঁচড়ে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে।

সন্দীপ টিলা থেকে নামবার উপক্রম করতেই অপরূপ তাঁকে বাঁধা দিয়ে বলে – তোমার কোন কথাই আর আমি শুনব না, তুমি একপাও নামবে না। প্রথমত পায়ে গুলি করেছ, সামনে গেলে তোমাকে ও ছাড়বে না। তোমাকেও টেনে নিয়ে যাবে সাথে। সন্দীপ হাতের বন্দুকটা কাঁধে ঝুলিয়ে কোন উত্তর না দিয়ে অপরূপকে ধাক্কা মেরে নীচে নেমে যায়। অপরূপের সাহস হোল না একা টিলা থেকে নেমে যাওয়ার। এই অবস্তার মধ্যে সে ভয়ে ভয়ে কোনক্রমে টিলার উপর হাঁটুগেরে বসে রইল। ভোরের আবছা আলো ফুটতেই অপরূপ টিলা থেকে নেমে গেস্ট হাউসে ফিরে আসে।

আজ দুপুরেই কোলকাতা ফিরবে ওরা। এখন সকাল সাতটা। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দু-জন মুখোমুখি অথচ কোন ভাষা নেই মুখে। আর ধৈর্য রাখতে না পেরে অপরূপ নিজেই জিজ্ঞাসা করল - কি হোল বাঘটার শেষ পর্যন্ত? চায়ে চুমুক দিয়ে সন্দীপ গলা ঝেড়ে বলল – আমি পৌঁছানোর আগেই ও পালিয়ে গেছে। আমি জঙ্গল, গ্রাম ঘুরে যখন নদীর ধারে ফিরে আসি তখন দেখি ও জল খেতে এসেছে। আর সময় নষ্ট না করে তিনটে গুলি ছুঁড়ে দেই। গুলি খেয়ে বাঘটা একেবারে নীচে নেতিয়ে পড়ে।

অপরূপ কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় চৌকিদার এসে কড়া নাড়ায়, দরজা খোলা ছিল, ভিতরে ডাকতেই চৌকিদার ঢুকে কাঁদো কাঁদো মুখে বলে – বাবু আমার ছেলেটাকে খুঁজতে এসেছিলাম। অন্যদিন এসময়ে চলে আসে। কাল রাত থেকে...... বলতে বলতে চৌকিদার এবারে কেঁদেই ফেলে, বলে – দেখি ছেলে ঘরে নেই। কোথাও নেই, সব জায়গায় খুঁজে এসেছি। অপরূপ উঠে গিয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে বলে – কি বলছ কি? রাত থেকে নেই মানে?

চৌকিদার এবারে কাঁদতে কাঁদতে নীচে বসে পড়ে, নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলে – রাতে দরজা খুলে বাইরে প্রস্রাব করতে গেছিল আর ফেরে নি। সেই থেকেই খুঁজছি বাবু। অপরূপ বেশ চিন্তিত হয়েই বলল, চলো আমি যাব তোমার সঙ্গে খুঁজতে। আর চলো পুলিশেও একটা...

এতক্ষণে সন্দীপ এবারে প্রথম মুখ খুলে বলল – আর পুলিশের কি দরকার, ও হাতের কাছেপিঠেই কোথায়ও আছে। চলে আসবে, তুমি চিন্তা করো না। এবারে অপরূপ বেশ বিরক্তির সঙ্গে বলল – কি বলছ কি? রাত থেকে একটা ছোট্ট বাচ্চা ছেলে উধাও তাকে খুঁজতে হবে না! আর কথা না বাড়িয়ে অপরূপ ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়, চৌকিদারও একবার মুখ কাঁচুমাচু করে সন্দীপের দিকে তাকিয়ে অপরূপের পিছু নিল।

যতটা সম্ভব ঘোরাঘুরি করে ব্যর্থ হয়ে শেষে পুলিশে খবর দিয়ে অপরূপ চলে আসে গেস্ট হাউসে। বেলা বেশ গড়িয়ে গেছে, এখন রওনা না দিলেই নয়। সন্দীপ তাড়াতাড়ি বলল – রাস্তায় খেয়ে নেওয়া যাবেক্ষণ, এখন চলো তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়ি, না হলে দেরী হয়ে যাবে। অপরূপ ক্লান্ত মুখে বলল, না খেয়ে যেতে পারব না। সকাল থেকে কিছু পেটে নেই। একেবারে লাঞ্চ করেই বের হব। বাধ্য হয়ে সন্দীপও লাঞ্চ করার জন্য থেকে গেল।

সারা রাস্তা কোন বিশেষ কথা হয়নি এখনো পর্যন্ত, অনেকটা রাস্তা চলার পর চা খাওয়ার জন্য গাড়ি থামিয়ে সন্দীপ চায়ের দোকানে ঢুকেছে অর্ডার দিতে। অপরূপ নামতে যাবে এমন সময় চায়ের দোকানে চকলেট দেখে ওর মনে পড়ে, সন্দীপ কিছু চকলেট কিনেছিল গতকাল রাতে। সেগুলো কি করেছে? এর আগে কখনও ওকে চকলেট খেতে দেখে নি ও। সন্দীপের কাছে গিয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে অপরূপ জিজ্ঞাসা করে, কালকের অতগুলো চকলেট কি করলে? সঙ্গে সঙ্গে সন্দীপের মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে, চৌকিদারের ছেলেটাকে দিয়েছিলাম।

একটু থেমে আবার অপরূপ বলে, কখন দিলে? ওকে তো রাত থেকেই পাওয়া যাচ্ছে না। এবারে সন্দীপ চায়ের কাপ শক্ত করে ধরে দাঁত চিবিয়ে বলে, রাতেই দিয়েছি। অপরূপ কিছুক্ষণ কিছু একটা চিন্তা করে, তারপর চায়ে চুমুখ দিয়ে গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করে, কত রাতে? কখন দেখা হল ওর সাথে?

সন্দীপ প্রচণ্ড রেগে গিয়ে সোজা অপরূপের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, বাঘ শিকার দেখবে আর টোপ ফেলবে না?

অপরূপের মাথা এক মূহুর্তের জন্য জ্ঞানশূন্য হয়ে গেল। মনে হল ও এই জগতেই নেই। কিছুই মাথায় ঢুকছে না, অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশ। মাথাটা হালকা হয়ে আসছে, পা-দুটো মনে হয় আর শরীরের ওজন নিতে পারবে না। গাড়ির হর্নের শব্দে টনক নড়ল। অনেক কষ্টে পা-দুটোকে টেনে হিঁচড়ে নিজের শরীরটাকে গাড়ির ভিতর নিয়ে গিয়ে ফেলল। আর কোন কথা হয় হয় নি সন্দীপের সাথে সারা রাস্তায়।

ফিরে এসে আজ সকালেই অফিসে ঢোকে দুজনেই। সকাল থেকে এখনো পর্যন্ত কোন কথা বলার ইচ্ছা হয় নি অপরূপের। মানসিক চাপ আর অফিসের কাজ দুয়ে মিলে আজ দিনটা প্রচণ্ড কঠিন মনে হয়েছে।

সন্ধেতে অপরূপ ঘরে ফিরেও স্ত্রীর সাথে তেমন কথা বলে নি। টিভির খবরটা ওর ভিতরটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে সারা রাত। ভালো ঘুম হয় নি। সকালে খবরের কাগজটা ভয়ে ভয়ে হাতে নিয়ে বসে, এমন সময় হঠাৎ ওর দশ বছরের ছেলে প্রীতম দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ঘাড়ের উপর আহ্লাদে।

অপরূপ প্রীতমকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। ওর দুচোখ বেয়ে জলধারা বয়ে যায় ওরই অজান্তে। সেটা কার জন্য? ও ঠিক বুঝতে পারে না, প্রীতমের জন্য, নাকি চৌকিদারের ছেলের জন্য। আরও বেশী করে আঁকড়ে ধরল ছেলেকে বুকের মধ্যে।।

গল্প - মৌ দাশগুপ্তা

মাতৃহীন
মৌ দাশগুপ্তা


সায়কের বাড়ীতে মানুষ বলতে তিনটে প্রাণী। সায়কের বাবা, সৎ মা আর সায়ক। ওর নিজের মা মারা গেছে সে ছোট থাকতে। সাধারণ মৃত্যু না খুন তা সে জানেনা। কিন্তু তার মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবাকে বেশ কিছুদিন জেলে থাকতে হয়েছিল। মামাবাড়ী তার একটা আছে বলে সে কানাঘুষোয় শুনেছে কিন্তু সে বাড়ীতে কে কে থাকে, তা ওর জানা নেই। যেমন জানা নেই সে জায়গাটাই বা কোথায়? পাড়া প্রতিবেশীদের বদান্যতায় ও জানে ওর বাবামায়ের বছর দশেকের বিবাহিত জীবনে বারো ঘর এ উঠানের বাসিন্দা ওর বর্তমান সৎ মাটির অসময় আগমনের কারনেই নাকি আজ ও মাতৃহারা। ওর মায়ের নামও এখন এ বাড়ীতে কেউ নেয় না। একটা ছবি থাকা তো দূর অস্ত। মাকে এখন আর মনে পড়ে না সায়কের। আর মাঝে মধ্যে এই না মনে পড়ার অসহায়তা ওকে হিংস্র করে তোলে। সায়ক তাই তার সৎ মাকে মা ডাকে না। এর জন্য ছোটবেলায় প্রায় প্রত্যেকদিন মার খেতে হত তাকে। এখন ও বড় হয়েছে। তাই সায়কও ভুলে যেতে চায় কিরকম শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে পার হয়েছে তার ছেলেবেলা । এখন ও কলেজে ভতি হয়েছে তাও নিজের টিউশনি পড়ানো আর খবরের কাগজ ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসার কাজটার সুবাদে। পাড়ায় ওর পরিবারের খুব বদনাম, এজন্যই বোধহয় তার স্কুলে পড়াকালীন সহপাঠীরা বা পাড়ার সমবয়সীরা খুব একটা তার সাথে মিশতো না। একটু বোধবুদ্ধি হওয়ার পর সায়কের মনে হয়েছে তার সৎ মা মহিলাটিও খুব একটা সুবিধার নয়। ওনার সম্পর্কে কানাঘুষোয় পাড়া বেপাড়ায় অনেক কথাই এখনো শোনা যায়। ঘৃণায়- লজ্জায় সায়ক আপাতত ঘরের সাথে পাট চুকিয়েই দিয়েছে। সটান মেদিনীপুরের সুতাহাটা ছেড়ে কলকাতার কলেজে ভরতি হয়েছে। থাকেও কলকাতায় মেসে।আসার আগে খালি হাত ছিলো, জীবনে প্রথমবার বাবার মনিব্যাগটা তুলে নিয়ে এসেছিলো সায়ক কিন্তু তার জন্য কোনদিন অনুতাপ হয়নি। আগে অনেকবার চুরি না করেই যখন বাবার হাতে চোরের মার খেয়েছে তখন নালিশকারিনী সৎমার মুখ টেপা হাসিটা মনে পরলেই আর খারাপ লাগতো না ওর। এর মাঝে কেটে গেছে দীর্ঘ একটি বছর।

-তিলু ,তোর কি হয়েছে বল তো? একটা সামান্য ভাগের অঙ্ক করতে কারো এতক্ষণ লাগে?
- ঘুম পাচ্ছে সায়কদা।
- তোর তো পড়তে বসলেই ঢুলুনি লাগে রোজ। নতুন আর কি।
- ঢুলুনি লাগে তো জানি। আগেতো এরকম ঘুম পায় নি কখনো।
- সারা দুপুর বিকেল করিস টা কি? তখন ঘুমাতে পারিস না?

- না, দুপুরে ঘরে কেউ থাকে না তো। ঘুমাবো কি করে? পাহারা দিতে হয় না?

- পাহারা আর তুই? কি পাহারা দিস শুনি? খালি বাজে বকা। মারবো এক থাপ্পড়।

তিলু প্রতিবাদ করে কিছু বলতে গিয়ে দিদির দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। তান্নি আর তিলু, দুজনেই ঘরে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে বসেছে। তিলু সবে ক্লাস ফোর, ওর দিদি তান্নি ক্লাস এইট। তিলুটা পড়াশুনোয় অমনোযোগী, তুলনায় তান্নিটার মাথা খুব পরিস্কার। দুজনকেই একসাথে পড়াতে হচ্ছে বলে কিছুটা সমস্যা হলেও সায়ক মানিয়ে নেয়। কি করবে? এই ক’টা মাত্র টিউশন। দুর্দিনে যা পেয়েছে সেটাই অনেক বেশি। এর ওপরই ওর পড়াশুনো, খাইখরচা, যাতায়াত। মন্দের ভালো যে তান্নির দিকে বেশি মনোযোগ দেয়ার দরকার নেই। ওদের কথার মধ্যেই বাড়ির ভেতর থেকে হঠাৎ চিৎকার আর কান্নার মাঝামাঝি একটা বোবা চিৎকারভেসে এল। প্রায়ইএটা আসে। মনে হচ্ছে বিকৃত গলায় কেউ যেন কাউকে ডাকছে। মা মা বলার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে বাক-প্রতিবন্ধী কেউ আছে এখানে। যে কথা বলতে পারেনা। তিলুর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল, যেন প্রবল অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে। উঠতে চাইছে না। তান্নি কিন্তু ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলল,

- আমি একটু আসছি সায়কদা, বলেই লঘু পায়ে বেরিয়ে গেল।

সায়ক জিজ্ঞাসা করলো,

- তিলু, কে কাঁদছে রে?

- কাঁদছে না, ডাকছে,

- কে ডাকছে? কাকে?

- বলতে মানা আছে।

- কে মানা করেছে?

- বলতে পারবো না।

কথার মাঝে তান্নি ফেরত আসে। হাতে ট্রেতে এককাপ চা আর পকৌড়া। রোজই এই সময় এ বাড়ীর কেউ না কেউ চা আর চায়ের সাথে টা দিয়ে যায়। সায়কের সামনে ট্রেটা নামিয়ে বললো,

- দিদা পাঠিয়ে দিলেন সায়কদা, সেই কলেজ থেকে সিধে এসেছেন। খিদে তো পেয়েছে নিশ্চয়ই।

হাত বাড়িয়ে চা টা নিয়ে সায়ক আবার একই প্রশ্ন করলো,

- কে কাঁদছে রে তান্নি?

তান্নি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভাইকে বললো,

- তোকে দিদা ডাকছে কেন দেখ,

তিলু লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে গেলে সায়কের দিকে না তাকিয়ে নীচু কিন্তু পরিস্কারগলায় তান্নি বলল,

- ও আমার মা সায়কদা, কথা বলতে পারেন না কিনা। বাবা রেললাইনে কাটা পড়ার পর কাউকে চিনতেও পারেননা।

চরম অস্বস্তি সায়ককে ছেঁকে ধরল। প্রশ্নটা করা খুব জরুরী ছিলো কি?

- এ্যাই! মাত্র সওয়া আটটা বাজে, এখনই হাই তুলছিস ক্যানো? বীজগণিতের পাঁচের চ্যাপ্টারের সবগুলো অঙ্ক কষা হলে ছুটী পাবি। এর আগে নো ঘুম। আমিও বসে রইলাম। নে অঙ্ক কর।
- আজ আর ভাল লাগছে না। কাল তো বিজ্ঞান এক্সাম। রিভিশন শেষ করে নিয়েছি তো। আজ একটু গল্প করো না সায়কদা।

- তুই কিন্তু বড্ড ফালতু কথা বলছিস আজকাল । কোথায় পড়ার সময়টা কাজে লাগাবে না শুধু ফাঁকিবাজি।
- কিন্তু আজ আমার পড়তে মন লাগছে না সায়কদা।
- এটা কি কথা হল মিঠু? এখন বাজে রাত সাড়ে আটটা।

মিঠুর মা ঢুকলেন। মাকে দেখেই মিঠু হাসিমুখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।

- আজ আর পড়ব না মামনি প্লীজ। সায়কদাকে বলো না আজ তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে।

ক্লাশ নাইনের তুলনায় মিঠু বেশ লম্বা, বরঞ্চ ওর মা বেশ ছোটখাটো।এখানে ওদের মা ছেলের সম্পর্কটা ভারী ভালো লাগে সায়কের। ও খেয়াল করে দেখেছে মিঠু কিন্তু ওর বাবাকে বেশ সম্ভ্রমভরে দূর থেকে কথা বলে আর যত আবদার ওর মায়ের কাছে। সায়ক এখানে এলে নিজের মায়ের অভাবটা খুব বেশী করে বুঝতে পারে। মিঠুর মা হাসিমুখে ছেলের মাথার চুলটা আদর করে ঘেঁটে দিয়ে বললেন,

- আজ পাগলটাকে না হয় ছেড়েই দাও সায়ক। একবার যখন বলেছে পড়তে মন নেই তখন কিছুতেই পড়াতে পারবে না। তবে মিঠু, কাল এমনটা হবে না তো বাবা? প্রমিস?

- হ্যাঁ মা, প্রমিস।

- আচ্ছা, সায়ক একটু বসো তবে। আজ বাড়ীতে নারায়ন পূজা ছিল কিনা। প্রসাদ এনে দিই। খেতে খেতে একটু গল্প করে নিয়ে তুমিও আজ একটু তাড়াতাড়িই না হয় ছুটী নাও। বলতে বলতে সায়কের মা বেরিয়ে গেলেন।

- আজ কিসের পূজো রে মিঠু?

একটু থমকে গিয়ে বলবে কি বলবে না ভেবে মিয়ানো গলায় মিঠু বললো,

- আজ আমার মায়ের বাৎসরিক ছিল সায়কদা।

- মানে?

- আমার তো নিজের মা নেই সায়কদা। আমার তাকে মনেও পড়ে না। কিন্তু মামনি বলেছে বছরে এই অন্তত একটা দিন আমায় সেই না দেখা মায়ের আত্মার শান্তির জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে। মামনি কিছু বললে কি আমি না শুনে পারি?

নাঃ,এখন না সত্যিই বড় কান্না পাচ্ছে। মায়ের জন্য নয়, সায়কের নিজের জন্য চোখ জলে ভরে উঠছে। বাইরে বুঝি বা অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে , আজকের বৃষ্টিটা বড়ই অদ্ভুত। থামার নামই নিচ্ছেনা। শুধু ঝরেই যাচ্ছে। আর ঘরের ভিতর লুকানো কান্নার চাপা গমকে কেটে যাচ্ছে এক মাতৃহারা সন্তানের জীবনের কয়েকটি সামান্য সময়ের একক।



ধারাবাহিক উপন্যাস - ঐন্দ্রিলা মুখোপাধ্যায়

 ভালোবাসার দিনকাল

ঐন্দ্রিলা মুখোপাধ্যায়






৪.
সন্ধ্যেবেলা শপিং সেরে পিৎজাহাটে চান্দ্রেয়ী, আত্রেয়ী আর ডিংগো ।
ডিংগো : মা রাতের জন্যে আরেকটা পিৎজা নিয়ে নাও না....
চান্দ্রেয়ী: রাতের জন্যে মানে ? এখনই প্রায় ন'টা বাজে , যা খাওয়ার খেয়ে নাও ।বাড়ী গিয়ে আবার কিসের খাওয়া ?
আত্রেয়ী: দিদি বেরিয়ে একটু কুলফি খাব কিন্তু ....আচ্ছা সায়নের শার্টের কালার টা একটু বেশি ডার্ক হয়ে গেলো না?
চান্দ্রেয়ী: না তো ....খুব আনকমন কালার....সবেতে এত কনফিউসড কেন? আর তোর কথায় আমি ওকে যতটা চিনেছি তুই ভালোবেসে দিচ্ছিস, এতেই ও ভীষন খুশি হবে দেখে নিস!
আত্রেয়ী: তাই যদি হবে ,তবে জাম্বোর ব্যাপারে তুই এত কনফিউসড কেন?
চান্দ্রেয়ী: না ঠিক কনফিউসড নয়...একটু বেশি বাছাই করি কারণ তোর জাম্বোর বড় বেশি নাক উঁচু ।
আত্রেয়ী: তাই....তো তুই কি বলতে চাইছিস জাম্বো সাধারণ জিনিসপত্র ব্যবহার করে না?
চান্দ্রেয়ী: না, একেবারেই তা নয়, রাজদ্বীপ অত্যন্ত সাদাসিধে , সপ্রতিভ কিন্তু ও কোয়ালিটিতে বিশ্বাস করে ।

আত্রেয়ীঃ তো, এত কিছু ভাল থাকা সত্ত্বেও, তুই এত হাঁফিয়ে উঠেছিস কেন?আর কেনই বা তোর সাঁঝের ওপর দুর্বলতা বেড়ে, উঠেছে ......এর উত্তরটা আমাকে বল তো শুনি...।
চান্দ্রেয়ীঃ(খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ) ত্রয়ী, তুই ব্যাপারটা অন্য ভাবে নিচ্ছিস ।রাজদ্বীপ আর সাঁঝ দুজনের দুটো ভিন্ন জায়গা।আমার রোজকার জীবনের যে একঘেঁয়েমি .........তার প্রধান কারন হল তোর জাম্বোর না থাকা আর ঠিক ততটাই বৈচিত্রহীনতা হল আমার কিছু না করা ...এরকম একটা জায়গায় থেকে যখন আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছি ,ঠিক সেই সময়ই সাঁঝের চোখে দিয়ে নিজেকে ফিরে পাওয়ার একটা চেষ্টা বলতে পারিস আমার সাঁঝের সাথে এই বন্ধুত্ব ।....হ্যাঁ তুই বলতেই পারিস সাঁঝ আমাকে ভালো বা খারাপ যাই বলুক তাতে আমার কি আসে যায়......ঠিক ,কিন্তু আমার সত্যি জাানতে ইচ্ছা করে এখনো আমার মধ্যে অনুভুতির সুক্ষ্মতাগুলো আদৌ আছে না মরে গেছে ......আর সবচেয়ে বড়ো কথা রোজের কথা বলার এক জন সঙ্গী...আই মিন ধ্যাত ...এত বোঝাচ্ছি কেন বলত ...?
আত্রেয়ীঃআমার ও তো সেই প্রশ্ন ......এতো বোঝাচ্ছিস কেন আর কাকে ?এই কথাগুলো কি আমায় বলছিস নাকি নিজেকে ...?
চান্দ্রেয়ী: তোদের হল ?চল...এবার এখান
থেকে ওঠ ...বেরোব তো ...আর ভাল্লাগছে না।


৫.
বাড়ী ফিরতে ফিরতে প্রায় সাড়ে দশটা বেজেই গেছে ......ডিংগো টি.ভি চালাতে যাচ্ছিল .... চান্দ্রেয়ী বলল " আর টি.ভি নয় ডিংগো...এবার শুয়ে পড় ......।"
চান্দ্রেয়ী চেঞ্জ করে এসে ব্যালকনিতে দাঁড়ায়...তারপর রকিং চেয়ার টা ঘুরিয়ে হাতে মোবাইল টা নিয়ে বসে ......আজ আকাশটা বেশ পরিস্কার ......দক্ষিনের হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ......স্বচ্ছ কালো আকাশের বুকে জোনাকির মত ...টিমটিম করে তারাগুলো জেগে আছে ...দূরে নিয়নের আলোয় মাখামাখি হয়ে আছে শুনশান রাস্তাটা...এক টা কি দুুটো কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে ...একটা রিক্শা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে ..... অদ্ভুত একটা নিশ্তব্দতায় গা ভাসিয়েছে মায়াবীনি কলকাতা ...চান্দ্রেয়ীর চোখ দুটো জুড়িয়ে আসছে ঘুমে... কোলে রাখা ফোনটা ভাইব্রেট করতে থাকে......চান্দ্রেয়ীর ঘুমের রেশটা কেটে যায়......রাজদ্বীপের ফোন .....
চান্দ্রেয়ী: হ্যালো ....বলো
রাজদ্বীপঃ হুম ...কি করা হচ্ছে ?...ওই 'সাস ভি কভি বহু থি ' মার্কা সিরিয়াল দেখছ...? আর এখন থেকেই নিজেকে' ভাবি সাস' বানিয়ে তোলার চেষ্টা করছ নাকি ?
চান্দ্রেয়ীঃ ধ্যাত ....তুমি যে কি বল তুমিই জান ...।
আমরা আজ শপিং এ গিয়েছিলাম ...সায়ন্তন আসছে তো ...।
রবিবার...তুমি চলে এসো কিন্তু শনিবার ... । 
আমি একা আর কতদিক সামলাব বল দেখি ?
রাজদ্বীপঃ পারো তো সবই... তা কি কি কিনলে শুনি ?
চান্দ্রেয়ী: ত্রয়ী তোমার আর সায়ন্তনের জন্যে দুটো শার্ট কিনেছে..... আর আমি ডিংগোকে একটা হাফ জিনস...ত্রয়ীর একটা শিফন শাড়ী....সায়ন্তনের জন্যে পার্ক অ্যাভিনিউয়ের একটা পারফিউম আর শেভিং সেট কিনে দিয়েছি ...।
তুমি রাতে কি খেলে?
রাজদ্বীপ :খেয়েছি ...।
খেয়েছি। গেস্টহাউসের ছেলেটা ভাল রাঁধে ......।
তা তোমার জন্যে কি কিনলে ?
চান্দ্রেয়ীঃ আমি আবার কি কিনব!!!
রাজদ্বীপঃ কেন? তোমার কিছু কিনতে ইচ্ছা করে নি ?আচ্ছা বল তোমার জন্যে কি নিয়ে যাব হায়দ্রাবাদ থেকে ?
চান্দ্রেয়ীঃনা মশাই.... আমার কিছু লাগবে না ...।
 তাও যদি আনতে চাও...।
তোমার যা ভাল লাগে এনো ...।
তুমি তো জানোই তোমার আনা যেকোনো জিনিস আমার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে ।
রাজদ্বীপঃ আচ্ছা সকালে কি যেন বলবে বলছিলে ...।
পরে বলবে বললে ...।
চান্দ্রেয়ীঃ কি বলতো ?ওহো...না সেরকম কিছু না ...।
আসলে মা বাবা নেই আমরাই তো ত্রয়ীর সব তাই না......তোমার দায়িত্ব অনেক !
রাজদ্বীপঃ সেটাও কি তোমায় বলতে হবে দয়ি ...।
আচ্ছা বল সাঁঝের সাথে কি গল্প করলে কদিন...?
চান্দ্রেয়ীঃ কথা সেরকম হচ্ছে কই? ডিংগোতো ল্যাপটপ ছাড়েই না...কাল রাত জেগে গল্পের বই পড়েছে তাই দুপুরে ঘুমচ্ছিল বলে...আমি একটু বসেছিলাম আর কি...তুমি কি রাগ করলে...?
রাজদ্বীপঃ আমার রাগের কি আছে ...তবে কি জানো তো তুমি তো সরল মনে সব বলছ কিন্তু বেসিক্যালি যারা এরকম চ্যাটিং করে তারা সবসময় সত্যি পরিচয় দেয় না...তার ওপর আবার একঘেঁয়েমি লাগলে বেশি দিন চালায়ও না....মাঝখান থেকে একটা ইমোশানাল অ্যাটাচমেন্টে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়....যাক ছাড়ো....বেশি রাত জেগো না....শুয়ে পড়....ঠিক আছে মাই কিউটিপাই.....
চান্দ্রেয়ী: তুমি আগে ফিরতে পারবে না ,না?আমার একা একা ভালো লাগে না একদম.....(চান্দ্রেয়ীর গলাটা কেমন যেন বুজে আসছিল....)
রাজদ্বীপ: প্লিজ দয়ি....এভাবে বলো না....ছেলেমানুষের মতো কথা বলছ....আমারও কি ভালো লাগে তোমাকে ছেড়ে ছেড়ে থাকতে ?....একটু হাসো....শনিবার গিয়ে সব ইন্টারেস্ট পে করে দেব....ঠিক আছে ??....যাও ঘুমিয়ে পড়ো.....
চান্দ্রেয়ী : হ্যাঁ ....ঠিক আছে....সাবধানে থেকো....বাই.... গুড নাইট ।
রাজদ্বীপ: গুড নাইট


৬.
চান্দ্রেয়ী মোবাইলটা অফ করে ঘরে আসে...।
ডিংগো খাটে শুয়ে আছে...হাতে ভিডিও গেম...।
ডিংগো এ কদিন মায়ের সাথে শুচ্ছে ...।
ও জানে বাবা আসলে ওর আর মায়ের কাছে শোওয়া হবে না.. চান্দ্রেয়ী ডিংগোর পাশে বসে বলে 'কি...ঘুম আসছে না?'
ডিংগো মাকে জড়িয়ে ধরে ...' মাম্মা জানো..এবার আমার বেস্ট ফ্রেন্ড পাল্টে গেছে....আগে মৈনাক ছিলো ...এখন বিনীত হয়েছে ...মৈনাকের সাথে একদিন খুব ফাইট হয়েছে '
চান্দ্রেয়ী : সেকি তোরা ওখানে মারপিঠ করিস....ফাদার ড্যানিয়েল কিছু বলেন না...!!!.আচ্ছা তোর ওখানে আমাদের জন্যে মনখারাপ করে না....'!!!
ডিংগো: আগে করত...এখন করে না...জান ,আমি টেবিল টেনিস শিখছি,...এবার ম্যাথে হাইয়েস্ট স্কোর করেছি ....
চান্দ্রেয়ী ডিংগোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে' অনেক রাত হল ডিংগো....এবার শুয়ে পড়...কাল অনেক কাজ.... ।'
...ওরা দুজনে শুয়ে পড়ে....নাইট ল্যাম্পের নীল আলোয় গোটা ঘরটার যেন এক শান্ত সমাহিত রূপ....কিন্তু চান্দ্রেয়ীর মনে শান্তি কোথায় ....তার এতবছরের সিস্টেমেটিক লাইফে কোথা দিয়ে যেন ঢুকে পড়েছে ,সাঁঝ ।তার তো আগে কখনো মনে হয়নি ...রাজদ্বীপ তাকে অবহেলা করেছে...নিজেকে নিয়েই শুধু ব্যাস্ত থেকেছে....তবে আজ কেন তার এমন মনে হচ্ছে....আজ কেন হঠাৎ সাঁঝ তার এত বেশি বন্ধু হয়ে উঠেছে ....কেন আজ সাঁঝের কথা মনে করতেই তার বেশি ভালো লাগে....আর কেনই বা সে সারাটা দিন সাঁঝের মধ্যেই ডুবে থাকে....কেন? কেন? কেন?....কি বলে এই ভাবনাটাকে? ...কে বলে দেবে এর সদুত্তর!!!
....চান্দ্রেয়ী ভাবে, যদি সত্যিই সাঁঝ কোনদিন কলকাতায় আসে ...আর চান্দ্রেয়ীর সাথে দেখা করতে চায়?....ও কি দেখা করবে?...বুকের ভেতরে যেন দামামা বাজতে থাকে ।....একটা শিহরণ অনুভব করে...আচ্ছা এই যে ও দিনের পরদিন সাঁঝের সাথে গল্প করছে ....কেন করছে? শুধুই কি ভালো লাগা ? একটা নেশা....কিন্তু কেন ?...তার অনুভূতির সাথে আপোষ করতে হয় না বলে? ....তাহলে কি তার এতবছরের জীবনে সে কি শুধু আপোষ ই করে এসেছে?....ভালোবাসা বলে কিছু ছিল না?....তার যদি এই বয়সে এসে এরকম ওলোট পালোট হয়.....আর সাঁঝ তো একটা ছেলে....তাহলে কি চান্দ্রেয়ী সাঁঝের ইমোশন নিয়ে নিজের অজান্তেই খেলছে????...উফফ একটা সজোরে ধাক্কা খেলো যেন চান্দ্রেয়ী !!!!....একটা দীর্ঘশ্বাস ...আর নিতে পারছে না ....কি সব ভাবছে..চোখটা বুজে ফেলে সে...ভাবে সম্পর্কের নাম দেওয়াটা কি এতটাই জরুরী ...নাই বা রইল কোনো সম্পর্ক কিংবা পুরোটাই মানবিক সম্পর্ক .....মনের ভেতরটা উথালপাতাল করে উঠল....আর তার মন্থনে একঘড়া কান্না উপচে উঠল ...বিছানায় উঠে বসল চান্দ্রেয়ী....টেবিল ল্যাম্পটা জ্বাললো....সাইড টেবিল থেকে জল নিয়ে খেলো......ঘড়িতে কটা বাজে দেখল....নাঃ একটু ঘুমোনো দরকার কাল অনেক কাজ আছে...কিন্তু তার শান্তির ঘুমটা যে চুরি হয়ে গেছে... নাঃ সাঁঝকে এড়িয়ে চলতে হবে যত কষ্টই হোক....এতেই সবার ভালো । এবার তার চোখের জল আর বাঁধ মানলো না...এই উপলব্ধি তার একান্তই নিজের ...এই কথাগুলো সে সাঁঝকেও বলতে পারবে না....রাজদ্বীপকে তো নয়ই.... ।


৭.
সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু বেলাই হল চান্দ্রেয়ীর ।ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ এসে দেখল আত্রেয়ী আজ চা বানিয়ে রেডি....দুজনে একসাথে চা নিয়ে বসল....সারাদিনের প্ল্যান ডিসকাশন হল...আজ সারাদিন অনেক কাজ....ঝাড়াঝুড়ি,পর্দা পাল্টানো....শেল্ফ গোছানো, বাগানের আর ব্যালকনির গাছ গুলোকে একটু কেটে ছেঁটে ঠিক করা....চান্দ্রেয়ী আর আত্রেয়ী কাজ গুলোকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিল..
সন্ধ্যেবেলা একবার বেরিয়ে সে ফ্লরিস্টকে অর্ডার করে আসে ....কেক আর কনফেকশনারীর অর্ডার দেয় মনজিনিসে.....নতুন টেবিল ম্যাট কিনে আনে...টেবিল সাজানোর ব্যাপারে সে আবার ভীষণ খুঁতখুঁতে... ...সারাদিন এইভাবে নিজেকে কাজে ভীষন ব্যস্ত রেখে সে সাঁঝকে ভুলে থাকতে চেষ্টা করে.............বাড়ি ফিরে আসার পর দেখল বিন্দু রান্না করতে আসেনি....অন্যদিন হলে চান্দ্রেয়ী ভীষন রেগে যেত....আজ কিন্তু সে ভাবল....ভালোই হয়েছে ডিংগো বাড়ি এসেছে কদিন....নিজে রেঁধে ওকে কিছু খাওয়ানোই হয়নি .....ছেলেটা আবার নর্থ ইন্ডিয়ান ফুড খেতে খুব ভালোবাসে ....তাই চান্দ্রেয়ী ডিনারে রাজমা , পালক পনীর আর পরোটা বানায়....
.....রাত্রে ত্রয়ী আসে দিদির সাথে একটু কথা বলতে ....দুইবোনে ছোটবেলার অনেক গল্প ডিংগোকে শোনায় ....এত হৈ চৈ এর মাঝে মাঝেও কিন্তু চান্দ্রেয়ী কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়....কেমন যেন তাল কেটে যায়....সবার মাঝে থেকেও সে এই নিখাদ আনন্দের স্বাদটা চেটেপুটে নিতেও পারে না....কিন্তু সে বদ্ধ পরিকর ....এখন কিছু দিন সে কোনোভাবেই সাঁঝের সাথে যোগাযোগ করবে না....এই মোহটা কাটাতেই হবে....
এইভাবে চান্দ্রেয়ী পরেরদিনটাও কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করে ।....সকাল থেকে ঘর সাজায়....ইকেবানা তৈরি করে....বেলায় ব্যাঙ্কের কাজে বেরোয়.... ।
....সন্ধ্যেবেলা ডিংগোর কলকাতায় স্কুলে পড়াকালীন বেস্ট ফ্রেন্ড অনীশের বাড়িতে নিমন্ত্রণে নিয়ে যায় ডিংগোকে....বেশ লাগে চান্দ্রেয়ীর...হাসি মজা গল্পে অনেকটা সময় কেটে যায়....
......ফেরার পথে চান্দ্রেয়ী ভাবে...একা থাকলেই তো যত সমস্যা ....মনটা ছটফট করে...রাতে বরং ত্রয়ীকে ডেকে নেবে...আজ রাতে একসাথে তিনজনে শোবে.... গতকালের মত গল্প করে কাটিয়ে দেবে....আর আগামী কাল তো শনিবার....সকালে তো তার অনেক কাজ....রবিবারের রান্নার জোগাড় ....চিকেন ম্যারিনেশন....কাজুর পেস্ট বানানো....পুদিনার চাটনি....হাঙ্গ কার্ড প্রসেস...আরও কত কি..!!! আর রাতের ফ্লাইটে তো রাজদ্বীপ এসেই যাবে.....এবার সে সব ভাবনা তাকেই দিয়ে দেবে.....আর না অনেক হয়েছে ....আর সে নিজেকে হারিয়ে যেতে দেবেনা....রাজদ্বীপকে নতুন করে আঁকড়ে ধরবে....নতুন ভাবে ভালোবাসায় রাজদ্বীপের সব অভিমান ভাঙিয়ে দেবে....মনের সবটুকু জুড়ে থাকবে তার জীবনের সামতলিক ক্ষেত্রটা....আর সে নিজের আইডেন্টিটি বাইরে খুঁজতে যাবে না ....ডিংগোর মাম্মা...মিসেস রাজদ্বীপ এর মাঝেই সে নিরাপদ ...এর মাঝেই সে আবদ্ধ থাকবে.....বাড়ির গেটের কাছে গাড়ী এসে থেমে যায়.... ।


৮.
শনিবার দুপুরবেলা....তিনজনে একসাথে লাঞ্চ করল...আজ ত্রয়ীর কোথাও বেরোনো নেই...যদিও থিসিসের জন্যে প্রফেসর অখিলেশ সান্যালের বাড়িতে যায় কিন্তু আজ যাবে না আগে থেকেই বলে এসেছিল....খাওয়া শেষ হতেই চান্দ্রেয়ী বলল' আজ ভীষন ক্লান্ত লাগছে ত্রয়ী ...আমি একটু শুয়ে নি....চারটে নাগাদ মিসেস রায় ফোন করবেন...ওনার এনজিও র ব্যাপারে ....ভাবছি রাজদ্বীপ এলে এবার সিরিয়াসলি কিছু করার কথা বলব...ল্যান্ডলাইনে ফোন করবেন...ঘুমিয়ে গেলে একটু ডেকে দিস'....
ত্রয়ী আর ডিংগো খুব মনোযোগ দিয়ে ফিয়ার ফাইল'সের রিপিট টেলিকাস্ট দেখছিল....ত্রয়ী বলল...'হুম...ডেকে দেব তুই যা রেস্ট নে'...
চান্দ্রেয়ী ঘরে এসে বিছানায় একটু শুতে যায়...ডিংগো খাটের ওপর ল্যাপটপটা ফেলে রেখেছে ...সরিয়ে রেখে শুয়ে পড়ে....ভাবে দুদিন ওটাকে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেনি....চোখ দুটো জুড়ে আসছে....একটা ঘুম ঘুম ভাব....একটা নিস্তব্ধতা....সেই নৈঃশব্ধতা ভেদ করে একটা মেটালিক সাউন্ড.....বিপ্ বিপ্...বিপ্ বিপ্...এটা কোথায়...দেখে তো মনে হচ্ছে ...একটা আই সি সি ইউ...কেউ কাঁদছে ...সামনে কে শুয়ে আছে...আরে ওই তো রাজদ্বীপ...চান্দ্রেয়ী বুঝতে পারছে না কেন সে এখানে....রাজদ্বীপ ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে 'যাও....সাঁঝ ডাকছে....ওর গাড়ীটা স্কিড করে...' ও ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সাঁঝকে দেখতে... সাদা চাদরে ঢাকা একটা মানুষ বিছানায় শুয়ে..মুখে অক্সিজেন মাস্ক...মনিটারিং চলছে....ওর দিকে হাত বাড়িয়ে আছে...চান্দ্রেয়ী হাতটা বাড়াতে যায় কিন্তু .... পাশ থেকে কে একটা ওর হাত ধরে নাড়ছে আর বলছে ' পেন ড্রাইভটা কই....কি গো কোথায় সরালে.........এই তো খাটে ছিল....পেন ড্রাইভটা কোথায় রাখলে মাম্মা....?'....চান্দ্রেয়ীর স্বপ্নের ঘোরটা কেটে যায়....ধড়ফড় করে উঠে বসে...একটু ধাতস্থ হয়ে ভাবে...উফ এটা স্বপ্ন ছিল? ইস্ কি সব দেখছিল...ডিংগো কে একটু ধমকেই বলে ওঠে...আমি বললাম তো একটু রেস্ট নিতে দে আমাকে...আর এভাবে কাউকে ঘুমের মধ্যে ডাকে ?...যাও নীচে যাও....সারাদিন খালি গেম গেম আর গেম....' ...ডিংগো 'সরি মাম্মা' বলে নেমে যায়...
চান্দ্রেয়ী আর ধৈর্য রাখতে না পেরে...ল্যাপটপ খোলে......ডিরেক্ট ফেসবুকে না গিয়ে ...মেলগুলো চেক করে...দেখে অচীন পাখি প্রোফাইল থেকে মোটে একটা মেসেজ....একটু অবাক লাগে চান্দ্রেয়ীর...এই দুদিনে সাঁঝের মোটে একটা মেসেজ ??...মেলটা খোলে...লেখা ' প্লিজ কল....9830046586...ইট'স ভেরি আরজেন্ট....' আজ বেলা দশটায় এসেছে মেসেজটা....চান্দ্রেয়ীর মনের মধ্যে সব জট পাকিয়ে যায়..'.কি এমন প্রবলেম হতে পারে'....এটা ভাবতে গিয়ে স্বপ্নটার কথা মনে হয়...হঠাৎ একটা প্রবল অপরাধ বোধ কাজ করে....কিছু হয়নি তো সাঁঝের....???..ও তো সব বলেই বন্ধ করতে পারতো গল্প করাটা...আর বেশি কিছু না ভেবে ফোন নাম্বারটা ডায়াল করে.....
রিং হচ্ছে....ও প্রান্তে
হ্যালো....
চান্দ্রেয়ী...একটু চুপ থেকে 'হ্যালো আমি ...আমি দয়িতা বলছি...'
ওহো....হাও আর ইউ ম্যাম...কখন মেল পাঠিয়েছি....আর কখন ফোন করছিস বলতো দয়ি...
ইউ...ইউ মিন সাঁঝ????.
ইয়েস....বল কোথায় দেখা করব??
মানে ...তুই কোথায় ??
আই অ্যাম ইন কলকাতা ডিয়ার....বল তোর বাড়ি কোথায় এগজ্যাক্টলি ...আমি আজই দেখা করব....আর এই সারপ্রাইজটা দেব বলেই দুদিন কোনো মেসেজ করি নি'
আমার কেমন একটা হচ্ছে ...ভীষণ আনইজি লাগছে সাঁঝ...
কেন দয়ি আমরা কি দেখা করতে পারিনা....?...বাড়িতে অসুবিধে হলে বাইরে দেখা করি...তুই বল কোথায় হলে তোর সুবিধে ?
বেশি ভেবে কাজ নেই...তুই সায়েন্স সিটির উল্টো দিকে মিলন মেলায় ক্র্যাফ্ট ফেয়ার চলছে ...ওখানে আয়...বাই দ্য ওয়ে তুই কতদূরে....
আমি নর্থ এ...শোন না এখন ৩:২০...তুই সাড়ে চারটেয় চলে আয় ....মিলন মেলার সামনের গেটে ....আমি নাইকের ইয়ালো টিশার্ট ...ব্লু ডেনিম জিনস...
নর্থে কোথায়....??
বেলেঘাটায়...
কোথায়??...হ্যালো...হ্যালো
লাইনটা কেটে যায়....ফোনটা ছেড়ে চান্দ্রেয়ী ঘড়িটা দেখে...চোখটা বুজে একটু ভাবতে চেষ্টা করে....চান্দ্রেয়ীর সব বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে ...তার ভীষন অস্থির লাগছে....সেই জয় গোস্বামীর কবিতার মত তার 'তখন বুকের মধ্যে কাঁসর ঘন্টা শাঁখের উলু/একশো বনের বাতাস এসে একটা গাছে হুলুস্থূল' অবস্থা ।তার সব কাজ এবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ...কুশন কভার পাল্টানো......কার্পেট পাতা...ইনডোর প্ল্যান্ট চেঞ্জ করা....সব ...সব কেমন যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে ...মনে হচ্ছে সেই প্রথম রাজদ্বীপের সাথে দেখা হওয়ার কথা....নীচে ল্যান্ড লাইনটা বাজছে...ফোনের শব্দটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে ...কর্ডলেসটা হাতে নিয়ে ত্রয়ী চান্দ্রেয়ীকে দিতে যায় ...'দিদি ফোন....মিসেস রায় বোধহয়
চান্দ্রেয়ী বলে...'বলে দে আমি বেরিয়ে গেছি....আমি পরে ফোন করে নেব...'
ত্রয়ী ফোনটা ধরে কথা বলতে বলতে একটু অবাক হয়ে নীচে নেমে যায়....
....হাতে সময় কম....চান্দ্রেয়ী চোখে মুখে জল দেয়....ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে ...আলমারী থেকে একটা হালকা ভায়লেট আর ক্রীম কম্বিনেশনের শিফন শাড়ি বার করে পরে....খোলা চুলে হালকা একটু ব্রাশ করে... ঠোঁটে গ্রেপওয়াইন কালার লিপস্টিক....একটু পারফিউম...ব্যাগে সানগ্লাস পার্স চাবি মোবাইল সব রেখে পার্ল টপ আর পেনডেন্ট টা পরতে গিয়ে ড্রয়ারে খুঁজে পেল না....ওহো ওটাতো সেদিন ত্রয়ী পড়েছিল ...তাই ত্রয়ীর ঘরে আনতে যায় চান্দ্রেয়ী...পার্ল সেট পরে ত্রয়ীর ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে ...বেরোতে যাচ্ছে দেখে ত্রয়ীর মোবাইলটা বাজছে রিডিং টেবিলের ওপর....চান্দ্রেয়ী চেঁচিয়ে ডাকে....'ফোনটা ধর ত্রয়ী...' কোনো সাড়া নেই....টেবিলের সামনে এগিয়ে ফোনটা ধরবে কিনা একটু ইতস্তত করে.... মোবাইল স্ক্রীনে সায়ন কলিং দেখে...একটু হেসে .......চান্দ্রেয়ী ভাবে আজকে কথাটা হয়েই যাবে....ফোনের সুইচ ওকে করে.....
হ্যালো জিনা...বলোতো কোথায়?
চান্দ্রেয়ী চুপ...
হ্যালো জিনা.....আমি বেলেঘাটায় পিসির বাড়ী...আজ সকালেই পৌঁছেছি...রাগ করেছো ফোন ধরিনি বলে...হ্যালো ..হ্যালো....
চান্দ্রেয়ী লাইনটা কেটে দেয়....
জিনা-কলকাতা-বেলেঘাটা-অস্ট্রেলিয়া-সায়ন-সাঁঝ.....চান্দ্রেয়ীর মাথাটা ঘুরছিল...হ্যাঁ একই ফোন নাম্বার...একই কন্ঠস্বর একটু আগেই কথা বলেছে.....ও এতদিন কার সাথে কথা বলেছে....বেলেঘাটা টা শুনেই কেমন যেন একটু অস্বস্তি হচ্ছিল আর এখন তো আর .....
ঠিক সাঁঝই সায়ন .....!!!
চান্দ্রেয়ী ঘরে আসে....কেমন যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়..এই প্রথম তার ছোটো বোনকে তার একটু হিংসে হতে থাকে....দক্ষিণের জানলার পাশে এসে বসে....মনে করতে থাকে...কেমনভাবে ত্রয়ী তাকে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল....আর কিছু বন্ধুকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল....তার কিছুদিন পর একটা খাঁচাবন্দী পাখির ছবির প্রোফাইল নেম অচীন পাখি দেখে আর ত্রয়ীর মিউচুয়াল ফ্রেন্ড দেখে রিকোয়েস্ট পাঠায়....সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকসেপ্ট হয়ে যায়....অনলাইন দেখতে পেয়ে কথা শুরু ।
হাই
আমি অচীন পাখি
অচীন পাখি কারো নাম হয়নাকি?
না..তোমার নাম দয়িতা?..
.দয়িতা নামের মানে কি?
আগে তোমার নাম বল...
ওকে ...সাঁঝ ধরে নাও
তোমার ছবি নেই কেন?
তোমারও তো নেই....
.........
এইভাবে গল্প এগিয়ে গেছে নাম আর ছবি সব কিছু ছাপিয়ে.....ধীরে ধীরে তুমি থেকে তুই.....
.....কি ভুলটাই না চান্দ্রেয়ী করেছে.....তার দুচোখে জল থই থই করতে থাকে....সময় গড়িয়ে যায়....মোবাইল টা বাজতে থাকে...সাঁঝ থুড়ি সায়নের ফোন....অসহ্য লাগছে রিংটোন টা.....চান্দ্রেয়ী ফোনটা কেটে দেয়...আবার রিং হতে থাকে....এবার চান্দ্রেয়ী ফোনটা সুইচ অফ করে দেয়.....তার গলাটা কান্নায় বুজে আসছে....একটা বালিশ নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে....এমনিতেই একটা মিশ্র অনুভূতি ছিল এই দেখা করতে যাওয়ায় তার ওপর এই ধাক্কা ....চান্দ্রেয়ী বালিশে মুখ গুজে কাঁদতে থাকে..বাইরে আকাশটা লাল হয়ে আছে....চান্দ্রেয়ী ভাবে এই ভালোলাগাটার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল একটা প্রশ্ন ....এর শেষ কোথায় ??....কোনো শেষ নেই কিংবা দেখা হলেই শেষ....তার চেয়ে এই ভালো....ওর কান্নাটা বের হওয়ার দরকার আছে....ও বড় বিভ্রান্ত...ওর সমস্ত উন্মাদনা উত্তেজনা একমুহূর্তে যে শেষ হয়ে গেছে আজ...কিন্তু কাল তো ওকে এই সায়নের জন্যেই খাবার বানাতে হবে...টেবিল সাজাতে হবে.....ত্রয়ীর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে হবে....কিন্তু কাউকে বুঝতে দেওয়া চলবে না যে সেই দয়িতা...সাঁঝের দয়িতা....যার সাথে যোগাযোগ করার জন্যে সাঁঝ পাগলের মত ফোনে চেষ্টা করে যাচ্ছে আর ফোন কানে দিলেই শুনছে....
দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড ইজ সুইচড অফ নাও...প্লিজ ডায়াল আফটার সামটাইম...

গুচ্ছ কবিতা - বিনু মাহ্‌বুবা






মেঘের উৎপাত বিনু মাহ্‌বুবা


ঘুমের পাশে এই তো চুপ করে বসে আছি,
দিগন্তে অনিবার্য মেঘের উৎপাত,
রাতের রেলিং-এ জামদানী কারুকাজ,
মেঘলা রঙের জমিন, অন্ধকারের পাড় বোনা ।
সকাল হতেই বকুল গন্ধে উন্মনা মন,
টুকিটাকি হারানো জিনিস খুঁজে খুঁজে উচাটন-অকারণ,
তুমি-ই কি জানো, কি তোমার প্রয়োজন? জেনেছো তো ঠিক ?
তুমি কি জানো, মধ্যরাতে মুষলধারে বৃষ্টি ভাসে,
তোমার কন্ঠ তখন রেশমের মতো নেমে আসে-
অগণন ভালোবাসায় ভেসে যায় মনো জমি।


নিঃশব্দ রাত্রির গান 

চিঠির গায়ে ধূলো জমেছে ,
হাওয়া এসে আলো নেভানো রাতে

ঠিকানা খুঁজছে এলোমেলো পায়ে।
ঠিক দেখেছি, টিক টিক শব্দে
ঘড়িটা বলছে, রাত হয়েছে, রাত!
কিন্তু কিছুতেই ঘুমোতে পারছিনা এই আমি !
যদি ও আকাশে তুলকালাম মেঘের ঘনঘটা নেই,
নেই বৃষ্টির আভাস ,
জ্যোৎস্না আছে তাও বলা যাবেনা,
কারণ,এখন অমাবস্যা রাত।
কিছুই ভোলায়না , টানে না ,
এ কেমন অভিসম্পাত!
তবে কি অলৌকিক দাহ !
পাহাড়ের চুড়ায়
সূর্যাস্তের আরশি ভেঙে সোনা রঙ থমকে নিঃশেষ।



বড় বেশী কুন্ঠিত থাকি

বড় বেশী কুন্ঠিত থাকি, তবু সাজ হয়না !
ইদানিং বড় কুন্ঠিত থাকি এই আমি ,
হৃদয়ের নুড়িপাথর গুলো নাড়া দিলে বেসুর বাজে,
জ্যান্ত জোনাক মৃত দেখি ,
অসময়ে কাজল ল্যাপটে যায় ব্যাভিচারি রাজনীতিকদের মতো
"ভুমি"র টাইম নেই দাদা শুনতে এখন,
আর ভাল্লাগেনা।
পথের দু'ধারের যতো ফুল ,
বর্ণহীন,গন্ধহীন, পিঙ্গল লাগে ,
বিপুল বিভ্রম হয় জন্ডিস আলোয় ,
দিবসের কোনো সমাবেশে আগ্রহ আসেনা আর ।

গুচ্ছ কবিতা - বেবী সাউ



প্রবাসী
বেবী সাউ



তুই পা বাড়ালি ,
কেউ পেছন ডাকলো না
নাকি থেকে যাওয়ার কথা ...



স্যালাইনের বোতল
আর কিছু জ্বরগন্ধ সূচ পড়ে থাকল ,
একা নার্সের সাদা রঙ দেখে রঙেরা সরে গেল ,
দূরে খালি স্থান জুড়ে বসে গেল পিঁপড়ের সারি ,
মুখে ডিম
তুই চলে গেলি , কেউ কাঁদলও না



সফর



এরপরেও সে ভাবাচ্ছে আমায়
কিছু অস্পষ্ট আলো ,
কিছু সমান্তরাল বক্ররেখা ছাড়া
এ মূহূর্তে যদিও আর কোন বিলাসিতা নেই
পাঁচিলের ওপাশে শিরীষ গন্ধ
নিমগাছে ডানাভেজা কাক
ভাবতে ভাবতে
সূর্যাস্ত
আর
আমার সময় শেষ ছাতিমতলায় !




কবিতা - রক্তিম জয়



যা জীবনান্ত ছায়া নিয়ে ছেয়ে আছে
রক্তিম জয়



দরজা বিহীন একটা ঘরের সামনে দাড়িয়ে; অবিরত প্রার্থনা,
দরজা খুলে কেউ আসবেই!!
একটু আগে আগুনের উত্তাপ হারিয়ে বসে ছিলাম--কি বিমর্ষ সেই খোঁজা-খুঁজি
আমাকে কে যেন প্যাকেট ভর্তি মৃত্যু উপাহার দিয়ে গেল।

সারা ঘরে ঘরে
রং হীন ছবির নাচ।।
কাগজ আর কলম অপেক্ষায়
নতুন কবিতার।


সারাটা সময় তোমাকে বুকে করে জীবন
কি কুৎসিত সুন্দর এক মানুষের শেষ হয়ে যাওয়া দেখলাম।।
আলো, তুমি কি অধরা, অস্পষ্ট

এই অন্ধকারে' বিকশিত হয়েই চলছো,
জানালার মুখ চিড়ে বৃষ্টির আগমন, সেই অস্পষ্টতায়!!

চামড়ার চিঠি লিখে জানিয়ে দিতে হয়—

কোন শহরকে, কেউ ভাল আছে, কেউ নেই
ঘুম হীন চোখে তুমি ও জেগে আছো এই রাত,
আজ বুকে নিয়ে ঐ দূ-র আকাশের নগ্নতার ক্রন্দনে।।

ভগবান ভীত হয়ো না
তোমার কোলেও সন্তান জন্ম নেবে
তোমাকে আর কেউ ঘেন্না- করবে না,
মানুষের ভাগ্যের মত।।

দুর্নিবার বজ্র পথচলা
যেমন কবি চলে যায়
তুমি ও পারবে- হ্যাঁ
অভিশাপ- সেই শুভ কামনার,
নারকীয় অভিশাপ তোমাকে দিলাম।।

কে বেরিয়ে আসলো, দরজা খুলে!! কে তুমি
কি আশ্চর্য! অবিকল যেন আমি- এখানে কি ঘর ছিল?
নাকি ভুল ছিল আমার সাধনা!!
কে তুমি!! আমার ছায়া নিয়ে করেছিলে খেলা?


কবিতা - সুমন কুমার সাহু

মুক্তির চেতনাসুমন কুমার সাহু

জল স্থল আকাশে
নিঃশ্বাস স্বপ্নের মোড়কে,

ভালোবাসা বিশ্বাসে
আশ্বাস জীবনের সড়কে,

ঢেউ তোলে ,হাল ধরে,পাখামেলে,
লিখে চলে দিতে কবিতা তোমাকে।

গভীর ঘুমের আগে,
শুধু একবার শোনাও পড়ে
এ জীবনের কথা কবিতার ঢঙে,
শোনাও আমাকে।

ছ্ন্দ মেশাই স্পন্দনে,
আমি এক অদ্ভুত কবি,
সব কবিতাই তোমাকে
এ জীবনের কথা আর ছবি।

যত মায়াজাল
আসুক নেবে
তোমায় আমি ভুলছিনে
চোখের নোনতা জিভে মুছে।

মুষ্টিবদ্ধ হাতে
ফেটেপড়ি চিত্কারে।

নিষ্ঠুর নিয়তি ভেঙে
পিপিলিকা যাক উড়ে।

কবিতা - অশোক মল্লিক



যদি করে থাকি ভুল অশোক মল্লিক



ক্ষমা কর মোরে যদি করে থাকি ভুল
কষ্ট দিয়েছি যত পার দিতে ফিরিয়ে |
তবুও বলব ঐ নিরব দৃষ্টিতে,আছে
সব কিছু ধ্বংস বা সৃষ্টি----
স্বপ্নের লুকোচুরি হয়েছে যে শেষ,
অপেক্ষা শুধু ফাৎনাটা ডোবার |
বাতাসের আর্দ্রতা আর করুন আলো


ঢেকে দেয় কুআশার চাদর মুড়ে |
জানি পালাতে দেবেনা আমায়,
পড়ে আছি মাটিতে নিরুপায় |
দুহাতে ভোরে তুলি কালি বালি
ফেলে দিয় ছুড়ে স্বপ্ন আশা বিবেক,
সবুজ পাতার ফিকে আলো মলিন,
আজ তাই ফিরে যায় খালি দুহাত |
কাঠের আগুনে নাড়া দিয়না তুমি
নিভে যাবে তাড়াতাড়ি হয়ে কালো |
ঘাসের হলুদ পাতা নীল নিশ্বাস নেয় ,
অব্যক্ত ভাষা বলে তোমার মুখ
আমি ক্ষমাচাই যদি করে থাকি ভুল!!!

কবিতা - ধ্রুবনীল পদ



জীবন্ত কাব্যের অনাদি পুরাণ
ধ্রুবনীল পদ (সবুজ মন্ডল)



জীবনবৃক্ষ কালবসন্তে রঙ্গিন কষ্টের ডানা মেলে

হতাশার ভস্ম ঘেরা একলা কোন মরুর সাগরে।
প্রানশুধার মৌহেল গন্ধে ধরা মাতিয়ে বেড়ায়

অধরা আশাবৃন্তে ফোটা স্বপ্ন শতদল।


ক্ষণিকালয়ের সিন্ধু কঠোরে লুকিয়ে থাকা বরপুত্র
পথ হারায় সমবাহুর বিপরীত দুই বিন্দুতে...

জীবনের সংজ্ঞাও ধোঁয়াশায় মিলিয়ে যেতে থাকে তার কাছে

প্রাতিষ্ঠানিক কোন রূপও দিতে পারে না সে !
জীবন হয়তোবা গুপ্ত ঘাতকের মতই বর্ণচোরা

ঘাপটি মেরে বসে থাকে, প্রাণহীন কণিকায়

প্রাণরস চুষে নেবার আশায়...

চলন্তিকার পাঁজর চিড়ে সাড়ে তিন হাত অতলেও

যখন সংজ্ঞাতীত মনে হয় পার্থিব জীবন,

তখনি অস্তিত্বের অবস্থান জানান দেয় জীবন্ত কীটগুলো

বিবেকের সলিলপুত্র তখনও উৎসের খোঁজে

ঠায় তাকিয়ে রয়,চন্দ্রগিরির দিকে চোখ তুলে ...

কিন্তু আদৌ কি সে খোঁজ পায় উৎসের ?

নাকি উত্তরায়ণের জীবনবায়ু ছিন্ন মস্তা করে দেয়

স্বপ্নঘুড়িকে,

হয়তোবা আশার নাটাই ছাড়াই

স্বপ্নঘুড়ি খুঁজে পায় নবালম্বন।

কিন্তু সে-ই নিঃস্ব গুপ্তচর ...?

সে-তো পড়ে থাকে জীবন পথের আস্তাকুড়ে

জীবন্ত টোকাই হয়ে,

শুন্য ঝোলা স্কন্ধসঙ্গী করে-

“ভালবেসে খুঁজে বেড়ায় ভালোবাসা

ভালোবাসার জন্য।”

কবিতা - অনিমেষ সিংহ

দেখা হবে আবার
অনিমেষ সিংহ


আমাকে খুঁজবে না তুমি
তোমরা !
জানি ফুলের গাছ পোঁতা হবে
ফুটপাতে
হাতে-হাত রোদ মাখতে মাখতে
হেঁটে যাবে...
তোমাদের পায়ে পায়ে সমুদ্র
নৌকো করে ফুল আসবে ভেসে।
তবু দেখা হবে।

শাশ্বত অরণ্য আমার মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা...
মেঘ বৃষ্টিতে ধুয়ে ধুয়ে
যখন সারা রাত চাঁদ,
জোছনায় জ্বলতে জ্বলতে...
আমি ভালবাসব তোমাকে,
নিজেকে,
বরফ পাহাড় তার নিচে ঢেউ খেলানো ধাপে ধাপে
সোনালী ফসল...
এতোসব কিছু তাই ফিরব ডাঙ্গায়,
রক্ত দেওয়া-নেওয়া প্রখর খোরা জিভে লোনা স্বাদ
সিনেমার ঘর জল ছই ছই !
ভাঙ্গা রিক্সার ছাদে হিমেল বাতাস
সবুজ ঘাসে গঙ্গা-ফড়িং
রাতের বেলায়
পা তুলে নেমে যাবে নদীর ভেতর ।
বড় রাস্তার মোড়ে ভিজে যাওয়া রেলিং-এর
নীল রঙে
মিশে যাবে তোমার দীঘল দুটি চোখ...
দেখা হবে।

আজ কম্বলে মেঘ জড়িয়ে শুয়ে আছি
মরুভূমি ক্যাকটাস আঙ্গুলে নখে
রোদ ছুঁলেই আমি প্রেমিক আবার
দেখা হবে
ভীষণ ঝড়ে...

এখন দিগন্তে বৃষ্টি ঝরার গান নেই,
পাঁজরে দামামার ভীষণ প্রহার,
চাঁদে যোদ্ধারা আসে চাঁপা বনে...!
পালকে পুরুষ ঠোঁট লাগাও যতটা আঁধার নিতে পারে তোমার
খয়েরী ডানা ।

তারপরে ভালবাসার দেখা হবে একদিন
ভালবাসার সাথে ।

কবিতা - শুভজিৎ বসাক

পুতুল শক্তি
শুভজিৎ বসাক



পূজো এসেছে, চারদিক তারই নেশায় মেতেছে,
তবু কিছু একটা বিষাদের মায়ায় যেন চারিদিক নিস্তব্দ্ধ।।
আজ নারীশক্তি শুধুই মাটির পুতুলেই পূজিত,
তার সম্মান আজ লাঞ্ছিত অবহেলিত।।
মা আজ যে উচ্ছাস তোমার সামনে করছি,
তা নিছকই আনন্দের নয়,
এ যেন শক্তিকে পুতুলে পরিণত করার উচ্ছাস।।
যে নারীশক্তির আরাধনায় সমাজ মেতেছে,
আদৌ সে সমাজ তার অঙ্গীকার রক্ষা করেছে??
পারেনি, এ সমাজ পারেনি।।
মা এবার কিছু সুমতি এনো তোমার সাথে,
যেন শক্তিকে শুধু পুতুলে নয়,
বাস্তবেও তাকে সম্মান করি,
তবেই এ শক্তি পূজো সার্থক,
তোমার মর্তে আগমন সার্থক হবে মা,
সেইই হবে তোমার শ্রেষ্ঠ পূজার অজ্ঞলি।।।


কবিতা - সূর্যস্নাত বসু



নিম্নমধ্যবিত্ত 
সূর্যস্নাত বসু


তিন বাটি দই, গঙ্গারামপুরেরে । একুশ টাকা । একটা আস্তো কলার মোচা, আর পাঠা
এই নিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ কাটত । মাঝে দু একবার মাছের ঝোল, চকলেট আইসক্রিম ।
ক্যাডবেরী । এর বেশী নয় ।

পুজোর ঠিক একমাস আগে মদনলাল ব্রীজমোহন । তিন চারটে শাড়ি, হংসরাজে আমার
চারটে হাফপ্যান্ট দুটো টিশার্ট, দুটো জামা---সপ্তমী থেকে দশমী অব্দি । এ ক্লাস ।
এছাড়া সস্তার ক্যাপ বন্দুক, সাথে এক প্যাকেট বুড়িমার বাজি । চরকা বোম্ব ।
আর বাইরে অনেক কথা ।

মনে পড়ে,বাজার শেষে ফেরার পথে রোজ রিক্সায় আমি নানা ধরণের বায়না করতাম,
মা-বাবার ঝগড়া হত,দু তিন রকমের চড়ও খেতাম । রিক্সা চলত । কখনও দুজনের
হাত ধরে হাঁটতাম । ভিড় বাসে বাড়ি ফিরতাম । বাবা হিসেবের খাতা বাড়িয়ে দিত ।
মা পাশ ফিরে ঘুমোতে যেত ।
ঘুম আসত না ।

তবে এখন ,এই যে আমার বড় হয়ে ওঠা, এর মধ্যে অনেককিছুই বদলেছে
দামী খেলনা থেকে চকলেটপ্রেম, সব কমেছে । বুঝতে পারি । আর হ্যাঁ, একটা
সুখবর, এখন আর আমার তেমন কোন আবদার নেই, ছোট্ট একটা চাহিদা
বলতে রোজ রাতে ঘুমোনোর আগে বাবার মতই হিসেব করি,

আবদার কিনি
আবদার বেচি ...



বাবার অনেক বয়স হয়েছে । এই বয়সে
প্রায় সবকিছুই ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক ।
আর বাদবাকিদের কথা ছেড়েই দিলাম
মাঝেমধ্যে নিজেকে চিনতেই ভুল হয় তাঁর ।
বাজারঘাট, হিসেবপত্তর, ঘা বসানো---এসব
স্মৃতি থেকে তুলে দেওয়া তো রোজকার ঘটনা ।
অনেক ডাক্তার, বৈদ্য, কবিরাজ, হাকিম
দেখানো হল, বকবকবক থেকে ইলেকট্রিক শক
সব কিছুই এল, কিন্তু কাজের কাজ হল কই ?
অতঃপর আর কোন উপায় না পেয়ে কোত্থেকে এক
পক্ষীসদ্দৃশ এবং অত্যন্ত নমনীয় অর্বাচীন এসে
বাবার দুহাতের মুঠোয় মা আর আমাকে বন্দী করে দিল,
আর তা দেখে উনি প্রায় একগাল হেসে বেশ স্বতঃস্ফূর্ততায়
বলে দিলেন,"হয়ত আনুমানিকতাই আমার ভুলে যাওয়ার কারণ ।"




কবিতা - অনুপম দাশশর্মা









শব্দের খাতিরেঅনুপম দাশশর্মা



বিষয় কি ভাসে বাতাসের গায়ে কিংবা কি ডুব
দিতে হবে তার গাত্রদাহের ঝিল সাঁতারে!
টানটান চোখের চামড়া শিখেছে শব্দের রহস্য ফাঁদতে।
যদি পারো গিলতে ভালো নয়ত রোয়াকহারা
দোরগোড়ায় মজলিশ খুঁজে নাও
মাউসের ক্লিকে।

সমাজের উসখুস মাথায় চেয়ো না নাজুক গোলাপখাস
চারধারে দেখো থোকা থোকা কাঁচপোকা
প্রহর গোনে সাবাশের মনকাড়া আলাপে।

আর আমি আর তুমি, বিছুটি পাতা ফুঁড়ে
সামনে দেখাই ক্ষুব্ধ খাদ।
আহ্লাদ নয়, নয় হেমন্ত সন্ধ্যায় বোতলের
মহোৎসব রাতভর অযাচিত বীর্যক্ষয়ে,

তোমারও দায়িত্ব থাকে কবি
আত্মঝংকার ঝেড়ে দায়বদ্ধতার আলো জ্বালাতে
বিষয়ের সুস্থ সাঁঝবাতিতে।

অবিস্মৃত - অলোক চৌধুরী

অবিস্মৃত
অলোক চৌধুরী



(আমাদের এক বিস্মৃত কবি সুশীল রায়। তাঁর প্রকাশিত বহু বইয়ের মধ্যে ‘পাঞ্চালী’ এক অন্যতম কবিতার বই। প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ১৩৫৭ সালের মাঘ মাসে। সভ্যতা কবিতাটি কবির ‘পাঞ্চালী’ বইটি হতে আহরণ করা)

সভ্যতা
সুশীল রায়

কোদালে কুপিয়ে মাটি বেকুবীর দৃষ্টান্ত চরম
দেখিয়েছি আত্মীয়-স্বজনে ।
স্বখাত সলিলে ডুবে লভিয়াছি আনন্দ পরম
লঘু করি’ দৈহিক ওজনে ।।

মুক্তহস্তে বিতরণ, অন্নদান নিজেকে ঠকিয়ে—
এ-জীবনে হয়েছে অনেক ।
অভিজ্ঞ যাঁহারা, তাহারা কহিতেন, ‘করিছ ও কি হে ?—
এরি মধ্যে হারালে বিবেক ?’

বিবেক সাবেক-কেলে বৃদ্ধ ভেবে কহিনু, ‘এবার
বুদ্ধি দিন্ আনাড়ি আমাকে ।’
সম্ভ্রমে বসিনু পার্শ্বে, হেরিলাম শ্বেতগুম্ফ তাঁর
হরিদ্রাভ হয়েছে তামাকে ।।

শির সঞ্চালন করি’ বহুকষ্টে হাসিয়া কাশিয়া
মন্ত্র কহি’ দিলেন মোক্ষম ।
সভ্য-বুদ্ধি লাভ করি’ উঠিলাম ক্ষণে উদ্ভাসিয়া,
অপারগ হলেম সক্ষম ।।

তাই তো সম্প্রতি আমি ঘোরতর নেমকহারাম,
পরার্থে নাহি কো স্বাদ, পর-অর্থে প্রচুর আরাম ।।

স্মৃতিচারণ - সুদীপ্তা চ্যাটার্জ্জী

প্রবাসীর পত্র
সুদীপ্তা চ্যাটার্জ্জী


(পর্ব - ২)

এদেশে যারা নতুন আসে তাদের সবাইকে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়,হয়ত তার কিছু আনন্দের, কিছু দুঃখের, এর পর থাকে অবাক করা অদ্ভুত সব ঘটনা । আমার ঝুলিতেও আছে তেমনি অনেক গল্প ,কিছু নিজের অভিজ্ঞতা কিছু অন্য কারো কাছ থেকে শোনা ঘটনা। হতেও পারে এই ঘটনা কেউ কেউ হয়ত পড়েও ফেলেছেন অন্য কোন ব্লগে ,যাই হোক তবুও জানাতে ইচ্ছে করছে .. সেই রকম একটি গল্প মনে পড়ছে,এক বন্ধুর কাছে শোনা গল্প ,সত্যি না মিথ্যে তা কিন্তু জানি না ...

এদেশে এসে সবার প্রথম লক্ষ্য থাকে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া ,কেউ কেউ IDP (international driving license) নিয়ে আসেন তবে তাদের ও এক বছর পর টেস্ট দিতে হয় । এই পরীক্ষাতে পাস করা আমাদের মানে ভারতীয় দের কাছে এক নতুন চ্যালেঞ্জ। লিখিত পরীক্ষা তেমন ঝামেলার নয় ,বই মুখস্ত করে উগরে দিতে আমরা উস্তাদ,ঝামেলায় পড়ি রোড টেস্ট এ,মোটামুটি সবাই এই রোড টেস্টে পাশ করার জন্য কিছু প্র্যাকটিস লেসন নিয়ে থাকেন ।

একবার একজন বঙ্গভাষীর কপালে জুটল এক সাদা চামড়ার হুঁকো মুখো ড্রাইভিং টিচার , ৬০/৭০ মাইল এ ছুটে চলা ৪ ওয়ে লেনে হাজার হাজার গাড়ির মাঝে, তিনি ওই দেশী ভাই কে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। এনাদের পাশে বসে নিজের দক্ষতার পরীক্ষা দেওয়া কারো জন্যই খুব একটা আনন্দের অনুভুতি না ,আর এই দেশী ভাই টি তো খুব কম দিন হলো এদেশে এসেছিলেন ।

নিয়ম অনুযায়ী,যে গাড়ি প্রথম ক্রসিং এ আসবে, সেই গাড়ি একটু থেমে ,চার দিকে দেখে আগে যাবে ,পরে আসা গাড়ি পরে যাবে । এদিকে সেই দেশী ভাই সেই যে ক্রসিং এ এসে দাঁড়িয়েছেন এর পর আর নড়েন ও না চড়েন ও না ,

বিরক্ত শিক্ষক প্রশ্ন করলেন 'Exactly how long are you planning to stay here ?'

পরীক্ষার্থীর উত্তর 'according to my visa I can stay 4 -6 years, it all depends on my job '

বলা বাহুল্য এর পর তিনি ড্রাইভিং এর অনুমতি পেয়েছিলেন কিনা আমার আর জানা নেই।

এর পরের ঘটনা আমাদের এক বন্ধুর ,ইনিও তখন নতুন এসেছেন,IDP নিয়ে নিউ জার্সির সবচেয়ে পুরনো রাস্তা “ রুট ওয়ান” দিয়ে গাড়ি নিয়ে অফিসে চলেছেন,কলকাতার রাস্তায় গাড়ি চালিয়েছেন,সেই নিয়মে রাস্তার বা দিক (লেফট লেনে) দিয়ে চলছেন নিজের স্পীডে,এদেশের নিয়ম কানুন এতটা জানেননা ,পাশ দিয়ে সব গাড়ি হর্ন বাজিয়ে চলে যাচ্ছে । কলকাতার রাস্তায় হর্ন শুনেঅভ্যস্থ কানে অস্বাভাবিক কিছু ঠেকছে না। কিছু পরে দেখলেন লাল হলুদ লাইট জ্বালিয়ে সাদা গাড়ি পেছনে আসছে ,উনি তখনও চলছেন নিজের খেয়ালে ,আসলে লেফট লেন পাসিং লেন,স্পীড লিমিট মেনে জোড়ে চালিয়ে বেড়িয়ে যাওয়াই উচিত।এখানে স্পীড লিমিট ক্রস করলেও যেমন ফাইন দিতে হয় স্পিড লিমিটের নিচে চালিয়ে ট্র্যাফিক স্লো করলেও ফাইন দিতে হয়। কিন্তু এসব নিয়ম এর কিছুই জানেন না তিনি । এও জানেন না কপ পেছনে এসে লাইট জ্বালিয়ে দিলে সাইডে দাঁড়িয়ে যেতে হয় ।

হঠাৎ তিনি দেখলেন চারদিক থেকে পুলিসের গাড়ি তাকে ঘিরে ফেলেছে ,তারপর শুনলেন PAসিস্টেম এ (মাইকে) বলছে “ পুল ওভার টু ইওর সাইড” বুঝলেন ভালোই ঝামেলা করেছেন ,ভয়ে হাত পা ঠান্ডা, ডেপুটি এসে দাঁড়ালেন জানলার পাশে। উনি তাকে বিনয়ের সাথে জিগাসা করলেন “ ডীড আই ডু এনিথিং রং আঙ্কেল ?”

দেশে আমাদের অভ্যেস পুলিসকে মামা বলা,এত পুলিস দেখে ঘাবড়ে গিয়ে উনি কি সম্মোধন করবেন ভুলে গিয়ে মামা কে আঙ্কেল করে দিয়েছেন ।সম্মোধন শুনে কপ এর মনের অবস্থা কি হয়েছিল জানিনা ,তবে তার পরের প্রশ্নের উত্তরে তিনি যা জবাব দিলেন সেই শুনে তার মনের অবস্থা কি হয়েছিল সেটা বলাই বাহুল্য ..এর পর নিয়ম অনুযায়ী পুলিস জিগ্যেস করলো

"where are you coming from sir?”' (বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইছেন ফাইনের টিকিট পাঠাবে) ।

ওনার উত্তর ঃ- “ from India” !

Cop এর উত্তর:-“that makes sense, why are you driving so slowly!! It's really a long way from India to New Jersey, maybe you are too tired to drive .So sir, let’s go. Take some rest on our car.

আমার নিজের ড্রাইভিং টেস্ট এর ঘটনাও কম মজার না ...এর পর সেই সব শোনাবার ইচ্ছে রইলো ।

স্মৃতিচারণ - মধুছন্দা পাল




ছোটবেলা -২ 

মধুছন্দা পাল



আমাদের শহরে বাঙালিদের দুর্গাপুজো হত বাড়ি থেকে বেশ দূরে ,একলা যেতে পারতামনা দাদাদের কেউ না কেউ সারাদিন যাওয়া আসা করত ,কারো সাইকেলের রডে উঠে বসলেই হল । দাদারা পৌঁছে দিয়ে নিজেদের আড্ডায় চলে যেত সেখানে তখন রিহার্সাল চলছে ওদের নাটকের । বাড়ী ফেরার জন্যে চিন্তা ছিলনা বৌদিরা বা কাকিমা জ্যাঠাইমারা কেউনা কেউ আসতো তাদের সঙ্গে ফিরতাম । যদিও মনে হত আরও একটু থাকিনা কেন !

দুর্গাবাড়ী র বারোয়ারী পুজো । সারাদিন বাঙ্গালীদের ভিড়ে জমজমাট ।একচালার প্রতিমা ,খুব বেশি বড় নয় তা -ই দেখে দেখে আশ মিটতনা । পূজো করতেন মাখন ভট্টাচার্য । বৃদ্ধ মানুষ । সন্ধ্যা বেলা আরতি করার সময় মনে হত যেন কিছু তে ভর করেছে । নেশা গ্রস্তর মত নেচে নেচে বহুক্ষন ধরে করতেন আরতি । চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তো । মুখে মা –মা ডাক । সাধারন আলো । ধুনোর ধোঁয়ায় আবছা ঠাকুরের মুখ ,মনে হত জীবন্ত । তেমন কোন জাঁক জমক নেই কিন্তু কি যেন ছিল সেই পুজোয়! মন খুশীতে ভরে উঠত ।

পাকামন্দির দুর্গাবাড়ির ।সামনে খোলা মাঠে ত্রিপল টাঙ্গিয়ে ,স্টেজ বেঁধে রোজ সন্ধ্যেবেলা নানান অনুষ্ঠান হত। আমার দাদাদের ক্লাব একদিন নাটক করত ।দাদা পিসিমার থান ,জ্যাঠাইমার সেমিজ , বউদিদের শাড়ি নিয়ে যেত পরে নাটক করবে বলে ,একবার বড় বউদির নতুন ব্যঙ্গালোর শাড়ি হারিয়ে এল ,খুব বকুনি খেল বাড়িতে । বৌদি তো শাড়ীর দুঃখে কেঁদেকেটে একসা !

এক পুজোয় মহাভারতের কোন অংশ অভিনয় করেছিল দাদাদের ক্লাব । দাদা যুধিষ্ঠির । কি যে বিড়বিড় করে বলল বোঝাতো গেলইনা শোনা ও গেলনা ভালো করে । বাড়ী ফেরার পর মা সে কথা বললে দাদা উত্তর দিল “ যুধিষ্ঠির কেমন ভদ্রলোক ছিলেন জাননা ? খুব আস্তে কথা বলতেন ।”

একবার হোল পশুরামের ‘ ভুশুণ্ডির মাঠ ।’ পর্দার ওপরে ছায়া ফেলে ভুতেদের করা সেই নাটক দেখে আমরা তো একেবারে যাকে বলে “বাক্যরহিত । ”

গঙ্গার ধারে অনেকদিনের পুরনো ‘ বুঢ়ানাথ ’এর মন্দির,শিবের নাম । বিশাল বড় চত্বর। নবমির দিন সেখানে পাঁঠা বলি হতো মনে আছে । মাএরা সেখানে নবমীর দিনই গঙ্গা স্নান করতে যেত । গঙ্গা এখানে বিশাল চওড়া , এপার ওপার দেখা যায়না প্রায় । আমরা ছোটরা পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম । আমাদের মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিত মা। তারপর মেজ্যাঠাইমা আর মা একদিকে ছোটকাকীমা আর জ্যাঠাইমা আর একদিকে ,আর একদিকে সেজজ্যাঠাইমা আর ন’কাকীমা একে অপরের ওপর হাত (বাহু) ধরে এক এক করে ডুব দিত।

নবমীর দিন দেহাত থেকে দেহাতীরা আসতো শহরের পুজো দেখতে । হলদে আর গোলাপি রঙে ছোপান শাড়ী ধুতি পরে । সব এক সঙ্গে হাত ধরে হাঁটতো রাস্তায় । মাঝে মাঝে খুব মজা হতো কোন গাড়ী হয়তো পেছন থেকে হর্ন দিল , ওরা সব এক সঙ্গে হুড়মুড় করে একদিকে এ ওর ঘাড়ে গিয়ে পড়ল ।তবু হাত ছাড়বেনা কিছুতেই ।

বিজয়াদশমীর দিন অনেক লোকজন আসতো বাড়ীতে । পুরোন বাঙালী পরিবার বলে অনেকেই দেখা করতে আসতেন । আমাদের বাড়ী লোকজনের ভিড়ে গমগম করতো । পিসিমা তার বিশেষ আসনে বসতো । আমরা কাছে বসে দুর্গানাম লিখতাম লালকালী দিয়ে । তারপর পিসিমা ছোট্ট রূপোর গ্লাস থেকে মুখে একটু সিদ্ধি ঢেলে দিত । নিয়ম । নিয়মের বাইরের সিদ্ধি হতো ছোটকাকা ,মা আর ছোটকাকীমার উৎসাহে ।বেশী করে । বড়দের অনেকেই বেশী রাতে আরও বড়রা ঘুমিয়ে পড়লে সেই সিদ্ধি খেয়ে হাসাহাসি করতো । নারী পুরুষ নির্বিশেষে। পরদিন কারো কোন বেফাঁস কথায় জানতে পারতাম ।

আমাদের কোজাগরী লক্ষ্মীপূজোর নিয়ম ছিলনা ।কালীপুজোরদিন মহা লক্ষ্মীর পূজো হত ।



স্মৃতি-চারণ - সীমা ব্যানার্জ্জী রায়

এ ব্যথা...কি যে ব্যথা!
সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়



ঘুম তো ছুটে গেছে কবেই, নাওয়া খাওয়াও মাথায় উঠেছে । দেশে যাওয়া না তো, যেন একটা বিরাট প্রজেক্ট শেষ করে তবে দেশে যাওয়া।

দেশে যাওয়া এ আর এমন কি ব্যাপার; সবাই তো যায়। হ্যাঁ! খাঁটি সত্যি। কিন্তু আমার প্রথম যাওয়া যেন মনে হয়েছিল বিরাট একটা ব্যাপারস্যাপার।

সকাল থেকে সংসার-এর খুঁটিনাটি সব গুছিয়ে গাছিয়ে আসার পর যেন একটু নিশ্চিন্ত। প্লেন ছাড়বার এখনও ঘন্টাখানেক দেরি। বসে আছি ডালাসের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। বড্ড ব্যস্ত এয়ারপোর্ট। শ্বেতাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গীনিদের ভিড়। তারই মধ্যে আমাদের দেশের দুচারজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিদেশে ভারতীয় দেখলেই মনে হয় আমরা যেন কতকাল চেনা। আছি এদেশে তাও অনেকদিন হল, বাঙালী দেখলেই কথা বলার জন্য মনটা কেমন পিপাসার্ত হয়ে ওঠে, তাই দৃষ্টিও খুঁজে ফেরে বাঙ্গালীকে। বসে আছি একা, মনটা মাঝে মাঝেই চলে যাচ্ছিল কলকাতায়, একে একে ভেসে আসছিল একান্ত কাছের মানুষদের মুখগুলো।

হঠাৎ এক ভদ্রমহিলার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম – প্রিয়াংকা - ! না না, এ মহিলা প্রিয়াংকা তো নয়, সে এখানে কোথা থেকে আসবে? আর আসলে..... আমাকে কি জানাবে না? যেতে গিয়েও পা দুটো যেন গঁদের আঠায় আটকে গেল। কিন্তু কি আশ্চর্য মিল!

ঘুমিয়ে থাকা স্মৃতির গোপন গহ্বর থেকে বেরিয়ে এলো কবেকার প্রিয়াংকার কথা...... সেই প্রিয়াংকা যে ছিল অগাধ সম্পত্তির মালিকের একমাত্র সন্তান। আমার সাথেই কেটেছে ওর স্কুল আর কলেজ জীবন। ভীষণ সুন্দরী ছিল আর ছিল খুব সুন্দর একটা মনের অধিকারী। আমার আর ওর মধ্যে ছিল গভীর বন্ধুত্ব।

আমার বিয়ে অনেক আগে হয়েছিল স্কুল গন্ডী পেড়োনর সাথে সাথেই একেবারে সাত পাকে বাঁধা। আর বিয়ের পরেই চলে আসতে হয়েছিল এই সুদূর মার্কিনে, নতুন জীবনের স্থায়ী ঠিকানায়। তারপর হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো, নতুন দেশকে চেনা, নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে চলতে চলতে দিন কাটছিল। প্রিয়াংকার সাথে চিঠির আদান প্রদানও চলছিল সেই সাথে নিয়মিতভাবে। ওর রগরগে প্রেমের সব গল্প লিখত আমাকে। তারপর বেশ কিছুদিন চুপচাপ।

হঠাৎ করে চিঠিতেই ওর বিয়ের নিমন্ত্রণ কার্ড পেয়েছিলাম। ওর হানিম্যুন-এর ছটফটে সব গল্প আর ছবি পাঠিয়েছিল। খুব খুশী হয়েছিলাম, কিন্তু তারপর আর ওর সাথে যোগাযোগ হওয়ার সুযোগ হয় নি। ঘোর সংসারী হয়ে পড়লাম। কেমন যেন দিনগুলো ছুটে পালাতে শুরু করল। কাজেই বন্ধুবান্ধবদের সাথে চিঠির আদান প্রদান কমতে কমতে একেবারেই কমে গেল। বিয়ের পর মেয়েদের যেমন হ্য় আমিও বাদ যাই নি সেই একই কেমিস্ট্রির ইকুয়েশন থেকে। কাজেই বন্ধুবান্ধবদের সাথে চিঠির আদান প্রদান কমতে কমতে একেবারেই কমে গেল।

অনেকদিন আগের কথা। তখন মাত্র আমার বিয়ে হয়েছে। থাকি ইনডিয়ানার শহরতলীতে। ওখান থেকে গিয়েছিলাম দেশে। এ দেশ থেকে সেই আমার প্রথম যাওয়া কলকাতায়।

দেশে পৌঁছেই মনে হলো এ মাটির সাথে নাড়ির এক অদ্ভুত টান। খুব আনন্দে কাটতে লাগলো দিনগুলো –সকাল থেকে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চলেছি গাড়ি নিয়ে, বন্ধু বান্ধব আর আত্মীয়দের সাথে আড্ডা দিয়ে আর গল্প করে কাটিয়ে দিচ্ছি বেলা। আমেরিকা থেকে এসেছি বলে হয়ত, আদরের সাড়াটা আরো বেশি পাচ্ছি। ছকে বাঁধা জীবন থেকে বেরিয়ে এসেছি যেন মুক্ত পাখি আর মনে এসেছিল এক অবর্ণনীয় আনন্দের স্বাদ । তাই কিছুদিন বাড়ি থাকার পরেই পায়ে লাগাম দিয়ে ছুটে বেড়ানো। সে কি আনন্দ ! ভাষায় হয়ত বোঝাতে পারব না। আমারই খালি বিয়ে... সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে... হয়েছিল বন্ধুদের মধ্যে, তাই আমি আরও স্পেশাল বন্ধুমহলে। কি ভাবে দিন কাটাই বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলছিলাম ওদের।

সেদিন বেরিয়েছিলাম আমার পিসতুতো দাদার বাড়ি ম্যান্ডেভিলি গার্ডেনেস-এ যাবো বলে। গাড়ি চলছিল অসংখ্য মানুষ আর ট্রাম-বাসের ভীড় ঠেলে । হঠাৎ গড়িয়াহাটার মোড়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে চোখ পড়তেই দৃষ্টিটা আটকে গেল।

মনে হল প্রিয়াংকা দাঁড়িয়ে। পরনে হলুদ রঙ্গের শাড়ি আর চোখে আকাশনীল চশমা। দেখে খুব অবাক হলাম কারণ ওকে কখনও ট্রামে বাসে যাতায়াত করতে দেখি নি। ড্রাইভারকে একটু থামতে বলে ওখানে নামলাম। প্রিয়াংকা আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরল, আবেগ-আনন্দে বলে উঠল , “কবে এসেছিস রে?”

ওকে দেখে কেমন যেন মনে হল। বদলে গেছে অনেকটাই। ও আগে ছিল উচ্ছ্বাসে ভরপুর,লাস্যময়ী আর আহ্লাদী। এখন অনেকটাই উদাসীন। গাড়িতে তুললাম ওকে। শুরু করলাম ফেলে আসা দিনগুলোর রোমন্থন।

ও খালি আমাকেই আমার কথা জিগেস করে যাচ্ছে। বললামঃ “কি গো! কে সেই ভাগ্যবান যে কলেজের সেরা সুন্দরীকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আমাদের কাছ থেকে।” দেখলাম ও কিন্তু শুনেও না শোনার ভান করছিল। বললামঃ কিসের চিন্তায় এত মগ্ন শুনি? দেখতে দেখতে কখন ওর বাড়ি এসে গেছিল। আমি তো অবাক হয়ে ওকে জিগেস করেই ফেললাম যে, “এখানে নামাব তোকে নাকি? এখানে থাকিস?” বললঃ "হ্যাঁ! এখানেই নামিয়ে দে। একদিন তোদের বাড়ি গিয়ে অনেক আড্ডা দেওয়া যাবে রে। তুই কবে ফ্রী থাকবি আমাকে জানাস কেমন? আমার ফোন নম্বর নিয়ে নে।”

ওর বাড়ির অ্যাড্রেসও জোর করে নিয়ে নিলাম। আমি হাসতে হাসতে বললামঃ “আমাকে তোর সংসার দেখাবি না? ওরে বাবা, হিংসে করব না, একটুকুও, হল!” বললঃ “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। একদিন আসিস” বলে দেখলাম চুপ হয়ে গেল।”

একদিন ফোন না করেই ওর বাড়িতে হাজির হলাম। দেশে তো আর ফোন করে যাবার প্রয়োজন নেই, তাই একদিন রবিবার দেখে... না জানিয়েই... সকাল সকাল চলে গেলাম ওর বাসায়। দরজা খুলে দিল ওর বাড়ির কাজের মাসি। আমাকে বসতে বলে সেই মাসি ভেতরে চলে গেল। বেশ ছিমছাম সাজানো বসার ঘর। বেশি ফার্নিচার নেই তবে যা আছে বেশ সুরুচির পরিচয় পাওয়া গেল। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি ঘরের চারিদিকে। কেমন যেন একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ঘড়ির টিক্ টিক্ আওয়াজ সময়ের সাথে খালি তার কাজ করে চলেছে।

আমাকে অবাক করে একটু পরে সাজগোজ ছাড়াই সাধারণ একটা শাড়ি পড়ে প্রিয়াংকা ঘরে এল। বসল ঠিক আমার পাশে। আমাকে বললঃ “তোকে কি সুন্দর লাগছে রে..মনে হচ্ছে তুই খুব সুখী। আমি বললাম: “~ আর তুই?”

আবার সেই নীরবতা। সর্বনাশা মেঘপুঞ্জের মতন চারিদিক ঘিরে ধরল আমায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললঃ “~আমি কেমন সুখী দেখবি?” আমাকে ওর পিঠের ওপর রাখা কাপড়ের আঁচল সরিয়ে দেখাল..আমি ত’ দেখে চমকে উঠলাম। এত সুন্দর মেয়েটাকে কেউ এরকম ক্ষত বিক্ষত করতে পারে? তাহলে কি.........

আমার দুইচোখে জল আসতে দেখে খুব স্বাভাবিকভাবে বললঃ “~চিন্তা করিস না, অন্ধ ভালবাসার এইটাই চরম পুরস্কার তো......এটাই আধুনিকতা... ~একদিন যার প্রেমে একেবারে হাবুডুবু, যার জন্য মা বাপিকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল ।

জানিস, মা বাপির একটুও ইচ্ছা ছিল না এই বিয়েতে... হয়ত, দূরে চলে যাব বলে, নতুবা ওর সম্বন্ধে ঠিকঠাক খবর না পাওয়ার জন্য। তাদের ইচ্ছে ছিল, মেয়ে কাছাকাছি থাকুক। সাধারণতঃ সব মায়েরাই তাই চায়। ওনারা আমার কথা চিন্তা করে তাদের একমাত্র আদরের মেয়েকে ধুম ধাম করে বিয়ে দিয়েছিলেন। আর কলেজের সবার ঈর্ষার পাত্রী হয়েছিলাম বড়লোকের হ্যান্ডসাম, অধিক সম্পত্তির অধিকারী একমাত্র সন্তানের পুত্রবধূ হতে পেরেছিলাম বলে, কারণ আমি যে ভাবে মানুষ হয়েছিলাম অনুকল্প-ই ছিল আমার যোগ্য পাত্র।“

আমি জিজ্ঞেস করে ফেললাম “অনীক? ও যে তোকে অত ভালবাসত?”

---“অনীক গরীবের ছেলে ছিল আর তার ছিল বড় দায়িত্ব ...আর আমার মতন মেয়ে ওর সঙ্গে মানাতেই তো পারতাম না ।

আজ বুঝি, টাকাটাই বড় নয় জীবনে, একটা মানুষকে তার টাকা পয়সা দিয়ে বিচার করা যায় না রে, কথায় আছে না, ~সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। একদম খাঁটী কথা। বড্ড অহংকার ছিল আমার, কি বল।”

আমি যেন বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা, ~“অনুকল্প তো শুনেছিলাম খুব ভাল ছেলে ছিল। তাহলে? কিন্তু হঠাৎ বদলে গেছিল কেন ?”

কথার মাঝে দেখলাম মাসি এক প্লেট চিঁড়ে, আলু -কপি ও বাদামভাজা তার সাথে বড় বড় ল্যাংচা ট্রে তে করে রেখে গেল। প্রিয়াংকার মনে ছিল আমার প্রিয় খাবার। কলেজে থাকাকালীন আমরা বান্ধবীরা প্রায়ই ওদের বাড়িতে আড্ডা দিতে যেতাম, যে যা ভালবাসত তাই ওদের বাড়ি পাওয়া যেত বলে আমরা হুড়্মূড় করে হাজির হতাম।

খেতে খেতে বললঃ “~ তোকে সব বলে একটু হালকা হই কি বল? তুই-ই তো আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিলি সেই স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত। তারপর সব কেমন যেন হিজিবিজি হয়ে গেল। এত কথা মনে আছে, না বার করে দিলে হয়ত শুনবি একদিন আমি শেষ। ওর মুখে হাত দিয়ে বললামঃ “এই বললি আর যেন কোনদিন না শুনি...এই শুনতে কি আমি ছুটে এসেছি, বল?” তৃতীয়ার শশীর মত ক্ষীণ হাসি ভেসে উঠল তার মুখে।

চুপটি করে শোন এবার!!!!! পার্ক স্ট্রীটের হিন্দুস্থান হোটেলের একটা পার্টিতে অনুকল্প-র সাথে আলাপ হয়েছিল, আলাপ থেকে অন্তরঙ্গতা। তারপর বিয়ের জন্য জোরাজুরি। জানিনা নিজের অজ্ঞাতে আমিও কখন ওর প্রেমের জোয়ারে গা ভাসিয়েছিলাম।

খালি ভাবতাম, সহচরের মতো সে এসেছে বুঝি আলো হাতে নিয়ে! নিঃস্পাপ জোছনায় অপরূপ কথাকলি ফুটে উঠেছে আমার মাটি অঙ্গন জুড়ে! অঞ্জলি ভরে এনেছে সুগন্ধি আখর, প্রেম, অলৌ্কিক সৃজনকল্প!!!

সেই বদান্যতায় আশরীর বড় স্বচ্ছ হয়ে উঠেছিলাম হঠাৎ-ই...... বিয়ে করে তো এলাম, শ্বশুরবাড়ি বলতে তখন মুম্বাই-এর পালি হিল। অনুকল্প মা বাবার সাথে থাকত, আর আমিও তাই চাইতাম একসাথে থাকার। একসাথে থাকার থিওরিটা আমার খুব পছন্দ ছিল, এই জন্য যে কোন বিপদ আচমকা ঢুকতে পারে না। জানি না সেটা আমি ঠিক বুঝেছিলাম কিনা!!

ভীষণ মদ খেত অনুকল্প, যেটা আমি একদম জানতাম না আর আমাকে সে বলেওনি। যখন মদ খেত তখন হিতাহিত জ্ঞান থাকত না। খুবই বড় পোস্টে কাজ করছিল। মুম্বাই-এর মহেন্দ্র এন্ড মহেন্দ্র কম্পানীতে প্রোডাক্সন ম্যানেজার ছিল। যখন মদ খেত না, তখন মাটির মানুষ। আর মদ খেলে ভাষা আর উগ্রতা চরমে উঠত। বুঝতে পারতাম না এইসব ভাষা বলে কি করে? আর মদই বা খেত কেন? শখে না অন্য কোন কারণে? আজও জানতে পারি নি।

ওর মা বলতেনঃ আমার জন্য-ই ও নাকি মদ খায়। আমি ওকে কেন ভালবাসা দিয়ে আটকে রাখতে পারি না। কি আশ্চর্য যুক্তি। সেই চিরাচরিত কথা। সব দোষ এই নন্দ ঘোষ। কিরকম ভালবাসায় আটকানো যায় আমার অজ্ঞাত ছিল।

কিছুদিন পরে ওর সাথে চলে গেলাম হাওয়াই, ওর একটা প্রজেক্টের কাজের জন্য। ওখানে গিয়ে হঠাৎ করে অদ্ভুত ভাবে নিজেকে বদলে নিল অনুকল্প। রোজই প্রায় দেরী করে আসত। জিগেস করলে বলতঃ “~তুমি বুঝবে না, এ তো আর দেশ নয়? দেরি হলে খেয়ে শুয়ে পড়বে। কি ভাবতাম বল তো? ভাবতাম বেশ এই দূরদেশের চাঁদ একসাথে দেখব রাতের বেলা আর স্বপ্নের ঢেউ-এ ভেসে বেড়াব দুজনায়। আদনান সামি-র “অব তুম নজর মিলাও/ অব তুম করিব আও~~”-সেই গানটা শুনতে শুনতে হারিয়ে যাব কোথাও দুজনে।

যাই হোক, ওখানে সারাদিন একা একাই থাকতে হ্ত, এখানে ওখানে ঘুরি, মল- এ যাই, নিজেও একটা ফরেন ল্যাঙ্গুইয়েজ কোর্স নিয়ে পড়াশুনা শুরু করে দিলাম। ওখানেই আলাপ মধুরিমার সাথে। এক-ই সাথে ক্লাস করি, জানিস তো দেশের বাইরে দেশীয় কাউকে দেখলে কত ভরসা হয় মনে, তাই নয় রে?

একদিন মধুরিমার কথা অনুকল্প-কে বললাম, ও আমাকে বলল যে ওর অফিসেও নাকি দেশ থেকে একজন কাজের জন্য এসেছে, তাহলে একদিন ওদের একসঙ্গে ডাকলে কেমন হ্য়। বললামঃ- ঠিক আছে। বাহ! ভাল কথা তো। ওদের ডাকলাম আমাদের এপার্টমেণ্টে।

কি আশ্চর্য জানিস, মধুরিমার সাথে যে এল... সে ছিল অনীক। আমি ভেতরে গিয়ে দেখি আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে, আমি বেশ ঠান্ডায়ও কেমন যেন ঘামতে শুরু করেছি। অনুকল্প আমাকে অনীকের সাথে আলাপ করিয়ে দিল, কিন্তু অনীক এমন ভাব করল যেন আমাকে চেনেই না, আমাকে দেখে একেবারেই চিনতে পারল না, হয়ত ওকে না বিয়ে করার প্রতিশোধ নিল। আমিও আর আগ বাড়িয়ে কিছু বললাম না। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল।

অনীক আর মধুরিমা ওখানে লিভ টুগেদার থাকত। মধুরিমা আগেই গল্প করেছিল যে, ও নাকি একজনের সাথে প্রেম করত, সে তাকে ধোঁকা দিয়েছে তাই আর বিয়ে করবে না। ওখানে এসে অনীকের সাথে আলাপ হবার পর ওরা দুজনেই ঠিক করেছে একসাথে থাকবে একদম বন্ধুর মতন। কারণ এই দূরদেশে দুজনে একসাথে থাকলে বেশ কিছু পয়সা বাঁচানো যায়, মধুরিমার তাই মত। তবে আমি আর নাম জিগেস করিনি তখন, যার সাথে মধুরিমা থাকত। ও যে অনীকের সাথে থাকত সেটা তো আর জানতাম না।

মধুরিমা আর অনুকল্প-কে দেখলাম বেশ স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলছে যেন অনেকদিনের পরিচিত ওরা। অনীক হুঁ-হাঁ ছাড়া বেশি কথা বলছে না, একমনে খাবার খাচ্ছে। আমার দিকে একবারও তাকায় নি অনীক। মুখ নীচু করে খেয়েই যাচ্ছিল। আমার খুব ইচ্ছে করছিল অনীক-এর সাথে অনেক কথা বলার জন্য। কিন্তু সে তো এড়িয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল মনের সব কথা উজাড় করে দি তাকে।

ওরা দুজনে তো খেয়েদেয়ে চলে গেল। ওদের মিলিয়ে যাওয়া দেখলাম দুজনে এ্যপার্টমেন্টের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। ঘরের ভেতরে আসলে হঠাৎ অনুকল্প আমাকে বলেঃ ~''আমি মধুরিমার মতন মেয়েই চেয়েছিলাম যে সেলফ সাফিসিয়েন্ট। আমার ভাগ্যটাই খারাপ তাই তোমার মতন মোমের পুতুলের প্রেমে পড়ে হুড়মুড় করে বিয়ে করেছি'', বলে আবার মদ খেতে শুরু করল।

আবার রাত করে ফেরা আরম্ভ করল, মাঝে মাঝে রাতে না আসাও শুরু করে দিল। একদিন খুব বরফ পড়ছে, হঠাৎ করে ইলেকট্রিসিটি চলে যেতে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম, ফোন করলাম অনুকল্প-কে। মিসড কল দেখতে পেলাম। সেদিন সারা রাত জেগে ছিলাম, না খেয়ে।

ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কখন অনুকল্প এসে আবার কাজে গেছে... জানতেও পারি নি। বিকেলে কাজ থেকে আসলে জিগেস করলাম যখন যে, “কাল কোথায় ছিলে?” উত্তরে পেলাম তখন এক হ্যাঁচকা ধাক্কা। মুখটা যেন এক হিংস্র বাঘ। আমি তো অবাক! এ কোন অনুকল্প? এ কি করল সে? আমার ভালবাসাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল?

ভাবলাম, অনীক বোধহ্য় আমাদের কলেজ লাইফের আন্তরিকতার কথা বলেছে। তাই ওর সম্মানে লেগেছে বা অত্যধিক ভালবাসে আমাকে বোধহয় তাই,... অতীতের ভালবাসার কথা জানতে পেরে বোধহ্য় খারাপ লেগেছে।

এইসব নানান কথা মনে ভিড় করাতে আমি আসতে আসতে উঠে আবার কাজে লাগলাম। সেদিন গেল, আবার কিছুদিন পর একই দৃশ্যের সম্মুখীন হলাম। কিন্তু কেন যে এরকম করছে জানতে পারছিলাম না। আমি কথার মাঝে প্রিয়াংকা-কে জিগেস করলাম, ~~“মধুরিমার সাথে আর দেখা হয় নি তোর?”

প্রিয়াংকা বললঃ “~না, হঠাৎ করে ও ক্লাসে আসা বন্ধ করে দিল।” অনুকল্প মধুরিমার মধ্যে কোন ভালবাসা জন্মেছিল কিনা সেটা আমি জানতে পারিনি, বা বলতে পারিস জানবার সুযোগ হয় নি। সে কখনই আর অনীক বা মধুরিমার কথা বলত না, বা সময় পেত না। আর তিনজনেই তো কাজে ব্যস্ত থাকত। দেশের মতন তো আর ঘুরে ফিরে বেড়ালে চলত না, কারণ যে প্রজেক্টের জন্য গেছিল অনু, সেটা খুব অল্প সময়ের মধ্যে শেষ করে ফিরে আসতে হবে। কাজেই, আমার মনে সন্দেহের প্রশ্নই ছিল না। আর কেনই বা করব সন্দেহ-বল? মধুরিমা তো আর সুন্দরী ছিল না... বা একটুও অ্যাট্রাক্টেড মনে হয় নি তাকে দেখে যা দেখে, সাধারণতঃ ছেলেরা...এটা অবশ্যই আমার একান্ত ধারণা। ভুল হতেও পারে।

অনুকল্প-এর প্রজেক্ট শেষ হয়ে গেলে আমরা দেশে ফিরে এলাম। দেশে এসে ও যেন আমাকে সহ্য করতে পারছিল না। কিছু বললেই আমাকে যা নয় তাই বলতে শুরু করত। আমি তো আমার মা বাপিকে কিছু জানাতেও পারছিলাম না। নিজের ইচ্ছেতেই তো বিয়ে করেছিলাম। নিজের বিবেকের কাছে মস্ত বড় পাপী মনে হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিৎ আমার।

এইভাবে দিনের পর দিন যায়। বেশ দু তিনদিন বাড়ি আসা বন্ধ করে দিল। একে তো এই চিন্তা তারপর শ্বশুর শাশুড়ির সন্দেহপ্রবণ কথাবার্তা তে আমি আরো অতিষ্ঠ হয়ে পড়লাম। রোজই রাত করে আসত, একদিন সন্ধ্যেবেলায় আসলে এমনি অভিমানের সুরে বলেছিলামঃ ~~আজ যে বড় তাড়াতাড়ি এলে? মনে মনে কিন্তু খুউব খুশী হয়েছিলাম, জানিস। সেদিন ছিল আমার বিয়ের পর প্রথম তেইশ বছর জন্মদিন। আমি ভাবলাম আমার জন্মদিনের জন্য বোধহয় তাড়াতাড়ি এসেছে............ তার ফল এই আমার পিঠের চেহারা, দুচোখে টলটল করা জল নিয়ে বলল আমাদের নাম দেওয়া “আদুরি”। এই ছিল আমার জন্মদিনের উপহার। বাড়িতে বাঙ্গালী চাকর বাকর, শ্বশুর শাশুড়ি থাকাতেও কেউ এগিয়ে এল না আমাকে বাঁচাতে।

বুঝতে পারলাম!!!! …..স্বপ্নময় আলোগুলো আমায় অনায়াসে ভেদ করে চলে গেছে...পড়েছে অন্যত্র.......সবার অগোচরে বহুদিন পরে রাত পাহাড়ে আমি কিন্তু জেগে উঠেছিলাম...নিঃশব্দে....মনে হল চলে যাচ্ছি কোথাও... এই চলে যাওয়া মনে প্রস্থান নয়...নয় বন্ধন ছিন্ন করা... কেবল সময়ের স্রোতে গা ভাসানো...প্রাত্যহিক ব্যস্ততার ঘোরে যে জীবন কেবল সামনে এগোয়...তার হাত ধরে...নতুন পথে বন্ধুর সময়ে পথ চলা...... সেদিন না খেয়ে শুয়ে পড়লাম জানিস, কেউ এল না ডাকতে।

আচ্ছা, শ্বশুর শাশুরির একটুও কি মায়া মমতা হয় না পরের বাড়ির একটা মেয়ের জন্য। ওনারাও তো মানুষ- আমি কি অন্যায় করেছিলাম বলতে পারিস? কেন জানতে পারলাম না আমার কি অন্যায়?

আমার মতন কত মেয়ে এখনো এই রোবটের যুগে মার খাবে বলত? কি দোষ করেছিলাম আমি? কেন আমি এই শিকারের সম্মূখীন হলাম বল আমাকে? আমিও তো চেয়েছিলাম একটা সুন্দর জীবন, একটা মিষ্টি সংসার। এই চাওয়া আমার মতন সব মেয়েই তো চায়, তাই না রে? আমি যদি কোন দোষ করতাম আমাকে তো বলতে পারত অনুকল্প, না হোক ওর মা বাবাও। তারপরও না শুনলে না হয় আমার উপর অত্যাচার চালাত, আমি মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম এই ভেবে যে, আমার অন্যায়ের পুরস্কার।

কিন্তু আশ্চর্য কি জানিস, যে মাসিকে তুই দেখলি সেই মাসি পরের দিন ঘর পরিষ্কার করতে এসে আমাকে বললঃ “~বৌদি তুমি এত কষ্ট সহ্য করছ কেন? আমাদের মতন মুখ্যু সুখ্যু মানুষ তো নও। তবে কেন এত কষ্ট নিচ্ছ? আমরা গরীব হলেও সব বুঝতে পারি। তখন জানলাম আমাকে এই বাড়িতে কাজের মানুষগুলো চুপচাপ ভালবাসে। যে মনে একবার এসেছিল দুনিয়ায় আমাকে মা বাপি ছাড়া আর কেউ ভালবাসে না, সেই মন বলে দিল নাঃ ~ভাল মানুষ চারিদিকে ছড়িয়ে ছটিয়ে আছে। ভালবাসা এখনও আছে মানুষের মনে।”

আমি যেন নীরব শ্রোতা। সব কথা তখন কোথায় হারিয়ে গেছে আমার। ওর কথায় আবার ফিরে পেলাম আমার চৈতন্য।

প্রিয়াংকা তখনও বলে চলেছে ফোয়ারার মতন~~ “চিন্তা করলাম মাসির কথা, ওকে বললাম, “~মাসি আমার সাথে যাবে? তাহলে আমি একটা ভরসা পাই।

আমার মা বাপির কাছে আমি যাব না, এই বয়সে তাদের দুঃখ আমি বাড়াব না। তাদের জানতেও দেব না, তাদের প্রিয়ু ভীষণ পরীক্ষা দিচ্ছে। তারা তো বিয়ের পর থেকে কোনদিন আমার শ্বশুরবাড়িতে আসতেন না কারণ, আমার শাশুড়ি একদম তাদের পছন্দ করতেন না। আমার মা বাপি কিন্তু তাকে দেখতেন খুব স্নেহের চোখে, আমার আদর তখন মা-বাবার কাছে ভাগাভাগি হয়ে গেছিল। মা-বাপির তো অনুকল্পকে খুব পছন্দ হয়েছিল, খালি বলতেন আমরা একটা ছেলে পেলাম আর সেই ছেলের স্নেহেই তারা তাকে দেখতেন, আমার আদরে তখন ভাগ বসিয়েছিল সে। তাই হয়ত আমার শাশুমা ভয় পেতেন ছেলে হারাবার কথা ভেবে।। আজও জানি না কেন তারা আমার মা বাপিকে সহ্য করতে পারেন না। তাই মা বাপিরা আসত না আমার শ্বশুরবাড়ি। আমি তো কোন অন্যায় করি নি? আমিই যেতাম মাঝে মাঝে দেখা করতে কিন্তু শ্বশুর শাশুড়ি আমার বাপের বাড়িতে থাকা একেবারেই পছন্দ করতেন না। তাই সাত দিনের জন্য গিয়ে দেখা করেই চলে আসতাম।

কাজেই কোন সমস্যা হবে না বাপি মায়ের দিক থেকে ।

একদিন সব ছেড়ে চলে এলাম কলকাতার এই বাসায়। কেউ তো তখন বাধা দিল না ।

নিঃসন্তান মাসি এক কথায় রাজি হয়ে গেল। বলল, “আমিও মেয়েমানুষ বৌ্দি, আমার মেয়েকে কেউ এইভাবে কষ্ট দিলে কি আমি চুপ করে থাকতাম? না তাকে বাঁচাবার জন্য চেষ্টা করতাম? মা হলেই যে মানসিকতা জন্মায়, তা নয় বৌ্দি। আমি ভগবানের কৃপা থেকে বঞ্চিত, কিন্তু আজ তাঁদের দয়ায় মেয়ে পেলাম।”

জানিস তো সেই প্রথম আমি কাঁদলাম। মাসিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম বেশ খানিকক্ষণ। মাসি তার স্নেহমাখানো হাতের ছোঁয়ায় আমার মনকে শক্ত করে দিয়েছিল। এখন কি ভাবি জানিস, গরীবদের মন বলে একটা জিনিস আছে, কিন্তু টাকার গরম মানুষদের মন নেই, ওরা পাথর।”

আমি জিগেস করলামঃ ~ “অনুকল্প আর খোঁজ করে নি”?

“করেছিল মোবাইল ফোনে, তবে আমি আর আমার ঠিকানা চাইতেও ওকে দি নি। সে তার ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছিল, আমার দিক থেকে আর আমি সাড়া পেলাম না। কত স্ব্প্ন দেখেছিলাম তাকে নিয়ে, সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চূরমার করে দিল সে। একটা নতুন জিনিস তৈ্রি করতে যা সময় লাগে, ভাঙ্গা জিনিস গড়তে তার চেয়ে বেশি সময় লাগে এটাও আমি মনে করি পার্সোনালি। কিন্তু ভাঙতে এক সেকেন্ড, তাই না?

এইভাবেই সারা জীবন কাটিয়ে দেব ভাবছি। একটা প্রফেসর-এর পোস্ট খালি হয়েছিল বেথুনে, সেইখানেই ঢুকে গেছি। ভাগ্যিস একটু পড়াশুনা করেছিলাম। প্রেমে গা ভাসিয়ে দিই নি-আমার মতন যে সব মেয়েরা বিনা দোষে কষ্ট পায়, তাদের পাশে যদি দাঁড়াতে পারি, তবেই জীবনে আমার সার্থকতা আসবে, তাই মনে করি। তারপর না হয়, সারদা মঠে শেষ জীবনটা কাটিয়ে দেব।

আর না! আর না, অনেক হয়েছে এই ভাবি, সুখের দিন আমার কাছ থেকে চলে গেছে মা বাপির জন্য একটু সিঁদূর লাগাই যাতে তারা বুঝতে না পারেন।”-বলে ম্লান হাসল।

প্রিয়াংকা বরাবরই একটু রোমান্টিক ছিল, ভেবেছিলাম ওর হানিম্যুন -এর গল্পের মতন বিবাহিত জীবনের গল্পও শোনাবে যেটা নতুন কিছু মিষ্টি মধুর স্মৃতি। কত আশা নিয়ে এসেছিলাম বন্ধুর বাড়ি, কিন্তু এ-কি শুনলাম আমি?

খুব ভাল গান গাইত, এখন ও হয়ত গাইছে ওর প্রিয় গানঃ “ম্যায়নে তুঝকো দিল সে দিলহি দিয়া তুমহি শোচো তুম নে মুঝসে ক্যা কিয়া... ইয়ে তুম নে ক্যা কিয়া......।” বিছানা বালিস যেন ঢেকে আছে তার বকুলের আঘ্রাণে। সকলে একথা জানে ভালোবাসলেই শয্যা হয় তিক্ত মাটি, ভালোবাসা-বাসি ,ঝরে যায় প্রেমের ফুল, শরীরের সুখের সংজ্ঞাটি বদলাতে থাকে যেন একাদশী চাঁদ মুহূর্ত আগে, জ্যোৎস্নায় ভাসাভাসি-গা ঢলাঢলি, আবার মুহূর্তে অবসাদ......

শুনেছিলাম তার অবসাদ গুলো বাঁধানো ফটোর ফ্রেমে, আর শরীর পুড়েছে তার শুধুই আগুন প্রেমে এবং...

এখনও ভদ্র সমাজের ধনী পরিবার নিপীড়ণ করে চলেছে মেয়েদের আড়ালে আবডালে? আবার এরাই বাইরে 'নারী দিবস' পালন করছে ধুমধাম করে, বাড়ির বৌ্দের নিপীড়ন করে? এরা কবে বদলাবে?

যদিও জানি নিরবেই ঘটে সব কিছু, এতো মৌন, চুপচাপ, যেন সূর্য এসে পড়ার আগেই লাজুক রাত্রি লুকিয়ে নেয় নিজেকে আকাশের ওপাশে... ঠিক যেন প্রিয়াংকার মতন।

প্লেনে আসতে আসতে এই প্রিয়াংকার অসমাপ্ত গল্প-এর শেষ কি হবে ভাবতে ভাবতে নিজের সংসারের দেশ ডালাস পৌঁছে গেলাম।

অভিবাসী মনের ঘরে ফেরার টানে বার বার গেছি কলকাতায় কিন্তু আর দেখা হয় নি প্রিয়াংকার সাথে। বেলুড় মঠ, সারদা মঠেও খুঁজে বেড়িয়েছি তাকে, পাই নি তার দেখা।

কোথায় হারিয়ে গেল স্বপ্ন দেখা আরেক নারী। তিল তিল করে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় যে মন্দির সে মনের মধ্যে গড়ে তুলেছিল, সেখানে সে তার প্রিয় ও অপ্রিয় মানুষজনদের নিজের মনের মাধুরী মিশিয়েই প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু কোথায় গেল তার সাজানো মন্দির?

হয়ত ঠিকই দেখা পাব গোলাকার পৃ্থিবীর কোন এক কোণে। আমি আশার হাত ধরে হেঁটে যাই সময়বেলায়! পাশাপাশি! অথচ নিজের দেশ আমায় ভীষণ টানে! গঙ্গা নদীর পারে মেঘেদের সাথে ভীড় করে মন উড়ে যায়, কলকাতা এলেই! পাশে তাকাই, দেখি সমস্ত চরাচর জুড়ে সে একা...ভীষণ একা! হায়! একাকিনীর যে কোন বান্ধব থাকতে নেই, তাই তো এত সাধের নাম!

কিন্তু কী আশ্চর্য, কেউ বলতে পারে না, কোনদিক থেকে আসে নৈ্তিকতার সুর, হারিয়ে যাওয়া মানুষ, সেই সুর খুঁজতে খুঁজতেই তো ক্ষয়ে-বয়ে যায় আমাদের এক একটা জীবন। এক একটা স্মৃ্তি।