সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৩

ভারতকথা - শমীক (জয়) সেনগুপ্ত

সত্যবতী -২য় পর্ব

শমীক (জয়) সেনগুপ্ত



(৩)

দিনের সাথে সাথে মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নরা কেমন যেন ফিকে হয়ে আসে। মানুষের মন, সে সত্যি বিচিত্র। যে সত্য জানবার জন্য সে এতকাল মরিয়া হয়ে দাসরাজের কাছে এত অনুনয় করেছে আজ সেই সত্যই পিতা নিজে তাকে জানিয়ে দিলেন। নিজের জন্মের জন্য আজ তার ভারী লজ্জা অনুভব হয়, আর তারই সাথে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বাসা বাঁধে মনে। যে পিতা জন্মলগ্নেই পরিত্যাগ করেছে তাকে, ভবিষ্যৎ কেন সেই কামূক অধর্মীর নামে তাকে ডাকবে "উপচারিক-তনয়া" বলে ? সে অধিকার না আছে সময়ের আর না সে দেবে সময়কে। সারা পৃথিবী যদি জানে সে ধীবর-কন্যা, তবে সেই তার গৌরব।

ঋষি পরাশরকে আজ নিতান্তই কাপুরুষ মনে হল তার। উপচারিকের হাতে যেমন অদৃকা ভোগের বস্তু, মন ও প্রেমের কোন দাম নেই সেখানে - শুধু গর্ভসঞ্চারের এক মাধ্যম মাত্র, আজ পরাশরের জন্য তার নিজেকে তেমনই এক মাধ্যম মনে হল, যা শুধুমাত্র পুত্র ব্যাসের জন্মের জন্য প্রয়োজন!!

মন বারবার বলতে লাগলো "ছিঃ, ব্রক্ষ্মর্ষি । আমার জন্মদাতার মত তুমিও তঞ্চকতা করলে ?"

না, পরাশর তাকে শকল-সমাদৃতা থেকে মৃনালিনী করেছেন, শুধু তাই নয় ফিরিয়ে দিয়েছেন

তার অক্ষুণ্ণ কৌমার্য । কিন্তু সে ত এ সব চায়নি?? সুখী গৃহকোণ কি তবে তার জন্য নয় ?

চিন্তার সাথে যমুনার ঢেউ বলছে ছলাত-ছল। নদীর বুকেই নিজের কথা বলে হালকা হয় সত্যবতী।

রোজ তাই নদীর কাছেই কথা বলার সময় খেয়াল থাকে না কে তাকে সবার অলক্ষে দেখে চলে।

ভরতের বংশজ মহারাজ প্রতীপের কনিষ্ঠ পুত্র শান্তনু তখন হস্তিনাপুরের নৃপতি। ভাগ্য তার সাথেও শুধু খেলেই চলেছে। একে অসময়ে রাজত্বের গুরুভার কাঁধে নিয়েছিলেন অগ্রজ দুই ভাইএর পরিবর্তে; তারপর যাও বা একটু থিতু হলেন, দেবতারা এসে নিজেদের ভাগ্যের ডোর বাঁধতে লাগলেন তার সাথে, একেবারে অযাচিত ভাবে। প্রথমে পতিতপাবিনী দেবী জাহ্নবীর সাথে তার পরিনয়, আর পরবর্তী সময় অষ্টবসুদের তার সন্তান হয়ে জন্মানো ও জন্মলগ্নেই তাদের সলিল সমাধি স্ব-চক্ষে দেখা। মানুষ সে, তার ওপর পিতা। দৈব মানলেও সন্তানস্নেহ,তাকে এড়াবেন এ ক্ষমতা শান্তনুর কোথায়?

মহারাজের তৎপরতায় পুত্র দেবব্রত রক্ষা পেলেও সংসার গেল ভেঙে। জাহ্নবীকে সত্যি বড় ভালোবেসেছিলেন তিনি। তাই তার চলে যাওয়া শান্তনু কে পীড়া দিত,আর যা ভুলতে নির্জনে

গহীন বনে একা একা ঘুরে বেড়াত পিপাসার্ত প্রেমিক হৃদয়। মনের অচিরে প্রশ্ন থাকত, “যাবেই যখন, তখন এসেছিলে কেন?”

দেবব্রত এখন যথেষ্ট সাবালক। পিতার সাম্রাজ্য পিতার থেকেও ভালো সে সামলাতে জানে,তাই লোকসমক্ষে তাকে যুবরাজ হিসেবে ঘোষনাও করে দিয়েছেন মহারাজ শান্তনু। সুযোগ্য পুত্রের পিতা

সে, অহংকার করা তাকে সাজে,আর কিছুদিন পরই তিনি দায়মুক্ত হবেন। কিন্তু অভিলাস কি কিছুই নেই

প্রৌঢ় রাজপুরুষের মনে ?

তবে কেন এখনো বিজন প্রান্তরে উদ্ভ্রান্তের মত ভ্রাম্যমান হৃদয় শুধু বারবার ডাকে “জা-হ্ন-বী !!!”

নারী নয়, সংসারের আসক্তি বেঁধে রেখেছে তাকে। তাই জন্যই সবটা দিতে চেয়েও ভারী অপারগ সে।

আর দৈবাতই জাহ্নবীর মত অপরূপা সত্যবতীকে নদীর তীরে আবিষ্কার করে প্রেমাস্পদের মন। শান্তনু হয়ত বাঁচতে চেয়েছিলেন ?

(৪)

আজ হস্তিনাপুরের রাজপরিবার থেকে রাজা শান্তনুর বিবাহ-প্রস্তাব এসেছে ধীবর-পল্লীতে। দেবব্রত শুধুমাত্র সুপ্রশাসক বা পরম সৌর্যশালী নন,সুপুত্র ও বটে। পিতার অভিপ্সা জানতে পেরে নিজে এসেছেন সমবয়স্কা এক নারী কে মায়ের মর্যাদা দিয়ে বরণ করে নিয়ে যেতে। মাছ ভেড়িতে আঁশটে গন্ধের ভিতর তাকে জালের আড়াল দিয়ে দেখতে পেল সত্যবতী। যেন দুবাহু প্রসারিত শ্বেত-চন্দনের বৃক্ষ উন্নতশিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে

স্বপ্নের ওপার থেকে। বার্তা কি ছিল তাতে ,তা জানবার অবকাশ ছিল না... শুধু অজানা ছন্দে বুক উঠেছিল কেঁপে। মনে হল – “হা ঈশ্বর, এ কী আমার ভাগ্য ??”

আর সময়ও বলেছিল ধীরে সত্যবতী, ধীরে । এ ভাগ্য তোমারই ।

“দাসরাজ, আমি হস্তিনাপুরের যুবরাজ আপনার কন্যা সত্যবতীর জন্য রাজপরিবার থেকে বিবাহের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছি। আপনার কোন আপত্তি নেই ত ?” কানে বাজতে লাগল ভৈরবীর মিঠে তান । চঞ্চল মন বারবার বাধ্য করছে কুমারের দিকে দৃষ্টি-নিক্ষেপ করবার জন্য, কিন্তু বাঁধ সাধছে শঙ্কোচ আর প্রণয়ভীরু লজ্জার আরক্তিম আভা।

দাসরাজের কুমার দেবব্রতের প্রতি সম্ভ্রম ও বাৎসল্যে ভাঁটা পড়লো এটা জেনে যে পাত্র কুমার নন, বৃদ্ধ মহারাজ। জোড়া ভুরুর মাঝখানে শঙ্কা আর অনিশ্চয়তার কালো ছায়া কুঞ্চনের মধ্যে দিয়ে দেখা দিল। অন্যপ্রান্তে সদ্য প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের শিখাও ম্লান হতে থাকে।

দূরে কোথাও, বহুদূরে মন বলে উঠলো “ব্যর্থ যৌবণ ।”

দাস-জেলে, মাছ ধরা তার পেশা। মানুষের মন ধরা নয়। দেবব্রতের নিষ্কলুষ মনকে ধরার মত জাল তার ছিলনা। গঙ্গাজলকে ধরে রাখতে গেলে বিশ্বাসের কমন্ডুলুই যথেষ্ট, বিশাল বাপীর দরকার পড়ে না। কিন্তু সে চিন্তা যদি দাস করবে তবে ত আর মহাভারত হবে না,তাই সময়কে সময়ের কাজ করতে দিয়ে দাস উদ্বেগ প্রকাশ করলো, “যুবরাজ, সত্যবতী আমার পালিতা কন্যা, আসলে সে চেদীরাজ উপচারিকের পুত্রী যাকে জন্মলগ্নেই পিতা ত্যাগ করে মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে, তাই আমি পিতা ও মাতা দুই ভূমিকাতেই তাকে পালন করেছি। আজ যদি বিবাহের পর,ঈশ্বর না করুক মহারাজ মারা যান, সে ক্ষেত্রে আপনি রাজা হলেও ঐ রাজ্যে আমার কন্যার অবস্থান কোথায় থাকবে? সে ত আবারো উপেক্ষিতাই থাকবে। কারন রাজমাতা হবার যোগ্যতা ত আর তার থাকবে না।”

মৃদু হাসলেন গাঙ্গেয় দেবব্রত।

অসম্ভবকে জয় করবার পণ করে এসেছিলেন দেবব্রত। পিতার সুখের জন্য ত্রিলোক ও প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে অঙ্গীকার করলেন যে আজীবন অকৃতদার থেকে রাজ-সিংহাসনের রক্ষা করবেন ও সত্যবতীর সন্তান ও তার সন্তানদের রাজ্যভোগ করতে দেবেন।

এই ভীষণ প্রতিজ্ঞায় স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে আলোড়ন সৃষ্টি করে দেবশঙ্খনাদে মুখরিত হয়ে উঠলো চারিধার, আর এক অলৌকীক কান্ড ঘটে গেল নিমেষের মধ্যে। রাশি রাশি ফুল ,কত নাম না জানা অনুভূতির আশীষ-বার্তা সাথে নিয়ে বর্ষিত হল কুমারের শিরে। দেবতারা জয়-গাঁথায় মাতিয়ে দিলে দশদিক আর দৈববানী হল –“কুমার, পিতার সুখের জন্য যে কঠিন ব্রত তুমি নিলে ,তাতে তোমার দেবব্রত নাম যেমন স্বার্থক হল,তেমনভাবেই এই ভীষণ প্রতিজ্ঞার জন্য সসাগরা বসুন্ধরায় তুমি ভীষ্ম নামে খ্যাত হও ।”

সত্যবতী জালকের আভরণে এতক্ষণ আবদ্ধা ছিলেন। কিন্তু এ যে অন্যায় হতে চলেছে ন্যায়-প্রিয় এই মানুষটার সাথে। আজ শুধু তার জন্য এক রাজ্য হারাবে নিজের পরম প্রতাপী ধার্মিক এক রাজাকে, পিতা চিরজীবন তার সন্তানের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবে আর সব কিছুর নিমিত্তে জড়িয়ে থাকবে একটাই নাম-

“সত্যবতী”।।

বেড়িয়ে এলেন ধীবরকন্যা সত্যবতী,কিন্তু তার চলনে বলনে আজ জন্মসূত্রে প্রাপ্ত আভিজাত্য ও সম্ভ্রম চোখে এড়ালো না গঙ্গানন্দন ভীষ্মের। ধীর কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে শ্রুত হল, “দাঁড়াও যুবরাজ, ফিরিয়ে নাও নিজের প্রতিজ্ঞা।

মহারাজকে বিবাহ করবার জন্য আমি তোমার জীবন নষ্ট করতে পারিনা । এত স্বার্থপর আমি হতে পারবো না।”

মুহুর্তের মোহের আবরণ ঘুচে এই নারী মনে এখন বাৎসল্যের মধু মাখা অনুভূতি। মায়ের মন যেমন সন্তানের ক্ষতি কামনায় অক্ষম, সত্যবতীর কাছেও আজ ভীষ্মের শুভাকাঙ্খাই করে চলেছে বারবার, তাতে নাই বা হল রানী হওয়া !! প্রেম নয়, মোহ নয়, শুধু পিতাকে ভালবেসে পুত্রের এই আত্ম-ত্যাগে ভীষ্ম জয় করেছে তার নারী-সত্ত্বাকে,বেঁধেছে স্নেহ ও শ্রদ্ধার বন্ধনে। অপরদিকে সত্যবতীর আভিজাত্য ও মাতৃসুলভ আচরনে ভীষ্মও বুঝেছেন তিনি ভুল করেননি। আর ভাগ্যের হাতে কাঠপুতুলীর মত নাচতে থাকা দাসরাজের মন নিরন্তর আশঙ্কিত হতে থাকে ও সত্যবতীর উদ্দেশে বলতে থাকে “মূর্খ।”

রাত্রি ত্রিযামা, আকাশে বাঁকা চাঁদ এবার নিদ্রামগ্ন হতে চাইছে.. আর অপেক্ষা করে আছে ঊষশীর জন্য। শীত চলে গেলেও হিমেল হাওয়ায় তার রেশ ছেড়ে গেছে। হার মানলো সত্যবতী। পিতার অভিসন্ধি বা রাজার ইচ্ছের কাছে নয়, মায়ের মন হার মানলো পুত্রের আব্দারের কাছে। দাসরাজকে প্রণাম জানিয়ে মাতা-পুত্র চলল হস্তিনাপুরের পথে। আর সময়-

তার এখনো অনেক কিছু বলা বাকি ।।

(ক্রমশ)



0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন