সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ, ৯ম সংখ্যা



সম্পাদকের কলম থেকে

যা দেবী সর্বভূতেষু বিদ্যারূপেন সংস্থিতা
নমস্তসৈঃ নমস্তসৈঃ নমস্তসৈঃ নমো নমঃ

বন্ধুরা,
ভাল আছেন তো?

আবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মে শরৎ আসে। আসে উৎসবের দিনগুলি। প্রকৃতি হয়ে ওঠে মোহময়, স্বতঃস্ফূর্ত সৌন্দর্যে পৃথিবী নেচে ওঠে, বয়ে যায় হৃদয়ে হৃদয়ে ফল্গুধারা। সেই ধারার সাথে মেলবন্ধনে ফিরে এলাম আমরা। শারদীয়ার আগাম প্রতিশ্রুতি নিয়ে।

সফল কি না সে খবর আমাদের জানা নেই, কিন্তু সবার আন্তরিকতা ও ভালোবাসার সহজ সরল বন্ধনে এই প্রচেষ্টা যে সব দিক থেকে সুন্দর এ কথা স্বীকার করতেই হবে। সে ক্ষেত্রে "সৌকর্য" নামটা স্বার্থক।

ঠিক ধরেছেন বন্ধুরা আবার প্রকাশিত হল আপনাদের ভালোবাসার "সৌকর্য"।।

প্রবীণ ও নবীন সাহিত্যিক ও সাহিত্যানুরাগী মানুষজনকে একসঙ্গে একসুত্রে গাঁথার চেষ্টা করে এই সৌকর্যের জন্ম। তাই এই মিলন মেলায় যেটা সব থেকে বেশী চোখে পড়ে , তা হল এক সাথে একাধিক প্রজন্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাহিত্যের রস উপভোগ করছে ও তারই সাথে নতুনকে খুঁজে এনে তাদের সৃষ্টিকে সবার সামনে প্রকাশ করছে।

আমাদের বিশ্বাস, পুরোন না থাকলে নতুনের জন্ম সম্ভবপর নয়, নিজেদের ঐতিহ্য ও দর্শনকে না জানলে, না বুঝলে সেই চেতনায় কোথাও না কোথাও একটা ফাঁক থেকে যায়। তাই সেই কথা মাথায় রেখেই এবারের সৌকর্যে থাকছে কিছু বিশেষ আকর্ষণ।

১. বহু পুরোন কোন কবির কবিতা
২. ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার, পরম্পরা
৩. ভারত-কথা,
তা ছাড়াও কবিতা - গল্প - ভ্রমণ-রম্যরচনা ও প্রবন্ধের সমাহারে সেজে উঠেছে আমাদের সৌকর্য । আপনাদের সবার সাথে হাতে হাত রেখে ভবিষ্যতের এক সুন্দর ও বলিষ্ঠ অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করুক সৌকর্য , এটাই কাম্য।

সবাই ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন.... সুস্থ রাখুন নিজেকে ও নিজের চারপাশকে ।। পূজোর গন্ধকে ছড়িয়ে দিন ধনী থেকে দরিদ্রে, মানুষ থেকে মানুষে, মন থেকে মনে।

আগমনীর প্রীতি ও শুভেচ্ছাসহ......

ধন্যবাদান্তে
সৌকর্য সম্পাদক-মন্ডলী

প্রবন্ধ - শ্রী শুভ্র

জন্ম যদি তব বঙ্গে
শ্রী শুভ্র


বহু যুগ আগে বৃটিশ শাসনের সেই পরাধীনতার কালেই প্রমথ নাথ বিশী বাঙালী জাতির প্রকৃতি সম্বন্ধে আলোচনা কালে বলেছিলেন, বাঙালীর মোটো হচ্ছে- "এসো ভাই টেনে নামাই"! এস ওয়াজেদ আলীর ভাষায় বলা যায়, "সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলছে!" দেখা যাচ্ছে দেশ স্বাধীন হলেও বাঙালীর রীতি বদলায় নি! শোনা যায় দয়ার সাগর বিদ্যাসগর, যাঁর কাছে উপকৃত হওয়া বাঙালীর সংখ্যা মোটেও নগণ্য নয়, শেষ জীবনে কারুর কাছে আঘাত পেলে বলতেন, "ওহে মনে তো পড়ে না কস্মিনকালেও তোমার কোনো উপকার করেছি কিনা!" বাঙালীর কৃতজ্ঞতা বোধ তার স্বজাতি প্রীতির মতোই দূর্লভ বলা চলে! শ্রী চৈতন্য থেকে শুরু করে অনেক মহাপুরুষেরই সেই উপলব্ধি হয়েছে হাড়ে হাড়ে!

বাংলার ইতিহাস বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস! বাঙালীর ইতিহাস আত্মঘাতী ইতিহাস! বঙ্কিম চন্দ্রের লোক রহস্যের বাবু বৃত্তান্ত থেকে নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর আত্মঘাতী বাঙালী পর্যন্ত বাঙালীর পরিক্রমণে স্বয়ং বিধাতাও বোধ করি বারংবার বিষম খেয়ে অস্থির হন! বস্তুত বিবাদ বিসংবাদ বিদ্বেষ বাঙালীর মজ্জা গত! স্বজাতির সাথে কলহে আমরা যেমন পারদর্শী বিদেশীর সাথে গলাগলিতেও ততোধিক উৎসাহী! পরজাতির সাথে প্রীতি বিনিময় সৌহার্দ স্থাপন দোষাবহ নয়! কিন্তু ভয়াবহ আমাদের বিদেশী সংস্কৃতির অনুকরণ প্রীতি! বৃটিশ আমলে আমাদের মক্কা ছিল লন্ডন! একবার ঘুরে আসতে পারলে জীবন ধন্য হয়ে যেত! এখন হয়েছে গ্রীণকার্ড! যা না হলে সমাজে মান থাকে না! বষ্কিমচন্দ্রের ভাষায় পর ভাষা পারদর্শীতায়, মাতৃভাষা বিরোধীতায় ও পর জাতি নিষ্ঠীবনে পরিতৃপ্তিতে বাঙালীর সহজাত প্রতিভা সহজেই উন্মীলিত হয়!এহেন বাঙালী যে (ইংরেজী হিন্দী না জানা) স্বজাতি বিদ্বেষী হবে সে কথা বলাই বাহুল্য!

নকল নবিশ অনুকরণ পটু মুখস্ত বিদ্যায় ডিগ্রী ধারী বাঙালী স্বভাবতই পরশ্রীকাতর ও ঈর্ষান্বিত চরিত্রে বলশালী! তাই দূর্বলের কাছে অত্যাচারী সবলের কাছে বিনীত, সহধর্মীর কাছে মুখে হাসি আর পিছনে ছুরি বাঙালীর স্বভাব প্রকৃতি! বস্তুত কাঁকড়া প্রজাতির সংস্কৃতিতেই বাঙালীর জন্ম! তাই বিশী কথিত সেই "টেনে নামানো"র প্রয়াসে বাঙালীর উদ্যমে কোনদিন কোনো ঘাটতি ছিল না, আজও নেই! বিখ্যাত সাহিত্যিক যাযাবর একবার বন্ধু সমারোহে গুরু দেব রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাত করতে গিয়ে বিশ্বকবির কাছে বিনীত প্রশ্নে জানতে চেয়েছিলেন, কবির "সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে" গানটি কবি তার শেষ জীবনে লিখলে কি একই ভাবে লিখতেন? উত্তরে বলেছিলেন বাংলার সর্ব কালের সর্ব শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, "এখন লিখলে সার্থক কথাটা কেটে দিতাম!" আশি বছরের জীবন অভিজ্ঞতার কি নিদারুণ উপলব্ধি! দয়ার সাগর বিদ্যাসাগরের আক্ষেপের মতোই কি তীব্র ভয়াবহ! যদিও তখনও কবি জানতেন না তাঁর সেই কবি কল্পনার সোনার বাংলা খুব শীঘ্রই কেটে দু টুকরো করা হবে! আর সেই বিদেশী ষড়যন্ত্রে হাত লাগাবে তাঁরই স্বজাতির বিশিষ্ট জনেরা! হয়ত তাঁরই স্নেহভাজন কেউ কেউ!

১৯৪০ সুকান্তের কলম থেকে জন্মাল, "অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি, জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি" আর আমরা যারা আজ জীবনের অর্ধশতাব্দী পাড় করছি তারা আরও অনেক বেশি অবাক হয়েছিলাম জ্ঞান বুদ্ধির প্রথম উন্মেষ লগ্নেই, "জন্মেই দেখে ভঙ্গ বঙ্গভূমি!" কি বিচিত্র এই দেশ! ১৯৮৯, বার্লিন প্রাচীর ভেঙ্গে মিলন হল দুই জার্মানীর! আমরা উদ্বুদ্ধ হলাম না তবু! কারণ আমরা তো জানি বিচ্ছেদই আমাদের মন্ত্র! বিভেদেই আমাদের শক্তি!

বিধর্মী স্বজাতি আমাদের বিদেশী! তাই কাঁটা তারের দংশন দহনের সীমারেখার দুই পাড়েই শৈশবাভ্যস্ত গ্রন্থগত পাণ্ডিত্য, বাক্যে সরস্বতী ও কলহ প্রিয় পরধন লোভে মত্ত বাঙালিকুল, কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কুল কুল হয়ে আজও বিভক্ত!ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে ৪৭এর বাংলা ভাগে কোটি কোটি বাঙালী হিন্দুর নিজের জন্মভূমি পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়ে সহায় সম্বলহীন ভাবে দেশ ত্যাগ করে উদ্বাস্তু হয়ে এ পাড়ে চলে আসার মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব আর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার প্রতি অন্ধ আনুগত্য স্পষ্টতই চোখে পড়ে!

কিন্তু বিষয়টা আবার এতটা সরলও নয়! মূলত বৃটিশের নির্দেশে ও সহায়তায় লাগানো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বাঙালী হিন্দুরা মুসলিম শাসনের অধীনে নিরাপদ নয় আশংকা করেই এই দেশ ত্যাগ! অর্থাৎ ইউরোপের জাতিগুলি যেখানে দেশপ্রেমের প্রয়োজনে প্রাণ ত্যাগেও ভীত ছিল না, বাঙালী সেখানে প্রাণ বাঁচানোর জন্যে দেশ ত্যাগেও পিছপা নয়! আপনি বাঁচলে দেশের নাম!বাঙালীর দেশপ্রেমের কথা বলতে গেলে গোলমাল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি! দেশ সম্পর্কে বাঙালীর ধ্যান ধারণা রীতিমত গবেষণার বিষয়! যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির অনেক আগে দেশ ছিল চলা ফেরা জানা শোনার গণ্ডীর সীমানায় আবদ্ধ! তার বাইরে সবটাই বিদেশ!আর আধুনিক সভ্যতায় দেশ পাসপোর্টের পরিসরে নির্দিষ্ট! আবার বৃটিশ আমলে বাংলার তথাকথিত নব জাগরণের সোনালী দিনে বাংলায় দেশ বলতে বর্ণহিন্দু দের দেশ বোঝাতো, শিক্ষিত সমাজে! অন্যদিকে বাঙালী মুসলিম সমাজে শিক্ষা প্রসারের সাথে সাথে দেশ হয়ে ওঠে ইসলামিক! যার মধ্যে মক্কা ,মদীনা, আরব্য রজনীও হয়ে ওঠে বাংলা! ফলে দেশপ্রেম হয়ে ওঠে মুলত সম্প্রদায় প্রেম! অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক!মাটির সাথে সম্পর্ক হীন!ফলে বাংলার শিকড়ের সাথে, বাংলার ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের সাথে বাংলার হিন্দু মুসলিম কোনো সম্প্রদায়েরই কোনো আত্মিক যোগ গড়ে ওঠে নি কোনো কালেই!

আর এইটি বুঝতে পেরেই সুচতুর বৃটিশ যখন বাঙালীর মেরুদণ্ডটিকে চিরকালের মতোই ভেঙ্গে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করল তখন দুই একজন ছাড়া বাংলা ভাগের কারণে অশ্রুপাত করার মত বাঙালী খুঁজে পাওয়া গেল না! হিন্দুরা ভারতবর্ষের স্বাধীনতায় উদ্বেল হল! মুসলিমরা পাকিস্তানের! বাংলা যে স্বাধীনতা পেল না, সার্বভৌম অখণ্ড দেশ রূপে বিশ্ব সভায় আত্মপ্রকাশ করল না, তাতে সেদিনের বাঙালীর কিছুই এসে গেল না! বৃটিশরা শুধু মুচকি হাসল!অন্যদিকে বাংলার নিয়তির নীরব অশ্রুপাত কারুরই দৃষ্টিগোচর হলো না!বাংলার নিয়তির সেদিনের নীরব অশ্রুপাতের আংশিক প্রায়শ্চিত্য করতে হল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীকে তিরিশ লক্ষ প্রাণের মূল্যে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতায়! তারপর চার দশকের সময় সীমায় সরকারী সৌজন্যে ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের নিরন্তর ধর্ষণে আজ বাংলাদেশের বাঙালীকে হতে হয়েছে বাংলাদেশী! মৌল বাদ ও সম্রাজ্যবাদের যুগল বন্দীর সাঁড়াশি আক্রমণে সেখানে আজ শাহবাগ আন্দোলনকে শিখণ্ডী করে দেশ ভাগ হয়ে গিয়েছে আস্তিকে আর নাস্তিকে! বাঙালী হয়ে গেলেই বিপদ! নিশ্চিন্তে থাকতে গেলে হতে হবে বাংলাদেশী! ভারতীয় উপমহাদেশের সুপ্রাচীন সভ্যতার সাথে যে নাড়ির স্পন্দন রয়ে গিয়েছে বাংলার অস্তিত্বে, ভুলতে হবে সেকথা! ভাবতে হবে মক্কা মদীনার ঐতিহ্য!

এ পাড়ের বাঙালীকে অবশ্য তেমন কোনো সংশয় দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি! কারণ এ পাড়ে বাঙালী এখন ভারতীয় হয়ে সানন্দা! একটু প্রাগ্রসররা, গ্রীণকার্ড হোল্ডাররা অবশ্য নিজেদের বিশ্ব নাগরিক ভেবে আত্ম প্রসাদ লাভ করেন বেশি! আমরা এ রাজ্যে কেউ ভারতীয় হিন্দু, কেউ ভারতীয় মুসলমান! ভুলেও কেউ নিজেদের বাঙালী জাতীয়তা নিয়ে আর গর্ব অনুভব করি না, পাছে কেউ আমাদের প্রাদেশিকতার দোষে দোষী করতে পারে!একটু গভীরে ঢুকলে দেখা যাবে বাঙালী জাতীয়তা অনেকটাই সোনার পাথর বাটিতে কাঁঠালের আমসত্বর রসাস্বাদন করার মতো! পূর্বেই বলেছি বাংলার নব জাগরণ ছিল বর্ণহিন্দু দের জাগরণ; যার অভিমুখ ছিল ভারতীয় হিন্দুত্বের সনাতন ঐতিহ্যের দিকে!

শিক্ষিত প্রাগ্রসর বাঙালী হিন্দু যেমন ভারতীয় সনাতন হিন্দুত্বের প্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যে নিজের আত্ম পরিচয়ের সন্ধান করল, ঠিক তেমনই শিক্ষার বিস্তারের সাথে সাথে বাঙালি মুসলিম আরবের ইতিহাসে, ইসলামের অনুশাসনের মধ্যেই নিজেদের আত্ম পরিচয় আছে ভেবে আত্ম প্রসাদ লাভ করল! উভয় সম্প্রদায়ই বিস্মৃত হল তার বাঙালী জাতিসত্ত্বার সাধারণ ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার! কি বিচিত্র এই জাতি! বাঙালী হিন্দু ভুলে গেল, সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যের
উত্তরাধিকারী হয়েও বাঙালী একটি স্বতন্ত্র জাতি! ভারতের অন্যান্য জাতির থেকে ভিন্ন সংস্কৃতির ধারক! তার এই ভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে, আপন মাতৃভাষায় সে যে এক স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বা সে কথা স্মরণে রইল না তার!বাংলার ইতিহাসে শতাব্দীব্যাপি বর্ণহিন্দু দের দ্বারা অত্যাচারিত নিম্ন বর্ণের হিন্দু ধর্মান্তরিত মুসলমান হয়ে ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের
মধ্যে আশ্রয়ের সন্ধান করল! কিন্তু উচ্চ বর্ণের হিন্দুসমাজের হাতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণ অব্যাহত থাকল শতাব্দীব্যাপি! ফলে শিক্ষার বিস্তারের সাথে বাঙালী মুসলিম তার স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে চাইল আরবের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যে! ইসলামের কঠোর অনুশাসনের মধ্যে নিজেকে ব্যাপৃত রেখে হিন্দু সমাজের বেষ্টনীর পরিধির বাইরে আপন অস্তিত্বের ভিত্তি গড়ে তুলতে গিয়ে ভুলে গেল ইসলাম সম্পূর্ণ ভাবেই বিদেশী ধর্ম! ভিনদেশী সংস্কৃতির ধারক! খৃষ্ট ধর্মের মতোই! বাংলার জলবায়ুর সাথে সম্পর্ক হীন!বাঙালী হিন্দু নিজেকে যতই ভারতীয় বলে মনে করুক ভারতের অন্যান্য জাতির হিন্দুত্ব থেকে বাঙালী হিন্দুর আচার বিচার ধর্মীয় অনুশাসন সামাজিক রীতিনীতি প্রবল ভাবেই স্বতন্ত্র! এবং সেখানেই তার বাঙালিয়ানা! দুঃখের বিষয় ইসলামের গঠন তন্ত্রে বাঙালী মুসলিম এই রকম স্বতন্ত্র কোনো বঙ্গীয় মুসলিম সংস্কৃতি গড়ে তোলার অবকাশ পায়নি! তাই সেই অর্থে আজও হয়ত তার স্বতন্ত্র বাঙালিয়ানা গড়ে ওঠে নি! এবং গড়ে ওঠার পরিসরগুলিও রাজনৈতিক ভাবেই রুদ্ধ করে দেওয়ার প্রবল প্রয়াস দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে বই কমেনি!

বর্তমানে বাংলাদেশে মৌলবাদী প্রবণতা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে বাঙালী মুসলিমের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আজ ইসলামের হাতেই বিপন্ন!অন্যদিকে বিশ্বায়নের বিপুল ঢক্কা নিনাদে বর্তমানে শিক্ষিত বাঙালিকুল কেউ আর বাঙালী থাকতে রাজী নয়! সবাই এখন গ্লোবাল ভিলেজে পা রাখতে তৎপর! যে কারণে শিক্ষিত মাত্রেই গ্রীণকার্ডের জন্যে মরিয়া! কারণ বাঙালীর গ্লোবাল ভিলেজ এখন মার্কিন মুলক! এবিষয়ে উভয় বঙ্গের মধ্যে মানসিকতার মিল লক্ষণীয়!আর উচ্চ শিক্ষিত এই বঙ্গ সন্তানদের বাইরে যে বিপুল জনগোষ্ঠী তারা পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় আর বাংলাদেশে বাংলাদেশী! হিন্দু আর মুসলমান! বাংলার নিয়তি তাই আজও একটা দুটো বাঙালীর মুখ দেখার জন্য করে চলেছে নীরব অশ্রুপাত! কতযুগ আগে মধু কবি আত্ম বিলাপ করেছিলেন, "পরধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি!"
অথচ বঙ্গের ভাণ্ডারে যে বিবিধ রতন ছিল তার খোঁজ করতে গেলে এবং বিশ্বের দরবারে সেই আত্ম পরিচয়ের দৃঢ়তর প্রত্যয়ে আত্মপ্রকাশ করতে গেলে, যে জাতীয়তাবোধে দৃপ্ত হতে হয় (বিশ্বের প্রত্যেকটি উন্নত জাতির মতো); বাঙালীর তা কোনো কালেই ছিল না! এবং বাংলা ও বাঙালীর চিরন্তন অভিশাপ যে, আজ পর্যন্ত কোনো মনীষী বা নেতা বাঙালীকে জাতীয়তাবোধে দীক্ষিত করেন নি! না, স্বয়ং বঙ্গবন্ধুও নয়! কারণ বাঙালীর জাতীয়তাবোধ খণ্ড বাংলাকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে না! কখনোই না! আর স্বাভাবিক কারণেই তা কখনো গড়ে ওঠে নি বাঙালী মানসে! কারণ দুই হাজার বছরের এই জনপদে অখণ্ড বাঙালিয়ানা কোনো কালেই ছিল না! শ্রেণী বিভক্ত সমাজ অসাম্যের ভিত্তিতে বিভক্ত ছিল বরাবর!

তাই বাঙালী হয়ে জন্মালে বিচ্ছিন্নতা বিভেদ বিদ্বেষের অভিশাপ নিয়েই জন্মাতে হবে! সেই সূত্রেই বাঙালী চিরকাল ধনবান ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বশ্যতা স্বীকার করে, তার ভাষা সংস্কৃতি ধর্ম অনুকরণ করে স্বজাতির মধ্যে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে আত্মপ্রসাদ লাভ করে! এটাই বাঙালীর ধর্ম! আর এই একটি বিষয়ে কি হিন্দু কি মুসলমান, কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিত, কি ধনী কি নির্ধন সবাই সমান! আর এই কারণেই বিশ্বকবি আক্ষেপ করেছিলেন, "রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করনি!" সারা জীবনের অভিজ্ঞতায় বলতে বাধ্য হয়েছিলেন "সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে" শেষ জীবনে লিখলে কেটে দিতেন সার্থক কথাটি! এতটাই অ সার্থক আমাদের বাঙালী হয়ে জন্মানো!

ভ্রমণকাহিনী - অরিন্দম চক্রবর্তী

তিনদিন তিনকন্যের সঙ্গে
অরিন্দম চক্রবর্তী

পর্ব - ১
জুতোর স্ট্র্যাপে তামাম পিছুটান


- অরিন্দম, ঘুরতে যাবি?

- না, হবেনা, বস্‌।

- কেন, সমস্যা কী?

- একটা দুটো হলে বলা যায়, ১কোটি ৩৩ লক্ষ এক... বিয়ে'ত করিসনি, করলে বুঝতিস।

- বৈবাহিক সমস্যা হলে এককথা; কিন্তু পারিবারিক সমস্যা হলে'ত বলাই যায়, বিয়েনা করলেও তো পরিবার আছে সকলের...

- আরে একটা কোন মাস নেই বছরে, যে মাসে নিয়মমাফিক ন্যূনতম খরচা ছাড়া কিছু হয়না...

- কী রকম?

- আরে যেমাসে এল.আই.সির প্রিমিয়াম নেই, ছেলের

স্কুলের মাইনে নেই....ঘরে সেরকম কেউ অসুস্থ হয়নি (মানে বদ্যির পিছনে টাকা ঢালতে হল'না) একটু স্বস্তি, সেইমাসে কোত্থেকে কী হয়ে কম্প্যুটারটা বসে গেল...ব্যস ঢুকে গেল... ছাড়্‌ ওসব হবেনা... পুরী দীঘা হলে চ’ আছি। অন্য কোথাও নয়।

- মনোহরপুর যাবি? কোয়েলেরকাছে । সেখান থেকে কিরিবুরু, মেঘাতাবুরুর পাশে...

শোনা মাত্র মনকেমনের শুরু। মুখে না বললেও মন কিন্তু না শুনছে না...

ভারতের আফ্রিকা! শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্য।বুদ্ধদেব গুহ থেকে ডাঃ বৈদ্যনাথ গাঙ্গুলি তখন দরজায় কড়া নাড়ছেন...

আদিম গন্ধ নাকে লাগছে।মন চাইছে দেখতে সেই জায়গাটা – যেখানে সকাল হয়না, সকাল আসে।কীভাবে আসে সে...?

আবার হিসেব নিকেশ শুরু হয়।অঙ্ক গরীবের খুব চেনা বন্ধু, সে পাশে এসে দাঁড়ায় পিঠে হাত রেখে বারণ করে আর প্রেম (বা প্যাশন) মানুষের চির শত্রু- সে বারণ না শুনতে বলে...

লড়াই চলে শুম্ভ-নিশুম্ভের।

মন তো কার্ণিক খেয়েই ছিল হ্যাঁ-র দিকে ,মুখও এইবার আস্তে আস্তে । তাই কয়েকদিনের মধ্যে সবচেয়ে খতরনাক কাজটা করে ফেললাম...রাত্তিরবেলা খাওয়ার টেবিলে কথাটা পেড়ে ফেললাম-

-ভাবছি এইবার একটু মনোহরপুর যাব...

-সেটা আবার কোথায়?

-ঐ তো কাছেই জামশেদপুরের (ইচ্ছে করেই ঝাড়খন্ড বলিনি, কেন বলিনি সে পরের কথোপকথন থেকেই বুঝবেন)

-এই'ত কয়েকদিন আগে ঘুরে এলি ওখান থেকে, আবার কেন?

আরে বাবা বড় জায়গানা, একবারে কী সব দেখা যায়! ভেঙে ভেঙে দেখতে হয়, তাই।

ঘরে শত্রুর অভাব নেই, হট্‌ করে সত্যবতী সেজে একজন বলে বসল- এই যে কাল বললে ওটা ঝাড়খন্ডে... সেখান থেকে সারান্ডা রেঞ্জ কাছে....

কথাটা পড়ল খাওয়ার টেবিলে, স্বপ্নভঙ্গের ধ্বনি-চিত্র একেবারে সামনে...

-না! ওখানে যাওয়া হবেনা । মাওবাদী এলাকা। ডেন একটা। রোজ খুন...গুলির লড়াই, অপহরণ, রেললাইন ওড়ানো, ল্যান্ডমাইন... না, হবে না। আমরা বেঁচে থাকতে হবে না । মরে গেলে যা খুশি করো।

আমি জানি, এই সব সময়ে বলে লাভ নেই।মানবে না।দশ-বিশটা ref. এনে হাজির করবে...সেই কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী কবে কোথায় কী হয়েছিল সঅঅব...।সমুদ্রস্নানের অভিজ্ঞতা বলে ঢেউ যখন প্রবল বেগে পারের দিকে আসছে তখন হয় 'ডুব দে মন কালী বলে' নইলে শরীরটা ভাসিয়ে দে...মুখোমুখি দাঁড়াতে গেলে বিপদ।

২৪ ঘন্টা মনমরা , জীবনে আর বনে কোন তফাৎ নেই মার্কা দৃষ্টি , 'ATM ব্যতীত আর'ত কিছু নয়' গন্ধ মাখা দীর্ঘশ্বাস ছড়াতে লাগলাম।দীর্ঘশ্বাস বড় সংক্রামক ।কাজ দিল।শেষ পর্যন্ত বলল,

'ভেবেছিস যখন যাবি যা। আমাদের কপালে যা লেখা আছে তা তো হবেই...'

প্রস্তুতি শুরু হ'ল। ট্রেনের টিকিট, থাকার ব্যব্স্থা ইত্যাদি ইত্যাদি... প্রাক্‌ভ্রমণ কথোপকথন, চিরাচরিত চেনা সংলাপের আনাগোনা - 'চারদিনের জন্য নিজের চারটে কবিতার বই যাবে, অথচ আমার দুটো শাড়ি বেশি নিলে ওজন বেড়ে যাবে!!'

ওই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় শাড়ি দেখবে কে? এই প্রশ্ন মনে এলেও মুখে আনিনি, কারণ বাঙালি মহিলারা শাড়ি প্রদর্শনের জন্য সুমেরুর ঠান্ডাকেও অগ্রাহ্য করতে পারে...

দেখতে দেখতে যাওয়ার দিন এসে গেল...বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ মন্ত্র কানের সামনে আওড়ে গেল দু'জনে--

- রাত্রে রিসর্ট ছেড়ে বাইরে যাবেনা ।একা একা ঘুরবেনা, উল্টোপাল্টা খাবেনা ,'দাদুর' দিকে নজর রাখবে ।নিজেরা আনন্দ করতে গিয়ে সব ভুলে যাও...ইত্যাদি ইত্যাদি।

এইসব টপকে সুবোধ বালকের মতন ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম।বাঁক নিতেই চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল দু'জন।মন খারাপের একটা পাতলা আলোয়ান উড়ে এসে পড়ল গায়ে...

এটা হয়, যখন-ই কোন প্রিয় মানুষ কে বিদায় জানাতে যাই বা নিজে দূরে যাই প্রিয় মানুষদের ছেড়ে তখন-ই মনে হয় এই বুঝি শেষ দেখা হ'ল, আর যদি দেখা না হয়...

তার মধ্যে ঝাড়খন্ড যাওয়ার ভয় তো আছেই, তাই উটকো দু'একটা মন খারাপের দৃশ্য ভিস্যুয়ালাইজ করতে থাকি...করতে করতে-ই পৌঁছে যাই আজকাল পরশুর চিরন্তন মিটিং স্পটে- হাওড়ার বড় ঘড়ির নীচে।

তখনও আমাদের দলের অন্যরা আসেনি। ব্যস্ত হাওড়া স্টেশান, ঘোষকের ঘোষণা, চলমান ডিসপ্লেতে ট্রেনের সময় সারণী, চেকারদের ব্যস্ততা, মানুষের ছোটাছুটি, এরই মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চিন্তে মাটিতে বিছানা পেতে ঘুমোচ্ছে...

এত আওয়াজে ঘুম আসে!! সত্যি যে পারে সে আপনি পারে....

একটা পুরোনো মজার খেলা খেলি নিজের মনে...

সামনে কোন ভদ্রলোককে দেখে মনে হয় এ নিশ্চয়ই উইকএন্ড-এ বাড়ি যাচ্ছে, অন্য কোন জাঁদরেল চেহারার মহিলাকে দেখে মনে হয় এ যদি আমাদের কামরায় ওঠে তা'হলে হয়ে গেল এমন নাক ডাকবে...ট্রেনেই হাতির ডাক শুনতে পাব, বা বড় ঘড়ির নীচে দাঁড়ানো একটা ছোট্ট কিটস্‌ ব্যাগ হাতে মেয়েটা কে দেখি...বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে নাকি- উফফ্‌ ভাবতে কী ভাল্লাগে ... এক থরথর উত্তেজনার প্রণয় কাহিনী কল্পনা করি...। এর-ই মধ্যে আমাদের দলের অন্য সদস্যরা এসে পড়ে...কল্পনায় ছেদ পড়ে । হইহই , হল্লাগুল্লা , সংরক্ষিত তালিকা মেলানো শুরু হয়...

নির্দ্দিষ্ট কামরায় উঠে বসি...সময় মতন নড়ে ওঠে কোরাপুট এক্সপ্রেস...

- মা ট্রেন ছেড়েছে...

- ভালো করে ঘুরে আয়, সাবধানে থাকিস...

দরজা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ঝাপটা মারে মুখে...কুয়াশা নামে... দূরের আলো গুলো ঝাপসা হয়....ট্রেনের গতি বাড়তে থাকে।


পর্ব - ২
উড়িয়ে দিয়ে নিরুদ্দেশী মন......



ট্রেন ছোটে ।মাঝে মাঝে ছোট বড় ব্রীজ। আওয়াজ, ঘুম হয় না।শুয়ে শুয়ে জোৎস্না দেখি।দেখে কী মন ভরে! গায়ে মাখতে হয়।ঠাণ্ডা বাড়ে (মনে মনে বলি - ভাগ্যে 'লিক্যুইড কম্বল' সঙ্গে ছিল! / নইলে কী দুর্দশাই হত তা না হলে।')

একে একে পেরিয়ে যাচ্ছি খড়গপুর, ইস্পাতনগরী (টাটানগর), চক্রধরপুর।নেমেছি সেখানে, যেখানে ট্রেন থেমেছে। চা খেয়েছি অথবা শুধু নামার জন্য নেমে এদিক ওদিক করেছি । মনোহরপুর পৌঁছোন-র সময় রাত সাড়ে তিনটে ।ঠাণ্ডা বাড়ছে মনে মনে চাইছি ট্রেণটা একটু যেন লেট করে...চাইলে হয়না...প্রকৃত ভক্তের কথাই একমাত্র ভগবান শোনেন।

ঠিক নির্দ্দিষ্ট সময়ের পাঁচ মিনিট আগে ট্রেন আমাদের নামিয়ে দিল মনোহরপুর স্টেশনে... তারপর হুইসেল দিতে দিতে মিলিয়ে গেল।

দাঁড়িয়ে আছি, সঙ্গে ঠান্ডা। ওপরে ঠান্ডা, নীচে ঠান্ডা। ডাইনে বাঁয়ে ঠান্ডা। কোত্থাও কেউ নেই...চা-ওয়ালা নেই, স্টেশন-মাস্টারের ঘর খোলা ছিল, ট্রেন চলে যেতেই সে চম্পট দিল এমন কি আর কেউ না থাকুক দু-একটা লোম-ঝরা ঘিয়ে-ভাজা চামড়ার কুকুর অন্তত দেখতে পাওয়া যায় সর্বত্র, তারা –ও নেই । শুধু আমরা পাঁচজন আর পাঁচ বছরের স্পন্দন ,সঙ্গে আকাশ ভরা অসংখ্য তারা ও রাতচরা কিছু পাখি।

খবরটা ঠিক পেয়েছেন তো গাঙ্গুলি সাহেব ? মনে দ্বিধা...এমন সময় দেখি তিনটে ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে...

নির্জন মনোহরপুর স্টেশান গমগম করে উঠল...

- 'আরে ভাইয়া চিন্তা করবেন না এসে গেছি...আমি অভিজিৎ গাঙ্গুলি আর এরা দুজন আমার ছায়া সঙ্গী... চলুন বাইরে গাড়ি আছে...মালপত্তর তুলে নেবে ওরা...'। 'আ যা বেটা ', বলে স্পন্দনকে কোলে তুলে নিলেন অভিজিৎবাবু...।

এক ছুটে গিয়ে গাড়ির সামনে। জানি ডিজেল ইঞ্জিন চললে গরম হবে, কিছুটা রেহাই...ধুরধুর কোথায় রেহাই! শালা! বিহারের ঠাণ্ডা...(মাথা মুন্ডু নেই কোনও)

এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা।গাড়ি লাফিয়ে উঠছে কখনও, আবার কখনও গড়িয়ে পড়ছে গর্তে।হেডলাইট জ্বলছে, মাঝেমাঝে সেই আলো গিয়ে পড়ছে দুধারের গাছপালার ওপর।আশেপাশে কোন বাড়ি নেই, আকাশ চুপচাপ, শুধু গাছগুলো মাথা নাড়ছে এমনভাবে, মনে হবে যেন এখনই কোথাও বেজে উঠবে হারমোনিয়াম।ঝরাপাতা উড়ে যাচ্ছে চাকার হাওয়ায়...মাত্র চার কিমি পথ কিন্তু রাস্তা অসম্ভব খারাপ তাই সময় লাগল মিনিট পনেরো...

গোটা পথটায় মাও-আতঙ্ক গ্রাস করেনি যতটা আচ্ছন্ন করেছিল ঠান্ডাতঙ্ক!

চকিতে সম্বিৎ ফিরে এল অভিজিৎবাবুর গলা শুনে, 'এসে গেছি নেমে পড়ুন।'

নামতেই মনটা ভাল হয়ে গেল...একেবারে 'অন্যভূবন'। ঠাণ্ডা আপনি হতেই সরে গেল...শব্দে আমার বিস্ময় ও সন্তুর রিসর্টের সৌন্দর্য্য বাখ্যা করা অ-সম্ভব । তবু বলি সন্তুর রিসর্ট কোন রিসর্ট নয়... বাগান আর খাওয়া দাওয়ার জায়গা দেখলে মনে হবে হর্টিকালচারে এসে পড়েছেন আর অভিজিৎবাবুর বাড়িটি যেন একটা মিউজিয়াম। সর্বসাকুল্যে সন্তুর রিসর্টে চারটি ঘর আছে...চারটি ঘরের নাম- কারো, কোয়েনা, কোয়েল এবং সুবর্ণরেখা। বুকিং পেয়েছিলাম পাঁচ বিছানার কারোতে কিন্তু অভিজিৎবাবু বল্লেন- 'ঘরটা বড় , দুটো বাথরুম-ও আছে তবু পাঁচজনে থাকবেন, তার'চে বরং বাচ্চাটাকে নিয়ে আপনারা আমার একতলার বেডরুমে থাকুন।'

রিসর্টের অন্যলোকেরা এসে মালপত্তর নিয়ে চলে গেল আমরা বসে আছি অভিজিৎবাবুর বাড়ির সামনে খড়ের ছাউনি দেওয়া বিশ্রামশালায়।

অভিজিৎবাবু বললেন, 'চা আসছে একটু বসুন খেয়ে নিয়ে রেস্ট নেবেন...'।

সকলের সামনে কিন্তু সকলের অগোচরে এমন কি নিজের অজান্তেও আমি দুশ্চিন্তা থেকে দূরে সরে গেলাম, বিরক্তি আর আমার নাগাল পেলনা... ফুল সমুদ্রের পার দিয়ে হাঁটছি আর অভিজিৎবাবুর জানলায় রাখা বিভিন্ন মূর্তি দেখছি...ছোট বড় হরেক রকম মূর্তি।কোনটা হাতি, কোনটাকে দেখে মনে হচ্ছে বাঘ হরিণ শিকার করছে, আবার কোনটা কে দেখে মনে হচ্ছে একদল ছেলে ছুটছে... যেখানে বসে আছিলাম আমরা সেই জায়গায় মাঝখানে একটা কাঠের গোল টেবিল আর তাতে ঐরকম একটা মূর্তি অবিকল রবীন্দ্রনাথের আঁকা মা-ছেলের মতন...

বিস্ময়ের ঘোর না কাটিয়ে বলে ফেললাম – এত রকম মূর্তি আপনি সংগ্রহ করেছেন...কোথা থেকে কিনেছেন?

বিস্ময়ের আর-ও কিছু বাকি ছিল...

হা হা করে হেসে উঠে অভিজিৎবাবু বললেন- আমি সংগ্রহ করেছি ঠিকই; তবে এ হল প্রকৃতি-শিল্পীর দান। কোয়েনার তীর থেকে সংগ্রহ করা নুড়ি পাথর।এর একটিতে-ও কোন হাত দিতে হয়নি। চোখ দিয়ে দেখে তুলে নিয়ে এসেছি...

আমাদের চোখ কপালে!

চা এসে গেল সঙ্গে বিস্কুট আর কেক, স্পন্দনের জন্য দুধ (না আমরা কেউ মনে করাইনি)। চা খেতে খেতে টুকটাক গল্প...কাল সকালে কোথায় যাব এইসব কথা...স্পন্দন আর শাশ্বতী ঘরে চলে গেল ঘুমোতে।

নিষিদ্ধ রোদের প্রিয় ডাকে আমরা চারজন -আমি, বিদ্যুৎদা ,মঞ্জুদি (বিদ্যুৎদার বোন) আরবুড়ো এগিয়ে চল্লাম একটা টিলার দিকে যেখান থেকে ঘাসের কাঁথায় ঘুমোতে আসা শিশিরে মোড়া মনোহরপুর কে জাগতে দেখা যাবে।

এগিয়ে চলেছি। টিলায় পৌঁছোনর ফাঁকে একটু মনোহরপুরের কথা বলেনি।

মনোহরপুর একটা ছোট্ট জায়গা।চাকচিক্য নেই।গুটি কয়েক পয়সাওয়ালা জঙ্গল-ঠিকাদার পরিবার। অফুরন্ত বনজ সম্পদ। আর সেই সম্পদ থেকে মুনাফা আদায় করার জন্য ব্যবহৃত পিছিয়ে পড়া জনসমষ্টি- ওরাঁও , হো , মুন্ডা , বারুই ,ঝোরো প্রভৃতি। অরণ্যের অধিকার যাদের থাকা উচিত ছিল তারাই সবচেয়ে বঞ্চিত। সরকারী অনুগ্রহে হাসপাতাল আছে, আছে প্রাইমারী স্কুল কিন্তু এমন-ই দশা সেখানে না যায় কোন রোগী, না জোটে কোন পড়ুয়া।বরং মিশনারীদের সাহায্যে এখানে স্কুল হাসপাতাল খুব ভাল চলে...

হাঁটছি চোখে পড়ে একটি গির্জা ।উল্টোদিকে খেলার ফুটবল মাঠ।তার পাশে একটি মিশনারি স্কুল।বাঁ পাশে টালির বাড়ি, ঝাঁ তকতকে উঠোন। খড়ের গাদা... হাঁস মুরগী চড়ে বেড়াচ্ছে। সরু পাকদন্ডী পথ বেয়ে উঠে চললাম... বাতাসে বুনো ফুলের গন্ধ। টিলার মাথায় উঠে মনোহরপুরকে দেখা যায়... পূব থেকে পশ্চিমে বয়ে চলেছে কোয়েল।শীত কালে কোয়েল শুকনো...চিকচিক করে বালি।কোথাও কাদা নেই, জল-ও নেই। টিলার ঠিক নীচ দিয়ে একটা ট্রেন লাইন চলে গেছে । সে আসছে। কুয়াশার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে...মেঘমশারির ফাঁক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসছে 'সে'।কত রকম লাল... গাঢ়, হাল্কা, গোলাপী, ধূসর।

দূর থেকে ট্রেনের হুইসিল ।সকাল কে ওয়েলকাম করার জন্য বিউগেল বাজালো যেন।কুয়াশা ভেঙে ট্রেনের হাল্কা হলুদ আলো ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হল।কু-ঝিকঝিক সঙ্গে পাখির ডাক আর ওরকম নরম রোদ্দুর সব মিলিয়ে গুলজারের 'ইজাজত্‌'। মনে পড়ল সেই দৃশ্য যেখানে নাসিরুদ্দিন আর রেখা এক সোয়েটারে ঢুকে প্রকৃতির কোলে একটু উষ্ণ হয়েছিল পরস্পরের জন্য।

যা পাইনি তার বিহনে আর কি কাঁদি, তার চে’ বরং এমন সকাল গায়ে মাখি।

আমরা আবার ফিরে এলাম সন্তুরে । ততক্ষণে আমাদের দলের অন্য দুই সদস্য উঠে পড়েছে। আর একদফা চা খাওয়া হ'ল তারপর গরম গরম পুরী, আলুর তরকারি আর মিষ্টি।সন্তুরে ঘরে ঘরে গিজার নেই কিন্তু ভোরবেলা থেকেই বাগানে বিরাট হাঁড়িতে জল গরম হচ্ছে। আর বলা মাত্র লখা ও তার বউ(বউ নামেই তাকে সকলে ডাকত) বালতিতে গরম জল নিয়ে হাজির। ১০ টা নাগাদ গাড়ি রেডি।সঙ্গে অভিজিৎবাবুর দুই সঙ্গী আর আমরা। হটপটে দুপুরের খাবার তুলে নেওয়া হল।

এর মধ্যে আমি লখার সঙ্গে জল-চুক্তি সম্পন্ন করে ফেলেছি। রাম দিয়েছিলাম তাকে তার বদলে চেয়েছি মহুয়া রাতেরজন্য।

গাড়ি নড়ে উঠল...

বিদ্যুতদা স্লোগান তুলল- ‘দুলেদুলে দুলদুলি...’!



পর্ব - ৩
আলগা নেশা চাহিদা মিস্টিক...



কিছুটা রাস্তা ভাল, অধিকাংশটাই খারাপ। অটোম্যাটিক ব্রেকড্যান্স।আমরা ডিস্কো ড্যান্সার।রোদ বাড়ছে ঠান্ডা কমছে, একে একে শরীরের ওজন কমাচ্ছি আমরা।মনোহরপুর-এর আর এক বৈশিষ্ট্য... সে ত্রিবেণী সঙ্গম। কারো এসে মিশেছে সমীজে কোয়েলের বুকে। কোয়েনাও পড়েছে দো-মোহনায়। তারই পাশে পাশাপাশি শ্মশানঘাট ও কবরখানা। ধর্ম জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারে না।যে টুকু দূরত্ব তৈরী হয়, তা'হয় ওই মাঝের জীবনটাতে যখন মানুষের জ্ঞানবুদ্ধির নাকি বিকাশ হয়!

বিকাশ চিরকালই আকাশে...

দোমোহনার শ্মশান ঘাট যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, তবে সে সন্ধেবেলা। লক্ষ্মণ আমাদের গাড়ির ড্রাইভার কে বলাতে সে বলল ফেরার পথে চেষ্টা করবে।এত কম কথা বলে লোকটা, যে কিছু বলতেই কেমন দ্বিধা হয়।গাড়ি এগোচ্ছে... কথা বাড়ছে। তখনও আমাদের কথার সিংহভাগ দখল করে রেখেছে বিহারের ঠান্ডা( অমরীশপুরী )। তবুও তারই মাঝে মাঝে দু পাশের রুক্ষ্ম নুড়ি পাথর, লালচে রাস্তা আর দূরান্তের বনভূমি আমাদের উদাস করে দিচ্ছে প্রতি পলে। পথে নামলে পেট রোগা বাঙালির চোখের খিদে বাড়ে। পথের ধারে একটা চায়ের দোকান দেখে গাড়ি থামলাম আমরা। একপ্রস্থ চা খাওয়া হল, নেতানো ফুলুড়ি মারলাম খানদুয়েক...এক ঢোক কাফ সিরাপ।ঠান্ডার ধাত আমার তাই কাফ সিরাপ সঙ্গে থাকে বারোমাস। ঐ দোকান থেকেই লম্বা বিড়ি কিনলাম তিন প্যাকেট। মেয়েরা নাক সিঁটকোল...ইস্‌, বিড়ি...(ধরাইনি ,তবু গন্ধ পেয়ে গেল!!!)

বুড়ো বলল, ‘ অরিন্দমদা সিগারেট আর বিড়ির মধ্যে কোন দর্শনগত পার্থক্যআছে?’

-‘ হ্যাঁ আছেই তো। সিগারেট হল পুরুষ, দগ্ধ হতে হতে স্তব্ধ হয়ে যাবে কিন্তু স্তব্ধ হওয়ার আগে নিভবেনা। সে জানে আমাকে পুড়তে হবে।পুড়তেই হবে।

আর বিড়ি হল- নারী। অভিমানিনী। না টানলে নিভে যাবে।সবসময় অ্যাটেনশান চায়। ASS-এ আক্রান্ত। অ্যাটেনশান সীকিং সিন্ড্রোম।

সবে সমুদ্রে তুফান উঠবে...মঞ্জুদি কিছু একটা বলবে বলবে করছে, এমন সময় বিদ্যুৎদা বলে উঠল-‘ চল চল, এখানে এইভাবে সময় নষ্ট করলে হবে না।তাড়াতাড়ি ওঠ্‌ গাড়িতে’।

গাড়ি ছুটছে। চাকার হাওয়ায় লাল ধূলো উড়ছে দু'পাশে। মাঝেমাঝে গরু ছাগল নিয়ে রাখালবালক যাচ্ছে।গাড়ি দেখে থামছে।চোখাচুখি হতেই হাসছে, হাত নাড়ছে।

ইউরোপ আমেরিকাতে অচেনা লোক দেখলেও এই রকম প্রীতি সম্ভাষণের রীতি চালু আছে, কিন্তু আমাদের মধ্যে'ত এইসবের বালাই নেই।চেনার মাপকাঠির ওপর সৌজন্যটুকুও নির্ভরকরে।

পরিবেশ পারে বদল আনতে। আনল।আমরাও হাত নাড়ি হাসি...

হট্‌ করে ঢালুতে নেমে গেল গাড়ি...আবার উঠল... তারপরেই একটা কালর্ভাট পেরিয়ে থেমে গেল। লক্ষ্মণ বলল এটাই দুলদুলি... ঘুরে আসুন কিন্তু চোখের নাগালের বাইরে যাবেন না।

লক্ষণ না হয়ে ওর নাম কমল মিত্র হলে ভাল হ'ত।

নেমে চারদিকে তাকাতেই মনে হল – অরণ্য জেলে বন্দী আমরা ক'জন। চারপাশে উঁচু পাহাড় আর গাঢ় সবুজ অরণ্য আর পায়ের পাশ দিয়ে কুলকুল ধ্বনি তোলা...কারো-কোয়েনার যুগ্ম কনসার্ট।স্রোতের মাথায় ফেনার মুকুট...অরণ্যের সবুজ, মাইনস্-এর লাল আর পাথরের ধূসর রঙ মিলেমিশে এক চলমান নক্‌শি কাঁথা।

প্রতিবারের মতন এইবার ও হ'ল। সেই লাইন মনে এল...

ওরা দিবসরজনী নাচে

তাহা শিখেছে কাহার কাছে।

আমার জীবনের এই এক ট্রাজেডি... প্রকৃতির কোলে গিয়ে পড়লে আমার কিছুতেই অন্যকারও কবিতা মনে পড়েনা। ঘুরে ফিরে সেই বুড়োর দুএকটা কবিতা।অবিশ্যি পড়েছিই বা ক'টা ?

কাঁধে দুটো ক্যামেরা, এত বিরক্তি লাগে এই সব সময়... 'এই , ছবিটা তোল', 'এই এইখানে আছি এইটা তোল', ' এই, বাবুর সঙ্গে আছি এইটা তোল' , ' ধুর! এমা! চোখ বন্ধ উঠেছে !আবার তোল।'

নিজের জীবনটা বিয়েবাড়ির ফটোগ্রাফারের মতন, ইচ্ছে মতো ঘোরার সুযোগ নেই...ইচ্ছে মতো ছবি তোলার সুযোগ নেই।

আমার মুক্তিদেবীর ফুর্তিতে।

ছবি তুলছি... তুলতে তুলতেই মাথার ওপর দিয়ে একঝাঁক টিয়া উড়ে গেল। স্বাধীনতা দিবসে যুদ্ধ বিমানগুলো যেমন সবুজ ধুঁয়া ছড়িয়ে চলে যায় সেইরকম।তোলা হল'না।

জীবনভর এরকম কত না-তোলা জমা হয়...

খেয়াল করিনি , বুড়ো স্পন্দনকে কোলে নিয়ে অনেকটা দূর চলে গেছে।সম্বিৎ ফিরল স্পন্দনের ডাকে- বাবা এই দেখ, আমি একা একা দাঁড়িয়ে আছি...

- দেখিস সাবধানে(সকলে শুনল)!

যা শুনলনা লোকে, যা ওকে আমি চিৎকার করে বলিনি, তা'হল- আমরা প্রত্যেকে একা...একা থাকার বীজমন্ত্রটা শিখেনে।

- চলুন এইবার।অনেক দূর যেতে হবে। লক্ষ্মণের গলা।

গাড়ি ছুটল... লালমাটি আর সবুজ প্রাচীরের মধ্য দিয়ে... এইবার যাব কোয়েনার উৎসস্থল দেখতে।অজিতা হিলস্‌।

রাস্তার কথা আলাদা করে বলবনা। দেহের রক্ত রস যদি দুধ হ'ত, তাহলে এতক্ষণে তার থেকে মাখন নির্গত হয়ে যেত। যত অল্পকথায় সারলাম..ঠিক ততটা অল্প সময় লাগেনি। অনেকটা পথ যেতে হয়...পথে বার কয়েক থামা।ফটোসেশান।গাছ থেকে নামা লতানো ডাল ধরে টারজান সাজা... সবই হয়েছে!

কোয়েনার উৎস স্থল দেখে অজিতা হিলসের আরও ওপরে উঠে চলা।

একটা জায়গায় গিয়ে জিপ দাঁড়াল।লক্ষ্মণ বলল, কী আছে দেখে আসুন নেমে গিয়ে।

সোজা তাকিয়ে দেখছি লালমাটির রাস্তা উঠে গেছে আর যেখানে শেষ সেখানে নীল আকাশ ছুঁয়ে আছে ওকে।

তাহলে কী এরপর অতল গিরিখাত!

পুরো বুরবক করে দিল। গিয়ে দেখি আবার ঢালু পথে রাস্তা নেমেছে।ওরা হাসছে। আমরাও হাসলাম। দু'বার।

গাড়ি গড়াল।আমরা গিয়ে বসলাম এমন জায়গায়, যেখান থেকে কয়লা নিষ্কাশন করে ট্রলির সাহায্যে নীচে নামে।ঘুরে ফিরে দেখলাম ট্রলি-ঘর।

খাওয়াদাওয়ার কথা এমনিতে বলতে বিরক্ত লাগে..তবু বলি ,কারণ একটাই, এমন খাতির (পড়ুন উষ্ণতা) শ্বশুরবাড়িতেও পাইনি।লক্ষ্মণ আর সহযোগী বসার ব্যবস্থা করে দিল...খাওয়ার জলের বোতল এগিয়ে দিল। পেঁয়াজ, শসা কেটে এনে দিল ।তারপর থালায় করে ভাত -ডাল-আলুভাজা, ফুলকপির তরকারী এবং মাছের কালিয়া পরিবেশন করল।

খেতে চাইছিনা , তবু সে কী জোর করা! বিয়ের পর প্রথম জামাইষষ্ঠীতে শাশুড়ির খাবার থালা হাতে তাড়া করার দৃশ্য মনে এল।

দুপুরের রোদ পিঠে নিয়ে একটু গড়িয়ে নিলাম। চোখ লাগব লাগব করছে আবার সেই লক্ষ্মণের হুঙ্কার... “চলুন চলুন, নইলে দেরি হয়ে যাবে।”

গাড়ি গড়াল।গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি...আমাকে এখনও চমকায় দেখে বিস্মিত হলাম (অতটা বুড়ো হইনি তাহলে!)

বেলা পড়ছে। রোদ ঢলছে...ঠান্ডা নামছে।ওজন বাড়াচ্ছি শরীরের।গাড়ি এসে থামল শ্মশানের অনতি দূরত্বে কোয়েনার তীরে।

কাঁহাতক আর সবুজ প্রাচীর...কোয়েনার কুলকুল লিখব।নিজেরা বুঝেনিন। শুধু বলি ফিসফিসকরে – আমি তোমাকে ভালোবাসি বললে...অরণ্যের পাতা নড়ে উঠবে...এতটাই নির্জন অথচ এতটাই সজাগ এই বনভূমি।

কোয়েনার পারে সকলে ঘুরছে...পাথর তুলছে...

মাঝে মাঝে স্পন্দনের কথা কানে আসছে...

- 'বাবা এই দেখ হাতি পেলাম একটা'...'বাবা একটা বেবি পেয়েছি।'

একটা গাছের গোড়ায় বসে আছি। কাফ সিরাপ খাচ্ছি...

*'সুকন্যার কথা মনে এল।সুকন্যা বলেছিল এক তরুণ ডাক্তারকে- এইখানে শ্মশানে কোন ভয় নেই...কেমন খুশি খুশি ভাব।

তরুণ ডাক্তার মৃদু হেসে বলেছিল –“ ভয় পেলেই ভালো হত! অন্তত অস্তমিত সূর্যদেবকে আর একটু রাঙিয়ে দিতে পারতাম। ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরতে আর আমিও অভয় দেওয়ার ছলে আরও কাছে টেনে নিতাম তোমাকে।

সুকন্যা চিবুক তুলে হেসেছিল।”*

আমিও হাসলাম।

এভাবেও ছুঁয়ে থাকা যায়...তাহলে!

গাড়ি গড়াল সন্তুর রিসর্টের দিকে।

রাত্রির রঁদেভু...কাল

(তরুণ ডাক্তারটির নাম ডাঃ বৈদ্যনাথ গাঙ্গুলি। অভিজিৎ গাঙ্গুলির বাবা। কাহিনীর তথ্যসূত্রঃ- কারো-কোয়েনা-কোয়েল)

(চলবে)


গল্প - অনুপ দত্ত

মনের সঙ্গে খেলা
অনুপ দত্ত



দিন দুই আগে শীতটা একটু কমে এসেছিল৷ আজ সকাল থেকে আবার বেশ জাঁকিয়ে বসেছে৷ ভোরের ঝিলে স্নান করতে নেমে অন্তরা অনুভব করলো ঠান্ডাটা বেশ জবর৷ করতোয়া নদীর বাঁধের উপরে কয়েকটা লোক উঁবু হয়ে বসে আগুন তাপাচ্ছিল৷ পাশ দিয়ে যেতে যেতে অন্তরা টের পেল আগুন তাপানো মানুষগুলোর শরীর থেকে বেশ আগুন লাগা দৃষ্টি এসে ওর ভেজা কাপড়ের শরীরে পড়ছে৷.ভালই লাগছে অন্তরার৷ ভিজে কাপড় চোপর যদি অগ্নি দৃষ্টিতে একটু শুকিয়ে যায় আর কি৷

পরমেশের সকাল হয় বেলা আটটার পর৷ অনেককিছু শুধরেছে পরমেশ বিয়ের পর কিন্তু এটাকে আর শোধরাতে পারেনি৷ আজ যিশু আর পরমেশের ছুটির দিন৷ অনেকক্ষণ ধরে নিরিবিছিন্ন কাজ করল অন্তরা ঠাকুর ঘরে৷ এর মাঝে যিশু এসে একবার উঁকি দিয়ে গেল৷

-ও মা তোমার পুজো হোল ? প্রসাদ দেবে না?

যিশু, ছুটির দিনগুলোতে পারলে বিছানায় গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকে৷ঠিক যেন বেড়াল ছানা । শুধু লেজটাই নেই আরকি৷ এখানে পরমেশের প্রশ্রয় পায় যিশু৷ সাধারণত সংসারের কোনো কাজ পরমেশের জমে না৷ তার এই সংসারের প্রতি উদাসীনতা ছোট শিশু যিশু কেও স্পর্শ করে৷ সেটা পরমেশ বোঝে না৷ শাশুড়ী মা জীবিত থাকতে বলতেন --

- মা অন্তরা৷এটাতো ওদের বংশে৷ ভয় পাসনি মা৷ নিজেকে শক্ত কর৷.আমিও করেছি৷ তুই একা নোস৷ এটাই বোধ হয় জীবনের খেলা৷ মনের সঙ্গে খেলা৷ মন শক্ত কর৷

যিশুকে ঘিরেই সমস্ত স্বপ্ন রোজকার বেলার মতো আবর্তে ঘুরেছে৷গড়ে উঠেছে তার এক আবাসিক অস্তিত্ব৷ কোনো এক দুর্বল মুহুর্তে পরমেশকে জিগ্যেস করেছিল অন্তরা

-যিশু কে নিয়ে তোমার কোনো স্বপ্ন নেই?

ম্যাগাজিনের পাতা থেকে চোখ তুলে নীরবে হেসে বলেছিল পরমেশ

-দেখ অন্তরা, আমার নিজের কোনো স্বপ্ন সফল হয় নি৷ তাই কারো জন্য স্বপ্ন দেখি না, বরং বলি , ভয় পাই আমি৷ হতে চেয়েছিলাম কত কি৷ বিদেশ যাব৷.ডলারে টাকা ইনকাম করব৷ তা না হতে পেরে হলাম গিয়ে একটা ব্লকের বি ডি ও কেরানি ৷ যার না আছে কোনো আশা না ভরসা৷ রোজকার এই না পাওয়া মরার মাঝে আবার স্বপ্ন দেখে নতুন করে মরব নাকি কারো জন্যে৷

অন্তরা লক্ষ করলো৷.কথাটা বলে পরমেশ টবিলে রাখা যিশুর ফটোটার দিকে কেমন করে যেন চেয়ে রইলো৷

- তুমি কি স্বপ্ন দেখ অন্তরা, যিশু কে নিয়ে ? পরমেশ পাল্টা বলেছিল৷

অন্তরা আর উত্তর করেনি৷পরমেশের হাত থেকে শেষ হয়ে যাওয়া চায়ের কাপটা নিয়ে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেছে৷ জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দেখে নেয়৷যিশু খেলছে ঝিলের পাশের মাঠটাতে৷ যিশু বেশ রাজা সেজেছে৷

ঠাকুর ঘরে আজ অনেক্ষণ কাটাল অন্তরা৷ আলমারিতে বাসন গুলো সাজিয়ে রাখতে যাছিল৷ পেছন থেকে হঠাত যিশু এসে জড়িয়ে ধরলো৷ ছুটির দিনের আবদার৷অন্তরা বুঝতে পারল৷

পেছন ফিরে দেখে যিশুর মুখ ভর্তি ঘাম..জামাটাও প্রায় ভেজা৷

- হ্যাঁ রে যিশু৷এত ঘামছিস কেন? শরীর খারাপ নয় তো৷

- ও কিছু না মা৷ এত গরম পড়েছে তাই৷ ও মা শোনো না৷.ইস্কুলের মাঠে ক্লাস টেন'এর পিনাকিদা অবিরাম সাইকেল চালাচ্ছে ২৮ ঘন্টা ধরে৷ আগের বাদলদার ২৭ ঘন্টার রেকর্ড ভাঙবে বলে৷ ও মা , ওই যে শুনছো না মাইকে গান বেজে চলেছে৷বলতে বলতে জুতো হাতে নিয়ে এক দৌড় লাগালো যিশু৷দূর থেকে বলল--

-মা দুপুরে খেতে আসব৷ আজকে তো তুমি মাংস রাঁধবে বলেছিলে৷ তোমায় সব দেখে এসে পরে বলবো মা৷

খবরটা যখন এলো তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে৷ যিশুর ক্লাসমেট সুনিত প্রায় কাঁধে করে যিশু কে বাড়ি পৌছে দিলো৷ পেটের যন্ত্রণায় যিশুর মুখ কালো হয়ে আছে৷ শরীর কেমন বার বার কুঁকড়ে যাচ্ছে৷ কোলে টেনে নিতে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল যিশু--

-ও মা আর তোমার অবাধ্য হবো না৷ আমায় ভালো করে দাও মা৷ তুমি যেমন বলবে আমি তেমন হবো মা৷

বাড়িতে কেউ নেই ! পরমেশ ছুটির দিনে তাস পেটাতে গেছে বন্ধুদের সাথে৷ হাসপাতালে অন্তরা নিয়ে গেল একা৷ পাশের ফ্লাটের অর্ক'র বাবাকে রিকোয়েস্ট করলো একটু পরমেশকে খবর দিতে৷

পরমেশ যখন খবর পেয়ে এলো যিশু তখন ঘুমের ইন্জেকশনে ঘুমাচ্ছে৷ পরমেশ দেখে , মাথাটা বালিশের একপাশে হেলে পড়েছে৷ আস্তে করে সোজা করে দিলো পরমেশ যিশুর মাথাটা৷ সারা মুখটা কেমন কালচে হয়ে আছে৷

অন্তরা ডাক্তারের কাছে পরমর্শের জন্য গিয়েছিল৷ ফিরে এসে দেখে পরমেশ এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে যিশুর মুখের দিকে বেডের পাশে দাঁড়িয়ে৷

নিবিষ্ট মনে বড় পরমেশ দেখছে ছোট পরমেশকে৷ কেন জানি সমস্ত স্বপ্ন ভাঙ্গার কারণগুলো একসঙ্গে যেন প্রতিবাদ করে উঠলো পরমেশের ভেতরে৷ তবে কি এই স্বপ্ন দেখার স্বপ্নটাও তার ভেঙ্গে যাবে ? কি একটা ভয়ের আতঙ্ক নিয়ে দ্রুত সে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো ! পাগলা ঘোড়ার মতো মনটাকে ছুটিয়ে শেষ এক চাঙ্গর হাওয়া ফুসফুসে ভরে নিয়ে বাঁধের দক্ষিণ দিকে স্লুইস গেটের রেলিং'এ বসলো পরমেশ৷ তার একদা প্রিয় নদী করতোয়া’র দিকে তাকাতেও যেন ভয় পেল৷.কি জানি করতোয়া নদীর জল’ও যদি শুকিয়ে যায় তার মতো কিছু না পাওয়া মানুষের দৃষ্টিতে৷ ভেতরে ভেতরে একটা সুপ্ত পরমেশ যেন ছোট্ট পরমেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল৷

যিশুকে যখন অপারেশন থিয়েটারের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, .পরমেশ উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে ছুটে এলো৷ ডাক্তার মজুমদার ভ্রু কুঁচকে দেখলেন এই পাগলের মতো লোকটাকে৷ অন্তরা বললে, পরমেশ চক্রবর্তী৷.যিশুর বাবা৷

-ডাক্তার মজুমদার৷অস্ফুট উচ্চারণ করল পরমেশ৷

-ইয়েস৷পরমেশ বাবু৷

- .আমাদের মানে আমাকে কি অপারেসন থিয়েটারে থাকতে দেবেন ?

- না না তা হয় না পরমেশবাবু৷ এরকম নিয়ম তো নেই আমাদের৷

পরমেশের এই মানসিক অস্হিরতায় অন্তরাও স্তব্ধ হয়ে রইলো৷ এ কোন পরমেশ? মধ্যবিত্তের সমস্ত আশা ভঙ্গের নজীর পোড় খাওয়া উদাসীনতার ব্যাকুল পরমেশ৷ তা হলে যিশুর জন্য সে একা নয়৷

অন্তরার ভেতর এবার কেমন টিপ বাঁধা জল ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল তার সমস্ত সত্বাকে ! মার্জনা চাইবার লজ্জা হারিয়ে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলো৷ও'টির লাল আলোটা নিভে গেল হঠাৎ ! দরজা খুলে ডাক্তার মজুমদার বেড়িয়ে এলেন৷.পরমেশ আবার ছুটে এলো ! ডাক্তার একবার তাকালেন পরমেশের দিকে

- Don’t worry ...everything is alright৷যিশু খুব ভালো আছে৷ ঘন্টা তিনেক বাদে দেখা করতে পারেন৷ প্লিজ এখন যেন ডিস্টার্ব করবেন না৷

যিশুর বেডটা দুটো মেল নার্স আস্তে আস্তে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল কেবিনের দিকে৷.পরমেশ ঝুঁকে পড়ল যিশুর মুখের কাছে! স্পষ্ট অথচ অস্ফুট উচারণ করে বলল পরমেশ

-ভালো হয়ে ওঠ রে বাবা তাড়াতাড়ি৷ভালো হয়ে তোর মার মতো হোস যিশু৷ আমার এই আশা ভঙ্গের কপাল যেন তোর কপালে না লাগে বাবা৷ভালো হয়ে যা৷ভালো হয়ে যা....

আরো কিছু যেন বলতে যাচ্ছিল পরমেশ৷ নার্স দুটো যিশুকে তখন অনেকটা দূর ঠেলে নিয়ে গ্যাছে৷ এবার অন্তরার দিকে তাকালো একবার পরমেশ৷

ওর উদ্ভ্রান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে অন্তরার এতক্ষণ টিপ বাঁধা জল উপচে পড়ল অঝোরে৷ সমস্ত পরিবেশ ভুলে গিয়ে সে পরমেশকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে নীরবে৷ মনের ভেতরে এক কথা গুমড়ে গুমড়ে বেজে গেল তার৷

-ক্ষমা করো পরমেশ৷ক্ষমা করো আমায়৷

ওদের পাশ দিয়ে দুটো ফিমেল নার্স নতুন রুগী কে নিয়ে আবার ও'টির ভেতরে ঢুকে গেল৷

গল্প - আইভি চট্টোপাধ্যায়

ভদ্রা
আইভি চট্টোপাধ্যায়


আমি ভদ্রা । বরাহপর্বত থেকে যাত্রা শুরু করেছি । বরাহপর্বত মানে, সেই পশ্চিমঘাট পর্বতমালা । গঙ্গামুলা থেকে এতদূর এসে পড়েছি । চলছি তো চলছিই । চলাটা আমার ভালোবাসা, চলাটা আমার নেশা । যতক্ষণ না মাযের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারছি, আমাকে চলতেই হবে ।

আমার মা, কৃষ্ণা । মা যে কি সুন্দর, মাযের গায়ের গন্ধে কি যে টান । মাযের কোলে চড়ে আমি সাগরে যাব । আমি একা নয়, আমরা সব ভাইবোনেরা একসঙ্গে সেখানে যাব । এই তো কুদালি পৌঁছে গেলেই আমার বোনের সঙ্গে দেখা হবে আমার । আমার বোন তুঙ্গা । তারপর থেকে তো আমাদের আর আলাদা করে চেনাই যাবে না । তখন আমাদের দুজনের একটাই নাম । তুঙ্গভদ্রা । আমাদের কৃষ্ণা-মা আমাদের পথ চেয়ে বসে আছেন । মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তবে শান্তি । সাগরে যাবার জন্যেই যে আমার এতখানি পথ চলা ।

ভদ্রাবতী পৌঁছে বেশ ভয় হয়েছিল, এই বুঝি চলা শেষ হয়ে গেল । ভদ্রাবতী একটা মস্ত শহর, বড় বড় কারখানা । অনেক মানুষের ভিড় । মস্ত একটা ব্রীজ । অনবরত গাড়ি আসছে আর যাচ্ছে । ব্রীজের ওপর তলায় আবার রেললাইন। যখন ট্রেন যায়, ঝম ঝমাঝম বাজনা বাজে । ব্রীজটা কাঁপতে থাকে । আমার বুকের মধ্যে বান ডাকে ।

ব্রীজ পার হলেই লেভেল ক্রসিং । দুদিকে উপছে পড়া বাজার । আলু, পটল, কুমড়ো, কাঁচা লঙ্কা । একদিকে ছোট বড় মাছ । টপাটপ কেটে ফেলছে দোকানী । আরেকদিকে মুরগির গলা কাটছে মুরগির দোকানে । ছাল ছাড়ানো পাঁঠাগুলো দুলছে আরেক দোকানে । হার্ডওয়ারের দোকানে লোহার আওয়াজ । উল্টোদিকে সাইবার কাফে । কম্পিউটার আর ইন্টারনেট । শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ।

এদিকে মস্ত মুদির দোকান । ওহ না, মুদির দোকান না । শপিং মল । ওখানে মুদির দোকানের জিনিসপত্র থেকে সব্জী জামাকাপড় জুতো মোজা সব পাওয়া যায় । বড় বড় খাবারের দোকান থেকে বিউটি পার্লার । সব ।

শপিং মল ছাড়িয়ে আর একটু এগোলে শাড়ির দোকান । সোনার গয়নার দোকান । মেকী সোনা, ঝুটো পাথরের গয়নার দোকানও আছে একটা । পাশাপাশি । শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ।

রাস্তার ওপারে ঝাঁ চকচকে খাবার দোকান । কে-এফ-সি চিকেন । ম্যাক ডোনাল্ড । একটা শিঙারা কচুরির দোকান। বাজে ডালডায় গরম গরম জিলিপি ভাজা হচ্ছে । আমার নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে । নদীর ধার ঘেঁষে গড়ে উঠেছে সব । এত ভিড়, এত আওয়াজ, আমার কষ্ট হয় খুব ।

এইখানে এই ছোট্ট জায়গাটায় এসে আমি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি । এই জায়গাটার নাম আমি জানি না । কেউ বলে কালসা, কেউ বলে কাজরা । তবে ভদ্রাবতীর ভিড় ছাড়িয়ে এসে এখানে নিঝুম শান্তি ।

একদিকে বড় বড় সবুজ গাছ । গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ছোট ছোট কুঁড়েঘর, সবুজ সবুজ ক্ষেত । এদিকে একটা গ্রাম । বড্ড ইচ্ছে করে একবার গ্রাম দেখে আসি । আমার তো আর সে উপায় নেই । তবে গ্রাম দেখা না হলেও গ্রামের লোকজন সবাইকেই চিনি । সবাই আসে আমার কাছে ।

ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমার কাছে এসে খেলাধুলো করে । বর্ষাকালে ঘাসে আগাছায় ভরে যায় । তখন সাপখোপ এসে ঘোরাফেরা করে । পোকামাকড়, ফড়িং, প্রজাপতি । রঙ বেরঙের পাখি । ঘাসফুলে ভরে ওঠে জায়গাটা । আরেকদিকে অনেকখানি বালির চড়া । একটু উঁচু হয়ে ওদিকে ঢাল নেমেছে । তাই ওদিকটা দেখা যায় না । কে জানে ওদিকেও গ্রাম আছে কিনা । ওদিক থেকে লোকজনও তো বিশেষ আসে না । তবে মাঝে মাঝে কাঁসর শিঙা ঢোলক বাজে । মনে হয় কোনো আদিবাসী গ্রাম আছে । হয়ত কাছে নয় । হয়ত ওদিকে আর একটা নদী বা পুকুর আছে । তাই ওরা আমার কাছে আসে না ।

আমারই বা আছে কি ! ভদ্রাবতীতে বিশাল বাঁধ দিয়ে আমার তো সব নিয়েই নিয়েছে । ইচ্ছেমতো ঢেউ নিয়ে চলার স্বাধীনতা নেই আমার । এখানে এসে তো একেবারেই সব হারিয়ে আছি । এই যে মাঝে এতখানি চড়া পড়ে আছে, এই যে এদিকে কালো পাথরগুলো জেগে উঠেছে, এসব তো জলের নিচে থাকার কথা । ছোট মাছ, ব্যাঙাচি, ছোট ছোট জলের পোকাগুলো কি কষ্টে যে বেঁচে আছে ।

কাজরা গ্রামের ছোট্ট রাখাল ছেলেগুলো গরু চরাতে এসে যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে জলের মধ্যে, কি ভালো যে লাগে আমার । একমাত্র তখনই মনে হয়, আমি বেঁচে আছি ।

এমনি সারাদিন আমি একা একাই থাকি । রাজি ছাড়া কেউ এমন নেই, যে রোজ আমার কাছে আসে । গাঁয়ের লোক অবশ্য আসে নদীর ধারে । তবে তারা কেউ আমার কাছে আসে না । মেয়ে-বউরা জল নিয়ে যায়, গাঁয়ের মোড়ল ওই অশ্বত্থ গাছটার তলায় বসে কাজিয়া মেটায় । ছেলেরা কখনো কখনো খেলা করতে আসে । আর আসে গাঁয়ের গরু ছাগলগুলো ।

আজকাল মাঝে মাঝে একটা লম্বা ছায়া এসে দাঁড়ায় । মানুষটাকে অবশ্য দেখি নি । ও কোনোদিন আমার কাছে এসে বসে নি । ছায়ামানুষ এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখে আমি জানি । ও রাজিকে দেখতে আসে ।

রাজি । রাজশ্রী । নামে রাণী, নামে শ্রী । কিন্তু রাজির মুখে এক পৃথিবী বিষাদ ।

আমার মতই শীর্ণ, নিষ্প্রাণ, প্রায় গতিহীন জীবন । আমার বুকের মধ্যে এতখানি চড়া, বড় বড় কালো পাথর জেগে আছে । রাজির শিরা বের হয়ে যাওয়া হাতে কড়া । শুকনো মুখে চোয়ালের হাড় জেগে থাকে আমারই মত । রাজিকে দেখলেই আমি নিজেকে দেখতে পাই ।

সারাদিন যন্ত্রের মত খাটে মেয়েটা । কিন্তু কেউ খুশি হয় না । মা, বাবা, ভাই, বোন, একটা বিয়েওলা বড় দিদি আসে মাঝে মাঝে, সে-ও না । মারের দাগে ওর হাতে কপালে গালে কালশিটে । কেন যে ওরা অত মারে ওকে, কে জানে । মেয়েজন্মের অপরাধ কিনা কে জানে । রাজির অন্য বোনেরা, দিদি, বৌদিরা, মা .. তারাও তো মেয়ে । তবে কেন তারা সমব্যথী নয় ?

রাজি আসলে নিজের কথাটা বলতেই পারে না । যে আত্মবিশ্বাস থাকলে সংসারে নিজের জায়গা ধরে রাখা যায়, নিজের ভেতরে যে জোর থাকলে ‘আত্মদীপো ভব’ বলা যায়, রাজি তা জানে না । রাজির জীবন বয়ে চলেছে আমারই মত । গতিহীন, দিশাহীন ।

আমার চলার ওপর যেমন আমার কোনো হাত নেই । কোথাও মস্ত বাঁধ, কোথাও ঢাল কেটে রাস্তা বন্ধ । স্বছন্দে বয়ে চলার আনন্দ নেই । আমি আজ গতিহীন, দিশাহীন । রাজিরই মত ।

অথচ প্রবাহ রক্ষা করাই নদীর ধর্ম । তার প্রবাহ রক্ষার মধ্যে দিয়েই মানুষের স্নান, পান, ক্ষেতের কাজ । ঠিক মানুষের জীবনের নানা প্রবাহের মতই । জীবনের নিজস্ব গতির প্রবাহ । সম্পর্কের প্রবাহ । বর্ণে ছন্দে কাটানো দিনরাতের প্রবাহ।
রাজির জীবনে এ প্রবাহ থেমে গেছে । রাজিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে । রাজির কোথাও যাবার জায়গা নেই। তাই রাজি আমার কাছে আসে বারবার । বাড়ির লোকে রাগ করে । কাজে ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে ওকে শাস্তি দেয় ।

কিন্তু রাজি আবার আসে । ওর আর কোথাও জায়গা নেই । নইলে আমারই বা আছে কি ! এই তো শুকিয়ে যাওয়া নদী । জল নেই, ঢেউ নেই । কালো কালো পাথর জেগে আছে । গাঁয়ের বৌরা কাপড় কাচতে গিয়ে দেখেছে, সেই শীর্ণ রেখার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে রাজি । বিকেলে নদীর ধারে খেলা করতে গিয়ে ছেলেরা দেখেছে, নদীর জলে নিজের ছায়ার দিকে চেয়ে বসে আছে রাজি ।

ভোরবেলা যখন পাখিরা জেগে ওঠে, গাছে গাছে দোলা লাগে, তারও আগে রাজি উঠে পড়ে । আকাশ বাতাসের কথা বাদই দাও, গ্রামের রাস্তাটাও তখন মায়া মায়া ।

রাজি এসে নদীর জলে নামে । অঞ্জলি ভরে চোখে মুখে দেয়, মাথায় ছোঁয়ায় । পুবের আকাশ তখন লাল হয়ে উঠছে । জলের মাঝে দাঁড়িয়ে সেইদিকে তাকিয়ে থাকে রাজি । রাজির সঙ্গে সঙ্গে আমিও আকাশকে হেসে উঠতে দেখি । গাছে গাছে পাখিরা জেগে উঠে গান গায় । রাজির সঙ্গে সঙ্গে আমি সেই গান শুনি । ভোরবেলা এই স্নিগ্ধ শান্ত সময়ে কুরূপা রাজির মুখখানা সোনা আলোয় মায়া মায়া হয়ে থাকে ।

আর সেই মায়া মায়া সময়ে আমার নতুন করে সাধ জাগে, আবার চলা শুরু করি । এই যে বালির চড়া, তাকে পেরিয়ে যাই । আমার বুকের মধ্যে সাগর ডাক দেয় ।

কিন্তু রাজির মতই আমি নিরুপায় অসহায় । গ্রামের লোকে আমার একদিকে বাঁধ দিয়ে খাল কেটে দিয়েছে । যেটুকু জল আছে, তা খালের দিকেই বয়ে যায় । কি করে এগিয়ে যাব আমি ! কে পথ করে দেবে আমায় !

কে পথ করে দেবে রাজিকে !

অনেক রাতে, চারদিক নিঝুম হলে রাজি একবার আমার কাছে আসে । আকাশে মায়াবী চাঁদ । চাঁদের আলোয় আমার জলের ওপর চিকচিকে রূপোলী মায়া । সেই মায়ার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে রাজি ।

দুপুরবেলা সব কাজ শেষ করে গাঁয়ের বৌরা আমার কাছে এসে বসে । নদীর ধারে, গাছের ছায়ায় । সেখানে রাজিকে কেউ ডাকে না । রাজি তখন খালের মুখটায় বসে কাপড় কাচে । তখন আবার ছায়াটা এসে দাঁড়ায় । লম্বা ছায়াটার দিকে তাকিয়ে কেমন চমকে উঠে রাজি গায়ের কাপড় টেনে নেয় ।

শুধু একদিন চঞ্চল হয়েছিল । যেদিন মানুষের ছায়াটা একেবারে নদী পেরিয়ে এসে রাজির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল ।

‘চলে যাও । আর কক্ষনো এসো না তুমি ।‘

ছায়ামানুষ বুঝি রাজির চেনা মানুষ ! আমার কৌতুহল হলেও জানতে পারি না । সেদিন চলে গেলেও ছায়ামানুষ আবার আসে । আবার । বারবার ।

শুকনো দু’চোখ তুলে রাজি বলে, ‘কেন আসো বারবার ?’

‘না এসে পারি না যে । তুমি বুঝি সব ভুলে গেছ রাজি ?’

‘হ্যাঁ, ভুলে গেছি । তুমিও ভুলে যাও । বেশ তো সংসার করছ, কাজকর্ম করছ । সে নিয়ে থাকো না কেন? কেন বারবার আসো ? মায়া ? করুণা ?’

আমার মনে হয়, এইসময় যদি রাজির চোখে দু’ফোঁটা টলটলে জল আসত কিংবা আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকত রাজি, তবে ছবিটা সম্পুর্ণ হত । তা হয় না । রাজি যেমন হাসতে ভুলেছে, তেমনই কাঁদতেও ভুলে গেছে । গলার কাছে নীল একটা শিরা জেগে উঠে শুধু রাজির মুখটা আর কুরূপ হয়ে যায় ।

সেই নীল শিরাটার দিকেই মায়ার চোখে চায় ছায়ামানুষ, ‘আর একবার রাজি । আর একবার ..’

নদীতে জল নিতে এসে, কাপড় কাচতে এসে গাঁয়ের মেয়ে বউরা আজকাল রাজির দিকে আড়ে আড়ে চায় । কখনো বা হেসে গড়িয়ে পড়ে । ‘ও রাজি, কি রে ? এতদিন পর ফিরে এসেছে, তোর জন্যে নাকি ?’

‘ও রাজি, তাহলে তোকে বিয়ে করার ভয়ে পালিয়ে গেছিল কেন ? জিজ্ঞেস করিস নি ?’

রাজি উত্তর দেয় না ।

রাজির বৌদি সবার সামনেই রাজির চুল ধরে টানে, ‘নদীর ধারে এসে বসে থাকিস এই জন্যে ?’

রাজি মুখ নামিয়ে থাকে ।

‘বাড়ির লোক তাড়িয়ে দিয়েছে তো ওকে । ওর অসুখ হয়েছে না ? ওর রক্ত খারাপ হয়ে গেছে ।‘ কেউ কেউ খবর
আনে, ‘তাই তো একলা এখানে ঘর বেঁধে থাকে । এখন আবার পুরোনো ভালোবাসা জেগেছে তাই ।‘

অসুখের কথাটা বুঝি রাজি জানত না ! ওর ভাষাহীন চোখ অমন চমকে উঠল কেন !

আমি নিজে নিজেই একটা না-বলা গল্প বুঝে ফেললাম । রাজির সঙ্গে বিয়ের কথা উঠেছিল যার, সে গাঁয়ের কাউকে কিছু না বলে চলে গেছিল । অলক্ষুণে মেয়েকে সেই লগ্নেই বিয়ে দিয়ে পর করে দিয়েছিল রাজির বাড়ির লোক । আর রাজির কপাল যেমন । সে বাড়ি থেকেও একদিন চলে আসতে হয়েছিল । আজ অসুস্থ মানুষটা বুঝি সেদিনের দোষ মুছে ফেলতে চায় ।

অসুখ হোক, আর যা-ই হোক, এমন বিশ্রী ব্যাপার মানবে কেন কেউ ? দোষ তো রাজিরই । নইলে এত বছর পর একটা লোক আবার এমন নির্লজ্জ হয়ে ওঠে ? রূপ নেই, গুণ নেই, এমন মেয়ের টানে কোনো মানুষ আসবে কেন ? কখন আসে?
কুরূপা মেয়েরা কি সংসার করে না ? তাহলে রাজি কেন পারে নি ? কেন স্বামী রাজিকে ছেড়ে অন্য মেয়েকে ঘরে তোলে? সব দোষ রাজির । কিছু তো একটা কারণ আছেই, নইলে দিনের মধ্যে দশবার করে নদীর ধারে যাওয়া কেন ? ওই তো শুকিয়ে যাওয়া নদী । জল নেই, ঢেউ নেই ।

গাঁয়ের মেয়ে বউরা বলতে লাগল, ‘সারাদিন নদীর ধারে থাকে কেন রাজি ? বদ মতলব না থাকলে এমন হয় ?‘
গাঁয়ের মোড়ল বলল, ‘এই নদীটাই অপয়া । এই নদীর জলে শয়তান বাস করে ।‘

সবাই সায় দিল, ‘ঠিক । ঠিক । নদীতে জল নেই । ঢেউ নেই । একটা ব্যাঙাচিও বাঁচে না এ জলে । নদীর জলে বিষ আছে নিশ্চয় । নৌকো চলে না । চাষের কাজেই বা কতটুকু লাগে ? এ নদীটা বুজিয়ে দাও । তবেই শয়তানের মরণ হবে।‘

আরো অনেক কথা হল । গাঁয়ের বুড়োরা এই নদীর ধারে বসেই তো রাজনীতি করে । নেশাখোর ছেলেগুলোর নেশার ঠেকও তো এই নদীর ধারেই । শাশুড়ি-ননদের নামে নিন্দামন্দ এই নদীর ধারে এসেই বেশি হয় । গত বছর দু’ দু’জন কিশোর ডুবে গেল এ নদীতে । অথচ এমন কিছু ডুবে যাবার মত জল নেই । মাথাটা জলের মধ্যে পাথরে লেগে গিয়েই হল । ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এসে নদীর ধারে খেলা করে, নদীটা খারাপ বলেই ওদের শরীর খারাপ হয় । নদীর ধারে এত গাছ । ছেলেমেয়েদের মাথায় গাছের ডালও ভেঙে পড়তে পারে । গাছের ওপর বজ্রপাত হতে পারে ।

দরকার কি এত ঝামেলা রেখে ! নদী না থাকলেই কেউ আর এদিকে আসবে না । গাঁয়ের সব মানুষ সজাগ হয়ে উঠেছে এবার ।

খুব ভয় করছে আমার । তাহলে কি এখানেই যাত্রা শেষ ? আর দেখা হবে না বোনের সঙ্গে ? মাযের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়া হবে না ? মোহানার মুখে দাঁড়িয়ে সাগর দেখা হবে না ? সাগরের সঙ্গে সঙ্গম .. আহ, আর হবে না আমার ?

গাঁয়ের লোকেরা রাজ্যের নোংরা ফেলা শুরু করেছে । নদীতে বাসন মাজা, কাপড় কাচাও বন্ধ । কেউ আর স্নান করতে, জল নিতে নামে না । সরু ধারাটা বয়ে যাচ্ছিল, সেখানে গাছের গুঁড়ি ফেলে মাটি ফেলে রাস্তা বন্ধ হচ্ছে । আসল কথাটা জেনে ফেলেছি আমি । এই নদী, নদীর ধারের জমি সব নিতে চায় ওরা । এখান দিয়ে পাকা রাস্তা হবে । বড় বড় বাড়ি উঠবে । বাঁধ দিয়েও আশ মেটে নি মানুষের ।

এই নদীর জমি নিয়ে দু’ দল লোকের লড়াই লেগেছে । নদী নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই । নদী না থাকলেই বা কি ! জলের জন্যে ভাবনা নেই । ভদ্রাবতী থেকে জল আসছে । ওখানে বাঁধ দেবার পর জলের বড় পুকুর তৈরী হয়েছে যে । না না, পুকুর না । সরোবর । লেক । লেক ঘিরে চমত্কার বাগান । ওটা একটা ট্যুরিস্ট স্পট ।

বোতলে ভরে, বড় বড় ক্যানে ভরে আমার জল বিক্রী হয় এখন । রাস্তার নিচে দিয়ে পাইপ করে কত দূর পর্যন্ত আমার জল নিয়ে যাওয়া হয় । আমার এই শুকিয়ে যাওয়া নদী ওদের কাজে লাগবে না আর ।

রাতারাতি বদলে গেছে এ গাঁয়ের লোক । তাদের কারো চোখে লোভ, কারো চোখে ভয় । বিদ্বেষ, ঘৃণা ।

খুব কষ্ট হচ্ছে আমার । গভীর কষ্ট ।

রাজি এসে মুখ শুকনো করে বসে থাকে আমার কাছে । একদিন ফিসফিস করে বলেছে, ‘তোমার সঙ্গে সঙ্গেই আমারও যাত্রা শেষ হবে ।‘

এ কথাটার মানে কি, আমি বুঝি নি । কিন্তু একজন মানুষ, অন্তত একজন যে আমার কষ্ট বোঝে তা জেনে আমার বুকের মধ্যে থেকে জল উছলে উঠেছে ।

আমি অবশ্য জানতাম না, আরো একজন মানুষ আমাকে গভীর ভাবে দেখে । সেই দৃষ্টিতে লোভ, ভয়, বিদ্বেষ নেই । রাজির মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সে আমারই দিকে চেয়ে থাকে । সে দৃষ্টিতে মায়া, মমতা, ভালোবাসা । আর আজ এতদিন পরে ছায়ামানুষকে আমি চিনতে পারলাম ।

এ তো সেই ছেলেটা । হাফপ্যান্ট পরে খালি গায়ে আমার জলে দাপাদাপি করত । এই তো সেই ছেলেটা, যে একদিন ছোট্ট নৌকো করে রাজিকে নিয়ে আমার জলে ভেসেছিল ওই চাঁপা গাছের তলা থেকে । তখন তো আমার দুই ধারে কত নৌকো । সারাদিন ধরে কত পারাপার । তবু ওদের মনে আছে আমার । নৌকোয় বসে আমার জলে ভালোবেসে হাত দিয়েছিল রাজি । তারপর এই এতগুলো বছর কোথায় ছিল ও ?

কেন জানি না, বেশ স্বস্তি হল আমার । সেই যে হাফপ্যান্ট, সময়ে অসময়ে এসে গাছের ডালে চড়ে পাখির বাসা খুঁজে বার করত, তরতর করে নারকোল গাছে চড়ে পড়ত, নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে পারাপার করত, সে এখন কত শান্ত ভদ্র সুন্দর । আমি বেশ নিশ্চিন্ত হলাম ।

গাঁয়ের লোকের কাছে অন্য কথা বলতে লাগল সে । নদী ঈশ্বরের আশীর্বাদ । নদীর ধারে সারাদিন ধরে মানুষের মেলা। তা কোনো শয়তানের টানে নয় । নদী একজন মানুষকে আরেকজন মানুষের কাছে টেনে আনে । নদী মানুষকে সামাজিক হতে শেখায় ।

নদীর জলে আলো-ছায়ার খেলা । নদীর ধারে ধারে সবুজ ক্ষেত, চিরসবুজ বনানী । নদী সুন্দর । নদী প্রাণ দেয় । তাই না যত জলের প্রাণী, শামুক গেঁড়ি গুগলি থেকে ছোট বড় মাছ, না-দেখা অসংখ্য জলের প্রাণী বেঁচে থাকে । শুধু প্রাণী কেন, উদ্ভিদ নেই ? সবুজ শ্যাওলা থেকে রঙিন শালুক পদ্ম । আহা, বড় সুন্দর । এই যে কত হাঁস .. ওই একটা পানকৌড়ি ডুব দিয়ে উঠল .. সকালবেলা যে সাদা বকের সারি আকাশ আলো করে উড়ে উড়ে আসে .. নদী না থাকলে এমন হত ?
 
নদী সুন্দর । নদী ভালো । নদীর জল ভালো । নদীর হাওয়া ভালো । আমাদের ক্লান্তি দূর করে, অবসাদ বিষাদ দূর করে। নদী না থাকলে মানুষের অনেক ক্ষতি । নদীর জল নোংরা করলে মানুষের ক্ষতি ।

শুধু মুখে বলা নয়, আমার চলার রাস্তা থেকে সব বাধা দূর করার ইচ্ছেও জানিয়েছে সে । বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে আমার জল পরিষ্কার করা, কেউ যাতে নোংরা না ফেলে সে জন্যে পাহারা দেওয়া ।

গাঁয়ের লোকেরা এখন তিন ভাগে ভাগ হয়েছে । একদল লোক, যারা নদী শয়তান শুনে রাগ করেছিল, তারা নদীর এত গুণের কথা শুনে শান্ত । তারা আর নদী নিয়ে মাথা ঘামায় না ।

আর একদল লোক, রাজিও তাদের মধ্যে একজন, তারা ভালোবেসে রোজ আমার কাছে আসে । আমার চলার পথের বালি, পাথর, গাছের ডাল সরিয়ে দেয় ।

কিন্তু আরেকদল লোক নির্মম, নিষ্ঠুর । তারা প্রতিজ্ঞা করেছে, এই জমি তারা নেবেই । দরকার হলে রক্ত ঝরবে, লাঠি বল্লম সড়কি বন্দুক সবরকম দিয়ে তারা লড়াই করবে ।

নতুন করে ভয় হচ্ছে আমার । আমাকে নিয়ে মানুষে মানুষে এমন সংঘর্ষ হবে ?

সেদিন সারা বেলা ধরে সে কী হট্টগোল । একদল মাটি ফেলতে এসেছে । ট্রাক ট্রাক মাটি, বালি । নদী বুজিয়ে ফেলবে । আরেকদল সার দিয়ে নদীর ধারে বসে । মাটি ফেলতে দেবে না ।

পাখিরা ভয় পেয়ে এ গাছের মাথা থেকে ও গাছের মাথায়, তারপর ছটফটিয়ে আকাশে উড়ে গেল । একদল ছাগল এ পাশের সবুজ ঘাসে মাথা ডুবিয়ে ঘাস খাচ্ছিল, তারা ভয় পেয়ে ছুটে চলে গেল । বড় বড় কালো মোষগুলো ভয় পেয়ে জল ছেড়ে উঠে গেল । গাছের ডালগুলো মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে পাতা ঝরাতে লাগল । আশেপাশের বাড়িগুলো দরজা-জানলা বন্ধ করে নিঝুম হয়ে গেল ।

রাত হল । চারদিকে নি:সীম অন্ধকার । নিস্তব্ধ । নি:শব্দ । মাথার ওপর চাঁদ নেই আজ । আকাশের তারাগুলো কেমন ভয় পেয়ে তাকিয়ে আছে ।

রাজি বসেছিল আমার কাছে । ওপারে বসেছিল রাজির ছায়ামানুষ । নিশ্চুপ । তাকে নিয়ে রাজিকে নানা বদনাম দেবার পর থেকে সে আর রাজির কাছে আসে না । গাঁয়ের মেয়ে-বউরা অবশ্য অন্য কথা বলে । ওর অসুখের কথাটা জানাজানি হয়ে গেছে বলেই ভয় পেয়ে সরে গেছে ও । রাজিও নিশ্চয় সব বুঝতে পেরেছে ।

নিজের মনে ভাবছিলাম । দেখতে পাই নি । গাছের মাথায় পাখিগুলো অসময়ে কিচির মিচির করে উঠল । হাওয়া নেই, তবু পাতাগুলো দুলতে লাগল । হাতকাটা গেঞ্জি, শক্ত চোয়াল, নির্মম চোখ । হাতে ধারালো অস্ত্র । রাজিকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে একদল নির্মম মানুষ । নদীর বন্ধু হবার শাস্তি দেবে । কুরূপা হোক, আর অলক্ষুণেই হোক, মেয়ে তো । মেয়েদের শাস্তি দেবার অধিকার পুরুষের আছেই । এমন শাস্তি দেবে, গাঁয়ের লোক আর বাধা দেবার সাহস পাবে না ।

স্তব্ধ মুহূর্ত । অনিশ্চিত মুহূর্ত ।

আকাশের একটা তারা টুপ করে খসে পড়ল । আর কে যেন আমার জলে ঝাঁপ দিল । সাঁতার । ডুব সাঁতার । সাগর সঙ্গমে আমার যেমন গতি বেড়ে ওঠে, সেইরকম বেগে কে যেন জল সরিয়ে যেতে লাগল ।

তারপর বজ্রনির্ঘোষ । কী যে হল, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না ।

শুধু দেখতে পেলাম, রাজিকে ছাড়িয়ে নিয়েছে ছায়ামানুষ । এখন আর ছায়া নেই, চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তাকে ।

মুখোমুখি দুই দল ।

‘নদী থাকবে না । নদী শয়তান । ও মেয়েমানুষটাকে ছেড়ে দিচ্ছি, নদী আমাদের চাই ।‘

‘না । নদী জীবন । নদী না থাকলে জীবন থাকে না । আর মেয়েমানুষ আবার কি ? ও মানুষ । একজন আস্ত মানুষ ।
তোমাদের গায়ে বুঝি অনেক জোর ? তাই মানুষের ওপর সে জোর দেখাচ্ছ ?’

‘ও তো একটা নষ্ট মানুষ । ওর জীবনের দামই বা কি ? বেশ তো, ওকে তো ছেড়েই দিয়েছি । ওকে নিয়ে চলে যাও । আমরা নদী চাই না । নদী না থাকলেই জীবন । বড় বাজার, মাল্টিপ্লেক্স, বড় বড় বাড়ি । অনেক মানুষের জীবন । আমরা ওই কালো অন্ধকার কাটিয়ে আলো জ্বালাব । ঝলমলে আলো ।‘

‘কোথায় কালো ? অন্ধকারই বা কোথায় ? নদীর জলে ওই দ্যাখো, কেমন রূপোলী চাঁদের আলো । আকাশের তারাগুলো কেমন ঝিকিমিকি আলো জ্বেলে রেখেছে । নকল আলোয় কি আর আসল আলো আড়াল হয় ? সাদাকে কালো করে দেখলেই হল ? তাই তো আলো থাকলেও সব অন্ধকার দেখায় ।‘

‘তুমি বুঝি কালো দেখতে পাও না ? পৃথিবীতে বুঝি শুধুই আলো ? অন্ধকার নেই ?’

‘না, নেই ।‘

‘নেই ?’ হাত থেকে খসে পড়ল তীরধনুক, বল্লম বন্দুক । ‘কি করে বলছ এ কথা ? অন্ধকার একটা বাস্তব । অন্ধকার নেই ? কালো নেই ?’

‘না গো । নেই । বাস্তব অবাস্তব বলেও কিছু নেই । আমাদের জানার বাইরে আছে অনেকখানি । সব আলো, সব সুন্দর
.. কোথাও কালো নেই, কোথাও অন্ধকার নেই .. এমন কখন হয় জানো ? যখন নিজের ভেতরে আলো জেগে থাকে ।‘

এমন কথা তো কেউ বলে নি আগে ! কেড়ে নিতে হবে, ক্ষমতায় শক্তিতে বেড়ে উঠতে হবে, এই তো জেনেছিল সবাই । আলো জ্বালার কথা কেউ তো শেখায় নি । তাই তো । চারদিক আলো আলো হয়ে উঠলেই না ঠিক ঠিক দেখা যায় । নদীকে, প্রকৃতিকে, নিজেকেও ।

আমি দেখলাম দু’দল মানুষ একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছে । তাদের চোখে ভালোবাসা । বুকের মধ্যে আলো জেগে উঠলেই এমন চোখ হয় ।

এখন আর ভিড় নেই । শুধু দুজন মানুষ । একে অন্যের দিকে চেয়ে আছে ।

‘তুমি বাড়ি যাও রাজি ।‘

‘চলো ।‘ রাজি একদিকে এগিয়ে গেল ।

‘ওদিকে কেন রাজি ? তুমি বাড়ি যাও । আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি । আর বিরক্ত করব না তোমায় ।‘

‘তুমি যে বললে, নিজের ভেতর আলো জ্বালার কথা ? তাহলে বাধা দিচ্ছ কেন ? আমার বুঝি নিজের ভুল বোঝার কথা থাকবে না ?’

‘কিন্তু আমার অসুখের কথাটাও সত্যি । রক্ত খারাপ হয়ে গেছে আমার । ওরা বোধহয় ঠিকই বলেছে । অসুখ হয়েই মন দুর্বল হয়েছে আমার ।‘

‘তাই ?’ হাসলে যে রাজিকে এমন সুন্দর দেখায় আমি জানতাম না । ‘তাহলে কুরূপা অলক্ষুণে মেয়ের সঙ্গে অসুস্থ দুর্বল মানুষের জোড় । এক্কেবারে ঠিক ঠিক । না ?’

‘মায়া করছ রাজি ? অসুখ হয়েছে বলে করুণা ?’

‘তাই মনে হচ্ছে তোমার ? এই দ্যাখো, এই নদীর দিকে চেয়ে দ্যাখো । সব হারিয়েও বয়ে চলেছে । জীবনের অন্য নাম হল গতি । বারবার ওর কাছে এসেও আমি সেটা জানতে পারি নি । আজ তুমিই তো শেখালে আমায় । আমি বুঝি নিজের ভেতরে আলো জ্বালাব না ?’

সুন্দর করে হাসল সে । ‘এসো তাহলে । আমরা দুজন মিলে নদীকে ভালোবাসি ।‘

আমার বুকের মধ্যে বান ডাকল । উছলে পড়ল আলো । আর মানুষ নদী নিয়ে উদাসীন নয় । তাই বুঝি এতদিন পর নদীতে জোয়ার এল । আমার যাত্রা শুরু আবার ।

কুদালি পৌঁছে গেলেই আমার বোনের সঙ্গে দেখা হবে আমার । আমার বোন তুঙ্গা । তারপর থেকে আমাদের আর আলাদা করে চেনাই যাবে না । তখন আমাদের দুজনের একটাই নাম । তুঙ্গভদ্রা । আমাদের কৃষ্ণা-মা আমাদের পথ চেয়ে বসে আছেন । মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তবে শান্তি । সাগরে যাবার জন্যেই যে আমার এতখানি পথ চলা ।

গল্প - মৌ দাশগুপ্তা

অল্প-স্বল্প গল্প-গাথা
মৌ দাশগুপ্তা



বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সিনহা বাড়ীর মহিলা মহলে সাজ সাজ রব, অথচ দেখতে গেলে ব্যাপারটা এমন কিছু আহামরি নয়। প্রতি মাঘী পূর্ণিমায় এ বাড়ীর আরাধ্যা কমলা কিশোরীর পূজো হয়। এ বছর একে মাঘী পূর্ণিমা বৃহস্পতিবারে পড়েছে, তারওপর বাড়ীর গিন্নী সুশীলা দেবীর বিচ্ছিরি ধরনের ডায়াবেটিস ধরা পড়ায় নতুন বউ রাই এর ওপর পুরো ঝঞ্ঝাটটা এসে পড়েছে। সে বেচারা এমনিতেই একটু ধীর স্বভাবের , তায় মেজাজী শাশুড়ীকে একটু ভয়ই পায়, কখন কোন কাজে কি খুঁত ধরা পড়বে আর মিষ্টি কথার হূল খেতে হবে, সেটা ভেবেই একটু তফাত থাকে, আজ আর বেচারীর রেহাই নেই।

বাড়ীর লোকসংখ্যা যে অনেক তা নয়, গৃহকর্তা কেশব বাবু, বাড়ীর গিন্নী সুশীলাদেবী,তাঁদের ছেলে কৃষ্ণমোহন, ছেলে-বৌ রাই, কলেজ পড়ুয়া দুই মেয়ে কান্তা আর করুণা,কেশব বাবুর দূর সম্পর্কের বিধবা ভাগ্নে-বৌ বনলক্ষ্মী (বাড়ীর বিনা পয়সার রাঁধুনী), আর সব সময়ের কাজের লোক সাবিত্রী, কূল্যে আটজন। বাড়ীর পুরুষমানুষরা অত ভক্তিমান নন, দুজনেই যথানিয়মে এবং যথাসময়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছেন অতএব মহিলা মহল সোৎসাহে ভীড় জমিয়েছেন দোতলার ঠাকুরঘরে। আজ ঘরের হেঁসেলে নিত্যকালীন ভাতডাল রান্নার পাট নেই, ছেলেরা পূজোয় ভাগ নেবেন না, তবে ঘরেও ভাত জোটেনি তাই আজ অফিস ক্যান্টিনেই খেয়ে নেবেন। ঠাকুরঘরের পাশের একফালি ছাদটাই ধুয়ে মুছে গঙ্গাজল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে,নতুন তোলা উনুনে পূজোর হাঁড়ি পাতিলে ভোগ বানানোর প্রস্তুতি চলছে।

রান্নাবান্নার দায়িত্ব রোজকার মত বনলক্ষ্মীর ওপর, রাই-র ওপর ঠাকুরঘরের কাজ,যে যার কাজে লেগে পড়েছে। সাবিত্রীর রোজকার ঝাঁটপাট,মোছামুছি,ধোয়াধুয়ি চলছে, বাড়ীর বড় মেয়ে কান্তার সাথে সকালেই তর মায়ের একচোট লড়াই হয়ে গেছে, আজ বাড়ীর পূজোর অজুহাতে সুশীলাদেবী কান্তাকে ঘরবন্দী করেছেন, এদিকে ওর বন্ধু, (ইয়ে, মানে বিশেষ ছেলেবন্ধু) মাধব আজ একটু বিশেষ ধরনের জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবে বলে সারপ্রাইজ দিতে চাইছে, এখন কান্তা কি করে? মাকে বলতে পারছে না মাধবের কথা, আর মাধব বুঝছে না বাড়ীর অসুবিধার কথা। তাই দুজনের উপর রাগ করে দোতলাতেই নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে । ছোট মেয়ে করুণার ঠাকুর দেবতায় অত ভক্তি-শ্রদ্ধা নেই, নেহাত কলেজে সেমিষ্টার পরীক্ষা চলছে, কলেজ বা বন্ধুর বাড়ী গিয়ে বসে থাকতে পারছে না, আর দিদির সাথে মায়ের ঝামেলার বহরটাও দেখে নিয়েছে,তাই কানে হেডফোন গুঁজে বইপড়ার ভান করছে। সুশীলাদেবী ঠাকুরঘর আর রান্নার জায়গার মাঝে চেয়ার পেতে বসে সবদিকে নজর রাখার মহান কাজটি করছেন।

কথায় বলে কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, এখানে সেটা একটু পাল্টে কর্ত্রীর ইচ্ছেয় হয়ে থাকে।পূর্ণিমা লাগবে সন্ধ্যা নাগাদ, ততক্ষণ অবধি সব নির্জলা উপোষ। না খেয়ে থাকলে একদিনে কেউ চোখে অন্ধকার দেখে না, বা অসুস্থ হয়ে পড়ে না সেটা ঠিক-ই, খালি পেটেয় ছুঁচোর দঙ্গল ডন-বৈঠকি মারে। তবে নিজের থেকে মন স্থির না করলে, মানে, বাধ্য হয়ে, বা অন্যের কথামত উপোষ করে আছি ভাবলেও খিদে তেষ্টা বুঝি বা মানুষকে একটু বেশীই কাবু করে তোলে।এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।সবাই যে যার বরাদ্দ কাজ মুখ বুঁজে করে যাচ্ছে বটে,অন্যদিকে ইন্দ্রিয়গুলো কিন্তু পূজোর পাকশালাতেই ঘোরঘুরি করছে। সাবিত্রী আবার সুশীলাদেবীর খাস লোক। ঘরের সবার গোপন এবং নির্ভরযোগ্য খবরটি যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছানোটাও ওর কাজের মধ্যেই পড়ে। বয়স খুব বেশী না হলেও বোঝে খুব বেশী,তাই সময় থাকতেই উঁচু ডালে মই বেঁধে রেখেছে। বাড়ীতে রান্নার পাট নেই, কেউ যাতে লুকিয়ে খাবার খেয়ে উপোষ ভেঙ্গে বাড়ীর অকল্যাণ না করতে পারে তার জন্য গিন্নী স্বয়ং রান্নাঘরে,ভাঁড়ারঘরে,তালা দিয়ে চাবি আঁচলে বেঁধে রেখেছেন।সকালে যেখানে কর্তামশাই দাদাবাবু না খেয়ে বেরিয়েছেন সেখানে কে আর হেঁচিপেচি সাবির জন্য খাবার কোলে বসে আছে? অথচ সাবির মত কাজ সকাল থেকে কে করছে? সেই কোন কনকনে ঠান্ডা ভোর রাত থেকে গোটা দোতলা বাড়ী ঝাঁটপাট,মোছামুছি, এতগুলো লোকের গত রাতের এটোঁ বাসন ধোয়াধুয়ি, কাপড় কাচা চলছে, হাত-পা ভেরে গেছে, কিন্তু পেটে দানাটি অবধি নেই।গিন্নীমাটির রোগজনিত কারণে খাই খাই ভাবটা ইদানীং খুব বেড়েছে, আসল খিদে কি চোখের খিদে বলা মুশকিল , ডাক্তারের কড়া নির্দেশে খাবারের পরিমানতো অনেক কমেছেই, তার সাথে না খেতে পারার তালিকায় অধিকাংশ প্রিয় খাবারের অন্ত্রভুক্তি ঘটায় মনোকষ্টটাও বেড়েছে বই কমেনি। আজ হয়ত তাই সেগুলোই ভোগে উৎসর্গ করার নির্দেশ দিয়েছেন, যেগুলো এখন ওনার নাগলের বাইরে বললেই হয়। কমলাকিশোরীর পরিতৃপ্তির থেকেও কিছুটা নিজের রসনাতৃপ্তির ব্যাপারটাই বোধহয় অবচেতনে কাজ করেছে এদিকে লিস্টি বানিয়েছে যজ্ঞিবাড়ীর,কিন্তু কার যে লোভের পরিতৃপ্তি হচ্ছে দেবতার নামে, সে কি আর কারো জানতে বাকি আছে? । খিচূড়ী, লাবড়া, চরু, নারকোলের নাড়ু,তক্তি,মোয়া,মুড়কি,পুলি পিঠে, মুগতক্তি, রাঁধিয়ে একমনে ঘাড় গুঁজে সকাল থেকে ঘেমে নেয়ে বানিয়ে যাচ্ছে, আর সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘ্রাণে অর্ধভোজন তো হচ্ছেই সাথে মুখের ভিতরে লোকচক্ষুর অন্তরালে যা জল কাটছে তাতে তেষ্টাটাও পাবে না বোধহয়।

গিন্নীমাটি অবশ্য গতর নেড়ে কাজটিওতো করেন না, হাঁটাচলাও তো ঘরের মধ্যেই,এ ঘর থেকে ওঘর। বেশী খেলে হজম হবে কি করে? শকুনির দৃষ্টি মেলে সক্কাল থেকে থানা গেড়েছে সামনে, যেন রাঁধতে রাঁধতে লক্ষী বউদিই আধা পেসাদ পেটে লুকিয়ে রাখবে! সবাইকে নিজের মত নিখাউন্তী ভাবছে ! এদিকে ঠাকুরকে দেবার আগে যে নিজেই চোখ দিয়ে গিলছে সে কি আর কেউ টের পাচ্ছে না? পূজো যাদের ঘরের, উপোষও বাপু তারাই করুক না, কি দরকার অন্যদের জোরজার করে নিয়ম মানানোর?

তারপরে ঐ লক্ষী বৌদি, নিজের বলতে সেরকম কেউ কোথাও নেই বলে, বলতে গেলে একরকম দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়া পরার বিনিময়ে এখানে আছেন, বদলে সংসারের হেঁসেল সামলাচ্ছেন। তাতেও কথা তো আর কম শুনতে হয়না! কিন্তু এই যে এ বাড়ীতে ওনাকে ঠিক পরিবারের একজন বলে মানা হয়না । বরং মাঝে মধ্যে বোঝাই যায় যে ওনার জায়গাটা সাবিত্রীর থেকে খুব একটা আলাদা না, তাও তো সাবির না পোষালে অন্য বাড়ীতে কাজ নিয়ে বেরিয়ে যাবে, বনলক্ষ্মী তো সেটাও পারবেন না। অথচ বাড়ীর পূজোর বাহানায় এই শীতে কাঁপতে কাঁপতে ভোর রাতে স্নান সেরে সারাটি দিন জল অবধি না খেয়ে সেই যে পাকশাল সামলাচ্ছেন তাতে কারো কিন্তু সামান্য কৃতজ্ঞতাটুকু অবধি নেই। তা ওনার তো কারণে অকারণে ব্রত পার্বন,সাত-সতেরো, তার ওপর ছোঁয়াছুয়ি, মানামানিটাও লোক দেখিয়ে একটু বেশী করতে হয়, পূর্ণিমা, অমাবস্যা, একাদশী সবই মানেন, উপোষ করাটা ওনার কাছে হাঁচি কাশির মত নিত্যি ব্যাপার ।অথচ সারাদিন তো রান্নাঘর আর ভাঁড়ারঘরেই খুচখাচ চলে, তা মুখ কি আর চলে না? খুব চলে। নয়তো অত টুসটুসে চেহরাটা থাকে কি করে? আজও সব নিয়ে যে ভাবে সবার দিকে পিছু ফিরে মুখ গুঁজে বসেছে দু এক গাল মুখ চালালেও কেউ টেরটি পাবেনা।

বড়দি তো সাতসকালেই মায়ের সাথে ঝগড়া করে গোঁসাঘরে খিল দিয়েছে, ও প্রায়ই হয়।বাপের আদুরী কিনা, যতক্ষন না বাপে এসে “বাবা বাছা” বলে ডাকাডাকি করবে,ততক্ষন দরজা খুলবে না, আজকাল তাই বড়দি ঘরে দোর দিলে কর্তাবাবু না ফেরা অবধি কেউ ডাকেও না।আর রাগ হলে বুঝি ওদের খিদে টিদেও পায় না।ওদের আর কি? খিদের জ্বালা জিনিষটা কোনদিন ভুগতে হয় নি কিনা! এই যেমন ছোড়দি, খেলে মোটা হয়ে যাবার ভয়ে সেধে একবেলা খায়, ভাত রুটি খায়না, ভাজভুজি,মশলাদার খাবার, মিষ্টি এসব কিচ্ছু খায় না। সারাদিন তো ঐ লেবুর রস, টকদই, ফল, স্যালাডই খায়, সপ্তাহে একদিন নিয়ম করে কারণ ছাড়া উপোষ।

দুই মেয়ের পর ঐ টিংটিং চেহারার কনে বৌটি, আলালের ঘরের দুলালী কিনা,রীতিমত খুঁটে টিপে ফেলে ছড়িয়ে ছাড়া খেতে পারেনা। না খাবার লিস্টিটাই এত বড় যে, কি খায় কে জানে,ডাল খেলে পেট ফাঁপে,ফল খেলে অ্যাসিড হয়,শাক দেখলে বমি আসে,মাটির নীচে হওয়া সব্জিতে অ্যালার্জি আছে।কত ঢং যে জানে। ঘনঘন পেটের প্রবলেমে ভোগে আর খাওয়া দাওয়া ছেড়ে চোখ উল্টে পড়ে থাকে।নেহাত বাপে ডাক্তার , তাই রক্ষে।নয়ত ঐ রক্ষাকালীর অসুখ সারাতেই সব ফতুর হয়ে যেত।

তা সাবির তো আর অত সুখের জীবন না,শখেরও না, রীতিমত গতর খাটিয়ে পেটের ভাত জোগাতে হয়।সাবিকে নিজের ভালোটা নিজেকেই বুঝতে হবে। কাজপাট সেরে গিন্নীমার পা টিপে দেবার আছিলায় বসে থাকতে হবে, ঐ দুই পথের কাঁটা নিজেদের এলাকা থেকে একটু সরলেই টুক করে হাত আর মুখের কাজটা সেরে নিতে হবে, এমনিতেও সকাল থেকে এতপদ রান্না হলে কি হবে, সাবিকে দিতে করো হাত সরবে না তখন সাবির ভাগে যত গুঁড়ো-গাড়া ফেলা-ছড়া জিনিষ!

ভাবনা চলে ভাবনার মত আর সময় চলে সময়ের মত, দুজনেই নিরন্তর বহমান কিন্তু একসঙ্গে যে গতিশীল তা নয়।সময়ে ছেদ পড়ে না, ভাবনায় পড়ে। পুরোহিত এসে পড়ায় সাবিকে চিন্তায় যতি দিতে হল। রাই,করুণা,পুরোহিতের সাথে ঠাকুরঘরে ঢুকলো, বনলক্ষ্মী সারাদিনের ক্লান্তি সরিয়ে নীচে গেল একটু গরম জলে স্নান সেরে সে অঞ্জলি দেবে, সাবির বাবা ত পূজো পাটে ভক্তি নেই।দুমুঠো পেটের ভাত জুটলেই হোল,তা পূজো শেষ হতে এখনও অনেক দেরী, সকালের উপোষী শরীর আর টানছে না অতএব সাবি গায়ে কাপড়টা টেনে গুড়িসুড়ি মেরে নীচের বৈঠকখানায় বসতে গেল, টিভি দেখতে , সুশীলা বোধহয় বড় মেয়েকে ডাকার বৃথা চেষ্টায় যাচ্ছিলেন, এমন সময় হঠাৎ বনলক্ষ্মীর আর্ত চিৎকার। জল গরম করতে গিয়ে বেখেয়ালে শাড়ীতে আগুন ধরে গেছে, বিপদের ওপর বিপদ,চিৎকার শুনে তড়িঘড়ি নামতে গিয়ে সুশীলা সেই যে আছাড় খেয়ে পড়েছেন আর উঠতে পারছেন না।এদিকে পূজো শুরু হয়ে গেছে, থামাতে গেলে অমঙ্গল। নেহাত কান্তা গাড়ী চালাতে জানে,গোঁসা ঘর থেকে বার হয়ে কান্তা তৎক্ষণাৎ মা,বোন,বনলক্ষ্মীকে নিয়ে কাছেই রাইয়ের বাবার নার্সিংহোমের দিকে রওনা দিল, রাই ও চললো সাথে, দু’জন আহতকে সামলাতে দুটো লোক তো লাগবে, নাকি? সপুত্র কেশব বাবুকেও খবর দেওয়া হোল।

যথাবিহিত পূজো-পাঠ, হোম-আহূতি সেরে পুরোহিত মশাই অঞ্জলি দেবার জন্য ডাকলেন যখন, তখন বাড়ীতে সাবি ছাড়ার কেউ নেই। খুব মন দিয়ে পুষ্পঞ্জলি দিল সাবি।“সবার মঙ্গল কোর ঠাকুর, সবার মনের ইচ্ছা পূর্ণ কোর।“

গল্প - পূজা মৈত্র

ভালোবাসার অঙ্ক
পূজা মৈত্র



বিকালের রোদ পড়ন্ত হয়ে এসেছিলো। সূর্য পশ্চিম দিগন্তে, ডুববো ডুববো করছে। পাখিদের ঘরে ফেরার সময় হয়ে এসেছে। অনুমিতার মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় এমন সময় ওদের খেলা ভাঙ্গত। সারা বিকাল মাঠে দৌড়ে বেড়াবার পর, ঠিক এই সময় লুকোচুরি, চোর পুলিশ, কুমীর ডাঙ্গা শেষে, কা-কা ডাক ডাকতে ডাকতে ঘরে ফিরত ওরা। আরও একটু খেলতে মন করত না তা নয়, কিন্তু বাড়িতে সন্ধ্যার পরে ফিরলে কপালে দুর্ভোগ ছিল। সেই ভয়েই ঘরের ছানার ঠিক সময়ে ঘরে ফেরা। আজকেও বড্ড দেরী হয়ে গেছে। স্কুল থেকে ফিরতে এতোটা দেরী কখনো হয়না। আজ দিনটাই ছিল অন্যরকম। সব হিসাব উলটপালট করে দেওয়া একটা দিন। সবাই চলে যাওয়ার পর, অনুমিতা একা একা কমন রুমে বসে ছিল, ফিরতে ইচ্ছাই করছিল না। অনিরুদ্ধ ফোন না করলে, আরও অনেক দেরি হয়ে যেত। অনিরুদ্ধ সব জেনেও অদ্ভুত শান্ত আছে। কি করে যে আছে, কে জানে? খুব চাপা স্বভাবের মানুষ। কম কথা বলে। ধৈর্য্য প্রচুর। কিন্তু এত বড় দুঃসংবাদ জেনেও কোন প্রতিক্রিয়া থাকবে না, তাও তো অস্বাভাবিক। অনিরুদ্ধ কি কোন ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়েছে? ওদের বাড়িতে কথাটা জানাজানি হলে কি যে হবে,অনুমিতা জাস্ট ভাবতে পারছেনা।ওর মাকে বোঝানো, প্রায় অসম্ভব। অনুমিতার মা-বাবা দুজনেই বুঝবেন। অনিরুদ্ধর বাবাও। কিন্তু অনিরুদ্ধর মা হাউস ওয়াইফ। বাইরের দুনিয়ার সম্পর্কে উনার ধারণা সীমিত। ভুলটা যে দুই বাড়ির তরফ থেকেই হয়ে গেছে, একা অনুমিতাদের নয়, এটা উনাকে বোঝাতে অনিরুদ্ধকে বেশ বেগ পেতে হবে। অনুমিতা বুঝতে পারছিলো না, কিভাবে শাশুড়ি মায়ের সামনে কথাটা পাড়বে। নাকি সব দায়িত্ব অনিরুদ্ধকেই দিয়ে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয়। তলপেটটা ব্যথা করছে। বেশ ভারী হয়ে উঠেছে আজকাল। হবে না? তিনমাস হতে এল। অনুমিতা এখন একটানা বেশী হাঁটতে পারে না। অল্প হাঁফ ধরে। তাই ধীরে ধীরে যাতায়াত করে এখন। আগামী ছয় মাসও এভাবেই সাবধানে কাটাতে হবে, ডাক্তারবাবু বলেছেন। কথাটা মনে পড়তেই অনুমিতার মনটা মোচড় দিয়ে উঠল। অবান্তর চিন্তা। সাবধানতার দিন কালকেই শেষ হয়ে যাবে। অনুমিতার মা হওয়া এবারের মত আর হল না।
অনিরুদ্ধ আগেই ফিরে এসেছিল। অনুমিতা ফিরে দেখল, ফ্ল্যাটের কোলাপসিবেল গেট ভিতর থেকে তালা দেওয়া। গড়িয়ায় ভাড়ার ফ্ল্যাটে দুজনে থাকে। অনিরুদ্ধ যাদবপুরে লেকচারারশিপ করে। দর্শনের অধ্যাপক। অনুমিতা গড়িয়াতেই একটা উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের রসায়ন শিক্ষিকা। বছর দুয়েক বিয়ে হয়েছে। দেখাশোনা করে। অনুমিতার বৌদির দাদার বন্ধু অনিরদ্ধ। দুবছরে দুজনে দুজনকে জেনেছে, বুঝেছে, ভালবেসেছে। দুজনের যাতায়াতের সুবিধার জন্য অনিরুদ্ধর শ্যামনগরের বাড়ি থেকে উঠে এসে এখানে ফ্ল্যাট নিয়েছে। অনিরুদ্ধর মায়ের আপত্তি ছিলনা, তা নয়। তবে অনিরুদ্ধ মায়ের একমাত্র এবং আদরের ছেলে। ওর চাওয়ার ব্যাপারে খুব একটা না করতে পারেন না। বেল বাজাল অনুমিতা। অনিরুদ্ধ দরজা খুলে দিল। থমথমে মুখ দেখবে, আশা করেছিল অনুমিতা। কি আশ্চর্য অনিরুদ্ধ মৃদু হেসে দরজা খুলল। অনুমিতা কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছিলনা। নিজেকেই নিজের কাছে খুব ছোট লাগছিলো। ওর জন্য অনিরুদ্ধর স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে।
____ গরম পড়েছে খুব। বসার ঘরের পাখাটাকে জোরে দিতে দিতে বলল অনিরুদ্ধ।
____ হ্যাঁ, তুমি কখন এলে?
____ দুপুরেই ফিরে এসেছি। তেমন ক্লাস ছিল না। গ্লাসে করে অনুমিতাকে জল দিল অনিরুদ্ধ।
____ তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে অনু। টিফিন করেছ? নাকি না খেয়েই কাটিয়ে দিলে?
____ খেয়েছি। এতটা হেঁটে এলাম। তাই। এখন একটু হাঁটলেই হাঁফ লাগে।
____ যত্ন নাও। যাও, ফ্রেশ হয়ে এসো। অনিরুদ্ধ সোফায় বসে বলল।
____ তুমি এতটা শান্ত রয়েছ কি করে বলতো? অবাক চোখে তাকাল অনুমিতা।
অনিরুদ্ধ হাসল। কষ্টের হাসি মনে হল অনুমিতার।
____ তা নাহলে কি করব? সত্যিটাকে মেনে নিতেই হবে। ভুল যখন হয়েই গেছে, তার শাস্তি পেতেই হবে।
____ ভুল?
অনিরুদ্ধ চোখ থেকে চশমা খুলল।
____ হুম। ভুলই। শিক্ষিত হয়েও আমরা শিক্ষার প্রয়োগ করতে পারিনি। প্রি- ম্যারিটাল চেক আপ করে নেওয়া জরুরী জেনেও আমরা করাইনি।করালে আজকে এই দিন দেখতে হতনা।
____ বিয়েটাই খুব ভুল হয়ে গেছে, বল?
অনিরুদ্ধ অনুমিতার অভিমান বুঝল।
____ আমি তা বলিনি অনু। যেহেতু আমাদের দেখেশুনে বিয়ে, তাই চেক আপ করিয়ে নেওয়াই শ্রেয় ছিল। দুজনেই থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার জানলে আমাদের কেউই বিয়েতে মত দিতাম না। ক্যারিয়ার নয় এমন কাউকে বিয়ে করাটাই তখন উচিৎ ভাবতাম।
____ যা হয়ে গেছে, তাকে নিয়ে আফসোস করা ছাড়া উপায় কি? অনুমিতা চোখ মুছল। একটা আশা ছিল, জানো? বেবি যদি থ্যালাসেমিক না হয়? এমনও তো হয়। কিন্তু আজকের অ্যামনিয়োসেন্টেসিসের রিপোর্টটাই সব গোলমাল করে দিল।
____ বরং বাঁচিয়ে দিল বল।
____ মানে? অনুমিতা অবাক হল।
অনিরুদ্ধ ওর পাশে এসে ওর হাতে হাত রাখল।
____ দেখ অনু, যদি তোমাদের স্কুলে থ্যালাসেমিয়ার স্ক্রিনিং দল না আসতো, আর তুমি যদি সেখানে রক্ত না দিতে, তাহলে আমরা জানতেই পারতাম না ছয় মাস পরে যে পৃথিবীতে আসছে, সে অসুস্থ। তাকে অজান্তে পৃথিবীতে এনে কষ্ট দিয়ে ফেলতাম। আমাদের দোষের বোঝা তাকে জীবন দিয়ে বহন করতে হত। তার থেকে জেনে গেছি, ভালই হয়েছে।
____ ডাক্তারবাবু বললেন, কালকেই অ্যাবোরশনের ডেট।
অনিরুদ্ধ অনুমিতার হাতে চাপ দিল।
_____ যা করতেই হবে, তাকে ফেলে রেখে লাভ কি? মিথ্যা মায়া বাড়িয়ো না অনু। কাল আমি ছুটি নিয়েছি। তোমার পাশে থাকব।
_____ মিথ্যা মায়া বলছ? আমি যে ওর মা। ওকে নিজের হাতে মেরে ফেলব?
অনুমিতার চোখ থেকে অঝোর ধারা বইছিল।
_____ সুস্থ জীবন যাকে দিতে পারবে না, তাকে এনে শাস্তি দেবে কেন? কষ্ট হলেও ওর ভালর জন্যই তোমাকে আমাকে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
_____ তোমার বাড়িতে কি বলবে?
_____ সত্যিটাই বলব।
_____ তোমার মা?
_____ কি আর বলবে? প্রথমে বুঝতে চাইবে না। পরে বুঝতে হবে।
_____ আমাকে দোষ দেবেন। শাপ-শাপান্ত করবেন।
অনুমিতার কথা ফেলতে পারল না অনিরুদ্ধ।
_____ হয়ত। তবে মাকে আমি বুঝিয়ে বলব, যে তোমার যতটা দোষ ততটাই আমার। না বুঝলে কি আর করব? সচেতনতার অভাবেই তো ভুগতে হচ্ছে সবাইকে।
_____ ডাক্তারবাবু বলছিলেন প্রায় ২৫% ক্ষেত্রে মা-বাবা দুজন বাহক হলেও বাচ্চা নাকি থ্যালাসেমিক হয় না? বলছিলেন কয়েক মাস বাদে আবার চান্স নিতে।
অনিরুদ্ধ ঘাড় নাড়ল, না- বাচক।
_____ আমিও নেটে দেখেছি অনু। তবে আমি এই জুয়োখেলায় আর যেতে চাই না। তোমাকে আবার এক নিদারুণ কষ্টের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন অভিপ্রায় আমার নেই। কি গ্যারান্টি আছে যে পরের বার সুস্থ সন্তান আসবে? না আসলে? আবার পরের বার? না, না। আমি এতে রাজি নই।
অনুমিতা বিহ্বল হয়ে গেল। তার মানে অনিরুদ্ধ চায় না, যে অনুমিতা আর মা হোক? অন্তত চেষ্টা করে দেখতে চায় অনুমিতা। ভাগ্যে থাকলেও তো থাকতে পারে।
____ তাহলে আমি কখনো মা হতে পারব না অনিরুদ্ধ? চেষ্টাও করব না?
_____ নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখ অনু। এই কয়েকদিনে নিজের কি অবস্থা করেছ সে খেয়াল আছে? তোমার শরীর মন কে বিপদে ফেলে, বারংবার কষ্ট দিয়ে সন্তান আসুক, আমি চাই না। বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করালে হয়ত বিয়েটাই হত না, কিন্তু বিয়ের দুবছর পরে, তোমাকে ভালবেসে ফেলার পরে, তোমার কষ্টের বিনিময়ে কোন কিছুই চাইনা আমি।
অনুমিতা কথা বলার ভাষা ছিল না। মিতবাক অনিরুদ্ধ এই প্রথম এত জোর গলায় ভালবাসার কথা বলল।
____ কিন্তু...
____ কোন কিন্তু নয়। কালকের কাজটা সেরে আসি। তারপর দুজনে মিলে তোমার মা হওয়ার খোঁজ শুরু করব। কেমন?
_____ মা হওয়ার খোঁজ? এই যে বললে, চেষ্টা করবে না?
_____ চেষ্টা করব না বলিনি তো? অনিরুদ্ধ হাসল। একটু অন্যভাবে করব, বুঝলে? আজ সুজয়ের মেয়েটাকে দেখলাম। দারুন ফুটফুটে হয়েছে।
_____ সুজয়দা এনেছিলেন নাকি?
_____ হ্যাঁ। শ্রীতমাও ছিল। দারুণ খুশি আছে ওরা। বাচ্চাটা এত কিউট কি বলব? তোমার ফোন পেয়ে মুড অফ ছিল। ওকে দেখেই সমাধান খুঁজে পেলাম।
অনুমিতা বুঝল অনিরুদ্ধ কি বলতে চায়। সুজয়দা শ্রীতমা বৌদি মাস ছয়েক আগে সৃজাকে দত্তক নিয়েছেন। এখন বছর খানেক বয়স মেয়েটার। অনুমিতা আগেও ওর ছবি দেখেছে। ফেসবুকে। খুব সুন্দর। পরীর মত।
____ অ্যাডপট করবে?
____ আপত্তি আছে?
____ আমার নেই। কিন্তু তোমার মা?
_____ মানবে না? এই তো? আমাদের সন্তানকে যাতে মানে, বোঝাবো। বুঝবে আশা করি। না বুঝলে কি আর করার আছে? সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। অসুস্থ কাউকে আনার থেকে, সুস্থ যে, তাকে অনাদরের জায়গা থেকে এনে আপন করে নেওয়াই শ্রেয়, কি বল?
অনুমিতা অনিরুদ্ধর বুকে মাথা রাখল। সায়েন্সের ছাত্রী ও। সায়েন্স না মেনে নেওয়া সিদ্ধান্তটা জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল বলে কষ্ট পাচ্ছিল। অঙ্কে ভুল হয়ে গেছে ভেবে চোখের জল ফেলছিল। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে ভুল হয়েই ভাল হয়েছে। না হলে ভালবাসার অঙ্কটা এ জীবনে মিলত না।

অনুগল্প - অভিলাষা দাশগুপ্তা আদক

স্বপ্ন
অভিলাষা দাশগুপ্তা আদক


ন্যাশনাল এ্যথলেটস মীট । এবার হচ্ছে যুবভারতীতে। তাই ১০০ মিটার, ৪০০ মিটার, ৮০০ মিটার (সিঙ্গল) আর ৪০০ মিটার রিলে রেসে একটা স্থানীয় মেয়ের নাম ঘোষিত হওয়ার সাথে সাথে গোটা স্টেডিয়াম দুলে উঠছে হাততালি, জয়ধ্বনি আর খুশীর চিৎকারে। সোহনী পাল, মাত্র ১৬ বছরেই তাক লাগিয়ে দিচ্ছে তাবত ক্রীড়ামোদীর, ক্রীড়া সমালোচকদের। সোহিনীকে মিলখা সিং বা পি টি উষার আগামী দিনের উত্তরসুরী বলে অনেকেই মনে করছেন । ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো মেয়েটার ঘর্মাক্ত লালচে মুখে মুর্হূমুহূ ফ্ল্যাশবাল্বের ঝলক। সাথে যুগপত জয়ধ্বনি “সোহিনী,সো-হি-নী,সোহিনীইইইইইইই”, আস্তে আস্তে আওয়াজের তীব্রতাটা কমে গেল, কে যেন গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকছে, “সোহিনী,সো-নী,সোনীইইইইইইই”.., মায়ের আদরের ডাকটা বুঝতে একটু সময় লাগে সোহিনী ওরফে সোনীর, চোখ খুলতেই টিউবের চড়া আলো, ইসসস, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এতক্ষন ঘুমিয়েছে? কাঁচা ঘুমভাঙ্গা চোখে মায়ের দিকে তাকায় সোহিনী, সোমা, সোহিনীর মা আলতো হেসে বলেন,

- আর ঘুমায় না সোনী, রাতে ঘুম হবেনা যে। বাবা এসে গেছেন। ডিমের চপ বানিয়েছি আজ, খাবিতো ? তোর বাবা কখন থেকে বসে আছে তোর জন্য, আয় তাড়াতাড়ি।

বিছানার পাশে হেলান দেওয়া অ্যালুমিনিয়াম-ফাইবারের ক্রাচটা মেয়ের দিকে বাড়িয়ে ধরেন সোমা।

ধারাবাহিক উপন্যাস - ঐন্দ্রিলা মুখার্জী

ভালবাসার দিনকাল
ঐন্দ্রিলা মুখার্জী
 


(১)

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চান্দ্রেয়ী । ভিজে চুল , ঈষৎ কোঁকড়ানো , টিকালো নাক,সুডৌল চিবুক, ছোট কপাল । ডানহাতের তর্জনী ও বুড়ো আঙুলের সাহায্যে এক চিমটে সিঁদূর নিয়ে সরু সিঁথিতে ছোঁয়ালো চান্দ্রেয়ী । তারপর নাকের ওপরে পড়া গুঁড়ো সিঁদূরটা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে, একটু হাসলো ।আঁচলটা ঠিক করে আরও একবার আয়নায় নিজেকে দেখলো আর ভিজে চুলটা পিঠের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে , একটু নাক কুঁচকে ,মিউজিক সিস্টেমটা অন্ করল ।এফ.এম এ রূপঙ্করের গান ....."গভীরে যাও, আরও গভীরে যাও.....এই বুঝি তল পেলে ,ফের হারালে.....প্রয়োজনে ডুবে যাও".......হালকা একটা ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো চান্দ্রেয়ী । একটা বালিশ নিয়ে শরীরটা এলিয়ে দিল বিছানায় । চোখ বুজে একটু শ্বাস নিল, যেন আঘ্রাণে অনুভব করতে চাইলো গানটা। হঠাৎ একরাশ ঝোড়ো হাওয়ার মতো ঘরে ঢুকলো আত্রেয়ী । 'এই দিদি, জাম্বোর ফোন ! ধর ধর ।'.......রেশ কেটে গেলো চান্দ্রেয়ীর ।ফোন হাতে নিয়ে স্নিগ্ধ কন্ঠে বলল 'হ্যালো, এই যে মশাই তোমার কি ব্যাপার বলতো, ফোন করতে হলে খালি কি ত্রয়ীর নাম্বারটাই মনে আসে ?'...ফোনের ও প্রান্তে রাজদ্বীপের আরক্ত কন্ঠ ভেসে ওঠে ....

রাজদ্বীপ : তাই , নাকি তোমার ফোনটা কোনও সময়ই তোমার কাছে থাকেনা ! সারাদিন কোথায় থাকো দয়ি ....ফোনের আওয়াজও শুনতে পাও না ?

চান্দ্রেয়ী : ওহো ,সরি সরি , আমি স্নানে গিয়েছিলাম তো ......

রাজদ্বীপ : সেটা তো আধঘন্টা আগে...তারও একঘন্টা আগে কি করছিলে শুনি ?

চান্দ্রেয়ী : তুমি কি আমাকে জেরা করছো নাকি !

রাজদ্বীপ : ল্যান্ডলাইনটা এনগেজড ছিলো ....মানে নেট খোলা ছিলো ..যাক্ ছাড়ো ,কাজের কথায় আসি....আমার এখানে আরও দিন তিনেক সময় লাগবে...ফিরতে ফিরতে শনিবার । ডিংগোকে নিয়ে একটু বেরিয়ো ,তবে সাবধানে ,আজকাল এতো আনমনা হয়ে থাকো....

একটু চুপ করে থেকে চান্দ্রেয়ী বলে,

'ঠিক আছে বাবা,ঠিক আছে ....জানতো ....( একটু চুপ করে থেকে)....না থাক পরে বলব....তুমি কি ত্রয়ী বা ডিংগোর সাথে কথা বলবে?'

রাজদ্বীপ : না না আমি এখন রাখছি ।

ফোনের লাইন কেটে গেলো ....চান্দ্রেয়ী হাতে ফোনটা ধরে কিছু একটা ভাবতে লাগল । আত্রেয়ী ঘরে আসল,বলল 'কিরে , কথা হল? জাম্বো কি বলছে ? কবে ফিরছে?'
চান্দ্রেয়ী কথাটা ঠিক শুনেও শুনেছিল না....আত্রেয়ী বিছানার ওপর ফেলে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল'তুই কিন্ত একটু বেশিই ফিদা হয়ে যাচ্ছিস সাঁঝে'র ওপর'....
কথা শেষ না হতেই চান্দ্রেয়ী বলে উঠল 'এভাবে বলিস না,....একটা সাদামাটা ব্যাপারকে নিয়ে এত জল ঘোলা করার খুব দরকার আছে কি ?'

আত্রেয়ী: সাদামাটা হলেই ভাল....চ্যাটিং আমরাও করি ....কিন্তু এতটা ইনভল্ভমেন্ট....আই থিন্ক....

চান্দ্রেয়ী: ঔচিত্যবোধটা মানুষের কনসেন্স থেকে আসে ত্রয়ী, আর আমার কনসেন্স আমাকে কাউন্টার করেনি কখনও ....তাই...

আত্রেয়ী: ওহো দিদিভাই....তুই রেগে যাচ্ছিস....লিভ্ ইট.....চল না আজ একটু শপিং -এ যাই!!

চান্দ্রেয়ী: (এবার একটু সহজ হয়ে হেসে বলল)হুম্.......বুঝেছি!! সায়ন আসছে বলে?.....কি রে ? তোর কি হল....ত্রয়ী । যে তুই জিনস ছাড়া কিছু পড়তে চাইতিস না.....আজ আলমারীতে আমার শাড়ি দেখছিস!!! সায়ন তোকে কি বদলে দিল নাকি ....আচ্ছা চল বেরিয়ে আসি কোথাও একটা......

আত্রেয়ী দিদির কথায় একটু লজ্জা পেল।


(২)
দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়ার পর চান্দ্রেয়ী ওর বেডরুমে এল। বেডরুমটা সাউথ ফেসিং......দক্ষিণে একটানা একটা বড় জানলা....সেই জানলার একদিকে চান্দ্রেয়ী আর রাজদ্বীপের হাল ফ্যাশনের স্টিলবেড । বেডের পাশে সাইড টেবিল....ল্যাম্প শেড ...... উল্টোদিকে একটা ফুল সাইজ কাবার্ড উইথ মিরর...... ডিংগো ওদের ৯ বছরের ছেলে......ওদের পাশের ঘরটা ডিংগোর ।দুটো ঘরের মাঝে একটা কমন্ দরজা । ডিংগো সিমলার একটা কনভেন্ট স্কুলে পড়ে ।এখন এই সামার ভেকেশনে বাড়ী এসেছে ।রাজদ্বীপ চায় ডিংগোর ব্রাইট কেরিয়ার ।ক্লাস ফোরের ডিংগো সারাদিন ল্যাপটপে ভিডিও গেম খেলছে ।
চান্দ্রেয়ীর বিয়ে হয়েছে এগারো বছর ।একটা সময় ছিল যখন সে তার অফিস নিয়ে বেশ ব্যস্ত থাকত । তখনও ডিংগো হয়নি । তখন শ্বশুর শ্বাশুড়ি দুজনেই ছিলেন । তার বছর দেড়েকের মাথায় ডিংগো হওয়ার আগেই রাজদ্বীপের মা মারা গেলেন ।এরপর ডিংগো হল....আর তার চারমাসের মেটারনিটি লিভ্ ও শেষ হল ।অফিস জয়েন করার জন্যে তখন ব্যস্ত চান্দ্রেয়ী....সাথে সাথে চিন্তাও....কি করবে....ডিংগোকে কার কাছে রেখে যাবে!!!! তার এই চিন্তায় ছেদরেখা টানল রাজদ্বীপ ।ছেলেকে আয়ার হাতে ছেড়ে অফিস করতে দিতে নারাজ সে ।....শুরু হল চান্দ্রেয়ীর আপোষ ।বিপত্নীক শ্বশুর মশাই, ডিংগো, রাজদ্বীপ .....এই তিন বয়সী তিনটি পুরুষের মাঝখানেই আটকে রইল চান্দ্রেয়ী ।রাজদ্বীপের বাবা চাইলেও রাজদ্বীপের উষ্মা তাকে বলিষ্ঠ হতে দেয় নি ।
প্রায় চার বছর হল রাজদ্বীপের বাবা মারা গেছেন ....ডিংগো বোর্ডিং-এ...আর রাজদ্বীপ প্রায়শই ট্যুরে.....চান্দ্রেয়ী দিনে দিনে ক্রমশঃ একা হয়ে গেছে ।এরই মাঝে তার মা মারা যাওয়ায় সে তার ছোটো বোন আত্রেয়ীকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে ।চান্দ্রেয়ীর বাবা তো সেই কোন ছেলেবেলায় মারা গেছেন ।আত্রেয়ী এখন রিসার্চ করছে....বছর পঁচিশেকের আত্রেয়ী ভীষণ কনফিডেন্ট,স্মার্ট, শার্প.....সায়নের সাথে বন্ধুত্ব বছর দুয়েকের.... তারপর প্রেম!! সায়ন এখন অস্ট্রেলিয়ায়....স্কলার ছেলে ....নম্র,ভদ্র ,খোলামনের ,পুরোপুরি একজন বাঙালী । সায়নের সাথে চান্দ্রেয়ীর কথা না হলেও আত্রেয়ীর কাছে শুনে শুনে খুব চিনে ফেলেছে ও ।আর এই সায়ন সেনগুপ্ত দুদিন পরই আসছে কলকাতায়....তাই সন্ধেবেলায় চান্দ্রেয়ীরা যাবে কেনাকাটা করতে ।
৩.

দুপুর আর বিকেলের এই সময়টায় চান্দ্রেয়ীর একটু ঘুম ঘুম পায়.....গরমের সময় একটা আলসেমী চেপে ধরে সবাইকে । কিন্তু আজ তার চোখে ঘুম নেই....কদিন ধরেই ডিংগো কম্পিউটারটা দখল করেছে তাই কিছুতেই আর তার নেট খোলা হচ্ছে না....আজ বেলায় একটু খুলেছিল কিন্তু সারবার বিজি থাকায় কানেক্ট করতে পারা যায় নি । ডিংগো এখন ঘুমচ্ছে ।চান্দ্রেয়ী ল্যাপটপ নিয়ে বসল ।প্রায় তিন চার দিন হবে....কথা হয়নি সাঁঝের সাথে । ফেসবুক লগ্ ইন করে চান্দ্রেয়ী.....সাইট খুলে যায়...আঃ পাওয়া গেছে....চান্দ্রেয়ীর যেন ধৈর্য ধরতে পারছিল না.....ইনবক্সে সাঁঝের অনেক মেসেজ্ জমা হয়ে আছে ।কোনো উত্তর করা হয়নি....বেশ খানিকটা রাগ ,অভিমান ,দুঃখ, অভিযোগ ....... তার সাথে কথা বলতে না পারার জন্যে একটা মনখারাপ.....চান্দ্রেয়ী সব লেখাগুলো নিমেষের মধ্যে পড়ে ফেলে....সাঁঝকে অনলাইন দেখতে না পেয়ে, চান্দ্রেয়ী টাইপ শুরু করে ।

'হাই সাঁঝ....
আছিস......নাকি?
রাগ করেছিস.......
সরি....
প্লিজ.....
আমার সাথে কথা বলবি না তো ? যাঃ আমি নেট অফ করে দিচ্ছি ......

.........এবার চ্যাট বক্সের নীচে টাইপিং লেখাটা দেখতে পাওয়া যায়...স্ক্রীনে রিপ্লাই ভেসে ওঠে...

সাঁঝ : তোর ব্যাপারটা কি দয়িতা ?
আমার কথা একটুও ভাবিস কি !!আমি যে একটু ফাঁকা সময় পেলে তোর সাথে কথা বলার জন্যে ছটফট করি....তার কি আদৌ কোনও মূল্য আছে?

দয়িতা(চান্দ্রেয়ী): আরে নারে...আমার বোনের উড বি কলকাতায় আসছে....আমার ছেলে পাঁচদিন হল গরমের ছুটিতে বাড়িতে এসেছে ....আমি সময় করেই উঠতে পারছি না.....প্লিজ একটু বোঝ....আচ্ছা তোর এমনি ছবি তো দিস না ...একটা রাগী মুখেরই ছবি দে....

সাঁঝ: না আর ছবি দেখতে হবে না,থাক......তোর বাড়ি যাব যখন পোস্তর বড়া আর বিউলির ডাল খাওয়াস.....আর তুই ই তো বলেছিস সারপ্রাইজ....আমরা পেন ফ্রেন্ডের মত শুধুই শব্দে থাকব....যতদিন না কলকাতায় যাচ্ছি .....

দয়িতা : হ্যাঁ তাইতো ....যাহোক বল তোর জি .এফ কেমন আছে ?কি নাম যেন....ওহো জিনা.....আচ্ছা এটাও কি আসল নাম নয় ,তোর সাঁঝ নামটার মত?

সাঁঝ: শোন একটা মানুষকে অন্য একজনের থেকে আলাদা করতেই নাম দরকার...সারাজীবন তো ওই মা বাবাকে ওগো-হ্যাঁগো করতেই শুনলাম!! আর তুই তো তোর অনেক নামের মধ্যে একটা নাম বলেছিস.....তাতে তোকে চিনতে কি আমার অসুবিধে হয়েছে??

দয়িতা: জানিস, আমি মাঝে মাঝে ভাবি আমি তোকে কতটুকুই বা জানি তবুও কথা বলার নেশাটা কাটাতে পারছি না কেন কে জানে? তুই কলকাতা কবে নাগাদ আসবি....?

সাঁঝ : বলব না....সারপ্রাইজ দেব কলকাতায় পৌঁছে....আচ্ছা এখন আর নয়....পরে আবার....বাই ।

মনটা কেমন যেন একটু বিষণ্ণ হয়ে গেল চান্দ্রেয়ীর....ঘড়িতে প্রায় পাঁচটা বাজে....ফেসবুক লগ অফ করে শরীর টা বিছানায় এলিয়ে দিল চান্দ্রেয়ী....চোখটা বুজে একটা ভালোলাগা অনুভব করে ....তার নিত্যদিনের পাঁচালী...কেমন যেন একটা নেশা.....মোহ!!!!!



(চলবে)

বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

কবিতা - ঊষসী ভট্টাচার্য

বনফুল
ঊষসী ভট্টাচার্য



সারা রাত জাগা বুকের নোঙরে
ভেসে ওঠা মুখ,
পরিত্যক্ত বিছানায়
হারিয়ে ফেলা বসত বাড়ি,
পোড়া কিছু চিঠি
তারই মাঝে রিনরিনে বাজে..
`তোকে নিয়ে মহুল বনের সারেং হবো`


বনপলাশির বন্য চিবুক ছুঁয়ে যায়
রাত পোড়া ক্যাডবেরি দাগ
সাদাটে ধোঁয়ায় ছাই হয়
মাদলের আওয়াজে দুলতে থাকা শরীর -
অবিন্যস্ত নাবিকের সাঁওতালী ফুল
শহুরে পাশবালিসে তুলো ভরে,
মহুয়ার বিষে পোষ না মানা কেউটে
খেলে কানামাছি ...
ক্যানভাসে ভাসে চেনা স্বর
`তোকে নিয়ে মহুল বনের সারেং হবো'


সীমান্তে প্রহরী দাড়ায় বন্ধনী হাতে,
রাত বিছানা ডাকে
`আয় আয় '
তবুও ফিরে আসে চেনা স্বর
'তোকে নিয়ে মহুল বনের সারেং হবো '! 


কবিতা - মামনি দত্ত

একক সঙ্গী
মামনি দত্ত



সমুদ্রপাখি
অতল ভুলে বৈকালিক স্বরে চাঁদ প্লাবন খুঁজে মরে,
সাধ ওগো সাধের কাছাকাছি ডানা মেলা গান ! .....
গান আর গানের কিছু ঘুম ........
অনেক স্বপ্ন –
সারি বেঁধে কম্পাঙ্ক শুষে নেয়।

হলুদ আখরগুলো
পাক খায় জলের সিঁড়ি বেয়ে,
তারই দোতারা তে বিবাদ ঘুচে পরিতৃপ্ত যাপন
.....শরীর ঘামে উষ্ণতা অনিঃশেষ নরম,
কাতর স্পর্শ লেগে থাকে
বাঁধ ভাঙা নিখাদ যামিনীর হাতে
যার বালিরাশি তে নীল সেতু ... ...
তার উপর একাকী শঙ্খ,
শঙ্খের বুকে এক অতল সমুদ্রপাখি।




কবিতা - অনিমেষ সিংহ

সংশয়
অনিমেষ সিংহ


মুহূর্তরা বদলায়
ছোবলে হ্যামলক গেঁথে,
প্রতি পলকে
ছলকে ওঠে নদী।

কখন নম্বর আসে
মায়াময় কূহেলীকায়,
কালো ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে
আমার সর্বস্ব নিয়ে
সিরোট্রেটাসের ওপর উঠে যায় রথ ,
সূর্যের চেয়েও আতপ্ত উত্তাপে
ধরতে পারি না
প্রিয়তমা অবয়ব।

এখনো জঠরে যন্ত্রনা সাথী
নিদারুন তৃষ্ণায়,
অস্ত্রের আগে আগে আমাদের ইতিহাস
নদী মাতৃক
শুকনো কূলে ভেসে যায়
ঘোড়া গুলো।

তোমায় ধরতে পারি না।।


কবিতা - বেবী সাউ

হঠাৎ এক বৃষ্টিরাত
বেবী সাউ


(১)
এই মাত্র নিজামত শেষ হলো
চোখে চোখে খেলে গেল পরোয়ানার গোপন ইস্তাহার
ইয়ারবক্সীদের পদলেহন
আগুন ঢাললো রূপোর গেলাসে ।

অধোবদন হয়ে হাঁটু গেড়ে আছে ষোড়শী রাত
দৃষ্টিহীন পথে উল্কা ছাই হয়ে গ্যাছে কবে !

আসমান আর জমিন বোঝাতে
তখনি খুরের শব্দ
মহল্লায় ঢুকে পড়ছে নবজাতকের কান্না ।

কবিতা - ভাস্কর ভট্টাচার্য

সাফো এসো
ভাস্কর ভট্টাচার্য


সাফো এসো শত শতাব্দী পার থেকে
বয়ে নিয়ে তোমার চুম্বন
তোমার অনন্ত শব্দ দাসেরা
কানে কানে বলে যাক
‘ভালবাসি’।
সাফো,
এসো কলুষিত কর আমাকে,
ভেঙ্গে দাও আমার আয়ুর অহঙ্কার,
আমার যৌবনের পুতুল ঘর,
হাহাকারে ভরে যাক আমার ফোপরা বুকের খাঁচা,
উইয়ের ঢিবির মতো ভঙ্গুর অনু পরমাণু,
ঝুর ঝুর করে খসে গেলে -
দেখতে পাব, আমার দেওয়া সব প্রতিশ্রুতি,
মিথ্যে হয়ে গেছে।
আমার জন্মেরও আগে......
সাফো এসো,
এসো!


কবিতা - বিদিশা সরকার

বিল্লুরানি
বিদিশা সরকার


এক পক্ষকাল অপেক্ষার পর বিল্লুরানি
ভাঁজ করে রাখলো রাতের শরীর।
যদিও সারা দেওয়াল জুড়ে
একটাই শব্দ বেজে উঠেছিল "তওবা " "তওবা " ।
তবু সে জানতো, নার্গিস চোখের সুর্মা মুছে দিলে
নিষিদ্ধ রাতের রূপচাঁদ বড়াল স্ট্রীটের মতোই সব পথ সুনসান,
ফরাসে পড়ে থাকে সারেঙ্গী ।
সারেঙ্গী যখন চলে গিয়েছিল
বিল্লুর সুর্মাও শেষ ।
খদ্দেরের জন্য পেতে রাখা বিছানায় অভিষিক্ত মুগ্ধতারা
একবারও জানতে চাইলনা বিল্লু কেন সে ভাবে বাজেনা ,
কেন বিল্লু আলিঙ্গন প্রত্যাখ্যান করে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে যায়
খোলা জানলায়,
আর ঠাহর করার চেষ্টা করে দূরের সে শব্দ
অন্য কার ঘরে বেজেই চলেছে ।।

কবিতা - চৈতালী বসু

তোমারই জন্য
চৈতালী বসু



পৃথিবীর সব মাঠের শেষে একান্তে বিকেল নামে
কপালের রোদ্দুর মুছে,
বিষণ্ণতা, ক্ষণিক তোমায় পাওয়ার ৷

অরণ্যের ঘ্রাণ নিয়ে জেগে থাকা রাঙা পাখির
ডাকাডাকি অবিরত, তোমায় শুধু…

আদিগন্ত ব্যপ্ত অঘ্রাণের ধানে স্বপ্নের দোলা লাগে
শিহরণ, তোমার ছোঁয়ায়…

কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডবে ভেঙে চুরে সব তছনছ ।
উন্মত্ত, তুমি না এলে…

ধূসর কালো মেঘে শ্রাবণের অঝোর ধারা
আকাশও কাঁদে, তোমারই জন্য…

এসব কথা সারা পৃথিবী জানে,
তুমি জানো না?

কবিতা - চৈতালী গোস্বামী

প্রেম
চৈতালী গোস্বামী


মেঘের পাহাড়ে ঘুমিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ।
জেগে উঠলাম, আর উপন্যাস শুরু হল ,
গীর্জার সামনে এসে দাঁড়ালাম ,
ঘাসের মুখ ভিজিয়েছে শিশির
পাইনের পথ আরও শিথিল …

আমায় বর্ষাকালের মত ভালবেসেছ তুমি।
তাই ঝাউয়ের ভিড়ে ঘর বেঁধেছি একসুরে
দীঘির মত উপচে এসেছ বলেই
সরোবরে সরোবর মিলে গেল।

বর্ষা হোক
ঘাস হোক
আরো গভীর হোক অরণ্যের বুক

একটা কামড়-আদরের সকাল দিয়েছ তুমি।
একটা গীর্জা
একটা সরোবর
আমার শরীরে তীব্র বুনো-গন্ধ দিয়েছ
তুমি।

কবিতা - এমদাদুল আনোয়ার

শিকারী
এমদাদুল আনোয়ার


পাখি দিয়ে পাখি ধরো কেন?
খাঁচার পাখি দিয়ে বনের পাখিটিকে
করছ যে বার বার নিঠুর শিকার
সে কি ক্ষোভে, নাকি কোনো বেদনায়?

তুমিও কি হয়েছিলে
মানুষের রূপ ধারী
কোনো এক পাখির শিকার
পাখি দিয়ে পাখি ধরো সেই অভিমানে?
চুপ কেন শিকারী, পায়ে পড়ি বলো!

কবিতা - ইমেল নাঈম

আর্জি
ইমেল নাঈম



সরল অংক গরল হচ্ছে বারবার,
আশার ফানুস মিথ্যেয় উড়ছে হাওয়ায়।
অন্নপ্রাশনকে খাঁটি ভেবে পাড়ি দিই দু'মাইল পথ
অতঃপর মোহ ভাঙ্গতেই তমস্যার সৌধসিত।

ইদানিং মধ্য-পূর্ব পৃথিবীতে মাছিদের আগ্রাসন প্রকট ,
ছয়টি মাছি মুখ হা করে আছে শকটে ।
নিবৃত কর কেউ ওদের ।
কেউ বোঝাও -
নোংরা ময়লা খেয়ে আর যাই হোক
পৃথিবীর বুকে শান্তি নামে না ,
দর্শন হয় না স্ট্যাচু অফ লিবার্টি'র ।

মাছিদের বল চলে যেতে
তাদের আগমন রক্তের স্বাদ দেবে পৃথিবীকে ...

কবিতা - মনিরা বাকী

ফেলে আসা ভুলে
মনিরা বাকী



গুহার আঁধার ছেড়ে আলোতে এসে দেখো
ক্ষোভে ফেটে পড়া জ্বালামুখীতে কে কাকে ছুঁড়ে ফেলে ?
জোনাকি না হয়ে কার আর সাধ জাগে আগুনমুখী পতঙ্গ হবার ?
যদি ইচ্ছে করো দৃশ্যটা দেখার; জানি পারবে ।
জেগে যে ঘুমাতে পারে, তাকে কি জাগানো যায় ?
তাই যাই না আর ওদিকে ।
ঘুমের শহর অচেনা হল; রোদের আঁচড়ে দগদগে হল দিনের ক্ষত !
তোমার অবিনাশী চোখ জুড়ে ভালবেসে আজও এই দু’চোখ অবনত !
ফোটে কত ফুল;গায় কত পাখি;কত পতঙ্গ মেলছে ডানা,
গন্তব্য তবু ঠিক হয়নি, মনও রয়ে গেল অজানা ।
গাংচিল মন ওড়ে; ওড়ে সাদা বক ভাবনারা রাশি রাশি
আজও মনে পড়ে সেদিনই তো ছিলাম দু’জনেই পাশাপাশি ।।