সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ভ্রমণকাহিনী - অরিন্দম চক্রবর্তী

তিনদিন তিনকন্যের সঙ্গে
অরিন্দম চক্রবর্তী

পর্ব - ১
জুতোর স্ট্র্যাপে তামাম পিছুটান


- অরিন্দম, ঘুরতে যাবি?

- না, হবেনা, বস্‌।

- কেন, সমস্যা কী?

- একটা দুটো হলে বলা যায়, ১কোটি ৩৩ লক্ষ এক... বিয়ে'ত করিসনি, করলে বুঝতিস।

- বৈবাহিক সমস্যা হলে এককথা; কিন্তু পারিবারিক সমস্যা হলে'ত বলাই যায়, বিয়েনা করলেও তো পরিবার আছে সকলের...

- আরে একটা কোন মাস নেই বছরে, যে মাসে নিয়মমাফিক ন্যূনতম খরচা ছাড়া কিছু হয়না...

- কী রকম?

- আরে যেমাসে এল.আই.সির প্রিমিয়াম নেই, ছেলের

স্কুলের মাইনে নেই....ঘরে সেরকম কেউ অসুস্থ হয়নি (মানে বদ্যির পিছনে টাকা ঢালতে হল'না) একটু স্বস্তি, সেইমাসে কোত্থেকে কী হয়ে কম্প্যুটারটা বসে গেল...ব্যস ঢুকে গেল... ছাড়্‌ ওসব হবেনা... পুরী দীঘা হলে চ’ আছি। অন্য কোথাও নয়।

- মনোহরপুর যাবি? কোয়েলেরকাছে । সেখান থেকে কিরিবুরু, মেঘাতাবুরুর পাশে...

শোনা মাত্র মনকেমনের শুরু। মুখে না বললেও মন কিন্তু না শুনছে না...

ভারতের আফ্রিকা! শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্য।বুদ্ধদেব গুহ থেকে ডাঃ বৈদ্যনাথ গাঙ্গুলি তখন দরজায় কড়া নাড়ছেন...

আদিম গন্ধ নাকে লাগছে।মন চাইছে দেখতে সেই জায়গাটা – যেখানে সকাল হয়না, সকাল আসে।কীভাবে আসে সে...?

আবার হিসেব নিকেশ শুরু হয়।অঙ্ক গরীবের খুব চেনা বন্ধু, সে পাশে এসে দাঁড়ায় পিঠে হাত রেখে বারণ করে আর প্রেম (বা প্যাশন) মানুষের চির শত্রু- সে বারণ না শুনতে বলে...

লড়াই চলে শুম্ভ-নিশুম্ভের।

মন তো কার্ণিক খেয়েই ছিল হ্যাঁ-র দিকে ,মুখও এইবার আস্তে আস্তে । তাই কয়েকদিনের মধ্যে সবচেয়ে খতরনাক কাজটা করে ফেললাম...রাত্তিরবেলা খাওয়ার টেবিলে কথাটা পেড়ে ফেললাম-

-ভাবছি এইবার একটু মনোহরপুর যাব...

-সেটা আবার কোথায়?

-ঐ তো কাছেই জামশেদপুরের (ইচ্ছে করেই ঝাড়খন্ড বলিনি, কেন বলিনি সে পরের কথোপকথন থেকেই বুঝবেন)

-এই'ত কয়েকদিন আগে ঘুরে এলি ওখান থেকে, আবার কেন?

আরে বাবা বড় জায়গানা, একবারে কী সব দেখা যায়! ভেঙে ভেঙে দেখতে হয়, তাই।

ঘরে শত্রুর অভাব নেই, হট্‌ করে সত্যবতী সেজে একজন বলে বসল- এই যে কাল বললে ওটা ঝাড়খন্ডে... সেখান থেকে সারান্ডা রেঞ্জ কাছে....

কথাটা পড়ল খাওয়ার টেবিলে, স্বপ্নভঙ্গের ধ্বনি-চিত্র একেবারে সামনে...

-না! ওখানে যাওয়া হবেনা । মাওবাদী এলাকা। ডেন একটা। রোজ খুন...গুলির লড়াই, অপহরণ, রেললাইন ওড়ানো, ল্যান্ডমাইন... না, হবে না। আমরা বেঁচে থাকতে হবে না । মরে গেলে যা খুশি করো।

আমি জানি, এই সব সময়ে বলে লাভ নেই।মানবে না।দশ-বিশটা ref. এনে হাজির করবে...সেই কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী কবে কোথায় কী হয়েছিল সঅঅব...।সমুদ্রস্নানের অভিজ্ঞতা বলে ঢেউ যখন প্রবল বেগে পারের দিকে আসছে তখন হয় 'ডুব দে মন কালী বলে' নইলে শরীরটা ভাসিয়ে দে...মুখোমুখি দাঁড়াতে গেলে বিপদ।

২৪ ঘন্টা মনমরা , জীবনে আর বনে কোন তফাৎ নেই মার্কা দৃষ্টি , 'ATM ব্যতীত আর'ত কিছু নয়' গন্ধ মাখা দীর্ঘশ্বাস ছড়াতে লাগলাম।দীর্ঘশ্বাস বড় সংক্রামক ।কাজ দিল।শেষ পর্যন্ত বলল,

'ভেবেছিস যখন যাবি যা। আমাদের কপালে যা লেখা আছে তা তো হবেই...'

প্রস্তুতি শুরু হ'ল। ট্রেনের টিকিট, থাকার ব্যব্স্থা ইত্যাদি ইত্যাদি... প্রাক্‌ভ্রমণ কথোপকথন, চিরাচরিত চেনা সংলাপের আনাগোনা - 'চারদিনের জন্য নিজের চারটে কবিতার বই যাবে, অথচ আমার দুটো শাড়ি বেশি নিলে ওজন বেড়ে যাবে!!'

ওই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় শাড়ি দেখবে কে? এই প্রশ্ন মনে এলেও মুখে আনিনি, কারণ বাঙালি মহিলারা শাড়ি প্রদর্শনের জন্য সুমেরুর ঠান্ডাকেও অগ্রাহ্য করতে পারে...

দেখতে দেখতে যাওয়ার দিন এসে গেল...বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ মন্ত্র কানের সামনে আওড়ে গেল দু'জনে--

- রাত্রে রিসর্ট ছেড়ে বাইরে যাবেনা ।একা একা ঘুরবেনা, উল্টোপাল্টা খাবেনা ,'দাদুর' দিকে নজর রাখবে ।নিজেরা আনন্দ করতে গিয়ে সব ভুলে যাও...ইত্যাদি ইত্যাদি।

এইসব টপকে সুবোধ বালকের মতন ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম।বাঁক নিতেই চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল দু'জন।মন খারাপের একটা পাতলা আলোয়ান উড়ে এসে পড়ল গায়ে...

এটা হয়, যখন-ই কোন প্রিয় মানুষ কে বিদায় জানাতে যাই বা নিজে দূরে যাই প্রিয় মানুষদের ছেড়ে তখন-ই মনে হয় এই বুঝি শেষ দেখা হ'ল, আর যদি দেখা না হয়...

তার মধ্যে ঝাড়খন্ড যাওয়ার ভয় তো আছেই, তাই উটকো দু'একটা মন খারাপের দৃশ্য ভিস্যুয়ালাইজ করতে থাকি...করতে করতে-ই পৌঁছে যাই আজকাল পরশুর চিরন্তন মিটিং স্পটে- হাওড়ার বড় ঘড়ির নীচে।

তখনও আমাদের দলের অন্যরা আসেনি। ব্যস্ত হাওড়া স্টেশান, ঘোষকের ঘোষণা, চলমান ডিসপ্লেতে ট্রেনের সময় সারণী, চেকারদের ব্যস্ততা, মানুষের ছোটাছুটি, এরই মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চিন্তে মাটিতে বিছানা পেতে ঘুমোচ্ছে...

এত আওয়াজে ঘুম আসে!! সত্যি যে পারে সে আপনি পারে....

একটা পুরোনো মজার খেলা খেলি নিজের মনে...

সামনে কোন ভদ্রলোককে দেখে মনে হয় এ নিশ্চয়ই উইকএন্ড-এ বাড়ি যাচ্ছে, অন্য কোন জাঁদরেল চেহারার মহিলাকে দেখে মনে হয় এ যদি আমাদের কামরায় ওঠে তা'হলে হয়ে গেল এমন নাক ডাকবে...ট্রেনেই হাতির ডাক শুনতে পাব, বা বড় ঘড়ির নীচে দাঁড়ানো একটা ছোট্ট কিটস্‌ ব্যাগ হাতে মেয়েটা কে দেখি...বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে নাকি- উফফ্‌ ভাবতে কী ভাল্লাগে ... এক থরথর উত্তেজনার প্রণয় কাহিনী কল্পনা করি...। এর-ই মধ্যে আমাদের দলের অন্য সদস্যরা এসে পড়ে...কল্পনায় ছেদ পড়ে । হইহই , হল্লাগুল্লা , সংরক্ষিত তালিকা মেলানো শুরু হয়...

নির্দ্দিষ্ট কামরায় উঠে বসি...সময় মতন নড়ে ওঠে কোরাপুট এক্সপ্রেস...

- মা ট্রেন ছেড়েছে...

- ভালো করে ঘুরে আয়, সাবধানে থাকিস...

দরজা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ঝাপটা মারে মুখে...কুয়াশা নামে... দূরের আলো গুলো ঝাপসা হয়....ট্রেনের গতি বাড়তে থাকে।


পর্ব - ২
উড়িয়ে দিয়ে নিরুদ্দেশী মন......



ট্রেন ছোটে ।মাঝে মাঝে ছোট বড় ব্রীজ। আওয়াজ, ঘুম হয় না।শুয়ে শুয়ে জোৎস্না দেখি।দেখে কী মন ভরে! গায়ে মাখতে হয়।ঠাণ্ডা বাড়ে (মনে মনে বলি - ভাগ্যে 'লিক্যুইড কম্বল' সঙ্গে ছিল! / নইলে কী দুর্দশাই হত তা না হলে।')

একে একে পেরিয়ে যাচ্ছি খড়গপুর, ইস্পাতনগরী (টাটানগর), চক্রধরপুর।নেমেছি সেখানে, যেখানে ট্রেন থেমেছে। চা খেয়েছি অথবা শুধু নামার জন্য নেমে এদিক ওদিক করেছি । মনোহরপুর পৌঁছোন-র সময় রাত সাড়ে তিনটে ।ঠাণ্ডা বাড়ছে মনে মনে চাইছি ট্রেণটা একটু যেন লেট করে...চাইলে হয়না...প্রকৃত ভক্তের কথাই একমাত্র ভগবান শোনেন।

ঠিক নির্দ্দিষ্ট সময়ের পাঁচ মিনিট আগে ট্রেন আমাদের নামিয়ে দিল মনোহরপুর স্টেশনে... তারপর হুইসেল দিতে দিতে মিলিয়ে গেল।

দাঁড়িয়ে আছি, সঙ্গে ঠান্ডা। ওপরে ঠান্ডা, নীচে ঠান্ডা। ডাইনে বাঁয়ে ঠান্ডা। কোত্থাও কেউ নেই...চা-ওয়ালা নেই, স্টেশন-মাস্টারের ঘর খোলা ছিল, ট্রেন চলে যেতেই সে চম্পট দিল এমন কি আর কেউ না থাকুক দু-একটা লোম-ঝরা ঘিয়ে-ভাজা চামড়ার কুকুর অন্তত দেখতে পাওয়া যায় সর্বত্র, তারা –ও নেই । শুধু আমরা পাঁচজন আর পাঁচ বছরের স্পন্দন ,সঙ্গে আকাশ ভরা অসংখ্য তারা ও রাতচরা কিছু পাখি।

খবরটা ঠিক পেয়েছেন তো গাঙ্গুলি সাহেব ? মনে দ্বিধা...এমন সময় দেখি তিনটে ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে...

নির্জন মনোহরপুর স্টেশান গমগম করে উঠল...

- 'আরে ভাইয়া চিন্তা করবেন না এসে গেছি...আমি অভিজিৎ গাঙ্গুলি আর এরা দুজন আমার ছায়া সঙ্গী... চলুন বাইরে গাড়ি আছে...মালপত্তর তুলে নেবে ওরা...'। 'আ যা বেটা ', বলে স্পন্দনকে কোলে তুলে নিলেন অভিজিৎবাবু...।

এক ছুটে গিয়ে গাড়ির সামনে। জানি ডিজেল ইঞ্জিন চললে গরম হবে, কিছুটা রেহাই...ধুরধুর কোথায় রেহাই! শালা! বিহারের ঠাণ্ডা...(মাথা মুন্ডু নেই কোনও)

এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা।গাড়ি লাফিয়ে উঠছে কখনও, আবার কখনও গড়িয়ে পড়ছে গর্তে।হেডলাইট জ্বলছে, মাঝেমাঝে সেই আলো গিয়ে পড়ছে দুধারের গাছপালার ওপর।আশেপাশে কোন বাড়ি নেই, আকাশ চুপচাপ, শুধু গাছগুলো মাথা নাড়ছে এমনভাবে, মনে হবে যেন এখনই কোথাও বেজে উঠবে হারমোনিয়াম।ঝরাপাতা উড়ে যাচ্ছে চাকার হাওয়ায়...মাত্র চার কিমি পথ কিন্তু রাস্তা অসম্ভব খারাপ তাই সময় লাগল মিনিট পনেরো...

গোটা পথটায় মাও-আতঙ্ক গ্রাস করেনি যতটা আচ্ছন্ন করেছিল ঠান্ডাতঙ্ক!

চকিতে সম্বিৎ ফিরে এল অভিজিৎবাবুর গলা শুনে, 'এসে গেছি নেমে পড়ুন।'

নামতেই মনটা ভাল হয়ে গেল...একেবারে 'অন্যভূবন'। ঠাণ্ডা আপনি হতেই সরে গেল...শব্দে আমার বিস্ময় ও সন্তুর রিসর্টের সৌন্দর্য্য বাখ্যা করা অ-সম্ভব । তবু বলি সন্তুর রিসর্ট কোন রিসর্ট নয়... বাগান আর খাওয়া দাওয়ার জায়গা দেখলে মনে হবে হর্টিকালচারে এসে পড়েছেন আর অভিজিৎবাবুর বাড়িটি যেন একটা মিউজিয়াম। সর্বসাকুল্যে সন্তুর রিসর্টে চারটি ঘর আছে...চারটি ঘরের নাম- কারো, কোয়েনা, কোয়েল এবং সুবর্ণরেখা। বুকিং পেয়েছিলাম পাঁচ বিছানার কারোতে কিন্তু অভিজিৎবাবু বল্লেন- 'ঘরটা বড় , দুটো বাথরুম-ও আছে তবু পাঁচজনে থাকবেন, তার'চে বরং বাচ্চাটাকে নিয়ে আপনারা আমার একতলার বেডরুমে থাকুন।'

রিসর্টের অন্যলোকেরা এসে মালপত্তর নিয়ে চলে গেল আমরা বসে আছি অভিজিৎবাবুর বাড়ির সামনে খড়ের ছাউনি দেওয়া বিশ্রামশালায়।

অভিজিৎবাবু বললেন, 'চা আসছে একটু বসুন খেয়ে নিয়ে রেস্ট নেবেন...'।

সকলের সামনে কিন্তু সকলের অগোচরে এমন কি নিজের অজান্তেও আমি দুশ্চিন্তা থেকে দূরে সরে গেলাম, বিরক্তি আর আমার নাগাল পেলনা... ফুল সমুদ্রের পার দিয়ে হাঁটছি আর অভিজিৎবাবুর জানলায় রাখা বিভিন্ন মূর্তি দেখছি...ছোট বড় হরেক রকম মূর্তি।কোনটা হাতি, কোনটাকে দেখে মনে হচ্ছে বাঘ হরিণ শিকার করছে, আবার কোনটা কে দেখে মনে হচ্ছে একদল ছেলে ছুটছে... যেখানে বসে আছিলাম আমরা সেই জায়গায় মাঝখানে একটা কাঠের গোল টেবিল আর তাতে ঐরকম একটা মূর্তি অবিকল রবীন্দ্রনাথের আঁকা মা-ছেলের মতন...

বিস্ময়ের ঘোর না কাটিয়ে বলে ফেললাম – এত রকম মূর্তি আপনি সংগ্রহ করেছেন...কোথা থেকে কিনেছেন?

বিস্ময়ের আর-ও কিছু বাকি ছিল...

হা হা করে হেসে উঠে অভিজিৎবাবু বললেন- আমি সংগ্রহ করেছি ঠিকই; তবে এ হল প্রকৃতি-শিল্পীর দান। কোয়েনার তীর থেকে সংগ্রহ করা নুড়ি পাথর।এর একটিতে-ও কোন হাত দিতে হয়নি। চোখ দিয়ে দেখে তুলে নিয়ে এসেছি...

আমাদের চোখ কপালে!

চা এসে গেল সঙ্গে বিস্কুট আর কেক, স্পন্দনের জন্য দুধ (না আমরা কেউ মনে করাইনি)। চা খেতে খেতে টুকটাক গল্প...কাল সকালে কোথায় যাব এইসব কথা...স্পন্দন আর শাশ্বতী ঘরে চলে গেল ঘুমোতে।

নিষিদ্ধ রোদের প্রিয় ডাকে আমরা চারজন -আমি, বিদ্যুৎদা ,মঞ্জুদি (বিদ্যুৎদার বোন) আরবুড়ো এগিয়ে চল্লাম একটা টিলার দিকে যেখান থেকে ঘাসের কাঁথায় ঘুমোতে আসা শিশিরে মোড়া মনোহরপুর কে জাগতে দেখা যাবে।

এগিয়ে চলেছি। টিলায় পৌঁছোনর ফাঁকে একটু মনোহরপুরের কথা বলেনি।

মনোহরপুর একটা ছোট্ট জায়গা।চাকচিক্য নেই।গুটি কয়েক পয়সাওয়ালা জঙ্গল-ঠিকাদার পরিবার। অফুরন্ত বনজ সম্পদ। আর সেই সম্পদ থেকে মুনাফা আদায় করার জন্য ব্যবহৃত পিছিয়ে পড়া জনসমষ্টি- ওরাঁও , হো , মুন্ডা , বারুই ,ঝোরো প্রভৃতি। অরণ্যের অধিকার যাদের থাকা উচিত ছিল তারাই সবচেয়ে বঞ্চিত। সরকারী অনুগ্রহে হাসপাতাল আছে, আছে প্রাইমারী স্কুল কিন্তু এমন-ই দশা সেখানে না যায় কোন রোগী, না জোটে কোন পড়ুয়া।বরং মিশনারীদের সাহায্যে এখানে স্কুল হাসপাতাল খুব ভাল চলে...

হাঁটছি চোখে পড়ে একটি গির্জা ।উল্টোদিকে খেলার ফুটবল মাঠ।তার পাশে একটি মিশনারি স্কুল।বাঁ পাশে টালির বাড়ি, ঝাঁ তকতকে উঠোন। খড়ের গাদা... হাঁস মুরগী চড়ে বেড়াচ্ছে। সরু পাকদন্ডী পথ বেয়ে উঠে চললাম... বাতাসে বুনো ফুলের গন্ধ। টিলার মাথায় উঠে মনোহরপুরকে দেখা যায়... পূব থেকে পশ্চিমে বয়ে চলেছে কোয়েল।শীত কালে কোয়েল শুকনো...চিকচিক করে বালি।কোথাও কাদা নেই, জল-ও নেই। টিলার ঠিক নীচ দিয়ে একটা ট্রেন লাইন চলে গেছে । সে আসছে। কুয়াশার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে...মেঘমশারির ফাঁক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসছে 'সে'।কত রকম লাল... গাঢ়, হাল্কা, গোলাপী, ধূসর।

দূর থেকে ট্রেনের হুইসিল ।সকাল কে ওয়েলকাম করার জন্য বিউগেল বাজালো যেন।কুয়াশা ভেঙে ট্রেনের হাল্কা হলুদ আলো ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হল।কু-ঝিকঝিক সঙ্গে পাখির ডাক আর ওরকম নরম রোদ্দুর সব মিলিয়ে গুলজারের 'ইজাজত্‌'। মনে পড়ল সেই দৃশ্য যেখানে নাসিরুদ্দিন আর রেখা এক সোয়েটারে ঢুকে প্রকৃতির কোলে একটু উষ্ণ হয়েছিল পরস্পরের জন্য।

যা পাইনি তার বিহনে আর কি কাঁদি, তার চে’ বরং এমন সকাল গায়ে মাখি।

আমরা আবার ফিরে এলাম সন্তুরে । ততক্ষণে আমাদের দলের অন্য দুই সদস্য উঠে পড়েছে। আর একদফা চা খাওয়া হ'ল তারপর গরম গরম পুরী, আলুর তরকারি আর মিষ্টি।সন্তুরে ঘরে ঘরে গিজার নেই কিন্তু ভোরবেলা থেকেই বাগানে বিরাট হাঁড়িতে জল গরম হচ্ছে। আর বলা মাত্র লখা ও তার বউ(বউ নামেই তাকে সকলে ডাকত) বালতিতে গরম জল নিয়ে হাজির। ১০ টা নাগাদ গাড়ি রেডি।সঙ্গে অভিজিৎবাবুর দুই সঙ্গী আর আমরা। হটপটে দুপুরের খাবার তুলে নেওয়া হল।

এর মধ্যে আমি লখার সঙ্গে জল-চুক্তি সম্পন্ন করে ফেলেছি। রাম দিয়েছিলাম তাকে তার বদলে চেয়েছি মহুয়া রাতেরজন্য।

গাড়ি নড়ে উঠল...

বিদ্যুতদা স্লোগান তুলল- ‘দুলেদুলে দুলদুলি...’!



পর্ব - ৩
আলগা নেশা চাহিদা মিস্টিক...



কিছুটা রাস্তা ভাল, অধিকাংশটাই খারাপ। অটোম্যাটিক ব্রেকড্যান্স।আমরা ডিস্কো ড্যান্সার।রোদ বাড়ছে ঠান্ডা কমছে, একে একে শরীরের ওজন কমাচ্ছি আমরা।মনোহরপুর-এর আর এক বৈশিষ্ট্য... সে ত্রিবেণী সঙ্গম। কারো এসে মিশেছে সমীজে কোয়েলের বুকে। কোয়েনাও পড়েছে দো-মোহনায়। তারই পাশে পাশাপাশি শ্মশানঘাট ও কবরখানা। ধর্ম জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারে না।যে টুকু দূরত্ব তৈরী হয়, তা'হয় ওই মাঝের জীবনটাতে যখন মানুষের জ্ঞানবুদ্ধির নাকি বিকাশ হয়!

বিকাশ চিরকালই আকাশে...

দোমোহনার শ্মশান ঘাট যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, তবে সে সন্ধেবেলা। লক্ষ্মণ আমাদের গাড়ির ড্রাইভার কে বলাতে সে বলল ফেরার পথে চেষ্টা করবে।এত কম কথা বলে লোকটা, যে কিছু বলতেই কেমন দ্বিধা হয়।গাড়ি এগোচ্ছে... কথা বাড়ছে। তখনও আমাদের কথার সিংহভাগ দখল করে রেখেছে বিহারের ঠান্ডা( অমরীশপুরী )। তবুও তারই মাঝে মাঝে দু পাশের রুক্ষ্ম নুড়ি পাথর, লালচে রাস্তা আর দূরান্তের বনভূমি আমাদের উদাস করে দিচ্ছে প্রতি পলে। পথে নামলে পেট রোগা বাঙালির চোখের খিদে বাড়ে। পথের ধারে একটা চায়ের দোকান দেখে গাড়ি থামলাম আমরা। একপ্রস্থ চা খাওয়া হল, নেতানো ফুলুড়ি মারলাম খানদুয়েক...এক ঢোক কাফ সিরাপ।ঠান্ডার ধাত আমার তাই কাফ সিরাপ সঙ্গে থাকে বারোমাস। ঐ দোকান থেকেই লম্বা বিড়ি কিনলাম তিন প্যাকেট। মেয়েরা নাক সিঁটকোল...ইস্‌, বিড়ি...(ধরাইনি ,তবু গন্ধ পেয়ে গেল!!!)

বুড়ো বলল, ‘ অরিন্দমদা সিগারেট আর বিড়ির মধ্যে কোন দর্শনগত পার্থক্যআছে?’

-‘ হ্যাঁ আছেই তো। সিগারেট হল পুরুষ, দগ্ধ হতে হতে স্তব্ধ হয়ে যাবে কিন্তু স্তব্ধ হওয়ার আগে নিভবেনা। সে জানে আমাকে পুড়তে হবে।পুড়তেই হবে।

আর বিড়ি হল- নারী। অভিমানিনী। না টানলে নিভে যাবে।সবসময় অ্যাটেনশান চায়। ASS-এ আক্রান্ত। অ্যাটেনশান সীকিং সিন্ড্রোম।

সবে সমুদ্রে তুফান উঠবে...মঞ্জুদি কিছু একটা বলবে বলবে করছে, এমন সময় বিদ্যুৎদা বলে উঠল-‘ চল চল, এখানে এইভাবে সময় নষ্ট করলে হবে না।তাড়াতাড়ি ওঠ্‌ গাড়িতে’।

গাড়ি ছুটছে। চাকার হাওয়ায় লাল ধূলো উড়ছে দু'পাশে। মাঝেমাঝে গরু ছাগল নিয়ে রাখালবালক যাচ্ছে।গাড়ি দেখে থামছে।চোখাচুখি হতেই হাসছে, হাত নাড়ছে।

ইউরোপ আমেরিকাতে অচেনা লোক দেখলেও এই রকম প্রীতি সম্ভাষণের রীতি চালু আছে, কিন্তু আমাদের মধ্যে'ত এইসবের বালাই নেই।চেনার মাপকাঠির ওপর সৌজন্যটুকুও নির্ভরকরে।

পরিবেশ পারে বদল আনতে। আনল।আমরাও হাত নাড়ি হাসি...

হট্‌ করে ঢালুতে নেমে গেল গাড়ি...আবার উঠল... তারপরেই একটা কালর্ভাট পেরিয়ে থেমে গেল। লক্ষ্মণ বলল এটাই দুলদুলি... ঘুরে আসুন কিন্তু চোখের নাগালের বাইরে যাবেন না।

লক্ষণ না হয়ে ওর নাম কমল মিত্র হলে ভাল হ'ত।

নেমে চারদিকে তাকাতেই মনে হল – অরণ্য জেলে বন্দী আমরা ক'জন। চারপাশে উঁচু পাহাড় আর গাঢ় সবুজ অরণ্য আর পায়ের পাশ দিয়ে কুলকুল ধ্বনি তোলা...কারো-কোয়েনার যুগ্ম কনসার্ট।স্রোতের মাথায় ফেনার মুকুট...অরণ্যের সবুজ, মাইনস্-এর লাল আর পাথরের ধূসর রঙ মিলেমিশে এক চলমান নক্‌শি কাঁথা।

প্রতিবারের মতন এইবার ও হ'ল। সেই লাইন মনে এল...

ওরা দিবসরজনী নাচে

তাহা শিখেছে কাহার কাছে।

আমার জীবনের এই এক ট্রাজেডি... প্রকৃতির কোলে গিয়ে পড়লে আমার কিছুতেই অন্যকারও কবিতা মনে পড়েনা। ঘুরে ফিরে সেই বুড়োর দুএকটা কবিতা।অবিশ্যি পড়েছিই বা ক'টা ?

কাঁধে দুটো ক্যামেরা, এত বিরক্তি লাগে এই সব সময়... 'এই , ছবিটা তোল', 'এই এইখানে আছি এইটা তোল', ' এই, বাবুর সঙ্গে আছি এইটা তোল' , ' ধুর! এমা! চোখ বন্ধ উঠেছে !আবার তোল।'

নিজের জীবনটা বিয়েবাড়ির ফটোগ্রাফারের মতন, ইচ্ছে মতো ঘোরার সুযোগ নেই...ইচ্ছে মতো ছবি তোলার সুযোগ নেই।

আমার মুক্তিদেবীর ফুর্তিতে।

ছবি তুলছি... তুলতে তুলতেই মাথার ওপর দিয়ে একঝাঁক টিয়া উড়ে গেল। স্বাধীনতা দিবসে যুদ্ধ বিমানগুলো যেমন সবুজ ধুঁয়া ছড়িয়ে চলে যায় সেইরকম।তোলা হল'না।

জীবনভর এরকম কত না-তোলা জমা হয়...

খেয়াল করিনি , বুড়ো স্পন্দনকে কোলে নিয়ে অনেকটা দূর চলে গেছে।সম্বিৎ ফিরল স্পন্দনের ডাকে- বাবা এই দেখ, আমি একা একা দাঁড়িয়ে আছি...

- দেখিস সাবধানে(সকলে শুনল)!

যা শুনলনা লোকে, যা ওকে আমি চিৎকার করে বলিনি, তা'হল- আমরা প্রত্যেকে একা...একা থাকার বীজমন্ত্রটা শিখেনে।

- চলুন এইবার।অনেক দূর যেতে হবে। লক্ষ্মণের গলা।

গাড়ি ছুটল... লালমাটি আর সবুজ প্রাচীরের মধ্য দিয়ে... এইবার যাব কোয়েনার উৎসস্থল দেখতে।অজিতা হিলস্‌।

রাস্তার কথা আলাদা করে বলবনা। দেহের রক্ত রস যদি দুধ হ'ত, তাহলে এতক্ষণে তার থেকে মাখন নির্গত হয়ে যেত। যত অল্পকথায় সারলাম..ঠিক ততটা অল্প সময় লাগেনি। অনেকটা পথ যেতে হয়...পথে বার কয়েক থামা।ফটোসেশান।গাছ থেকে নামা লতানো ডাল ধরে টারজান সাজা... সবই হয়েছে!

কোয়েনার উৎস স্থল দেখে অজিতা হিলসের আরও ওপরে উঠে চলা।

একটা জায়গায় গিয়ে জিপ দাঁড়াল।লক্ষ্মণ বলল, কী আছে দেখে আসুন নেমে গিয়ে।

সোজা তাকিয়ে দেখছি লালমাটির রাস্তা উঠে গেছে আর যেখানে শেষ সেখানে নীল আকাশ ছুঁয়ে আছে ওকে।

তাহলে কী এরপর অতল গিরিখাত!

পুরো বুরবক করে দিল। গিয়ে দেখি আবার ঢালু পথে রাস্তা নেমেছে।ওরা হাসছে। আমরাও হাসলাম। দু'বার।

গাড়ি গড়াল।আমরা গিয়ে বসলাম এমন জায়গায়, যেখান থেকে কয়লা নিষ্কাশন করে ট্রলির সাহায্যে নীচে নামে।ঘুরে ফিরে দেখলাম ট্রলি-ঘর।

খাওয়াদাওয়ার কথা এমনিতে বলতে বিরক্ত লাগে..তবু বলি ,কারণ একটাই, এমন খাতির (পড়ুন উষ্ণতা) শ্বশুরবাড়িতেও পাইনি।লক্ষ্মণ আর সহযোগী বসার ব্যবস্থা করে দিল...খাওয়ার জলের বোতল এগিয়ে দিল। পেঁয়াজ, শসা কেটে এনে দিল ।তারপর থালায় করে ভাত -ডাল-আলুভাজা, ফুলকপির তরকারী এবং মাছের কালিয়া পরিবেশন করল।

খেতে চাইছিনা , তবু সে কী জোর করা! বিয়ের পর প্রথম জামাইষষ্ঠীতে শাশুড়ির খাবার থালা হাতে তাড়া করার দৃশ্য মনে এল।

দুপুরের রোদ পিঠে নিয়ে একটু গড়িয়ে নিলাম। চোখ লাগব লাগব করছে আবার সেই লক্ষ্মণের হুঙ্কার... “চলুন চলুন, নইলে দেরি হয়ে যাবে।”

গাড়ি গড়াল।গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি...আমাকে এখনও চমকায় দেখে বিস্মিত হলাম (অতটা বুড়ো হইনি তাহলে!)

বেলা পড়ছে। রোদ ঢলছে...ঠান্ডা নামছে।ওজন বাড়াচ্ছি শরীরের।গাড়ি এসে থামল শ্মশানের অনতি দূরত্বে কোয়েনার তীরে।

কাঁহাতক আর সবুজ প্রাচীর...কোয়েনার কুলকুল লিখব।নিজেরা বুঝেনিন। শুধু বলি ফিসফিসকরে – আমি তোমাকে ভালোবাসি বললে...অরণ্যের পাতা নড়ে উঠবে...এতটাই নির্জন অথচ এতটাই সজাগ এই বনভূমি।

কোয়েনার পারে সকলে ঘুরছে...পাথর তুলছে...

মাঝে মাঝে স্পন্দনের কথা কানে আসছে...

- 'বাবা এই দেখ হাতি পেলাম একটা'...'বাবা একটা বেবি পেয়েছি।'

একটা গাছের গোড়ায় বসে আছি। কাফ সিরাপ খাচ্ছি...

*'সুকন্যার কথা মনে এল।সুকন্যা বলেছিল এক তরুণ ডাক্তারকে- এইখানে শ্মশানে কোন ভয় নেই...কেমন খুশি খুশি ভাব।

তরুণ ডাক্তার মৃদু হেসে বলেছিল –“ ভয় পেলেই ভালো হত! অন্তত অস্তমিত সূর্যদেবকে আর একটু রাঙিয়ে দিতে পারতাম। ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরতে আর আমিও অভয় দেওয়ার ছলে আরও কাছে টেনে নিতাম তোমাকে।

সুকন্যা চিবুক তুলে হেসেছিল।”*

আমিও হাসলাম।

এভাবেও ছুঁয়ে থাকা যায়...তাহলে!

গাড়ি গড়াল সন্তুর রিসর্টের দিকে।

রাত্রির রঁদেভু...কাল

(তরুণ ডাক্তারটির নাম ডাঃ বৈদ্যনাথ গাঙ্গুলি। অভিজিৎ গাঙ্গুলির বাবা। কাহিনীর তথ্যসূত্রঃ- কারো-কোয়েনা-কোয়েল)

(চলবে)


1 comments:

  1. অসাধারণ মানের লেখা, ভ্রমকাহিনী এতো ভাল করেও লেখা যায়, পরের অংশের জন্য পাঠক্ক কে অপেক্ষা করতেই হবে Arindam

    উত্তরমুছুন