সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

গল্প - মৌ দাশগুপ্তা

অল্প-স্বল্প গল্প-গাথা
মৌ দাশগুপ্তা



বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সিনহা বাড়ীর মহিলা মহলে সাজ সাজ রব, অথচ দেখতে গেলে ব্যাপারটা এমন কিছু আহামরি নয়। প্রতি মাঘী পূর্ণিমায় এ বাড়ীর আরাধ্যা কমলা কিশোরীর পূজো হয়। এ বছর একে মাঘী পূর্ণিমা বৃহস্পতিবারে পড়েছে, তারওপর বাড়ীর গিন্নী সুশীলা দেবীর বিচ্ছিরি ধরনের ডায়াবেটিস ধরা পড়ায় নতুন বউ রাই এর ওপর পুরো ঝঞ্ঝাটটা এসে পড়েছে। সে বেচারা এমনিতেই একটু ধীর স্বভাবের , তায় মেজাজী শাশুড়ীকে একটু ভয়ই পায়, কখন কোন কাজে কি খুঁত ধরা পড়বে আর মিষ্টি কথার হূল খেতে হবে, সেটা ভেবেই একটু তফাত থাকে, আজ আর বেচারীর রেহাই নেই।

বাড়ীর লোকসংখ্যা যে অনেক তা নয়, গৃহকর্তা কেশব বাবু, বাড়ীর গিন্নী সুশীলাদেবী,তাঁদের ছেলে কৃষ্ণমোহন, ছেলে-বৌ রাই, কলেজ পড়ুয়া দুই মেয়ে কান্তা আর করুণা,কেশব বাবুর দূর সম্পর্কের বিধবা ভাগ্নে-বৌ বনলক্ষ্মী (বাড়ীর বিনা পয়সার রাঁধুনী), আর সব সময়ের কাজের লোক সাবিত্রী, কূল্যে আটজন। বাড়ীর পুরুষমানুষরা অত ভক্তিমান নন, দুজনেই যথানিয়মে এবং যথাসময়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছেন অতএব মহিলা মহল সোৎসাহে ভীড় জমিয়েছেন দোতলার ঠাকুরঘরে। আজ ঘরের হেঁসেলে নিত্যকালীন ভাতডাল রান্নার পাট নেই, ছেলেরা পূজোয় ভাগ নেবেন না, তবে ঘরেও ভাত জোটেনি তাই আজ অফিস ক্যান্টিনেই খেয়ে নেবেন। ঠাকুরঘরের পাশের একফালি ছাদটাই ধুয়ে মুছে গঙ্গাজল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে,নতুন তোলা উনুনে পূজোর হাঁড়ি পাতিলে ভোগ বানানোর প্রস্তুতি চলছে।

রান্নাবান্নার দায়িত্ব রোজকার মত বনলক্ষ্মীর ওপর, রাই-র ওপর ঠাকুরঘরের কাজ,যে যার কাজে লেগে পড়েছে। সাবিত্রীর রোজকার ঝাঁটপাট,মোছামুছি,ধোয়াধুয়ি চলছে, বাড়ীর বড় মেয়ে কান্তার সাথে সকালেই তর মায়ের একচোট লড়াই হয়ে গেছে, আজ বাড়ীর পূজোর অজুহাতে সুশীলাদেবী কান্তাকে ঘরবন্দী করেছেন, এদিকে ওর বন্ধু, (ইয়ে, মানে বিশেষ ছেলেবন্ধু) মাধব আজ একটু বিশেষ ধরনের জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবে বলে সারপ্রাইজ দিতে চাইছে, এখন কান্তা কি করে? মাকে বলতে পারছে না মাধবের কথা, আর মাধব বুঝছে না বাড়ীর অসুবিধার কথা। তাই দুজনের উপর রাগ করে দোতলাতেই নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে । ছোট মেয়ে করুণার ঠাকুর দেবতায় অত ভক্তি-শ্রদ্ধা নেই, নেহাত কলেজে সেমিষ্টার পরীক্ষা চলছে, কলেজ বা বন্ধুর বাড়ী গিয়ে বসে থাকতে পারছে না, আর দিদির সাথে মায়ের ঝামেলার বহরটাও দেখে নিয়েছে,তাই কানে হেডফোন গুঁজে বইপড়ার ভান করছে। সুশীলাদেবী ঠাকুরঘর আর রান্নার জায়গার মাঝে চেয়ার পেতে বসে সবদিকে নজর রাখার মহান কাজটি করছেন।

কথায় বলে কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, এখানে সেটা একটু পাল্টে কর্ত্রীর ইচ্ছেয় হয়ে থাকে।পূর্ণিমা লাগবে সন্ধ্যা নাগাদ, ততক্ষণ অবধি সব নির্জলা উপোষ। না খেয়ে থাকলে একদিনে কেউ চোখে অন্ধকার দেখে না, বা অসুস্থ হয়ে পড়ে না সেটা ঠিক-ই, খালি পেটেয় ছুঁচোর দঙ্গল ডন-বৈঠকি মারে। তবে নিজের থেকে মন স্থির না করলে, মানে, বাধ্য হয়ে, বা অন্যের কথামত উপোষ করে আছি ভাবলেও খিদে তেষ্টা বুঝি বা মানুষকে একটু বেশীই কাবু করে তোলে।এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।সবাই যে যার বরাদ্দ কাজ মুখ বুঁজে করে যাচ্ছে বটে,অন্যদিকে ইন্দ্রিয়গুলো কিন্তু পূজোর পাকশালাতেই ঘোরঘুরি করছে। সাবিত্রী আবার সুশীলাদেবীর খাস লোক। ঘরের সবার গোপন এবং নির্ভরযোগ্য খবরটি যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছানোটাও ওর কাজের মধ্যেই পড়ে। বয়স খুব বেশী না হলেও বোঝে খুব বেশী,তাই সময় থাকতেই উঁচু ডালে মই বেঁধে রেখেছে। বাড়ীতে রান্নার পাট নেই, কেউ যাতে লুকিয়ে খাবার খেয়ে উপোষ ভেঙ্গে বাড়ীর অকল্যাণ না করতে পারে তার জন্য গিন্নী স্বয়ং রান্নাঘরে,ভাঁড়ারঘরে,তালা দিয়ে চাবি আঁচলে বেঁধে রেখেছেন।সকালে যেখানে কর্তামশাই দাদাবাবু না খেয়ে বেরিয়েছেন সেখানে কে আর হেঁচিপেচি সাবির জন্য খাবার কোলে বসে আছে? অথচ সাবির মত কাজ সকাল থেকে কে করছে? সেই কোন কনকনে ঠান্ডা ভোর রাত থেকে গোটা দোতলা বাড়ী ঝাঁটপাট,মোছামুছি, এতগুলো লোকের গত রাতের এটোঁ বাসন ধোয়াধুয়ি, কাপড় কাচা চলছে, হাত-পা ভেরে গেছে, কিন্তু পেটে দানাটি অবধি নেই।গিন্নীমাটির রোগজনিত কারণে খাই খাই ভাবটা ইদানীং খুব বেড়েছে, আসল খিদে কি চোখের খিদে বলা মুশকিল , ডাক্তারের কড়া নির্দেশে খাবারের পরিমানতো অনেক কমেছেই, তার সাথে না খেতে পারার তালিকায় অধিকাংশ প্রিয় খাবারের অন্ত্রভুক্তি ঘটায় মনোকষ্টটাও বেড়েছে বই কমেনি। আজ হয়ত তাই সেগুলোই ভোগে উৎসর্গ করার নির্দেশ দিয়েছেন, যেগুলো এখন ওনার নাগলের বাইরে বললেই হয়। কমলাকিশোরীর পরিতৃপ্তির থেকেও কিছুটা নিজের রসনাতৃপ্তির ব্যাপারটাই বোধহয় অবচেতনে কাজ করেছে এদিকে লিস্টি বানিয়েছে যজ্ঞিবাড়ীর,কিন্তু কার যে লোভের পরিতৃপ্তি হচ্ছে দেবতার নামে, সে কি আর কারো জানতে বাকি আছে? । খিচূড়ী, লাবড়া, চরু, নারকোলের নাড়ু,তক্তি,মোয়া,মুড়কি,পুলি পিঠে, মুগতক্তি, রাঁধিয়ে একমনে ঘাড় গুঁজে সকাল থেকে ঘেমে নেয়ে বানিয়ে যাচ্ছে, আর সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘ্রাণে অর্ধভোজন তো হচ্ছেই সাথে মুখের ভিতরে লোকচক্ষুর অন্তরালে যা জল কাটছে তাতে তেষ্টাটাও পাবে না বোধহয়।

গিন্নীমাটি অবশ্য গতর নেড়ে কাজটিওতো করেন না, হাঁটাচলাও তো ঘরের মধ্যেই,এ ঘর থেকে ওঘর। বেশী খেলে হজম হবে কি করে? শকুনির দৃষ্টি মেলে সক্কাল থেকে থানা গেড়েছে সামনে, যেন রাঁধতে রাঁধতে লক্ষী বউদিই আধা পেসাদ পেটে লুকিয়ে রাখবে! সবাইকে নিজের মত নিখাউন্তী ভাবছে ! এদিকে ঠাকুরকে দেবার আগে যে নিজেই চোখ দিয়ে গিলছে সে কি আর কেউ টের পাচ্ছে না? পূজো যাদের ঘরের, উপোষও বাপু তারাই করুক না, কি দরকার অন্যদের জোরজার করে নিয়ম মানানোর?

তারপরে ঐ লক্ষী বৌদি, নিজের বলতে সেরকম কেউ কোথাও নেই বলে, বলতে গেলে একরকম দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়া পরার বিনিময়ে এখানে আছেন, বদলে সংসারের হেঁসেল সামলাচ্ছেন। তাতেও কথা তো আর কম শুনতে হয়না! কিন্তু এই যে এ বাড়ীতে ওনাকে ঠিক পরিবারের একজন বলে মানা হয়না । বরং মাঝে মধ্যে বোঝাই যায় যে ওনার জায়গাটা সাবিত্রীর থেকে খুব একটা আলাদা না, তাও তো সাবির না পোষালে অন্য বাড়ীতে কাজ নিয়ে বেরিয়ে যাবে, বনলক্ষ্মী তো সেটাও পারবেন না। অথচ বাড়ীর পূজোর বাহানায় এই শীতে কাঁপতে কাঁপতে ভোর রাতে স্নান সেরে সারাটি দিন জল অবধি না খেয়ে সেই যে পাকশাল সামলাচ্ছেন তাতে কারো কিন্তু সামান্য কৃতজ্ঞতাটুকু অবধি নেই। তা ওনার তো কারণে অকারণে ব্রত পার্বন,সাত-সতেরো, তার ওপর ছোঁয়াছুয়ি, মানামানিটাও লোক দেখিয়ে একটু বেশী করতে হয়, পূর্ণিমা, অমাবস্যা, একাদশী সবই মানেন, উপোষ করাটা ওনার কাছে হাঁচি কাশির মত নিত্যি ব্যাপার ।অথচ সারাদিন তো রান্নাঘর আর ভাঁড়ারঘরেই খুচখাচ চলে, তা মুখ কি আর চলে না? খুব চলে। নয়তো অত টুসটুসে চেহরাটা থাকে কি করে? আজও সব নিয়ে যে ভাবে সবার দিকে পিছু ফিরে মুখ গুঁজে বসেছে দু এক গাল মুখ চালালেও কেউ টেরটি পাবেনা।

বড়দি তো সাতসকালেই মায়ের সাথে ঝগড়া করে গোঁসাঘরে খিল দিয়েছে, ও প্রায়ই হয়।বাপের আদুরী কিনা, যতক্ষন না বাপে এসে “বাবা বাছা” বলে ডাকাডাকি করবে,ততক্ষন দরজা খুলবে না, আজকাল তাই বড়দি ঘরে দোর দিলে কর্তাবাবু না ফেরা অবধি কেউ ডাকেও না।আর রাগ হলে বুঝি ওদের খিদে টিদেও পায় না।ওদের আর কি? খিদের জ্বালা জিনিষটা কোনদিন ভুগতে হয় নি কিনা! এই যেমন ছোড়দি, খেলে মোটা হয়ে যাবার ভয়ে সেধে একবেলা খায়, ভাত রুটি খায়না, ভাজভুজি,মশলাদার খাবার, মিষ্টি এসব কিচ্ছু খায় না। সারাদিন তো ঐ লেবুর রস, টকদই, ফল, স্যালাডই খায়, সপ্তাহে একদিন নিয়ম করে কারণ ছাড়া উপোষ।

দুই মেয়ের পর ঐ টিংটিং চেহারার কনে বৌটি, আলালের ঘরের দুলালী কিনা,রীতিমত খুঁটে টিপে ফেলে ছড়িয়ে ছাড়া খেতে পারেনা। না খাবার লিস্টিটাই এত বড় যে, কি খায় কে জানে,ডাল খেলে পেট ফাঁপে,ফল খেলে অ্যাসিড হয়,শাক দেখলে বমি আসে,মাটির নীচে হওয়া সব্জিতে অ্যালার্জি আছে।কত ঢং যে জানে। ঘনঘন পেটের প্রবলেমে ভোগে আর খাওয়া দাওয়া ছেড়ে চোখ উল্টে পড়ে থাকে।নেহাত বাপে ডাক্তার , তাই রক্ষে।নয়ত ঐ রক্ষাকালীর অসুখ সারাতেই সব ফতুর হয়ে যেত।

তা সাবির তো আর অত সুখের জীবন না,শখেরও না, রীতিমত গতর খাটিয়ে পেটের ভাত জোগাতে হয়।সাবিকে নিজের ভালোটা নিজেকেই বুঝতে হবে। কাজপাট সেরে গিন্নীমার পা টিপে দেবার আছিলায় বসে থাকতে হবে, ঐ দুই পথের কাঁটা নিজেদের এলাকা থেকে একটু সরলেই টুক করে হাত আর মুখের কাজটা সেরে নিতে হবে, এমনিতেও সকাল থেকে এতপদ রান্না হলে কি হবে, সাবিকে দিতে করো হাত সরবে না তখন সাবির ভাগে যত গুঁড়ো-গাড়া ফেলা-ছড়া জিনিষ!

ভাবনা চলে ভাবনার মত আর সময় চলে সময়ের মত, দুজনেই নিরন্তর বহমান কিন্তু একসঙ্গে যে গতিশীল তা নয়।সময়ে ছেদ পড়ে না, ভাবনায় পড়ে। পুরোহিত এসে পড়ায় সাবিকে চিন্তায় যতি দিতে হল। রাই,করুণা,পুরোহিতের সাথে ঠাকুরঘরে ঢুকলো, বনলক্ষ্মী সারাদিনের ক্লান্তি সরিয়ে নীচে গেল একটু গরম জলে স্নান সেরে সে অঞ্জলি দেবে, সাবির বাবা ত পূজো পাটে ভক্তি নেই।দুমুঠো পেটের ভাত জুটলেই হোল,তা পূজো শেষ হতে এখনও অনেক দেরী, সকালের উপোষী শরীর আর টানছে না অতএব সাবি গায়ে কাপড়টা টেনে গুড়িসুড়ি মেরে নীচের বৈঠকখানায় বসতে গেল, টিভি দেখতে , সুশীলা বোধহয় বড় মেয়েকে ডাকার বৃথা চেষ্টায় যাচ্ছিলেন, এমন সময় হঠাৎ বনলক্ষ্মীর আর্ত চিৎকার। জল গরম করতে গিয়ে বেখেয়ালে শাড়ীতে আগুন ধরে গেছে, বিপদের ওপর বিপদ,চিৎকার শুনে তড়িঘড়ি নামতে গিয়ে সুশীলা সেই যে আছাড় খেয়ে পড়েছেন আর উঠতে পারছেন না।এদিকে পূজো শুরু হয়ে গেছে, থামাতে গেলে অমঙ্গল। নেহাত কান্তা গাড়ী চালাতে জানে,গোঁসা ঘর থেকে বার হয়ে কান্তা তৎক্ষণাৎ মা,বোন,বনলক্ষ্মীকে নিয়ে কাছেই রাইয়ের বাবার নার্সিংহোমের দিকে রওনা দিল, রাই ও চললো সাথে, দু’জন আহতকে সামলাতে দুটো লোক তো লাগবে, নাকি? সপুত্র কেশব বাবুকেও খবর দেওয়া হোল।

যথাবিহিত পূজো-পাঠ, হোম-আহূতি সেরে পুরোহিত মশাই অঞ্জলি দেবার জন্য ডাকলেন যখন, তখন বাড়ীতে সাবি ছাড়ার কেউ নেই। খুব মন দিয়ে পুষ্পঞ্জলি দিল সাবি।“সবার মঙ্গল কোর ঠাকুর, সবার মনের ইচ্ছা পূর্ণ কোর।“

1 comments: