সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ভারতকথা - শমীক (জয়) সেনগুপ্ত

ভারতকথা
শমীক (জয়) সেনগুপ্ত

সত্যবতী


(১)
শাওণ মেঘের ছায়া বুকে নিয়ে জল চলেছে কালিন্দীর বুকের ওপর দিয়ে । বর্ষার রুমঝুম শব্দে অলকাপুরীর সভার নৃত্যাঙ্গণাদেরও আজ তাল কেটে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। সেখানে খেয়া পারানীর কড়ির হিসেব করতে ভুলে যাওয়াটা আজ সত্যি স্বাভাবিক ছিল মৎসগন্ধার পক্ষে। নারী সে, জেনে এসেছে কৌমার্যের দাম অমূল্য; তবু আজ স্বেচ্ছায় তা দান করেছে সে অবিবাহিত অবস্থায়। ঋষি পরাশর, বশিষ্ঠের পৌত্র ও শক্তির পুত্র পরাশর শুধু যে জ্ঞানী ও ত্রিকালজ্ঞই নন,অদ্ভূত এক তেজ তাঁর মধ্যে আছে, যাকে অস্বীকার করা যায় না। এত মোহময় তাঁর চোখ, যে সে চোখের দিকে তাকালে চোখ সরানো দায়। ঋষি ত’ কোন জোর করেননি-

শুধু আঁশটে গন্ধ লেপটে থাকা মেয়েটাকে একবার অনুরোধ করেছেন

- “দেবী আমি তোমার গর্ভে আমার সন্তানের বীজ বপন করতে চাই। তুমি সর্ব-সুলক্ষণা, ও ভবিষ্যত আর্যাবর্তের অধিশ্বরী হবে। আমার পুত্রের মাতা হওয়ার সম্পূর্ণ যোগ্যতা তোমার আছে আর্যা। আমাকে ফিরিয়ে দিও না।“

“আর্যা !!” অস্ফুট স্বরে স্বগোতক্তি করল মৎসগন্ধা । এ কি বলছেন ভগবন পরাশর ? জন্ম অবধি সে জেনে এসেছে অনার্য, ধীবরদের সর্দার তার পিতা, দাসরাজ তাকে হাতে ধরে জাল বোণা শিখিয়েছেন, শিখিয়েছেন তীরন্দাজি, নৌকা চালানো। শরীর দিয়ে মাছের বাস আসে তাই সকলে ডাকে মৎসাবতী বা মৎসগন্ধা। শুধু পিতা দাসরাজ মাঝের মধ্যে ডেকে ওঠেন আদর করে “সত্যবতী।”

ত্রিকালজ্ঞ মুনি শুধু হাসলেন। কিছু বলা হয়ে ওঠেনি। আকাশের কালো মেঘ মাঝ যমুনার বুকে ঘণায়মান অন্ধকারকে নিবিড় করে কুহেলিকার মায়াজাল বুনলো। তারপর সেই অন্ধকারেই দুই শরীর দুই আত্মার মিলনের ভিতর দিয়ে জন্ম নিল এক শিশুপুত্র অপার্থিব ও পারলৌকিক যোগবলে।

পরাশর এবার চলে যাবেন, কিন্তু যাওয়ার পূর্বে একবার তার সন্তানের মাকে প্রাণ ভরে দেখবার ভারী সাধ হল। ষোড়শী যুবতী, যমুনার স্রোতের মতই স্রোতবতী ও স্নিগ্ধা, তবে যে সকলেই বলে এ মেয়ে ভারী চঞ্চল। কৈ মনে ত’ হল না সে কথা ।সম্পূর্ণ কৃষ্ণাঙ্গ সেই শিশুর মায়া ত্যাগ করা যায় না। সত্যবতী বললেন “ভগবন, আমি কুমারী।তবু এক সন্তানের জন্ম দিলাম। আমি জানি আমার কোন পাপ নেই কিন্তু সমাজে আমার পুত্রের কি অবস্থান হবে? আর আমার সারা শরীরের দুর্গন্ধর মত আমার পুত্রের ভাগ্যেও যেন কোন মলিনতা না জড়িয়ে থাকে।

স্মিত হাসলেন পরাশর। বললেন,

- “আর্যা, আমাদের সন্তান জগৎপুজ্য এক ঋষি হবে । তাঁর জন্মই হয়েছে বিশেষ কারনবশত। সময় এলে তুমি নিজেই তাকে ফিরে পাবে। আপাতত সে আমার সাথে যাবে নিজেকে জানতে, বুঝতে। আর আমার বরে আজ তুমি তোমার হারানো কৌমার্য আর প্রকৃত শারিরী ঘ্রাণ ফিরে পাবে। আজ থেকে তুমি আর মৎসগন্ধা নও উপচারিক-তনয়া, এই মুহুর্ত থেকে সহস্র যোজন বিস্তৃত কুমুদিনীর সুবাস তোমার অঙ্গের নিত্য সহচরী হল। আজ থেকে তুমি যোজনগন্ধা হলে সত্যবতী ।। ’’

ইতিহাস থেকে দূরে থাকা সত্যবতীর কানে না পৌছালো ঋষির আশিস, না ধাক্কা দিল উপচারিকের নাম মনের কোণে ?? তার কানে তখন বেজে চলেছে ,

- “আপাতত সে আমার সাথে যাবে নিজেকে জানতে, বুঝতে। ....”

- “আমাদের সন্তান জগৎ পুজ্য এক ঋষি হবে ।”

সত্যবতী- “তবে আমি তাকে পাবো কি করে? দুধের শিশু,মা ছাড়া থাকবে কি ভাবে? সুকোমল ক্ষুদ্র বাহু এখনো অসমর্থ ওর। দোহাই মহর্ষি, ও কে আমার কাছে রেখে দিন। ”

- “ সে তোমার শরীরের অংশ...তুমি ডাকলে সে তোমার সামনে আপনি এসে উপস্থিত হবে...

চিন্তা কিসের দেবী? এতেই ওর ও তোমার মঙ্গল ।” পরাশরের অবিচলিত উত্তরে কিন্তু মায়ের মন পড়লো অসম অনুভূতির বেড়াজালে। একদিকে সন্তান অন্যদিকে তার মঙ্গলচিন্তা। মায়ের মন সন্তানের মঙ্গলের কাছে দূরত্বকে মেনে নিল। চলে গেলেন ঋষি পরাশর। না, যাওয়ার আগে তাঁর সন্তানের মাকে অধিকার দিয়ে গেলেন পুত্রের সাথে দেখা করবার। অধিকার দিয়েছিলেন তাঁর সাথে একাসনে বসে সন্তানের নামকরনের।

পরাশরের বংশজ সেই শিশুর নাম দ্বৈপায়ণ। কালো রঙ তাই মা ডাকলেন কৃষ্ণ বলে আর স্বর্গ থেকে দৈববাণী হল –

- “এই পুত্র বশিষ্ঠের যোগ্য উত্তরসূরী।চেদীরাজ-বংশ আর বশিষ্ঠের রক্তের মানবৃদ্ধিকারী এই পুত্র । সমস্ত আর্যাবর্ত এঁকে ব্যাস নামে চিনবে। আর দেবতারাও এঁকে পূজা করবে।’’

চলে গেলেন পরাশর নিজের শিশুপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে।

(২)
কেটে গেছে দু-বছর। “আচ্ছা, কৃষ্ণ এখন কত বড় হবে? আমার কথা কি ঋষি তাকে জানিয়েছেন?” এই সব সাত পাঁচ কথা ভাবতে ভাবতে হঠাত করেই বিদ্যুৎ শিখার মত নামটা মনে এল সত্যবতীর। মহর্ষি পরাশর তাকে বারবার “আর্যা” বলে সম্ভাষণ করেছেন । কেন ? উপচারিক-তনয়া বলে ডেকেছেন মুনিবর, আর দৈববানীতে তার সাথে চেদীরাজের যোগ দেখিয়েছে স্বয়ং দেবতারা। এ সব কিসের সংকেত। উতলা হল নারীর হৃদয়। উপচারিক কে? এ নামটা তো আগে কখনো শোনেনি সত্যবতী। চেদী রাজ্যটা কোথায় তার জানা নেই । কি হয়েছিল তার জন্মের সময় ? এই সব প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খাচ্ছে সমানে। পিতা দাসরাজকে জিজ্ঞাসা করেও কোন সদুত্তোর পায়নি সে। নারী সে, একা তার পক্ষে এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়- তাও বদ্ধপরিকর সে । তাকে জানতেই হবে ।

নিশীথাবসানে যেমন ঊষার প্রকাশ হয় ঠিক তেমনই ভাবে নিজের অন্তরের সব দোলাচলকে প্রশমিত করে আজ এক আত্মপ্রত্যয়ী কন্যা এসে দাঁড়ালো দাসরাজের সামনে। এ তার চেনা সত্যবতী নয়। শরীরে ও মনে এ কোন জেলেনী নয়, কোন অচেনা সম্ভ্রম ও জোড় নিয়ে দাঁড়ালো মেয়েটা প্রত্যুষে প্রথম রবিকরপাতে।

- “পিতা, কোনদিন কিছু চাইনি আপনার কাছে। আপনার সব আদেশ মেনে এসেছি। সত্য বলুন আমায়, কি আমার পরিচয়? চেদীরাজ্যের সাথে কি সম্পর্ক আমার? চুপ থাকবেন না তাত। সত্য জানার অধিকার আমার আছে। ”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো দাস-ধীবর । স্মৃতিপটে ভেসে আসে আঠারো বছরের ব্যবধান। আর একটা টুলটুলে মুখ। যাকে ভুলে গেছিলেন দাসরাজ, সেই অদৃকা আজ স্মৃতির দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। মেয়েটার মুখ অবিকল সেই শাপভ্রষ্ট অদৃকার মত।

১৮ বছর আগে এক অনিন্দ্যসুন্দরী নারী এসেছিল যাযাবর ধীবর পল্লীতে । দাসরাজ ও তার দলবল তখন আস্তানা নিয়েছিল চেদীর বেত্রাবতী ও যমুনার সঙ্গমে। মোহনার মাছ যেমন সরেস ও সুস্বাদু তেমনি এই মেয়েটি। ভরা যৌবন ,ওমন নদীতে বাণ ডাকার মত দল-মলা শরীর, অমন নাচের মুদ্রার মত চলন , আর কথা- আহাঃ, সে যেন মধু মাখানো।

মেয়েটি অদৃকা। ইন্দ্রের অমরাবতীর এক শাপভ্রষ্টা নির্বাসিতা কিন্নরী সে। ছন্দে লয়ে সামঞ্জস্য রাখতে না পারার দোষে তাকে নামানো হয়েছে মাটিতে। গান্ধর্বী কলার অমর্যাদা কিন্নরকুলে ক্ষমার অযোগ্য তাই মর্ত্যলোকে রাজা উপচারিকের সন্তানের জন্ম দিয়ে সে শাপমুক্ত হবে। তাই সে আশ্রয় চেয়েছে দাসরাজের কাছে। দিয়েছিল আশ্রয় দাসরাজ। তারপর কত দিন রাতের শেষে স্বয়ং রাজা উপচারিককে চোরের মত পালাতে দেখেছেন অদৃকার ঘর থেকে। রানী গিরিকার ভয়ে কোনদিন অদৃকাকে ঘরে তুলতে সাহস পায়নি চেদীপতি। তাদের মিলন সীমাবদ্ধ ছিল তাদের গন্ধর্ব বিবাহের মতই।

কিন্তু ক্রমে গর্ভসঞ্চার হল অদৃকার। রাজাও কোন কথা না বলে আসা বন্ধ করলেন। তারপর একদিন শোনা গেল রাজা যুদ্ধে গেছেন। আর কোন সন্ধান নেই। নয় মাস পেরিয়ে দশ মাসে পরার তিনদিন বাদে অদৃকা এক শিশু পুত্র ও এক কন্যাকে জন্ম দিয়ে ফিরে যায় ইন্দ্রলোকে। যাবার আগে ফিরেও তাকায়নি সন্তানদের দিকে। পিছুটান থাকতে নেই অপ্সরাদের।

ধর্মত এই সন্তান চেদীরাজের। তাই ধীবর গেল রাজপ্রাসাদে। রাজা ফিরে এসেছেন। দুটি বাচ্চার মধ্যে পুত্র মৎসকে গ্রহণ করলেও সত্যবতীর জায়গা হলনা। একে কন্যা তায় মাছের গন্ধ গায়ে লেপটে আছে। এ মেয়ে রাজার হয় কি করে? তা ছাড়া পুত্রের জন্য ভার্যাগ্রহণ করা যায় কারন সে বংশ বাড়াবে, মেয়ে লাগবে কোন কাজে ? এত যুক্তির আড়ালে দাসরাজ শুধুই হাসলো। বলল ,

- “তাই হক, এ মেয়ে আমার পরিচয়ে বড় হবে। সময় দেখাবে রাজা, মেয়ে সন্তান শুধু পিতৃ-মাতৃ বা শ্বশ্রূকুল নয়, সমস্ত দেশের গৌরব হয়ে উঠবে মহারাজ। সেদিন ভাগ বসাতে এসো না।”

পরে রটনা শুনলে দাসরাজ। মৈথুনরত অবস্থায় গিরিকার সঙ্গত্যাগ করে উপচারিককে যুদ্ধে যেতে হয়। তাই অসমাপ্ত অভিসারের মিলনকে সম্পন্ন করতে পত্রপুটে বীর্য পাঠিয়েছিলেন রাজা প্রিয় পারাবতের মাধ্যমে। দুর্ভাগ্যবশত সেই পাতা যমুনার জলে পরে ও এক মীণকন্যা তা ভক্ষন করে অন্তস্বত্তা হয়ে যায়। তারই সন্তান মৎসকে ধীবরবেশী বরুনদেব ফিরিয়ে দিয়েছেন উপচারিকের কোলে।

সত্যবতীও হয়ত ভাবলো বিচিত্র এ দেশ সেলুকাস, আরো বড় অদ্ভুত নারী হয়ে জন্মানোটা। প্রদীপ নিভে গেল। লাল আভায় পূর্বাশার আকাশ তখন নতুন দিন কে স্বাগত জানাচ্ছে। কি করবে সত্যবতী !! জানে না সে। রাজকুলে জন্মেও যে রাজকন্যা নয়, পিতা মাতা থেকেও যে অবাঞ্ছিত, সন্তান থেকেও যে তার সুখভোগ করতে পারলোনা তার আর কি বা করার থাকতে পারে। ঘরের এক কোণে পরে থাকা অরিত্রকে সঙ্গী করে মেয়ে চলল তার ডিঙি নৌকার দিকে। হয়ত নদী জানে কি করতে হয়, কোন স্রোত কি ভাবে বান আনে, জোয়ার-ভাঁটার খেলায় বড় অসহায় বোধ করছে সে নিজেকে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন