সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ, ১০ম সংখ্যা

সম্পাদকীয়



সাহিত্যসাথীরা,

আশা করি ভালো আছেন সবাই। হেমন্তের পেলব পরশ গায়ে মেখে শীত এসে গেল,আর তারই সাথে পৌষের ডালি সাজিয়ে সৌকর্য আরো একবার আপনাদের কাছে হাজির। আপনাদের ভালবাসা ও সুন্দর সাহিত্যচিন্তা আমাদের এগিয়ে চলার পাথেয়। তাই আপনাদের কাছে আবারো ধন্যবাদ।

আমাদের এবারের বিভাগেও আগেরবারের মত গল্প,প্রবন্ধ, কবিতা বা ধারাবাহিক উপন্যাসের মত নিয়মিত বিভাগগুলো ছাড়াও আমাদের বিশেষ বিভাগগুলো রয়েছে -

১. স্মৃতিচারণ
২. অবিস্মৃত
৩. ভারতকথা
৪. পরম্পরা

আমাদের শীতকালীন এই সওগাত মিঠে রোদ্দুরে পিঠ ঠেকিয়ে উপভোগ করুন বন্ধুরা। ভালো থাকুন ও সঙ্গে থাকুন ।।

সম্পাদক মন্ডলী
সৌকর্য

প্রবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

নারী ও আমাদের সমাজ
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সম্প্রতি একটি সংবাদপত্রে লিখেছেন “...এই যে এখন প্রায় দিনই ধর্ষণ বা যৌননিগ্রহের ঘটনার কথা জানতে পারছি, এ সব আগেও প্রচুর পরিমানেই ছিল। তখন এমন জানা যেত কম । এখন এটা সম্ভব হচ্ছে মিডিয়া হাইপের জন্য । মিডিয়া এখন এগুলোকে নিয়মিত তুলে ধরছে । আমারতো বয়স অনেক হয়ে গেল । মেয়েদের ওপর অত্যাচার বরাবরই হতে দেখেছি । নতুন কিছু নয়” ।

খুব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার কারণেই অনেকেই এরকম মন্তব্য পছন্দ করবেন না । তারা মনে করতে পারেন এই রকম ক্যাজুয়াল মন্তব্য নির্যাতনকারীদের উৎসাহিত করারই সমতুল । আমার মনে আছে অনেক বছর আগে তখনকার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বানতলায় নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে সাংবাদিক দের প্রশ্নের উত্তরে ইংরাজিতে বলেছিলেন “ইয়েস,ইট হ্যাপেনস”। সাংবাদিকরা এর বাংলা অনুবাদ করে ছড়িয়ে দিলেন ‘হ্যা এরকম ঘটনা তো কতই হয়” জ্যোতি বসু নাকি বলেছেন । এবং প্রবাদের মত হয়ে গেলো উদ্দেশ্য প্রনোদিত ভুল অনুবাদ করা উক্তিটি । পাড়ার আড্ডায় কোন আলটপকা মন্তব্য আর শীর্ষেন্দুর মত সাহিত্যিকের কথার ওজনতো এক নয় ! না শীর্ষেন্দু ভুল কিছু বলেননি এবং নতুন কিছুও নয় । কিন্তু একটা তাচ্ছিল্য ভাব যে আছে এই মন্তব্যে তাতে সংশয় নেই । আসলে এ থেকে নারীর অবস্থান সম্পর্কে আমাদের সমাজের মনোভাবটাই প্রতিফলিত হয়েছে এরকম মন্তব্যে ।

সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই পুরুষের প্রয়োজনে নারী ব্যবহৃত হয়ে এসেছেন, মাতৃতান্ত্রিক সমাজও এর ব্যতিক্রম ছিল না । যাযাবর জীবন থেকে মানুষের সমাজ গঠনের প্রক্রিয়ায় নারীর ভূমিকাই তো ছিল প্রধান কেননা তাকে নিয়েই পরিবার , আর অনেক পরিবার নিয়েই গড়ে উঠলো সমাজ । এবং তখন থেকেই নারী হয়ে গেলো পুরুষের অধীন । মনুর বিধান ছিল ‘ন স্ত্রীস্বাতন্ত্র্যমর্হতি’ ।

স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয় । তারা কুমারী অবস্থায় পিতার অধীন, বিবাহের পর পিতার অধীন আর বার্ধক্যে পুত্রের অধীন” ।

তো এই বন্দোবস্তই তো প্রবহমান আজকের আধুনিক ভারতীয় সমাজেও । হ্যা,গত দু আড়াইশ বছরে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ও নানান আইন-কানুনের প্রণয়ন চোখে পরার মত অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু নারী সম্পর্কে সমাজের মনোভাব সেই বেদ-পুরাণ কথিত কাঠামোতেই আছে । লেনিন বলেছিলেন নারী সবচেয়ে আগে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়েছে আর তার শৃঙ্খল মুক্তি ঘটবে সবচেয়ে পরে ।

‘জোর যার মুল্লুক তার’ আমাদের সমাজ বন্দোবস্তের বেশ জনপ্রিয় প্রবাদ । শিশুকাল থেকেই আমাদের এইরকম শেখানো হয় । তসলিমা নাশরিন এই প্রবাদটিকেই অন্যরকম ভাবে তাঁর কবিতায় একটা পংক্তি লিখেছিলেন “হাতিয়ার যার মুল্লুক তার তখনো বোঝেনি নারী” । না, এখনো বোঝেনি, তাকে বুঝতে দেওয়া হয়না । এই আধুনিক সমাজে নারী স্বাধীনতাবাদীরা নিজের জন্য যে স্বাধীনতার সোচ্চার দাবী করেন তারা কি তাদের ঘরের কাজের মেয়েটির ক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতার দাবী মেনে নেন ? না নেননা । আসলে সমাজ বন্দোবস্তের মূল ভিত্তিটার বদল নাহলে তার উপরিসৌধের বদল হতে পারে না বড়জোর কিছু প্রসাধনী প্রলেপ দেওয়া যায় মাত্র । পুরুষ যেদিন অস্ত্রের দখল পেলো সেদিন থেকেই অস্ত্র বলে বলীয়ান পুরুষ নারীকে বসে রাখতে শুরু করলো । তারপর ধর্ম, আইন, লোকাচার ইত্যাদির সৌধ গড়ে উঠলো এই মূল কাঠামোর ওপর । আধুনিক সমাজে নারীকে বশে রাখার অস্ত্র যেমন রিভলবার ও শাণ দেওয়া ছুরি, তেমনই অখিলেশ যাদবদের রাজনৈতিক ক্ষমতাও । আদিযুগের অস্ত্রের ক্ষমতা এখন অর্থের ক্ষমতাও ।

পুরুষতান্ত্রিক আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান কোথায় সেই প্রশ্নেও পুরুষ দোদুল্যমান সেই বেদ-পুরাণের কাল থেকেই । নারী ‘নরকের দ্বার’ আবার সে শক্তি রূপিণী । তার বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণের অধিকার নেই কিন্তু দৈব আরাধনার সমস্ত উপাচার করবেন নারী । অসুর নিধনে প্রবল শক্তিধর দেবতারা স্মরণ নেন দেবী দূর্গার । কিন্তু অসুর নিধনে তার যাবতীয় প্রহরণ পুরুষ দেবকুল প্রদত্ত । তুমি দেবী বটে কিন্তু তোমার শক্তির উৎস আমরা পুরুষ দেবকুলই । এই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে নারীর ক্ষমতায়নের যত কথাই বলিনা কেন নারীর স্বাধীন মানবিক সত্বাকে পুরুষ স্বীকার করে না, নারীও ও এটা মেনে নেয় । সেই আদি যুহ থেকেই সমজে নারীর অবস্থন, প্রভাব ও ক্ষমতা নির্ভর করে এসেছে অর্থনীতির ক্ষেত্রে তার স্থানের উপর । আদর্শগত ভাবে একথা আমরা প্রায় সকলেই স্বীকার করে নিই যে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার মধ্যেই নারীর স্বাধিকার ও মুক্তির বীজটি নিহিত রয়েছে, কিন্তু নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কোন আমূল পরিবর্তন হয়েহে এমন কথাও বলা যাবে না । উনিশ শতকের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েহে সত্য । উনিশ শতকে যখন অনভিজাত নারী অন্দর মহল থেকে বাইরে বেরিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে, সমাজের চোখে তারা ছিল কুল কলঙ্কিনী । যাদের শ্রমশক্তির ওপর দাড়িয়েছিল সেকালের হিন্দু সমাজ তারা হয়ে গিয়েছিলেন গণিকালয়ের মালিকদের শিকার আর নতুন গজিয়ে ওঠা বড়লোকদের গৃহ পরিচারিকা । এযুগে শিক্ষিত মহিলারা অনেক উচ্চ ও প্রশাসনিক দায়িত্বে কিংবা ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে সাফল্যের শিখরে উঠছেন সত্য, কিন্তু প্রান্তিক নারীসমাজ, কৃষক রমণী, খণি শ্রমিক, আয়া, পরিচারিকারা নারীত্বের সম্মান থেকে বঞ্চিতই থেকে যান ।

ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথচলায় কত পরিবর্তন হয়ে গেছে – হয়ে চলেছে নিয়ত । আমাদের সমহ অ পরিবারের কাঠামোয় কত পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে, পরিবারের বন্ধন শিথিল হয়েছে, আমাদের মূল্যবোধগুলির কত রূপান্তর ঘটে গিয়েছে, কিন্তু নারীর প্রতি সমাজের মনোভাবের বিষয়টি সেই এক সনাতনী বিশ্বাসের অচলায়তনে বন্দি । নারী পুরুষের আশ্রিতা, পুরুষের ভোগ্যা সামগ্রী, লিঙ্গ-বৈষম্যের কারণে সে যেন এক আলাদা প্রজাতি । পিতৃপ্রধান যৌথ পরিবার ভেঙে এখন অনু পরিবার কিন্তু সেখানেও আধুনিক সমাজ কতটুকু স্বাধীনতা দিতে সম্মত নারীকে ? স্ত্রী তার পুরুষ স্বামীর আশ্রিতা – এ ভিন্ন অন্যকিছুই পুরুষ ভাবে না । সমাজ তাকে অন্য কিছু ভাবতে শেখায় না । নারী নিজেও এই ভাবনার অচলায়তনে বন্দি, ধর্মের বাঁধন তাকে অন্য কিছু ভাবতে দেয় না ।

এ বছর ‘আন্তর্জাতিক নারীদিবস’(৮ই মার্চ)এর কেন্দ্রীয় ভাবনা ‘লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান’। রাষ্ট্রসঙ্ঘের নির্দেশিকায় আহ্বান জানানো হয়েছে – ‘প্রতিশ্রুতি হ’ল প্রতিশ্রুতি, এবার লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান ভাবনাকে কার্যকরী করতে হবে’। রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রস্তাবে বা একটি বা কয়েকটি নারীদিবস পালনের মধ্য দিয়ে লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান ঘটবে এমনটা মনে করেননা কেউই । নারীমুক্তির দীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রধানতম অংশই হ’ল লিঙ্গ বৈষম্য ভাবনার অবসান, কারণ নারী-পুরুষের যৌন বিভাজনই মানব-ইতিহাসের প্রথমতম শ্রেণী বিভাজন । মানব সভ্যতার ঊষা লগ্নে মানুষ যেদিন থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা পেল সেদিন থেকেই শুধুমাত্র লিঙ্গ বৈষম্যের কারণেই নারী পরিণত হ’ল পৃথক এক ‘নিকৃষ্ট’, ‘নির্যাতিত’ প্রজাতিতে । মানুষের শ্রমেরও যৌন বিভাজন হয়ে গেল । আর ধর্মীয় অনুশাসনের নিগঢ়ে আবদ্ধ আমাদের সমাজ সেই ধারাকেই বহন করে চলেছে আজও ।

তাহলে শুধুই কি অন্ধকার ? নিশ্চিত ভাবেই তেমন মনে করার কারণ নেই । সমাজ রূপান্তরের যে প্রবহমান প্রক্রিয়া – লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান ভাবনা সেই প্রক্রিয়ারই অংশ । নারী নির্যাতন রোধে মানুষের ক্রমবর্ধমান সচেতনতা কিছু আশার সঞ্চার করে , নারীর অধিকারের স্বীকৃতি ও বৈষম্যের অবসানে নানান আইন প্রণয়ন হচ্ছে । আইন সমাজের মানসপটকে আমূল বদলে দিতে পারে না ঠিকই , কিন্তু আইন সমাজ মানসের পরিবর্তনের ধারাকে কিছু রক্ষাকবচ দিতে পারে যা নারী প্রগতির প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিও বটে ।

লেখা শুরু করেছিলাম এক খ্যাতিমান সাহিত্যিকের প্রাসঙ্গিক বয়ান উদ্ধৃত করে, আর শেষ করছি আর এক প্রবীণ সাহিত্যিকের মন্তব্যের উধৃতি দিয়ে । সম্প্রতি একটি দৈনিক সংবাদ পত্রে খ্যাতিমান সাহিত্যিক দেবেশ রায় লিখিত ‘কত উৎসব! কত টুকরো দেশ !! কত অখন্ড নারী ও বাজার !!!’ শিরোনামের নিবন্ধটির শেষ স্তবকটি এইরকম –
“আমাদে দেশের এক ব্যবসায়ী তাঁর স্ত্রীর পঞ্চাশ বছরের জন্মদিনে নিজের জেট বিমানে অতিথিদের নিয়ে যেতে পারেন দেশের আর এক প্রান্তর ঐতিহাসিক প্রাসাদে আর সেই একই দিনে কচি কচি মেয়েরা রাস্তায় মিছিল বের করে, তাদের ছোট ছোট হাতে প্ল্যাকার্ড তুলে – আমাদের ধর্ষণ করো না । মুকেশ আম্বানির স্ত্রী শতায়ু হোন । কিন্তু যে ছাত্রীটির স্কুল ব্যাগ পুকুরপাড়ে পড়ে থাকে আর তার ধর্ষিত শরীর পুকুরের জলে ভাসতে থাকে, তারা পৃথিবীর কোন সভ্য কল্পনায় এক দেশের মানুষ হতে পারে না” ।