সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

স্মৃতিচারণ - মধুছন্দা পাল

স্মৃতিচারণ
মধুছন্দা পাল

স্মৃতির ঝাঁপি // ছোটবেলা ১

বিহারের মফস্বল সহরের যৌথ পরিবারে জন্ম আর বেড়ে ওঠা । বাড়িতে অনেক ঘর, বারান্দা,উঠোন,ছাদ অনেক লোকজন, পুরাণো জীর্ণদশাগ্রস্থ অনেক প্রবাসী, ভারতবর্ষ,শনিবারের চিঠি আর কিছু অচল পত্র ,সচিত্র ভারত আর ছোটদের পত্রিকা শিশুসাথি । এই বইগুলো দিয়েই আমার ৮/৯ বছরবয়সে গল্প বই পড়ার শুরু ।

এই সমস্ত কিছুর সঙ্গে ছিল কিছু জন্তু জানোয়ার ।একটা কালিন্দী নামের ভাল্লুক,
চিলিম্পা নামের বাঁদরী আর একটা শেয়াল ,(তার নাম মনে নেই)।কালিন্দী থাকতো রাস্তার উল্টো দিকে সেজজ্যাঠাবাবুর বাড়ীতে । আমার এক দাদা , কাতুদা, শিকারে যেতো মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে । মনে পড়ে জিপ চলতে শুরু করার আগে একবার মুখ তুলে দু’তলার বারান্দার দিকে তাকাত , যেখানে অনেকের সঙ্গে বউদিও শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে । তো কালিন্দীর মা সেবার মারা পড়েছিল আর কালিন্দীকে মায়া বশতঃ নিয়ে এসেছিল কাতুদা । প্রথম প্রথম কি ভীষণ চিৎকার তার । সারা বাড়ী কাঁপিয়ে । কাঁদতো নিশ্চয়ই । তারপর আস্তে আস্তে সবাইকে চিনল । একসময় পূর্ণ বয়স্ক হল । বিরাট চেহারা হল তার । কোনদিন ভয় করেনি । যেন বাড়ীর পোষা কুকুর । সব চাইতে বেশী সখ্য হল আরেক দাদা খোকাদার সঙ্গে । খোকাদা কলেজ থেকে ফিরলেই নখের খচমচ আওয়াজ করতে করতে ছুটে আসতো ।তারপর দুজনের গড়াগড়ি খাওয়া দেখার মত ।খুব যত্ন করতো খোকাদা । লোহার দাঁড়ার চিরুনি দিয়ে কালিন্দীর কর্কশ লোম আচঁড়াত । স্নান করাতো । সকালে চা খাওয়ার সময় কাপ প্লেটের আওয়াজ পেলেই ছুটে আসতো হেলেদুলে । প্লেটে চা ঢেলে দিলে ছুঁচল মুখ দিয়ে চোঁ চোঁ করে খেয়ে নিত । পিঁপড়ের গর্তে সামনে মুখ লাগিয়ে পিঁপড়ে খেত ।

অতি শান্তশিষ্ট স্বভাব বাড়ীর সকলের বন্ধু । একবারই তাকে খেপতে দেখেছিলাম।আমাদের এক দিদির বিয়ে ছিল বাড়ীতে । ক’দিন কালিন্দীকে আটকে রাখা হয়েছিল । বাড়ীতে অনেক বাইরের লোকজন তাই ।তাছাড়া মনোযোগও পায়নি সেরকম ।
বিয়ের দিন বরযাত্রিদের কেউ কেউ খানিক অভদ্রতা করেছিল ।দাদাদের মধ্যে অনেকেই ফুঁসছিল রাগে । পরদিন সকালে আবার কিছু করে থাকবে তারা। কেউ কিছু বোঝার আগেই খোকাদা কালিন্দীকে ছেড়ে দিল না কি খাবার দিতেই গিয়েছিল ও নিজেই বেরিয়ে এলো জানা নেই । ছাড়া পেয়েই পাগলের মত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল কালিন্দী । বরযাত্রীরা তখন ছাদে , গল্পগাছা করছে । শীতের বেলা ।

আমি আর আমার ১৯ দিনের ছোট জ্যাঠতুত বোন কেয়া একটা কারো ছোট বাচ্চাকে আগলাচ্ছি হঠাৎ’ পেছনদিকে খচমচ নখের আওয়াজ পেয়ে দুজনেই মাটিতে গড়িয়ে পড়লাম বাঁচার জন্যে ।আমাদের ওপর দিয়ে একটা কালো বিদ্যুতের মত লাফিয়ে পার হয়ে গেলো কালিন্দী ।আমাদের এতটুকুও আঘাত না দিয়ে । ওর লক্ষ্য তখন ছাদ , যেখানে বাইরের লোকেরা রয়েছে । ছাদে পৌঁছে একটা অদ্ভুত ঘোঁতঘোঁত আওয়াজ করে ছাদে যারা ছিল তাদের তাড়া করলো ও। অতিথিদের অবস্থা শোচনীয় । সারা ছাদ ভাল্লুকের তাড়া খেয়ে খেয়ে দৌড়ে কাহিল তারা । বিশাল ছাদ তার তিনটে সিঁড়ি । অতি কষ্টে একটা সিঁড়ি দিয়ে তাদের নামিয়ে একটা ঘর বন্দি করা হল । কালিন্দীকে শান্ত করতে সেদিন অনেক কসরত করতে হয়েছিল ।সামলেছিল খোকাদা , আর কেউ কাছে যেতে সাহস করেনি ।

রান্নাঘরের সামনে একটা বড়সড় উঠোন ছিল । তার একেবারে শেষ প্রান্তে একটা উঁচু পাড়ের কপিকল লাগানো পাকা কুঁয়ো । ব্যবহার হয়না তখন । মুখটা টিন আর তার ওপর থান ইঁট সাজিয়ে বন্ধ করে রাখা । তার ঠিক পাশে পর পর তিনটে চৌবাচ্চা । প্রথমটা কয়লার ,তারপরেরটা জিওল মাছের আর শেষেরটা মুখ ধোবার । মুখ ধোবার চৌবাচ্চাটা ঢাকা দেওয়া । উঠোনের মাঝখানে একটা বিশাল বড় উনুন । সেই উনুনের গর্তে থাকতো আমাদের শেয়ালটা। ,উনুনটায় বছরে একবার কি দুবার আগুন পড়তো ,একটা বিশাল বড় হাঁড়িতে জল ফুটত তার ওপর । সামনের চোঙদিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জলপড়ে জমত অন্যপাত্রে , distilled water হত বাড়ীতেই । বাড়ীতে বেশকিছু ডাক্তার আর দুটো ডাক্তারখানার চাহিদা মেটাতে ।শেয়াল টা বাড়ীর অন্য কোথাও যেতনা ,মাঝে মাঝে রাতের দিকে গর্ত থেকে বেরিয়ে আকশের দিকে মুখ তুলে হুক্কাহুয়া করেডাকতো । কখন যদি আমাদের পোষা কুকুর উঠোনে গিয়ে পড়তো দুজনে সাঙ্ঘাতিক ঝটাপটি বেঁধে যেত । গোল হয়ে ঘুরত দুজন , তালগোল পাকিয়ে ,সে সময় ওদের আলাদা করা খুব শক্ত ব্যপার ছিল । উনুনের গর্তে বেশ আরামেই থাকতো সে মনে হয়।

বাঁদরী চিলিম্পা বাড়ীর পুরুষদের কাঁধে চড়ে ঘুরতে ভালোবাসত । এক ভাই ফোঁটার দিন অনেক বেলা অবধি ওর কথা কারো মনে পড়েনি মনে হয় । খাওয়া দাওয়াও হয়নি হয়তো। এর মধ্যে দাদা আঙুলে ডগায় একটু চন্দন লাগিয়ে আদর করে ওর কপালে একটা টিপ পরিয়ে দিল । চিলিম্পা কিছুক্ষন দাদার দিকে তাকিয়ে এক চড় মারল দাদার গালে । ছোট ছোট ভাই বোনের সামনে বাঁদরীর চড় খেয়ে দাদা অপ্রস্তুত । চিলিম্পা মরে গেলে দাদা আরেকটা বাঁদরী নিয়ে এসে তার নাম রাখল মধুবালা । তবে ওকে মনে হয় বেশিদিন বাড়ীতে রাখা হয়নি ওর কথা বেশী মনে পড়েনা ।

বাবা, কাকা, জ্যাঠা, দাদারা ডানপিটে ছিল কমবেশি প্রায় সবাই । শ্মশান থেকে চোয়াল শুদ্ধু মানুষের মাথার খুলি এনে দুতলার কলঘরের জানলায় রাখা ছিল ।তার আবার চোখে ব্যটারি দিয়ে লাল আলো লাগানো । এটা করা হয়ে ছিল কোন এক জামাইবাবুকে ভয় দেখানর জন্যে । কাজ সারা হয়ে গেলেও ওটা ঐখানেই থেকে গিয়েছিল ,আমরা অভ্যস্ত ছিলাম কিছু মনে হতোনা। অবশ্য আলো আর তখন জ্বলতনা ।তবে এক সময় এই মড়ার মাথার নিয়ে কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল বলে শোনা যায়।

সাপ পুষত বাবারা । বাবাকে বিয়ের আগে দেখতে এসছিলেন আমার মামাবাবু আর রাঙা মেশোমশাই । আমার বাবা গলায় সাপ ঝুলিয়ে তাঁদের দেখা দিয়েছিলেন বলে শুনেছি । দেখে তাঁ দের যে কি অবস্থা হয়েছিল অনুমান করা যায়।

এক সময় বাইরের বড় চৌবাচ্চায় ঘড়িয়াল পোষা হয়েছিল ।মারা যাবার পর কাঁচের লম্বা বাক্সে আমরা chemical এ ওদের ভেজানো অবস্থায় দেখেছি । সাপও দেখেছি ঐ ভাবে। শুনেছি একবার মাটীর হাঁড়ীতে করে কিছু কাঁকড়া বিছে সংগ্রহ করছিল ন’জ্যঠাবাবু । আমারা অবশ্য বলতাম ন’কা । জ্যাঠা বলার লোক কম ।বেশীর ভাগেরই কাকা । শুনে শুনে আমরাও কাকাই বলতাম । তো সেই কাঁকড়া বিছেশুদ্ধু হাঁড়ি আমাদের ঠাকুমা জ্বলন্ত উনুনে বসিয়ে তাদের ভবলীলা সাঙ্গ করেন ।

পেঁচা ছিল দুটো ।এরা দিনের বেলা আমাদের ডিসপেনসারির সাইনবোর্ডের দুপাশে ঘুমত। একবার Wrapper দিয়ে জড়িয়ে শকুনি ধরার চেষ্টা হয়েছিল শুনেছি ।তবে তাদের গায়ে নাকি ভীষণ পোকা তাই আর তাকে আর বাড়ী অবধি আনা হয়নি ।

তো এইরকম ছিল আমাদের ছোটবেলার জীবন । এখন মনে হয় খুব রোমাঞ্চকর । তখন একদম স্বভাবিক লাগত ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন