সুবোধ খানিক আগে থেকেই এসি মেশিন চালিয়ে গাড়ির ভেতরটা ঠান্ডা করে রাখে । বিনায়ক অফিস ছেড়ে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে ফাইল আর ল্যাপটপ নিয়ে এগিয়ে গিয়ে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দাঁড়াল । বিনায়ক মাথাটা একটু হেলিয়ে একটা দরাজ হাসি উপহার দিলেন আজ । একটু অবাক হল সুবোধ । মুখার্জিসাহেবের হাসিমুখ দেখা যায় না । ততক্ষণে আয়েসে শরীর ছেড়ে বসেছেন বিনায়ক । এসির ঠান্ডা হাওয়া মনটা আরো ঠান্ডা করে দিল । আহ । দীর্ঘ সাত বছরের লড়াই ।
বুকপকেটেই আছে চিঠিটা । বন্ধ খাম । এখনো খোলেন নি । নন্দিনীকে খুলতে বলবেন । নন্দিনী অবশ্য এসব নিয়ে তেমন চাপে থাকে না । বরং মিসেস গান্ধী বা মিসেস শর্মা কেমন স্বামীদের অফিস, প্রোমোশন, বিদেশ-ট্যুরের গল্প করেন, তা নিয়ে বিনায়কের সঙ্গে গোপনে হাসিঠাট্টা করে । ক’দিন আগে মিসেস বাসুর কথা বলছিল, ‘কাল পার্টিতে মিসেস নায়েকের সঙ্গে মিসেস বাসু কেমন আঠার মত লেগে ছিলেন দেখেছ ? আমি ভাবছি, কি না জানি গল্প করছেন । ওমা শুনি, বলছেন নায়েকসাহেবের বিজনেস ট্যুর বেশ ভালো হল এবার, না ? পঁচিশকোটি টাকার অর্ডারটা পেয়েছেন শুনলাম।‘ খুব হেসেছিলেন দুজনেই । নায়েক আর বাসু হয়ত জানেনই না, তাঁদের অর্ধাঙ্গিনীদের আড্ডাতেও কেমন অফিসের অর্ডার, সাপ্লায়ার, বিজনেস ডীল মিশে থাকে ।
মিসেস বাসু নন্দিনীকে একদিন বলেছেন, ‘মিস্টার মুখার্জির চাকরি, আবার আপনার চাকরি । কি করে সামলান সব? এই তো অফিসে সাবস্টাফ রিক্রুটমেন্ট নিয়ে কদিন রাতের ঘুম নেই আমার ।‘ বাইরের কেউ শুনলে মনে করবে, মিসেস বাসুই কাজটার দায়িত্বে আছেন । সুবিমল বাসুর কাজের দায়িত্ব এইভাবেই ভাগ করে নেন মিসেস দীপা বাসু ।
বাসু একদিন বলছিলেন, ‘বুঝলেন মুখার্জি, বাড়িটা ফার্নেস হয়ে আছে । এবারেও যদি চিফ ম্যানেজারের প্রোমোশনটা না পাই, বউয়ের কাছে প্রেস্টিজ থাকবে না । এক একসময় কি বলতে ইচ্ছে করে জানেন? বেশ তো সারাদিন আরামে খাচ্ছদাচ্ছ, বেড়াচ্ছ । দুপুরে বিউটিস্লিপ, বিকেলে জিম, সন্ধেবেলা পার্টি, উইকেন্ডে ক্লাব । আর কত চাও বাবা? অশান্তির ভয়ে বলতে পারি না ।‘
উদয় ঘোষাল প্রায়ই বলেন, ‘পুরুষমানুষের দুঃখ কেউ বোঝে না । অমুক কি করে তোমার আগে প্রোমোশন পেল, তমুক কি করে কোম্পানির গাড়ি পেল, ক-বাবুকে অফিস থেকে মোবাইল ল্যাপটপ সব দিল, খ-বাবু প্রতিমাসে ট্যুরে যাচ্ছে, গ-বাবুর বউ অফিসের মহিলা সমিতির সেক্রেটারি হল । তোমাকে কেন কিছু দেয় না অফিস? মাথা গরম হয়ে যায়, জানেন?’
* * * *
না, বিনায়ক সত্যিই ভাগ্যবান । নন্দিনী কোনদিন এমন বলে না । বরং অফিস নিয়ে চাপের সময় নন্দিনীর একটা কথা, ‘জীবনের জন্যেই জীবিকা, জীবিকার জন্যে জীবন নয়’, বিনায়ককে খুব শক্তি দেয় । তবু … চাকরি করতে এসে ত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে থাকা যায়? নিজের প্রাপ্য সম্মানটুকুর লড়াই ছেড়ে দিলে হয়?
ম্যানেজমেন্টের পড়ায় ম্যাসল’জ হায়ারার্কি নীড খুব মনে ধরেছিল । আব্রাহাম ম্যাসল-র হায়ারার্কি মডেল । একটা পিরামিড । জীবনযাপনে প্রয়োজনের শ্রেণীবিভাগের সূত্র । পিরামিডে পরপর পাঁচ ধাপ । সবচেয়ে নিচের ধাপ ‘সার্ভাইভাল’; বেঁচে থাকার জন্য অবশ্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা । খাদ্য, বস্ত্র .. শারীরিক সব চাহিদা । নিতান্ত জৈব চাহিদাগুলো না মিটলে পরের ধাপে পৌঁছনো হয় না ।
দুই, ‘সেফটি’; সুরক্ষা । আশ্রয় । মাথার ওপর ছাদ ।
তিন, ‘সোশাল’; সামাজিক অবস্থান । যে মুহুর্তে প্রথম দুটি চাহিদা পূরণ হয়, সামাজিক অবস্থান এবং সামাজিক স্বীকৃতির প্রয়োজন অনুভব করে মানুষ । স্বজনবন্ধুর সঙ্গে, প্রতিবেশীর সঙ্গে মিলেমিশেই মানুষ ভালো থাকে । একা একা কেউ ভালো থাকে না ।
চার, ‘এস্টিম’; শ্রদ্ধা । এই চাহিদা খুব গভীর এবং সুক্ষ্ম অভাববোধ থেকে তৈরি হয় । আশপাশের মানুষের শ্রদ্ধা, সম্মান । তীব্র আত্মসম্মানবোধ । স্বীকৃতি চাইই চাই ।
বিনায়কের এই প্রোমোশনটা যেমন । হায়ারার্কি নীডের মডেল মেনেই এই প্রয়োজন । এই চাহিদার তীব্রতায় অনেক নির্ঘুম রাত কেটেছে ল্যাপটপ আর কাজ নিয়ে । কাজের স্বীকৃতি চাই । পরিশ্রমের, মেধার স্বীকৃতি চাই ।
সবচেয়ে ওপরের ধাপে ‘সেলফ-আকচুয়ালাইজেশন’; মোক্ষ ।
নন্দিনী বলেন, যেহেতু নিচের চারধাপ পার না হয়ে মোক্ষলাভের কথা নেই, তাই কেরিয়ারের সিঁড়িটায় বড্ড চড়াই । বিনায়ক তা মনে করেন না । লড়াইটা আছে বলেই না জীবনের তাপ টের পাওয়া যায় !
* * * *
বাড়িতে ঢোকার জন্যে দুজনের কাছে দুটো চাবি আছে । রোজ নিজের চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢোকেন বিনায়ক । সন্ধেবেলা নন্দিনী টুপুরকে নিয়ে বসে ।স্কুলের পড়া হোমটাস্ক প্রোজেক্ট । এসময় নিজের কোনো কাজে নন্দিনীকে না ডাকাই ভালো ।
আজ কলিংবেলে হাত রাখলেন । প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেল । মুখবন্ধ খামটা বাড়িয়ে ধরলেন । হাসলেন । নন্দিনীর মুখেও হাসি, ‘হয়ে গেল ?’
ভেতরের ঘর থেকে দৌড়ে এসেছে টুপুর । আস্তে হেঁটে আসা টুপুরের ধাতে নেই । চোদ্দ বছর বয়স হল, এখনো ছেলেমানুষ খুব । দৌড়ে এসে ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়েছে, ‘কি হয়ে গেল ? প্রোমোশনটা?’
হেসে মাথা নাড়লেন বিনায়ক ।
‘ওয়াও । পার্টি চাই বাবা । কনগ্র্যাটস ।‘ শেকহ্যান্ডের ভঙ্গিতে হাত বাড়াল টুপুর ।
খুব মজা লাগে এসব সময় । ছোট্ট টুপুর, লাল কম্বলের ঢাকনি থেকে বেরিয়ে আসা টুকটুকে ঘুমন্ত মুখের টুপুর । বড় হয়ে গেল মেয়েটা! দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন টুপুরের হাত, ’আজই পার্টি । চলো । সেইজন্যেই তো তাড়াতাড়ি বাড়ি এসেছি ।‘
‘যাবে ? রেডি হই ? ও মাম, রেডি হই ?’
‘আজ থাক । উইকেন্ডে যাব নাহয় ।‘
এতক্ষণে নন্দিনীর দিকে ভালো করে তাকালেন বিনায়ক । কি হয়েছে ? এত নিষ্প্রাণ কেন নন্দিনী ?
‘চলো না মাম । উইকেন্ডে আবার অন্য প্রোগ্রাম হয়ে যাবে বাবার ।‘ টুপুর জোর করতে লাগলো ।
‘আচ্ছা । যাও, রেডি হয়ে নাও’, বিনায়কের দিকে ফিরলেন নন্দিনী, ‘তুমিও চেঞ্জ করবে তো? করে নাও, আমি চা আনছি ।‘ ধীর পায়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল ।
কি হল নন্দিনীর ? শরীর খারাপ ? এমন স্বভাব নন্দিনীর, শরীর খারাপ হলেও কাউকে জানাবে না । কম খাটুনি পড়ে ? অফিস থেকে ফিরেই টুপুরকে নিয়ে আজ গানের ক্লাস, কাল নাচের ক্লাস, পরশু আঁকার ক্লাস । একদিন সাঁতার, একদিন টেনিস । আবার সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে রোজ নতুন নতুন জলখাবার করে খাওয়ানো, তারপর পড়াতে বসা ।
টুপুরের জন্যে বিনায়কের একটাই কাজ । সকালে টুপুরকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া । ব্যস । স্কুল থেকে বাড়ি নিয়ে আসার কাজটা ইলা করে । সকালে নন্দিনী অফিস বেরোবার আগেই ইলা আসে । সারাদিন টুপুরকে নিয়ে নিশ্চিন্ত । অফিসের পর বাকি সময়টা নন্দিনী টুপুরকে জড়িয়ে থাকে ।
* * * *
টুপুরের চারবছর বয়স পযর্ন্ত কোন অসুবিধে হয় নি । মা ছিলেন । দশহাতে আগলে রেখেছিলেন টুপুরকে । নিশ্চিন্তে চাকরি করেছেন নন্দিনী-বিনায়ক । তিনদিনের জ্বরে মা অচিনদেশে পাড়ি দেবার পর নন্দিনী বলেছিল, ‘চাকরি ছেড়ে দিই । টুপুর একা থাকবে কি করে?’
ভালো কাজের লোক পাওয়া যাচ্ছিল না । বয়স্কা মহিলা হলে ভালো । একটাও ভালো লোক পাওয়া যাচ্ছিল না । কেউ নেশা করে, কেউ চুরি করে । কেউ বাড়ির দরজায় বাইরে থেকে তালা দিয়ে টুপুরকে একলা বাড়িতে রেখে আশেপাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে আড্ডা দেয় । শেষপযর্ন্ত এক বিধবা মহিলাকে পাওয়া গেল । তিনকূলে কেউ নেই ।
‘তুমি সারাজীবন আমাদের বাড়ি থেকো মাসি ।’ নন্দিনী বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছিল । বেশ ছিল মহিলা, রান্নার হাতটিও ভালো ছিল, বিনায়ক-নন্দিনীকে ‘ছেলে’ আর ‘বউ’ ডাকে আপন হয়েছিল । টুপুরও ‘দিদা’ বলতে পাগল । নিজের সংসার ছিল না, এ সংসারে বেশ অভিভাবকের মত ছিল পারুলমাসি ।
চারমাস নিশ্চিন্তে কাটার পর নন্দিনী যেদিন বলল, ‘পারুলমাসির টুপুরের ওপর খুব মায়া পড়ে গেছে’, তার ঠিক পরের দিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই টুপুর নালিশ করল, ‘দিদা মেরেছে ।’
খেলনার ঝুড়ি উলটে পড়ে আছে, ঘরময় ছড়ানো গাড়ি, খেলনাট্রেন, পুতুল, টেডিবিয়ার ।
নরম ফরসা গালে আঙুলের লাল দাগ, চোখের জলে মাখামাখি মুখ, নন্দিনীও কেঁদেই ফেলেছিলেন, ‘কেন মেরেছ ওকে, মাসি ? এতটুকু মেয়ে, মারতে পারলে তুমি ? কি এমন করেছে টুপুর ?’
‘দস্যি মেয়ে । সারা দুপুর একটু ঘুমোতে দেয় না । একটু চোখ লেগেছে, আর অমনি সারা রাজ্যের নোংরা এনে জড়ো করেছে । তোমাকে তো সারাদিন তো রাখতে হয় না, এখন এসে তাই সোহাগ দেখাচ্ছ ।’ পারুলমাসির এ রূপ আগে দেখেন নি নন্দিনী ।
খুব রাগ হয়েছিল নন্দিনীরও, ‘ওর জন্যেই রাখা হয়েছে তোমায় । আর কোনদিন ওকে মারবে না তুমি ।‘
‘আমার টাকাপয়সা দিয়ে দাও, আমি এবাড়িতে আর কাজ করব নি ।’ এক কথায় কাজ ছেড়ে চলে গেল । পরে খবর পেয়েছিলেন, পাশের বাড়ির উদিত ঘোষের মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কাজে লেগেছে সে । পাড়ার লোক যেন কাজের লোক ভাঙিয়ে নেবার জন্যে তক্কে তক্কে থাকে ।
আবার যত দিন লোক না পাওয়া যায়, কি অশান্তি ।
রাস্তায় অচেনা কাজের মেয়ে দেখলেই ‘আমার বাড়ি কাজ করবে ?’
অফিসের পিওনদের ডেকে ডেকে বলা । দুধ আনতে গিয়ে ডিপোর ছেলেটাকে বলা । বাজারে দোকানে রিকশাস্ট্যান্ডে মিস্টি মিস্টি হেসে ‘একটা কাজের লোক দেখে দাও না গো’ .. ‘একটা ভালো লোক দিতে পারো ?’
শেষ অবধি পাওয়া গেল ইলাকে ।
সব সময় থাকবে না । ওরও বাড়িতে বাচ্চা আছে । পাঁচ পাঁচটা ছেলেমেয়ে । বড় তিন ছেলে স্কুলে যায় । তারপর মেয়ে । কোলের ছেলে মাত্র আট মাস । মেয়েটা টুপুরেরই বয়সী । বর রাজমিস্ত্রীর কাজ করত, ভারা থেকে পড়ে গিয়ে একটা পা কেটে বাদ দিতে হয়েছে । ইলাকে তাই কাজে বেরোতে হয়েছে ।
আট মাসের কোলের ছেলে, তাই চব্বিশ ঘন্টার জন্যে থাকতে পারবে না । সকালে আসবে, সারাদিন থাকবে । শান্ত নম্র শীর্ণ রুগ্ন চেহারা, কালোর ওপর মুখখানা ভারি সুন্দর, মায়া মায়া দুটি চোখ মেলে বলেছিল, ‘আপনি কিছু ভাববেন না দিদি, আমি সব সামলে নেব ।‘
ওইটুকু কোলের ছেলে ছেড়ে থাকতে পারবে ? রোজই হয়ত কামাই করবে । সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না নন্দিনী ।
ইলা বলল, ‘আমার শ্বশুরবাবা আছেন বাড়িতে, সুবল-মুন্নী ওঁর কাছে থাকবে । ওদের বাবাও তো ঘরেই থাকে সারাদিন । আমি পারব । কাজটা আমার খুব দরকার দিদি ।‘
বিনায়কও বললেন, ‘ওকেই রাখো মণি । সারাদিন থাকছে তো । তাতেই হবে ।‘
ইলার মত লোক পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের কথা । যত দিন গেছে, ইলা এ সংসারে আপন হয়ে উঠেছে । টুপুরকে জড়িয়ে রেখেছে তো বটেই, সংসারকেও দশ হাতে জোগান দিয়েছে ।
ঠিকে কাজের মাসি আসে নি । বাসনমাজা, ঘরমোছা করবে কে? ইলা ।
রান্নার জন্য জোগাড় দেওয়া, কুটনো কোটা, মিক্সিতে দোসা ইডলির জন্যে চাল-ডাল বেটে দেওয়া করবে কে? ইলা ।
ছুটির দিনে দশবার চা কফি কে করে দেবে? ইলা ।
রোজ সমস্ত আসবাবপত্র মুছে রাখা, ছুটে ছুটে কাজ করা, কে করবে? ইলা ।
টুপুরকে ‘মামণি’ বলে ডাকে ইলা । খুব মায়ায় আদরে সে ডাক । ছুটির দিন তেলমালিশ করে নিমপাতা জলে দিয়ে কুসুম কুসুম জলে চান করানো । সর্দিকাশি হলে তুলসিপাতা-মধু খাওয়ানো । বুকে গরম তেলমালিশ করে দেওয়া । নন্দিনী নিজেও এত পারত না ।
বিনায়ক খেয়াল করেছেন, ‘বস্তীতে থাকা মানুষদের মত নয় ইলা, দেখেছ মণি ? ও টুপুরকে কক্ষণো তুই করে কথা বলে না । এত ভদ্র মেয়েটা, কেন যে কাজের লোক হল ! বাড়ির মধ্যে দশ হাতে সংসার করবে, এইটাতেই ঠিক ঠিক মানায় ওকে, না ?’
শুধু টুপুরকে কেন, নিজের ছেলেমেয়েদেরও ইলা ‘তুমি’ করে কথা বলে । ভালো সংস্কার । লেখাপড়া শিখেও এইটা শেখা হয় না সবার । বাজার করতে গিয়ে সব্জীবিক্রেতাকে, রিক্সাচালককে, বাড়ির কাজের লোককে ‘তুই’ ‘তুই’ করে কথা বলেন যে সব তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ, তাঁদের ডেকে ডেকে ইলাকে দেখাতে ইচ্ছে হয় নন্দিনীর ।বস্তীতে থাকা একটি মেয়ের এই মানসিক উত্তরণের এই ঘটনা সত্যি আলো দেখায় ।
* * * *
এমনি করে দশ বছর কেটেছে ।
টুপুর এখন চোদ্দ । ইলার মুন্নীও তাই । বড় তিন ছেলে কাজ করছে । কেউই স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে নি । আগ্রহই নেই । কাজ করছে ফার্নিচারের দোকানে, মুরগী কাটার দোকানে, কেবল টিভির কাজে । ওদের গোটা পরিবারের সঙ্গে মায়ার জড়িয়েছে নন্দিনীও । মুন্নী সুবল স্কুলে পড়ছে, নন্দিনীর জন্যেই । এই নিয়ে ইলার গোটা পরিবার কৃতজ্ঞতায় জড়িয়েছে । মনের কোণে লুকোনো নেই, নন্দিনী জানে এই কৃতজ্ঞতা প্রাপ্য নয় তার ।
টুপুর তখন ক্লাস সিক্স । হঠাত আসা বন্ধ করেছিল ইলা । পাঁচদিন আসে নি, কোনো খবরও দেয় নি । ‘আবার লোক খুঁজতে হবে মনে হচ্ছে’, বিনায়ক বলেছিলেন ।
আবার নতুন লোক ! আবার নতুন একজনের সঙ্গে টুপুরের মানিয়ে চলা । ইলার মত এত ভালো একটা কাজের লোক আর কি পাওয়া যাবে ?
অনেক ভেবে, বিনায়কের সঙ্গে পরামর্শ করে ইলাদের বস্তীতে গিয়েছিল নন্দিনী ।
‘আমি আর কাজ করতে পারব না দিদি’, ইলার শরীর শীর্ণতর, গালে চোখের জলের দাগ । মুন্নী সুবল সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়, বুড়ো শ্বশুরবাবা চোখে দেখেন না আজকাল । সেদিন গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচেছে সুবল ।
‘সারাদিন থাকা হবে না আমার । সুবল মুন্নীকে কে দেখবে ? মামণির জন্যে মনখারাপ করছে দিদি । কিন্তু আপনি চিন্তা করবেন না, আমার বোনের মেয়েকে খবর পাঠিয়েছি, মামণির কোনো অসুবিধে হবে না ।‘
ইলার পরনের জীর্ণ শাড়ি, খড়িওঠা হাত, মাটির দেওয়াল, মলিন বিছানার দিকে চেয়ে নন্দিনীর বুকের মধ্যে ব্যথা করেছিল সেদিন । ইলা কাজ না করলে ওদের চলবে কি করে ?
ইলাকে ছাড়া নন্দিনীরই বা চলবে কি করে ?
‘মুন্নী সুবলকে আমি স্কুলে ভর্তি করে দিই ? তাহলে আর সারাদিন ওদের দেখার ভাবনা থাকবে না । তুমি ভেবো না, দুজনের পড়ার সব খরচ আমার ।‘ আবেগতাড়িতা নন্দিনী বলেছিল ।
দু’হাত জোড় করে ইলা আর তার প্রতিবন্ধী স্বামী । চোখ বুজলেই ছবিটা ভেসে ওঠে । ইলাদের বস্তীতে সবাই ধন্যি ধন্যি করে । এমন কাজের বাড়ি পাওয়া ইলার ভাগ্যি, সে কথা বলে ।
শুধু বিনায়ক –নন্দিনী জানেন, ইলাকে কাজ ছাড়তে না দেওয়ার জন্যে এটুকু অর্থমূল্য কিছুই না ।
* * * *
‘কি হয়েছে ? আমায় বলবে না মণি ?’
‘আমি কি করব কিছু বুঝতে পারছি না গো’, নন্দিনী দু’হাতে মুখ ঢাকলেন, ‘এত অসহায় লাগছে আমার । খুব অপরাধী লাগছে । কি যে করি আমি ! ওহ ভগবান !’
নন্দিনীকে এত বিপযর্স্ত আগে কোনদিন দেখেন নি বিনায়ক । মায়ের অসুখ, ভাইয়ের চাকরি, বোনের বিয়ে, বিনায়কের মায়ের সব দরকারে নন্দিনী একাহাতে সামলে নিয়েছে । ওর নিজের বাবা মারা গেলেন যেদিন, শক্তহাতে মাকে জড়িয়ে ছিল । নন্দিনী শক্তি । নন্দিনী সব সময় শান্ত । স্থির ।
সেই নন্দিনী এত ভেঙে পড়েছে ! বিনায়কের কেমন ভয় ভয় করল । টুপুরকে নিয়ে কিছু হল নাকি!
ক’দিন আগেই নন্দিনী বলেছে, যত ব্ল্যাঙ্ককল আসে ফোনে । টুপুর ব্যলকনিতে দাঁড়ালে কেউ কেউ রাস্তা থেকে ইশারা করে । ইলাও বলেছে, স্কুল থেকে ফেরার পথে মোটরবাইক নিয়ে ইচ্ছে করে টুপুরের গা ঘেঁষে যায় দুটো ছেলে । অফিস গিয়েও চিন্তায় থাকে নন্দিনী । মেয়ে বড় হচ্ছে, আগলে রাখতে হয় বেশি করে । ইলাকে বলা আছে, অচেনা কাউকে দরজা না খোলার কথা । স্কুলবাস আসার অন্তত দশমিনিট আগে থেকে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকার কথা । টুপুরকে নিয়ে বাড়ি ফিরেই নন্দিনীকে ফোন করার কথা । ব্ল্যাঙ্ককল এলে কোনো রাগারাগি না করে শান্ত হয়ে ফোন নামিয়ে রাখার কথা ।
নিশ্চয় এই নিয়েই কিছু হয়েছে । বিনায়কের বুকের মধ্যে শিরশির করে উঠল ।
‘কি হয়েছে মণি ? আমায় বলো ।‘
‘মুন্নী । মুন্নীর সবর্নাশ হয়ে গেছে ।‘
মুন্নী ! কে মুন্নী ! কি সবর্নাশ হয়েছে তার ?
‘আমার মেয়েকে সবর্ক্ষণ আগলে রেখেছে ইলা, ওকে আমি কি করে মুখ দেখাব ?’
আরো গুলিয়ে গেল । ইলা এর মধ্যে এল কোথা থেকে? ইলার কাছে নন্দিনীর মুখ দেখাবার কথাই বা উঠছে কেন? চাপা কান্নায় ফুলে ফুলে উঠছে নন্দিনীর পিঠ । পাশের ঘরে টুপুরের কানে না যায় তাই কান্নার আওয়াজ চেপে রাখার চেষ্টায় মুখে হাত চাপা ।
‘মুন্নী, ইলার মেয়ে । ছোটবেলায় কত আমাদের বাড়ি আসত, টুপুরের সঙ্গে খেলা করত, মনে নেই তোমার ?’
* * * *
সত্যিই মনে ছিল না । এখন মনে পড়ল । হাঁড়িকড়াই নিয়ে রান্না রান্না খেলা .. টুপুর ‘মা’ হয়ে রান্না করছে, মুন্নী ‘ইলা’ হয়ে রান্নার জোগাড় দিচ্ছে । গাছের পাতা কুচিকুচি করে কাটা, ছোট্ট গ্যাসওভেনে ছোট্ট প্রেশার কুকার, ছোট্ট থালায় আটার গোল্লা ।
হাতে চকপেন্সিল, চশমা চোখে ‘টিচার’ টুপুর, খাতা পেন্সিল নিয়ে ‘স্টুডেন্ট’ মুন্নী ।
কানে খেলনা-স্টেথো হাতে খেলনা-থার্মোমিটার ‘ডাক্তার’ টুপুর । বিছানায় শুয়ে ‘পেশেন্ট’ মুন্নী । জোর করে ইঞ্জেকশন দেবেই টুপুর । আর মুন্নী কেঁদে কেঁদে নন্দিনীর কাছে নালিশ করছে, ‘মাসি, টুপুর আমায় ব্যথা দিচ্ছে ।‘ ইলা বলছে, ‘দেখছেন দিদি, কেমন বুদ্ধি । জানে, মামণিকে আমি বকব না, তাই আপনার কাছে নালিশ করছে ।‘
নন্দিনীর মা এসেছিলেন একবার, বিরক্ত হয়েছিলেন । ‘কাজের লোকের মেয়ের সঙ্গে টুপুরের এত খেলা কিসের, মণি?’
‘চুপ চুপ’, নন্দিনী মায়ের মুখে হাত রেখেছিলেন, ‘ইলা শুনতে পাবে । মুন্নী খুব ভালো মেয়ে, কাজের লোকের মেয়ে তো কি হয়েছে ? বাচ্চারা ওসব বোঝে না ।‘
বিনায়কেরও তাই মত । শিশুমনে শ্রেণীসচেতনতা না থাকাই ভালো ।
মুন্নীও স্কুলে পড়ছে তখন, দিব্যি স্কুলের গল্প করত টুপুরের সঙ্গে । ছুটির দিন হলেই এবাড়িতে চলে আসত ।
কবে থেকে যেন আসা বন্ধ করেছিল মুন্নী । ইলা বললেও আসতে চাইত না । টুপুরও আর মুন্নীর কথা বলত না । নিজে থেকেই শ্রেণীসচেতন হয়েছে টুপুর-মুন্নী ।
নন্দিনীও ঠিক এই কথাটাই ভাবছিল তখন ।
বারবার বলেছে ইলা, ‘দিদি, আমাকে দিন পনেরো ছুটি দেবেন ? মেয়েটা সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় । সুধীর সেদিন ওকে বড়বাজারের মোড়ে একটা ছেলের সঙ্গে দেখেছে।‘
সুধীর, ইলার বড় ছেলে । কেবল টিভির কাজ করে ।
‘আমি কদিন বাড়িতে থেকে ওকে চোখে চোখে রাখি দিদি । বস্তীর মেয়েগুলো ভালো নয় ।‘
আর একদিন বলেছে, ‘দত্তবাবুরা সারাদিনের লোক খুঁজছে, মুন্নীকে দিয়ে দিই দিদি ? তাহলে আর বাইরে বাইরে ঘোরা হবে না ওর ।‘
প্রবল প্রতিবাদ করেছেন নন্দিনী, ‘না ইলা । মুন্নীকে একটা কাজের মেয়ে কোরো না । ক্লাস এইটে পড়ছে, আর তো দুটো বছর, ম্যাট্রিক পাশ করলেই মুন্নী বদলে যাবে । ও বুঝবে, ও বস্তীর অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা ।‘
‘তাহলে আমি কদিন বাড়িতে থেকে ওকে চোখে চোখে রাখি দিদি ।‘
বিরক্ত হলেও প্রকাশ করে নি নন্দিনী । ‘বাড়িতে বসে থেকে কদিন মেয়েকে সামলাবে ইলা ? তোমার বর তো সারাদিন বাড়িতে বসে থাকে, ছেলে মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিতে পারে না ? মেয়েকে চোখে চোখে রাখতে পারে না ?’
‘ওর কথা শোনে না দিদি । সে তো জানতেই পারে না । মুন্নী বাপকে বলে, স্কুলে যাচ্ছি । স্কুলে না গিয়ে ঘুরে যে বেড়াচ্ছে তা সে বুঝবে কি করে ? আমার যে কি জ্বালা দিদি ।‘
‘তাহলে সুধীরকে বলো । বসন্তকে বলো । বোনের প্রতি ওদেরও তো দায়িত্ব আছে । তুমি একা কতদিক সামলাবে?’
মনের কাছে গোপন নেই, ইলা ছুটি নিলে যে নন্দিনীর সংসার অচল । টুপুরকে সারাদিন আগলাবে কে ? মেয়ে বড় হচ্ছে, এখন অতিরিক্ত সাবধান হতেই হয় । পড়া, প্রোজেক্ট, টুপুরের নাচের ক্লাস, গানের ক্লাস, সাঁতার । কতরকম ভাবনা । সেইসঙ্গে নিজের অফিস । বাপের বাড়ি । বিনায়কের অফিসের নানা টেনশন । ইলার সমস্যা নিয়ে ভাবার সময় কই ?
বরং মনে মনে স্বস্তি, ভাগ্যিস ইলা আছে । ভাগ্যিস ইলা কামাই করে না !
* * * *
একদিন ইলা বলেছে, ‘মুন্নীকে সেলাইস্কুলে ভর্তি করে দিই দিদি ? স্কুল থেকে ফিরে সময়টা একলা থাকে, তখন বস্তীর মেয়েগুলোর সঙ্গে মেশে । মামণিও তো স্কুলের পর কত কিছু শেখে ।’
বিনায়ক বিরক্ত হয়েছেন, ‘ইলার চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে মণি । খাবার জোগাড় নেই, শখ বাড়ছে।‘
নন্দিনীরও মনে হয়েছে, টুপুরকে এত ভালোবাসে ইলা, তবু টুপুরের নাচ-গান-সাঁতার নিয়ে মনে মনে নিজের মেয়েকে নিয়ে প্রতিযোগিতা করছে নাকি ! আরো বিরক্ত হয়েছে, যখন শুনেছে, সেলাইস্কুলে কাটিং এমব্রয়ডারী নয়, সফট-টয় বানানো শিখছে মুন্নী । পাশের ফ্ল্যাটের বাবলিবৌদির মেয়ে শেখে, বাবলিবৌদি একদিন বলছিলেন, ‘কি খরচ, কি খরচ । এক একটা পুতুল তৈরি হয়, তিনশ’ টাকা মিটার কাপড়, নরম তুলো, সিল্কের সুতো ।‘
ইলাকে বলেছিল নন্দিনী, ‘সফট-টয় না শিখে মুন্নীকে সেলাই শেখালে না কেন ? শাড়ির ফলস লাগানো, ব্লাউজ পেটিকোট তৈরি করা, বাচ্চাদের ফ্রক তৈরি করা, সালোয়ার কামিজ বানানো শিখুক । আমি তোমায় ইনস্টলমেন্টে একটা সেলাই মেশিন কিনে দেব নাহয় ।‘
ইলা গম্ভীর হয়ে জবাব দিয়েছে, ‘মেয়ের শখ দিদি । আমার ছেলেরা খরচ দেবে ।‘
ইলা বুঝি ভাবল, খরচের ভয়ে নন্দিনী কথাটা বলেছে । নাকি বাবলিবৌদির মেয়ে আর মুন্নীকে একরকম দেখা হল না কেন, সে নিয়ে অভিমান । ক’দিন মুখ গম্ভীর করে কাজ করেছে ইলা । নন্দিনীই সেধে মান ভাঙিয়েছে । ইলা ছাড়া সংসার অচল । পুরোনো সিল্কের শাড়ি দিয়েছে ইলাকে । টুপুরের সোয়েটার দিয়েছে মুন্নীর জন্যে । সুবলের জন্যে পুরোনো জিনসের জ্যাকেট ।
অফিস, সংসার নিয়ে ব্যস্ত নন্দিনী বেশ কিছুদিন ইলার সংসারের খবর নিতে পারে নি । অফিসফেরত পাড়ার মোড়ের দোকানটায় টুকিটাকি কেনাকাটা করতে ঢুকেছিল, মুন্নীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল । পরনে লাল সালোয়ার কামিজ, খুব হেসে হেসে গল্প করছিল দোকানের ছেলেটার সঙ্গে, নন্দিনীকে দেখে আড়ষ্ট ।
ভারি সুন্দর হয়েছে তো মেয়েটা । ‘পড়াশোনা ঠিক হচ্ছে তো মুন্নী ?’হেসে জিজ্ঞেস করল ।
ইলাকেও বলেছিল পরের দিন, ‘কি সুন্দর হয়েছে তোমার মেয়ে । লেখাপড়া শিখলে মুখে একটা ছাপ পড়ে । খুব ভালো লাগল আমার ।‘
ইলা মাথা নিচু করে ফেলেছে, ‘মুন্নী আর ইশকুলে যায় না দিদি । পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে ।‘
‘সেকি ! আমায় বলো নি তো !’
‘কিছুতেই কথা শোনে না দিদি । জানি না আমি কি করব । ভালো একটা ছেলে পেলেই বিয়ে দিয়ে দেব ।‘
‘না না । বিয়ে দিয়ে দেবে কি ? মাত্র চোদ্দ বছর বয়স । মুন্নীকে নিয়ে এসো কাল, আমি কথা বলব ।‘
মুন্নী আসে নি । ইলাও মুন্নীর কথা উঠলে অস্বস্তিবোধ করে । মুন্নীর স্কুলের মাইনে হিসেবে টাকাটা নেওয়া বন্ধ করে নি ইলা । নন্দিনীও বলতে পারে নি চক্ষুলজ্জায় । বারবার মুন্নীর স্কুলের কথা তুললে ইলা না ভাবে, নন্দিনী টাকার জন্যেই বলছে । তাই এড়িয়ে থেকেছে ।
অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে ইলারও দেরি হয়ে যায় । তড়িঘড়ি বেরিয়ে যায় । কথা বলার সময়ই বা কই !
তার মধ্যেই দু’চার বার ইলা ছুটির কথা বলেছে । মুন্নীর জন্যে দুশ্চিন্তার কথা বলেছে ।
‘কদিন বাড়িতে থেকে মেয়েটাকে আটকে রাখলে ভালো হত’, বারবার বলেছে । নন্দিনী বিরক্ত হয়েছে । এত করেও কাজের লোকের মন পাওয়া যায় না ।
তিনতলার ফ্ল্যাটের মৌসুমীর জন্মদিনের পার্টিতে এই নিয়ে আলোচনায় নন্দিনী সব গৃহিণীদের সঙ্গে একমত হয়েছে । মৃদুলা বলছিল, ‘এ সংসারে কে যে কাকে শোষণ করে ! এই কাজের লোকদের অত্যাচারে আমরা কম শোষিত হই?’
বাবলিবৌদিও বলেছেন, ‘গরীবের জন্যে দরদে সবাই কাঁদে, শোষণের আসল শিকার তো আমরাই । যতই দাও ওদের, কিছুতেই মন পাবে না । যখন খুশি কামাই, কিছু বলতে গেলেই কাজ ছেড়ে চলে যাবে ।‘
নন্দিনীও ইলার কথা বলেছে । ছুটি না দিলেই কেমন মুখ ভার করে । বাড়িতে চাপা অশান্তি ।
তারপর গত রবিবার থেকে কাজে আসছে না ইলা । আগামী সপ্তাহে পুজোর ছুটি । না বলেকয়ে এ সময় কামাই করা মানে নন্দিনীকেই ছুটি নিয়ে বাড়িতে থাকতে হবে । সবই জানে ইলা । তবু আসে নি ।
দু’দিন রাগ করে থেকে আজ বিকেলে ইলার বস্তীতে গিয়েছিল নন্দিনী ।
‘জানো, কি রকম অসহায়ের মত কাঁদছিল ইলা । মেয়ের এমন বিপদ, অথচ গলা ছেড়ে কাঁদতে পারছে না । জানাজানি হলে পরে মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে না ।‘
যাক, টুপুরের ব্যাপার নয় । বিনায়ক আলগোছে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন ।
হ্যাঁ, ঘটনাটা খারাপ ঠিকই । তবে এ নিয়ে নন্দিনীর এত উতলা হবার মত ব্যাপার কিছু নয় । বিনায়ক একটু বিরক্তই হলেন । আজ এমন একটা আনন্দের দিন, জয়ের দিন । নন্দিনী জানে, এই লড়াইটা বিনায়কের কাছে কতখানি । এই সাফল্য বিনায়কের কতখানি তৃপ্তি । তবু এই সামান্য কারণে নন্দিনী সেটায় বিনায়কের অংশীদার হল না ! সামান্য একটা বস্তীর ঘটনা নিয়ে শোকার্ত হয়ে রইল !
ওরা তো ওইরকমই । যখন তখন যার তার সঙ্গে .. বস্তী টস্তীতে ওইরকমই হয় । কম তো করা হয় নি ওদের জন্যে । বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে । যথেচ্ছ টাকা বিলোনো হয়েছে । ইলার জন্যে বছরে তিনবার শাড়ি, বিছানার পুরোনো চাদর, পুরোনো পর্দা, মেয়েটা তো টুপুরের পুরোনো জামা পরেই বড় হয়ে গেল । আবার কি ! ওদের বাড়ির সমস্যাতেও মাথা ঘামানোর মত সময় নেই বিনায়কের । নন্দিনীরও থাকা উচিত নয় ।
মাইনে দাও, কাজ নাও । এটাই প্রোফেশনাল দুনিয়া । হ্যাঁ, কাজ করতে গেলে ইন্টারপার্সোনাল সম্পর্কটাও জরুরী । সহানুভূতি নিয়ে কথা বলো, মাঝে মাঝে খোঁজখবর নাও, দরকার পড়লে টাকাকড়ি দাও ।
ব্যস, মিটে গেল ।
এর চেয়ে বেশি জড়াবেই বা কেন ? তোমার একটা ডিগনিটি নেই ? একটা সম্মান নেই ? বস্তী টস্তীর কেচ্ছা কেলেঙ্কারিতে জড়ানো মানায় ?
মনে মনেই একচোট ঝগড়া করে ফেললেন বিনায়ক ।
* * * *
‘আমি ইলাকে বেশি করে ধরে রেখেছি, আমার মেয়ের জন্যে, নিজের স্বার্থে । বেশি টাকা দিয়েছি । ওর লোভ বাড়িয়েছি, বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করে, সংসারের বিপদ আপদে টাকা দিয়ে । ইলা নিজের সংসার দেখতে সময় পায়নি । সেই ফাঁকে ওর মেয়ের এত বড় সবর্নাশ হয়ে গেল । কত কাঁদছিল ইলা, জানো ? আমার নিজেকে এত অপরাধী লাগছে ..’
‘শোনো মণি, এত ইমোশনাল না হলেই ভালো । নিজেকে অপরাধী ভাবছই বা কেন ?’
পলকে সিধে হয়ে বসেন নন্দিনী, ‘তুমি এই কথা বলছ ? তুমিই না বলেছিলে, ইলা শ্রীময়ী মাতৃমুর্তি ? ওকে কাজের লোক হিসেবে মানায় না, ঘর সংসারে জড়িয়ে থাকা মানায় ? অভাবে পড়ে কাজ করতে বেরিয়েছে, আমার কাছে কাজ করছে, ওর এত বড় বিপদের দিনে আমি ইমোশনাল হব না ? … তুমি জানো, আমাকে কতবার বলেছে ইলা ? দিদি আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি যাব .. দিদি, মেয়েটাকে চোখে চোখে রাখতে হবে .. দিদি, ক’দিন ছুটি দিন, মেয়েটাকে সামলাতে হবে .. দিদি, আমি কাজ ছেড়ে দিই । বলে নি ? আমরা ছুটি দিয়েছি? আমরা কাজ ছাড়তে দিয়েছি ? আমরা চাইনি । কারণ তাতে আমাদের অসুবিধে । আমি ভুলে গেছি, ইলাও আমারই মত একজন মা । টুপুর আর মুন্নী, এই এক জায়গায় দুজনেই সমান ।‘
‘টুপুরকে এর মধ্যে একদম জড়াবে না’, উত্তেজিত হয়েছেন বিনায়কও, ‘ইট’স হার প্রবলেম । ইলা কেন ঘর আর বার ঠিক ঠিক ব্যালান্স করে চলতে পারে নি ? তুমি আমায় একটা কথা বলো । তুমি তো সবসময় বলো, তুমি আর ইলা একই গোত্রের মানুষ, কারণ তোমাদের দুজনকেই সংসারের প্রয়োজনে ঘর ছেড়ে বাইরে কাজ করতে বেরোতে হয়েছে । তোমার কথা ধরেই প্রশ্ন করি, তোমার সংসারের কোনো অঘটনের জন্যে কি তোমার অফিস দায়ী থাকে?’
বিনায়ক চিরকালই যুক্তিবাদী । নন্দিনী আর কথা বাড়াল না । কিছু কথা থাকেই, যা যুক্তি-বুদ্ধির বাইরে ।
ছোট্ট মুন্নীর হাত ধরে প্রথমদিন এবাড়িতে এসেছিল ইলা । টুপুরের খেলার সঙ্গী মুন্নী । নীল-স্কার্ট সাদা-শার্টের স্কুলড্রেসের মুন্নী । লাল সালোয়ার-কামিজের মুন্নী । ছবির মত ভেসে ওঠে সব ।
হয়ত বিনায়কের কথাটাই ঠিক । ইলা এবাড়িতে কাজ না করলেও ঘটনাটা ঘটতে পারত । পরিবেশটাই ভালো নয় যে । তবু মনখারাপটা কিছুতেই কাটানো হচ্ছে না ।
বারবার বলেছে ইলা, ‘আমাকে কদিন ছুটি দিন দিদি, ছেলেগুলো আজকাল আমাদের বাড়ির বাইরের গাছতলায় বসে সারাদিন আড্ডা দেয়, যদি কোন দিন ঢুকে আসে ?’
তাই তো হল । আজকাল রোজ অফিসে দেরি হচ্ছিল, ইলারও বাড়ি ফিরতে রোজ ছ’টা বেজে যাচ্ছিল । সেই সুযোগ নিয়েই তো বদ ছেলেটা মুন্নীর সবর্নাশ করল ।
সেই দায়টা নন্দিনীর নয় ? বিনায়ক যতই বলুন, নন্দিনীর অপরাধবোধ কাটবে না ।
* * * *
সাত দিন কেটেছে তারপর । ইলা কাজে আসছে না । ছুটি নিয়ে বাড়িতে আছে নন্দিনী । অফিস থেকে বারবার ফোন আসছে ।
‘চাকরিটা ছেড়েই দিই’, আবার বলল নন্দিনী ।
‘এই সামান্য কারণে এত ভালো চাকরি ছাড়ে কেউ ? আমি কয়েকজনকে বলেছি কাজের লোকের কথা । চাকরি ছাড়ার কথা ভেবো না তুমি ।’ বিনায়ক বলে উঠলেন ।
‘আর দু’বছর পর আমি বাইরে পড়তে চলে যাব ।তখন তো আর আমার জন্যে বাড়িতে থাকতে হবে না তোমায় । এইটুকু সময়ের জন্যে তুমি চাকরি ছেড়ে দেবে মাম ? ভেবো না, আমি একলাই থাকতে পারব ‘, টুপুর বলল ।
‘তুমি বরং ঠিকে কাজের মেয়েটাকে বলো, টুপুর স্কুল থেকে ফেরার পর দু’ঘন্টা এবাড়িতে থাকুক । স্কুলবাসের দরকার নেই, সুবোধ আমার গাড়ি নিয়ে টুপুরকে স্কুলে দেওয়া নেওয়া করবে’, বিনায়ক বললেন ।
‘আর ছুটির দিনে ? গরমের, শীতের লম্বা ছুটিতে ? পরীক্ষার সময় ?’
‘সে যা হয় ব্যবস্থা হবে । তোমার মাকে নাহয় সে সময় এনে রেখো । আপাতত এই ব্যবস্থা থাক ।‘
হঠাৎ খেয়াল করল নন্দিনী, ইলার সমস্যাটা নিয়ে এ বাড়িতে আর ভাবনা করছে না কেউ । ইলা কাজে আসবে না, এটাই ভাবনা । ‘আমরা কি মানুষ ?’ তীব্র আক্রোশে বলে উঠল নন্দিনী ।
কেউ শুনতে পেল না অবশ্য । কিন্তু কথাগুলো বুকের মধ্যে ধাক্কা খেয়ে ফিরতে লাগলো ।
ইলা । দশ বছর ধরে মমতায় যত্নে শ্রমে নন্দিনীর সংসারে শ্রী গড়ে তোলা ইলা । মামণি-ডাকে মায়ায় স্নেহে যত্নে টুপুরকে লালন করা ইলা । সেই ইলার এত বড় বিপদের দিনে মুখ ঘুরিয়ে থাকবে নন্দিনী ? যা হোক দূরে দূরে, আমার গায়ে যেন আঁচ না লাগে ?
বস্তী টস্তীর সমস্যার সঙ্গে একটা ডিগনিফায়েড দূরত্ব রাখা উচিত, বিনায়ক বারবার বলেন ।
নিজেদের প্রয়োজনের সময় আমরা ইচ্ছে করে সে দূরত্বের কথা ভুলে যাই । ওদের লোভ দেখাই । বেশি টাকার
লোভ । পুরোনো জামাকাপড়ের ঘুষ দিই । আর কাজ শেষ হলেই ডিগনিফায়েড দূরত্বে সরে আসতেও পারি । এই কি মানুষের সমাজ ? আহা, কি করবে ইলা এখন ? একা একা ?
‘সুধীর বলেছে মুন্নীকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে । ও এসব ঝামেলা নেবে না ।’ ইলা বলেছিল । ‘ওদের বাপ বলছে, ওই ছেলেটার সঙ্গেই মুন্নীর বিয়ে দিয়ে দিতে । কি করে দেব দিদি ? তার একটা বৌ আছে, তিনটে বাচ্চা আছে ।‘
মুন্নী সামনে আসেনি । দাদারা খুব মেরেছে ওকে । ইলা বলছিল, ‘আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে দিদি । আর কাজ করব না আমি । কিসের জন্যে কাজ? কার জন্যে কাজ? মেয়েটাকে নিয়ে আমি গ্রামের বাড়িতে চলে যাব ।‘
ইলার কান্নাভেজা কথাগুলোর প্রতিধ্বনি নন্দিনীর বুকের মধ্যে ।
সত্যিই তো । কিসের জন্যে কাজ ? কার জন্যে কাজ ?
বিনায়ক বলেছেন, ‘তেমন হলে কিছু টাকা দিয়ে দাও । নিজেকে জড়িও না । তোমার নিজের সংসারেও ক্রাইসিস এখন । আর একটা সারাদিনের লোক রাখতে হবে । টুপুর একলা থাকবে বাড়িতে । সেসব নিয়ে ভাবো ।‘
এইরকমই তো করি আমরা । সমাজে অপরাধ ঘটে, তার আঁচ যেন নিজের সংসারে না লাগে । পাশের বাড়িতে কেউ অসহায় হয়ে কাঁদলে জানলা বন্ধ করে নিই । ইলার সমস্যা নিয়েও তাই করাই নিয়ম । তবু কেন বুকের মধ্যে এমন ভার হয়ে আছে ?
একসঙ্গে ম্যানেজমেন্ট পড়েছিলেন দুজনে । বিনায়ক আর নন্দিনী । বিনায়কের সঙ্গে আলাপের সেই সব দিন । একসঙ্গে জীবনের পথে পা বাড়ানো । অনেকদিন পর সেই দিনগুলো মনে পড়ল । ম্যানেজমেন্টের পড়ায় ছিল ম্যাসল-র হায়ারার্কি নীডের কথা । পরপর পাঁচ ধাপ । সার্ভাইভাল, সেফটি, সোশাল, এস্টিম, সেলফ-আকচুয়ালাইজেশন । সবচেয়ে ওপরের ধাপে সেলফ-আকচুয়ালাইজেশন, মোক্ষ ।
জীবনের সবর্ক্ষেত্রে তাই । জীবনের জন্যেই জৈবিক চাহিদা । আর এই নেহাত জৈব প্রয়োজনে সবচেয়ে অবহেলিত হয় মনুষ্যত্ব ।
আহা ইলা । অশিক্ষিত ইলা । জন্মসূত্রে বস্তীতে থাকতে বাধ্য হওয়া ইলা । যে ইলা শ্রীময়ী মাতৃমূর্তি । যার সুন্দর সংসার জড়িয়ে থাকার কথা ছিল । পিরামিডের একধাপ পেরিয়ে আসতে আসতে জীবনের লড়াই শেষ করে ফেলবে ইলা ?
নন্দিনীও কি তাই ? শিক্ষা আর সামাজিক অবস্থানে উন্নত নন্দিনী কি স্বচ্ছন্দে পিরামিডের ধাপগুলো অতিক্রম করে ফেলতে পারবে ? ইলাদের বাদ দিয়ে ?
পিরামিডের সবচেয়ে ওপরের ধাপটা কেমন ? পাহাড় চূড়োর মত ? বড় একটা একলা পাহাড়, তার চারদিকে শুধুই আলো, শুধুই শান্তি । সেইখানে চড়তে গিয়ে আপনা থেকেই খসে পড়ে সব শৃঙ্খল । সেইখানে উঠতে গেলে সবাইকে ভালোবেসে ফেলা হয় । নতুন করে জীবনের মানে বোঝা যায় । জীবন । মানুষের জীবন । জৈব চাহিদার থেকে তা অনেক বড় ।
ম্যানেজমেন্টের পড়ায় ব্যক্তিগত উত্তরণের মন্ত্র । জীবনের নিয়মে একটু অন্যরকম হবে না ?
আনমনে মাথা নাড়ল নন্দিনী । জীবনের নিয়ম হল পরিপার্শ্বকে নিয়ে উত্তরণ । ইলাদের সুরক্ষা সম্পূর্ণ না হলে নন্দিনীদের পিরামিডে চড়ার পথ মসৃণ হবে কি করে ? জৈব প্রয়োজনে ইলার ভূমিকা কম নাকি ?
বিনায়ক যা-ই বলুন, নন্দিনী দায়িত্ব অস্ব্বীকার করবে না । ইলার পাশে দাঁড়াতেই হবে । হাত ধরে তুলে আনতে হবে মুন্নীকে, ইলাকে ।
কোনো অপরাধবোধ আর ক্ষত-বিক্ষত করবে না । নিজেদের বাঁচাতে গিয়ে, নিজের সন্তানের জীবন আলোময় করতে গিয়ে ইলার মত কারো জীবনে আঁধার এনে ফেলার দায় বইতে হবে না । আজই যাবে ইলার কাছে । যা যা করার সব করবে ইলার হাত ধরে, ইলার সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে ।
এবার উঠতে হবে । অনেক কাজ । বাইরের অন্ধকারটা ঘরে ঢুকে পড়ার আগেই সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বেলে নিতে হবে ।