সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১২

গল্প - গাঙ্গেয় অধিবাসী

সঘন গহন রাত্রি





হাতিবাগানের এই রাস্তাটা সন্ধের দিকে বেশ নির্জন।

সবকটা ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলেও না। অহনা একটু পা চালিয়েই হাঁটে এ সময়টা। ভিতরে ভিতরে গা ছমছমও করে বোধহয়।

পূর্ণশ্রী সিনেমা ছাড়িয়েই ডানদিকে গীতবিতান, ঠিক সন্ধে ছ’টায় গানের ক্লাস। সুরমাদি খুব কড়া, দেরি হলে বেশ বকাবকিও করেন। অহনা অবশ্য কোনদিনি লেট করে না। প্র্যাক্টিকাল ক্লাস শেষ হয় সাড়ে পাঁচটায়। ও ঠিক ছটা বাজতে পাঁচেই রুপবানী স্টপে এসে নামে। আর ঠিক ছটায় ক্লাসে ঢোকে। তাছাড়া শনিবারের এই ক্লাসটা ওর মিস করতে ইচ্ছেও করে না।

প্রতিদিনের মতো আজো ছেলেগুলো বসে আছে রকে।

পূর্ণশ্রীর পাশে একটা গ্যারেজ, আর তার লাগোয়া একটা রক। চার-পাঁচটা ছেলে প্রত্যেকদিন এখানে আড্ডা দেয়। অবশ্য প্রত্যেকদিন কিনা অহনা জানেনা, ও তো শুধু শনিবারি আসে।

বখাটে টাইপ চেহারা, গলায় চেন, হাতে বালা, অবশ্য আজ অবদি ওরা কেউ অহনাকে কিছু বলেনি, তবুও ওর যেনো কেমন কেমন লাগে।

একবার আড়চোখে দেখে হন হন করে অহনা ক্লাসে ঢুকে যায়।

আজ সুরমাদি ওই ‘সঘন গহন রাত্রি...’ টা তোলাবেন, আগেরদিনই বলে দিয়েছিলেন। ওটা অহনারি অনুরোধে। কিশোরকুমারের কন্ঠে ঐ গানটা অহনার ফেভারিট।

কি আশ্চর্য্য!! আজ দিদি এসে পৌঁছোন নি। দিদি তো সাধারণতঃ লেট করেননা। অহনা একটু অবাক ই হয়। এখনও কেউ আসেনি। ও স্বরবিতান ওল্টাতে শুরু করে।

আজ আবার আকাশে খুব মেঘ করেছে। একটু একটু বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। বাসেই মায়ের ফোন এসেছিল, ‘আজ কিন্তু দেরি করিস না, বৃষ্টি আসতে পারে’ । হাতঘড়িটা একবার ওল্টায় ও। সওয়া ছটা বাজল।

খুব জোর হাওয়া দিচ্ছে, ঘরের পর্দা উড়ে যাচ্ছে, সোঁদা হাওয়া, কোথাও কি বৃষ্টি নামল? বৃষ্টি অহনার খুব প্রিয়, ও উঠে জানলার কাছে এসে দাঁড়ায়, আচমকা বৃষ্টি-ছাঁটে অহনার সারামুখ ভিজে যায়, আর ঠিক তখনি, বাইরে কোথাও থেকে একটা গানের কলি ভেসে আসে।। কে যেনো গাইছে...”সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবণ ধারা...”।।কোন উদাত্ত পুরুষ কন্ঠ। কেনো কে জানে, অহনার সমস্ত শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়...





আজ সকাল থেকেই শ্রাবণের মনটা ভাল নেই।

খুব ভোরে উঠেই ও মালা কিনে এনে মায়ের ফটোতে লাগিয়েছে, সামনে ধূপ জ্বালিয়েছে।

ফি-বছরি ও এটা করে, কিন্তু মায়ের এই মৃত্যদিনেও দাদা কথা শোনাতে ছাড়েনি। ওর কানে এসেছে, দাদা বৌদিকে বলছে, “চার বছর হয়ে গেলো , এম এ পাস করে বসে আছে, মাতৃভক্ত হনুমানকে একটু বোঝাও , চাল-ডালের দাম, গ্যাসের দাম এখন অনেক বেড়েছে, একজনের পেট চালাতে কম খরচ হয় না”।

গায়ে খুব লাগে, সত্যি এখন গায়ে খুব লাগে। একেকবার ভাবে, গ্রামে ফিরে গিয়ে বাবার সাথে জমি চাষই করবে, চাকরি-বাকরি তো কিছু হবে না। কত জায়গায় কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিল, হোল তো নাই, যে দুটো জায়গায় হোল, সেখানেও তো টাকা চায়, দেড়-দুলক্ষ টাকা কে ধার দেবে ?

ওর আজ খুব বেশী করে মায়ের কথা মনে পড়ছে।

নাথপুরের বাড়িতে ওদের পিছনদিকের উঠোন ছুঁয়ে পাড়বাঁধানো পুকুর, মা সেই উঠোনে তুলসীতলায় পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়েই হারমোনিয়ম নিয়ে বসতেন। পুকুরের অন্যপার থেকে ভেসে আসত হাওয়া, বুনোফুলের গন্ধ, মা হারমোনিয়ম বাজিয়ে গান ধরতেন...“তোমাকেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা...”, বাবা খুব চুপচাপ এসে বসতেন উঠোনে, একটা উঁচু পিঁড়ি নিয়ে, চোখ বন্ধ করে শুনতেন মায়ের গান, সারাদিনের চাষের ধকলটা তাঁর মুখ থেকে এক নিমেষে উধাও হয়ে যেতো। ও গুটিগুটি মায়ের কোলের কাছে গিয়ে বসত। আর দাদা এসে বসত বাবার পিঁড়ির পাশে। আর খানিক গেয়েই মা বলতেন, “ ধর শুবু, আমার সাথে ধর”...আর অমনি ও কচি কচি গলায় ...

আর গান শেষ হলেই মা, দুগাল ধরে চুমু খেতেন...আর বাবাকে বলতেন, “ ঈশ্বর এ ক্ষমতা সকলকে দেননা, শুবুর কি আশ্চর্য্য ক্ষমতা দেখো, একটা গান একবার শুনে হুবহু সুরে গেয়ে দেয়, কে জানে, ঠাকুর কি লিখেছেন ওর কপালে!”

আর কি লিখেছেন!!

বাউন্ডুলে হয়ে গেছে শ্রাবণ।

না, গান শেখার বিলাস ও স্বপ্নেও ভাবেনি, আর দশটা ছেলের মতো শহরে এসে পড়াশুনা করে একটা ভাল চাকরি...ব্যাস!।।এছাড়া আর ও কিছু ভাবতেও পারেনি। বাবা একবার বলেছিলেন...একটা ছেলে শহরে থাকলে, আরেকজন কে তো জমিজমার দেখাশুনা করতে হয়। কিন্তু শ্রাবণ শোনেনি। ও কখনও ভাবতে পারেনি, ও সারাজীবন বাবার মতো চাষবাস করে কাটাবে।

নদীয়ার ইছামতির তীরে এই গ্রাম, নাথপুর। সেখানে দশবিঘা জমির উপরে ওদের দখলদারি। বাবা নিজেও চাষ করতেন, প্রান্তিক চাষীও লাগাতেন।

কিন্তু বারো ক্লাসে পড়ার সময়ই, মায়ের রোগটা ধরা পড়ল। প্রথমে কৃষ্ণনগর, তারপর কলকাতা...হাসপাতাল-বাড়ি করতে করতে কবে যে দশ বিঘা জমি দশ শতকে নেমে এলো, তা আজ আর শ্রাবণ মনেও করতে পারেনা।

এখন বাবা ওই টুকু জমিতে একাই চাষ করেন, আর দাদা যেটুকু টাকা পাঠাতে পারে, তার উপর ভরসা।

মাঝে মাঝে নিজের উপর খুব ঘেন্না হয়। একেবারে অপদার্থ মনে হয় নিজেকে। আর দাদা যখন এইসব বলে, একেকবার মনে হয়, রেলের তলায় গিয়ে গলা দেয়।

আর তখনি মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে।

মৃত্যুর আগেরদিন মায়ের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শেষবারের মতো শ্রাবণের গাল দুটো ধরে বিড়বিড় করেছিলেন মা, আর কেউ বোঝেনি, কিন্তু শ্রাবণ বুঝেছিল মা কি বলছেন। খুব আস্তে আস্তে উনি বলেছিলেন “শুবু, যখন খুব কষ্ট হবে, তখন আমার মুখটা ভাববি, আমি তোকে ছেড়ে যাচ্ছি না, আমি তোর সঙ্গেই আছি...এবার গা, ওই গানটা”...শ্রাবণ কাঁদেনি, শ্রাবণ জানত কোন গানটা... খুব আস্তে ও শুরু করেছিল “আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে, তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে...” , মা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

পরেরদিনি মা মারা যান, কিন্তু না, শ্রাবণ তবুও কাঁদে নি।

আজ খুব কষ্ট হচ্ছে, আজ খুব বেশী করে মায়ের কথা মনে পড়ছে শ্রাবণের।

আকাশটা আজ ভোর থেকেই মেঘলা।

সারাদিন দাদা থাকে না, ও তবু বাড়িতে একটু নিশ্চিন্ত থাকে। বৌদির ফাই-ফরমাস খেটেও দেয়, তারপর যে কোন চুলোয় ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, নিজেই তার হদিস দিতে পারে না...আর নিজের দু-চারটে টিউশন তো আছেই বিকেল চারটে থেকে রাত দশটা পর্যন্ত।

কিন্তু আজ যেনো কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না ওর।

হাতিবাগানে ওদের বাড়ির গলিটার পর একটা গলি ছেড়ে পরের গলিটায় একটা গানের স্কুল আছে, গীতবিতান। ওর যখন খুব বেশী করে মায়ের কথা মনে পড়ে, ও ওই স্কুলটার উল্টোদিকের রকে গিয়ে বসে সন্ধেবেলায়। ভিতর থেকে গান ভেসে আসে, আর ওর মনে হয়, ওর মা গাইছেন...রবীন্দ্রসংগীত।

আরো তিন-চারটে ছেলে এসে বসে ওখানে, ওর মতোই, তবে ওরা কিছু না কিছু করে, এজেন্সী, দোকানের সেলসম্যানের চাকরি...ওকেও বলেছে শিবু, বুড়োরা, কোনো দোকানে লাগিয়ে দেবে, কিন্তু ওর মন সায় দেয় নি, তাহলে এতো কষ্ট করে টিঊশনের পয়সায় এম এ করে কি লাভ হোল?

ও বাউন্ডুলেই রয়ে গেছে।

আজ রকে বসে থাকতে থাকতেই আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি এল।

আর অনেকদিন পর যেনো নিজের কষ্টটা চাপতে না পেরেই ও গেয়ে উঠল...“সঘন গহন রাত্রি...ঝরিছে শ্রাবণ ধারা...”




বৃষ্টিটা থামছেনা কিছুতেই। অহনা আনতে চায়নি, তবু জোর করে মা ছাতাটা ভাগ্যিস ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তাই বাঁচোয়া। ছাতাটা খুলেই ও হনহন করে হাঁটতে শুরু করে। একটু বাদেই ও লক্ষ করে ওর পিছু পিছু কেউ যেনো আসছে, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, ঠিক, যা ভেবেছে, তাই। ওই ছেলেটা তো ওই রকেই বসে। এতোদিনে তবে নিজের রূপ দেখাচ্ছে , পেছু নিয়েছে। ভাবতে ভাবতেই ছেলেটা সামনে এসে পড়ে।

“একটা কথা ছিল...”

অহনা একটু বিরক্তির সুরেই যেনো বলে, “আমার সাথে?...আপনি কি আমায় চেনেন?...আমিতো আপনাকে চিনিনা। আর এখন কোন কথা বলার সময় নেই, আমায় বাড়ি যেতে হবে” ...বলছে আর ভাবছে, এই অন্ধকারে ছেলেটা কিছু করবে নাতো?

“ না , মানে আপনি কড়ি-মা লাগালেন, ওটাতো শুদ্ধমধ্যম...আমি...মানে এটা বলতে এলাম...” চারবার ঢোক খেয়ে কথা শেষ করে শ্রাবণ, “সঘন গহন রাত্রি.তে কোথাও কড়িমা নেই তো...”।

অন্ধকার রাস্তা বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে, দূরে ল্যাম্পপোস্টের কালচে হলুদ আলোয় একবার ছেলেটাকে দ্যাখে অহনা স্তম্ভিত হয়ে; প্রায় ছ’ফিটের কাছাকাছি লম্বা, অন্ধকারেও বেশ বোঝা যায়...ফরসা গালের উপর খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথার চুলগুলো অবিন্যস্ত, উস্কোখুস্কো, নাকটা, খরগের মতো বেরিয়ে আছে। সারা শরীর বেয়ে জল ঝরছে। আর চোখ দুটো!!...

অহনা শুধু বলতে পারে, “ আপনি বৃষ্টিতে ভিজে এই বলতে এলেন?” আর ভাবে, এরকম চোখ মানুষের হয়!! এত পবিত্র চোখ!!

খুব লজ্জা পায় শ্রাবণ। “ হ্যাঁ...,মানে আমার মা...আমায় শিখিয়ে ছিলেন তো...তাই”

কি ভাবে অহনা একবার, তারপর বলে, “ দিদিকে জিজ্ঞেস করে ঠিক করে নেব, অনেক ধন্যবাদ। আমি এখন যাই”।

শ্রাবণ দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকে, অহনা হাঁটতে থাকে, একটু পরে, কি ভেবে অহনা ছাতাটা বন্ধ করে দেয়।

বৃষ্টি পড়তেই থাকে।




পরের শনিবার, ক্লাসে ঢুকবার আগে অহনা ভাল করে লক্ষ্য করে, না, আজ তো সেই ছেলেটা নেই। বাকিরা তো আছে। তবে কি ও রোজ আসে না?

আগের দিনের গানটাই আজকেও গাওয়া হচ্ছে...অহনা কি ভেবে দিদিকে বলে, “ আজ আমার তাড়া নেই দিদি, আমায় পরে ছাড়লেও চলবে”। সুরমা অবাক হয়, যে মেয়েটা এসে ইস্তক যাই যাই করে, তার হল কি?কিন্তু মুখে তিনি কিছু বলেননা, শুধু বলেন, “ঠিক আছে”।

এই প্রথমবার, ক্লাস থেকে বেরোনর সময় অহনা পূর্ণ দৃষ্টিতে রকটার দিকে তাকায়।

তারপর একটু সঙ্কুচিত ভঙ্গীতে রকটার সামনে এগিয়ে যায়। ওকে দেখেই চওড়া রকের ভিতর থেকে শ্রাবণ বেরিয়ে আসে।

অহনা বলে, “ একটু কথা ছিল...”

শ্রাবণ ওর সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে থাকে-- “বলুন”

---“আজকে ঠিক আছে...গানটা?”

---“একদম পারফেক্ট”

---“সেদিন বাড়ি গিয়ে আমি শুদ্ধমধ্যমেই প্র্যাকটিস করেছি”

---“দিদিকে জিজ্ঞেস করলেন না?”

---“না, স্বরবিতান খুলে দেখলাম, আপনি ঠিক বলেছেন, আর আজ দিদিও সেটাই বললেন, অথচ আগেরদিন বলেননি, কেনো কে জানে?...আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

---“করুন”

---“অত মেয়ের ভিতর আমার গলা কোনটা, আপনি কি করে বুঝলেন সেদিন?”...বলে আর ভাবে, ছেলেটা চুল আঁচড়ায় না কেনো? ঠিক করে দাড়ি কামায় না কেনো?...একটুও কি পরিচ্ছন্ন থাকতে ইচ্ছে করে না?

---“আমি লাস্ট তিনমাস ধরে আপনার গলা শুনছিতো, আমি আপনার গলা চিনি, এই ব্যাচের মধ্যে আপনার গলাই সবচেয়ে ভালো”

---“তার মানে?...আপনি আড়ি পেতে মেয়েদের গলা শোনেন?”

অহনা দেখে, ছেলেটার ফর্সা কানদুটো লজ্জায়, অপমানে লাল হয়ে উঠছে, মনে মনে খুব হাসি পায় অহনার।

শ্রাবণ বলে, “ এমা!! নানা, আমি তো শুধু আপনার গলাই...”...কথা আটকে যায় শ্রাবণের, জীভ কেটে দাঁড়িয়ে যায় শ্রাবণ।

এবার অহনা সটান শ্রাবণের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়, “কেনো? আমার গলাই কেনো?

শিশুর মতো উত্তর দেয় শ্রাবণ, “জানি না তো”

---“জানেন না? আশ্চর্য্য..আমার গলাই শুধু শোনেন, অথচ জানেন না কেনো?”

---“সত্যি ই জানিনা , বিশ্বাস করুন”

বিশ্বাস করে অহনা, করতে বাধ্য হয়, শ্রাবণের কন্ঠস্বর থেকে, শ্রাবণের চোখ থেকে একটা কিছু বেরোয়, অহনা টের পায় সেই সোঁদা হাওয়ার গন্ধ, বৃষ্টির গন্ধ, প্রকৃতির গন্ধ, শ্রাবণের শরীর থেকে বেরিয়ে এসে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে,

অহনা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়, সামনের এই মানুষটা কোন মিথ্যে বলতে পারেনা, এই মানুষটা আদ্যপান্ত সৎ।

অনেকক্ষণ দুজনে হাঁটতে থাকে চুপচাপ।

হঠাৎ শ্রাবণ খুব বিমর্ষভাবে বলে ওঠে, “জানি , আপনি আমাকে বিশ্বাস করলেননা, কিন্তু যেদিন আপনাকে প্রথম দেখেছি, সেদিন থেকে আমি প্রতি শনিবার আপনাকে একবার দেখবার জন্য, আপনার গলাটা একবার শোনবার জন্য এখানে আসি, জানি আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, হয়তো আমাকে লোফারও ভাবছেন...কি করব?”

অহনা কোন উত্তর দেয় না, চুপচাপ হাঁটতে থাকে, তারপর আচমকাই বলে—

“সেদিন স্কুলের উল্টোদিক থেকে কেউ একজন ঐ গানটা গাইছিল, আপনি শুনেছেন?...ঐ সঘন গহন ...গানটা”

শ্রাবণ বলে, “হ্যাঁ”

---“কে গাইছিল বলুন তো?”

এবার শ্রাবণ খুব লজ্জিত গলায় বলে, “আমি”

খুব টানটান গলায় অহনা বলে, “ এই রকে বসে আপনি কি করেন?...চাকরিবাকরি করেন না কেনো? এটাকি আপনার উপযুক্ত জায়গা?”

---“কি করব? এম এ করার পর চার বছর শুধু পরীক্ষা দিয়ে গেছি, চান্স পেয়েও টাকা দিতে পারিনি বলে চাকরি হয় নি...কি করব বলুন? বাড়িতে থাকলে দাদার অপমান সহ্য হয় না...একটু গান শুনব বলে...মানে, গান শুনলে ভিতরের জ্বালাটা...মানে...” গলা কিরকম ভারি হয়ে আসে শ্রাবণের...

---“তবে ব্যবসা করুন...কিছু একটা করুন...এভাবে সময় নষ্ট করবেন না”

---“আমার পুঁজি কই?...টিউশন করে যা পাই তার প্রায় সবটাই বৌদিকে দিয়ে দিই, নিজের কাছে শুধু যাতায়াতের খরচাটা ছাড়া কিছুই থাকে না”...ম্লান হাসে শ্রাবণ।

---“নিজের পুঁজিটা নিজেই চেনেন না? ঘটে আছে কি?”...এতক্ষণে হাসে অহনা।

---“পুঁজি? আমার?”...ফ্যালফ্যাল করে অহনার দিকে তাকিয়ে থাকে শ্রাবণ।

---“ আপনি গান শিখেছেন?” অহনা জিজ্ঞেস করে।

---“ছোটবেলায়, মায়ের কাছে”

---“তবে এখন আবার শিখুন”

---“হাসালেন, খাবার পয়সা থাকেনা পকেটে, আর গান?...আপনি যদি শেখান, বিনিপয়সায়, তবে শিখতে পারি”...রসিকতার চেষ্টা করে শ্রাবণ।

অহনা খুব কাছে এগিয়ে আসে শ্রাবণের, বলে, “উপায় থাকলে শেখাতাম, বিশ্বাস করুন” তারপর একটু থেমে বলে, “কিন্তু ওটাই আপনার পুঁজি, জেনে রাখুন...ঈশ্বর দিয়েছেন আপনাকে”।

বাসে উঠে যায় অহনা।

শ্রাবণ তাকিয়ে থাকে চলে যাওয়া বাসটার দিকে...জানলা দিয়ে অহনা একবার হাতটা নাড়ে...অহনার মুখের উপর দিয়ে ভেসে ওঠে মায়ের মুখ, অহনার যুঁইফুলের মতো সুন্দর মুখখানা আর নিজের মায়ের মুখখানা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় শ্রাবণের চোখে।




বৌদির সাথে শ্রাবণের সম্পর্কটা বেশ সখ্যতার। অসীমার বাপের বাড়ি জয়েন্টফ্যামিলি। অনেক ভাইবোন। তাই একটা মাত্র দেওর তার কাছে খুব বেশী বোঝা বলে মনে হয়নি কোনদিনই। কিন্তু অর্পনের একার রোজগার, তার থেকেও কিছুটা দেশের বাড়িতে পাঠাতে হয়, তাই অর্পন যখন শ্রাবণের ব্যাপারে কিছু বলে, সে মেনে নিতেই বাধ্য হয়। কারণ তার ছেলেটাও বড় হচ্ছে, তার লেখাপড়া, শখ আহ্লাদ, এসবের জন্য খরচ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তা সত্ত্বেও অসীমা শ্রাবণের জন্য একটু আধটু ভাবে। তাই শ্রাবণ যখন হঠাৎ এসে বলে , “বৌদি , ভাল খবর আছে”। অসীমা ভাবে, কোন চাকরির খবর এসেছে, ভীষণ খুসি হয়ে হাঁকডাক করতে থাকে, “শুনছ, শুনছ, শুবুর এতদিনে ভাল খবর এসেছে...কবে থেকে জয়েন করতে হবে শুবু?”

---যাচ্চলে! সেখবর নয় বৌদি...এটা অন্য কেস।।

---সে যে কোন জায়গায় হলেই হোল, এরপরে একটা বিয়ে দিয়ে দেব, এরকম রাজপুত্তুরের মতো চেহারায় নইলে নজর লেগে যাবে।

---হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, সেই চেষ্টাটাই আগে করোতো

---মানে?

---মানে চাকরি নয়, একজনের সাথে আলাপ হয়েছে

---এতক্ষণ তুমি আমার সাথে ঠাট্টা করছিলে?

---কি সুন্দর দেখতে বৌদি!! সে বলেছে , আমার নাকি গানটাই হবে, তুমি জানো...মাও তাই বলেছিল...

---ওও...প্রেরণা!!! তা সে প্রেরণাদাত্রীর নামটা কি শুনি?

---এই যাহ!! নামটা জিজ্ঞেস করতেইতো ভুলে গেছি

--- তবে আর কি? চাকরি বাকরির চেষ্টা ছেড়ে এখন ঐ গানের স্কুলে ভর্তি হও।

---চেষ্টা কি করছিনা বৌদি? কিন্তু কিছুই তো হচ্ছে না...দেখি না একটু গানের লাইনটায়, যদি কিছু হয়? আচ্ছা বৌদি, তোমার বাপের বাড়িতে তো তোমার তানপুরা, হারমোনিয়ম সব আছে, তুমি কতদূর গান গেয়েছিলে?

---সেতো আমি পিওর ক্লাসিক ও শিখেছি, বাংলা আধুনিকো শিখেছিলাম...কিন্তু বিয়ের পর গত বারো বছরে সব মর্চে ধরে গেছে।

---মরা হাতি লাখ টাকা, আমি কালই তোমার ওবাড়ি থেকে সব নিয়ে আসব। তুমি দুপুর বেলায় আমায় একটু একটু করে শেখাতে পারবে না? তুমি দেখো, যে কোন গান, আমি একবার শুনলেই...

---শুধু গান তুললেই হবে না শুবু, রেগুলার রেওয়াজ করতে হবে, দুপুর বেলায় তুমি কোথায় কোথায় টই টই করে বেড়াও...ওসব করলে এটাও হবে না...আর অন্য সময়ে তোমার দাদা থাকবে, তার সামনে এসব করা যাবে না, তুমি একটা চাকরি পেয়ে গানবাজনা করো, সে সেটা মেনে নেবে, কিন্তু এই অবস্থায় না।

---আচ্ছা, শুধু দুপুর বেলাটুকু করব, এখন থেকে আর কোথাও যাবো না...তাহলে হবে তো? কাল তবে তোমার জিনিসগুলো নিয়ে আসি?

---আচ্ছা নিয়ে এসো।




অসিতরঞ্জন ভট্টাচার্য্য , হিন্দুস্থান অ্যালয় স্টীলের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার, স্বভাবতই খুব রাশভারি প্রকৃতির মানুষ। একমাত্র মেয়েকে তিনি সবরকম সুখ ও স্বাচ্ছ্যন্দেই মানুষ করেছেন। কিন্তু মেয়ের অনেক দেরি করে বাড়ি ফেরাটা তিনি মোটেই বরদাস্ত করেন না। অহনাকে বরাবরি বলা আছে, যতই দেরি হোক, পড়া থেকে বা গানের ক্লাস থেকে, রাত আট টার মধ্যে বাড়ি ঢুকতেই হবে। রাত সোয়া নটায় তাকে ফিরতে দেখে তিনি যথেষ্ট রুষ্ট হয়েছেন, কিন্তু তা সত্তেও গলার স্বরকে স্বাভাবিক রেখেই জিজ্ঞেস করলেন,

----“ কি ব্যাপার? এতো দেরি?”

----“ আসলে বাবা, আজ তো দিদি অনেক দেরি করে ছাড়লেন, কোন ট্যাক্সিও পেলামনা, বাসেই আসতে হোল, আর তাছাড়া...”

---“তাছাড়া?”

---“আসলে গানের স্কুলের সামনে একটি ছেলের সাথে আলাপ হোল, কি ভীষণ ভালো গায় বাবা, কিন্তু গান টান শেখে নি...ওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই...”

---“তুমি কি আজকাল রাস্তার ছেলেদের সাথে আলাপ করতে গানের স্কুলে যাচ্ছ?”

চড়াৎ করে কথাটা অহনার গায়ে লাগে, “ও রাস্তার ছেলে নয় বাবা, ও এম এ পাস করে চাকরি খুঁজছে”

---“ ওওও...কি নাম তার?”

এতক্ষণে অহনার খেয়াল হয়, ও তো তার নামটাই জানে না, এই দুদিনে জিজ্ঞাসাও করা হয় নি...বোকার মতো বলে, “জানি না তো বাবা”

---“বেশ, এখন শোন, তোমার ফাইনাল এক্সাম এসে গেছে, নেক্সট দিন গানের ক্লাস এ গিয়ে বলে দেবে আর যাবে না তুমি এখন, আরো শোন, তোমার এক্সাম কমপ্লিট হলেই মিহির আসবে অনির্বাণ কে নিয়ে, তোমার মনে আছে তো? আমি ফাইনাল কথাটা সেরে নিতে চাই”।

অনির্বাণ গাঙ্গুলী। মিহির গাঙ্গুলীর একমাত্র ছেলে। আর মিহির গাঙ্গুলী হলেন অসিতরঞ্জনের আবাল্যসুহৃদ, ক্রিমিনাল ল’ইয়ার। অনির্বাণকে চেনে অহনা ছোট থেকেই। বিয়ের সম্বন্ধটা হয়েছে গত ছমাসে। অনির্বান আছে ইনফোসিসে। বাঙ্গালোরে। সফট-ওয়ার এঞ্জিনীয়ার। এর মধ্যে কয়েকবার ফোন ও করেছে সে অহনাকে। অহনার কোন আপত্তিও ছিলনা। তাই অহনা চুপই করে থাকে।

এ বাড়িতে মা হোল অহনার সবচেয়ে বড় বন্ধু, আজ অবধি কোন কথা সে মাকে গোপন করে নি। খেয়ে দেয়ে নিজের ঘরে যাবার আগে মাকে বলে অহনা, “আচ্ছা মা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

মা বলেন, “কি রে?”

---“ তোমার তো অ্যারেনজড ম্যারেজ?...তুমি বিয়ের আগে কারোর প্রেমে পড়েছিলে?”

---“ এ আবার কিরকম প্রশ্ন?”

---“বলো না...বলো না মা”

মা একটু চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, “আমাদের বাড়ি খুব গোঁড়া ছিল। কাস্ট মানতো খুব। তাই প্রবুদ্ধরা দাসগুপ্ত ছিল বলে আমার মা বাবা মেনে নেননি। আমি মা বাবার অমতে কোন কাজ করব ভাবতেই পারতাম না। তাই.........”

---“ আচ্ছা , মা, তুমি সুখী হয়েছো?”

---“তোর মতো মেয়ে যার আছে, সে সুখী না হয়ে পারে?...নে অনেক বকবক করেছিস, এখন আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়”...মা চলে গেলেন।

অহনা বুঝলো মা কি সুন্দর কথাটা এড়িয়ে গেলেন...ও ভাবতে লাগল...আচ্ছা সুখ কি? আগে যা হোত না এখন তার হচ্ছে কেনো?...বুকের ভিতরটা এরকম জ্বালা জ্বালা করছে কেনো? অথচ শারীরিক কোন তো কষ্ট নেই...কত কিছু ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ল, আর ঘুমের ভিতর তার কপালের উপর একজোড়া ভীষণ পবিত্র শিশুর মতো চোখ জ্বল জ্বল করতে থাকল, করতেই থাকলো...




শনিবারদিন একটু আগে থেকেই শ্রাবণ গিয়ে বসেছিল রকে। অহনাকে দূর থেকে আসতে দেখে উঠে কাছে এলো।

অহনার , ওকে দেখেই কেনো জানিনা, একটা ভীষণ রাগ বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে,

“ কি? কি চাই আপনার? কেনো আমাকে এভাবে ডিস্টার্ব করেন আপনি?”

---“ আমি? ডিস্টার্ব করি?”...শুকিয়ে পাংশু হয়ে গেলো শ্রাবণের মুখ... “আমি শুধু বলতে এসেছিলাম , আপনার কথা মতো আমি গানের রেওয়াজ আর চর্চা ...” শেষ করতে পারলনা সে, অহনা ওকে ধাক্কা দিয়ে স্কুলের গেটে ঢুকে গেলো...

হতভম্বের মতো শ্রাবণ দাঁড়িয়ে রইলো বাইরে।

সেদিন সুরমাদি একটা নতুন গান তোলাচ্ছিলেন, “ তিমির অবগুন্ঠনে বদন তব ঢাকি ...কে তুমি মম অঙ্গনে দাঁড়ালে একাকি...”...না , কোনকিছুই কানে যাচ্ছিল না অহনার, বুকের ভিতর ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিল, মাথাটা কিরকম খালি খালি লাগছিল, সুরমাদি জিজ্ঞেস করলেন ,“ শরীর খারাপ করছে নাকি তোমার?”...অহনা বলল, “ কৈ , নাতো?”

---“নাহ।।আজ তোমার কিছু একটা হয়েছে। আজ তুমি বাড়ি যাও”।

অহনা ব্যাগটা তুলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো স্কুল থেকে। রকের দিকে তাকালো। না সে নেই। হটাৎ দেখল নিজের দুচোখের পাতা জুড়ে জল জমা হয়েছে। জলটা মুছে, ও রকের দিকে এগিয়ে গেলো। একজনকে বলল, “উনি নেই?”

সে বলল, “কে? শ্রাবণ?...নাতো আজ একটুখানি ছিল। কিন্তু কি যেনো একটা হয়েছে ওর। কিরকম লাগছিল ওকে। ছটফট করতে করতে চলে গেলো”

...শ্রাবণ শ্রাবণ , ওর নাম তবে শ্রাবণ... “আচ্ছা ওনার কোনো নাম্বার আছে?”

---আছে, তবে ল্যান্ড নাম্বার, ওর নিজের কোন মোবাইল নেই।

---সেটাই দিন।

---সেটাতো আমাদের কাছে নেই।

---ও আচ্ছা। হতাশ হয়ে ও পা চালায় রূপবানীর দিকে।

আজ আর পা যেনো চলছে না অহনার। কেনো এরকম হচ্ছে...বুকের ভিতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে কেনো?

রুপবাণী অবধি যেতেই মনে হচ্ছে রাত ফুরিয়ে যাবে। সিনেমার সামনের লাইটপোস্টে হেলান দিয়ে কে দাঁড়িয়ে আছে? কে?

---“আমি.”..শ্রাবণ এগিয়ে আসে। “ আমার সাথে আজ তুমি এরকম ব্যবহার করলে কেন? আমি কি করেছি বলো?।।আমি কি করেছি?”...শ্রাবণের গলা দিয়ে যেনো আর্ত চিৎকার বেরোয় ।

অহনা অতিকষ্টে নিজেকে সামলায়, যতটা পারে, গলাটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে, “ তুমি কিচ্ছু করোনি, আমার কথাটা মন দিয়ে একটু শোন। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, অনির্বাণ গাঙ্গুলী বলে একজনের কাছে আমি বাগদত্তা , সে বাঙ্গালোর-এ চাকরি করে, যোধপুর পার্কে বিশাল ফ্ল্যাট, ওখানেই আমার শ্বশুরবাড়ি হতে যাচ্ছে, আমার পরীক্ষা আগামী সপ্তাহ থেকে শুরু, পরীক্ষা শেষ হলেই আমার বিয়ে। আমি এই গানের স্কুলে আর আসব না। আজকেই আমার শেষদিন ছিল”...একদমে বলে গেলেও গলাটা কেমন করছিল অহনার...আর শ্রাবণ কোন কথা বলছিল না, একদৃষ্টিতে অহনার দিকে চেয়েছিল...একটা ট্যাক্সী এসে দাঁড়াল সামনে, অহনা গেট খুলে ভিতরে উঠে গেল। জানলা দিয়ে মুখটা বাড়িয়ে বলল, “ তুমিতো আমার নামটাও জানোনা শ্রাবণ, আমি অহনা”...ট্যাক্সীটা ছেড়ে দিল...একটু বাদে মিলিয়েও গেলো।

না। শ্রাবণ কাঁদে নি। শ্রাবণের চোখ থেকে একফোঁটাও জল পড়েনি। শুধু ও ভিতরে ভিতরে পাথর হয়ে গেলো।




এক আশ্চর্য্য পরিবর্তন হয়েছে ছেলেটার, এখন দাদার সামনে পিছনে মানছেনা, শুধু ঘুমটুকু বাদ দিয়ে উন্মত্তের মতো রেওয়াজ আর রেওয়াজ করে চলেছে শ্রাবণ সেন, যেনো এই সাতাশ বছরে যে রেওয়াজ হয় নি, এক বছরে তা করে ফেলবে, যেনো ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়েছে সে, উন্মত্ত গতিতে সংগীতের সমুদ্রকে গিলে ফেলতে হবে তাকে, যেনো তার হাতে সময় খুব কম...দাদাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছে, “ দাদা, আমায় শুধু পাঁচটা বছর সময় দাও, কথা দিচ্ছি, তোমায় এই হাতিবাগানের ভাড়া বাড়িতে থাকতে হবে না, যোধপুর পার্কে যদি আমি তোমায় ২৫০০ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট কিনে না দিতে পারি, আমি গ্রাম এ গিয়ে চাষ করব, বাবাকে জানিয়ে দাও, মায়ের চিকিৎসার জন্য যত জমি তাঁকে বিক্রি করতে হয়েছে, সব জমির এখনকার দাম হিসেব করে রাখতে, আমি কথা দিচ্ছি পাঁচ বছরের মধ্যে সব জমি তাঁর কাছে ফিরে আসবে”।।সে বলেছে আর তার সেই চোখ দুটো ধ্বক ধ্বক করে জ্বলেছে...দাদা বিশ্বাস করেছে, বলা যায় বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে।




অহনার সামনের ফোনটা বেজে উঠল...

ফাইলটা দেখতে দেখতেই অন্যমনস্ক ভাবে ফোন টা কানে লাগাল সে...

---“হ্যালো, কে অহনা? আমি বলছি রে...শর্মি, শর্মিষ্ঠা”...একটা প্রানোচ্ছল কন্ঠ ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এল।

---“আরে তুই?, এতদিন বাদে?...বিয়ের পর গত দুবছর যে কোথায় গেলি?” অহনাও খুসিটা চেপে রাখতে পারল না।

---“আসলে ওর তো বাঙ্গালোর হয়ে দিল্লি তে ট্রান্সফার হোল...আর আমার মোবাইল্ টাও হারিয়ে গেলো, ব্যাস, সব নাম্বার গায়েব, শোন আমি দুদিন হোল কলকাতায় এসেছি, অল্প কদিন থাকব, আজি চলে আয় আমার বাড়ি, কত কষ্ট করে যে তোর ফোন নাম্বারটা পেলাম কি বলব!!” শর্মিষ্ঠা কলেজ লাইফের সবচেয়ে প্রিয়বান্ধবী ছিল অহনার।

---“ এই নারে। আজ পারব না, আজ অফিস ক্লোজিং এর পর অফিস কালচারাল ক্লাবের মিটিং আছেরে, অ্যাটেন্ড করতেই হবে, কাল চলে যাব সন্ধেবেলা...ওকে?”

---“ তুই কি বিয়ে টিয়ে করবিনা ঠিক করেছিস নাকি রে?”

---“ তোদের সকলের এই একটাই কথা...করবনা বলিনিতো...কিন্তু যাকে করব, তাকে পাই আগে। ..জানিস তুই? বাবার মৃত্যুর পর যখন বাবার চাকরিটা পেলাম, সেই থেকে বাবার বন্ধুরা আর মা মিলে অন্তত একশ সম্বন্ধ এনেছে...এই সাড়ে চার বছরে। যাকে তাকে বিয়ে করে নিলেই হোল?”

---“ কিন্তু তুই যে কেনো আল্টিমেটলি কার্ড ছাপিয়ে বিলি করার পরো বিয়ের একুশদিন আগে অনির্বাণের সঙ্গে বিয়েটা ভেঙ্গেছিলি তা কিন্তু আজো আমি জানিনা, মনে হয় মাসীমাও জানেন না, আর তুই যতই অস্বীকার করিস, সেটা কিন্তু একটা বড় কারণ মেশোমশাইএর হার্ট-ফেলিওরের, যাকগে, এসব কথা বললেই তো তোর আবার গোঁসা হবে, কাল আয়, বাকি ঝাড় কালকের জন্য ডিউ রইল...এখন ছাড়ি”

---“হাহাহা, তুই আর বদলালি না, আচ্ছা যাব ঝাড় খেতে...কিন্তু কিছু খেতেও দিস...রাখি”।

......কিকরে বলে অহনা, ঐ বিয়ে না ভেঙ্গে তার আর কোন উপায় ই ছিলনা, সারা শরীর এর ভিতর যদি কারোর সোঁদা হাওয়ার গন্ধ থাকে, বৃষ্টির গন্ধ থাকে , প্রকৃতির গন্ধ থাকে, সে কিকরে , যে কাউকে বিয়ে করতে পারে? অহনার তো তাকেই চাই, সমস্ত মন, শরীর , আত্মা জুড়ে সেই অবয়বটা...আর তার সেই অদ্ভুত পবিত্র দুটো চোখ......




এখন বৌদিকেই সেক্রেটারির কাজটা করতে হচ্ছে, প্রতিদিন ই প্রায় প্রোগ্রাম শ্রাবণের। ডেট মাথায় রাখতে পারে না সে, সারা পশ্চিমবঙ্গের কোথায় না অনুষ্ঠান...ঘরে তো তার থাকাই হয়ে ওঠে না। মিন্টুর সঙ্গে খেলাও হয়না। তবে যেখানেই যায়, তার কাকুর জন্য খেলনা আনাটা বাঁধা। আর কলকাতায় থাকলে তো কথাই নেই, প্রতি সন্ধেই তার বুকড। মধুসূধন মঞ্চ, রবীন্দ্রসদন, বিড়লা সভাঘর দৌঁড়োতে দৌঁড়োতে জানান্ত।

পরপর দুটো এলবামো হিট। প্রথম প্রথম অনুষ্ঠান গুলোতে বৌদি , মিন্টুকে নিয়ে যেতো। এখন আর পারেনা। প্রতিদিন ঘর-সংসার ফেলে কাঁহাতক আর ছোটা যায়?

কলকাতার দিনগুলোতে, ফিরতে প্রত্যেকদিন রাত এগারোটা...বৌদি জেগেও থাকে খাবার বেড়ে দেবার জন্য। কখনো কখনো খারাপ লাগে শ্রাবণের। সারাদিন বৌদি এত কাজ করে, মিন্টুর দেখভাল, দাদার যাবতীয় খুঁটিনাটি, তার ওপর তার জন্য এই রাত বারোটা অবধি জেগে বসে থাকা, ভোর পাঁচটায় ওঠে বৌদি। কোনকোনদিন বলেও ফেলে সে, “খাবারটা ঢাকা রেখে শুয়ে পড়লেইতো পারো বৌদি, তোমায় অত ভোরে উঠতে হয়”!

---“ সেইজন্যই তো বলছি, এবার একজনকে নিয়ে এসো, কতদিন আর আমি এই হ্যাঁপা সামলাব?”

---“নাহ, ঐটা বাদ দিয়ে বলো বৌদি, ওসব পাট আর আমার জন্য নয়”

---“ কেনো? কারোর জীবনে কি কোন মিস-হ্যাপ ঘটে না? সে কি সারাজীবন ধরে তার জন্য দেবদাস হয়ে বসে থাকে, তাও এই যুগে?”

---“ একটা ভাল মেয়েকে নিয়ে এসে সারাজীবন ধরে দগ্ধাবার কি মানে হয় বৌদি? সেতো কিছুই পাবে না”...

---“কিন্তু তোমার দাদা বলছিল, যোধপুর পার্কের নতুন ফ্ল্যাটে যাবার আগে একেবারে তোমার বৌ সমেত গেলেই ভালো”

---“কিন্তু আমি তো দাদাকে ফ্ল্যাট দেবো বলেছিলাম, বৌ দেব তো বলিনি”

---“তোমার সাথে কথায় পারা খুব মুসকিল”...বলতে বলতে বৌদি উঠে যায়;

চেনে তার এই দেওরটিকে অসীমা। এই কথোপকথোন প্রায়ই হয় দেওর বৌদির। আর মুখে যাই বলুক , অসীমা মনে মনে সেলাম করে তার এই দেওরটিকে, এই ডিজিটাল যুগে যখন সম্পর্ক বদলে যাচ্ছে প্রতি আধ-ঘন্টায়, সেখানে একটা স্মৃতি আঁকড়ে বছরের পর বছর...নাহ ছেলেটা এই যুগের না।

আজো খেতে খেতে সাড়ে এগারোটা বাজল, বৌদির সাথে কথা বলতে বলতেই ওয়াল-ট্রের ওপর রাখা টেলিফোনটা ডেকে উঠল তারস্বরে।

---“এতো রাতে?” একটু অবাকি হোল শ্রাবণ।

---“ওওওও, তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, আজ দুপুরবেলা একটা ফোন এসেছিল, একটা প্রোগ্রামের, আমি একটু বেশি রাত করে করতে বলেছিলাম, দেখো, হয়তো সেই ফোনটাই”...বৌদি রান্নাঘর থেকে বলে ওঠে।

---“আমি কি শ্রাবন সেনের সাথে একটু কথা বলতে পারি?”, ওপাশ থেকে ভারি সুন্দর গলার এক মহিলার কন্ঠস্বর ভেসে আসে ।

---“হ্যাঁ, বলছি , বলুন”...কিন্তু কিছুই শোনে না শ্রাবণ, এ কার গলা? কার গলা? কোন ভুল হচ্ছে না তো তার? এই গলাটা যেনো বহু বছরের ওপার থেকে ভেসে এলো!!

---“ আগামী ১৮ ই জানুয়ারী কিন্তু...কলামন্দিরে, একটু দেখুন না, আপনি ফ্রী আছেন কিনা? আমি আপনার গানের ভীষণ ফ্যান, আমিই আপনার কথাটা আমাদের অফিস রিক্রিয়েশন ক্লাবকে বলেছিলাম্‌, আপনার দুটো এলবামই দারুন, আচ্ছা আপনার কোন ছবি নেই কেন এলবামে”...বলেই চলেছে ওপাশের বামাকন্ঠ।

“দেখছি, এক মিনিট”... , ডায়রী উলটে বলে, “ কাল কাউকে পাঠিয়ে দিন অগ্রিম সমেত, আমি ফ্রী আছি, চারটের আগে পাঠাবেন, আর প্রথমটা রিমেক আর পরের টা রবীন্দ্রসংগীত, নিজের গান যখন গাইব, তখন নিজের ছবি দেব”

ফোনটা রেখে দেয় ও। কার গলা ছিল ? নামটাও তো জিজ্ঞেস করতে পারত? কখনই কি ঠিক কাজটা ঠিক সময়ে করতে পারবে না সে? দূর!!! এখন আর জেনেই বা কি হবে? খামোখা নিজের কষ্টটাকে আবার খুঁড়ে বের করার কিই বা মানে হয়? নাহ ভুলও হতে পারে, এখানে তো তার থাকারই কথা না। নিজেই নিজেকে স্তোক দিয়ে ঘরে ঢুকে যায় শ্রাবণ।

আজ রাতে আর ঘুম আসবে না তার, সে বুঝতে পারে......


১০

মিন্টোপার্কের জ্যামে শ্রাবণের ভ্যাক্স-ওয়াগনটা দাঁড়িয়ে ছিল ডানদিকের ফুটপাথ ঘেঁষে। এখানে অন্ততঃ পাঁচ-মিনিট। অফিস টাইমের জ্যাম শুরু হয়ে গেছে। বিকেলের আলো এখনও ফুরোয় নি। শহরের বুকে এই সন্ধে নামাটা দেখলে এখনও তার মনে পড়ে যায় মায়ের সেই সন্ধে-বিকেলের আলোয় তুলসিতলায় পঞ্চ-প্রদীপ জ্বালানোর কথা, পুকুর পার থেকে হাস্নুহানার গন্ধ ভেসে আসার কথা, অকারণেই চোখে জল আসে তার, সেটা এড়াতেই, স্টীয়ারিং এর উপর হাত রেখে ডানদিকে মুখটা ঘোরালো শ্রাবণ। আর, মরা বিকেলের আলো জীবন্ত হয়ে উঠল।

কে দাঁড়িয়ে ঐ ফুটপাথে? অহনা না?

অহনাও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে শ্রাবণের দিকে । যেনো বিশ্বাস করতে পারছেনা নিজের চোখ কে।

হাজার যোজন নৈঃশব্দ ভেঙ্গে শ্রাবণই বলল, “ কি দেখছ? উঠে এসো গাড়িতে, সিগ্ন্যাল ছেড়ে দেবেতো এখুনি”...অহনা যেনো মন্ত্রমুগ্ধের মতো গাড়িতে এসে বসল।

তাকিয়েই আছে অহনা, এমনও হয়, কি সুন্দর দেখতে হয়েছে মানুষটাকে, সেই উস্কোখুস্কো চুল, খোঁচাখোচা দাড়ির ছেলেটা নেইতো আর...তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ও টের পেল বহুবছর আগের সেই গন্ধটা ভেসে আসছে পাশ থেকে, এটা স্মৃতি নয়, এটা টাটকা, ও কিরকম আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে, আর টের পেল, নিজের শরীর থেকে , বুকের ভিতর থেকে ফুলের গন্ধ বেরিয়ে আসছে, ফুলের সবকটা পাপড়ি খুলে যাচ্ছে, ভিতর থেকে এক প্রবল জলস্রোত ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে আর কিছু পাওয়ার নেই, এটুকুর জন্যই ও অপেক্ষা করেছিল এতো বছর।

---“তুমি কি এখন কলকাতায়? যোধপুরের সেই ফ্ল্যাট-এ”? নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো শ্রাবণ

---“যোধপুরের ফ্ল্যাট? কৈ নাতো? আমিতো সেই শিয়ালদার বাড়িতেই থাকি।”

---“আর অনির্বাণ?”

---“অনির্বাণ? তোমার মনে আছে? সে বিয়ে তো হয়নি আমার”

---“হয়নি???কেনো?”

---“আমি ভেঙ্গে দিয়েছিলাম, বিয়ের একুশদিন আগে”

---“কেনো?”

কোন উত্তর দেয়না অহনা, মুখটা বাঁদিকে ঘোরায়, শ্রাবণ লক্ষ্য করে অহনার চোখ দিয়ে আস্তে আস্তে জলের ধারা নেমে আসছে...একটু পরে অহনাই বলে, “ গাড়িটা তোমার?”

---“হ্যাঁ”,

---“ চাকরি না ব্যাবসা? কি কর এখন?”

---“ ঐ ফ্রী ল্যান্সিং বলতে পারো”

কথা বলতে বলতে গাড়িতে সিডি চালিয়ে দেয় শ্রাবণ, নিজের। অহনা এতোক্ষনে হাসে, সেই যুঁইফুলের মতো হাসি, বলে “ কি অপুর্ব গান না ভদ্রলোক? দুটো সিডিই কিনেছি, ওনার গান শুনলে মনে হয় আমি কোথাও ভেসে যাচ্ছি, আমার গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে যায়”

---“ তেমন কিছু তো লাগেনা আমার। ঐ মোটামুটি আর কি”

---“ জেলাস? নিজের গান হয়নি বলে?”

অট্টহাস্য করে ওঠে শ্রাবণ। জেলাসই বটে।

হঠাৎ ই জিজ্ঞেস করে অহনা “বিয়ে করেছ?

---“ সেতো কবেই করেছি, কতদিন আগে!!”

---“ওহ...” চুপ করে যায় অহনা। মুহূর্তের পূর্ণতা আচমকাই অপার শূন্যতায় ঢাকা পড়ে যায়।

ইতিমধ্যেই গাড়ি যে কখন যোধপুর পার্ক এরিয়ায় ঢুকে পড়েছে অহনা খেয়ালো করেনি। সম্বিত ফিরে পায় শ্রাবণের কথায়, “ একবার নামোতো এখানে”

অহনা বলে ------“একি? এতো যোধপুর পার্ক। এখানে এলাম কেনো”?

উল্টোদিকের এপার্টমেন্টএর দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় শ্রাবণ, “ঐটার ফোর্থ ফ্লোরে আমার নতুন ফ্ল্যাট, পছন্দ?”

---“ আমি পছন্দ করে কিকরব? তোমার আর তোমার স্ত্রীএর পছন্দ হলেই হবে। শোন, ভালই করেছ এদিকটায় নিয়ে এসে, আমার এক বান্ধবীর বাড়িতে যাওয়ারো ছিল, একবার ঘুরে যাব ওদের বাড়ি, তুমি চলে যাও শ্রাবণ...আমি পরে বাড়ি ফিরব”

---“শোন অহনা, শোন...”...শ্রাবণ কিছু বলতে যায়...কিন্তু অহনা আর দাঁড়ায় না...হনহন করে হাঁটা লাগায়।


১১

১৮ই জানুয়ারীর অনুষ্ঠানটায় দাদা নিজে থেকে বলল “এবার আমি শুনতে যাব”...তারমানে বৌদি আর মিন্টুও যাবে। শ্রাবণ ভীষণ খুসি হয়েছে তাই, অনেকদিন পর তার কোন অনুষ্ঠানে পুরো পরিবার যাচ্ছে। ও সেটা আগে থেকেই অর্গ্যানাইজারদের জানিয়ে দিয়েছিল। অনুষ্ঠান শুরু হবার আগে ঘোষক সেটা আবার জানিয়েও দিল। অহনা বসেছিল সেকেন্ড রো তে। নিজেদের অফিসের প্রোগ্রাম বলে কথা, পুরোটায় থাকতে হবে। ঘাড় উঁচু করে সে একবার দেখল , তার মানে শ্রাবণবাবু এখনো বিয়ে করেননি। মঞ্চে শ্রাবণ এসে হারমনিয়মে হাত রাখল, আর অহনার বিশ্ব অন্ধকার হয়ে গেলো, ও কাকে দেখছে!!, এই শ্রাবণ মানে ওই শ্রাবণ, মনে হোল সে আর বসে থাকতে পারবে না, সে এবার পড়ে যাবে, কোনমতে ব্যাগ থেকে একটা চিরকূট বের করে খস-খস করে দুটো কথা লিখে স্টেজে পাঠিয়ে দিল। তারপর টলতে টলতে বেরিয়ে গেলো।

টানা দুঘন্টার অনুষ্ঠান শেষে সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে কলামন্দিরের গাড়ি পার্কিং জোন এ নিজের গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ায় শ্রাবণ। দূরে সিমেন্টের বেঞ্চিতে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে অহনা। খুব আস্তে আস্তে ওর দিকে এগিয়ে যায় শ্রাবণ। কাছে গিয়ে ডাকে, “অহনা”

ছিলার মতো উঠে দাঁড়ায় অহনা,

অহনার ঠোঁট কাঁপছে, সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে...অস্ফুটে বলে, ---“চীটার”

শ্রাবণ হাসে, এই প্রথমবার তার কান লাল হয়না, প্রশান্তির হাসি ছড়িয়ে পড়ে ওর মুখে। অহনা খামচে ধরে ওর দামী পাঞ্জাবীটা, আবার বলে , “চীটার, চীটার, চীটার”।।আর অহনার শরীর ভেঙ্গে আসতে থাকে, বিবশ হয়ে যেতে থাকে, সেই ভয়ঙ্কর মাতাল বৃষ্টির গন্ধ, সোঁদা হাওয়ার গন্ধে সারা শরীর ভিজে যেতে থাকে, অহনার শরীরের কোন ভর থাকে না, শ্রাবণ খুব আলতো করে ওকে জড়িয়ে ধরে এক হাত দিয়ে , আরেক হাত দিয়ে থুতনিটা তুলে ধরে, মুখটা অহনার মুখের খুব কাছে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে , “আমাকে বিয়ে করবে অহনা?”

অহনা বেতস পাতার মতো লুটিয়ে পড়ে শ্রাবণের বুকের উপর, আর ফিসফিস করে , “ না, আমার বিয়ে তো কবেই হয়ে গেছে”।

কলামন্দিরের নির্জন গাড়িবারান্দা এক অভুতপূর্ব ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে থাকে।



**********









































































1 comments:

  1. স্বপ্ন পড়লাম!!!! একরাশ রজনীগন্ধার সুবাস ছড়ানো স্বপ্ন দেখলাম যেন। এত মিষ্টি ভালবাসা!!!!! মন্ত্র মুগ্ধ!!!

    উত্তরমুছুন