সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

পরম্পরা - ফুল্লরা নাগ

পরম্পরা
ফুল্লরা নাগ

আমার ভাবনায় রাধাকৃষ্ণের প্রেম

ভাদ্র মাস পেরিয়ে এলাম। যদিও এ মাসে যাত্রা নাস্তি, বিশেষ কিছু ক্ষতি নেই তাতে। মাসটা যে উৎসবে ভরা। শুরু তার ‘ঝুলন যাত্রা’ দিয়ে, তার পর ‘রাখী পূর্ণিমা’।হাতের রাখী খোলার আগেই আবার এসে পড়ে 'জন্মাষ্টমী’, শ্রীকৃষ্ণের জন্মোৎসব। তারপর দিন ‘নন্দোৎসব’,চলছে ত চলছেই।গোটা মাসটা ধরেই সেই পরম পুরুষকে ঘিরে নানান আনন্দ উৎসব।

ভারতীয় মননে শ্রীকৃষ্ণের স্থান যে ঠিক কোথায়, সেটা এক কথায় বলা মুশকিল। ভক্তজনের কাছে তিনি স্বয়ং অবতার। ভাগবত বলছেন,

- ‘এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্‌স্বয়ম্‌’।

(অর্থাৎ অবতারদের মধ্যে কেউ কেউ বা ভগবানের অংশ, কেউ বা তাঁর কলা; একমাত্র কৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান।)

মধুসূদন সরস্বতী যে এত বড় অদ্বৈতবাদী, তিনিও বলছেন,

- ‘কৃষ্ণাৎ পরং কিমপি তত্ত্বমহং ন জানে’। (শ্রীকৃষ্ণ থেকে শ্রেষ্ঠতর তত্ত্ব আর কিছু আছে বলে আমি জানি না)।

আবার অন্য দিক দিয়ে দেখতে গেলে শ্রীকৃষ্ণের মত বিতর্কিত চরিত্র ভারতীয় সাহিত্যে আর নেই। তাঁর বৃন্দাবন লীলার কথাই ধরা যাক না কেন, ভক্তজনের কাছে এর মুল্য অপরিসীম, কিন্তু মানবীয় দৃষ্টিতে যারা এটিকে দেখেন তাঁরা এর কিছু কিছু অংশ নিন্দা না করে পারেন না। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময়ও তাঁর অনেক কার্যাবলী আমাদের প্রচলিত নীতিবিরুদ্ধ, অনেকেই তার নিন্দা করেছেন। কিন্তু ভক্তদের তাতে কিছু এসে যায় নি, ওই যে, ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান্‌স্বয়ম্‌’।

আসলে রাধাকৃষ্ণের প্রেম কথা, সে যে বড় উচ্চস্তরের তত্ত্ব। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, সাধারণ লোকের এর মধ্যে না যাওয়াই ভাল। শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য এই চার ভাবের চূড়ান্ত পরিনতি যে মধুরভাব,কয় জন বা সে ভাব বুঝতে পারে? স্বামিজীই কি প্রথমে বুঝতে পেরেছিলেন?

ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা মনে পড়ে।নরেন তখন নরেনই।বিবেকানন্দ হতে ঢের দেরী।

- ‘রাধা-কৃষ্ণ? সে আবার কি’?

ঠাকুর বললেন,

- ‘আচ্ছা ধর, রাধা বা কৃষ্ণ বলে কেউ ছিল না, কিন্তু তাতে কি? নাই বা থাকলেন তাঁরা,.. কিন্তু কৃষ্ণের উপর রাধার টানটুকু ত সত্য।যা বাস্তবে নেই, তা কবি কল্পনায় ত’ থাকতে পারে ।তুই ওই টানটুকুই নে না’।

বিবেকানন্দ চুপ...

ছোটবেলায়ে যখন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়তাম, তখন শুনেছিলাম, কৃষ্ণ ভগবান ঠিকই; কিন্তু রাধা হলেন সংসারবদ্ধ জীবের প্রতীক।।আর সংসারের প্রতীক হলেন তাঁর স্বামী আয়ান ঘোষ।শ্বাশুরী তাঁর জটিলা আর ননদ হলেন কুটিলা, নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে তাঁরা কি বস্তু।তাঁরা হলেন এই সংসার বন্ধন। ধরনধারণ তার যেমনি জটিল তেমনি কুটিল।

মোট কথা হচ্ছে, এই আমরা পৃথিবীর জীব, অজস্র বন্ধনে বদ্ধ,কিন্তু যদি হৃদয়ে সত্যিকারের কৃষ্ণ প্রেম জাগে, তাহলে এই সব বন্ধন তুচ্ছ হয়ে যায়।।মানুষ সংসারবন্ধন ছিঁড়ে ফেলে আপনার দয়িতের সঙ্গে মিলিত হয়। তবে তখন কি সে সংসার-বহির্ভূত অসামাজিক একটি জীবে পরিণত হয়?না তা হয় না,কৃষ্ণলাভের পরও রাধা সংসারেই থাকতেন,তবে সংসার আর কোনদিন তাঁকে বাঁধতে পারেনি।

এ ত হল এক দিক। আসলে ভগবত তত্ব সে এক বিশাল ব্যাপার। যে যেভাবে দেখে। ভক্তরা কিন্তু বলেন বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই হলেন শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি,এখানে বলে রাখা ভাল, ভাগবতে কোথাও কিন্তু শ্রীরাধার উল্লেখ নেই।সেখানে এক গোপিনীর কথা অবশ্য আছে, যার দ্বারা ভগবান যথার্থই রাধিত অর্থাৎ আরাধিত হয়েছেন।‘ অনয়ারাধিতো নূনং’ । এই রাধিত থেকেই রাধা।রাধা আসলে বৈষ্ণব গুরুদের ধ্যানলব্ধা। যাক সে কথা,ফেরা যাক আসল কথায়।

শ্রীরাধা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। হ্লাদিনী শক্তি বস্তুটি কি? সৎ চিত আর আনন্দ।এই নিয়েই ত সদচিদানন্দ ভগবান।তাঁর সেই আনন্দই হলেন হ্লাদিনী রাধা।

কৃষ্ণ, অর্থাৎ যিনি আকৃষ্ট করেন,সবাই ভালবাসতেন কৃষ্ণকে। তবে সবাই আপন আপন ভাবে। মুনিঋষিদের শান্তভাব, তাঁরা তাঁর মহিমা দর্শনে শ্রদ্ধাবনত, দূর থেকে তাঁকে পূজা করেই তাঁদের তৃপ্তি। গোপগোপীদর সখ্যভাব, সঙ্গে সঙ্গে একটু দাস্যও,তাঁরা ভালবেসে এঁটো ফলটাও মুখে তুলে দেন।সখ্যভাবের সাধকের কাছে ভগবানের মহিমার কোন মূল্য নেই, বরং সে তাঁকে আপন জ্ঞানে বুকে জড়িয়ে রাখে, দুচারটা প্রাণের কথা বলে তৃপ্তি লাভ করে। যশোদা নন্দলালের বাৎসল্য ভাব, আপন সন্তান জ্ঞানে বাৎসল্যভাবের সাধক স্বয়ং ভগবানের সঙ্গে লড়াইতেও নেমে যান।যেমন যেতেন রামকৃষ্ণ ভক্তমণ্ডলীর গোপালের মা।

আর মধুর ভাব? সে ছিল একমাত্র রাধার,সবাই বলেন ‘আমি কৃষ্ণের’,একমাত্র রাধাই বলতেন ‘কৃষ্ণ আমার’।তা, কেমন আমার? চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে গেছেন কৃষ্ণ, শুনে রাধার কি রাগ!বললেন, ‘ ত কামুক,ও কি তোমার সেবা করতে জানে? কেন যাওয়া তার কাছে?’ বোঝ একবার!!!

আসলে ভাললাগা, ভালবাসা আর প্রেম, তিনটি আলাদা শব্দ।আলাদা ভাব। হাজার লোককে ভাল লাগতে পারে, ভালোও বাসতে পারো একসঙ্গে অনেকজনকে, প্রেম কিন্তু একজনের সঙ্গেই হতে পারে। কারণ প্রেমে দুটি সত্ত্বা এক হয়ে যায়,তৃতীয় সেখানে আসে কি করে?

প্রেমের অধিকারী ত আমি কোনোদিন হতে পারিনি,তবে শুনেছি সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি।শুনেছি, দূরত্ব সেখানে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারে না।দৈহিকভাবে দূ্রে থাকলেও প্রাণ মন থাকে পাশাপাশি,শ্রীচৈতন্য আর বিষ্ণুপ্রিয়ার প্রেমকাহিনীর কথাই ভাব না কেন? একজন থাকতেন নীলাচলে আর অন্যজন নদীয়ায়, তবুও মানসিক আদানপ্রদান অব্যহত থাকতো।

ইদানীংকার শ্রীরামকৃষ্ণ আর সারদাদেবীর প্রেমও কি কম ছিল না কি? ছমাস হয় ত দেখা নেই, কিন্তু একজনের মাথা ধরলে আরেকজনের ছটফটানি শুরু হয়ে যেত। একেই বলে প্রেম।আমরা তার কি বুঝি?

কৃষ্ণের কথাতেই ফিরে যাই না কেন? তাঁর বহু পত্নী ছিলেন, বলে নাকি ষোল হাজার।,সেটা বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি।,সে যাই হক, এদের সবাইকেই নিশ্চয়ই তাঁর ভাললাগত। কিন্তু ভালবাসতেন কি? মনে হয় না।এদের মধ্যে আবার চারজন প্রধানা মহিষী...’ রুক্মিনী’, ‘সত্যভামা’, ‘জাম্ববতী’ আর (বোধহয়) ‘শৈব্যা’।প্রধানা মহিষী যখন, এদের সবাইকেই নিশ্চয় তিনি ভালোও বাসতেন সমানভাবে।

কিন্তু প্রেম? সে একমাত্র রাধার জন্যই ছিল।ভাগবত বলেন, অনেক দিন পরে, ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রের প্রাঙ্গণে দেখা হয়েছিল গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণ বলরামের। দ্বারকানাথ শ্রীকৃষ্ণ এসেছিলেন সূর্য গ্রহণ উপলক্ষে কুরুক্ষেত্রের হ্রদে স্নান করতে। গোপগোপীরাও গিয়েছিলেন সেখানে, তবে পূণ্যলোভে নয় , গিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ দর্শনের আশায়। অন্যান্য গোপগোপীদের সঙ্গে রাধাও নিশ্চই গিয়েছিলেন সেখানে। দেখাও হয়তহয়েছিল দ্বারকানাথ শ্রীকৃষ্ণের আর আয়ানপত্নী রাধার। তারপর আবার হয়ত ফিরে গিয়েছিলেন তাঁরা তাঁদের আপন আপন গণ্ডির মধ্যে, কিন্তু তাদের সেই গণ্ডি বিহীন প্রেম আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে ভারতবর্ষের আকাশে বাতাসে, সেই প্রেমই আমাদের মনটাকে এমন উতলা করে তুলছে ঝুলন যাত্রার বা হোলির দিনগুলিতে, নইলে এই দিন গুলির এমন কি বৈশিষ্ট আছে?

1 comments: