সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

গল্প - পূজা মৈত্র

ভালোবাসার অঙ্ক
পূজা মৈত্র



বিকালের রোদ পড়ন্ত হয়ে এসেছিলো। সূর্য পশ্চিম দিগন্তে, ডুববো ডুববো করছে। পাখিদের ঘরে ফেরার সময় হয়ে এসেছে। অনুমিতার মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় এমন সময় ওদের খেলা ভাঙ্গত। সারা বিকাল মাঠে দৌড়ে বেড়াবার পর, ঠিক এই সময় লুকোচুরি, চোর পুলিশ, কুমীর ডাঙ্গা শেষে, কা-কা ডাক ডাকতে ডাকতে ঘরে ফিরত ওরা। আরও একটু খেলতে মন করত না তা নয়, কিন্তু বাড়িতে সন্ধ্যার পরে ফিরলে কপালে দুর্ভোগ ছিল। সেই ভয়েই ঘরের ছানার ঠিক সময়ে ঘরে ফেরা। আজকেও বড্ড দেরী হয়ে গেছে। স্কুল থেকে ফিরতে এতোটা দেরী কখনো হয়না। আজ দিনটাই ছিল অন্যরকম। সব হিসাব উলটপালট করে দেওয়া একটা দিন। সবাই চলে যাওয়ার পর, অনুমিতা একা একা কমন রুমে বসে ছিল, ফিরতে ইচ্ছাই করছিল না। অনিরুদ্ধ ফোন না করলে, আরও অনেক দেরি হয়ে যেত। অনিরুদ্ধ সব জেনেও অদ্ভুত শান্ত আছে। কি করে যে আছে, কে জানে? খুব চাপা স্বভাবের মানুষ। কম কথা বলে। ধৈর্য্য প্রচুর। কিন্তু এত বড় দুঃসংবাদ জেনেও কোন প্রতিক্রিয়া থাকবে না, তাও তো অস্বাভাবিক। অনিরুদ্ধ কি কোন ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়েছে? ওদের বাড়িতে কথাটা জানাজানি হলে কি যে হবে,অনুমিতা জাস্ট ভাবতে পারছেনা।ওর মাকে বোঝানো, প্রায় অসম্ভব। অনুমিতার মা-বাবা দুজনেই বুঝবেন। অনিরুদ্ধর বাবাও। কিন্তু অনিরুদ্ধর মা হাউস ওয়াইফ। বাইরের দুনিয়ার সম্পর্কে উনার ধারণা সীমিত। ভুলটা যে দুই বাড়ির তরফ থেকেই হয়ে গেছে, একা অনুমিতাদের নয়, এটা উনাকে বোঝাতে অনিরুদ্ধকে বেশ বেগ পেতে হবে। অনুমিতা বুঝতে পারছিলো না, কিভাবে শাশুড়ি মায়ের সামনে কথাটা পাড়বে। নাকি সব দায়িত্ব অনিরুদ্ধকেই দিয়ে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয়। তলপেটটা ব্যথা করছে। বেশ ভারী হয়ে উঠেছে আজকাল। হবে না? তিনমাস হতে এল। অনুমিতা এখন একটানা বেশী হাঁটতে পারে না। অল্প হাঁফ ধরে। তাই ধীরে ধীরে যাতায়াত করে এখন। আগামী ছয় মাসও এভাবেই সাবধানে কাটাতে হবে, ডাক্তারবাবু বলেছেন। কথাটা মনে পড়তেই অনুমিতার মনটা মোচড় দিয়ে উঠল। অবান্তর চিন্তা। সাবধানতার দিন কালকেই শেষ হয়ে যাবে। অনুমিতার মা হওয়া এবারের মত আর হল না।
অনিরুদ্ধ আগেই ফিরে এসেছিল। অনুমিতা ফিরে দেখল, ফ্ল্যাটের কোলাপসিবেল গেট ভিতর থেকে তালা দেওয়া। গড়িয়ায় ভাড়ার ফ্ল্যাটে দুজনে থাকে। অনিরুদ্ধ যাদবপুরে লেকচারারশিপ করে। দর্শনের অধ্যাপক। অনুমিতা গড়িয়াতেই একটা উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের রসায়ন শিক্ষিকা। বছর দুয়েক বিয়ে হয়েছে। দেখাশোনা করে। অনুমিতার বৌদির দাদার বন্ধু অনিরদ্ধ। দুবছরে দুজনে দুজনকে জেনেছে, বুঝেছে, ভালবেসেছে। দুজনের যাতায়াতের সুবিধার জন্য অনিরুদ্ধর শ্যামনগরের বাড়ি থেকে উঠে এসে এখানে ফ্ল্যাট নিয়েছে। অনিরুদ্ধর মায়ের আপত্তি ছিলনা, তা নয়। তবে অনিরুদ্ধ মায়ের একমাত্র এবং আদরের ছেলে। ওর চাওয়ার ব্যাপারে খুব একটা না করতে পারেন না। বেল বাজাল অনুমিতা। অনিরুদ্ধ দরজা খুলে দিল। থমথমে মুখ দেখবে, আশা করেছিল অনুমিতা। কি আশ্চর্য অনিরুদ্ধ মৃদু হেসে দরজা খুলল। অনুমিতা কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছিলনা। নিজেকেই নিজের কাছে খুব ছোট লাগছিলো। ওর জন্য অনিরুদ্ধর স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে।
____ গরম পড়েছে খুব। বসার ঘরের পাখাটাকে জোরে দিতে দিতে বলল অনিরুদ্ধ।
____ হ্যাঁ, তুমি কখন এলে?
____ দুপুরেই ফিরে এসেছি। তেমন ক্লাস ছিল না। গ্লাসে করে অনুমিতাকে জল দিল অনিরুদ্ধ।
____ তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে অনু। টিফিন করেছ? নাকি না খেয়েই কাটিয়ে দিলে?
____ খেয়েছি। এতটা হেঁটে এলাম। তাই। এখন একটু হাঁটলেই হাঁফ লাগে।
____ যত্ন নাও। যাও, ফ্রেশ হয়ে এসো। অনিরুদ্ধ সোফায় বসে বলল।
____ তুমি এতটা শান্ত রয়েছ কি করে বলতো? অবাক চোখে তাকাল অনুমিতা।
অনিরুদ্ধ হাসল। কষ্টের হাসি মনে হল অনুমিতার।
____ তা নাহলে কি করব? সত্যিটাকে মেনে নিতেই হবে। ভুল যখন হয়েই গেছে, তার শাস্তি পেতেই হবে।
____ ভুল?
অনিরুদ্ধ চোখ থেকে চশমা খুলল।
____ হুম। ভুলই। শিক্ষিত হয়েও আমরা শিক্ষার প্রয়োগ করতে পারিনি। প্রি- ম্যারিটাল চেক আপ করে নেওয়া জরুরী জেনেও আমরা করাইনি।করালে আজকে এই দিন দেখতে হতনা।
____ বিয়েটাই খুব ভুল হয়ে গেছে, বল?
অনিরুদ্ধ অনুমিতার অভিমান বুঝল।
____ আমি তা বলিনি অনু। যেহেতু আমাদের দেখেশুনে বিয়ে, তাই চেক আপ করিয়ে নেওয়াই শ্রেয় ছিল। দুজনেই থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার জানলে আমাদের কেউই বিয়েতে মত দিতাম না। ক্যারিয়ার নয় এমন কাউকে বিয়ে করাটাই তখন উচিৎ ভাবতাম।
____ যা হয়ে গেছে, তাকে নিয়ে আফসোস করা ছাড়া উপায় কি? অনুমিতা চোখ মুছল। একটা আশা ছিল, জানো? বেবি যদি থ্যালাসেমিক না হয়? এমনও তো হয়। কিন্তু আজকের অ্যামনিয়োসেন্টেসিসের রিপোর্টটাই সব গোলমাল করে দিল।
____ বরং বাঁচিয়ে দিল বল।
____ মানে? অনুমিতা অবাক হল।
অনিরুদ্ধ ওর পাশে এসে ওর হাতে হাত রাখল।
____ দেখ অনু, যদি তোমাদের স্কুলে থ্যালাসেমিয়ার স্ক্রিনিং দল না আসতো, আর তুমি যদি সেখানে রক্ত না দিতে, তাহলে আমরা জানতেই পারতাম না ছয় মাস পরে যে পৃথিবীতে আসছে, সে অসুস্থ। তাকে অজান্তে পৃথিবীতে এনে কষ্ট দিয়ে ফেলতাম। আমাদের দোষের বোঝা তাকে জীবন দিয়ে বহন করতে হত। তার থেকে জেনে গেছি, ভালই হয়েছে।
____ ডাক্তারবাবু বললেন, কালকেই অ্যাবোরশনের ডেট।
অনিরুদ্ধ অনুমিতার হাতে চাপ দিল।
_____ যা করতেই হবে, তাকে ফেলে রেখে লাভ কি? মিথ্যা মায়া বাড়িয়ো না অনু। কাল আমি ছুটি নিয়েছি। তোমার পাশে থাকব।
_____ মিথ্যা মায়া বলছ? আমি যে ওর মা। ওকে নিজের হাতে মেরে ফেলব?
অনুমিতার চোখ থেকে অঝোর ধারা বইছিল।
_____ সুস্থ জীবন যাকে দিতে পারবে না, তাকে এনে শাস্তি দেবে কেন? কষ্ট হলেও ওর ভালর জন্যই তোমাকে আমাকে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
_____ তোমার বাড়িতে কি বলবে?
_____ সত্যিটাই বলব।
_____ তোমার মা?
_____ কি আর বলবে? প্রথমে বুঝতে চাইবে না। পরে বুঝতে হবে।
_____ আমাকে দোষ দেবেন। শাপ-শাপান্ত করবেন।
অনুমিতার কথা ফেলতে পারল না অনিরুদ্ধ।
_____ হয়ত। তবে মাকে আমি বুঝিয়ে বলব, যে তোমার যতটা দোষ ততটাই আমার। না বুঝলে কি আর করব? সচেতনতার অভাবেই তো ভুগতে হচ্ছে সবাইকে।
_____ ডাক্তারবাবু বলছিলেন প্রায় ২৫% ক্ষেত্রে মা-বাবা দুজন বাহক হলেও বাচ্চা নাকি থ্যালাসেমিক হয় না? বলছিলেন কয়েক মাস বাদে আবার চান্স নিতে।
অনিরুদ্ধ ঘাড় নাড়ল, না- বাচক।
_____ আমিও নেটে দেখেছি অনু। তবে আমি এই জুয়োখেলায় আর যেতে চাই না। তোমাকে আবার এক নিদারুণ কষ্টের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন অভিপ্রায় আমার নেই। কি গ্যারান্টি আছে যে পরের বার সুস্থ সন্তান আসবে? না আসলে? আবার পরের বার? না, না। আমি এতে রাজি নই।
অনুমিতা বিহ্বল হয়ে গেল। তার মানে অনিরুদ্ধ চায় না, যে অনুমিতা আর মা হোক? অন্তত চেষ্টা করে দেখতে চায় অনুমিতা। ভাগ্যে থাকলেও তো থাকতে পারে।
____ তাহলে আমি কখনো মা হতে পারব না অনিরুদ্ধ? চেষ্টাও করব না?
_____ নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখ অনু। এই কয়েকদিনে নিজের কি অবস্থা করেছ সে খেয়াল আছে? তোমার শরীর মন কে বিপদে ফেলে, বারংবার কষ্ট দিয়ে সন্তান আসুক, আমি চাই না। বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করালে হয়ত বিয়েটাই হত না, কিন্তু বিয়ের দুবছর পরে, তোমাকে ভালবেসে ফেলার পরে, তোমার কষ্টের বিনিময়ে কোন কিছুই চাইনা আমি।
অনুমিতা কথা বলার ভাষা ছিল না। মিতবাক অনিরুদ্ধ এই প্রথম এত জোর গলায় ভালবাসার কথা বলল।
____ কিন্তু...
____ কোন কিন্তু নয়। কালকের কাজটা সেরে আসি। তারপর দুজনে মিলে তোমার মা হওয়ার খোঁজ শুরু করব। কেমন?
_____ মা হওয়ার খোঁজ? এই যে বললে, চেষ্টা করবে না?
_____ চেষ্টা করব না বলিনি তো? অনিরুদ্ধ হাসল। একটু অন্যভাবে করব, বুঝলে? আজ সুজয়ের মেয়েটাকে দেখলাম। দারুন ফুটফুটে হয়েছে।
_____ সুজয়দা এনেছিলেন নাকি?
_____ হ্যাঁ। শ্রীতমাও ছিল। দারুণ খুশি আছে ওরা। বাচ্চাটা এত কিউট কি বলব? তোমার ফোন পেয়ে মুড অফ ছিল। ওকে দেখেই সমাধান খুঁজে পেলাম।
অনুমিতা বুঝল অনিরুদ্ধ কি বলতে চায়। সুজয়দা শ্রীতমা বৌদি মাস ছয়েক আগে সৃজাকে দত্তক নিয়েছেন। এখন বছর খানেক বয়স মেয়েটার। অনুমিতা আগেও ওর ছবি দেখেছে। ফেসবুকে। খুব সুন্দর। পরীর মত।
____ অ্যাডপট করবে?
____ আপত্তি আছে?
____ আমার নেই। কিন্তু তোমার মা?
_____ মানবে না? এই তো? আমাদের সন্তানকে যাতে মানে, বোঝাবো। বুঝবে আশা করি। না বুঝলে কি আর করার আছে? সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। অসুস্থ কাউকে আনার থেকে, সুস্থ যে, তাকে অনাদরের জায়গা থেকে এনে আপন করে নেওয়াই শ্রেয়, কি বল?
অনুমিতা অনিরুদ্ধর বুকে মাথা রাখল। সায়েন্সের ছাত্রী ও। সায়েন্স না মেনে নেওয়া সিদ্ধান্তটা জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল বলে কষ্ট পাচ্ছিল। অঙ্কে ভুল হয়ে গেছে ভেবে চোখের জল ফেলছিল। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে ভুল হয়েই ভাল হয়েছে। না হলে ভালবাসার অঙ্কটা এ জীবনে মিলত না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন