সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা

সম্পাদকের কলম থেকে


প্রিয় পাঠকবৃন্দ,

আবার হৈ হৈ করে এসে পড়ল সৌকর্য ষষ্ঠ সংখ্যা।

শীত চলে গিয়ে বসন্ত কোন ফাঁকে উঁকি দিয়েছে, আর গাছে গাছে, পাতায় পাতায় তার হিন্দোল চুপিসারে বলে গেছে-- এসে গেছে এসে গেছে ঋতুরাজ, আবার জাগবে আমের মুকুল, ফুটবে কুঁড়ি, নতুন পাতায় জাগবে জীবনের বোল ... ফাগুন আবার দেখাবে ম্যাজিক, বনে বনে, মনে মনে...

আমরা ধরে রাখব তারি রেশ পত্রিকায় লেখায় লেখায় ছত্রে ছত্রে...

কিন্তু আমরা ভুলিনি, এক বিশাল তরুণ প্রজন্ম, এক মহান দেশপ্রেমের নতুন অঙ্গীকার নিয়ে রক্ত ঝরাচ্ছে ঠিক আমাদের পাশের দেশে, আমাদেরি ভাইবোন ছিনিয়ে আনছে ন্যায় বিচার, শাহবাগ চত্তরে, আমরা তুলে ধরেছি তার এক প্রামাণ্য দলিল।

এবারের মূখ্য কবি চৈতালি গোস্বামীর কবিতা অনেকদিন ধরে এদিকে ওদিকে দেখা যাচ্ছিল, আমরা তার ঘরানাটি এখানে উপস্থাপনের সুযোগ পেলাম, আমাদের স্থির বিশ্বাস, কেউই নিরাশ হবেন না।

এবারে বহু তরুণ ও প্রবীন কবির কবিতায় সাজালাম সৌকর্যের থালা, মূল বিষয় ফাগুন ও তার প্রভাব। সাহিত্যমানে, গভীরতায় ও মনোরঞ্জনে প্রতিবারের মত এবারেও কেউই হতাশ হবেননা।

প্রবীন প্রবন্ধকার ফাল্গুনী মুখার্জীর দোল সম্পর্কিত প্রবন্ধটি এক অনন্য দিশার সন্ধান দেবে বলেই মনে করি।

প্রাবন্ধিক শ্রীশুভ্র-এর শাহবাগের উপর লেখাটি, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সঠিক অবস্থানের কথা আপনাদের অবদিত করবে।

কবি বায়রণের কবিতার অনুবাদ এবার আপনারা পাবেন ইন্দ্রাণীর কলমে...যা এক অভুতপূর্ব স্বাদের কথা আপনাদের মনে করাবে।

মৌ দাসগুপ্তার গল্প এক নতুন সংযোজন এবারের সংখ্যায়, সন্দেহাতীত ভাবে নানান বৈচিত্র্যে এবারের সংখ্যা অন্যান্যবারের চেয়ে সম্পূর্ন এক ভিন্নস্বাদের গল্প নিয়ে এলো।

আশা রাখব, আপনাদের হাতে হাত রেখে, আমাদের পত্রিকা আরো বহু যোজন পথ হাঁটবার সাহস পাবে, সঙ্গে থাকবেন, পাশে থাকবেন......


অলমিতি, 


সম্পাদক
সৌকর্য





হোলি - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

নানা কথায় হোলি
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



দোল বা হোলি হিন্দুদের এক পবিত্র উৎসব । ভারতের সর্বত্র এই উৎসব পালিত হয় নানান রীতিতে , এমনকি বহির্ভারতে নেপালে বা ভারতীয় বংশদ্ভূতদের মধ্যে হোলি উৎসব পালনের রেওয়াজ আছে । হোলি উৎসবের পেছনে নানান পৌরানিক লোককাহিনি প্রচলিত আছে এর মধ্যে প্রধান ‘হোলিকা দহন’ কাহিনি । এই থেকেই হোলি কথাটির উৎপত্তি । বাংলায় আমরা বলি ‘দোলযাত্রা’ আর পশ্চিম ও মধ্যভারতে ‘হোলি’ । আমাদের অনেক ধর্মীয় উৎসবেই আঞ্চলিক লোক-সংস্কৃতি ও রীতির প্রভাব দেখা যায় । পূর্বভারতে প্রধান ধর্মীয় উৎসব দূর্গা পূজা , পশ্চিমে গুজরাটে ‘নবরাত্রি’ । বাংলার দূর্গা, সিংহবাহনা আর গুজরাতে দুর্গা শেরওয়ালি । বাংলার দোলযাত্রায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব রীতির প্রাধান্য , এখানে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম লীলার বার্তাই সঞ্চারিত হয় । মথুরা বৃন্দাবনের উৎসবেও এই রীতি ।

কিন্তু মধ্যভারত বা পশ্চিমভারতে বিষ্ণু ভক্ত প্রহ্লাদের কাহিনিই প্রাধান্যপায় । সেই পৌরানিক কাহিনিটি এই রকম । দৈত্যরাজ হিরন্যকশিপু ব্রহ্মার বরে বলীয়ান ছিলেন যে , সে যেকোন পশু বা মানুষের দ্বারা অবধ্য । ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হিরন্যকশিপু দেবলোক আক্রমণ করে, দেবলোক তার পরম শত্রু । কিন্তু হিরন্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ ভগবান বিষ্ণুর পরম ভক্ত । দৈত্যকুলে বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদকে হত্যা করার নানান ষড়যন্ত্র করে পিতা হিরন্যকশিপু । কিন্তু ব্যর্থ হয় ।

হিরন্যকশিপুর ভগ্নী হোলিকাও বরপ্রাপ্তা ছিল যে অগ্নি তাকে বধ করতে পারবেনা । সুতরাং হিরন্যকশিপু হোলিকার কোলে বালক প্রহ্লাদকে বসিয়ে আগুন লাগিয়ে দিল । দাউদাউ অগ্নিশিখার মধ্যে প্রহ্লাদ ভগবান বিষ্ণুকে স্মরণ করে । বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ অগ্নিকুন্ড থেকেও অক্ষত থেকে যায় আর হোলিকা পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় । হিরণ্যকশিপুকে ভগবান বিষ্ণু নৃশিংহ অবতার রুপে বধ করেন ।

রঙ উৎসবের আগের দিন ‘হোলিকা দহন’ হয় অত্যন্ত ধুমধাম করে । শুকনো গাছের ডাল , কাঠ ইত্যাদি দাহ্যবস্তু অনেক আগে থেকে সংগ্রহ করে সু-উচ্চ একতা থাম বানিয়ে তাতে অগ্নি সংযোগ করে ‘হোলিকা দহন’ হয় । পরের দিন রঙ খেলা । বাংলাতেও দোলের আগের দিন এইরকম হয় যদিও তার ব্যাপকতা কম – আমরা বলি ‘চাঁচর’ । এই চাঁচরেরও অন্যরকম ব্যাখ্যা আছে । দোল আমাদের ঋতুচক্রের শেষ উৎসব । পাতাঝরার সময় , বৈশাখের প্রতিক্ষা। এই সময় পড়ে থাকা গাছের শুকনো পাতা, তার ডালপালা একত্রিত করে জ্বালিয়ে দেওয়ার মধ্যে এক সামাজিক তাৎপর্য খুঁজে পেতে পারি । বাংলায় দোলের আগের দিন ‘চাঁচর’ উদযাপনকে এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয় ।

অঞ্চল ভেদে হোলি বা দোল উদযাপনের ভিন্ন ব্যাখ্যা কিংবা এরসঙ্গে সংপৃক্ত লোককথার ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু উদযাপনের রীতি এক । ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন পূর্বভারতে আর্যরা এই উৎসব পালন করতেন । যুগেযুগে এর উদযাপন রীতি পরিবর্তিত হয়ে এসেছে । পুরাকালে বিবাহিত নারী তার পরিবারের মঙ্গল কামনায় রাকা পূর্ণিমায় রঙের উৎসব করতেন ।

দোল হিন্দু সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন উৎসব । নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ ও ‘জৈমিনি মিমাংশা’য় রঙ উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায় । ৩০০ খৃষ্টপূর্বাব্দের এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক ‘হোলিকোৎসব’পালনের উল্লেখ পাওয়া যায় । হর্ষবর্ধনের নাটক ‘রত্নাবলী’তেও হোলিকোৎসবের উল্লেখ আছে । এমনকি আলবিরুণীর বিবরণে জানা যায় মধ্যযুগে কোন কোন অঞ্চলে মুসলমানরাও হোলিকোৎসবে সংযুক্ত হতেন । মধ্যযুগের বিখ্যাত চিত্রশিল্পগুলির অন্যতম প্রধান বিষয় রাধা-কৃষ্ণের রঙ উৎসব ।

উদযাপনের রীতি রেওয়াজে ভিন্নতা থাকলেও দোল বা হোলির মূল সুরে কোন ভিন্নতা নেই তা হলো রবীন্দ্রনাথের গানের কথায় -
“রাঙ্গিয়ে দিয়ে যাও যাও যাওগো এবার যাবার আগে
তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে,
তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে,
অশ্রুজলের করুণ রাগে ......
মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ্র জাগে,
তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও
যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে
কাঁদন-বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে” ।।

তবে অন্য অনেক উৎসবের মত হোলিতেও অনেক নষ্টামি দেখা দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়কালে । অন্ধের মত গাছ কাটা হয় । মধ্যভারতে চাকুরী সূত্রে দীর্ঘদিন বসবাসের সুবাদে দেখেছি। দেখেছি রেল কোয়ার্টারের জানালা পর্যন্ত খুলে হোলিকা দহনের আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর বিষাক্ত রঙের কারণে চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়া তো প্রতি বছরই হয় । সেসম্পর্কে আমরা সতর্ক থাকি । কিন্তু সেই সব নষ্টামি হোলি বা দোল উৎসবের যে পবিত্র বার্তা, পারস্পরিক ভালোবাসার যে বার্তা তা কিছুমাত্র লঘু হয়ে যায়না। উৎসবের পবিত্রতার দিকটিই আমাদের গ্রহণীয় ।

শাহবাগ প্রত্যয় ও ভবিষ্যৎ! - শ্রীশুভ্র

শাহবাগ প্রত্যয় ও ভবিষ্যৎ!
শ্রীশুভ্র



বাংলাদেশ জ্বলছে! মানুষ মরছে! সাধারণ নিরীহ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত! সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর জামাত ও জামাত পন্থীদের আক্রমণ অব্যহত! রাষ্টীয় প্রশাসনিক দূর্বলতাগুলি ক্রমেই প্রকট হচ্ছে! ইসলামের নামে হুঙ্কার তুলে জামাত ও শিবির ঝাঁপিয়ে পড়েছে সহিংস্র আন্দোলনে! লক্ষ্য তাদের প্রগতিশীল গণজাগরণ মঞ্চ! লক্ষ্য তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনকে প্রতিরোধ করা! লক্ষ্য তাদের রাজাকারদের বিচার প্রক্রিয়া বানচাল করে সাজাপ্রাপ্ত কুখ্যাত রাষ্ট্রদ্রোহী জামাতি নেতাদের মুক্ত করে আনা! লক্ষ্য তাদের শাহবাগ প্রজন্ম! শাহবাগ প্রজন্ম জাতির কণ্ঠে যে সাহস যুগিয়েছে, তাকে অঙ্কুরেই খতম করা!

শাহবাগে রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে গণঅবস্থান সারা বাংলাদেশে অভুতপূর্ব সাড়া ফেলে দিয়েছে! ৪২ বছর ধরে জাতির অন্তরে দেশদ্রোহী পাকপন্থী এই নৃশংস রাজাকারদের প্রতি পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, এই প্রজন্মের এই আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তির একটা প্রশস্ত রাজপথ খুঁজে পেয়েছে! প্রধানত প্রথাগত রাজনীতির বাইরে সাধারণ নাগরিক মঞ্চের এই আন্দোলন দলমত নির্বিশেষে মানুষকে রাজাকারদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে একত্র করতে সফল হয়! অধিকাংশ মানুষই মনে করেছিলেন এই আন্দোলন তাঁরও আন্দোলন! ধৃত রাজাকারদের ফাঁসিই, ৪২ বছর আগে ঘটে যাওয়া নরমেধ যজ্ঞের সঠিক বিচার! সারা দেশের জনমানুষের অধিকাংশই এই বোধ থেকেই এই আন্দোলনের সাথে পা মেলাতে পথে নামেন!

শাহবাগ আন্দোলনের শুরুতে মূল সংগঠক এক্টিভিস্ট ব্লগারদের বেশিরভাগই বাম রাজনীতির সমর্থক হওয়ায় তাঁদের এই আন্দোলনের একটা অভিমুখ ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জামাতের মধ্যে গোপন রাজনৈতিক সমঝতার সম্ভাবনার বিরুদ্ধে! কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের রায়ে জামাত-ই ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়াটাকে এই ব্লগার এক্টিভিস্টরা ঐ দুইদলের বোঝাপরার ফল বলেই সন্দেহ করেন! কাদেরকে মৃত্যুদণ্ড থেকে এই রেহাই দেওয়াটা আওয়ামী লীগের নিরপেক্ষতার প্রতি তাঁদের যথেষ্ট সন্দিহান করে তোলে! এবং সাম্ভব্য এই বোঝাপরার বিরুদ্ধেই জনমত গঠনে তাঁরা কাদেরের ফাঁসির দাবীতে সোচ্চার হন শাহবাগে!

এদিকে আগামী নির্বাচনের আগে বিভিন্ন প্রশাসনিক অদক্ষতা, দূর্বলতা; স্বজন পোষণ; সরকারের সর্বস্তরে অবাধ দূর্নীতি এবং আওয়ামী লীগ ও বিশেষ করে তার ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের লাগামছাড়া দৌরাত্ম্য প্রভৃতি কারণে জনমানসে আওয়ামী লীগ বেশ কোণটাসা হয়ে পড়েছিল! বিরোধীরা সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আগামী নির্বাচনে তাদের পালে জনসমর্থনের হাওয়া টানতে বেশ অনেকটাই ফাঁকা ময়দান পেয়ে যাচ্ছিল! শাহবাগের এই আন্দোলন লীগের সামনে এনে দিল সুবর্ণ সুযোগ! লীগ নেতৃত্ব অত্যন্ত সুকৌশলে ছাত্রলীগকে এই আন্দোলনে সামিল করতে সফল হলেন! তাঁদের কাজটা সহজ হয়ে যায় আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ব্লগারদের একটা অংশের সাথে ছাত্রলীগের কিছু নেতার সৌহার্দ্য থাকায়!

এই সময়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন প্রজন্মের এই আন্দোলনের প্রতি তাঁর আবেগ ও সহানুভুতি প্রকাশ করায় আওয়ামী লীগের পক্ষে শাহবাগের নতুন প্রজন্মের এই আন্দোলনকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থের অনুকূলে টেনে নেওয়া আরও সহজ হয় খুব দ্রুততার সাথে! ফলে বামপন্থী মনোভাব সম্পন্ন আন্দোলনকারীরা কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যেতে বাধ্য হয়! আন্দোলনের পুরোধায় চলে আসে সরকারপন্থী জনসমর্থন! আর তখনই কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবির সাথে যুক্ত হয়ে যায় সব রাজাকারের মৃত্যুদণ্ডের দাবি! শুরু হয় জামাত নিষিদ্ধকরণের স্লোগান! রাজনীতি থেকে ধর্মীয় দলগুলির অপসারণ সহ সংবিধানে "রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম" বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে প্রজন্ম চত্বর!

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটা মূল লক্ষ্যই ছিল ধর্মনিরপেক্ষ গণপ্রজাতন্ত্রী সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের! কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে সাথেই সেই লক্ষ্যকে কবরে পাঠিয়ে দেন জিয়া! পরে এরশাদ এসে সংবিধানে বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করেন! বিগত ৪২ বছরে বাংলাদেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই লক্ষ্যের হত্যার সাথে দেখেছেন কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পাকপন্থী মৌলবাদীরা রাতারাতি সরকারি বদান্যতায় ফুলে ফেঁপে উঠে এক একটা কেষ্টবিষ্টু হয়ে বসেছেন সমাজের মাথায়! তাঁদের এই অবদমিত ক্ষোভই যেন মুক্তি পেয়েছে শাহবাগে নতুন প্রজন্মের এই আন্দোলনের ভাষায়! এটাই আজকের গণজাগরণের ভিত্তি!

বাংলাদেশে বিগত ৪২ বছরে মানুষ স্বৈরাচারী সামরিক শাসন আর রাজনৈতিক দলগুলির দূর্নীতিগ্রস্ত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করে ভিতরে ভিতরে ক্ষোভের বারুদ জমিয়ে তুলেছে! তারা অসহায় ভাবে প্রত্যক্ষ করেছে কিভাবে দেশটাকে পাকপন্থী রাজাকাররা মৌলবাদী মোল্লাতন্ত্রের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলেছে! কিভাবে জামাত সমাজের সকল স্তরে মৌলবাদের জ্বাল বিছিয়েছে! তারা ইসলামিক ব্যাঙ্ক গঠন করা থেকে শিল্পবাণিজ্যে প্রবেশ করেছে!

জামাতের লোকেরা প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায় থেকে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে নিয়েছে! ফলে একদিকে দূর্নীতি আর একদিকে জামাতের বারবড়ন্ত সাধারণ জনগনের একটা বড় অংশকেই ক্ষুব্ধ করে তুলেছে সেখানে!

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে দুটি ঘটনা সমান্তরাল ঘটেছে! একদিকে শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ প্রাপ্ত এক শ্রেণীর জনগণের মধ্যে ধর্মীয় সংস্কারের আবদ্ধতা থেকে মুক্তি এবং বাঙালি জাতীয়তার উন্মেষের প্রকাশ ঘটেছে ব্যাপক হারে! অন্যদিকে আর এক শ্রেণীর মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনায় বাঙালি জাতীয়তার বিপক্ষে ইসলামিক জাতীয়তাবোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দ্রুত! স্বভাবতই জামাত ও বিভিন্ন ইসলামিক দলগুলি বাংলাদেশের এই বিরাট অংশের ইসলামীকরণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করেছে! এর ফলে আজকের বাংলাদেশে একটি সুস্পষ্ট বিভাজনের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে! বাঙালি জাতীয়তার প্রবক্তারা সবকিছু ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে! আর গোঁড়া ইসলামীরা এদের ইসলামের শত্রু বলে মনে করে!

শাহবাগে অবস্থানরত গণজাগরণ মঞ্চকে ঘিরে এভাবেই বাংলাদেশ আজ পরস্পর বিরোধী দুই শিবিরে বিভক্ত! একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ নবজাগ্রত বাংলা- নতুন প্রজন্মের হাত ধরে উন্নত ভবিষ্যতমুখী আশায় স্বপ্ন বুনছে নতুনদিনের, স্লোগানে গানে কবিতায় মানববন্ধনে!

অন্যদিকে গোঁড়া মৌলবাদী ইসলামিক চেতনায় বিশ্বাসী যারা, তারা বাংলাদেশকে ধর্মীয় অনুশাসনে পরিচালনা করার মধ্যে দিয়েই ইসলামের আদর্শ সুরক্ষিত করতে উৎসাহী! ফলত প্রধান দুই রাজনৈতিক দল এখন এই দুই শিবিরের মধ্যেই তাদের ভোট ব্যাঙ্ক গুছিয়ে নিতে ব্যাস্ত! এরই প্রেক্ষিতে শাহবাগের আন্দোলনের অভিমুখ নির্ধারিত হতে বাধ্য! ফলে এই অরাজনৈতিক আন্দোলন আজ আর অরাজনৈতিক নেই!

সাধারণ মানুষ যদিও সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিয়ে দেশকে রাজাকার মুক্ত করা ও রাজনীতি থেকে ধর্মীয় দলগুলিকে দূর করতে এই আন্দোলনে শামিল হন! কিন্তু একদিকে যেমন আওয়ামী লীগ সুকৌশলে এই আন্দোলনকে দলীয়স্বার্থের সাথে যুক্ত করে ফেলে অন্যদিকে প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি জামাতের পক্ষ নিয়ে আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়! ফলে রাজনীতি নিরপেক্ষ মানুষরা আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্নতা বোধ করতে থাকেন! ফলত বর্তমানে আওয়ামী সমর্থকরা শাহবাগ আন্দোলনের সাথে যেমন সম্পৃক্ত তেমনি আওয়ামী বিরোধীরা আন্দোলনের বিরুদ্ধে যুক্তি শানাতে উদ্যত! মাঝখান থেকে আন্দোলনকে ব্যর্থ করতে জামাতের পক্ষে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বিভাজন!

ঠিক এই রকম পরিস্থিতিতেই শাহবাগের গণ আন্দোলনকে ব্যর্থ করতে জামাত ও জামাত পন্থী অন্যান্য ইসলামিক দলগুলি বিশেষ করে ইসলামিক ছাত্রশিবির সহ শাহবাগ বিরোধী গোষ্ঠী সব রকম বিধ্বংসী কার্যকলাপ শুরু করেছে সারা দেশ জুড়ে! শাহবাগ আন্দোলনের প্রায় শুরুতেই আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা ব্লগার রাজীব হায়দারকে এই বিরোধী গোষ্ঠীরই অজ্ঞাত পরিচয় দূর্বৃত্তদের হাতে খুন হতে হয় নৃশংস ভাবে! এই খুনের জের ধরে আমার দেশ পত্রিকায় রাজীবের নামে ইসলাম বিরোধী কুৎসা ছড়ানোর অভিযোগ প্রচার করা হয় সফল ভাবে! এর ফল হয় মারাত্মক! জামাত পন্থীরা দেশের বৃহত্তর মুসলিম সমাজে প্রচার করতে থাকে, শাহবাগের আন্দোলন ইসলাম বিরোধী নাস্তিকদের এক চক্রান্ত!

ফলে ধর্মপ্রাণ ধর্মভীরু মুসলিমদেরকে শাহবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে নিয়ে আসার জন্যেই শাহবাগ আন্দোলন ইসলাম বিরোধী নাস্তিকদের ষড়যন্ত্র বলে আমার দেশ সহ জামাত পন্থী কাগজগুলি প্রচার করতে থাকে! এদের প্রচারের মুখ্য অভিমুখ হল রাজাকারদের ফাঁসির দাবি করছে যারা তারা নাস্তিক এবং ইসলাম বিরোধী! ভারতের র-ই নাকি এই আন্দোলনের পিছনে কলকাঠি নাড়ছে! এই প্রচারের দুইটি সুবিধে - এক, আন্দোলনের পক্ষ থাকা অনেকের ইসলামিক আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে তাদের সন্দিহান করে তোলা! এবং দুই, মৌলবাদী জঙ্গী মনোভাবাপন্ন যুবশক্তিকে ক্ষিপ্ত করে তোলা! শাহবাগ আন্দোলনকে এভাবেই দূর্বল করে দিতে অগ্রসর হয় জামাতের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম!

এই আন্দোলনের সাথে আঃলীগের সংযুক্তিকে অনেকেই ভালো ভাবে মেনে নিতে পারেননি! বিশেষত বিএনপির সমর্থকরা! কিন্তু প্রাথমিক ভাবে শাহবাগের পাশে এরা অনেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন নৈতিক সমর্থন নিয়ে! এদিকে বিরোধী জোট অত্যন্ত সুকৌশলে তাদের ইসলামিক তাস খেলে শাহবাগ আন্দোলনকে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ বনাম ইসলামের সংঘর্ষের রূপ দিতে উঠেপড়ে লেগেছে! ইতিমধ্যেই এর সুফল ফলতে শুরু করেছে! একদল যেখানে রাজাকার মুক্ত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী আধুনিক বাংলাদেশের জন্য শাহবাগকে কেন্দ্র করে সারা দেশে গণজাগরণের ঢেউ তুলেছে! অন্যপক্ষ তখন এইটিকে ভারতের গোপন ষড়যন্ত্রের ফলে ইসলাম বিপন্ন প্রচার করে দেশের জনগণকে মৌলবাদী শক্তির পক্ষে ধরে রাখতে চায়!

বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া, স্বাধীনতা ও ইসলামকে পরস্পর বিরোধী ভূমিকায়- মুখোমুখি এনে দাঁড় করানোর জন্য আঃলী ও শাহবাগ আন্দোলনের নেতৃত্বকে অভিযুক্ত করেছেন! জামাত শিবির প্রচার করছে আঃলী রাজনৈতিক বিদ্বেষ বশত রাজাকারদের বিচারের নামে তাদের নেতাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে! এর মধ্যে দেশবাসীকে নাস্তিক ও আস্তিকের বিভাজনে বিভক্ত করতে আমারদেশের মতো কাগজগুলি যথেষ্ঠই সফল! ফলে শাহবাগে প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণ আন্দোলন বিপুল প্রতিকুলতা ও প্রতিরোধের সম্মুখীন! আশ্চর্যের বিষয় এর মধ্যেও এই আন্দোলনকারীরা তাদের প্রত্যয়ে অটল থেকে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সারা দেশে!

২৮শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের সাম্প্রতিকতম রায়ে কুখ্যাত রাজাকার হোসেইন দেলোয়ার সাঈদীর ফাঁসির ঘোষণায় জামাত শিবির ও অন্যান্য মৌলবাদী জঙ্গি শক্তিগুলি সারা দেশে যে সহিংস্র ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে তাতে এযাবৎ শতাধিক মানুষ প্রাণ দিয়েছেন! সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর শুরু হয়েছে অত্যাচার! উদ্দেশ্য পরিষ্কার! সারাদেশে একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে দিতে পারলে শাহবাগ আন্দোলনের মুখ ঘুরে যেতে বাধ্য! তাদের অন্যতম লক্ষ্য আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থক থেকে নেতাদের প্রাণনাশ! এই সুযোগে জামাত শিবির সারা দেশের জনজীবন স্তব্ধ করে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে সাধারণ মানুষকে! এভাবেই তারা শাহবাগকে ব্যর্থ করতে বদ্ধ পরিকর!

দেশের এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে জামাত শিবিরের সহিংস তাণ্ডবলীলার মধ্যে প্রধান বিরোধীদল বিএনপির জামাতের পক্ষ নেওয়ায় দেশ আজ স্পষ্টতই দুই ভাগে বিভাজিত! একপক্ষ বাংলাদেশ বাঙালি জাতীয়তার পক্ষে আর অন্যপক্ষ ইসলামিক জাতীয়তার পত্তনে বদ্ধপরিকর! এখন এই দুই পক্ষের গোলমালে রাজাকারমুক্ত দেশ গঠনের আন্দোলনের ভবিষ্যৎ খুবই জটিল হয়ে পড়ছে! এখানেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির শর্তাবলী বিশেষভাবে নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে! দেশের অভ্যন্তরে জামাত নিষিদ্ধকরণের যে দাবি উঠেছে বৃটেন ইতিমধ্যেই তার বিরুদ্ধে মত ব্যক্ত করতে বলেছে তারা নিষিদ্ধ করা সমর্থন করে না! মনে রাখতে হবে এই বৃটিশ মার্কিণ জোটই সারাবিশ্বে মৌলবাদী সংগঠন নিষিদ্ধ করে বেড়ায়!

মৌলবাদী সংগঠন জামাতের বাড়বাড়ন্তে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী দেশবাসী বিক্ষুব্ধ সন্ত্রস্ত! তারা অনেকেই মনে করছেন জামাতকে নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশে একে অতীত করে দেওয়ার এই এক সুবর্ণ সুযোগ এসেছে! তাই তারা শাহবাগের গণজাগরণকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলছেন! মুক্তি পাকপন্থী রাজাকার ও তাদের উত্তরসুরিদের থেকে! মুক্তি মৌলবাদী অপশক্তির সন্ত্রাস থেকে! মুক্তি ধর্মীয় গোঁড়ামীর মধ্য যুগীয় মানসিকতা থেকে! গত দুই মাসের জামাতী নাশকতা তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণার পক্ষে যথেষ্ঠ বলেই মনে করছেন দেশবাসীর এই অংশ! উল্টদিকে জামাতের শিকড় সমাজদেহের অনেক গভীরেই প্রবেশ করেছে! ফলে নিষিদ্ধ ঘোষণাই সমাধান আনবে না বলে মনে করেন অনেকেই!

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থনে জয়ী হয় প্রধানত দুই কারণে! এক বিএনপির বিদায়ী সরকারের ব্যাপক দূর্নীতি আর যুদ্ধপরাধীদের বিচার করার শপথ দেওয়া! ফলে প্রতিশ্রুতিমত বিচার সংঘটিত না করে কোনো উপায়ও ছিল না, বিশেষ করে তাদের এই সরকারেরও ব্যাপক দূর্নীতি চাপা দিতে! তবুও বর্তমান সরকার জামাত নিষিদ্ধ করতে এখনো অপারগ কারণ বৃটেন ও মার্কিণ প্রশাসন থেকে কোনো সবুজ সংকেত আসেনি! বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর বাংলাদেশ পুরোপুরি মার্কিণ পকেটে চলে যায়! ফলে বাংলাদেশের মতো দূর্বল দেশগুলিতে মার্কিণস্বার্থ যেভাবে মৌলবাদের পোষকতা দিয়ে চলে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যাতিক্রম হয়নি এযাবৎ! তাই সরকারেরও হাতপা বাঁধা!

গত চার দশক ধরে বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তিগুলি পুষ্ট হয়েছে মার্কিণ বরাভয়ে আর পেট্রোডলারের সৌজন্যে! দীর্ঘ সামরিক শাসনকালে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিগুলো সংহত হয়ছে জিয়া ও এরশাদের ছত্রছায়ায়! আর সেই কারণেই বিএনপির শাসনকালে জামাতের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে দ্রুত! ফলে আজকে জামাত বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নির্নায়ক শক্তি! যার ওপর মার্কিণ আশীর্বাদ থাকায় এই বীভৎস তাণ্ডব লীলা চালাতে পারছে নিশ্চিন্তে! আর ঠিক এইখানেই হাসিনা সরকারও জামাতের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে অপারোগ! তাঁর দলেও যে জামাতপন্থী নেই তা নয়! ফলে জামাতের এই সহিংসতা আর বিএনপির সক্রিয় বিরোধিতার মধ্যে শাহবাগের গণজাগরণ কতটা সফল হবে বলা শক্ত!

শাহবাগের গণজাগরণের এই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে নতুন প্রজন্ম জয়ী হবে কিনা ভবিষ্যতই বলবে! কিন্তু তারা জানে ৭১এর মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার সক্রিয় বিরোধিতা সত্ত্বেও স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ! যদিও তখন বিশ্বশক্তির ভারসাম্যে ভারতের পক্ষে সম্ভব হয়ে ছিল মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করা! আজকের পরিবর্তীত বিশ্ববন্দোবস্তে তা আর কখনোই সম্ভব নয়! তাই নতুন প্রজন্মের পক্ষে কাজটা বড়োই কঠিন! তাদের এই গণজাগরণকে তাই সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে! দেশের সর্বত্র মৌলবাদী শক্তিকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে জনগণ থেকে! একমাত্র তবেই হয়তো সম্ভব লক্ষ্য পৌঁছানো! নতুন প্রজন্ম আপোষহীন প্রত্যয়ে সেই লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারলে মুক্ত হবে দেশ মৌলবাদ থেকে!

পাঁচটি কবিতা - চৈতালী গোস্বামী

পাঁচটি কবিতা
চৈতালী গোস্বামী


কাফেরের কৈফিয়ৎ


কাফের চাইছ ডাকতে আমায়?
মনের ভিতর ভিন্ন সমাজ গড়ছি বলে?
তোমার বসন্তে সন্ন্যাসিনী সেজে
নিজের সাথেই হোলি খেলব এইবার।

তোমাকে সংস্কার শত বুঁদ করে রাখ
বেঁধে রাখ আষ্টে-পৃষ্টে চিরকাল
আমার বুকে আরো স্পষ্টতর হোক
প্রথম আলোয় অচিন পাখির ডাক।

অস্ত যেতে যেতে সূর্য যে বৈরাগ্য দিয়ে যায়,
আমি সেই রং দেখেছি জানালায়।
আয়নায় সব রঙকে দেখেছি রাজকীয় হয়ে যেতে
তোমার জীবন বৃথা সাদার সাথে খুঁজে মরুক কালো দাগ।


এখনও ভালবাসার কথা বলি


এপাশ ওপাশ করলে চামড়া কাঁটায় চিরে যায়
পেটে বুকে আগুন জ্বলতে থাকে
খাট, চারপাই চিতার মত ঝলসে দেয় রাতে
প্রার্থনার শব্দগুলি জন্ম নিয়েই মিলিয়ে যায় বাতাসে
তবু ভালবাসার কথা বলি
দেখি তারারা অসম্ভব স্নেহ নিয়ে নির্নিমেষ জ্বলছে
নাগালে পাব না তবু এক সুগন্ধি শরীর আমায় টানে।
জানি না গাছের শিকড় বেয়ে কোন বোধ গভীরে প্রবেশ করে।
প্রতিদিন রাত্রি আমায় বয়ে নিয়ে যায়।
ঠিক সেখানে যেখানে সূর্য ওঠার সীমানা....


শিরোনামহীন কবিতা


ওরা আমার রক্তের উচ্চারণ
ফেনিল সমুদ্রের বুকে
মান্দাসে ভেসে যেতে যেতে
বুকে মেখে নিই
সমৃদ্ধ উত্তাপ
ক্ষয়ের বিন্দুগুলি সংগ্রহ করে মালা গাঁথি।
অন্ধকারে ওরা মশালের মত বিচ্ছুরিত হয়।
পাহাড়ের মূক ভাঁজে
ওরা শান্ত নদীর তিরতির
কখনো স্তব গুম্ফায় ঘন্টার
মন্দ্র আন্দোলন
এ এক নির্জন ভালবাসা।
এ নির্জনে নিজেকে ভালবাসা।
জোয়ার-ঝঞ্ঝা-ঘূর্ণিবাতে অবিরত কেন্দ্রের দিকে চলা...



ছন্দ

সবকিছুর একটা নিজস্ব ছন্দ আছে
তীক্ষ্ণ চিৎকারে সেটা ভেঙে যায়
পিয়ানোতে আঙুল রেখ সন্তর্পণে
সুর একবার কাটলে মেলাতে কষ্ট হয়

মেঘগুলো ধীরেসুস্থে ভেসে বেড়ায়
মৃদু মাথা নাড়ে বাগানের ফুল, পাতা
দিনগুলি বড় মনে-পড়বার দিন
সামনে ছড়িয়ে পূর্ণ শূণ্যতা।

মাঝরাতে নদীর বুকে মস্ত চর জাগে
চরের বুকে বালি
আজ রাতে ওই চরে দমকা বাতাস এল
ঢেউয়ের মাথায় যত ছন্দ দুলছিল, থেমে গেল।
পাড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে মিশল নদীতে...

কে কার প্রতিদ্বন্দী আজ?
স্মৃতি না স্মৃতি-বিজড়িত রাত
মাঝপথে ছন্দ হারালে খেই হারিয়ে যায়...

দমকা বাতাস পায়ের চিহ্ন মুছে দিয়েছে প্রায়
সামান্য জোৎস্না সম্বল করে জেগে
একা জেতা-হারার অর্থ দেখি না কিছু
মাঝরাতে আমার সাথে নদীও ছিল জেগে

আমার সাথে নদীও দেখেছে তার উদাস চলে যাওয়া...



রূপক

মেঘের বুকে কালো ঘোড়া ছুটিয়েছিল কেউ।
রূপবান মেঘেরা আর আগের মত নেই।
কেমন যেন দলা পাকিয়ে গেছে সব।
পায়ের আঙুলগুলোও কেটে ফেলেছে তারা।
তাইতো এক্কা-দোক্কার ঘুঁটি আর
পরের খোপ-কাটা ঘরে ছোঁড়া হ’ল না...

নিয়ত হীমঘুমে থাকা আত্মা
আর ঝাঁপ দেবে না করিডোর ভেঙে।

তবু ভয় করে।

সমুদ্রের কাছে এসে গুটি-সুটি বসে আছি,
বিড়ালের মত।
নখ থাবার মধ্যে,
যেমন তরবারি রাখা থাকে,
খাপের ভিতর...

জল বড্ড গভীর।
পাড়ে বসেই বুঝতে পারি—
জল টানে।
কতটা টানে
আর টানে কোন কোন পথে...

অনুবাদ কবিতা - ইন্দ্রানী সরকার


She Walks in Beauty
Lord Byron


She walks in beauty, like the night
Of cloudless climes and starry skies;
And all that's best of dark and bright
Meet in her aspect and her eyes:
Thus mellowed to that tender light
Which heaven to gaudy day denies.

One shade the more, one ray the less,
Had half impaired the nameless grace
Which waves in every raven tress,
Or softly lightens o'er her face;
Where thoughts serenely sweet express,
How pure, how dear their dwelling-place.

And on that cheek, and o'er that brow,
So soft, so calm, yet eloquent,
The smiles that win, the tints that glow,
But tell of days in goodness spent,
A mind at peace with all below,
A heart whose love is innocent!




সে সুন্দরভাবে হেঁটে যায়

লর্ড বায়রন


ও কেমন হেঁটে চলে যায় নির্মল আকাশ
আর নক্ষত্রখচিত রাত্রির মত |
উজ্জল কাজল কালো তার চোখের দুটি তারা
নরম আলোয় ঝকঝকে দিনকেও হার মানায় |

আলো আঁধারিতে তার কালোচুলে
সৌন্দর্য্যের ঢেউ খেলে যায় অথবা
তার মুখের উপর ঝিলমিল করে |
তার পবিত্র সুন্দর চিন্তাগুলি মনের
মধ্যে কেমন আনাগোনা করে |

তার নরম গাল আর চোখের পাতা শান্ত অথচ
কত কিছু কথা বলে যায় |
সেই হাসি, সেই গালের রক্তিম আভা
বিজয়ীর মত সুন্দর দিনের আভাস দিয়ে যায় |
এক শান্ত মন যার মাঝে এক নিস্পাপ
ভালোবাসায় ভরা হৃদয় বসবাস করে |

কবিতা - অলকেশ দত্তরায়

প্রেম, ২০১৩
অলকেশ দত্তরায়


।১।
ব্যস, আর কিচ্ছু বলবার দরকার নেই।
তোমার ভালবাসা, আমার বার্ধক্য,
প্রজন্মের জোয়ারে নতুন সমুদ্রের বালির সেফটি নেটে
প্রস্তর কুড়াবার সময় হল।
- হে ইউ! নারী-পুরুষ-উভ-বাদী দর্শক, এবার অবগুন্ঠন খোলো, প্লিজ –

।২।
থ্যাঙ্ক ইউ !
এখন প্রেমের কবিতা লেখার সব উপকরণ আমার হস্তসম্মুখে।
নতমস্তকের নারী
অম্লান ধর্ষণকারী পুরুষ
বীরপুঙ্গবদের পশ্চাতদেশ
রুদ্ধদ্বার দৈহিক মিলনের ডিসপ্লে
অনাবিল সৌন্দর্য নিয়ে প্রতীক্ষার ছেনালি শব্দগুচ্ছ ইত্যাদি ইত্যাদি ...
যেহেতু কারফিউ ঘোষীত নগরীর নটী অভিসারে এখনও চলছেন / চলবেন
সুতরাং অবদমিত-সহানুভুতিশীল-গরিমায়
ইউ আর মাই ড্রিমম ওয়েকাপম।

কবিতা - কচি রেজা

ঢাকা, এই ফাগুনে
কচি রেজা


ঢাকা,আগুন,আগুন, আগুনে বাস পোড়ে, আমি কোথাও যেতে পারি না
ঢাকা, হরতাল,হরতাল, হরতালে স্কুল বন্ধ, আমি পরীক্ষা দিতে পারি না
ঢাকা, জেলখানা, মানুষের সাথে জিম্মি জল ও বাতাস
পৃথিবীর সেরা শহর ছেড়ে, ঢাকা, তুমি সেরা শহর আমার কাছে
আমি সেরা শহরে এসেছি,
শ্রেষ্ঠ গোলাপের ঘ্রাণ তোমার গায়ে, শ্রেষ্ঠ ফাগুন তুমি, এমন কোথাও শুঁকি নি
অনিমেষ চোখের আকাশ তোমার , কোথাও এমন দেখি নি
এ- মাটিতে আমার মা মিশে আছে,মিশে থেকে জন্মাবো আমিও,
মা,মায়ের মেয়ে আর প্রেমিকা হব আবার
ঢাকা, তোমার ঘন অলিগলি, ধূলো, ফেরিওয়ালা চটপটি,বাখরখানি ভালবাসি
পথে যেতে যেতে মানুষের পায়ের চাপে নিজের পা থেতঁলে গেলেও
আমি তোমাকে, তোমার রাস্তা ভালবাসি
ভালোবাসি সারাদেশ থেকে এই শহরে ছুটে আসা অগনিত মানুষ যারা
গারমেন্টস শ্রমিক, রিক্সাওয়ালা,চাকুরি প্রত্যাশী উদভ্রান্ত তরুণ
ঢাকা,সব ভালবাসা আমার তুমি আর আমার ঢাকা শহরের কবিদের…


কবিতা - কালপুরুষ


দোলযাত্রা
কালপুরুষ


উৎসব। আনন্দ। কল্যাণ। আজ দোলযাত্রা।
সত্য পবিত্র মানবতার পথে
সার্বজনীন সমাজতন্ত্রের পথে।

রবীন্দ্র সরোবরে; মনে পড়ে গেলো-
তোমার সচ্ছল মুখ,
পৃথিবীর ৯২ কোটি ক্ষুধার্ত মুখ,
যাদের ডাকনাম মানুষ।
খুধা; যে কোন ভদ্রতা জানে না
বয়স মানে না
ধর্মও নয়।
কুমারী রমণীর যৌবন যন্ত্রণা আমৃত্যু সে।

তুমি বলেছিলে, “এই যুদ্ধের পর, দেখো;
মানুষ যৌথ অধিকার পাবে আকাশের”

উৎসব। আনন্দ। কল্যান। আজ বসন্তপূর্ণিমা।
মানব ধর্ম- মানব কল্যাণের পথে যাত্রা।
পথে অপেক্ষমান কুৎসিত ভিখারিনি,
যার ধর্ম আমরা জানি না
কোন ভাষায় করে প্রার্থনা
স্রষ্টাকে ডাকে সে কোন প্রিয় নামে?
জানি না।
এসো; জানি- তার দুঃখ আছে কত?
শীতের দুঃখ, ক্ষুধার দুঃখ, প্রেমের দুঃখ,
মানুষ হয়ে জন্ম নেবার ঐতিহাসিক দুঃখ!

হাতে তার হাত রাখি।
উচ্চারণ করি-
ভালবাসা ভালবাসা ভালবাসা।

কবিতা - রুদ্রশংকর


বসন্ত ২০১৩
রুদ্রশংকর


প্রজন্ম চত্ত্বরের আড়াল থেকে উড়ে গেল
প্রেসক্রিপশানের অনেক অপচয়
এ’ ছাড়া অপচয় বলতে তেমন কিছু
আমার ও মারুফার মধ্যে আসেনি কখনো

#

এখন এ’রকমই হয় আমাদের …
ট্যান্টালাস নাবিকের সাথে মোমবাতি জ্বালিনোর মেলায়
শাহবাগে হাত চেপে ধরে বসন্তকাল …
বকিটা ঈশ্বরের মতোই কাল্পনিক ।

কবিতা - সুব্রত পাল

থেকো, বসন্তে
সুব্রত পাল


যদি বসন্ত পলাশ খোঁজে, খুঁজুক। তুমি খুঁজো না
রাঙামাটির পথে হাঁটতে ইচ্ছে করলে, হেঁটো না
                                   শুধু আমাকে খুঁজো

আমি তো দুরন্ত ফাল্গুন গোটা গায়ে মেখে
                            তোমার জন্য বসে আছি
মনে মনে মাদল বাজাচ্ছি আর
গোধূলির রঙ দেখছি দিগন্তে

যদি বসন্ত তোমাকে ডাকে, ডাকুক। তুমি যেয়ো না
আঙুল ছুঁতে ইচ্ছে করলে, ছুঁয়ো না, কথা বোলো না
                                         শুধু আমাকে ছুঁয়ো

আমি তো পাতায় পাতায় লুকিয়ে রেখেছি
                                 সব ঢেউ, দ্বীপ, দ্বীপপুঞ্জ
গহন অরণ্য হয়েছি
                               কুয়াশায় সেজেছি কখনো

তবু যদি বসন্ত আসে তোমার কৃষ্ণচূড়া ডালে
আর কোকিল ডাকে, তবে অপেক্ষা কোরো।
                                আমি আসছি আবির নিয়ে, থেকো।

কবিতা - অরিন্দম চন্দ্র

বসন্ত-বিলাস
অরিন্দম চন্দ্র



(১)

নোনা ধরা দেওয়ালে এক কোণে একা স্বামীজি;

তেলচিটে বিছানা গরম হয় পৃথুলা কামনায়-

হুক থেকে বিগত পিতার মুখে হাসি ঝরে।



(২)

মশার পাল পড়ন্ত বিকালে ঘুরপাক খায়;

বিড়ির গন্ধ গোল হয়ে ঘিরে ধরে-

তাসের পাত্তি আবছায়া হয়ে আসে।



(৩)

হপ্তার পেমেন্ট পেয়ে মেয়ের জন্য পিচকারি কিনে

লোকটা বিলাতি মদের দোকানে ঢোকে-

বুঝি, বসন্ত এসেছে...




কবিতা - রাহুল গুহ

একুশ
রাহুল গুহ


একুশ মানেই জ্যান্ত সময় রক্ত ফোঁটা ফোঁটা
একুশ মানেই শিশুর মুখে প্রথম কথা ফোটা
একুশ মানেই পাখির পালক প্রভাত ফেরীর গান
একুশ মানেই দৃপ্ত পায়ে মুছবো অপমান
একুশ মানেই ভোরের আকাশ আটপৌরে দিন
একুশ মানেই তোমার চোখে আমার জন্মদিন

একুশ মানেই পানকৌড়ি নাম না জানা পাখি
একুশ মানেই যাত্রা সুরু সূর্যপথে সাথী
একুশ মানেই ধুলোর মধ্যে কুড়িয়ে পাওয়া বই
সেই ছেলেটার ভেলভেলেটার নতুন বন্ধু হই
একুশ মানেই বদলে যাওয়া পথচলতি দিন
একুশ মানেই অক্ষৌহিনী সুরের জন্মদিন

একুশ আমার ব্যাক্তিগত একুশ আমার ভাই
তার কপালে হাত বুলিয়ে মন্ত্র এঁকে যাই
একুশ আমার জল সই বোন চোখের কোনে কালি
বিষের পাহাড় পেরিয়ে এসে তারার করতালি
একুশ মানেই তোমার জন্য মধ্যরাতে পথে
নগর বাউল আঁকছে দ্যাখো নিজস্ব এক ছাঁদে
একুশ আমার সত্যি কথা মায়ের মতন সাদা
যত দূরেই যাই না তবু নাড়ির টানে বাঁধা
একুশ আমার নদীর ভাঙন শাহবাগের ঋণ
একুশ মানেই মায়ের আঁচল আমার জন্মদিন

কবিতা - মৌ দাশগুপ্তা

দোল
মৌ দাশগুপ্তা


ভরা চতুর্দশীর চাঁদ
লজ্জা রাঙ্গা মুখ খানি নিয়ে আকাশের গায়ে উঁকি দিতেই
ফিচেল তারার দল ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল
এদিক ওদিক।

আর শান্ত দীঘির টলটলে জল
আয়ত চোখ মেলে খুশির হাসি হেসে
দুহাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে নিলো
ঠিক বুকের মাঝখানে।

রাত্রির কালো ক্যানভাসে
দাউদাউ করে জ্বলে উঠল ঝরা পাতার গোছা
পুরো স্মৃতিকে পুড়িয়ে লেলিহান শিখায় নেচে উঠল
দেদীপ্যমান হোলিকা।

রঙ্গিন পরকীয়ায় মত্ত ওই শিমুল পলাশের রাঙ্গা মুখ
অন্ধকারের সাদা কালো ফ্রেমে ম্লান
অথচ গাঢ় কালো বর্ণীল অন্ধকার
বেহিসাবি খুশিতে বলে উঠল “রঙ দাও রঙ!”

দমকা বয়ে গেল চৈতি বাতাস
ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল শুকনো পাতার সাথে কৃষ্ণচূড়া ঝরা পাপড়ি
আকাশে বাতাসে আনমনা মোহন বাঁশির সুর
চাঁদোয়ার মত আকাশ জুড়ে পীতাভ আলোর ঝলক।

আর সেই ফাগুন সন্ধ্যায় আজকের রাইসুন্দরী
মরা চাঁদের আলোয় ঘুমহীন বিছানায়
অব্যক্ত যন্ত্রণাতেও ফ্যাকাসে প্রেমে রঙ খোঁজে আর খোঁজে..
কাল যে দোল!

জীবন তবে বর্ণময় হোক!


কবিতা - অন্য দিন

কিংবদন্তী
অন্য দিন


আমার দু-ঠোটে অযুত সময়ের কাটা দাগ,
তুমি চুম্বনে চুম্বনে ইতিহাস চেখে নিতে পার।
দেখে নিতে পার মায়ান সভ্যতা, এবড়ো থেবড়ো
পথ বেয়ে ছুটে আসা বিক্ষিপ্ত জনপদ, ক্লিওপেট্রার
কাছে জেনে নিতে পার মার্ক অ্যান্থনির আলিঙ্গনে কী
মাদকতা ছিল, রোমান সম্রাট কেন কেঁপেছিল শীতে,
শোনো ট্রয় নগরী ধ্বংস হতে দাও, এ সমস্ত বিষাদ
আমাদের জন্য নয়, পেড়িয়ে এসো পাণ্ডুরতা, আমরা
দু’জন ব্রাত্য নরনারী, আমরা বরং নায়াগ্রার কাছে যাই,
ভাসিয়ে দেই উজ্জ্বল প্রপাত, তারপর সতেরশো শতাব্দীতে
গিয়ে নেপোলিয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করি, জোসেফিনে কিসের
কমতি ছিল! মেরী লুইসে মজে কেন সে নারীর নিজস্ব
পুরুষ? বুঝতে বুঝতে বড় বেশী দেরী হয়ে গেল।


আরে! এসব দেখে তুমি ভয় পেয়েছো!
জেনে রাখ, তোমায় ছেড়ে এক তিলও যাবনা কোথাও,
বাতুলতা নয়, এ আমার অহংকার,
এতো ভালবাসা ধুতে পারেনি কোনও সাগর।
ভাল বেসে পুড়ে খাক হৃদপিণ্ড,
তবু ভস্ম পাবে না কোথাও।
যখন চারপাশে থিক থিকে কালো হয়ে আসে,
যোজন যোজন পথ যখন বিয়োজনে ভেসে যায়,
এইদিকে এসো, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলে বুঝবে
চার পাশটা কেমন বদলে যাচ্ছে নিমেষেই।

আর এ সমস্ত কিছুই রূপকথা মনে হলে -
পরীক্ষা প্রার্থনীয়, রাজী?

কবিতা - সৈয়দ রায়হান ওয়ালী

এক বয়োবৃদ্ধ লোক
সৈয়দ রায়হান ওয়ালী


যদি
তুমি আমি আমরা সবাই
মানবতার রজ্জু ধরি
শক্ত করে লড়াই করি, দাড়াই
তবে, আলাদা করে নিজ নিজ ধর্মের পক্ষে
দাঁড়াবার প্রয়োজন, এমনিতেই ফুরোয়;
এমনই এক লম্বা ভাষণ শেষে,
‘তুমি কি বল’ ? প্রশ্ন টি, পাশে বসা আমার হিন্দু বন্ধু কে, ছুড়ে দিতেই
‘এক্কেবারে হক কথা’ ব’লে পেছন থেকে উঠল চেঁচিয়ে এক বয়োবৃদ্ধ লোক
রাতটি ছিল ৫ই ফেব্রুয়ারী, মধ্য-প্রায়, দুই হাজার তের
আমরা দু বন্ধু আশপাশ ভুলে মেতে ছিলাম তর্কে, ধর্ম নিয়ে বাসের ভেতর;

বাতাসে তখন অহিংস যুদ্ধের দৃঢ় আভাস
অথচ পথ ঘাট, অথচ মানুষগুলোর মুখ
কেন যেন অজানা আতংকে হয়ে ছিল ভার
করছিল নীচুস্বরে ভৌতিক ফিসফাস;

তাদের আতংকের যৌক্তিকতা
টের পেল বিশ্ব সভা, ক’টা দিন পর
শ’ য়ের অধিক ঝরলো প্রান,
সভ্য একটি দেশে, নাকি বর্বর?

রাতটি ছিল ফাল্গুনের, চৌদ্দ’শ উনিশ
এক বয়োবৃদ্ধ লোক তখনো নিচু স্বরে ‘হক কথা’ ‘হক কথা’ ব’লে
বাসের ভেতর বিড়বিড় করছিল...
.......................................................

কবিতা - আজম মাহমুদ

আমার চৈত্র
আজম মাহমুদ



এমন ঘটা করে কি প্রয়োজন ছিলো চৈত্রকে সর্বনাশ
মাস হিসেবে গুনবার?
আমার তো চৈত্র কেন- কোন মাসেই
আসেনা সর্বনাশ, সর্বনাশেও ভাগ্য লাগে!

আবার আমার সর্বনাশ যেন সারা বছর-
ফলে চৈত্রকে কেমন করে সর্বনাশের মাস বলি?
বরং বোশেখের চেয়ে চৈত্রই ঢের ভালো
হারিয়ে ফেলে- সরব কান্নার একটা রাত্রি মেলে।

চৈত্র আমার সর্বনাশ করেনা স্বতন্ত্র ভাবে-
বরং সব চৈত্রের যোগফল আমার প্রাপ্তিতে
যোগ হয়ে উঠে কালে কালে- যুগে যুগে।

চৈতি হাওয়া গায়ে লাগে, মনে সেই
মাঘের শীতলতা,
এভাবেই আজও সর্বনাশর চৈত্র নিরবেই
কেটে যায় আমার।




মুক্তগদ্য - শিবাশীষ রায়

হরষ গীত উচ্ছসিত হে, আনন্দ বসন্ত সমাগমে...
শিবাশীষ রায়


আমার কবিতায় আমি ছিলুম সর্বাধিনায়ক,আর আমার একাধিপত্যে যে নাক গলাতো তার নাকটি কেটে হাতে ধরিয়ে দেওয়া যে শুধু সময়ের অপেক্ষা তা ছিল সর্বজন বিদিত!তাই একটা উন্নাসিক তকমা দামী কাশ্মীরি শালের মত আমার গায়ে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই সময় থেকে যখন কৈশোরের দোসর ছিল সাদামাটা রোদ্দুর,আর তল্পীবাহকের কুলপি আর রঙিন বরফগোলা খাওয়া চেয়ে দেখার নীরব মুহূর্তে, আমি শুধু খেতুম ফলের রস, অনীহা আর স্পৃহাহীনতায়!তবু আমি ছিলুম উন্নাসিক,ক্লাসিক সৌজন্যের ধ্বজা ধরে...

লেখাটি লিখতে বসে ফেসবুকিয় লেখক হিসেবে আমায় মাথায় রাখতে হচ্ছে ভাষা যেন সহজ সরল হয়! গরল গিলতে আপত্তি নেই,কিন্তু বাংলা ভাষা সোজা করে না লিখলে আজকাল দক্ষ লেখকের নরম রুচিশীল গরম বক্ষ প্রাপ্তির আশা ক্ষীণ, তাছাড়া শক্ত বাংলা পড়া আর নিজের পিঠ নিজে চুলকানো এখন কয়েনের এই পিঠ আর ঐ পিঠ...

তা যাইহোক,আমি লিখি আমার মননশীলতায়, আগে একে ওকে ট্যাগ করতুম, এখন ট্যাগ করাটা ত্যাগ করেছি কারন "লিটল ম্যাগ" নামক ম্যাগ-ই- বাজীতে জড়িয়ে এটা বুঝেছি সবই ঘর সাজানোর জিনিস,কেউ পড়েনি...কেউ পড়েনা, চৌত্রিশ বছর কেটে গেছে কেউ কথা রাখেনি, শুধু বুকের মধ্যে বন্দী "বর্তমান" রেখে বরুণা বলেছিল ভগবান ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না... পিছিয়ে পড়ার ভয়েই কেবল তখন পড়তে হয়েছিল প্রেমে, "প্রতিদিন" দিয়ে শুরু করে যখন এসে থামলুম একটু এগিয়ে সেই প্রফুল্ল সরকার ষ্ট্রীটে... তখন আমার জীবনে শীতের সকাল আর উনিশ কুড়ির দেশ!আজ যখন নিজেকে দেখি আয়নায় তখন হিসেবি ক্লিন সেভিং করা মুখে দাড়িওয়ালা সেই স্বপ্নের মানুষ টাকে সত্যি খুঁজে পাই না... ! এক এক সময় বড় কান্না পায় যখন দে'জ পাবলিশার্স এর দাড়িওয়ালা মামা ( দিবাকর ব্যানার্জি) কফি হাউসের সামনে থেকে আমার গাড়িতে উঠে যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করে -"কিরে লেখালিখি একদম ছেড়ে দিলি নাকি...?? মাল কামালে কি আর কাব্য আসে চাঁদু... অ্যারোর শার্ট পড়ে আর যাইহোক সংস্কৃত কলেজের সিঁড়িতে বসে শক্তি সুনীল আওরানো যায় না...তার জন্যে সেই খাদির পাঞ্জাবী টা দরকার... ও তুই তো আজকাল ফ্যাব ইন্ডিয়া পরিস!!!" আমি শুধু হাঁসি আর মনে মনে বলি আজ আমার কপি রাইট নেই ঠিক কথা কিন্তু "দেশ" থেকে সোজা ফেসবুক,থুরি মহাদেশ সেকি কম কথা!!!!

এখন নিজেই লিখি নিজেই পড়ি... যারা আমায় ভালবাসেন তারা আমার দেওয়ালে আসেন,টিপে ভালবাসা ভালোলাগা জানিয়ে যান,আমি ও প্রতিভালবাসা জানাই... এখন একলা একলাই মাল খাই, যারা আমার মেজাজ ভালবাসেন তারা আসেন আমি আর ট্যাগ করে লোকের দেওয়ালে গিয়ে নিজেকে মাতাল, লেখক প্রতিপন্ন করা বন্ধ করে দিয়েছি,কারন আমি বুঝেছি মাথা চুলকানো মানুষদের বেশি না চুলকানোই ভালো, কারণ কখন যে এদের চুলকানি সুরসুরি তে রূপান্তরিত হয় আর আমি উন্নাসিক থেকে হয়ে উঠি নন্দ ঘোষ তা বোঝার আগেই এক ঝাঁক ভুঁইফোর সাহিত্য দালালরা গেয়ে ওঠে- "ওকে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছিঃ... ও যে চণ্ডালিকার ঝি!!!"

তাই খোলা মনে ফেসবুকে এলেও এখন কথা বলতে দ্বিধা হয়,দুবিধা হয় এই মর্মে যে আমি তো প্রেম চোপড়া, ছোপরা ঘসি গায়ে, প্রাণে আমার রবীন্দ্রনাথ কাদা লাগে পায়ে।

তবু ভালোলাগার কোঁচানো ধুতি আর মন্দলাগার গিলে করা পাঞ্জাবী পড়ি রোজ, কখনো সোনায় সোহাগা হলে এই হতভাগার পাঞ্জাবীতে বন্ধুত্বের আতর লাগে, আসর জমে,ক্রমে রাত বাড়ে... ! আড়ে যারা তাকায় পর্দার ওপাশ থেকে তাদের জন্যেও রাখা থাকে গোলাপ জলে চোবানো কিমাম জর্দা পান, কিন্তু ফুলের সাথে পান শুকোয় ঝাড় বাতির আলো ম্লান হয়ে আসে... পূর্বে হাল্কা আলোর আভা দেখা যায়...এক এক করে তাকিয়ায় এলিয়ে দিয়ে শরীর নিভে আসে চ্যাট বক্সের সবুজ আলো...

আমি তখনো জেগে থাকি,একলা একা ভোরের হাওয়া গায়ে মাখতে আমার ভীষণ ভাললাগে... ! সব ক্লান্তি,সব ব্যাথা,সব অক্ষমতা, অপবাদ যেন ধুয়ে যায়... কানে কানে কে যেন বলে যায়-" হরষ গীত উচ্ছসিত হে, আনন্দ বসন্ত সমাগমে!!!"





ছোটগল্প - মৌ দাশগুপ্তা

রং বেরঙের গল্প
মৌ দাশগুপ্তা
“জীবন কি যে গতিময়, কত দ্রুত কেটে যায় সময়। এই তো সেদিনও ছিলাম ছোট্ট এক স্কুল পড়ুয়া । ফুটবল, ক্রিকেট খেলে,ঘুড়ি উড়িয়ে, লাট্টু লেত্তি আর মার্বেলের সম্ভার সামলে,পাড়ার মধ্যমনি বিবেকদাদার মত হবার অদম্য আগ্রহ বুকে পুষে,ছোট বোনটির সাথে অহেতুক খুনসুটিতে , অকারন ব্যস্ততা আর উচ্ছ্বাসে কেটে যেত আমার সেই ফেলে আসা দিনগুলো। জীবনের পরতে পরতে তখন বেঁচে থাকার সুগন্ধ। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম সোনালী সকাল, ক্লান্ত বিকেলে, তারা ভরা মোহময়ী রাত। কত সহজ সরল ছিল দিন গুলো। বড় আপন লাগতো বাড়ীর লাগোয়া ঝিল পাড়ের কৃষ্ণচূড়া গাছটা, বন্ধুদের সাথে ঝগড়া হলে, মায়ের কাছে বকা খেলে, বোনের সাথে আড়ি হলে, সেই একা থাকার, মন খারাপের বিষণ্ণ মুহূর্তে আমায় সঙ্গ দিত সে। কত কথাই না বলতাম তার সাথে, কত আবেগঘন, একা থাকার মুহূর্তের সে সাক্ষী আমার। এখন বোধহয় বয়সের ভারে তার টানটান বাকল হারিয়েছে মসৃণতা, ফাটা ফাটা হয়ে খসে পড়েছে । ছোটবেলায় নেলকাটার ঘষে ঘষে নিজের নাম লিখে রেখেছিলাম। অনেকদিন অবধি লেখাটা ছিল। গাছটা আজ বয়সের ভারে জরাজীর্ন, তবুও প্রাণের টান বুঝিবা এখনও থোকাথোকা লাল ফুল দেয় প্রতি বসন্তে। সকাল বিকাল আজও বুঝি বা দামাল হাওয়া একই ভাবে লুটোপুটি খায় বুড়ো কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে, পাতায় পাতায়।“
এতটা একটানা লিখে পেনটা বন্ধ করতেই হোল, পেনের রিফিল শেষ। নব্য লেখক দীপুর ব্যাগে অবশ্যি অন্য পেন আছে, কিন্তু লেখার খাতা থেকে চোখ তুলতেই মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল।অবাক কৌতুহলী দৃষ্টিতে এতক্ষন ও দীপুর দিকেই তাকিয়ে ছিল, দীপু চোখ তুলে তাকাতেই অন্যদিনের মতই একটু ঘুরে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রইল।দীপু জানে, আর একবারও ও এদিকে তাকাবে না।মনে হয় দীপুর মত ওর ও বোধহয় পানিহাটির “বারো শিবমন্দির” ঘাটটা খুব পছন্দের।

আজ কিন্তু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সহজে চোখ ফেরাতে পারছে না দীপু।আজ দোল। সকালে বোধহয় খুব রঙ মেখেছিল, তার গোলাপী আভা এখনও মোছেনি কপালের,গালের ওপর থেকে।চুলে এখনও তেলের ছোঁওয়া পড়েনি বোধহয়।আলতো হাতখোঁপার বাঁধন এড়িয়ে চুলের গুছিগুলো হাওয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে আপনমনে খেলছে,নাচছে। আহামরি সুন্দরী নয়,তবু শালীনতা মেশানো একটা আলগা শ্রী মেয়েটাকে অন্যরকম আকর্ষনীয় করে তুলেছে।দীপুর তরুন হৃদয় তার মনের সবটুকু ভালোলাগা দিয়ে মুহূর্তটাকে ধরে রাখতে চাইছে।ঐ বাসন্তী হলুদ ছাপা শাড়ী,ঐ গালে হাত দিয়ে আনমনে বসে থাকা,ঐ অস্তগামী সূর্য্যের আলোকে সারা গায়ে মেখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা,সব আজ দীপুর চোখে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।

নীল দীপুর ছোটবেলার বন্ধু, একপাড়াতেই বড় হওয়া, স্কুল থেকে কলেজে যাওয়া, পরে নীলের বাবার কাজের সূ্ত্রে সোদপুরে বদলী হয়ে আসলেও প্রযুক্তি বিজ্ঞানের বদাণ্যতায় যোগাযোগে ভাঁটা পড়েনি। কতটুকুই বা দূর। ওড়িশার রাউরকেলা আর পশ্চিমবঙ্গের সোদপুর-পানিহাটি। নীলের খুব ছোটবেলাতেই মা মারা যাবার কারণে,আর বাবার বদলীর চাকরী হওয়াতে ওরা দুই ভাই বোন নীরা আর নীল ওদের ঠাকুরদার কাছেই বড় হয়েছে। রুদ্রদাদু দীপুরও খুব আপনজন,নীরাদিদি তো এখনও ভাইফোঁটায় দীপু আসবে না বললে কেঁদে ভাসায়।এই নীরাদিদির বিয়ে উপলক্ষ্যেই গত সাতদিন ধরে দীপু সোদপুরে এসে রয়েছে।বাড়ীতে মেলা আত্মীয় স্বজনের ভীড়। সবাইকে চেনে না দীপু। তাই বিকালের দিকে নীল ঘরের ডামাডোলে বেশী ব্যস্ত থাকে বলে ও একাই পায়ে হেঁটে চলে আসে গঙ্গাতীরে। সূর্য্যাস্তের পরে উঠে যায়। সাতদিন ধরেই মেয়েটাকে দেখছে ও।বিকালের দিকে আরেকটি বেশ সুন্দরী, আধুনিক পোষাকে সজ্জিতা মেয়ের সাথে এই মেয়েটি আসে, দুজন সমবয়সী।তাই বোন নয়, বান্ধবী হওয়াই স্বাভাবিক। এই দ্বিতীয় মেয়েটি বোধহয় এখন চুটিয়ে প্রেম করছে পাড়ার কোন উঠতি হিরো সাথে। রোজ বিকালে ভালোমানুষ বান্ধবীটিকে সাথে করে গঙ্গার হাওয়া খাবার নাম করে আসে, এসেই হিরোর হিরো হন্ডাটিতে সওয়ার হয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে যায়,যতক্ষন না সে ফেরত আসে ততক্ষন বেচারী এই মেয়েটি একা একা ঘাটের পাশে বসে একমনে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।

হঠাৎই ভালোলাগায় ছন্দপতন। হিরোর বাইকটা বীভৎস যান্ত্রিক আওয়াজ তুলে মেয়েটার পাশে এসে থামলো।মৃদু হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো ও। হিরো এবং তার বান্ধবীটিকে আর চেনা যাচ্ছেনা, এত বিভিন্ন রঙের আবীর ছড়ানো রয়েছে ওদের দেহের সর্বত্র। হিরো বাইক পার্ক করে নামলেন,একটু ঝুঁকে বান্ধবীর কানে কিছু বললেন। কাঁচভাঙ্গা আওয়াজের হিল্লোল তুলে গড়িয়ে পড়ল সঙ্গধারী রঙীন সঙ্গ সাজা সুন্দরী। হিরোসুলভ বীরত্বে হিরো এবার দু’হাতে আবীর নিয়ে অশ্লীলভাবে জড়িয়ে ধরে আগের মেয়েটিকে রঙ মাখিয়ে দিল।মেয়েটির ছটফটনি
দেখে বোঝা গেল ওর আপত্তি আছে। ছিটকে সরে যেতে গেলেও আঁচলটা মুঠো পাকিয়ে ধরে নিলেন হিরো।দোলের দিন, আর বোঝাই যাচ্ছে ওরা একে অপরের পরিচিত।তবু নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়য়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেল দীপু। ইতিমধ্যে অন্য মেয়েটিও গতি সুবিধার নয় দেখে প্রেমিক প্রবরের হাত চেপে ধরলো।গোটা ঘটনাটাই ভীষণ অল্প সময়ের মধ্যে এবং তাৎক্ষনিকভাবে ঘটে যাওয়াতে হিরোর হাতের মুঠো আলগা হয়ে গেল এবং মেয়েটিও টাল সামলাতে না পেরে দু তিন কদম এগিয়ে দীপুর গায়ে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তারপরেই চকিতে তাকাল দীপুর দিকে,কান্নার ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল আবীর রাঙানো গাল বেয়ে,অন্য কেউ দেখার আগে চট করে আঁচলে মুছে নিয়ে সরে দাড়ালো। ওদিকে দীপুকে আপদমস্তক দেখে নিয়ে বান্ধবীর সাথে কিছু একটা কথা বলে বাইকটা ঘোরালো হিরো, কিন্তু বান্ধবীটি কথা না শোনার ভান করে প্রথম মেয়েটিকে এসে জড়িয়ে ধরল।ওরই আঁচল দিয়ে যতটা পারে রঙীন আবীর ঝেড়ে ফেলে দিলো, অল্প হাসলো দীপুর দিকে তাকিয়ে, তারপর দু’জনে পা বাড়ালো বাড়ীর দিকে।পড়ন্ত বিকেল,কেমন যেন মায়া জোড়ানো রোদ শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছিলো।অদ্ভুত এক অচেনা আলো।কোথায় যেন দীপু শুনেছিল এমন আলোকে নাকি কনে দেখা আলো বলে।সেই কনে দেখা আলোর অরুনাভা মনে লুকিয়ে রেখে দীপু দুটি মায়বী চোখের বাঁধনে বাঁধা পড়ে একা দাঁড়িয়ে রইলো বোকার মত।

সন্ধ্যেবেলায় বাড়ী ফিরেই রুদ্রদাদুর সাথে নিমন্ত্রনপত্রের গোছা হাতে করে দীপু বেরোলো পাড়ায় ঘুরে ঘরে বিয়ের নিমন্ত্রন সারতে।নীল ওর বাবার সাথে গেছে দুরের আত্মীয়দের পাট মিটাতে।নীলরা থাকে ‘দিশা’ বলে একটা ছয়তলা হাউসিং অ্যাপার্টমেন্টে। ওদের পাড়ায় এই রকম ছোটবড় একাধিক অ্যাপার্টমেন্টও যেমন আছে, তেমনি নিজস্ব একতলা দোতলা বা তিনতলা বাড়ীও আছে। নীলদের বাড়ীর ঠিক উল্টোদিকে যে নতুন বিল্ডিংটা উঠেছে, তার তিনতলায় দরজা নক করতেই যে দরজা খুলে এক ঝলক অতিথিদের দিকে তাকিয়েই খোলা পাল্লার আড়ালে সরে দাঁড়ালো, তাকে দেখেই আনন্দে দম বন্ধ হয়ে আসলো দীপুর। এই তো
সেই অনামিকা।এবাড়ী সেবাড়ী ঘুরে কাজ শেষ করে বাড়ী ফিরে নীলের কাছে বাকি সুলুক সন্ধান পেয়ে গেল দীপু।

নীলদের বাড়ীর ঠিক উল্টোদিকের নতুন বিল্ডিংটার তিনতলায় থাকেন অবনীবাবু, প্রথম মেয়েটি ওনার ভাগ্নী, নাম ইন্দ্রানী ।মা বাবা নাকি খুব ছোটবেলাতেই মারা গেছে। মামা মামীর ঘরেই মানুষ।দু’বোনে খুব ভাব।ইন্দ্রানী আবার নীলদের কলেজেই পড়ে।নীল ফাইনাল ইয়ার আর ইন্দ্রানী মানে এই মেয়েটি সবে ফার্স্ট ইয়ার। অবনীবাবুর একটিই মেয়ে, কঙ্কনা ।সে আবার নীলের ক্লাসমেট।সে এখন চুটিয়ে প্রেম করছে পাড়ার উঠতি হিরো স্যান্ডির সাথে।পাড়ার সবাই জানে।তবে কিনা প্রেম পাড়ার সবাইকে দেখিয়ে করলেও বাড়ীতে লুকাতে হয়, তাই বোধহয় রোজ বিকালে পিসতুতো বোনটিকে সাথে করে গঙ্গার হাওয়া খাবার নাম করে আসে, এসেই স্যান্ডির হিরো হন্ডাটিতে সওয়ার হয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে যায়,যতক্ষন না দিদিটি ফেরত আসে ততক্ষন বেচারী ইন্দ্রানী একা একা ঘাটের পাশে বসে একমনে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।গতকয়েক মাস এক রুটিন চলছে।সেদিনের পর আর গঙ্গার ঘাটে দেখা হয়নি দুজনের।গঙ্গার ঘাটে আর আসেনি ইন্দ্রানীরা,এক্কেবারে দেখা হয়েছিল নীরাদিদির বিয়ের দিন। ম্যাজেন্টা রঙের সিল্কশাড়ীতে অসম্ভব সুন্দর লাগছিল মেয়েটা। দীপুর নজর আর সরছিল না। প্রজাপতির মত এদিক ওদিক ঘুরতে ফিরতে যতবারই দুজনের চোখাচোখি হয়েছ ততবারই একটা মিষ্টি প্রশ্রয়ের হাসি হেসে টুক করে সরে গেছে মেয়েটা।নীল তার মুখচোরা লাজুক বন্ধুটিকে ওস্কালেও মুখ ফুটে কোন কথা বলা হয়ে ওঠেনি দীপুর।আর বিয়ের পরদিনই রাউরকলার রিং রোডে দীপুর বাবার আচমকা অ্যাক্সিডেন্টটা দীপুকে কিছু বলার সুযোগও দেয়নি।আর দেখা হয়নি দুজনের। তবে দীপুর মন থেকে সেদিনের ভালোলাগাটুকু সময়ের সাথে হারিয়েও যায়নি।

তারপরে গঙ্গার বুক বেয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, অনেকগুলো দিনরাত পার করে এসে সেদিনের দীপু আজ গল্পলেখার নেশাটা হারিয়ে ফেললেও ডায়েরী লেখার বদভ্যাসটা কিন্তু ছাড়তে পারেনি।বিয়ে করাটা আর হয়ে ওঠেনি দীপুর। বাড়ীর সবাইকে নিয়ে দাদার মেয়ের বার্ষিক পরীক্ষার পরে বেড়াতে এসেছে নীলের বাড়ী।এখান থেকে দুই পরিবারের লোক মিলে ঘুরতে যাবে শিমলা কুলু মানালী।আজ রুদ্রদাদু নেই,নেই দীপুর বাবা-মাও। নীলের বাবা অবশ্য অবসর নিয়ে এখনেই আছেন। নীরাদিদি দুই ছেলে আর বরের সাথে কানাডায়।নীলের বৌ আঁখি আবার দীপুর বৌদি পাখির পিসতুতো বোন। তাই আসার আগ্রহটা ওর দাদা বৌদিরই বেশী। সেদিনও দোলপূর্ণিমা। শুভদিন দেখে রং খেলা শুরু হবার আগেই সাতসক্কালে বাড়ীর সকলে পূজো দিতে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে গেলেও দীপু একা চলে এসেছে বারো মন্দিরের ঘাট। কত লোকের ভীড়,কথা,কত মুখ,কত হাঁটার ভঙ্গী,কত চাউনী, কত কথকতা।দুচোখ ভরে খালি দেখে যাওয়া,দেখা তো নয়, যেন চোখ দিয়ে গোগ্রাসে খাওয়া।ডায়েরী লেখার জন্য হাতটা নিসপিশ করে ওঠে।হঠাৎ চোখে পড়ে খনিকটা দূরে ঘাটের সিঁড়িতে বসা এক সাদা শাড়ী পড়া মাঝবয়সী মহিলা এত লোকের ভীড়েও কেমন সবার থেকে আলাদা হয়ে আনমনে গালে হাত দিয়ে একদৃষ্টিতে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে আছেন। দৃশ্যটায় নতুনত্ব কিছু নেই।হঠাৎই খোল করতাল নিয়ে হোলির গান গইতে গাইতে বহুরূপী কৃষ্ণকে মধ্যমনি করে ,খোলা রাস্তায়, পথচলতি লোকের গায়ে, দুরন্ত বাতাসে আবীর ছড়িয়ে, ফুটকলাই ফেণীবাতসা দিয়ে মিষ্টিমুখ করাতে করাতে, একদল লোক পাশের রাস্তা ধরে বোধহয় শিরোমনি মশাই প্রতিষ্ঠিত রাধা কৃষ্ণের মন্দিরে দোলৎসবে গেল। আওয়াজে আকৃষ্ট হয়ে সাদা থান পড়া মহিলাও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন।চোখাচোখি হল দীপুর
সাথে।অচেনার ভঙ্গীতে লহমা মাত্র দীপুকে দেখে মহিলা চোখ সরিয়ে নিয়েও হঠাৎ ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মত চমকে উঠে ভালো করে তাকালেন দীপুর দিকে,হাতে ধরা ডায়েরীটার ওপর দিয়ে দৃষ্টিটা আবার চোখে এসেই থামল।দীপুর অবাক চোখের দৃষ্টি অনুসরন করে নিজের দিকে একপলক তাকিয়েই উঠে দাঁড়লেন। সাদাথান কাপড়টা ঘোমটার মত তুলে মুখটা আড়াল করে ত্বড়িতপায়ে লোকের ভীড়ে যেন বেমালুম মিশে গেলেন।

অজান্তেই অনেকক্ষন আটকে রাখা শ্বাসবায়ূটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এল।দীপুর কলম লিখে নিল ওর মনের অব্যক্ত কথাগুলো।
“প্রথম দেখাতেই মনে রঙ ধরিয়েছিলে ফাগের দিনের রঙীন বেশে , গোধূলীবেলায়, তবু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি।আজ আবার সেই আবীরমাখা দিনের শুরুতে সামনে এলে দুধসাদা রঙে সেজে, অমল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে, আজও আমার মনের কথা অব্যক্তই রয়ে গেল।“