সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

শনিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৩

প্রবন্ধ - শ্রীশুভ্র






এ কোন সকাল! এ কোন পরিবর্তন!


"যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি
আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-  প্রীতি নেই
-
করুণার আলোড়ণ নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া!...."

অমোঘ সত্যের এই লাইনগুলোই বিদ্যু চমকের মত মুহূর্মুহূ
আঘাত করে মস্তিষ্কের কোষাগারে; যখনই রোজকার প্রভাতী সংবাদে চোখ পড়ে যায়!

কথা হচ্ছিল সম্পাদকের সাথে! এবারের সংখ্যায় লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে! সম্পাদকের অনুরোধ বিষয় হোক এই সময়!

এই সময়ের কথা ভাবলেই মন্ত্রের মতো জীবনানন্দের এই লাইন কটি বিবস্ত্র করে দেয় আমাদের! সবচেয়ে দুঃখের কথা কোনো মতবাদই, কোনো তন্ত্রই তখন আর লজ্জা নিবারণ করতে পারে না! সত্যই তখন মনে হয় "অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ"!

মানুষের সমাজ সভ্যতার মূল কেন্দ্রে জীবনানন্দ যে অন্ধকারকে শিকড় বিস্তার করতে দেখে গিয়েছিলেন আজ তা হয়ত সর্বগ্রাসী জাল বিস্তারে পরিব্যাপ্ত হয়েছে! সে আমাদের নিজেদের লজ্জা! প্রতিরোধে দৃঢ় সংকল্প ছিলাম না আমরা! বিভিন্ন মতাদর্শ নিয়ে বিতর্ক করেছি যত কোনো আদর্শের প্রতিই সততা ধরে রাখতে পারিনি তত! ফলে আদর্শের রাস্তা দিয়ে এগোনোর বদলে ক্রমেই কুরুক্ষেত্র করে তুলেছি নিজস্ব পরিসর! নিজের সাথে অন্যকেও দাঁড় করিয়ে দিয়েছি অন্ধকারের মধ্যেখানে! সান্ত্বনা দিয়েছি নিজেকে, ঘোর কলি বলে! তাই দায় এড়ানো হয়েছে সহজ! ক্রমেই বাসযোগ্যতা হারিয়েছে আমাদের পরিপার্শ্ব! ক্রমেই জমে ওঠা জঞ্জালের স্তুপে চাপা পড়েছে নতুন প্রজন্মের দিশা!

আমাদের দ্বিখণ্ডীত এই বাংলায় অদ্ভুত আঁধারের এই সংস্কৃতি নতুন নয়! এর ইতিহাস অতি সুপ্রাচীন! স্বয়ং শ্রীচৈতন্যকেও লড়তে হয়েছিল এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে! তারপর গঙ্গা পদ্মা দিয়ে কত জল গড়িয়ে গেল! এখন আমরা আর লড়াইয়ের মধ্যে নেই! যে যার ফেস্টুনে মাঝে মধ্যে শুধু শ্যাডো প্র্যাকটিস করি একটু আধটু! বস্তুত স্বাধীনতার চোরাবালিতে ৪৭এর বাংলা ভাগের  সেই সন্ধ্যে থেকেই আমরা লড়াই ছেড়ে ফেস্টুন ধরেছি! ফেস্টুনের তলায় ঘর গুছিয়ে নিয়েছি! এটাই এখন বঙ্গসংস্কৃতির বর্ণপরিচয়!
আখের গোছানো দলবাজি রাজনীতির সহজপাঠে বাঙালি এখন সাবালক! শুধু তাই নয় এই বিষয়টাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছি আমরা! তাই আজ রাজনীতি একটা ইন্ডাস্ট্রী!

গত ছয় দশকে এরাজ্যে দলীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রিত জনজীবন! ফলে রাজনৈতিক পরিসরের বাইরে এরাজ্যে মুক্ত পরিবেশের অবসর প্রায় নেই বল্লেই চলে! আজকের সংস্কৃতি তাই "আমরা ওরা"র সংস্কৃতি! তার বাইরে তৃতীয় কোনো ভূবনের সংস্থান আজও গড়ে ওঠেনি! এরই মধ্যে আমাদের ব্যাক্তিস্বাধীনতার সংবর্ত!

সেই আমরা ওরার ঘূর্ণীপাকে আজ  আমাদের পরিবর্তনের গল্পগুলি ফেস্টুনে ব্যানারে ভোটের ইশতেহারে রাজনৈতিক পতাকার রঙে রঙিন স্বপ্নের ঢেউ ভাঙ্গে কেবলই!বস্তুত সেই গল্পের রসে মজে ভোটের লাইনের ভিড় যত বাড়ে ততই কারুর পৌষমাস তো কারুর সর্বনাশ! আজকের পশ্চিমবঙ্গের লড়াইটা তাই অন্ধকারের বিরুদ্ধে নয়! ক্ষমতার পক্ষে!
ওরা নয় আমরা! এটাই শেষ কথা!

এই "আমরাই থাকব"র দম্ভে চৌত্রিশ বছরের রাজত্বের পরিবর্তনে মানুষ আশা করেছিল তৃণমূল স্তর থেকে প্রশাসনের উর্দ্ধতম স্তরে দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে রাজ্যকে মুক্ত করা যাবে! কিন্তু পরিবর্তনের দেড় বছরেই জনসাধারণের স্বপ্নভঙ্গ হওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে! একটার পর একটা ঘটনা প্রমাণ করছে পরিবর্তন হয়েছে শুধুমাত্র দুইটি ক্ষেত্রেই! প্রথম পরিবর্তন শাসক দলের নাম ও দলীয় পতাকায়! এবং দ্বিতীয় পরিবর্তন; ভূতপূর্ব সরকারের আমলে দূর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছিল সাংগঠনিক সুশৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে! বর্তমান প্রশাসনে সেটিই ঘটছে চুড়ান্ত বিশৃঙ্খলায়! আর পূর্বতন শাসক দল চলত কেন্দ্রীয় পরিচালন মণ্ডলীর নির্দেশে! বর্তমান দল এক ব্যাক্তির অধীন!

ক্ষমতার দখল ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় ব্যাক্তিগত স্বার্থে অর্থনৈতিক ফয়দা তোলার এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটাই অভিমুখ; পরস্পরের দোষারোপ করা! এর বাইরে জনগণের কাছে কোনোরকম রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি আজ আর অবশিষ্ট নেই! বর্তমানের এই পরিমণ্ডলে বুদ্ধিজীবীদের দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে এই পারস্পরিক দোষারোপের ধারায় জড়িয়ে পড়া এই বাংলার পক্ষে এক গভীরতম বিপর্যয়! এর ফল অনেক দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে বাধ্য! আমরা অনেকেই হয়তো এই বিষয়টা নিয়ে এখনই তত চিন্তিত নই, যতটা নিশ্চিন্ত বুদ্ধিজীবীদের দীর্ঘ তিন দশকের নীরবতা ভেঙ্গে সরব হয়ে ওঠার বিষয়ে! ফলে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণের প্রতিভাসটা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে!

বুদ্ধিজীবীদের রাজনৈতিক শিবিরায়ন যে কোনো সমাজের পক্ষেই অশনি সংকেত! রাজনৈতিক দলগুলির অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাফাই গাওয়া, ব্যাক্তিগত খ্যাতিকে মুলধন করে জনগণকে বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দলের সম্বন্ধে প্রলুব্ধ করা ও বিপক্ষ দল সম্বন্ধে বিভ্রান্ত করার মধ্যে দিয়ে সামাজিক অবক্ষয়ের ভিত্তিটাকেই পোক্ত করা হয়! এবং এর ফলে ক্রমেই জনমানসে বুদ্ধিজীবীদের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পেতে থাকে! রাজনৈতিক দলগুলির মুখপাত্র হয়ে গিয়ে তারা আর সমাজকে কোনো রকম মৌলিক দিশা দেখাতে পারেন না! আর তখনই সামাজিক অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে গিয়ে সমাজ পারস্পরিক দোষারোপের কালিমা লেপনের অক্ষের চারপাশে ঘুরতে থাকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে! যার ফয়দা লুটতে থাকে অনেকেই!

এ এক অভিশপ্ত সময়! রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়! রাজনৈতিক কর্মসূচীর স্বপক্ষে নৈতিক সমর্থনের তল্পিবাহনে যখন ব্যাস্ত বুদ্ধিজীবী মহল, স্বভাবতঃই তখন রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়ন
বিস্তার দ্রুততর হয়ে ওঠে! আর সেই সুযোগটাকেই জমি দখলের লড়াইয়ে কাজে লাগাতে তপর পরস্পর প্রতিপক্ষ দলগুলি!এমত অবস্থায় রাজনৈতিক অস্থিরতা খুন জখম দাঙ্গাবাজি বাড়তেই থাকবে! জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রতিহত হতে থাকবে প্রতিনিয়ত, এই পরিস্থিতির কাছে! আর আমরা ওরার বিভাজন বাড়তে বাড়তে আইন শৃঙ্খলার অবনতি অবশ্যম্ভাবি! আজকের এই পরিস্থিতি নিশ্চয়ই একদিনে সৃষ্টি হয়নি! দীর্ঘ কয়েক দশকের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছে এই সংস্কৃতি! শপথ ছিল তারই পরিবর্তনের!

যারা ভেবেছিলেন এই অবস্থার পরিবর্তন আনবে তাদের মূল্যবান ভোট, যারা বিশ্বাস করেছিলেন পরিবর্তনের শপথ নেওয়া নেতানেত্রীদের প্রতিশ্রুতিতে এবার দিন পাল্টাবে, সুদিন আসবে; তাদের আজ বিশ্বাসভঙ্গের দিন! বিস্ফোরিত শিহরণে একটার পর একটা ঘটনা প্রত্যক্ষ করে তারা এখন বিস্মিত হয়ে অনুভব করছেন পরিবর্তন এসেছে তবে মাত্র দুটি ক্ষেত্রে! প্রশাসকের নাম ধাম রঙ হয়েছে বদল! আর সুসংঘটিত সাংগঠনিক শৃঙ্খলায় যে রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়ন ছিল পর্দার আড়ালে, আজ সেটা রঙ বদলে বিশৃঙ্খল সংঘটনের বেআব্রুতায় চলে এসেছে প্রকাশ্যে! ভূতপূর্ব প্রশাসক দল ঠিক যেখানে শেষ করেছিলেন তাদের ইনিংস, পরিবর্তনের দলটি সেইখান থেকেই বাউন্ডারী হাঁকাচ্ছেন খুব দ্রুত!

পরিবর্তনের পতাকা নিয়ে এহেন তাড়াহুড়ো এভাবে চলতে থাকলে তিনদশক কেন তিনবছরেই ইনিংস শেষ হতে পারে! তবে তাতেও জনসাধারণের বিশেষ লাভ নেই! কারণ তৃতীয় কোনো বিকল্প রাস্তা আমরা খুলতে পারিনি!

এই যে বিকল্পহীনতা এটাই ভয়ংকর! এটা গণতন্ত্রের পক্ষেই অস্বাস্থ্যকর! নাগরিক সামাজের মধ্যে এখনও যে সামান্য অংশে পচন ধরেনি, তাদের সময় এসেছে কোনো তৃতীয় বিকল্পের দিকে সমাজকে আলো দেখানো! আসল পরিবর্তনের সূচনা করতে গেলে যা জরুরী!রাজ্যরাজনীতির ক্ষমতা দখলের এই লড়াই নয়ত ক্রমেই ক্যানসারের মতো দূরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়ে যাবে! শকুন আর শেয়ালের খাদ্য হয়েই শেষ হবে তাদের হৃদয়, এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয় মহ সত্য বা রীতি!

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন