সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

শনিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৩

প্রবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



এই সময় সেই সমর এবং সব সময় ...


এই সংখ্যার বিষয় ভাবনা এই সময়এই সময় কথাটা আমার কাছে কিঞ্চি বিভ্রান্তিকর,কারণ কথাটা কিছু নির্দেশ করেনা। সেই অর্থে চলমান সময়ের কবিতা, বা সাহিত্য বা এই সময়ের রাজনীতি ইত্যাদি নির্দিষ্ট অভিমুখ পাওয়া যেতে পারেআরো একটা ধাঁধা আছে। এই সময়তো পমুহুর্তেই সেই সময় হয়ে যাচ্ছে। তাহলে ? আসলে কোন চলমান সময়ের শিল্প-সাহিত্য-  বা যেকোন সৃষ্টির বিচার সেই চলমান সময়ে করা যায়না। সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায় প্রবাদ হয়ে যাওয়া এই কথাটা ঠিক আবার বেঠিকও বটে। বেঠিক, সময়কে ধরা যায়না কিন্তু চলমান সময়ের সৃজনশীলতাকে আমরা ধরে রাখতে পারি। সময়ের শরীরে ধরে রাখা সবকিছুই তখন ইতিহাসের উপাদান। এই সময়ে লেখা প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বৃহ  সেই সময় উপন্যাসটির নাম এই সময় হতে পারতোনা। সময়কে ধরে রাখা যায় বলেই এই সময়কে অতিক্রম করে উনিশ শতাব্দীর সেই সময়ে পৌছে যাই ঐ সৃজনকর্মের মধ্য দিয়ে। চলে যাওয়া সময়কে আবার ঘটিয়ে দেওয়া যায়না বটে কিন্তু ফিরে ফিরে আসে মানুষের সৃজনকর্মের মধ্য দিয়ে
                
     সময়ের গতিও কি সবযুগে এক থাকে? না থাকেনা , যদি সমাজ ও সভ্যতার বিবর্তনের গতিকে সময়ের সঙ্গে এক করে দেখি। এদেশে প্রথম ধনিমূদ্রন ব্যবস্থা গ্রামোফোন রেকর্ড চালু হয় ১৯০২ সালে আর মাত্র ১০০ বছরের মধ্যে ৭৮ পাক গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে এক্সটেন্ডেড প্লে, লং প্লেইং রেকর্ড, টেপ রেকর্ডিং, ক্যাসেট, সিডি, ডিভিডি পদ্ধতিকে জাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়ে এখন মাইক্রো চিপস।  প্রাচীন সাহিত্যের ইতিহাস কিংবা সামাজিক ইতিহাসের সময় বা সমাজ বিবর্তনের একক তাই ধরা হত শতকের হিসাবে পঞ্চম শতাব্দী, সপ্তম শতাব্দী ইত্যাদি , আর এখন দশকের একক অর্থা ত্রিশএর দশক , পঞ্চাশের দশক এই রকম। কারণ একটা শতকের সময় কালে সমাজ বা সাহিত্যের বিবর্তন এতো দ্রুত, যুগ লক্ষণ বা দ্বান্দ্বিক সূত্রগুলি পালটে যাছে এতো দ্রুত যে সেগুলিকে আর শতকের এককে ধরে রাখা যাচ্ছেনা
     
   একটি ফেসবুক ব্লগজিনে একটা অনলাইন আলোচনার প্রতিবেদন পড়ছিলাম। বিষয়- সাহিত্যের ক্ষেত্রে কোন দশক বলে সীমা রেখা থাকা কি উচি ? প্রতিবেদনের কথা থাক। বিষয়টাই তো বোকা বোকা লাগে। আমি আপনি কে এই সীমারেখায় ভাগ করার ? মুকুন্দরাম চক্রবর্তী যখন ষোড়শ সতকে চন্ডীমঙ্গল কাব্য রচনা করেছিলেন তখনকি এই ভেবে লিখেছিলেন যে তাঁর কাব্য শুধু সেই সময়ের জন্য ? বিষয়টাতো এই যে লেখকের সৃজনকর্ম তাঁর সময়এর প্রতিনিধিত্ব করছে কিনা, তাঁর সময়এর যুগলক্ষণগুলি তাঁর সৃজনকর্মের শরীরে ছায়াপাত ঘটাচ্ছে কিনা। রোম ভস্মিভূত হবার সময় সম্রাট নীরোর বেহালা বাজানোর উপমাটা ক্লিশে হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু সম্রাট নীরো বেহালার ছড় টেনে একটা সঙ্গীতের সৃষ্টি করেছিলেনতো ! অপাংক্তেয় সেই সৃষ্টি আস্তাকুড়ে চলে গেছে কারণ সেই সৃষ্টি সময়ের দাবী মেটায়নি। গোষ্ঠীমানুষ, তার চারপাশ , আর সময় ভিন্ন আর কিছুই সাহিত্য শুধু নয় কোন সৃজনকর্মের বিষয়বস্তু হতে পারেনা। এই সময়এর যাকিছু সৃষ্টি বিচার আমি অন্তত এই মাপদন্ডেই করবো।
               
    দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণভেদ বিরোধী আন্দোলনের নিপীড়িত কালো মানুষের কবি, ফাঁসির দড়িতে মৃত্যুবরণকারী শহিদ কবি বেঞ্জামিন মোলায়েসএর দুঃসময় নামে একটি কবিতা উদ্ধৃত করি

“এখন সেই দুঃসময়, যখন
ঘন অরণ্যের আড়ালে
রোদ্দুর হারিয়ে গেছে
আমরা কেউ কোন প্রিয় মুখ
আর উজ্বলন্ত, দেখিনা
আমার মা নিঃশব্দে হেঁটে হেঁটে
কোথায় যাচ্ছে তা অন্ধকারে
ঠাওর করা দুঃসাধ্য
এখন কুঠারের আঘাতে আঘাতে
অরণ্যের অন্ধকার ছিন্ন ভিন্ন করে
এই ভয়ংকর সময়কে কে রুখতে চায়, কে ?
আমি তুমি আর
জঠরে যে ভ্রুণ আছে
সে”। (অনুবাদ সৌমিত্র সেনগুপ্ত)
 
    এ কবিতাতো একটা দেশের ও সময়ের বিশেষ প্রেক্ষিতে লেখা , কেমন করে দেশ কালএর উর্ধে উঠে গেলো? কিংবা তুরস্কের বিপ্লবী কবি ৬১ বছরের জীবনকালের বেশির ভাগটাই যার পলাতক ও বন্দী জীবন, সেই নাজিম হিকমতের জেলখানার চিঠির শেষ কয়েকটা পঙক্তি
আমি জেলে যাবার পর আরো বেশি উজ্বল হয়েছে দিন
আর আমি বারংবার সেই একই কথা বলছি
জেলখানার দশটা বছরে যা লিখেছি সব তাদেরই জন্য,
তাদেরই জন্য যারা মাটির পিঁপড়ের মত, সমুদ্রের মাছের মত অগণন
যারা ভীরু, যারা বীর, যারা শিক্ষিত, যারা শিশুর মত সরল
যারা ধ্বংস করে, যারা সৃষ্টি করে
কেবল তাদেরই বৃত্তান্ত আমার গানে।
আর যা কিছু, ধরো আমার জেলখানার এই দশটা বছর , শুধু কথার কথা”।
কবিতার শরীরে সময় আর মানুষের কথা রয়েছে বলেই এ কবিতা দেশ-কালের ঊর্ধে উঠে যায়
                 
    স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকে সাতটা দশক পেরিয়ে এলাম। প্রতিটি দশকেরই বিশেষ যুগলক্ষণ থাকতে পারে। সবগুলিই শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব হয়তো ফেলেনা। কারণ সমাজ বন্দোবস্তের বা সেই সমাজের মানুষের বোধএর তেমন কোন হেরফের হয়না। ধরা যাক মধ্য আশি থেকে  এই দুহাজার দশ এই প্রায় চার দশকে বাঙ্গালির সমাজ বন্দোবস্তে দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন এসেছে কি? কিংবা তার সৃজনশীলতাকে একটা নতুন বাঁকে এনে দাঁড় করাবে,খুঁজে পাবে আমাদের নাড়া দেওয়ার মত কোন উপাদান?  না আসেনি। প্রবল ভাবে এসেছে এক শূণ্যতা বোধএই সময়ের সাহিত্য সংস্কৃতিতে তাই শুধুই শূণ্যতা বোধ, শুধুই মধ্যবিত্ত মানুষের আত্মযুদ্ধ। সাহিত্য-নাটক গান বা বুদ্ধির চর্চায় এই চারটি দশক আগামী প্রজন্মের কাছে গর্ব করার মত কোন উপাদান দেয়নি। এই সময় অতএব শূণ্যতা বোধের সময়, অন্তত উপলব্ধীতে। হয়তো আরো অনেকের কাছে
    
    কোন কোন যুগে আমাদের মনন ও জীবনবোধ ও চর্চায় এক একটা বাঁক আসে, তখন আমাদের মনন ও সৃষ্টির ভুমিও উর্বর হয়। এরকমই হয়েছিল গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে তারপর আবার সত্তরের দশকে। চল্লিশের দশকে প্রগতি লেখক আন্দোলন ও গণনাট্য আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে আমাদের মননের যে উর্বর ভুমির নির্মাণ হয়েছিল তাইই একটা পরিণতি বিন্দুতে পৌছেছিল সত্তরের দশকে। জীবনের নবতর বোধের নির্মাণ ভুমি থেকেই ২য় যুদ্ধ পরবর্তী সময় কালে উঠে এসেছিলেন মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সলিল চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, সত্যজি রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রবিশঙ্কর, সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, উপল দত্ত, শম্ভূ মিত্র, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু এবং চিরদিন গর্ব করার মত কত নাম
     
    আমি চল্লিশ পরবর্তী সময়কালের কিংবা সত্তর দশকের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বা সেইসময়ের অভূতপূর্ব সৃষ্টি প্রাচুর্যের মধ্যে ঢুকবোনা , ঢোকা সম্ভবও নয় এই ক্ষুদ্র পরিসরের নিবন্ধে। শুধু এইটুকু বলি সত্তরের দশকটা ছিল বাংলার সমাজ জীবনে এক ক্রান্তিলগ্নের সময়কাল। সত্তর দশকটা  একদিকে ছিল মৃত্যুর দশক এবং একই সঙ্গে সৃজনের দশকও বটে। কবি বিমল ঘোষের কবিতার কয়েকটি পংক্তিতে আমি সত্তরের দশকটাকে ফিরে দেখবো

“কিনুগোয়ালার গলি
সোনার টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি
বারুদ গন্ধ বুকে নিয়ে আকাশে ফোটে জ্যোস্না
ময়লা হাতে ওকে তোরা ছুঁসনা
ওরে মওন, পৃথিবীর গভীর
গভীরতর অসুখ এখন”

    তো চল্লিশ পরবর্তী সময়কালে এইযে সৃষ্টি প্রাচুর্য, বাঙ্গালির মননের এই উর্বর নির্মাণভুমি তা সম্ভব হয়েছিল শিল্প-সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতার ছবি আঁকার জন্য। এমন নয় যে এখনকার শিল্প-সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতার ছবি বিন্দুমাত্র নেই। একটা ধারা আছে এবং থাকবেই, কিন্তু সেটা মূল শ্রোত নয় হতাশা এখানেই। এবং এখানেই বলার কথা যে আমরা সেই ধারাটিকে বেগবান করতে পারছি কিনা। সমাজ-বাস্তবতার শৈল্পীক প্রতিফলন সেই সাহিত্যকে কালোত্তীর্ণ করে। পাবলো নেরুদার ঐতিহাসিক নোবেল ভাষণের কয়েকটি বাক্য উধৃত করে এই নিবন্ধের ইতি টানবো যেখানে নোবেল জয়ী কবি, কবি ও কবিতার দায়বোধ সম্পর্কে তাঁর ভাবনার কথা ব্যক্ত করেছিলেন
“আমি কোন বই পড়ে কবিতা লিখতে শিখিনি। কাউকে আমি শেখাতেও পারবো না কি করে কবিতা লিখতে হয়। ... আমার এই পথচলার কাহিনি দিয়ে একটা কবিতা তৈরি হয়ে যায়। তাতে আমি মাটি থেকে উপাদান নিই, আত্মা থেকে উপাদান নিই। আমার কাছে কবিতা একটা কাজ, একটা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ক্ষণস্থায়ী কাজ, যার মধ্যে মিশে আছে একাকীত্ব ভাবনার বিশ্বস্ততা, আবেগ ও গতি, নিজের কাছে আসা, মানুষের কাছে আসা, প্রকৃতির গোপনীয়তার প্রকাশ। আমি প্রবলভাবে বিশ্বাস করি যে মানুষ তার ছায়ার সাথে,আচরণের সাথে,কবিতার সাথে যে আটকে আছে, মানুষের যে সমাজবদ্ধতার চেতনা, তা সম্ভব হয়েছে কারণ মানুষের একটা প্রচেষ্টা আছে স্বপ্ন আর বাস্তবকে মেলানোর। কবিতা এই স্বপ্ন ও বাস্তবকে মেলানোর কাজটা করে”

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন