সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৩

গল্প - মৌ দাশগুপ্তা

মাতৃহীন
মৌ দাশগুপ্তা


সায়কের বাড়ীতে মানুষ বলতে তিনটে প্রাণী। সায়কের বাবা, সৎ মা আর সায়ক। ওর নিজের মা মারা গেছে সে ছোট থাকতে। সাধারণ মৃত্যু না খুন তা সে জানেনা। কিন্তু তার মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবাকে বেশ কিছুদিন জেলে থাকতে হয়েছিল। মামাবাড়ী তার একটা আছে বলে সে কানাঘুষোয় শুনেছে কিন্তু সে বাড়ীতে কে কে থাকে, তা ওর জানা নেই। যেমন জানা নেই সে জায়গাটাই বা কোথায়? পাড়া প্রতিবেশীদের বদান্যতায় ও জানে ওর বাবামায়ের বছর দশেকের বিবাহিত জীবনে বারো ঘর এ উঠানের বাসিন্দা ওর বর্তমান সৎ মাটির অসময় আগমনের কারনেই নাকি আজ ও মাতৃহারা। ওর মায়ের নামও এখন এ বাড়ীতে কেউ নেয় না। একটা ছবি থাকা তো দূর অস্ত। মাকে এখন আর মনে পড়ে না সায়কের। আর মাঝে মধ্যে এই না মনে পড়ার অসহায়তা ওকে হিংস্র করে তোলে। সায়ক তাই তার সৎ মাকে মা ডাকে না। এর জন্য ছোটবেলায় প্রায় প্রত্যেকদিন মার খেতে হত তাকে। এখন ও বড় হয়েছে। তাই সায়কও ভুলে যেতে চায় কিরকম শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে পার হয়েছে তার ছেলেবেলা । এখন ও কলেজে ভতি হয়েছে তাও নিজের টিউশনি পড়ানো আর খবরের কাগজ ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসার কাজটার সুবাদে। পাড়ায় ওর পরিবারের খুব বদনাম, এজন্যই বোধহয় তার স্কুলে পড়াকালীন সহপাঠীরা বা পাড়ার সমবয়সীরা খুব একটা তার সাথে মিশতো না। একটু বোধবুদ্ধি হওয়ার পর সায়কের মনে হয়েছে তার সৎ মা মহিলাটিও খুব একটা সুবিধার নয়। ওনার সম্পর্কে কানাঘুষোয় পাড়া বেপাড়ায় অনেক কথাই এখনো শোনা যায়। ঘৃণায়- লজ্জায় সায়ক আপাতত ঘরের সাথে পাট চুকিয়েই দিয়েছে। সটান মেদিনীপুরের সুতাহাটা ছেড়ে কলকাতার কলেজে ভরতি হয়েছে। থাকেও কলকাতায় মেসে।আসার আগে খালি হাত ছিলো, জীবনে প্রথমবার বাবার মনিব্যাগটা তুলে নিয়ে এসেছিলো সায়ক কিন্তু তার জন্য কোনদিন অনুতাপ হয়নি। আগে অনেকবার চুরি না করেই যখন বাবার হাতে চোরের মার খেয়েছে তখন নালিশকারিনী সৎমার মুখ টেপা হাসিটা মনে পরলেই আর খারাপ লাগতো না ওর। এর মাঝে কেটে গেছে দীর্ঘ একটি বছর।

-তিলু ,তোর কি হয়েছে বল তো? একটা সামান্য ভাগের অঙ্ক করতে কারো এতক্ষণ লাগে?
- ঘুম পাচ্ছে সায়কদা।
- তোর তো পড়তে বসলেই ঢুলুনি লাগে রোজ। নতুন আর কি।
- ঢুলুনি লাগে তো জানি। আগেতো এরকম ঘুম পায় নি কখনো।
- সারা দুপুর বিকেল করিস টা কি? তখন ঘুমাতে পারিস না?

- না, দুপুরে ঘরে কেউ থাকে না তো। ঘুমাবো কি করে? পাহারা দিতে হয় না?

- পাহারা আর তুই? কি পাহারা দিস শুনি? খালি বাজে বকা। মারবো এক থাপ্পড়।

তিলু প্রতিবাদ করে কিছু বলতে গিয়ে দিদির দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। তান্নি আর তিলু, দুজনেই ঘরে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে বসেছে। তিলু সবে ক্লাস ফোর, ওর দিদি তান্নি ক্লাস এইট। তিলুটা পড়াশুনোয় অমনোযোগী, তুলনায় তান্নিটার মাথা খুব পরিস্কার। দুজনকেই একসাথে পড়াতে হচ্ছে বলে কিছুটা সমস্যা হলেও সায়ক মানিয়ে নেয়। কি করবে? এই ক’টা মাত্র টিউশন। দুর্দিনে যা পেয়েছে সেটাই অনেক বেশি। এর ওপরই ওর পড়াশুনো, খাইখরচা, যাতায়াত। মন্দের ভালো যে তান্নির দিকে বেশি মনোযোগ দেয়ার দরকার নেই। ওদের কথার মধ্যেই বাড়ির ভেতর থেকে হঠাৎ চিৎকার আর কান্নার মাঝামাঝি একটা বোবা চিৎকারভেসে এল। প্রায়ইএটা আসে। মনে হচ্ছে বিকৃত গলায় কেউ যেন কাউকে ডাকছে। মা মা বলার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে বাক-প্রতিবন্ধী কেউ আছে এখানে। যে কথা বলতে পারেনা। তিলুর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল, যেন প্রবল অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে। উঠতে চাইছে না। তান্নি কিন্তু ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলল,

- আমি একটু আসছি সায়কদা, বলেই লঘু পায়ে বেরিয়ে গেল।

সায়ক জিজ্ঞাসা করলো,

- তিলু, কে কাঁদছে রে?

- কাঁদছে না, ডাকছে,

- কে ডাকছে? কাকে?

- বলতে মানা আছে।

- কে মানা করেছে?

- বলতে পারবো না।

কথার মাঝে তান্নি ফেরত আসে। হাতে ট্রেতে এককাপ চা আর পকৌড়া। রোজই এই সময় এ বাড়ীর কেউ না কেউ চা আর চায়ের সাথে টা দিয়ে যায়। সায়কের সামনে ট্রেটা নামিয়ে বললো,

- দিদা পাঠিয়ে দিলেন সায়কদা, সেই কলেজ থেকে সিধে এসেছেন। খিদে তো পেয়েছে নিশ্চয়ই।

হাত বাড়িয়ে চা টা নিয়ে সায়ক আবার একই প্রশ্ন করলো,

- কে কাঁদছে রে তান্নি?

তান্নি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভাইকে বললো,

- তোকে দিদা ডাকছে কেন দেখ,

তিলু লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে গেলে সায়কের দিকে না তাকিয়ে নীচু কিন্তু পরিস্কারগলায় তান্নি বলল,

- ও আমার মা সায়কদা, কথা বলতে পারেন না কিনা। বাবা রেললাইনে কাটা পড়ার পর কাউকে চিনতেও পারেননা।

চরম অস্বস্তি সায়ককে ছেঁকে ধরল। প্রশ্নটা করা খুব জরুরী ছিলো কি?

- এ্যাই! মাত্র সওয়া আটটা বাজে, এখনই হাই তুলছিস ক্যানো? বীজগণিতের পাঁচের চ্যাপ্টারের সবগুলো অঙ্ক কষা হলে ছুটী পাবি। এর আগে নো ঘুম। আমিও বসে রইলাম। নে অঙ্ক কর।
- আজ আর ভাল লাগছে না। কাল তো বিজ্ঞান এক্সাম। রিভিশন শেষ করে নিয়েছি তো। আজ একটু গল্প করো না সায়কদা।

- তুই কিন্তু বড্ড ফালতু কথা বলছিস আজকাল । কোথায় পড়ার সময়টা কাজে লাগাবে না শুধু ফাঁকিবাজি।
- কিন্তু আজ আমার পড়তে মন লাগছে না সায়কদা।
- এটা কি কথা হল মিঠু? এখন বাজে রাত সাড়ে আটটা।

মিঠুর মা ঢুকলেন। মাকে দেখেই মিঠু হাসিমুখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।

- আজ আর পড়ব না মামনি প্লীজ। সায়কদাকে বলো না আজ তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে।

ক্লাশ নাইনের তুলনায় মিঠু বেশ লম্বা, বরঞ্চ ওর মা বেশ ছোটখাটো।এখানে ওদের মা ছেলের সম্পর্কটা ভারী ভালো লাগে সায়কের। ও খেয়াল করে দেখেছে মিঠু কিন্তু ওর বাবাকে বেশ সম্ভ্রমভরে দূর থেকে কথা বলে আর যত আবদার ওর মায়ের কাছে। সায়ক এখানে এলে নিজের মায়ের অভাবটা খুব বেশী করে বুঝতে পারে। মিঠুর মা হাসিমুখে ছেলের মাথার চুলটা আদর করে ঘেঁটে দিয়ে বললেন,

- আজ পাগলটাকে না হয় ছেড়েই দাও সায়ক। একবার যখন বলেছে পড়তে মন নেই তখন কিছুতেই পড়াতে পারবে না। তবে মিঠু, কাল এমনটা হবে না তো বাবা? প্রমিস?

- হ্যাঁ মা, প্রমিস।

- আচ্ছা, সায়ক একটু বসো তবে। আজ বাড়ীতে নারায়ন পূজা ছিল কিনা। প্রসাদ এনে দিই। খেতে খেতে একটু গল্প করে নিয়ে তুমিও আজ একটু তাড়াতাড়িই না হয় ছুটী নাও। বলতে বলতে সায়কের মা বেরিয়ে গেলেন।

- আজ কিসের পূজো রে মিঠু?

একটু থমকে গিয়ে বলবে কি বলবে না ভেবে মিয়ানো গলায় মিঠু বললো,

- আজ আমার মায়ের বাৎসরিক ছিল সায়কদা।

- মানে?

- আমার তো নিজের মা নেই সায়কদা। আমার তাকে মনেও পড়ে না। কিন্তু মামনি বলেছে বছরে এই অন্তত একটা দিন আমায় সেই না দেখা মায়ের আত্মার শান্তির জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে। মামনি কিছু বললে কি আমি না শুনে পারি?

নাঃ,এখন না সত্যিই বড় কান্না পাচ্ছে। মায়ের জন্য নয়, সায়কের নিজের জন্য চোখ জলে ভরে উঠছে। বাইরে বুঝি বা অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে , আজকের বৃষ্টিটা বড়ই অদ্ভুত। থামার নামই নিচ্ছেনা। শুধু ঝরেই যাচ্ছে। আর ঘরের ভিতর লুকানো কান্নার চাপা গমকে কেটে যাচ্ছে এক মাতৃহারা সন্তানের জীবনের কয়েকটি সামান্য সময়ের একক।



1 comments: