সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৩

গল্প - সুজাতা ঘোষ

শিকারের টোপ
সুজাতা ঘোষ



অপরূপ সান্যাল অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরটাকে মেলে দেয় সোফার উপর। স্ত্রী এসে টিভি চালিয়ে চা দিয়ে যায়। অভ্যস্থ হাত অনিচ্ছা সত্বেও চায়ের কাপটা তুলে নেয় মুখের সামনে। চাতে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজটার পাতা অমনযোগী হয়ে ওলটাতে থাকে সে। নানা রকম একঘেয়ে খবর ভেসে উঠছে টিভির পর্দায়। হাতের পাতাগুলো ওলটাতে ওলটাতে তিন নম্বর পাতার ছোট করে লেখা একটা খবর চোখে পড়ে – সুন্দরবনে নদীর পারে একটি বাঘ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। আবার সেই গ্রামেরই গেস্ট হাউসের চৌকিদারের ছেলে নিখোঁজ। ঘটনাটি দুদিন আগে ঘটেছে। পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। এই দুই খবরের ভিতর কোন যোগাযোগ আছে কিনা তাও পুলিশ খতিয়ে দেখছে। অপরূপের হাতের কাপ মুখের সামনে ধরা আছে, চোখের সামনে খবরের কাগজ খোলা। এমন সময় স্ত্রী রশ্মি ঘরে ঢুকে চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে বলল – দেখো, সুন্দরবনের গ্রামে দুদিন আগে বাঘ ঢুকেছিল, তখন তোমরা ওখানে ছিলে না? টিভিতে দেখাচ্ছে, দেখো না ...

অপরূপ নড়েচড়ে বসল। সত্যিই টিভিতে দেখাচ্ছে। প্রচুর লোক জড়ো হয়েছে নদীর ধারে। বাঘটা তখন অবশ্য সেখানে নেই, নিয়ে যাওয়া হয়েছে পরীক্ষা করার জন্য। এরপর আরও অনেক খবর চোখের সামনে নড়াচড়া করেছে, তবে অপরূপ সমানে বাঘ আর চৌকিদারের ছেলের নিখোঁজের যোগাযোগ খুঁজে চলছে মনে মনে। কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছে না।

এখন অনেক রাত, প্রায় পৌনে তিনটে। অপরূপের চোখ দুটো বাক্সে বন্দী ‘মমি’ র মত খোলা। পাশে রশ্মি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ছটফট করতে করতে অপরূপ উঠে গেল রাস্তার দিকের বারান্দায়। এখানে বেশ শান্তি পায় সে। রাতের অন্ধকারে দুয়েকটা গাড়ি, আবার মাঝে মধ্যে লোকজনও চলাফেরা করে। অপরূপ রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ঠাণ্ডা হাওয়া ওর সমস্ত বিক্ষিপ্ত মন আর শরীরকে শান্ত করে দিয়ে যাচ্ছে। ঘুম পাচ্ছে আস্তে আস্তে অপরূপের, চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসছে। সেদিনও তো এরকমই দু চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছিল ঘুমের নেশায়।

অপরূপ আর সন্দীপ, দুজনে বেড়াতে গেছিল সুন্দরবন। অফিসের গেস্ট হাউসে উঠেছিল। দুই রাত আর তিন দিন, বেশ আনন্দের সঙ্গেই কাটিয়েছে ছুটিটা। থাকা খাওয়ার কোন অসুবিধাই হয় নি, চৌকিদার সম্পূর্ন নজর রেখেছিল ওদের আপ্যায়ন করার জন্য। যা কিছু পাওয়া যেত না গেস্ট হাউসে তা সবকিছুই চৌকিদার এনে দিত বাইরে থেকে, ওদের শুধু কষ্ট করে মুখ থেকে অর্ডারটা দিতে হত।

সন্দীপ একটু অন্য ধরনের মানুষ। অপরূপের শান্ত নির্ভেজাল জীবনের সাথে ওর কোন মিলই নেই। সন্দীপ জঙ্গলে ঘুরতে ভালোবাসে, জংলী প্রানী শিকার করে খেতে ভালোবাসে। জংলী মেয়েরা ওর ভীষণ পছন্দের। বলে রাখা ভালো – ওর স্ত্রী স্মিতা উচ্চ শিক্ষিতা, রুচি সম্পন্ন, বেশ আধুনিক। ওরা কি করে যে এত বছর ধরে একসাথে আছে বলা মুশকিল। সন্দীপ সবসময় একা একাই বেড়াতে যায়, ওর নাকি পোষায় না ওর স্ত্রীর সাথে। আর অপরূপ ওর স্ত্রীকে বাদ দিয়ে বাজার করতে যাওয়ার কথাও ভাবতে পারে না। সন্দীপের জোরাজুরিতে একরকম বাধ্য হয়েই প্রায় এসছে সুন্দরবন বেড়াতে। এ একেবারে অন্যরকম অভিজ্ঞতা স্বীকার না করে উপায় নেই। কোন কিছুর সময় ঠিক নেই, কোন পরিকল্পনা নেই, যেমন ইচ্ছা ঘুরে বেড়াও। সেই ইচ্ছাটাও আবার সন্দীপের ইচ্ছা অনুযায়ী। এক কথায় আদিম আনন্দ।

অপরূপের ঘুমের নেশা ভাঙছে আস্তে আস্তে; সেদিন ওখানে কি ছিল? যেটা সন্দীপ বাঘের খাবার বলে ওদের বসার টিলার থেকে বেশ কিছুটা দূরে বেঁধে রেখেছিল অন্ধকারে? ছটফট করছিল নিজেকে ছাড়ানোর জন্য, অপরূপের খুব কষ্ট হচ্ছিল দেখে। সন্দীপ ওকে বলেছিল – চুপচাপ বসে থাক। কথা বললে আমার কন্সেনট্রেশন

নষ্ট হবে। ঐ খাবার খেতে বাঘ আসবে আর আমি তাঁকে এখান থেকে গুলি করে মারব।

অপরূপ আঁতকে উঠে বলেছিল – তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে সন্দীপ! বাঘ মারবে, তোমাকে পুলিশে ধরবে। সন্দীপ বিরক্ত হয়ে বলেছিল – আঃ, চুপ করো তো, শিকার করতে না পারো, অন্তত দেখে আনন্দ নাও। তাছাড়া আমি না মারলে গ্রামের লোকেরা মারবে। তার চেয়ে আমি মারি। অপরূপ আর কোন কথা না বলে চুপচাপ বসে ছিল টিলার উপর। বাঘের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমে চোখ দুটো জড়িয়ে আসছিল ওর। প্রায় ঢুলতে শুরু করেছে এমন সময় একটা অস্বাভাবিক শব্দ আর ধস্তাধস্তির মত নড়াচড়া অপরূপের দুচোখ খুলে দিয়েছিল। কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না তার, ঐ দূরে জলের কাছাকাছি এক মূহুর্তের মধ্যে কি ঘটে গেল। অন্ধকার থাকার জন্যই আরও বেশী করে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর অপরূপ বুঝতে পারল বাঘটাকে সন্দীপ গুলি করেছে, তবে সাইলেন্সার থাকার ফলে ও শব্দটা বুঝতে পারে নি। সামনের দুটো প্রানীই ছটফট করছে। বাঘের পায়ে গুলিটা লেগেছে। বাঘটা পালানোর চেষ্টা করছে আবার শিকারও ফেলে যাবে না। তাই আহত অবস্তাতেই মুখে করে অন্য প্রাণীটাকে টেনে হিঁচড়ে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে।

সন্দীপ টিলা থেকে নামবার উপক্রম করতেই অপরূপ তাঁকে বাঁধা দিয়ে বলে – তোমার কোন কথাই আর আমি শুনব না, তুমি একপাও নামবে না। প্রথমত পায়ে গুলি করেছ, সামনে গেলে তোমাকে ও ছাড়বে না। তোমাকেও টেনে নিয়ে যাবে সাথে। সন্দীপ হাতের বন্দুকটা কাঁধে ঝুলিয়ে কোন উত্তর না দিয়ে অপরূপকে ধাক্কা মেরে নীচে নেমে যায়। অপরূপের সাহস হোল না একা টিলা থেকে নেমে যাওয়ার। এই অবস্তার মধ্যে সে ভয়ে ভয়ে কোনক্রমে টিলার উপর হাঁটুগেরে বসে রইল। ভোরের আবছা আলো ফুটতেই অপরূপ টিলা থেকে নেমে গেস্ট হাউসে ফিরে আসে।

আজ দুপুরেই কোলকাতা ফিরবে ওরা। এখন সকাল সাতটা। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দু-জন মুখোমুখি অথচ কোন ভাষা নেই মুখে। আর ধৈর্য রাখতে না পেরে অপরূপ নিজেই জিজ্ঞাসা করল - কি হোল বাঘটার শেষ পর্যন্ত? চায়ে চুমুক দিয়ে সন্দীপ গলা ঝেড়ে বলল – আমি পৌঁছানোর আগেই ও পালিয়ে গেছে। আমি জঙ্গল, গ্রাম ঘুরে যখন নদীর ধারে ফিরে আসি তখন দেখি ও জল খেতে এসেছে। আর সময় নষ্ট না করে তিনটে গুলি ছুঁড়ে দেই। গুলি খেয়ে বাঘটা একেবারে নীচে নেতিয়ে পড়ে।

অপরূপ কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় চৌকিদার এসে কড়া নাড়ায়, দরজা খোলা ছিল, ভিতরে ডাকতেই চৌকিদার ঢুকে কাঁদো কাঁদো মুখে বলে – বাবু আমার ছেলেটাকে খুঁজতে এসেছিলাম। অন্যদিন এসময়ে চলে আসে। কাল রাত থেকে...... বলতে বলতে চৌকিদার এবারে কেঁদেই ফেলে, বলে – দেখি ছেলে ঘরে নেই। কোথাও নেই, সব জায়গায় খুঁজে এসেছি। অপরূপ উঠে গিয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে বলে – কি বলছ কি? রাত থেকে নেই মানে?

চৌকিদার এবারে কাঁদতে কাঁদতে নীচে বসে পড়ে, নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলে – রাতে দরজা খুলে বাইরে প্রস্রাব করতে গেছিল আর ফেরে নি। সেই থেকেই খুঁজছি বাবু। অপরূপ বেশ চিন্তিত হয়েই বলল, চলো আমি যাব তোমার সঙ্গে খুঁজতে। আর চলো পুলিশেও একটা...

এতক্ষণে সন্দীপ এবারে প্রথম মুখ খুলে বলল – আর পুলিশের কি দরকার, ও হাতের কাছেপিঠেই কোথায়ও আছে। চলে আসবে, তুমি চিন্তা করো না। এবারে অপরূপ বেশ বিরক্তির সঙ্গে বলল – কি বলছ কি? রাত থেকে একটা ছোট্ট বাচ্চা ছেলে উধাও তাকে খুঁজতে হবে না! আর কথা না বাড়িয়ে অপরূপ ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়, চৌকিদারও একবার মুখ কাঁচুমাচু করে সন্দীপের দিকে তাকিয়ে অপরূপের পিছু নিল।

যতটা সম্ভব ঘোরাঘুরি করে ব্যর্থ হয়ে শেষে পুলিশে খবর দিয়ে অপরূপ চলে আসে গেস্ট হাউসে। বেলা বেশ গড়িয়ে গেছে, এখন রওনা না দিলেই নয়। সন্দীপ তাড়াতাড়ি বলল – রাস্তায় খেয়ে নেওয়া যাবেক্ষণ, এখন চলো তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়ি, না হলে দেরী হয়ে যাবে। অপরূপ ক্লান্ত মুখে বলল, না খেয়ে যেতে পারব না। সকাল থেকে কিছু পেটে নেই। একেবারে লাঞ্চ করেই বের হব। বাধ্য হয়ে সন্দীপও লাঞ্চ করার জন্য থেকে গেল।

সারা রাস্তা কোন বিশেষ কথা হয়নি এখনো পর্যন্ত, অনেকটা রাস্তা চলার পর চা খাওয়ার জন্য গাড়ি থামিয়ে সন্দীপ চায়ের দোকানে ঢুকেছে অর্ডার দিতে। অপরূপ নামতে যাবে এমন সময় চায়ের দোকানে চকলেট দেখে ওর মনে পড়ে, সন্দীপ কিছু চকলেট কিনেছিল গতকাল রাতে। সেগুলো কি করেছে? এর আগে কখনও ওকে চকলেট খেতে দেখে নি ও। সন্দীপের কাছে গিয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে অপরূপ জিজ্ঞাসা করে, কালকের অতগুলো চকলেট কি করলে? সঙ্গে সঙ্গে সন্দীপের মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে, চৌকিদারের ছেলেটাকে দিয়েছিলাম।

একটু থেমে আবার অপরূপ বলে, কখন দিলে? ওকে তো রাত থেকেই পাওয়া যাচ্ছে না। এবারে সন্দীপ চায়ের কাপ শক্ত করে ধরে দাঁত চিবিয়ে বলে, রাতেই দিয়েছি। অপরূপ কিছুক্ষণ কিছু একটা চিন্তা করে, তারপর চায়ে চুমুখ দিয়ে গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করে, কত রাতে? কখন দেখা হল ওর সাথে?

সন্দীপ প্রচণ্ড রেগে গিয়ে সোজা অপরূপের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, বাঘ শিকার দেখবে আর টোপ ফেলবে না?

অপরূপের মাথা এক মূহুর্তের জন্য জ্ঞানশূন্য হয়ে গেল। মনে হল ও এই জগতেই নেই। কিছুই মাথায় ঢুকছে না, অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশ। মাথাটা হালকা হয়ে আসছে, পা-দুটো মনে হয় আর শরীরের ওজন নিতে পারবে না। গাড়ির হর্নের শব্দে টনক নড়ল। অনেক কষ্টে পা-দুটোকে টেনে হিঁচড়ে নিজের শরীরটাকে গাড়ির ভিতর নিয়ে গিয়ে ফেলল। আর কোন কথা হয় হয় নি সন্দীপের সাথে সারা রাস্তায়।

ফিরে এসে আজ সকালেই অফিসে ঢোকে দুজনেই। সকাল থেকে এখনো পর্যন্ত কোন কথা বলার ইচ্ছা হয় নি অপরূপের। মানসিক চাপ আর অফিসের কাজ দুয়ে মিলে আজ দিনটা প্রচণ্ড কঠিন মনে হয়েছে।

সন্ধেতে অপরূপ ঘরে ফিরেও স্ত্রীর সাথে তেমন কথা বলে নি। টিভির খবরটা ওর ভিতরটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে সারা রাত। ভালো ঘুম হয় নি। সকালে খবরের কাগজটা ভয়ে ভয়ে হাতে নিয়ে বসে, এমন সময় হঠাৎ ওর দশ বছরের ছেলে প্রীতম দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ঘাড়ের উপর আহ্লাদে।

অপরূপ প্রীতমকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। ওর দুচোখ বেয়ে জলধারা বয়ে যায় ওরই অজান্তে। সেটা কার জন্য? ও ঠিক বুঝতে পারে না, প্রীতমের জন্য, নাকি চৌকিদারের ছেলের জন্য। আরও বেশী করে আঁকড়ে ধরল ছেলেকে বুকের মধ্যে।।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন