সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৩

ধারাবাহিক উপন্যাস - ঐন্দ্রিলা মুখোপাধ্যায়

 ভালোবাসার দিনকাল

ঐন্দ্রিলা মুখোপাধ্যায়






৪.
সন্ধ্যেবেলা শপিং সেরে পিৎজাহাটে চান্দ্রেয়ী, আত্রেয়ী আর ডিংগো ।
ডিংগো : মা রাতের জন্যে আরেকটা পিৎজা নিয়ে নাও না....
চান্দ্রেয়ী: রাতের জন্যে মানে ? এখনই প্রায় ন'টা বাজে , যা খাওয়ার খেয়ে নাও ।বাড়ী গিয়ে আবার কিসের খাওয়া ?
আত্রেয়ী: দিদি বেরিয়ে একটু কুলফি খাব কিন্তু ....আচ্ছা সায়নের শার্টের কালার টা একটু বেশি ডার্ক হয়ে গেলো না?
চান্দ্রেয়ী: না তো ....খুব আনকমন কালার....সবেতে এত কনফিউসড কেন? আর তোর কথায় আমি ওকে যতটা চিনেছি তুই ভালোবেসে দিচ্ছিস, এতেই ও ভীষন খুশি হবে দেখে নিস!
আত্রেয়ী: তাই যদি হবে ,তবে জাম্বোর ব্যাপারে তুই এত কনফিউসড কেন?
চান্দ্রেয়ী: না ঠিক কনফিউসড নয়...একটু বেশি বাছাই করি কারণ তোর জাম্বোর বড় বেশি নাক উঁচু ।
আত্রেয়ী: তাই....তো তুই কি বলতে চাইছিস জাম্বো সাধারণ জিনিসপত্র ব্যবহার করে না?
চান্দ্রেয়ী: না, একেবারেই তা নয়, রাজদ্বীপ অত্যন্ত সাদাসিধে , সপ্রতিভ কিন্তু ও কোয়ালিটিতে বিশ্বাস করে ।

আত্রেয়ীঃ তো, এত কিছু ভাল থাকা সত্ত্বেও, তুই এত হাঁফিয়ে উঠেছিস কেন?আর কেনই বা তোর সাঁঝের ওপর দুর্বলতা বেড়ে, উঠেছে ......এর উত্তরটা আমাকে বল তো শুনি...।
চান্দ্রেয়ীঃ(খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ) ত্রয়ী, তুই ব্যাপারটা অন্য ভাবে নিচ্ছিস ।রাজদ্বীপ আর সাঁঝ দুজনের দুটো ভিন্ন জায়গা।আমার রোজকার জীবনের যে একঘেঁয়েমি .........তার প্রধান কারন হল তোর জাম্বোর না থাকা আর ঠিক ততটাই বৈচিত্রহীনতা হল আমার কিছু না করা ...এরকম একটা জায়গায় থেকে যখন আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছি ,ঠিক সেই সময়ই সাঁঝের চোখে দিয়ে নিজেকে ফিরে পাওয়ার একটা চেষ্টা বলতে পারিস আমার সাঁঝের সাথে এই বন্ধুত্ব ।....হ্যাঁ তুই বলতেই পারিস সাঁঝ আমাকে ভালো বা খারাপ যাই বলুক তাতে আমার কি আসে যায়......ঠিক ,কিন্তু আমার সত্যি জাানতে ইচ্ছা করে এখনো আমার মধ্যে অনুভুতির সুক্ষ্মতাগুলো আদৌ আছে না মরে গেছে ......আর সবচেয়ে বড়ো কথা রোজের কথা বলার এক জন সঙ্গী...আই মিন ধ্যাত ...এত বোঝাচ্ছি কেন বলত ...?
আত্রেয়ীঃআমার ও তো সেই প্রশ্ন ......এতো বোঝাচ্ছিস কেন আর কাকে ?এই কথাগুলো কি আমায় বলছিস নাকি নিজেকে ...?
চান্দ্রেয়ী: তোদের হল ?চল...এবার এখান
থেকে ওঠ ...বেরোব তো ...আর ভাল্লাগছে না।


৫.
বাড়ী ফিরতে ফিরতে প্রায় সাড়ে দশটা বেজেই গেছে ......ডিংগো টি.ভি চালাতে যাচ্ছিল .... চান্দ্রেয়ী বলল " আর টি.ভি নয় ডিংগো...এবার শুয়ে পড় ......।"
চান্দ্রেয়ী চেঞ্জ করে এসে ব্যালকনিতে দাঁড়ায়...তারপর রকিং চেয়ার টা ঘুরিয়ে হাতে মোবাইল টা নিয়ে বসে ......আজ আকাশটা বেশ পরিস্কার ......দক্ষিনের হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ......স্বচ্ছ কালো আকাশের বুকে জোনাকির মত ...টিমটিম করে তারাগুলো জেগে আছে ...দূরে নিয়নের আলোয় মাখামাখি হয়ে আছে শুনশান রাস্তাটা...এক টা কি দুুটো কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে ...একটা রিক্শা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে ..... অদ্ভুত একটা নিশ্তব্দতায় গা ভাসিয়েছে মায়াবীনি কলকাতা ...চান্দ্রেয়ীর চোখ দুটো জুড়িয়ে আসছে ঘুমে... কোলে রাখা ফোনটা ভাইব্রেট করতে থাকে......চান্দ্রেয়ীর ঘুমের রেশটা কেটে যায়......রাজদ্বীপের ফোন .....
চান্দ্রেয়ী: হ্যালো ....বলো
রাজদ্বীপঃ হুম ...কি করা হচ্ছে ?...ওই 'সাস ভি কভি বহু থি ' মার্কা সিরিয়াল দেখছ...? আর এখন থেকেই নিজেকে' ভাবি সাস' বানিয়ে তোলার চেষ্টা করছ নাকি ?
চান্দ্রেয়ীঃ ধ্যাত ....তুমি যে কি বল তুমিই জান ...।
আমরা আজ শপিং এ গিয়েছিলাম ...সায়ন্তন আসছে তো ...।
রবিবার...তুমি চলে এসো কিন্তু শনিবার ... । 
আমি একা আর কতদিক সামলাব বল দেখি ?
রাজদ্বীপঃ পারো তো সবই... তা কি কি কিনলে শুনি ?
চান্দ্রেয়ী: ত্রয়ী তোমার আর সায়ন্তনের জন্যে দুটো শার্ট কিনেছে..... আর আমি ডিংগোকে একটা হাফ জিনস...ত্রয়ীর একটা শিফন শাড়ী....সায়ন্তনের জন্যে পার্ক অ্যাভিনিউয়ের একটা পারফিউম আর শেভিং সেট কিনে দিয়েছি ...।
তুমি রাতে কি খেলে?
রাজদ্বীপ :খেয়েছি ...।
খেয়েছি। গেস্টহাউসের ছেলেটা ভাল রাঁধে ......।
তা তোমার জন্যে কি কিনলে ?
চান্দ্রেয়ীঃ আমি আবার কি কিনব!!!
রাজদ্বীপঃ কেন? তোমার কিছু কিনতে ইচ্ছা করে নি ?আচ্ছা বল তোমার জন্যে কি নিয়ে যাব হায়দ্রাবাদ থেকে ?
চান্দ্রেয়ীঃনা মশাই.... আমার কিছু লাগবে না ...।
 তাও যদি আনতে চাও...।
তোমার যা ভাল লাগে এনো ...।
তুমি তো জানোই তোমার আনা যেকোনো জিনিস আমার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে ।
রাজদ্বীপঃ আচ্ছা সকালে কি যেন বলবে বলছিলে ...।
পরে বলবে বললে ...।
চান্দ্রেয়ীঃ কি বলতো ?ওহো...না সেরকম কিছু না ...।
আসলে মা বাবা নেই আমরাই তো ত্রয়ীর সব তাই না......তোমার দায়িত্ব অনেক !
রাজদ্বীপঃ সেটাও কি তোমায় বলতে হবে দয়ি ...।
আচ্ছা বল সাঁঝের সাথে কি গল্প করলে কদিন...?
চান্দ্রেয়ীঃ কথা সেরকম হচ্ছে কই? ডিংগোতো ল্যাপটপ ছাড়েই না...কাল রাত জেগে গল্পের বই পড়েছে তাই দুপুরে ঘুমচ্ছিল বলে...আমি একটু বসেছিলাম আর কি...তুমি কি রাগ করলে...?
রাজদ্বীপঃ আমার রাগের কি আছে ...তবে কি জানো তো তুমি তো সরল মনে সব বলছ কিন্তু বেসিক্যালি যারা এরকম চ্যাটিং করে তারা সবসময় সত্যি পরিচয় দেয় না...তার ওপর আবার একঘেঁয়েমি লাগলে বেশি দিন চালায়ও না....মাঝখান থেকে একটা ইমোশানাল অ্যাটাচমেন্টে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়....যাক ছাড়ো....বেশি রাত জেগো না....শুয়ে পড়....ঠিক আছে মাই কিউটিপাই.....
চান্দ্রেয়ী: তুমি আগে ফিরতে পারবে না ,না?আমার একা একা ভালো লাগে না একদম.....(চান্দ্রেয়ীর গলাটা কেমন যেন বুজে আসছিল....)
রাজদ্বীপ: প্লিজ দয়ি....এভাবে বলো না....ছেলেমানুষের মতো কথা বলছ....আমারও কি ভালো লাগে তোমাকে ছেড়ে ছেড়ে থাকতে ?....একটু হাসো....শনিবার গিয়ে সব ইন্টারেস্ট পে করে দেব....ঠিক আছে ??....যাও ঘুমিয়ে পড়ো.....
চান্দ্রেয়ী : হ্যাঁ ....ঠিক আছে....সাবধানে থেকো....বাই.... গুড নাইট ।
রাজদ্বীপ: গুড নাইট


৬.
চান্দ্রেয়ী মোবাইলটা অফ করে ঘরে আসে...।
ডিংগো খাটে শুয়ে আছে...হাতে ভিডিও গেম...।
ডিংগো এ কদিন মায়ের সাথে শুচ্ছে ...।
ও জানে বাবা আসলে ওর আর মায়ের কাছে শোওয়া হবে না.. চান্দ্রেয়ী ডিংগোর পাশে বসে বলে 'কি...ঘুম আসছে না?'
ডিংগো মাকে জড়িয়ে ধরে ...' মাম্মা জানো..এবার আমার বেস্ট ফ্রেন্ড পাল্টে গেছে....আগে মৈনাক ছিলো ...এখন বিনীত হয়েছে ...মৈনাকের সাথে একদিন খুব ফাইট হয়েছে '
চান্দ্রেয়ী : সেকি তোরা ওখানে মারপিঠ করিস....ফাদার ড্যানিয়েল কিছু বলেন না...!!!.আচ্ছা তোর ওখানে আমাদের জন্যে মনখারাপ করে না....'!!!
ডিংগো: আগে করত...এখন করে না...জান ,আমি টেবিল টেনিস শিখছি,...এবার ম্যাথে হাইয়েস্ট স্কোর করেছি ....
চান্দ্রেয়ী ডিংগোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে' অনেক রাত হল ডিংগো....এবার শুয়ে পড়...কাল অনেক কাজ.... ।'
...ওরা দুজনে শুয়ে পড়ে....নাইট ল্যাম্পের নীল আলোয় গোটা ঘরটার যেন এক শান্ত সমাহিত রূপ....কিন্তু চান্দ্রেয়ীর মনে শান্তি কোথায় ....তার এতবছরের সিস্টেমেটিক লাইফে কোথা দিয়ে যেন ঢুকে পড়েছে ,সাঁঝ ।তার তো আগে কখনো মনে হয়নি ...রাজদ্বীপ তাকে অবহেলা করেছে...নিজেকে নিয়েই শুধু ব্যাস্ত থেকেছে....তবে আজ কেন তার এমন মনে হচ্ছে....আজ কেন হঠাৎ সাঁঝ তার এত বেশি বন্ধু হয়ে উঠেছে ....কেন আজ সাঁঝের কথা মনে করতেই তার বেশি ভালো লাগে....আর কেনই বা সে সারাটা দিন সাঁঝের মধ্যেই ডুবে থাকে....কেন? কেন? কেন?....কি বলে এই ভাবনাটাকে? ...কে বলে দেবে এর সদুত্তর!!!
....চান্দ্রেয়ী ভাবে, যদি সত্যিই সাঁঝ কোনদিন কলকাতায় আসে ...আর চান্দ্রেয়ীর সাথে দেখা করতে চায়?....ও কি দেখা করবে?...বুকের ভেতরে যেন দামামা বাজতে থাকে ।....একটা শিহরণ অনুভব করে...আচ্ছা এই যে ও দিনের পরদিন সাঁঝের সাথে গল্প করছে ....কেন করছে? শুধুই কি ভালো লাগা ? একটা নেশা....কিন্তু কেন ?...তার অনুভূতির সাথে আপোষ করতে হয় না বলে? ....তাহলে কি তার এতবছরের জীবনে সে কি শুধু আপোষ ই করে এসেছে?....ভালোবাসা বলে কিছু ছিল না?....তার যদি এই বয়সে এসে এরকম ওলোট পালোট হয়.....আর সাঁঝ তো একটা ছেলে....তাহলে কি চান্দ্রেয়ী সাঁঝের ইমোশন নিয়ে নিজের অজান্তেই খেলছে????...উফফ একটা সজোরে ধাক্কা খেলো যেন চান্দ্রেয়ী !!!!....একটা দীর্ঘশ্বাস ...আর নিতে পারছে না ....কি সব ভাবছে..চোখটা বুজে ফেলে সে...ভাবে সম্পর্কের নাম দেওয়াটা কি এতটাই জরুরী ...নাই বা রইল কোনো সম্পর্ক কিংবা পুরোটাই মানবিক সম্পর্ক .....মনের ভেতরটা উথালপাতাল করে উঠল....আর তার মন্থনে একঘড়া কান্না উপচে উঠল ...বিছানায় উঠে বসল চান্দ্রেয়ী....টেবিল ল্যাম্পটা জ্বাললো....সাইড টেবিল থেকে জল নিয়ে খেলো......ঘড়িতে কটা বাজে দেখল....নাঃ একটু ঘুমোনো দরকার কাল অনেক কাজ আছে...কিন্তু তার শান্তির ঘুমটা যে চুরি হয়ে গেছে... নাঃ সাঁঝকে এড়িয়ে চলতে হবে যত কষ্টই হোক....এতেই সবার ভালো । এবার তার চোখের জল আর বাঁধ মানলো না...এই উপলব্ধি তার একান্তই নিজের ...এই কথাগুলো সে সাঁঝকেও বলতে পারবে না....রাজদ্বীপকে তো নয়ই.... ।


৭.
সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু বেলাই হল চান্দ্রেয়ীর ।ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ এসে দেখল আত্রেয়ী আজ চা বানিয়ে রেডি....দুজনে একসাথে চা নিয়ে বসল....সারাদিনের প্ল্যান ডিসকাশন হল...আজ সারাদিন অনেক কাজ....ঝাড়াঝুড়ি,পর্দা পাল্টানো....শেল্ফ গোছানো, বাগানের আর ব্যালকনির গাছ গুলোকে একটু কেটে ছেঁটে ঠিক করা....চান্দ্রেয়ী আর আত্রেয়ী কাজ গুলোকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিল..
সন্ধ্যেবেলা একবার বেরিয়ে সে ফ্লরিস্টকে অর্ডার করে আসে ....কেক আর কনফেকশনারীর অর্ডার দেয় মনজিনিসে.....নতুন টেবিল ম্যাট কিনে আনে...টেবিল সাজানোর ব্যাপারে সে আবার ভীষণ খুঁতখুঁতে... ...সারাদিন এইভাবে নিজেকে কাজে ভীষন ব্যস্ত রেখে সে সাঁঝকে ভুলে থাকতে চেষ্টা করে.............বাড়ি ফিরে আসার পর দেখল বিন্দু রান্না করতে আসেনি....অন্যদিন হলে চান্দ্রেয়ী ভীষন রেগে যেত....আজ কিন্তু সে ভাবল....ভালোই হয়েছে ডিংগো বাড়ি এসেছে কদিন....নিজে রেঁধে ওকে কিছু খাওয়ানোই হয়নি .....ছেলেটা আবার নর্থ ইন্ডিয়ান ফুড খেতে খুব ভালোবাসে ....তাই চান্দ্রেয়ী ডিনারে রাজমা , পালক পনীর আর পরোটা বানায়....
.....রাত্রে ত্রয়ী আসে দিদির সাথে একটু কথা বলতে ....দুইবোনে ছোটবেলার অনেক গল্প ডিংগোকে শোনায় ....এত হৈ চৈ এর মাঝে মাঝেও কিন্তু চান্দ্রেয়ী কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়....কেমন যেন তাল কেটে যায়....সবার মাঝে থেকেও সে এই নিখাদ আনন্দের স্বাদটা চেটেপুটে নিতেও পারে না....কিন্তু সে বদ্ধ পরিকর ....এখন কিছু দিন সে কোনোভাবেই সাঁঝের সাথে যোগাযোগ করবে না....এই মোহটা কাটাতেই হবে....
এইভাবে চান্দ্রেয়ী পরেরদিনটাও কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করে ।....সকাল থেকে ঘর সাজায়....ইকেবানা তৈরি করে....বেলায় ব্যাঙ্কের কাজে বেরোয়.... ।
....সন্ধ্যেবেলা ডিংগোর কলকাতায় স্কুলে পড়াকালীন বেস্ট ফ্রেন্ড অনীশের বাড়িতে নিমন্ত্রণে নিয়ে যায় ডিংগোকে....বেশ লাগে চান্দ্রেয়ীর...হাসি মজা গল্পে অনেকটা সময় কেটে যায়....
......ফেরার পথে চান্দ্রেয়ী ভাবে...একা থাকলেই তো যত সমস্যা ....মনটা ছটফট করে...রাতে বরং ত্রয়ীকে ডেকে নেবে...আজ রাতে একসাথে তিনজনে শোবে.... গতকালের মত গল্প করে কাটিয়ে দেবে....আর আগামী কাল তো শনিবার....সকালে তো তার অনেক কাজ....রবিবারের রান্নার জোগাড় ....চিকেন ম্যারিনেশন....কাজুর পেস্ট বানানো....পুদিনার চাটনি....হাঙ্গ কার্ড প্রসেস...আরও কত কি..!!! আর রাতের ফ্লাইটে তো রাজদ্বীপ এসেই যাবে.....এবার সে সব ভাবনা তাকেই দিয়ে দেবে.....আর না অনেক হয়েছে ....আর সে নিজেকে হারিয়ে যেতে দেবেনা....রাজদ্বীপকে নতুন করে আঁকড়ে ধরবে....নতুন ভাবে ভালোবাসায় রাজদ্বীপের সব অভিমান ভাঙিয়ে দেবে....মনের সবটুকু জুড়ে থাকবে তার জীবনের সামতলিক ক্ষেত্রটা....আর সে নিজের আইডেন্টিটি বাইরে খুঁজতে যাবে না ....ডিংগোর মাম্মা...মিসেস রাজদ্বীপ এর মাঝেই সে নিরাপদ ...এর মাঝেই সে আবদ্ধ থাকবে.....বাড়ির গেটের কাছে গাড়ী এসে থেমে যায়.... ।


৮.
শনিবার দুপুরবেলা....তিনজনে একসাথে লাঞ্চ করল...আজ ত্রয়ীর কোথাও বেরোনো নেই...যদিও থিসিসের জন্যে প্রফেসর অখিলেশ সান্যালের বাড়িতে যায় কিন্তু আজ যাবে না আগে থেকেই বলে এসেছিল....খাওয়া শেষ হতেই চান্দ্রেয়ী বলল' আজ ভীষন ক্লান্ত লাগছে ত্রয়ী ...আমি একটু শুয়ে নি....চারটে নাগাদ মিসেস রায় ফোন করবেন...ওনার এনজিও র ব্যাপারে ....ভাবছি রাজদ্বীপ এলে এবার সিরিয়াসলি কিছু করার কথা বলব...ল্যান্ডলাইনে ফোন করবেন...ঘুমিয়ে গেলে একটু ডেকে দিস'....
ত্রয়ী আর ডিংগো খুব মনোযোগ দিয়ে ফিয়ার ফাইল'সের রিপিট টেলিকাস্ট দেখছিল....ত্রয়ী বলল...'হুম...ডেকে দেব তুই যা রেস্ট নে'...
চান্দ্রেয়ী ঘরে এসে বিছানায় একটু শুতে যায়...ডিংগো খাটের ওপর ল্যাপটপটা ফেলে রেখেছে ...সরিয়ে রেখে শুয়ে পড়ে....ভাবে দুদিন ওটাকে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেনি....চোখ দুটো জুড়ে আসছে....একটা ঘুম ঘুম ভাব....একটা নিস্তব্ধতা....সেই নৈঃশব্ধতা ভেদ করে একটা মেটালিক সাউন্ড.....বিপ্ বিপ্...বিপ্ বিপ্...এটা কোথায়...দেখে তো মনে হচ্ছে ...একটা আই সি সি ইউ...কেউ কাঁদছে ...সামনে কে শুয়ে আছে...আরে ওই তো রাজদ্বীপ...চান্দ্রেয়ী বুঝতে পারছে না কেন সে এখানে....রাজদ্বীপ ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে 'যাও....সাঁঝ ডাকছে....ওর গাড়ীটা স্কিড করে...' ও ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সাঁঝকে দেখতে... সাদা চাদরে ঢাকা একটা মানুষ বিছানায় শুয়ে..মুখে অক্সিজেন মাস্ক...মনিটারিং চলছে....ওর দিকে হাত বাড়িয়ে আছে...চান্দ্রেয়ী হাতটা বাড়াতে যায় কিন্তু .... পাশ থেকে কে একটা ওর হাত ধরে নাড়ছে আর বলছে ' পেন ড্রাইভটা কই....কি গো কোথায় সরালে.........এই তো খাটে ছিল....পেন ড্রাইভটা কোথায় রাখলে মাম্মা....?'....চান্দ্রেয়ীর স্বপ্নের ঘোরটা কেটে যায়....ধড়ফড় করে উঠে বসে...একটু ধাতস্থ হয়ে ভাবে...উফ এটা স্বপ্ন ছিল? ইস্ কি সব দেখছিল...ডিংগো কে একটু ধমকেই বলে ওঠে...আমি বললাম তো একটু রেস্ট নিতে দে আমাকে...আর এভাবে কাউকে ঘুমের মধ্যে ডাকে ?...যাও নীচে যাও....সারাদিন খালি গেম গেম আর গেম....' ...ডিংগো 'সরি মাম্মা' বলে নেমে যায়...
চান্দ্রেয়ী আর ধৈর্য রাখতে না পেরে...ল্যাপটপ খোলে......ডিরেক্ট ফেসবুকে না গিয়ে ...মেলগুলো চেক করে...দেখে অচীন পাখি প্রোফাইল থেকে মোটে একটা মেসেজ....একটু অবাক লাগে চান্দ্রেয়ীর...এই দুদিনে সাঁঝের মোটে একটা মেসেজ ??...মেলটা খোলে...লেখা ' প্লিজ কল....9830046586...ইট'স ভেরি আরজেন্ট....' আজ বেলা দশটায় এসেছে মেসেজটা....চান্দ্রেয়ীর মনের মধ্যে সব জট পাকিয়ে যায়..'.কি এমন প্রবলেম হতে পারে'....এটা ভাবতে গিয়ে স্বপ্নটার কথা মনে হয়...হঠাৎ একটা প্রবল অপরাধ বোধ কাজ করে....কিছু হয়নি তো সাঁঝের....???..ও তো সব বলেই বন্ধ করতে পারতো গল্প করাটা...আর বেশি কিছু না ভেবে ফোন নাম্বারটা ডায়াল করে.....
রিং হচ্ছে....ও প্রান্তে
হ্যালো....
চান্দ্রেয়ী...একটু চুপ থেকে 'হ্যালো আমি ...আমি দয়িতা বলছি...'
ওহো....হাও আর ইউ ম্যাম...কখন মেল পাঠিয়েছি....আর কখন ফোন করছিস বলতো দয়ি...
ইউ...ইউ মিন সাঁঝ????.
ইয়েস....বল কোথায় দেখা করব??
মানে ...তুই কোথায় ??
আই অ্যাম ইন কলকাতা ডিয়ার....বল তোর বাড়ি কোথায় এগজ্যাক্টলি ...আমি আজই দেখা করব....আর এই সারপ্রাইজটা দেব বলেই দুদিন কোনো মেসেজ করি নি'
আমার কেমন একটা হচ্ছে ...ভীষণ আনইজি লাগছে সাঁঝ...
কেন দয়ি আমরা কি দেখা করতে পারিনা....?...বাড়িতে অসুবিধে হলে বাইরে দেখা করি...তুই বল কোথায় হলে তোর সুবিধে ?
বেশি ভেবে কাজ নেই...তুই সায়েন্স সিটির উল্টো দিকে মিলন মেলায় ক্র্যাফ্ট ফেয়ার চলছে ...ওখানে আয়...বাই দ্য ওয়ে তুই কতদূরে....
আমি নর্থ এ...শোন না এখন ৩:২০...তুই সাড়ে চারটেয় চলে আয় ....মিলন মেলার সামনের গেটে ....আমি নাইকের ইয়ালো টিশার্ট ...ব্লু ডেনিম জিনস...
নর্থে কোথায়....??
বেলেঘাটায়...
কোথায়??...হ্যালো...হ্যালো
লাইনটা কেটে যায়....ফোনটা ছেড়ে চান্দ্রেয়ী ঘড়িটা দেখে...চোখটা বুজে একটু ভাবতে চেষ্টা করে....চান্দ্রেয়ীর সব বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে ...তার ভীষন অস্থির লাগছে....সেই জয় গোস্বামীর কবিতার মত তার 'তখন বুকের মধ্যে কাঁসর ঘন্টা শাঁখের উলু/একশো বনের বাতাস এসে একটা গাছে হুলুস্থূল' অবস্থা ।তার সব কাজ এবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ...কুশন কভার পাল্টানো......কার্পেট পাতা...ইনডোর প্ল্যান্ট চেঞ্জ করা....সব ...সব কেমন যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে ...মনে হচ্ছে সেই প্রথম রাজদ্বীপের সাথে দেখা হওয়ার কথা....নীচে ল্যান্ড লাইনটা বাজছে...ফোনের শব্দটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে ...কর্ডলেসটা হাতে নিয়ে ত্রয়ী চান্দ্রেয়ীকে দিতে যায় ...'দিদি ফোন....মিসেস রায় বোধহয়
চান্দ্রেয়ী বলে...'বলে দে আমি বেরিয়ে গেছি....আমি পরে ফোন করে নেব...'
ত্রয়ী ফোনটা ধরে কথা বলতে বলতে একটু অবাক হয়ে নীচে নেমে যায়....
....হাতে সময় কম....চান্দ্রেয়ী চোখে মুখে জল দেয়....ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে ...আলমারী থেকে একটা হালকা ভায়লেট আর ক্রীম কম্বিনেশনের শিফন শাড়ি বার করে পরে....খোলা চুলে হালকা একটু ব্রাশ করে... ঠোঁটে গ্রেপওয়াইন কালার লিপস্টিক....একটু পারফিউম...ব্যাগে সানগ্লাস পার্স চাবি মোবাইল সব রেখে পার্ল টপ আর পেনডেন্ট টা পরতে গিয়ে ড্রয়ারে খুঁজে পেল না....ওহো ওটাতো সেদিন ত্রয়ী পড়েছিল ...তাই ত্রয়ীর ঘরে আনতে যায় চান্দ্রেয়ী...পার্ল সেট পরে ত্রয়ীর ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে ...বেরোতে যাচ্ছে দেখে ত্রয়ীর মোবাইলটা বাজছে রিডিং টেবিলের ওপর....চান্দ্রেয়ী চেঁচিয়ে ডাকে....'ফোনটা ধর ত্রয়ী...' কোনো সাড়া নেই....টেবিলের সামনে এগিয়ে ফোনটা ধরবে কিনা একটু ইতস্তত করে.... মোবাইল স্ক্রীনে সায়ন কলিং দেখে...একটু হেসে .......চান্দ্রেয়ী ভাবে আজকে কথাটা হয়েই যাবে....ফোনের সুইচ ওকে করে.....
হ্যালো জিনা...বলোতো কোথায়?
চান্দ্রেয়ী চুপ...
হ্যালো জিনা.....আমি বেলেঘাটায় পিসির বাড়ী...আজ সকালেই পৌঁছেছি...রাগ করেছো ফোন ধরিনি বলে...হ্যালো ..হ্যালো....
চান্দ্রেয়ী লাইনটা কেটে দেয়....
জিনা-কলকাতা-বেলেঘাটা-অস্ট্রেলিয়া-সায়ন-সাঁঝ.....চান্দ্রেয়ীর মাথাটা ঘুরছিল...হ্যাঁ একই ফোন নাম্বার...একই কন্ঠস্বর একটু আগেই কথা বলেছে.....ও এতদিন কার সাথে কথা বলেছে....বেলেঘাটা টা শুনেই কেমন যেন একটু অস্বস্তি হচ্ছিল আর এখন তো আর .....
ঠিক সাঁঝই সায়ন .....!!!
চান্দ্রেয়ী ঘরে আসে....কেমন যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়..এই প্রথম তার ছোটো বোনকে তার একটু হিংসে হতে থাকে....দক্ষিণের জানলার পাশে এসে বসে....মনে করতে থাকে...কেমনভাবে ত্রয়ী তাকে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল....আর কিছু বন্ধুকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল....তার কিছুদিন পর একটা খাঁচাবন্দী পাখির ছবির প্রোফাইল নেম অচীন পাখি দেখে আর ত্রয়ীর মিউচুয়াল ফ্রেন্ড দেখে রিকোয়েস্ট পাঠায়....সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকসেপ্ট হয়ে যায়....অনলাইন দেখতে পেয়ে কথা শুরু ।
হাই
আমি অচীন পাখি
অচীন পাখি কারো নাম হয়নাকি?
না..তোমার নাম দয়িতা?..
.দয়িতা নামের মানে কি?
আগে তোমার নাম বল...
ওকে ...সাঁঝ ধরে নাও
তোমার ছবি নেই কেন?
তোমারও তো নেই....
.........
এইভাবে গল্প এগিয়ে গেছে নাম আর ছবি সব কিছু ছাপিয়ে.....ধীরে ধীরে তুমি থেকে তুই.....
.....কি ভুলটাই না চান্দ্রেয়ী করেছে.....তার দুচোখে জল থই থই করতে থাকে....সময় গড়িয়ে যায়....মোবাইল টা বাজতে থাকে...সাঁঝ থুড়ি সায়নের ফোন....অসহ্য লাগছে রিংটোন টা.....চান্দ্রেয়ী ফোনটা কেটে দেয়...আবার রিং হতে থাকে....এবার চান্দ্রেয়ী ফোনটা সুইচ অফ করে দেয়.....তার গলাটা কান্নায় বুজে আসছে....একটা বালিশ নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে....এমনিতেই একটা মিশ্র অনুভূতি ছিল এই দেখা করতে যাওয়ায় তার ওপর এই ধাক্কা ....চান্দ্রেয়ী বালিশে মুখ গুজে কাঁদতে থাকে..বাইরে আকাশটা লাল হয়ে আছে....চান্দ্রেয়ী ভাবে এই ভালোলাগাটার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল একটা প্রশ্ন ....এর শেষ কোথায় ??....কোনো শেষ নেই কিংবা দেখা হলেই শেষ....তার চেয়ে এই ভালো....ওর কান্নাটা বের হওয়ার দরকার আছে....ও বড় বিভ্রান্ত...ওর সমস্ত উন্মাদনা উত্তেজনা একমুহূর্তে যে শেষ হয়ে গেছে আজ...কিন্তু কাল তো ওকে এই সায়নের জন্যেই খাবার বানাতে হবে...টেবিল সাজাতে হবে.....ত্রয়ীর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে হবে....কিন্তু কাউকে বুঝতে দেওয়া চলবে না যে সেই দয়িতা...সাঁঝের দয়িতা....যার সাথে যোগাযোগ করার জন্যে সাঁঝ পাগলের মত ফোনে চেষ্টা করে যাচ্ছে আর ফোন কানে দিলেই শুনছে....
দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড ইজ সুইচড অফ নাও...প্লিজ ডায়াল আফটার সামটাইম...

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন