সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

বৃহস্পতিবার, ২০ জুন, ২০১৩

ছোট গল্প - পূজা মৈত্র

না মেলা অঙ্ক
পূজা মৈত্র



তারার মেইলটা এসেছে। অফিসে গিয়ে প্রথমেই মেইল ইনবক্স চেক করে প্রতীক। বরাবরের অভ্যাস। আজকেও করল। তবে আজকের চেক করাটা রোজকারের মত ম্যাড়মেড়ে নয়। একটা উত্তেজনা মেশানো কৌতূহল প্রতীকের কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম হয়ে জমা হয়েছে। হবে না-ই বা কেন? নীরস কেজো মেইল নয় এটা। তারা যদিও ওর কলিগ, ওদের কোম্পানির ক্যালিফোর্নিয়া অফিসের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। ঠিক যেমনটা প্রতীক কোলকাতা অফিসের। কিন্তু আজকের মেইলটা কোন প্রব্লেম সলভের রিকোয়েস্ট বা কোন নতুন আইডিয়া নিয়ে নয়। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। তারা আর প্রতীকের কি প্রেম চলছে? না, তা কেন হবে? প্রতীক বিবাহিত, তৃষার সাথে ছয় বছরের সুখী দাম্পত্য আর অনেক সাধ্যসাধনা করে পাওয়া দাম্পত্যের ফল দুই বছরের ফুটফুটে মেয়ে আনিশাকে নিয়ে দিব্যি আছে ও। তারা ওর কলিগ কাম বন্ধু অতিরিক্ত কিছু নয়। মাস তিনেকের একটা ট্রেনিং এর জন্য প্রতীক ক্যালিফোর্নিয়া গিয়েছিল। সেখানেই আলাপ, পরিচয়, বন্ধুত্ব। তবে আজকের মেইলটা নিয়ে প্রতীকের এত উৎকণ্ঠা কেন? দিন সাতেক হল ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ফিরেছে। চাইলেই আরও মাস তিনেক অনায়াসে কাটিয়ে আসতে পারত, কিন্তু তৃষা আর আনিশাকে খুব মিস করছিল।

আজকেই তো তারার ডক্টর ম্যাক্লারেনের ক্লিনিকে যাওয়ার কথা ছিল... হ্যাঁ, আজ, এখানে টিউস ডে মর্নিং, ওখানে মান ডে নাইট। মান ডে আফটারনুনেই তো যাওয়ার কথা ছিল। কি হল? তারা কি কনসিভ করেছে? আজকেই কি সেটা জানা যাবে? ইনসেমিনাইজেশন ঠিকঠাক হয়েছে তো? তারা আসলে সিঙ্গল মাদার হতে চেয়েছে। তাই পূর্ব সংগ্রীহিত বীর্য কৃত্রিমভাবে তারার মধ্যে দিয়ে, ওর ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার নির্ধারিত দিন ছিল আজ। আজ ওর ডিম্বাণু নিঃসরণ বা ওভ্যুলেশন এর দিন। আগের তিনটে ঋতুচক্র লক্ষ্য করে জানা গেছে যে, প্রতি ঋতুর চৌদ্দতম দিনে ওর ডিম্বাণু নিঃসরণ হয়। নিঃসৃত ডিম্বাণু ৩৬ থেকে ৭২ ঘণ্টা অবধি নিষেক যোগ্য থাকে। আবার শুক্রাণু স্ত্রী দেহে ৪৮ ঘণ্টার বেশি বাঁচেনা। সব মিলিয়ে আজই ইনসেমিনাইজেশনের উপযুক্ত দিন। আজকের দিনে বীর্য গেলে নিষেকের সম্ভবনা সর্বাধিক। ডক্টর ম্যাক্লারেন এতে সিদ্ধহস্ত। তারা কনসিভ করবেই। তারার জন্য এই সন্তান খুব জরুরী। ওর স্বামী সিদ্ধার্থ দুর্ঘটনায় মারা গেছে, প্রায় দেড় বছর হতে চলল। তারা সিদ্ধার্থকে খুব ভালবাসত। দ্বিতীয় বিবাহ ও করবে না। মা-বাবা অনেক বুঝিয়েছেন, তাও নারাজ। তারারা অনেক দিন থেকেই আমেরিকায়। তারার জন্ম নিউ ইয়র্কে। বাবা,মা দুজনেই আমেরিকার নামী ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন। উনারা এখন নিউ ইয়র্কেই থাকেন। তারা উদারমনা হাসি খুশি মেয়ে। ভারতীয় সংস্কার এখনো ওর মধ্যে প্রবল। আরও প্রবল একটা ইচ্ছা। মা হওয়ার ইচ্ছা। তারা মনেপ্রানে মা হতে চায়। কিন্তু বিয়ে করবে না। অগত্যা এই পন্থা।

প্রতীক চায় তারা যেন মা হতে পারে। তারার সাথে মিশে ওর মা-বাবার সাথে কথা বলে প্রতীকের মনে ওদের পরিবারের জন্য আলাদা সম্ভ্রম সৃষ্টি হয়েছে। তারার এই সিদ্ধান্তে ওর মা-বাবাও শরিক। কত কম জটিলতা উনাদের মনে। এদেশে হলে... প্রতীকের মনে পড়ে সেইদিনগুলোর কথা। তৃষা কনসিভ করতে পারছিল না বলে পরিবারে, পাড়ায়, আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কত কানাঘুষোই না শুরু হয়েছিলো। তৃষা নাকি বাঁজা! এমন কথাও শুনতে হয়েছিলো। তৃষার জন্য খারাপ লাগত খুব। মনমরা হয়ে থাকত মেয়েটা। লুকিয়ে কাঁদত। প্রতীকও কি কষ্ট পেত না? সন্তান তো সবাই চায়। অথচ তৃষাকে নিজের কষ্ট দেখাতে পারত না। পাছে ও কষ্ট পায়! আনিশা যেদিন হল, সেদিন তৃষাকে যতটা খুশি দেখেছে, আর কখনো দেখেনি। নিজেও তো খুশিতে পাগলপারা হয়ে গিয়েছিলো। তারার একটি অবলম্বন দরকার। মা-বাবা আর কত দিন? মানুষের কাউকে চাই, যে কিনা একান্ত নিজের হবে।

অথচ সমস্যা ছিল অন্য খানে। ডক্টর ম্যাক্লারেনের দুটি শর্ত ছিল। শুক্রানু দাতাকে তারার সম-দেশীয়, সমধর্মীয় এমন কি সম জাতীয় হতে হবে। আর সেই শুক্রানু দাতার নিজের একটি সন্তান থাকতে হবে। এতে সন্তানের সাথে তারার সাদৃশ্য থাকার সম্ভবনা সর্বাধিক। ভবিষ্যতের অহেতুক জটিলতা এতে কম হবে। ডোনারের নিজের সন্তান থাকলে ইন সেমিনাইজেশনের ফেলিওরের সম্ভবনা কম। কিন্তু ডক্টর ম্যাক্লারেনের শুক্রানু ব্যাঙ্কে এমন কোন দাতার শুক্রানু নেই। তারাও ভারতীয়,হিন্দু, বাঙালি এবং সন্তানের পিতা এমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছিল না, যাকে এই রিকোয়েস্ট করা যায়। প্রতীকের সাথে পরিচিত হয়ে ওর খোঁজার শেষ হয়ে ছিল। সংকোচের সাথেই প্রতীককে বলেছিল কথাটা। প্রতীকও তারার, তারার মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারেনি। অর্থের প্রলোভনে নয়, বন্ধুত্বের দাবিতেই রাজি হয়ে গিয়েছিল।আজ অফিসে আসার পথে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। তৃষা আর আনিশার সাথে অন্যায় করেছে ও। কিন্তু তাতে কি? ওরা তো জানবেই না কখনো। তারাও কনসিভ করার পর আর যোগাযোগ রাখবে না বলেছে, যাতে প্রতীক দুর্বল না হয়ে পরে। প্রতীকও আর যোগাযোগ রাখবে না। তবুও কনসিভ করল কিনা জানতে মনটা উতলা হয়ে পড়েছে। বাপ রে বাপ! তৃষার কনসিভ করার সময় কি হ্যাপা! কত গাইনি দেখিয়ে, ওষুধ পত্তর খাইয়ে, শেষে তৃষার ডাক্তার বন্ধু কুণাল কেসটা হাতে নিলে, ওর সিনিয়ারকে দেখিয়ে তবেই...তারাও না কোন হ্যাপায় পড়ে। যদিও গোটা তিনেক সিমেন স্পেসিমেন দিয়ে এসেছে প্রতীক...

মেইলটা চেক করল প্রতীক। ছোট মেইল... “ প্রতীক ইওর সিমেন ইজ azoosparmic.মিনস দেয়ার আর নো স্পারম ইন ইট। বাট হাউ ইট ক্যান বি?

হাউএভার আই অ্যাম অ্যাটাচিং ডক্টরস রিপোর্ট উইথ ইট। ” মাথাটা ঘুরে গেল প্রতীকের। রিপোর্টটা ওপেন করল। প্রতীক সেনেরই রিপোর্ট। থার্টি ফোর। মেল। সিমেন হ্যাজ নো স্পারম!!!!! তৃষা, আনিশার মুখ দুটো ফ্ল্যাশ করল প্রতীকের মাথায়...। আর একটা মুখ কার? গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। বরাবর অঙ্কে একশোয় একশো পাওয়া প্রতীক এই অঙ্কটার সমাধানে শূন্যই পয়াবে, বলা যায়।








1 comments:

  1. বেশ ভালো লেখা । ঝরঝরে লেখা । গল্প বলার মধ্যে যে মুন্সিয়ানা পাঠক প্রত্যাশা করেন ট্যাঁ আছে পূজার লেখার মধ্যে , কোন আড়ষততা নেই । ভালো ছোট গল্পের লক্ষণ - 'আমরা জানি হয়েও হইলনা শেষ' পড়ার পর এইরকমই মনে হবে । এই গল্পটা পড়েও পাঠকের মনে হবে যেন আর একটু হলে ভালো হতো, তারার জন্য একটু সহানুভুতি জাগে । এখানেই গল্পটার সার্থকতা । কারণ এটা তারার গল্প নয় - প্রতীকের গল্প । অনু গল্প হিসাবে বেশ ভালো লাগে - আমার শুভেচ্ছা ।

    উত্তরমুছুন