সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

মঙ্গলবার, ২০ নভেম্বর, ২০১২

শঙ্খ ভৌমিক

Do Androids Dream?




...তারপর অনুষ্টুপ মরে গেল। কুষ্টিতে ইচ্ছামৃত্যু ছিল। ১১-১১-১১ -তে রাত বারোটার সময় ফেসবুকে স্টেটাস আপডেট করল অনুষ্টুপ- " অদ্যই শেষ রজনী"। তারপর বেডসাইড ল্যাম্প জ্বালিয়ে "Do androids dream of electric sheep " বইটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লো। ফেসবুকে অনুষ্টুপের ১৯৮৪ জন বন্ধুদের মধ্যে ২০৫০ জন এই "স্টেটাস" "লাইক" করল। কিছু চনমনে বন্ধু বিভিন্ন "কমেন্ট" করলো। যার সারমর্মে অভিনেতা রজনীকান্তের উইল থেকে রজনী নামের লাস্যময়ী নারীর সংসর্গের উল্লেখ পাওয়া গেল। সেগুলো অনুষ্টুপের স্ক্রীনসেভার ভেদ করে ওর কাছে আপেলের নতুন Apps মারফত পৌঁছেছিল ঠিক-ই, কিন্তু স্টীভ জবসের অকাল মৃত্যুতে সেটা upgrade না হওয়ায় ওর খুলি ভেদ করে ব্রেনকোষে বৈদুত্যিক তরঙ্গ সঞ্চারে ব্যর্থ হল।

অনুষ্টুপের মাঝে মধ্যেই মরে যেতে ইচ্ছে করত। সবার যেমন বেড়াতে বা ময়দানে হাওয়া খেতে যেতে ইচ্ছে করে; অনুষ্টুপের সেরকম মরে যেতে ইচ্ছা করত। খুব ছোট বয়সেই ও মা-বাবা-কে হারায়। ওর মন খারাপের মুহূর্তে স্মৃতির অন্ধকার হাতড়ে এক দুটো ফ্রে্মের বাইরে মা-বাবা সম্বন্ধে বিশেষ কিছু খুঁজে পায় নি অনুষ্টুপ। ওর কেমন যেন মনে হত যে আলাদা একটা জগৎ আছে, যেখানে সবাই যেতে পারে না, যেখানে গেলে ওর মা-বাবা সঙ্গে দেখা হবে; আরো অনেক বন্ধু হবে।

শেষ দিনে ওর কি মনে হয়েছিল, সেটা ওর দিনপঞ্জি থেকে ঠিক বোঝার উপায় নেই। অনুষ্টুপের অন্তিম দিনটা নির্বিঘ্নেই কেটেছিল। ওর গানের সিডির জন্য শেষবার আবার রেকর্ড কোম্পানীকে যোগাযোগ করেছিল। এবং একই উত্তর পায়; এখনও তোমার সময় আসে নি-মাস্তুল মজবুত কর; পাল তোল; পশ্চিম থেকে পরিবর্তনের হাওয়া লাগলেই......... অনুষ্টুপ ফোন কেটে দিয়েছিল। তারপর মাস্তুলে চড়ে নির্বিকারভাবে শহরের ধোঁয়া ঢাকা অস্তিত্ত্বহীন স্কাইলাইনের দিকে তাকিয়ে খানিকটা কোক্‌নাসিকাসেবন করে তৃপ্তি পায়। শেষ বিকেলে শহরের জ্যামজট এড়িয়ে সে এসেছিল তার মন্দিরে- গানঘরে। সেখানে দীর্ঘ অনুশীলন শেষে সে ফ্ল্যাটে ফেরে রাত করে।




একসময় শহরে সকাল হল। সূর্য উঠলো নিজের গতিতে কিন্তু কেউ দেখতে পেলো না। অন্যান্য দিনের মতন কাকের ডাক ও কুকুরের চিৎকার ক্রমশ পরিণত হল গাড়ির কর্কশ হর্ন আর মানুষের হ্রেষাধ্বনিতে। টিভিতে সেই ধ্বনি আরো জোরালো হল বিদ্যা বালানের বিকিনির আলোচনায় আর পুন্‌ম পান্ডের আন্তউন্মোচনের ভাইরাল এমএমএস-এ। এই বিষয় বাবা রামদেব থেকে আন্না হাজারে পর্যন্ত সবাইকে গনতান্ত্রিক মতামত প্রকাশের অধিকার দেওয়ার জন্য সমস্ত টিভি চ্যানেলে ভীষণ হুটোপুটি লেগে গেল।

অনুষ্টুপের ফ্ল্যাটের অন্যান্যদের এই 'বিশেষ' সকাল আলাদা কোন স্বাদ এনে দিল না। আর পাঁচটা দিনের মতন রাতের বাঞ্ছিত ও অবাঞ্ছিত রতিস্বপ্ন সেরে সবাই ছুটলো তাদের অলীক স্বপ্নের দিকে। তবে দোতলায় মিস্টার ও মিসেস কাকাতুয়ার বাড়িতে এক চাপা শোরগোল শোনা গেল। মোহনের মা হঠাৎ কাজে না আসায় তাদের দৈনন্দিন জীবনে এক হ্যাঁচকা টান লেগেছে। মলম হিসেবে বাড়িতে দুধ দিতে আসা সুবলকে খুব একচোট বকে তাকে মোহনের মা-কে ধরে আনার হুকুম দেওয়া হল। সুবলের অপরাধ বছর চারেক আগে প্রেগনেন্ট মিসেস কাকাতুয়ার বাড়িতে কাজের লোক হিসাবে মোহনের মাকে সেই জোগাড় করে দেয়। কাকাতুয়াদের সকালের রোষ এড়ানোর জন্য সুবল বাধ্য হয় কিছুক্ষণের জন্য গা ঢাকা দিতে।

কিন্ত পাড়ার মোড়ে লিচুদার দোকানে সকালের প্রথম ধোঁয়া ছাড়ার মুহুর্তে পাঁচ মণের এক থাপ্পড় এসে পড়লো সুবলের ঘাড়ে। ঘুরে দেখলো যে পাড়ার হাতি শুড় উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিতীও থাপ্পড় পড়ার আগে, সুবল কোনমতে 'এক্ষুণি আসছি' বলে আবার উলটো মুখে হাঁটলো। ওর মনে পড়ে গেল, অনুষ্টুপের কাছে মাসখানেক কোকের বকেয়া টাকা জোগাড় করতে হবে। আবার যাতে কাকাতুয়াদের মুখোমুখি না হয়, তাই সন্তর্পনে সিঁড়ি বেয়ে অনুষ্টুপের ফ্ল্যাটের দিকে উঠতে লাগলো।

একই সময় 'পাগলা' মহিমও সিঁড়ি বেয়ে অনুষ্টুপের ফ্ল্যাটের দিকে উঠছিল। যদিও শহরে আর কেউ খেয়াল করে নি, সূর্য কিন্তু এই বিশেষ দিনের ইঙ্গিত দিয়ে যায় মহিমকে। রেলব্রিজের নিচে ত্রিপল দিয়ে বানানো ওর অচিন ঘরে আজ ভোরে সূর্য এক মুহুর্ত বেশিক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ায়। মহিম চমকে জ়েগে উঠেছিল। বাইরে বেড়িয়ে গভীর নিঃশ্বাস নিয়েই বুঝতে পারলো, আজ ইথারের প্রত্যেক তরঙ্গে অনুষ্টুপ। মহিমের মন হুহু করে ওঠে। কুয়াশার গায়ে এক হাল্কা চাদর জ়রিয়ে মহিম দ্রুত বেড়িয়ে পড়ে।

মহিম অফিসিয়ালি পাগল ঘোষিত হওয়ার পর রেলব্রিজের তলায় বাসা বাঁধে। সেখানেই ও প্রথম দেখে এক তরুণ কখনো গিটার, কখনো বেহালা বা কখনো একতারা বাজিয়ে গান গাইছে। নিজের মনে। মহিমের দেখে মনে হত ছেলেটা যেন নিজের জন্যই গাইছে। ওর পাশ দিয়ে ব্যস্ত শহর চলে যেত- কেউ ওর টের পেত না। শুধু ওকে ঘিরে নাচতো হাওয়া। ওর শরীরের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে হাওয়া খেলা করতো- অনুষ্টুপ যখন খুব উঁচুতে গান ধরতো, তখন হাওয়ার কি আনন্দ- ওর চুলে বিলি কেটে দিত। মহিমের অর্থহীন সামিজিক জীবনে এটা ছিল একমাত্র সুখের সঞ্চার। এইভাবে ক্রমশ অনুষ্টপের সঙ্গে মহিমের এক অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হয়।




মহিম ও সুবল প্রায় একই সময় অনুষ্টুপের ফ্ল্যাটে পৌঁছোয়। দরজ়া অল্প খোলা। ভেতর থেকে এক অদ্ভুত আলো আসছে। আলোর এই রঙ ওরা কেউ কখনো দেখে নি। সাহস করে যখন অনুষ্টুপের শোয়ার ঘরে পৌঁছোয়ে, তখন ওরা যে দৃশ্যের মুখমুখি হয় সেটা ব্যাখা করা অসম্ভব। এক বহুতলক শুয়ে থাকা অনুষ্টপের মাথার কাছে শূণ্যে উড়ছে; তার মধ্যে থেকে যে আলো বেরোচ্ছে সেটা পুরো ঘর ভরে দিয়েছে। তার মধ্যে মহিম এবং সুবল সন্মোহিত হয় দাঁড়িয়ে থাকে- ওদের চিৎকার থেকে কোন শব্দ বেরোয় না। এই অবস্থা কতক্ষণ চলেছে কেউই ঠিক বলতে পারে নি, কিন্তু সুবলের পরিত্রাহি চিৎকারে প্রথম অনুষ্টুপের অকাল দেহধারনের কথা পৃথিবী জানতে পারে।

পুলিশ আসে; দেহ পরীক্ষা করে ডাক্তাররা জানায় মৃত্যু স্বাভাবিক। থানায় দেহ সনাক্ত করতে অনুষ্টুপের কোন আত্মীয়-বন্ধু যখন এল না, মহিম পাগলা ও সুবল শেষ কাজের জন্য অনুষ্টুপকে নিয়ে শ্মশ্বানে পৌঁছোয়। এই সব সময় খুব স্বাভাবিক কারণেই শ্মশ্বানে বৃষ্টি পড়ে। অনুষ্টুপের বডি নিয়ে ইলেকট্রিক চুল্লির সামনে অপেক্ষা করতে করতে মহিম ধ্যানস্ত হয়; কিন্তু সুবল হঠাৎ ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো। ওর কান্না ক্রমশ বাড়তে থাকায়, বিরক্ত লালকেরা অন্য মাত্রা ভেদ করে মর্তে পদার্পন করলো। একজন এগিয়ে এসে বলল, "চুপ কর শালা!" সুবল তাও ফুঁপিয়ে যেতে লাগলো। তখন টেনে এক চড় কষিয়ে লালক বলল," চুপ করবি বে! বলছি তো অনুষ্টুপ দিব্যি আছে।" এবার সুবল বাচ্চাদের মতন হাঁউমাউ করে কেঁদে বলল ,"আমার কি হবে?" লালক সুবলের হাতে এক তারা নোট গুঁজে দিয়ে বলল, " ফোট শালা! তোর কিছু হবে না!" সুবল সুর-সুর করে কেটে পড়ল। রেলব্রিজের ওপর উঠে সুবল শেষ বারের জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে শ্বশানের দিকে তাকালো। শীতের বৃষ্টিভেজা অন্ধকারেও সুবল স্পষ্ট দেখতে পেলো সেই অশরীরি আলো, যা অনুষ্টপকে ঘিরে ছিল ওর শোয়ার ঘরে। সেই আলো শ্বশান ছেড়ে আকাশে উড়ছে! আর সেই আলোয় জ্বলজ্বল করছে এক সিংহাসন- যার ওপর হাসিমুখে বসে অনুষ্টুপ- ওকে ঘিরে নাচছে লালকেরা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন