দাদাজীর পাহুন
পাহুন ভাবছিল বইয়ের পাতায় চোখ মন কোনটাই না রেখে – দাদাজী প্রচুর ভাট বকে। খানিক্ষন আগে লোডশেডিং হয়েছে। শালা লোড নেওয়ার খেমতা নাই, শেডিং এর বাকতাল্লা। বহ্যারম্ভে লঘুক্রিয়া। হ্যাজাকের টুপিটায় আগুন দিয়ে পাম্পের বহর যত বাড়ল ওটার রঙ হলুদ থেকে লাল হয়ে সাদা হয়ে গেল। ঘরময় আলো । দাদাজীর চোখ বুজে গুড়গুড়ির টান অম্বুরির গন্ধ ছড়াচ্ছিল। আধখোলা চোখের লেভেল ক্রসিং আর গম গমে আওয়াজ ভেসে আসছিল – সুতোটা টান টান করে বাঁধ, এবার একটু পাম্প কর তেল পড়ুক টুপীটায়, এবারে আগুন দে, – এ পর্যন্ত ঠিক ছিল, দাদাজীর ভরসা টা পাহুন রেলিস করছিল একটু ভুরু কুঁচকে হলেও।
গোল বাধল এর পরেই । দাদাজী চোখ পুরো খুলে যখন হেঁকে উঠলেন – “সাবধান পাহুন, সাদা আগুনের আলো – ওর চারপাশে” – পাহুন আর থাকতে পারলো না, আমি জানি দাদাজী, ওইরকম সাদা আলোর চারপাশে করোনা বলে একটা ব্যাপার হয়, যাতে টেম্পারেচার ভীষণ বেশী হয়, ছোঁয়া লাগলে চামড়া ঝলসে যেতে পারে, আমাদের ক্লাসের বইতে আছে...
তোদের স্কুলে এখনি এইসব পড়াচ্ছে, তা জানিস কি কোন আলোর করোনা তে উত্তাপ সবচাইতে বেশী হয়? নাহ দাদাজির লেকচার শুরু হয়ে গেল এই ভেবে পাহুন বেশ বিরক্ত হল, বুড়ো হলেই কি এরকম হয়ে যেতে হয়, আর কিসসু বলার নেই। কি এত দেখল আর বুঝল বা জানলো এত্তা বছর বেঁচে থেকে গুড়গুড়ি টেনে। ওই মাঠের ধারের চা দোকানের বিষুন চাচা অনেক বেশী জানে, মাঠে কখন মেঘ নেমে আসে, গোল গোল কুয়াশাগুলো সিলিন্ডফারের মত কি করে গড়িয়ে গড়িয়ে ফুরিয়ে যায় শীতকালের সকালে বেলা বেড়ে গেলে, ব্যাঙের কোন ডাকটার কি মানে, ঝি ঝি পোকার কান্না টা আসলে কি করে বেরোয়, বেগুনের কোন রঙ দেখে বোঝা যায় গোড়ায় পোকা লেগেছে । বিষুন চাচা দোকান চালায় আর খেতি করে – ছোটো এক টুকরো জমিন আছে।
তবু ঘাড় গুঁজে উত্তর দিয়েছিল – জানি দাদাজী, হোয়াইট ফ্লেম তার করোনার উত্তাপ ফ্লেমের থেকেও বেশী আর সেটা সবচাইতে বেশী ঠিক শিখার ওপরে, বলেই সমস্ত কথায় যতি টেনে বলেছিল তুমি গুড়গুড়ি টানো, আমি একটু পড়ে নিই ...
সত্তরের বায়ুতাড়িত প্রস্টেটের চাপ আর ঘাড় গোঁজ পাহুনের ঘড় ঘড়ে আওয়াজের দ্বন্ধ মুলক সিন্থেসিস থেকে দাদাজী টের পেয়েছিলেন সাঁকো তৈরি হচ্ছে না। দাদাজীই বা কি করে, সারাজীবন কাজ করে গেছেন সংসার চালিয়েছেন সামর্থ্যে স্বাচ্ছল্য বহাল রেখে, দিয়েছেন আর্থিক নিরাপত্তা, সোনার মাছ সোনার মাছ তুমি কার – শুধু ফাতনায় চোখ রেখে আর কোনদিকে দেখেন নি। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন স্বচ্ছল পরিবারে তাদের চাহিদার যোগান দিয়ে, হঠাৎ দাদাজীর মনে পড়ে গেল ছেলের কথা। গম্ভীর ওইরকমই ঘাড় গোঁজ করে বসে থাকত, একটা কথারও উত্তর দিত না। ক্ষমতার পীক পিরিওডে অনন্তপ্রসাদ আবহমানের স্ব রচিত প্রেস্ক্রিপ্সান কাজে লাগাতেন দু চারটে গুব গাব আর তোর দ্বারা কিসসু হবে না’ র ধিক্কার।
একটু কি বুক চাপা নিঃশ্বাস পড়ল দাদাজীর। কি করে ছেলে মেয়ের সঙ্গে সহজ হতে হয়, গল্প করতে হয় সে সব ভাবার বয়েস যখন ছিল মন ছিল শুধুই অন্য ভিন্ন সব রেকারিং ঘাটের জলে। শুধু কচ্চিত একান্তে টের পেতেন তিনি একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ছেলে মেয়েদের কাছে যেখানে ওরা একটু আধটু পৌঁছয় ওদের মায়ের পেছন পেছন কখনো সখনো । আর পুরবীর তো দুটো স্টক কথা ছিল – “তুমি ওসব ভেব না তো” আর মেয়েরা যখন অজান্তেই একটু সহজ হত, তখন “বাবা কে একদম বিরক্ত করবে না”। ব্যাস দাদাজী’ও চুপ করে গম্ভীরের ভারিক্কে বাবা হতেন আর মেয়েরাও গুটিয়ে নিত নিজেদের।
ছেলেটা একদিন বড় হয়ে গেল, কিন্তু টের পেলেন সেদিন যখন পুরবীর আওয়াজে সেই সুর টা বেজেছিল যেটা পুরবীর গলা বাজাত যখন বিশেষ কিছু প্রায় অপছন্দের কথা শোনাতে হত। ভঙ্গীতে সেই একই রকম খোঁপার ভ্রুকুটির আমেজ একটু যেন অনন্তপ্রসাদের আধবোজা চোখের সামনে ভয়ে বিনীত আর মুখে সাঁটানো মন রাখা হাঁসি । অনন্তপ্রসাদ আজও উত্তর পান নি কি সিদ্ধি কি সার্থকতার ইতিহাস লেখা হত সেই সব সময়ে কিন্তু এটাও জানতে পারেন নি কোনোদিন যে ওখানে তখন ভেতরে ভেতরে একটা সিক্ত তৃপ্তির সুচনা হত।
গম্ভীর চলে যাচ্ছে – ভোপাল! পুরবী কোন রাখ ঢাক না করেই সোজাসুজি সেদিন বলেছিল। মাঁরহে? গুড়গুড়ির টানের ফাঁকে অনন্তপ্রসাদ যে আওয়াজটা ছেড়েছিলেন তার মানে পুরবী বুঝেছিল – মানে ও চাকরি পেয়েছে, চলে যাচ্ছে। খুব আস্তে গুড়গুড়ির নলটা মুখ থেকে সরিয়ে অনন্তপ্রসাদ দু হাতের মুঠোতে নলটা বুকের কাছে ধরে যেন কিছুর আশ্রয় খুজেছিলেন। মুখে শুধু বলেছিলেন ও, কবে! ততদিনে রিটায়ার করার দোরগোড়ায় এসে গেছেন । প্রায় ক্ষমা চাওয়ার মত করে পুরবী বলেছিল – কাল!
অফিস বেরুবার সময় গম্ভীরের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। গম্ভীর নিচু হয়ে প্রনাম করতে এলে হাত তুলেছিলেন, খানিকটা বাধা দেওয়ার ভঙ্গীতে খানিকটা আশীর্বাদের মত করে – থাক থাক, ভালো থেকো, চিঠি দিও – পৌছসংবাদ।
সেই গম্ভীর বিয়ে করল ভোপালেই – পুরবী গেছিল। বিয়ের পর ওরা এসেছিল একবার – অনুরাধা কে দাদাজীর খুব ভালো লেগেছিল। এসেই বলল আমি আপনাকে বাবু বলে ডাকব, বাবা নয়। এক বেলা পেরুবার আগেই আপনি তুমি তে পৌঁছেছিল। অনন্তপ্রসাদএকসঙ্গে মা মেয়ে আর বউয়ের মমতার মিশেল খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই যে ওরা চলে গেছিল, আর আসা হয় নি। পাহুন হওয়ার বছর আড়াইয়ের মাথায় পুরবী একদিন ছুটতে ছুটতে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল অনন্তপ্রসাদের হাঁটুর ওপর – কান্নায় কিছু বোঝা যায় নি, হাতে একটা টেলিগ্রাপ মুঠো করে ধরা ছিল।
ঘরের অন্য প্রান্তের অন্ধকারের দিকে চেয়ে অনন্তপ্রসাদের জানালাটা এক টানে খুলে ফেলতে ইচ্ছে হয়েছিল, আলো, বাতাস – কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। এতকাল শুধু পুরবীর দিকের দরজাটাই খোলা রেখে বাইরের আলো হাওয়া পেয়েছেন, সেদিন বন্ধ জানালাটার গরাদ ধরে ঝাঁকিয়ে বাইরেটা দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল অনন্তপ্রসাদের। প্রতিদিন শেভ করা নিজের মুখের আদল আর রেখাগুলো আয়ানায় দেখে দেখে অনন্তপ্রসাদের মুখস্ত হয়ে গেছিল। এতদিনের সেই আদলের ওপরে লাগান প্রভুত্ব আর শান্তির মায়াক্রিম চটে গিয়ে শুকনো শীর্ণ ভিখিরির মুখটার গলা দিয়ে একটা ফাটা আর্তনাদ বেরিয়েছিল – ভগবান!
গম্ভীর আর অনুরাধা দুজনেই চাকরি করত, ছোট পাহুন নানাজীর সঙ্গে থাকত সারাদিন আর রাতে বাবা মা এসে নিয়ে যেত। সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়িটাকে একটা ট্রাক দুমড়ে দিয়েছিল। দাদাজী আর পুরবী গিয়েছিল – ওদের ছাই আনতে আর সঙ্গে নিয়ে এসেছিল ছট্টূ পাহুন কে। পুরো কম্পেন্সেসানের টাকা নানাজী পাহুনের নামে ফিক্সড করে দিয়েছিলেন।
নানাজী গত আজ বছর কয়েক। আড়াইয়ের পাহুন আজ এগার। অনন্তপ্রসাদ বেশ বুড়ো হয়েছেন। এখন সারাদিন শুধু একটাই ইচ্ছে জেগে থাকে – সাঁকো গড়ার। নিজে নিজেই, কারুর মাধ্যমে নয়। পুরবীও যেন স্বস্তি পেয়েছেন তাতে। ইজি চেয়ারটা আজও আছে আর আছে গুড়গুড়ি। পুরনো অভ্যেসের বোধ গুলো রস বর্ণ বদলালেও রুপের ঝলক মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে ফেলে। দাদাজী আসলে কোনদিনই বন্ধু হতে শেখেন নি।
সেদিনের বাবাত্বের অলঙ্ঘনীয় মাসল ফোলানো অনন্তপ্রসাদ আজ পাহুনের কাছে পৌছনর তাগিদে নিজের শীর্ণ বাইসেপ্সে হাত বোলাতে গিয়ে থমকে গেলেন। অলীক জাল অলীক মাছ – ওরা কি ধরা দেবে না!
পাহুন ভাবছিল বইয়ের পাতায় চোখ মন কোনটাই না রেখে – দাদাজী প্রচুর ভাট বকে। খানিক্ষন আগে লোডশেডিং হয়েছে। শালা লোড নেওয়ার খেমতা নাই, শেডিং এর বাকতাল্লা। বহ্যারম্ভে লঘুক্রিয়া। হ্যাজাকের টুপিটায় আগুন দিয়ে পাম্পের বহর যত বাড়ল ওটার রঙ হলুদ থেকে লাল হয়ে সাদা হয়ে গেল। ঘরময় আলো । দাদাজীর চোখ বুজে গুড়গুড়ির টান অম্বুরির গন্ধ ছড়াচ্ছিল। আধখোলা চোখের লেভেল ক্রসিং আর গম গমে আওয়াজ ভেসে আসছিল – সুতোটা টান টান করে বাঁধ, এবার একটু পাম্প কর তেল পড়ুক টুপীটায়, এবারে আগুন দে, – এ পর্যন্ত ঠিক ছিল, দাদাজীর ভরসা টা পাহুন রেলিস করছিল একটু ভুরু কুঁচকে হলেও।
গোল বাধল এর পরেই । দাদাজী চোখ পুরো খুলে যখন হেঁকে উঠলেন – “সাবধান পাহুন, সাদা আগুনের আলো – ওর চারপাশে” – পাহুন আর থাকতে পারলো না, আমি জানি দাদাজী, ওইরকম সাদা আলোর চারপাশে করোনা বলে একটা ব্যাপার হয়, যাতে টেম্পারেচার ভীষণ বেশী হয়, ছোঁয়া লাগলে চামড়া ঝলসে যেতে পারে, আমাদের ক্লাসের বইতে আছে...
তোদের স্কুলে এখনি এইসব পড়াচ্ছে, তা জানিস কি কোন আলোর করোনা তে উত্তাপ সবচাইতে বেশী হয়? নাহ দাদাজির লেকচার শুরু হয়ে গেল এই ভেবে পাহুন বেশ বিরক্ত হল, বুড়ো হলেই কি এরকম হয়ে যেতে হয়, আর কিসসু বলার নেই। কি এত দেখল আর বুঝল বা জানলো এত্তা বছর বেঁচে থেকে গুড়গুড়ি টেনে। ওই মাঠের ধারের চা দোকানের বিষুন চাচা অনেক বেশী জানে, মাঠে কখন মেঘ নেমে আসে, গোল গোল কুয়াশাগুলো সিলিন্ডফারের মত কি করে গড়িয়ে গড়িয়ে ফুরিয়ে যায় শীতকালের সকালে বেলা বেড়ে গেলে, ব্যাঙের কোন ডাকটার কি মানে, ঝি ঝি পোকার কান্না টা আসলে কি করে বেরোয়, বেগুনের কোন রঙ দেখে বোঝা যায় গোড়ায় পোকা লেগেছে । বিষুন চাচা দোকান চালায় আর খেতি করে – ছোটো এক টুকরো জমিন আছে।
তবু ঘাড় গুঁজে উত্তর দিয়েছিল – জানি দাদাজী, হোয়াইট ফ্লেম তার করোনার উত্তাপ ফ্লেমের থেকেও বেশী আর সেটা সবচাইতে বেশী ঠিক শিখার ওপরে, বলেই সমস্ত কথায় যতি টেনে বলেছিল তুমি গুড়গুড়ি টানো, আমি একটু পড়ে নিই ...
সত্তরের বায়ুতাড়িত প্রস্টেটের চাপ আর ঘাড় গোঁজ পাহুনের ঘড় ঘড়ে আওয়াজের দ্বন্ধ মুলক সিন্থেসিস থেকে দাদাজী টের পেয়েছিলেন সাঁকো তৈরি হচ্ছে না। দাদাজীই বা কি করে, সারাজীবন কাজ করে গেছেন সংসার চালিয়েছেন সামর্থ্যে স্বাচ্ছল্য বহাল রেখে, দিয়েছেন আর্থিক নিরাপত্তা, সোনার মাছ সোনার মাছ তুমি কার – শুধু ফাতনায় চোখ রেখে আর কোনদিকে দেখেন নি। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন স্বচ্ছল পরিবারে তাদের চাহিদার যোগান দিয়ে, হঠাৎ দাদাজীর মনে পড়ে গেল ছেলের কথা। গম্ভীর ওইরকমই ঘাড় গোঁজ করে বসে থাকত, একটা কথারও উত্তর দিত না। ক্ষমতার পীক পিরিওডে অনন্তপ্রসাদ আবহমানের স্ব রচিত প্রেস্ক্রিপ্সান কাজে লাগাতেন দু চারটে গুব গাব আর তোর দ্বারা কিসসু হবে না’ র ধিক্কার।
একটু কি বুক চাপা নিঃশ্বাস পড়ল দাদাজীর। কি করে ছেলে মেয়ের সঙ্গে সহজ হতে হয়, গল্প করতে হয় সে সব ভাবার বয়েস যখন ছিল মন ছিল শুধুই অন্য ভিন্ন সব রেকারিং ঘাটের জলে। শুধু কচ্চিত একান্তে টের পেতেন তিনি একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ছেলে মেয়েদের কাছে যেখানে ওরা একটু আধটু পৌঁছয় ওদের মায়ের পেছন পেছন কখনো সখনো । আর পুরবীর তো দুটো স্টক কথা ছিল – “তুমি ওসব ভেব না তো” আর মেয়েরা যখন অজান্তেই একটু সহজ হত, তখন “বাবা কে একদম বিরক্ত করবে না”। ব্যাস দাদাজী’ও চুপ করে গম্ভীরের ভারিক্কে বাবা হতেন আর মেয়েরাও গুটিয়ে নিত নিজেদের।
ছেলেটা একদিন বড় হয়ে গেল, কিন্তু টের পেলেন সেদিন যখন পুরবীর আওয়াজে সেই সুর টা বেজেছিল যেটা পুরবীর গলা বাজাত যখন বিশেষ কিছু প্রায় অপছন্দের কথা শোনাতে হত। ভঙ্গীতে সেই একই রকম খোঁপার ভ্রুকুটির আমেজ একটু যেন অনন্তপ্রসাদের আধবোজা চোখের সামনে ভয়ে বিনীত আর মুখে সাঁটানো মন রাখা হাঁসি । অনন্তপ্রসাদ আজও উত্তর পান নি কি সিদ্ধি কি সার্থকতার ইতিহাস লেখা হত সেই সব সময়ে কিন্তু এটাও জানতে পারেন নি কোনোদিন যে ওখানে তখন ভেতরে ভেতরে একটা সিক্ত তৃপ্তির সুচনা হত।
গম্ভীর চলে যাচ্ছে – ভোপাল! পুরবী কোন রাখ ঢাক না করেই সোজাসুজি সেদিন বলেছিল। মাঁরহে? গুড়গুড়ির টানের ফাঁকে অনন্তপ্রসাদ যে আওয়াজটা ছেড়েছিলেন তার মানে পুরবী বুঝেছিল – মানে ও চাকরি পেয়েছে, চলে যাচ্ছে। খুব আস্তে গুড়গুড়ির নলটা মুখ থেকে সরিয়ে অনন্তপ্রসাদ দু হাতের মুঠোতে নলটা বুকের কাছে ধরে যেন কিছুর আশ্রয় খুজেছিলেন। মুখে শুধু বলেছিলেন ও, কবে! ততদিনে রিটায়ার করার দোরগোড়ায় এসে গেছেন । প্রায় ক্ষমা চাওয়ার মত করে পুরবী বলেছিল – কাল!
অফিস বেরুবার সময় গম্ভীরের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। গম্ভীর নিচু হয়ে প্রনাম করতে এলে হাত তুলেছিলেন, খানিকটা বাধা দেওয়ার ভঙ্গীতে খানিকটা আশীর্বাদের মত করে – থাক থাক, ভালো থেকো, চিঠি দিও – পৌছসংবাদ।
সেই গম্ভীর বিয়ে করল ভোপালেই – পুরবী গেছিল। বিয়ের পর ওরা এসেছিল একবার – অনুরাধা কে দাদাজীর খুব ভালো লেগেছিল। এসেই বলল আমি আপনাকে বাবু বলে ডাকব, বাবা নয়। এক বেলা পেরুবার আগেই আপনি তুমি তে পৌঁছেছিল। অনন্তপ্রসাদএকসঙ্গে মা মেয়ে আর বউয়ের মমতার মিশেল খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই যে ওরা চলে গেছিল, আর আসা হয় নি। পাহুন হওয়ার বছর আড়াইয়ের মাথায় পুরবী একদিন ছুটতে ছুটতে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল অনন্তপ্রসাদের হাঁটুর ওপর – কান্নায় কিছু বোঝা যায় নি, হাতে একটা টেলিগ্রাপ মুঠো করে ধরা ছিল।
ঘরের অন্য প্রান্তের অন্ধকারের দিকে চেয়ে অনন্তপ্রসাদের জানালাটা এক টানে খুলে ফেলতে ইচ্ছে হয়েছিল, আলো, বাতাস – কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। এতকাল শুধু পুরবীর দিকের দরজাটাই খোলা রেখে বাইরের আলো হাওয়া পেয়েছেন, সেদিন বন্ধ জানালাটার গরাদ ধরে ঝাঁকিয়ে বাইরেটা দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল অনন্তপ্রসাদের। প্রতিদিন শেভ করা নিজের মুখের আদল আর রেখাগুলো আয়ানায় দেখে দেখে অনন্তপ্রসাদের মুখস্ত হয়ে গেছিল। এতদিনের সেই আদলের ওপরে লাগান প্রভুত্ব আর শান্তির মায়াক্রিম চটে গিয়ে শুকনো শীর্ণ ভিখিরির মুখটার গলা দিয়ে একটা ফাটা আর্তনাদ বেরিয়েছিল – ভগবান!
গম্ভীর আর অনুরাধা দুজনেই চাকরি করত, ছোট পাহুন নানাজীর সঙ্গে থাকত সারাদিন আর রাতে বাবা মা এসে নিয়ে যেত। সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়িটাকে একটা ট্রাক দুমড়ে দিয়েছিল। দাদাজী আর পুরবী গিয়েছিল – ওদের ছাই আনতে আর সঙ্গে নিয়ে এসেছিল ছট্টূ পাহুন কে। পুরো কম্পেন্সেসানের টাকা নানাজী পাহুনের নামে ফিক্সড করে দিয়েছিলেন।
নানাজী গত আজ বছর কয়েক। আড়াইয়ের পাহুন আজ এগার। অনন্তপ্রসাদ বেশ বুড়ো হয়েছেন। এখন সারাদিন শুধু একটাই ইচ্ছে জেগে থাকে – সাঁকো গড়ার। নিজে নিজেই, কারুর মাধ্যমে নয়। পুরবীও যেন স্বস্তি পেয়েছেন তাতে। ইজি চেয়ারটা আজও আছে আর আছে গুড়গুড়ি। পুরনো অভ্যেসের বোধ গুলো রস বর্ণ বদলালেও রুপের ঝলক মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে ফেলে। দাদাজী আসলে কোনদিনই বন্ধু হতে শেখেন নি।
সেদিনের বাবাত্বের অলঙ্ঘনীয় মাসল ফোলানো অনন্তপ্রসাদ আজ পাহুনের কাছে পৌছনর তাগিদে নিজের শীর্ণ বাইসেপ্সে হাত বোলাতে গিয়ে থমকে গেলেন। অলীক জাল অলীক মাছ – ওরা কি ধরা দেবে না!
bhishon bhalo laglo.
উত্তরমুছুন