নীললোহিতের জগৎ থেকে নীরার ভূবন
রবীন্দ্রউত্তর কালের বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক চলে গেলেন মহাপ্রস্থানের পথে! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই যাত্রায় তাঁকে একাই এগোতে হল! কয়েকজনকে নিয়ে নয়, একাই তিনি কিংবদন্তী হয়ে রইলেন বাংলার লেখালিখির ইতিহাসে। অনেকেই এই চলে যাওয়াকে বলছেন ইন্দ্রপতন! অপূরনীয় ক্ষতি মনে করে শোকার্ত অধিকাংশ! কিন্তু লেখক আসেন, লেখক যান! রয়ে যায় তাঁর সৃষ্টি! কালের কষ্টি পাথরের চৌহদ্দীতে! সেই চৌহদ্দী পেড়িয়ে অনেকেই শতাব্দী পাড় হন না! যাঁরা হন তারা ছাড়িয়ে যান অন্যান্যদের! শতবর্ষ পড়েও রবীন্দ্রনাথের মতো সুনীল প্রাসঙ্গিক থাকবেন কিনা সেটা ভাবীকাল বলবে! সুনীল যদিও সেটা নিয়ে ভাবিত ছিলেন না কোনোদিন!
সুনীল কোনোদিনও ভাবীকালের দিকে তাকিয়ে লেখেননি! তাঁর সময়কে তাঁর লেখার মধ্যে ধরার প্রয়াস ছিল তাঁর! যে নাগরিক জীবন বাস্তবতায় স্বাধীনতা উত্তর বাঙালির জীবন পরিব্যাপ্ত হয়ে চলেছে, সুনীল টের পেয়েছিলেন তার নাড়ির স্পন্দন! সেই স্পন্দনকেই বিম্বিত করলেন তাঁর লেখনীর জাদুতে! বিশেষ করে গ্রাম বাংলার ঘেরাটোপ পেড়িয়ে ক্রমাগত শহরমুখী নাগরিক বাংলার এই যুগান্তরের মানসিকতাকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ঠিক সময়মত! এবং নন্দিত হলেন পাঠকের বরমাল্যে! সুনীলসাহিত্য সেই নাগরিক জীবনের সপ্রতিভ মানসের সমৃদ্ধ প্রতিফলন! বাঙালি পাঠকের বিমুগ্ধতায় তাই অর্জন করলেন অফুরান ভালোবাসা!
যে কোনো বড়োমাপের সাহিত্যিক খুব অল্প সময়েই তাঁর নিজস্ব একটি ধারা সৃষ্টি করে তোলেন! সেই ধারারই ভক্ত হয়ে পড়ে একটা নির্দিষ্ট পাঠক শ্রেণী।এবং দিনে দিনে যার কলেবর বাড়তেই থাকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য জীবনেও ঠিক তাই হয়েছে। এই যে আধুনিক নাগরিক জীবন বাস্তবতায় আবর্তিত রোজকার জীবন, সেই জীবনের বিশ্বস্ত রূপকার সুনীল! ফলে তাঁর সাহিত্যে পাঠক তার চেনা জানা প্রতিদিনের জীবনের অনুষঙ্গগুলি খুব স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করতে পারে। বাংলার পাঠক তাই তাঁর সাবলীল লেখনীর পরতে পরতে আবিষ্কার করল বহমান সময়ের প্রতিদিনের কথোপকথন থেকে উঠে আসা জীবন অভিজ্ঞতার বিশ্বস্ত অনুলিখন। পাঠক পেল লেখকের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখালিখি শুরু দেশের এক বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণে! সদ্য স্বাধীন দেশ! দূর্বল অর্থনীতি! দেশভাগের কারণে ছিন্নমূল মানুষের জীবন সংগ্রাম! জীবিকা সঙ্কট! তীব্র খাদ্য সঙ্কট! সদ্যজাত গণতন্ত্র তখনো আঁতুর ঘরে। চারিদিকে একদিশাহীনতা। অস্পষ্ট ভবিষ্যৎ! মানুষ জীবনে স্থিতু হওয়ার জন্যে হন্যে হয়ে দৌড়াচ্ছে! কিন্তু পথের পুরো হদিশ নেই হাতের নাগালে! শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজের ভিতে ধরেছে ফাটল! একান্নবর্তী পরিবারের আশ্রয় ছেড়ে মানুষ শহরমুখী! রাবীন্দ্রিক স্থিতপ্রাজ্ঞ বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে আস্থার জল সিঞ্চন ক্রমেই দূরূহ হয়ে পড়ছে! তিরিশের কবিরাও স্থির কোনো প্রত্যয়ের নিশানা তুলতে পারছেন না!
এইরকম এক যুগ সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে তিনি এলেন! একা এবং কয়েকজন! প্রতিদিনের জীবনের সীমাবদ্ধ পরিসরটাকে ভেঙ্গে ফেলে প্রচলিত সমস্ত জীবন প্রকরণের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে অগ্রসর হলেন! শুরু হল বাংলাসাহিত্যে নবকল্লোল! শুরু হল কৃত্তিবাস যুগ! শুধু লেখার মধ্যে দিয়েই নয়, জীবনচর্চার প্রাত্যহিকতার মধ্যে দিয়েও প্রচলিত চেনা ছকের জীবন ও সাহিত্যের দিকে ছুঁড়ে দিলেন বলিষ্ঠ ও প্রত্যয়ী চ্যালেঞ্জ! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী ধ্যান ধারণায় মানুষ যখন তার পরিপার্শ্বের সমসাময়িক সামূহিক বিপর্যয়গুলিকে আর ব্যাখ্যা করতে পারচ্ছে না, অথচ চেষ্টা করে যাচ্ছে; সেই অক্ষমতার ক্ষোভ ভাষা পেয়ে গেল এই নবধারার কালাপাহাড়ী সঙ্গীতে!
আর ঠিক এইখান থেকেই শুরু হল বাংলা সাহিত্যের এক নবপর্যায়! সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন সুনীল! একদিকে তিরিশের কবিদের
প্রবল আন্তর্জাতিক মনন ও একধারে রবীন্দ্রনাথের শাশ্বত আধ্যাত্মিকতার সর্বব্যাপী প্রভাব! এইদুইয়ের মধ্যবর্তী প্রতিদিনের আটপৌরে জীবন বাস্তবতার নিবিড় কথোপকথনের পরিসর থেকে উঠে আসতে থাকল বাংলা সাহিত্যের নব প্রকরণ! শহরমুখী নাগরিক জীবনের অনুষঙ্গগুলির প্রতিফলনে প্রতিবিম্বিত হতে থাকল আধুনিক সাহিত্যের নির্যাস! আর ঠিক এইখানেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমে বাংলাসাহিত্যের পাঠক পেয়ে গেল একান্ত আপন নিবিড় এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর নিবিড়তর সঙ্গ! যে সঙ্গ রোজকার পায়ে চলা জীবনের পদধ্বনির সাথে সামঞ্জস্যে সংহত! সমৃদ্ধ!
সুনীলসাহিত্যে নাগরিক জীবনের যে বিস্তার তার পরিধিতে বাঙালি পাঠকের এক বৃহত্তর অংশ খুঁজে পেল তার প্রতিদিনের চেনাজানা পরিচিত জীবনের খণ্ড খণ্ড কাব্যগুলির অখণ্ডজীবনের এক গল্প! এবং রোজকার জীবন যাপনের আশা নিরাশার দ্বন্দ্ববিধুর প্রেম অপ্রেমের ভাষাগুলির একান্ত সহচর হয়ে উঠল তাঁর লেখনী। এই সহজআড়ম্বরহীনভাষারজাদুতেসুনীল তাঁর পাঠককে যে গল্প বলেন, তাঁর গদ্যে আর পদ্যে; সেই গল্পের সাথে পাঠক খুব সহজেই সংযোগ স্থাপন করে নেয় নিজেদের জীবনবাস্তবতার।এখানেইতাঁর এই বিপুল জনপ্রিয়তার মূল ভিত্তি! আর সেই সূত্রেই তিনি দুই বাংলার সাহিত্যমোদী পাঠককে টেনে নেন সুনীলবৃত্তে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য আবহের গভীরতম অন্তরে রয়েছে এক অম্লান উন্মুক্ত উদাসীনতা! যে উদাসীনতায় যেমন, কোনো কিছুর প্রতিই নেই কোনো উপেক্ষা বা অবহেলা! ঠিক তেমনি নেই কোনো কিছুকেই একান্তে আঁকড়ে ধরে সংকীর্ণ গণ্ডীবদ্ধ হয়ে পড়ার কোনো প্রবণতা! এইখানেই তাঁর সাহিত্যের আঁতুরেই রয়ে গেছে এক অমলিন নির্লিপ্ততা! যে নির্লিপ্ততার পথে রয়ে যায় অফুরান মুক্তির স্বাদ! আমাদের প্রতিদিনের জীবনের বাঁধাধরা প্রাত্যহিকতার ঘেরাটোপের মধ্যেই সেই মুক্তির স্বাদ নিয়ে হাজির হল নীললোহিত! যে নীললোহিত আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেকার ঘুমিয়ে থাকা নীললোহিতকে জাগিয়ে রেখেছে চারদশকের ওপর সময় ধরে! হয়ত এইখানেই তাঁর সাহিত্যিক ঋদ্ধি।
বাংলা সাহিত্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই এক মস্ত অবদান! নীললোহিত! তাঁর নীললোহিতের মধ্যে তাই বাংলার পাঠক পাঠিকা পেয়ে গেল অন্তরের অন্তরতম এক সহচরকে, যে জনঅরণ্যেরই একজন! সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এক অম্লান বন্ধু! যে ঘরোয়া হয়েও উন্মুক্ত বিশ্বপ্রাণের সাথে অনায়াস সামঞ্জস্যে সমৃদ্ধ! যার মধ্যে বিপ্লব না থাকলেও আছে স্বাধীন ব্যক্তিসত্তার নিরুচ্চার ঔদ্ধত্য! চরিত্রের সেই অনায়াস দৃঢ়তায় বাঙালি পাঠকের নয়নের মণি হয়ে উঠল তাই নীললোহিত! নীললোহিতের এই জগত, যেখানে আত্মবিসর্জনের ব্যাকুলতা নেই! আছে আত্মোপলব্দির অনায়াস প্রয়াস! যেখানে সমষ্টির মধ্যে ব্যাক্তিসত্তার একান্ত উদ্ভাসন! সেখানেই পাঠক পেয়ে গেল পরম নির্ভর।
লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও হয়ে উঠলেন পাঠক এবং প্রকাশক দুইয়েরই পরম ভরসা স্থল! দীর্ঘ চারদশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা সাহিত্যে এমন এক নির্মেদ ঋজুতা জুগিয়ে গেলেন সুনীল, যা সংবেদনশীল কিন্তু আবেগতারিত নয়! আধুনিক যুগের কণ্ঠস্বরে প্রত্যয়ী তবু ঐতিহ্যের সাথে সম্বন্ধহীন নয়! দেশীয় শিকড়ে ঋদ্ধ হয়েও আন্তর্জাতিক! এবং এইখানে তাঁর নীললোহিতের জগতের মধ্যেই তাঁর পাঠক তাঁকেই যেন নতুন করে আবিষ্কার করে নেয়! নীললোহিতের জগত থেকে নীরার ভূবনে তাদের প্রিয় লেখককে অর্দ্ধশতাব্দী ব্যাপী অনুভব করে চলেছে বাংলার পাঠক! সেই অনুভবের পরিসরেই পুষ্ট হয়েছে আধুনিক বাংলা সাহিত্য তার সুনীলায়নে।
নীড় আর নারী! পুরুষের জীবনের দুই কেন্দ্রবিন্দু! আবহমান পুরুষ সত্তা এই দুই কেন্দ্রকে ঘিরে আবর্তিত! কিন্তু সত্যিই কি নীড় আর নারী দুইটি ভিন্ন কেন্দ্র পুরুষের অনুভবী জীবন যাপনের সংগ্রাম বিক্ষুব্ধ সংশয় আর সঙ্কটে! বিশ্বাস আর প্রত্যয়ে! ভালোবাসা আর মমতায়! নাকি তা মূলত এককেন্দ্রিক অস্তিত্বের দুই ভিন্ন মুখ! পরস্পরের মধ্যে বিলীন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই এককেন্দ্রিকতাকে বেঁধে ফেললেন তাঁর নীরার মধ্যে!
সেই কেন্দ্রের অভিমুখেই নীললোহিতের বৃত্তায়ন! বৃত্তায়ন বাংলার পাঠককুলেরও! তাই নীরার জন্যে বাংলাসাহিত্যে অমরতার দাবী করতেই পারেন সুনীল! নীরার ভূবনে আবর্তিত আধুনিক বাংলার সাহিত্যমানস! হয়ত এখানেই সুনীল এক মহীরুহ।
তাই নীরার ভূবন, লেখক সুনীলের শুধু আত্মনির্মাণের পরিসরই নয়; তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তার ভরকেন্দ্রও বটে! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্যসাহিত্য এবং কাব্যসাহিত্যর অন্তর্লোকের পরিসরে নীরা বা নীললোহিত উভয় অঞ্চলেই পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে! গদ্য থেকে কাব্যে! কাব্য থেকে পদ্যে! বাংলার সাহিত্যমোদী তাঁর পাঠকবর্গও তাই নীললোহিতের জগত থেকে নীরার ভূবনে ধরে রেখেছে সমগ্র সুনীল সাহিত্যের সারাৎসার! আর সেই সূত্রেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে ওঠেন তাঁর জীবদ্দশাতেই জীবন্ত কিংবদন্তী স্বরূপ!আর এখানেই তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সমসমায়িক সাহিত্য রথীদের! বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ইতিহাসে তাই নীললোহিতের জগত থেকে নীরার ভূবন এক পরিব্যাপ্ত সত্য!
রবীন্দ্রউত্তর কালের বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক চলে গেলেন মহাপ্রস্থানের পথে! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই যাত্রায় তাঁকে একাই এগোতে হল! কয়েকজনকে নিয়ে নয়, একাই তিনি কিংবদন্তী হয়ে রইলেন বাংলার লেখালিখির ইতিহাসে। অনেকেই এই চলে যাওয়াকে বলছেন ইন্দ্রপতন! অপূরনীয় ক্ষতি মনে করে শোকার্ত অধিকাংশ! কিন্তু লেখক আসেন, লেখক যান! রয়ে যায় তাঁর সৃষ্টি! কালের কষ্টি পাথরের চৌহদ্দীতে! সেই চৌহদ্দী পেড়িয়ে অনেকেই শতাব্দী পাড় হন না! যাঁরা হন তারা ছাড়িয়ে যান অন্যান্যদের! শতবর্ষ পড়েও রবীন্দ্রনাথের মতো সুনীল প্রাসঙ্গিক থাকবেন কিনা সেটা ভাবীকাল বলবে! সুনীল যদিও সেটা নিয়ে ভাবিত ছিলেন না কোনোদিন!
সুনীল কোনোদিনও ভাবীকালের দিকে তাকিয়ে লেখেননি! তাঁর সময়কে তাঁর লেখার মধ্যে ধরার প্রয়াস ছিল তাঁর! যে নাগরিক জীবন বাস্তবতায় স্বাধীনতা উত্তর বাঙালির জীবন পরিব্যাপ্ত হয়ে চলেছে, সুনীল টের পেয়েছিলেন তার নাড়ির স্পন্দন! সেই স্পন্দনকেই বিম্বিত করলেন তাঁর লেখনীর জাদুতে! বিশেষ করে গ্রাম বাংলার ঘেরাটোপ পেড়িয়ে ক্রমাগত শহরমুখী নাগরিক বাংলার এই যুগান্তরের মানসিকতাকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ঠিক সময়মত! এবং নন্দিত হলেন পাঠকের বরমাল্যে! সুনীলসাহিত্য সেই নাগরিক জীবনের সপ্রতিভ মানসের সমৃদ্ধ প্রতিফলন! বাঙালি পাঠকের বিমুগ্ধতায় তাই অর্জন করলেন অফুরান ভালোবাসা!
যে কোনো বড়োমাপের সাহিত্যিক খুব অল্প সময়েই তাঁর নিজস্ব একটি ধারা সৃষ্টি করে তোলেন! সেই ধারারই ভক্ত হয়ে পড়ে একটা নির্দিষ্ট পাঠক শ্রেণী।এবং দিনে দিনে যার কলেবর বাড়তেই থাকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য জীবনেও ঠিক তাই হয়েছে। এই যে আধুনিক নাগরিক জীবন বাস্তবতায় আবর্তিত রোজকার জীবন, সেই জীবনের বিশ্বস্ত রূপকার সুনীল! ফলে তাঁর সাহিত্যে পাঠক তার চেনা জানা প্রতিদিনের জীবনের অনুষঙ্গগুলি খুব স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করতে পারে। বাংলার পাঠক তাই তাঁর সাবলীল লেখনীর পরতে পরতে আবিষ্কার করল বহমান সময়ের প্রতিদিনের কথোপকথন থেকে উঠে আসা জীবন অভিজ্ঞতার বিশ্বস্ত অনুলিখন। পাঠক পেল লেখকের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখালিখি শুরু দেশের এক বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণে! সদ্য স্বাধীন দেশ! দূর্বল অর্থনীতি! দেশভাগের কারণে ছিন্নমূল মানুষের জীবন সংগ্রাম! জীবিকা সঙ্কট! তীব্র খাদ্য সঙ্কট! সদ্যজাত গণতন্ত্র তখনো আঁতুর ঘরে। চারিদিকে একদিশাহীনতা। অস্পষ্ট ভবিষ্যৎ! মানুষ জীবনে স্থিতু হওয়ার জন্যে হন্যে হয়ে দৌড়াচ্ছে! কিন্তু পথের পুরো হদিশ নেই হাতের নাগালে! শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজের ভিতে ধরেছে ফাটল! একান্নবর্তী পরিবারের আশ্রয় ছেড়ে মানুষ শহরমুখী! রাবীন্দ্রিক স্থিতপ্রাজ্ঞ বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে আস্থার জল সিঞ্চন ক্রমেই দূরূহ হয়ে পড়ছে! তিরিশের কবিরাও স্থির কোনো প্রত্যয়ের নিশানা তুলতে পারছেন না!
এইরকম এক যুগ সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে তিনি এলেন! একা এবং কয়েকজন! প্রতিদিনের জীবনের সীমাবদ্ধ পরিসরটাকে ভেঙ্গে ফেলে প্রচলিত সমস্ত জীবন প্রকরণের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে অগ্রসর হলেন! শুরু হল বাংলাসাহিত্যে নবকল্লোল! শুরু হল কৃত্তিবাস যুগ! শুধু লেখার মধ্যে দিয়েই নয়, জীবনচর্চার প্রাত্যহিকতার মধ্যে দিয়েও প্রচলিত চেনা ছকের জীবন ও সাহিত্যের দিকে ছুঁড়ে দিলেন বলিষ্ঠ ও প্রত্যয়ী চ্যালেঞ্জ! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী ধ্যান ধারণায় মানুষ যখন তার পরিপার্শ্বের সমসাময়িক সামূহিক বিপর্যয়গুলিকে আর ব্যাখ্যা করতে পারচ্ছে না, অথচ চেষ্টা করে যাচ্ছে; সেই অক্ষমতার ক্ষোভ ভাষা পেয়ে গেল এই নবধারার কালাপাহাড়ী সঙ্গীতে!
আর ঠিক এইখান থেকেই শুরু হল বাংলা সাহিত্যের এক নবপর্যায়! সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন সুনীল! একদিকে তিরিশের কবিদের
প্রবল আন্তর্জাতিক মনন ও একধারে রবীন্দ্রনাথের শাশ্বত আধ্যাত্মিকতার সর্বব্যাপী প্রভাব! এইদুইয়ের মধ্যবর্তী প্রতিদিনের আটপৌরে জীবন বাস্তবতার নিবিড় কথোপকথনের পরিসর থেকে উঠে আসতে থাকল বাংলা সাহিত্যের নব প্রকরণ! শহরমুখী নাগরিক জীবনের অনুষঙ্গগুলির প্রতিফলনে প্রতিবিম্বিত হতে থাকল আধুনিক সাহিত্যের নির্যাস! আর ঠিক এইখানেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমে বাংলাসাহিত্যের পাঠক পেয়ে গেল একান্ত আপন নিবিড় এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর নিবিড়তর সঙ্গ! যে সঙ্গ রোজকার পায়ে চলা জীবনের পদধ্বনির সাথে সামঞ্জস্যে সংহত! সমৃদ্ধ!
সুনীলসাহিত্যে নাগরিক জীবনের যে বিস্তার তার পরিধিতে বাঙালি পাঠকের এক বৃহত্তর অংশ খুঁজে পেল তার প্রতিদিনের চেনাজানা পরিচিত জীবনের খণ্ড খণ্ড কাব্যগুলির অখণ্ডজীবনের এক গল্প! এবং রোজকার জীবন যাপনের আশা নিরাশার দ্বন্দ্ববিধুর প্রেম অপ্রেমের ভাষাগুলির একান্ত সহচর হয়ে উঠল তাঁর লেখনী। এই সহজআড়ম্বরহীনভাষারজাদুতেসুনীল তাঁর পাঠককে যে গল্প বলেন, তাঁর গদ্যে আর পদ্যে; সেই গল্পের সাথে পাঠক খুব সহজেই সংযোগ স্থাপন করে নেয় নিজেদের জীবনবাস্তবতার।এখানেইতাঁর এই বিপুল জনপ্রিয়তার মূল ভিত্তি! আর সেই সূত্রেই তিনি দুই বাংলার সাহিত্যমোদী পাঠককে টেনে নেন সুনীলবৃত্তে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য আবহের গভীরতম অন্তরে রয়েছে এক অম্লান উন্মুক্ত উদাসীনতা! যে উদাসীনতায় যেমন, কোনো কিছুর প্রতিই নেই কোনো উপেক্ষা বা অবহেলা! ঠিক তেমনি নেই কোনো কিছুকেই একান্তে আঁকড়ে ধরে সংকীর্ণ গণ্ডীবদ্ধ হয়ে পড়ার কোনো প্রবণতা! এইখানেই তাঁর সাহিত্যের আঁতুরেই রয়ে গেছে এক অমলিন নির্লিপ্ততা! যে নির্লিপ্ততার পথে রয়ে যায় অফুরান মুক্তির স্বাদ! আমাদের প্রতিদিনের জীবনের বাঁধাধরা প্রাত্যহিকতার ঘেরাটোপের মধ্যেই সেই মুক্তির স্বাদ নিয়ে হাজির হল নীললোহিত! যে নীললোহিত আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেকার ঘুমিয়ে থাকা নীললোহিতকে জাগিয়ে রেখেছে চারদশকের ওপর সময় ধরে! হয়ত এইখানেই তাঁর সাহিত্যিক ঋদ্ধি।
বাংলা সাহিত্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই এক মস্ত অবদান! নীললোহিত! তাঁর নীললোহিতের মধ্যে তাই বাংলার পাঠক পাঠিকা পেয়ে গেল অন্তরের অন্তরতম এক সহচরকে, যে জনঅরণ্যেরই একজন! সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এক অম্লান বন্ধু! যে ঘরোয়া হয়েও উন্মুক্ত বিশ্বপ্রাণের সাথে অনায়াস সামঞ্জস্যে সমৃদ্ধ! যার মধ্যে বিপ্লব না থাকলেও আছে স্বাধীন ব্যক্তিসত্তার নিরুচ্চার ঔদ্ধত্য! চরিত্রের সেই অনায়াস দৃঢ়তায় বাঙালি পাঠকের নয়নের মণি হয়ে উঠল তাই নীললোহিত! নীললোহিতের এই জগত, যেখানে আত্মবিসর্জনের ব্যাকুলতা নেই! আছে আত্মোপলব্দির অনায়াস প্রয়াস! যেখানে সমষ্টির মধ্যে ব্যাক্তিসত্তার একান্ত উদ্ভাসন! সেখানেই পাঠক পেয়ে গেল পরম নির্ভর।
লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও হয়ে উঠলেন পাঠক এবং প্রকাশক দুইয়েরই পরম ভরসা স্থল! দীর্ঘ চারদশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা সাহিত্যে এমন এক নির্মেদ ঋজুতা জুগিয়ে গেলেন সুনীল, যা সংবেদনশীল কিন্তু আবেগতারিত নয়! আধুনিক যুগের কণ্ঠস্বরে প্রত্যয়ী তবু ঐতিহ্যের সাথে সম্বন্ধহীন নয়! দেশীয় শিকড়ে ঋদ্ধ হয়েও আন্তর্জাতিক! এবং এইখানে তাঁর নীললোহিতের জগতের মধ্যেই তাঁর পাঠক তাঁকেই যেন নতুন করে আবিষ্কার করে নেয়! নীললোহিতের জগত থেকে নীরার ভূবনে তাদের প্রিয় লেখককে অর্দ্ধশতাব্দী ব্যাপী অনুভব করে চলেছে বাংলার পাঠক! সেই অনুভবের পরিসরেই পুষ্ট হয়েছে আধুনিক বাংলা সাহিত্য তার সুনীলায়নে।
নীড় আর নারী! পুরুষের জীবনের দুই কেন্দ্রবিন্দু! আবহমান পুরুষ সত্তা এই দুই কেন্দ্রকে ঘিরে আবর্তিত! কিন্তু সত্যিই কি নীড় আর নারী দুইটি ভিন্ন কেন্দ্র পুরুষের অনুভবী জীবন যাপনের সংগ্রাম বিক্ষুব্ধ সংশয় আর সঙ্কটে! বিশ্বাস আর প্রত্যয়ে! ভালোবাসা আর মমতায়! নাকি তা মূলত এককেন্দ্রিক অস্তিত্বের দুই ভিন্ন মুখ! পরস্পরের মধ্যে বিলীন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই এককেন্দ্রিকতাকে বেঁধে ফেললেন তাঁর নীরার মধ্যে!
সেই কেন্দ্রের অভিমুখেই নীললোহিতের বৃত্তায়ন! বৃত্তায়ন বাংলার পাঠককুলেরও! তাই নীরার জন্যে বাংলাসাহিত্যে অমরতার দাবী করতেই পারেন সুনীল! নীরার ভূবনে আবর্তিত আধুনিক বাংলার সাহিত্যমানস! হয়ত এখানেই সুনীল এক মহীরুহ।
তাই নীরার ভূবন, লেখক সুনীলের শুধু আত্মনির্মাণের পরিসরই নয়; তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তার ভরকেন্দ্রও বটে! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্যসাহিত্য এবং কাব্যসাহিত্যর অন্তর্লোকের পরিসরে নীরা বা নীললোহিত উভয় অঞ্চলেই পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে! গদ্য থেকে কাব্যে! কাব্য থেকে পদ্যে! বাংলার সাহিত্যমোদী তাঁর পাঠকবর্গও তাই নীললোহিতের জগত থেকে নীরার ভূবনে ধরে রেখেছে সমগ্র সুনীল সাহিত্যের সারাৎসার! আর সেই সূত্রেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে ওঠেন তাঁর জীবদ্দশাতেই জীবন্ত কিংবদন্তী স্বরূপ!আর এখানেই তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সমসমায়িক সাহিত্য রথীদের! বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ইতিহাসে তাই নীললোহিতের জগত থেকে নীরার ভূবন এক পরিব্যাপ্ত সত্য!
আপনার লেখা শুধু নীরবে পড়ে যেতে হয় --
উত্তরমুছুন