রং বেরঙের গল্প
মৌ দাশগুপ্তা
মৌ দাশগুপ্তা
“জীবন কি যে গতিময়, কত দ্রুত কেটে যায় সময়। এই তো সেদিনও ছিলাম ছোট্ট এক স্কুল পড়ুয়া । ফুটবল, ক্রিকেট খেলে,ঘুড়ি উড়িয়ে, লাট্টু লেত্তি আর মার্বেলের সম্ভার সামলে,পাড়ার মধ্যমনি বিবেকদাদার মত হবার অদম্য আগ্রহ বুকে পুষে,ছোট বোনটির সাথে অহেতুক খুনসুটিতে , অকারন ব্যস্ততা আর উচ্ছ্বাসে কেটে যেত আমার সেই ফেলে আসা দিনগুলো। জীবনের পরতে পরতে তখন বেঁচে থাকার সুগন্ধ। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম সোনালী সকাল, ক্লান্ত বিকেলে, তারা ভরা মোহময়ী রাত। কত সহজ সরল ছিল দিন গুলো। বড় আপন লাগতো বাড়ীর লাগোয়া ঝিল পাড়ের কৃষ্ণচূড়া গাছটা, বন্ধুদের সাথে ঝগড়া হলে, মায়ের কাছে বকা খেলে, বোনের সাথে আড়ি হলে, সেই একা থাকার, মন খারাপের বিষণ্ণ মুহূর্তে আমায় সঙ্গ দিত সে। কত কথাই না বলতাম তার সাথে, কত আবেগঘন, একা থাকার মুহূর্তের সে সাক্ষী আমার। এখন বোধহয় বয়সের ভারে তার টানটান বাকল হারিয়েছে মসৃণতা, ফাটা ফাটা হয়ে খসে পড়েছে । ছোটবেলায় নেলকাটার ঘষে ঘষে নিজের নাম লিখে রেখেছিলাম। অনেকদিন অবধি লেখাটা ছিল। গাছটা আজ বয়সের ভারে জরাজীর্ন, তবুও প্রাণের টান বুঝিবা এখনও থোকাথোকা লাল ফুল দেয় প্রতি বসন্তে। সকাল বিকাল আজও বুঝি বা দামাল হাওয়া একই ভাবে লুটোপুটি খায় বুড়ো কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে, পাতায় পাতায়।“
এতটা একটানা লিখে পেনটা বন্ধ করতেই হোল, পেনের রিফিল শেষ। নব্য লেখক দীপুর ব্যাগে অবশ্যি অন্য পেন আছে, কিন্তু লেখার খাতা থেকে চোখ তুলতেই মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল।অবাক কৌতুহলী দৃষ্টিতে এতক্ষন ও দীপুর দিকেই তাকিয়ে ছিল, দীপু চোখ তুলে তাকাতেই অন্যদিনের মতই একটু ঘুরে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রইল।দীপু জানে, আর একবারও ও এদিকে তাকাবে না।মনে হয় দীপুর মত ওর ও বোধহয় পানিহাটির “বারো শিবমন্দির” ঘাটটা খুব পছন্দের।
আজ কিন্তু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সহজে চোখ ফেরাতে পারছে না দীপু।আজ দোল। সকালে বোধহয় খুব রঙ মেখেছিল, তার গোলাপী আভা এখনও মোছেনি কপালের,গালের ওপর থেকে।চুলে এখনও তেলের ছোঁওয়া পড়েনি বোধহয়।আলতো হাতখোঁপার বাঁধন এড়িয়ে চুলের গুছিগুলো হাওয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে আপনমনে খেলছে,নাচছে। আহামরি সুন্দরী নয়,তবু শালীনতা মেশানো একটা আলগা শ্রী মেয়েটাকে অন্যরকম আকর্ষনীয় করে তুলেছে।দীপুর তরুন হৃদয় তার মনের সবটুকু ভালোলাগা দিয়ে মুহূর্তটাকে ধরে রাখতে চাইছে।ঐ বাসন্তী হলুদ ছাপা শাড়ী,ঐ গালে হাত দিয়ে আনমনে বসে থাকা,ঐ অস্তগামী সূর্য্যের আলোকে সারা গায়ে মেখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা,সব আজ দীপুর চোখে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।
নীল দীপুর ছোটবেলার বন্ধু, একপাড়াতেই বড় হওয়া, স্কুল থেকে কলেজে যাওয়া, পরে নীলের বাবার কাজের সূ্ত্রে সোদপুরে বদলী হয়ে আসলেও প্রযুক্তি বিজ্ঞানের বদাণ্যতায় যোগাযোগে ভাঁটা পড়েনি। কতটুকুই বা দূর। ওড়িশার রাউরকেলা আর পশ্চিমবঙ্গের সোদপুর-পানিহাটি। নীলের খুব ছোটবেলাতেই মা মারা যাবার কারণে,আর বাবার বদলীর চাকরী হওয়াতে ওরা দুই ভাই বোন নীরা আর নীল ওদের ঠাকুরদার কাছেই বড় হয়েছে। রুদ্রদাদু দীপুরও খুব আপনজন,নীরাদিদি তো এখনও ভাইফোঁটায় দীপু আসবে না বললে কেঁদে ভাসায়।এই নীরাদিদির বিয়ে উপলক্ষ্যেই গত সাতদিন ধরে দীপু সোদপুরে এসে রয়েছে।বাড়ীতে মেলা আত্মীয় স্বজনের ভীড়। সবাইকে চেনে না দীপু। তাই বিকালের দিকে নীল ঘরের ডামাডোলে বেশী ব্যস্ত থাকে বলে ও একাই পায়ে হেঁটে চলে আসে গঙ্গাতীরে। সূর্য্যাস্তের পরে উঠে যায়। সাতদিন ধরেই মেয়েটাকে দেখছে ও।বিকালের দিকে আরেকটি বেশ সুন্দরী, আধুনিক পোষাকে সজ্জিতা মেয়ের সাথে এই মেয়েটি আসে, দুজন সমবয়সী।তাই বোন নয়, বান্ধবী হওয়াই স্বাভাবিক। এই দ্বিতীয় মেয়েটি বোধহয় এখন চুটিয়ে প্রেম করছে পাড়ার কোন উঠতি হিরো সাথে। রোজ বিকালে ভালোমানুষ বান্ধবীটিকে সাথে করে গঙ্গার হাওয়া খাবার নাম করে আসে, এসেই হিরোর হিরো হন্ডাটিতে সওয়ার হয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে যায়,যতক্ষন না সে ফেরত আসে ততক্ষন বেচারী এই মেয়েটি একা একা ঘাটের পাশে বসে একমনে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
হঠাৎই ভালোলাগায় ছন্দপতন। হিরোর বাইকটা বীভৎস যান্ত্রিক আওয়াজ তুলে মেয়েটার পাশে এসে থামলো।মৃদু হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো ও। হিরো এবং তার বান্ধবীটিকে আর চেনা যাচ্ছেনা, এত বিভিন্ন রঙের আবীর ছড়ানো রয়েছে ওদের দেহের সর্বত্র। হিরো বাইক পার্ক করে নামলেন,একটু ঝুঁকে বান্ধবীর কানে কিছু বললেন। কাঁচভাঙ্গা আওয়াজের হিল্লোল তুলে গড়িয়ে পড়ল সঙ্গধারী রঙীন সঙ্গ সাজা সুন্দরী। হিরোসুলভ বীরত্বে হিরো এবার দু’হাতে আবীর নিয়ে অশ্লীলভাবে জড়িয়ে ধরে আগের মেয়েটিকে রঙ মাখিয়ে দিল।মেয়েটির ছটফটনি
দেখে বোঝা গেল ওর আপত্তি আছে। ছিটকে সরে যেতে গেলেও আঁচলটা মুঠো পাকিয়ে ধরে নিলেন হিরো।দোলের দিন, আর বোঝাই যাচ্ছে ওরা একে অপরের পরিচিত।তবু নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়য়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেল দীপু। ইতিমধ্যে অন্য মেয়েটিও গতি সুবিধার নয় দেখে প্রেমিক প্রবরের হাত চেপে ধরলো।গোটা ঘটনাটাই ভীষণ অল্প সময়ের মধ্যে এবং তাৎক্ষনিকভাবে ঘটে যাওয়াতে হিরোর হাতের মুঠো আলগা হয়ে গেল এবং মেয়েটিও টাল সামলাতে না পেরে দু তিন কদম এগিয়ে দীপুর গায়ে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তারপরেই চকিতে তাকাল দীপুর দিকে,কান্নার ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল আবীর রাঙানো গাল বেয়ে,অন্য কেউ দেখার আগে চট করে আঁচলে মুছে নিয়ে সরে দাড়ালো। ওদিকে দীপুকে আপদমস্তক দেখে নিয়ে বান্ধবীর সাথে কিছু একটা কথা বলে বাইকটা ঘোরালো হিরো, কিন্তু বান্ধবীটি কথা না শোনার ভান করে প্রথম মেয়েটিকে এসে জড়িয়ে ধরল।ওরই আঁচল দিয়ে যতটা পারে রঙীন আবীর ঝেড়ে ফেলে দিলো, অল্প হাসলো দীপুর দিকে তাকিয়ে, তারপর দু’জনে পা বাড়ালো বাড়ীর দিকে।পড়ন্ত বিকেল,কেমন যেন মায়া জোড়ানো রোদ শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছিলো।অদ্ভুত এক অচেনা আলো।কোথায় যেন দীপু শুনেছিল এমন আলোকে নাকি কনে দেখা আলো বলে।সেই কনে দেখা আলোর অরুনাভা মনে লুকিয়ে রেখে দীপু দুটি মায়বী চোখের বাঁধনে বাঁধা পড়ে একা দাঁড়িয়ে রইলো বোকার মত।
সন্ধ্যেবেলায় বাড়ী ফিরেই রুদ্রদাদুর সাথে নিমন্ত্রনপত্রের গোছা হাতে করে দীপু বেরোলো পাড়ায় ঘুরে ঘরে বিয়ের নিমন্ত্রন সারতে।নীল ওর বাবার সাথে গেছে দুরের আত্মীয়দের পাট মিটাতে।নীলরা থাকে ‘দিশা’ বলে একটা ছয়তলা হাউসিং অ্যাপার্টমেন্টে। ওদের পাড়ায় এই রকম ছোটবড় একাধিক অ্যাপার্টমেন্টও যেমন আছে, তেমনি নিজস্ব একতলা দোতলা বা তিনতলা বাড়ীও আছে। নীলদের বাড়ীর ঠিক উল্টোদিকে যে নতুন বিল্ডিংটা উঠেছে, তার তিনতলায় দরজা নক করতেই যে দরজা খুলে এক ঝলক অতিথিদের দিকে তাকিয়েই খোলা পাল্লার আড়ালে সরে দাঁড়ালো, তাকে দেখেই আনন্দে দম বন্ধ হয়ে আসলো দীপুর। এই তো
সেই অনামিকা।এবাড়ী সেবাড়ী ঘুরে কাজ শেষ করে বাড়ী ফিরে নীলের কাছে বাকি সুলুক সন্ধান পেয়ে গেল দীপু।
নীলদের বাড়ীর ঠিক উল্টোদিকের নতুন বিল্ডিংটার তিনতলায় থাকেন অবনীবাবু, প্রথম মেয়েটি ওনার ভাগ্নী, নাম ইন্দ্রানী ।মা বাবা নাকি খুব ছোটবেলাতেই মারা গেছে। মামা মামীর ঘরেই মানুষ।দু’বোনে খুব ভাব।ইন্দ্রানী আবার নীলদের কলেজেই পড়ে।নীল ফাইনাল ইয়ার আর ইন্দ্রানী মানে এই মেয়েটি সবে ফার্স্ট ইয়ার। অবনীবাবুর একটিই মেয়ে, কঙ্কনা ।সে আবার নীলের ক্লাসমেট।সে এখন চুটিয়ে প্রেম করছে পাড়ার উঠতি হিরো স্যান্ডির সাথে।পাড়ার সবাই জানে।তবে কিনা প্রেম পাড়ার সবাইকে দেখিয়ে করলেও বাড়ীতে লুকাতে হয়, তাই বোধহয় রোজ বিকালে পিসতুতো বোনটিকে সাথে করে গঙ্গার হাওয়া খাবার নাম করে আসে, এসেই স্যান্ডির হিরো হন্ডাটিতে সওয়ার হয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে যায়,যতক্ষন না দিদিটি ফেরত আসে ততক্ষন বেচারী ইন্দ্রানী একা একা ঘাটের পাশে বসে একমনে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।গতকয়েক মাস এক রুটিন চলছে।সেদিনের পর আর গঙ্গার ঘাটে দেখা হয়নি দুজনের।গঙ্গার ঘাটে আর আসেনি ইন্দ্রানীরা,এক্কেবারে দেখা হয়েছিল নীরাদিদির বিয়ের দিন। ম্যাজেন্টা রঙের সিল্কশাড়ীতে অসম্ভব সুন্দর লাগছিল মেয়েটা। দীপুর নজর আর সরছিল না। প্রজাপতির মত এদিক ওদিক ঘুরতে ফিরতে যতবারই দুজনের চোখাচোখি হয়েছ ততবারই একটা মিষ্টি প্রশ্রয়ের হাসি হেসে টুক করে সরে গেছে মেয়েটা।নীল তার মুখচোরা লাজুক বন্ধুটিকে ওস্কালেও মুখ ফুটে কোন কথা বলা হয়ে ওঠেনি দীপুর।আর বিয়ের পরদিনই রাউরকলার রিং রোডে দীপুর বাবার আচমকা অ্যাক্সিডেন্টটা দীপুকে কিছু বলার সুযোগও দেয়নি।আর দেখা হয়নি দুজনের। তবে দীপুর মন থেকে সেদিনের ভালোলাগাটুকু সময়ের সাথে হারিয়েও যায়নি।
তারপরে গঙ্গার বুক বেয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, অনেকগুলো দিনরাত পার করে এসে সেদিনের দীপু আজ গল্পলেখার নেশাটা হারিয়ে ফেললেও ডায়েরী লেখার বদভ্যাসটা কিন্তু ছাড়তে পারেনি।বিয়ে করাটা আর হয়ে ওঠেনি দীপুর। বাড়ীর সবাইকে নিয়ে দাদার মেয়ের বার্ষিক পরীক্ষার পরে বেড়াতে এসেছে নীলের বাড়ী।এখান থেকে দুই পরিবারের লোক মিলে ঘুরতে যাবে শিমলা কুলু মানালী।আজ রুদ্রদাদু নেই,নেই দীপুর বাবা-মাও। নীলের বাবা অবশ্য অবসর নিয়ে এখনেই আছেন। নীরাদিদি দুই ছেলে আর বরের সাথে কানাডায়।নীলের বৌ আঁখি আবার দীপুর বৌদি পাখির পিসতুতো বোন। তাই আসার আগ্রহটা ওর দাদা বৌদিরই বেশী। সেদিনও দোলপূর্ণিমা। শুভদিন দেখে রং খেলা শুরু হবার আগেই সাতসক্কালে বাড়ীর সকলে পূজো দিতে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে গেলেও দীপু একা চলে এসেছে বারো মন্দিরের ঘাট। কত লোকের ভীড়,কথা,কত মুখ,কত হাঁটার ভঙ্গী,কত চাউনী, কত কথকতা।দুচোখ ভরে খালি দেখে যাওয়া,দেখা তো নয়, যেন চোখ দিয়ে গোগ্রাসে খাওয়া।ডায়েরী লেখার জন্য হাতটা নিসপিশ করে ওঠে।হঠাৎ চোখে পড়ে খনিকটা দূরে ঘাটের সিঁড়িতে বসা এক সাদা শাড়ী পড়া মাঝবয়সী মহিলা এত লোকের ভীড়েও কেমন সবার থেকে আলাদা হয়ে আনমনে গালে হাত দিয়ে একদৃষ্টিতে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে আছেন। দৃশ্যটায় নতুনত্ব কিছু নেই।হঠাৎই খোল করতাল নিয়ে হোলির গান গইতে গাইতে বহুরূপী কৃষ্ণকে মধ্যমনি করে ,খোলা রাস্তায়, পথচলতি লোকের গায়ে, দুরন্ত বাতাসে আবীর ছড়িয়ে, ফুটকলাই ফেণীবাতসা দিয়ে মিষ্টিমুখ করাতে করাতে, একদল লোক পাশের রাস্তা ধরে বোধহয় শিরোমনি মশাই প্রতিষ্ঠিত রাধা কৃষ্ণের মন্দিরে দোলৎসবে গেল। আওয়াজে আকৃষ্ট হয়ে সাদা থান পড়া মহিলাও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন।চোখাচোখি হল দীপুর
সাথে।অচেনার ভঙ্গীতে লহমা মাত্র দীপুকে দেখে মহিলা চোখ সরিয়ে নিয়েও হঠাৎ ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মত চমকে উঠে ভালো করে তাকালেন দীপুর দিকে,হাতে ধরা ডায়েরীটার ওপর দিয়ে দৃষ্টিটা আবার চোখে এসেই থামল।দীপুর অবাক চোখের দৃষ্টি অনুসরন করে নিজের দিকে একপলক তাকিয়েই উঠে দাঁড়লেন। সাদাথান কাপড়টা ঘোমটার মত তুলে মুখটা আড়াল করে ত্বড়িতপায়ে লোকের ভীড়ে যেন বেমালুম মিশে গেলেন।
অজান্তেই অনেকক্ষন আটকে রাখা শ্বাসবায়ূটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এল।দীপুর কলম লিখে নিল ওর মনের অব্যক্ত কথাগুলো।
আজ কিন্তু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সহজে চোখ ফেরাতে পারছে না দীপু।আজ দোল। সকালে বোধহয় খুব রঙ মেখেছিল, তার গোলাপী আভা এখনও মোছেনি কপালের,গালের ওপর থেকে।চুলে এখনও তেলের ছোঁওয়া পড়েনি বোধহয়।আলতো হাতখোঁপার বাঁধন এড়িয়ে চুলের গুছিগুলো হাওয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে আপনমনে খেলছে,নাচছে। আহামরি সুন্দরী নয়,তবু শালীনতা মেশানো একটা আলগা শ্রী মেয়েটাকে অন্যরকম আকর্ষনীয় করে তুলেছে।দীপুর তরুন হৃদয় তার মনের সবটুকু ভালোলাগা দিয়ে মুহূর্তটাকে ধরে রাখতে চাইছে।ঐ বাসন্তী হলুদ ছাপা শাড়ী,ঐ গালে হাত দিয়ে আনমনে বসে থাকা,ঐ অস্তগামী সূর্য্যের আলোকে সারা গায়ে মেখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা,সব আজ দীপুর চোখে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।
নীল দীপুর ছোটবেলার বন্ধু, একপাড়াতেই বড় হওয়া, স্কুল থেকে কলেজে যাওয়া, পরে নীলের বাবার কাজের সূ্ত্রে সোদপুরে বদলী হয়ে আসলেও প্রযুক্তি বিজ্ঞানের বদাণ্যতায় যোগাযোগে ভাঁটা পড়েনি। কতটুকুই বা দূর। ওড়িশার রাউরকেলা আর পশ্চিমবঙ্গের সোদপুর-পানিহাটি। নীলের খুব ছোটবেলাতেই মা মারা যাবার কারণে,আর বাবার বদলীর চাকরী হওয়াতে ওরা দুই ভাই বোন নীরা আর নীল ওদের ঠাকুরদার কাছেই বড় হয়েছে। রুদ্রদাদু দীপুরও খুব আপনজন,নীরাদিদি তো এখনও ভাইফোঁটায় দীপু আসবে না বললে কেঁদে ভাসায়।এই নীরাদিদির বিয়ে উপলক্ষ্যেই গত সাতদিন ধরে দীপু সোদপুরে এসে রয়েছে।বাড়ীতে মেলা আত্মীয় স্বজনের ভীড়। সবাইকে চেনে না দীপু। তাই বিকালের দিকে নীল ঘরের ডামাডোলে বেশী ব্যস্ত থাকে বলে ও একাই পায়ে হেঁটে চলে আসে গঙ্গাতীরে। সূর্য্যাস্তের পরে উঠে যায়। সাতদিন ধরেই মেয়েটাকে দেখছে ও।বিকালের দিকে আরেকটি বেশ সুন্দরী, আধুনিক পোষাকে সজ্জিতা মেয়ের সাথে এই মেয়েটি আসে, দুজন সমবয়সী।তাই বোন নয়, বান্ধবী হওয়াই স্বাভাবিক। এই দ্বিতীয় মেয়েটি বোধহয় এখন চুটিয়ে প্রেম করছে পাড়ার কোন উঠতি হিরো সাথে। রোজ বিকালে ভালোমানুষ বান্ধবীটিকে সাথে করে গঙ্গার হাওয়া খাবার নাম করে আসে, এসেই হিরোর হিরো হন্ডাটিতে সওয়ার হয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে যায়,যতক্ষন না সে ফেরত আসে ততক্ষন বেচারী এই মেয়েটি একা একা ঘাটের পাশে বসে একমনে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
হঠাৎই ভালোলাগায় ছন্দপতন। হিরোর বাইকটা বীভৎস যান্ত্রিক আওয়াজ তুলে মেয়েটার পাশে এসে থামলো।মৃদু হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো ও। হিরো এবং তার বান্ধবীটিকে আর চেনা যাচ্ছেনা, এত বিভিন্ন রঙের আবীর ছড়ানো রয়েছে ওদের দেহের সর্বত্র। হিরো বাইক পার্ক করে নামলেন,একটু ঝুঁকে বান্ধবীর কানে কিছু বললেন। কাঁচভাঙ্গা আওয়াজের হিল্লোল তুলে গড়িয়ে পড়ল সঙ্গধারী রঙীন সঙ্গ সাজা সুন্দরী। হিরোসুলভ বীরত্বে হিরো এবার দু’হাতে আবীর নিয়ে অশ্লীলভাবে জড়িয়ে ধরে আগের মেয়েটিকে রঙ মাখিয়ে দিল।মেয়েটির ছটফটনি
দেখে বোঝা গেল ওর আপত্তি আছে। ছিটকে সরে যেতে গেলেও আঁচলটা মুঠো পাকিয়ে ধরে নিলেন হিরো।দোলের দিন, আর বোঝাই যাচ্ছে ওরা একে অপরের পরিচিত।তবু নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়য়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেল দীপু। ইতিমধ্যে অন্য মেয়েটিও গতি সুবিধার নয় দেখে প্রেমিক প্রবরের হাত চেপে ধরলো।গোটা ঘটনাটাই ভীষণ অল্প সময়ের মধ্যে এবং তাৎক্ষনিকভাবে ঘটে যাওয়াতে হিরোর হাতের মুঠো আলগা হয়ে গেল এবং মেয়েটিও টাল সামলাতে না পেরে দু তিন কদম এগিয়ে দীপুর গায়ে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তারপরেই চকিতে তাকাল দীপুর দিকে,কান্নার ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল আবীর রাঙানো গাল বেয়ে,অন্য কেউ দেখার আগে চট করে আঁচলে মুছে নিয়ে সরে দাড়ালো। ওদিকে দীপুকে আপদমস্তক দেখে নিয়ে বান্ধবীর সাথে কিছু একটা কথা বলে বাইকটা ঘোরালো হিরো, কিন্তু বান্ধবীটি কথা না শোনার ভান করে প্রথম মেয়েটিকে এসে জড়িয়ে ধরল।ওরই আঁচল দিয়ে যতটা পারে রঙীন আবীর ঝেড়ে ফেলে দিলো, অল্প হাসলো দীপুর দিকে তাকিয়ে, তারপর দু’জনে পা বাড়ালো বাড়ীর দিকে।পড়ন্ত বিকেল,কেমন যেন মায়া জোড়ানো রোদ শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছিলো।অদ্ভুত এক অচেনা আলো।কোথায় যেন দীপু শুনেছিল এমন আলোকে নাকি কনে দেখা আলো বলে।সেই কনে দেখা আলোর অরুনাভা মনে লুকিয়ে রেখে দীপু দুটি মায়বী চোখের বাঁধনে বাঁধা পড়ে একা দাঁড়িয়ে রইলো বোকার মত।
সন্ধ্যেবেলায় বাড়ী ফিরেই রুদ্রদাদুর সাথে নিমন্ত্রনপত্রের গোছা হাতে করে দীপু বেরোলো পাড়ায় ঘুরে ঘরে বিয়ের নিমন্ত্রন সারতে।নীল ওর বাবার সাথে গেছে দুরের আত্মীয়দের পাট মিটাতে।নীলরা থাকে ‘দিশা’ বলে একটা ছয়তলা হাউসিং অ্যাপার্টমেন্টে। ওদের পাড়ায় এই রকম ছোটবড় একাধিক অ্যাপার্টমেন্টও যেমন আছে, তেমনি নিজস্ব একতলা দোতলা বা তিনতলা বাড়ীও আছে। নীলদের বাড়ীর ঠিক উল্টোদিকে যে নতুন বিল্ডিংটা উঠেছে, তার তিনতলায় দরজা নক করতেই যে দরজা খুলে এক ঝলক অতিথিদের দিকে তাকিয়েই খোলা পাল্লার আড়ালে সরে দাঁড়ালো, তাকে দেখেই আনন্দে দম বন্ধ হয়ে আসলো দীপুর। এই তো
সেই অনামিকা।এবাড়ী সেবাড়ী ঘুরে কাজ শেষ করে বাড়ী ফিরে নীলের কাছে বাকি সুলুক সন্ধান পেয়ে গেল দীপু।
নীলদের বাড়ীর ঠিক উল্টোদিকের নতুন বিল্ডিংটার তিনতলায় থাকেন অবনীবাবু, প্রথম মেয়েটি ওনার ভাগ্নী, নাম ইন্দ্রানী ।মা বাবা নাকি খুব ছোটবেলাতেই মারা গেছে। মামা মামীর ঘরেই মানুষ।দু’বোনে খুব ভাব।ইন্দ্রানী আবার নীলদের কলেজেই পড়ে।নীল ফাইনাল ইয়ার আর ইন্দ্রানী মানে এই মেয়েটি সবে ফার্স্ট ইয়ার। অবনীবাবুর একটিই মেয়ে, কঙ্কনা ।সে আবার নীলের ক্লাসমেট।সে এখন চুটিয়ে প্রেম করছে পাড়ার উঠতি হিরো স্যান্ডির সাথে।পাড়ার সবাই জানে।তবে কিনা প্রেম পাড়ার সবাইকে দেখিয়ে করলেও বাড়ীতে লুকাতে হয়, তাই বোধহয় রোজ বিকালে পিসতুতো বোনটিকে সাথে করে গঙ্গার হাওয়া খাবার নাম করে আসে, এসেই স্যান্ডির হিরো হন্ডাটিতে সওয়ার হয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে যায়,যতক্ষন না দিদিটি ফেরত আসে ততক্ষন বেচারী ইন্দ্রানী একা একা ঘাটের পাশে বসে একমনে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।গতকয়েক মাস এক রুটিন চলছে।সেদিনের পর আর গঙ্গার ঘাটে দেখা হয়নি দুজনের।গঙ্গার ঘাটে আর আসেনি ইন্দ্রানীরা,এক্কেবারে দেখা হয়েছিল নীরাদিদির বিয়ের দিন। ম্যাজেন্টা রঙের সিল্কশাড়ীতে অসম্ভব সুন্দর লাগছিল মেয়েটা। দীপুর নজর আর সরছিল না। প্রজাপতির মত এদিক ওদিক ঘুরতে ফিরতে যতবারই দুজনের চোখাচোখি হয়েছ ততবারই একটা মিষ্টি প্রশ্রয়ের হাসি হেসে টুক করে সরে গেছে মেয়েটা।নীল তার মুখচোরা লাজুক বন্ধুটিকে ওস্কালেও মুখ ফুটে কোন কথা বলা হয়ে ওঠেনি দীপুর।আর বিয়ের পরদিনই রাউরকলার রিং রোডে দীপুর বাবার আচমকা অ্যাক্সিডেন্টটা দীপুকে কিছু বলার সুযোগও দেয়নি।আর দেখা হয়নি দুজনের। তবে দীপুর মন থেকে সেদিনের ভালোলাগাটুকু সময়ের সাথে হারিয়েও যায়নি।
তারপরে গঙ্গার বুক বেয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, অনেকগুলো দিনরাত পার করে এসে সেদিনের দীপু আজ গল্পলেখার নেশাটা হারিয়ে ফেললেও ডায়েরী লেখার বদভ্যাসটা কিন্তু ছাড়তে পারেনি।বিয়ে করাটা আর হয়ে ওঠেনি দীপুর। বাড়ীর সবাইকে নিয়ে দাদার মেয়ের বার্ষিক পরীক্ষার পরে বেড়াতে এসেছে নীলের বাড়ী।এখান থেকে দুই পরিবারের লোক মিলে ঘুরতে যাবে শিমলা কুলু মানালী।আজ রুদ্রদাদু নেই,নেই দীপুর বাবা-মাও। নীলের বাবা অবশ্য অবসর নিয়ে এখনেই আছেন। নীরাদিদি দুই ছেলে আর বরের সাথে কানাডায়।নীলের বৌ আঁখি আবার দীপুর বৌদি পাখির পিসতুতো বোন। তাই আসার আগ্রহটা ওর দাদা বৌদিরই বেশী। সেদিনও দোলপূর্ণিমা। শুভদিন দেখে রং খেলা শুরু হবার আগেই সাতসক্কালে বাড়ীর সকলে পূজো দিতে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে গেলেও দীপু একা চলে এসেছে বারো মন্দিরের ঘাট। কত লোকের ভীড়,কথা,কত মুখ,কত হাঁটার ভঙ্গী,কত চাউনী, কত কথকতা।দুচোখ ভরে খালি দেখে যাওয়া,দেখা তো নয়, যেন চোখ দিয়ে গোগ্রাসে খাওয়া।ডায়েরী লেখার জন্য হাতটা নিসপিশ করে ওঠে।হঠাৎ চোখে পড়ে খনিকটা দূরে ঘাটের সিঁড়িতে বসা এক সাদা শাড়ী পড়া মাঝবয়সী মহিলা এত লোকের ভীড়েও কেমন সবার থেকে আলাদা হয়ে আনমনে গালে হাত দিয়ে একদৃষ্টিতে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে আছেন। দৃশ্যটায় নতুনত্ব কিছু নেই।হঠাৎই খোল করতাল নিয়ে হোলির গান গইতে গাইতে বহুরূপী কৃষ্ণকে মধ্যমনি করে ,খোলা রাস্তায়, পথচলতি লোকের গায়ে, দুরন্ত বাতাসে আবীর ছড়িয়ে, ফুটকলাই ফেণীবাতসা দিয়ে মিষ্টিমুখ করাতে করাতে, একদল লোক পাশের রাস্তা ধরে বোধহয় শিরোমনি মশাই প্রতিষ্ঠিত রাধা কৃষ্ণের মন্দিরে দোলৎসবে গেল। আওয়াজে আকৃষ্ট হয়ে সাদা থান পড়া মহিলাও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন।চোখাচোখি হল দীপুর
সাথে।অচেনার ভঙ্গীতে লহমা মাত্র দীপুকে দেখে মহিলা চোখ সরিয়ে নিয়েও হঠাৎ ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মত চমকে উঠে ভালো করে তাকালেন দীপুর দিকে,হাতে ধরা ডায়েরীটার ওপর দিয়ে দৃষ্টিটা আবার চোখে এসেই থামল।দীপুর অবাক চোখের দৃষ্টি অনুসরন করে নিজের দিকে একপলক তাকিয়েই উঠে দাঁড়লেন। সাদাথান কাপড়টা ঘোমটার মত তুলে মুখটা আড়াল করে ত্বড়িতপায়ে লোকের ভীড়ে যেন বেমালুম মিশে গেলেন।
অজান্তেই অনেকক্ষন আটকে রাখা শ্বাসবায়ূটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এল।দীপুর কলম লিখে নিল ওর মনের অব্যক্ত কথাগুলো।
“প্রথম দেখাতেই মনে রঙ ধরিয়েছিলে ফাগের দিনের রঙীন বেশে , গোধূলীবেলায়, তবু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি।আজ আবার সেই আবীরমাখা দিনের শুরুতে সামনে এলে দুধসাদা রঙে সেজে, অমল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে, আজও আমার মনের কথা অব্যক্তই রয়ে গেল।“
খূব ভাল লাগলও
উত্তরমুছুন