সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

বুধবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

ছোটগল্প - উদয়ন রায়

শুধু যখন বৃষ্টি হবে
উদয়ন রায়


এটা শুধুই একটা পুকুরের গল্প। বা তাও নয়। এটা একটা মেয়ের গল্প, তার একলা জানালার চৌখুপির গল্প। বা তাও নয়। এটা একটা জীবনের গল্প, একদিনের-প্রতিদিনের। না তাও ঠিক হল না। কিছু অকিঞ্চিৎকর মানুষের গল্প, হয়তো।

কলকাতার কাছাকাছি, আগাছায় ভরা রেললাইন, স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম, মরচেধরা লেবেল ক্রশিং, লেবেল ক্রশিং-এর ধারের চা-দোকানের ঝুপরি, বন্ধহওয়া কাঁচ'কলের জংধরা গেট, খোলা নর্দমার ডাঁশ মশার পন্‌পন, ঘাসওঠা কাদাজল মাখা উঠোন-আক্‌তি খোলা জায়গা, যার নাম 'নেতাজী ময়দান', সেখানে ডিসেম্বরের ধোঁয়াশা ভরা সন্ধ্যায় ম্যারাপ খাটিয়ে, নিয়নের আলোয় হয় অষ্টপ্রহর হরিনাম সংকীর্তন, এখানেই হয়তো তাদের দিনগত আহার-নিদ্রা-সঙ্গম। বোজা পুকুরে, ঘেঁষ আর শুরকি ফেলা জমিতে, বা পুকুরের ধার ঘেঁষে উঁচু জমিতে তাদের কোঠা বাড়ি, টালিরচালের বাড়ি দখলের জমিতে, অথবা পয়সাওয়ালা বড় চাকুরে বা ব্যবসাদার-এর সাদা-হলুদ-লাল রং এর বেমানান অট্টালিকা।



পুকুরটা সেই জীবনের সাক্ষি গোপাল। পুকুরটা বড়। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ নিয়ে প্রায় দেড়খানা ফুটবল মাঠের সমান। পুকুরটা আর তার আশেপাশের পাড়ার নাম সেনবাগান। কে জানে কেন এরকম নাম, কবেই বা হয়েছিলো এরকম ? পুকুরটার পূবদিকে বন্ধ হয়ে যাওয়া কাঁচ'কলের দেওয়াল। দেওয়ালে গায়ে নোনাধরা ইঁট আর বটগাছের চারা। উত্তরদিকে পুকুরের ধার ঘেঁষে এট্টুখানি চওড়া রাস্তা, দুনম্বর রেলগেট থেকে চলে গেছে বিটি রোড। এই রাস্তার দুধারে ড্রেন, মাশার চাষ হয় সেখানে। ড্রেনের ওপর বাঁশের পাটাতন পাতা পান-বিড়ি সিগারেট আর রেডিও-ঘড়ি-প্রেসারকুকার সারাই-এর দোকান। ঘিঞ্জি রাস্তায় মাঝে মাঝে যায়-আসে ক্যান্টনমেন্ট রুটের প্রাইভেট বাস। সরু রাস্তায় মুষকো বাসকে রাস্তা দিতে, পথচারীদের নেমে যেতে হয় প্রায় নর্দমায়। বাস চলে ২কিমি গতিতে। সেটা যত বেশী না ভীড় বাঁচাতে, তার চেয়ে-ও বেশী প্যাসেঞ্জারের আশায়। পুকুরের দক্ষিণ পশ্চিম পাড় এখানে-ওখানে সিমেন্ট করা। ভাঙ্গাচোরা সিঁড়ি নেমে গেছে জলে। পুকুরের ধার দিয়ে বারোফুটিয়া রাস্তা। খোয়া ঢালা। পিচ হয় নিয়ম করে, তবে ছয়মাসের বেশী অবশিষ্ট থাকেনা। রিক্সা চলে সেখানে, আর দুটো টিউওয়েল। রাস্তার ধারে ধারে নতুন পুরোনো পাকাবাড়ী। একতলা বা দোতলা বা তিনতলা। রাস্তার দিকে সস্তা গ্রিলের গেট।



পুকুরের দক্ষিন পারে তিনতলা বাড়ীর দোতালায় ভাড়া থাকে সুমনা আর তার বর। সুমনা-র বিয়ে হয়েছে ভালবেসে। বরটা তার সওদাগরি কোম্পানীর কারখানায় সামান্য উঁচুদরের চাকুরে। সূক্ষ্মদরে বিচার করলে অবশ্য কেরানীর বেশী কিছু নয়। তার ভাবখানা যেন কেউকেটা মতন। তার আপিসের ভাগ্য যেন লেখা আছে তার-ই হাতের মুঠোয়। তাই সেই 'একশো বারো' টাকা মাইনেতে দিবারাত্র আপিসের গোলামি খেটে যায় সে। পুর্বরাগ পর্বে ইডেনে বা বালিগঞ্জলেকের ঘন অন্ধকার মাখা বেঞ্চে বসে, পুলিশের চোখ এড়িয়ে সুমনার নরম-ভেজাভেজা ঠোঁটে চুমু দিতে দিতে সে বলেছিলো অফুরান সময় একসাথে কাটানোর কথা। সেকথা সে ভুলে গেছে কবেই । বা ভোলে-ও নি হয়তো। অপিসের গোলামি আর সুমনার জন্য সময় কাটাকুটি হয়ে যাচ্ছে বারবার। সুমনা বসে থাকে জানালায়। পুকুরের ধারে একটা কদমগাছ রাস্তা পেড়িয়ে ঝুঁকে এসেছে জানলার গ্রিলে। জানালার নীচে পুকুরের ধারে টিউওয়েল। লুঙ্গি আর ময়লা সার্ট পরা 'ভারী' টিনের বাঁকে করে জল নেয় টিউওয়েল থেকে। পুকুরের জলে বাসনধোয় ঠিকে কাজের লোকেরা। গুমোট দুপুরে কাপড় কাচে ঘাটের ভাঙা সিমেন্টের চাঙড়ে। বর্ষায় পুকুর প্রায় উপচে ওঠে জল। ঘাটের সিঁড়ি চলে যায় জলের তলায়। জলের ধারে মুখ বাড়িয়ে থাকে হেলে সাপ। বাসনধোয়া এঁটোকাঁটার আশায়। পাশের বাড়ীর প্রৌঢ় নন্দীবাবু-র ছেড়ে রাখা লুঙ্গি-তে লুকিয়ে থাকে হেলে সাপ, নন্দীবাবু তখন বুকজলে দাঁড়িয়ে নিমের দাঁতন করছিলেন। তারপর নন্দীবাবুর ভ্যাবাচ্যাকা মুখ আর লুঙ্গি ঝাড়ার বিচিত্র কায়দায়, হেসেকুটোপাটি হয় সুমনা, জানালা থেকে। রান্নাঘরে বাসনের ঠুংঠাং ,কাজের মাসিএল বোধহয়, একা কোথায় আর ? গরমের গুমোট দুপুরে, রেললাইনের ধারের বস্তির ছেলেপিলেরা ঝুপুস ডুবে থাকে জলে। জলের ধারের অশ্বত্থ গাছের ডাল থেকে ঝপাং লাফায় জলছিটিয়ে। কালোকুলো রোগারোগা, নেংটি পরা ছেলেদের হিহিহাসি আর মুখখিস্তির ফুর্তি শুনতে শুনতে সুমনার একা একা লাগেনা আর। বিকেলের দিকে, আকাশ ঘন করে ঝড় আসে। ঝড়ের তোড়ে ধুলো ওড়ে, ব্‌ষ্টি আসে ঝাঁপিয়ে, ধুলো আর ব্‌ষ্টিতে ঝাপসা হয়ে যায় পুকুরের পাড়। ব্‌ষ্টি থামলে সন্ধ্যা নামে ঝিঁঝি-ঁর ডাকে। ভেজাভেজা বাল্ব জ্বলে কাঁচ'কলের গায়। সুমনার কান খাড়া শোনে রিক্সার ক্যাঁচকোঁচ। বর আসবে এখুনি । অপেক্ষায় অপেক্ষায় সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। হ্যাঁ বর আসে, নিশুতি রাতে, পাড়া যখন ঘুমিয়ে পড়েছে। কাজের শেষে, অপিশ উদ্ধার করে। তারপর, রাতের খওয়ার শেষে, বিছানায় আবেশে, শরীরে শরীরে ঘনিষ্ঠ হতে হতে, সুমনা ভাবে, রবিবারের আর কত দেরি ?



কাজলদা। নন্দীবাড়িতে আশ্রিত। রোগাসোগা মধ্যবয়সী বেকার। বি এ পাশদিয়ে মাড়োয়ারি গদিতে খাতা লেখা থেকে বে-আইনি ওষুধের সেলসম্যানগিরি সব কাজেই অভিজ্ঞ। তবে আসলে অলস প্রক্‌তির। উপস্থিত কিছুই করেন না। একার জীবন চালাতেই হিম্‌সিম। প্রৌঢ় নন্দীবাবু, সম্পর্কে ওর গ্রামতুতো মামা হন। উঠোনে ইঁটের গাথনি আর দর্মার ছাদ দিয়ে ঘর বানিয়ে কাজলদা-কে থাকতে দিয়েছেন। এর বেশী কিছু নয়। ভাত জোটে মাঝেমধ্যে। কিন্তু কাজলদার শুধু ভাতে চলেনা, সিগারেটের নেশা, তরলের-ও। বিলিতি-র পয়সা নেই তাই চোলাই। মেয়েমানুষের ইচ্ছা-ও আছে, পয়সা নেই। তাই এর-ওর মাথায় হাত বোলানো। মানে জকমারা। বন্ধুর-বন্ধুর-বন্ধুর সোদপুরের বাড়িতে, ইলেকট্রিসিটি বিল জমা দেওয়ার নামে, টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া। আরো কোনো এক অল্প পরিচিতের ছাদের পাখা সারাই করার নামে, লোহার দরে বেচে দিয়ে আসা। এরকম করেই চলে কাজলদার আজ-কাল-পরশু। বি এ পাশের গুমো্র আছে অবশ্য বারোয়ানা। চোলাইয়ের ঠেকে রিক্সাচালক হরি-মধু আর রংএর মিস্ত্রি গুলে দের মনুষ্য প্রজাতির মনে করেন না । নীলগলাবন্ধনির খাটিয়ে কাজের লোকেদের ঘামের গন্ধে সরগরম চোলাইয়ের ঠেকে বিমর্ষ বসে থাকেন কাজলদা। ভাবেন শ্রেনী বৈষম্য। অনেক রাতে, বেসামাল পায়ে বসেন পুকুরের ধারের সিঁড়িতে। ঘোলা হয়ে ওঠা মগজের ঠেলায় হেঁড়ে গলায় গান ধরেন, 'কেন যামিনী না যেতে, জাগালে না'। সুমনা রাত জাগা চোখে শোনে। সুমনা জানে কাজলদার দর্মার ছাদের ঘরে, একটা পুরোনো এস্রাজ আছে। নন্দীবাড়ীর বউ তাকে বলেছে। কালেভদ্রে সেটা বাজান কাজলদা। বাজনার হাতটা তার মিষ্টি।



স্বপন ডাক্তার। বছর পঁয়তাল্লিশের, এম বি বি এস। পাড়ার ডাক্তার। বাবু নন, শুধু-ই ডাক্তার, সর্দি-কাশি-পাতলাপায়খানা-অম্বলের। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে তাঁর পৈত্‌ক বাড়ি-কাম-ডিস্পেনসারি। ই এস আই প্রেস্কিপশন লেখা তাঁর প্রধান কাজ। ছুটির দরখাস্ত আর ফিট সার্টিফিকেটে দস্তখত করা তাঁর অন্য প্রধান কাজ। বেওয়ারিস সারমেয়-এর দৌলতে, জলাতঙ্কের ওষুধের ব্যবসা-ও করছেন আজকাল। সকালের ডিস্পেনসারি শেষ করে, গামছা পড়ে, তেলের শিশি আর লাইফবয় সাবানের কৌটো হাতে পুকুরে যান স্নানে। পাতলা হয়ে যাওয়া কোঁকড়া চুলে, ঘষে ঘষে মাখেন প্যারাসুট নারকেল তেল। নাতিদীর্ঘ শরীরে আর ভুঁড়িতে লাইফ বয় সাবান। তিন চারটে ডুব দিয়ে বাড়ী ফিরে পোনামাছের ঝোল। সন্ধ্যায় আবার সেই তেঁতুলকাঠের ডিস্পেন্সারির টেবিল। রাতে যৌবন উত্তীর্ন বউ-এর সঙ্গে ভাগাভাগি বিছানা। রাত-বিরেতে মাঝেসাঝে কল আসে এবাড়ি সেবাড়ি থেকে। বর্ষায় ম্যালেরিয়া আর টাইফয়েড বাড়লে। সেদিন সুমনার সারাদিন-ই মাথা ঝিম্‌ঝিম। ওর বর ফেরে সেই নিশুতি রাতে। সুমনা তখন শরীরের অসোয়াস্তিতে বিছানায়। ব্যস্তসমস্ত ওর বর ডেকে আনে স্বপন ডাক্তারকে। সুমনার চোখের তলা আর নাড়ী দেখে, দুচারটে পরীক্ষার কথা বলে ফিরে যান ডাক্তার। বাড়ী ঢোকার আগে পুকুরের সিঁড়িতে ঝুম বসে থাকেন কিছুক্ষন। সুমনা সন্তানসম্ভবা। কিছুদিন পর ওদের দোতালার গ্রিলে ঝুলবে ছোট্ট ছোট্ট ব্যবহার্য্য। তাঁর নিজের বাড়ীর গ্রিলটা কতদিন খালি আছে, খালি-ই থাকবে।



ঝর্নাদি। একটু গলিতে ঢুকে, তিনইঞ্চি ইঁটের গাথনির দুঘরের বাড়ী ঝর্নাদির। বাড়ীটা হয়েছে দুবছর। ইঁটের দেওয়ালে পলেস্তারা নেই। মেঝেতে ইঁট পাতা। নীচু জমি বলে, বর্ষায় জল হয় বাড়ীর চারপাশে। তখন রাস্তা থেকে বাঁশের সাঁকোতে ঢুকতে হয় বাড়ীতে। জানালা বসানো হয়নি এখোনো। শীতে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখতে হয় উত্তরের হাওয়া। ঘরের ভেতরে ইঁটদিয়ে উঁচুকরা পুরোনো খাট, খাটটা, ঝর্নাদির ভেঙ্গে যাওয়া বিয়ের উত্তরাধিকার। রংওঠা স্টীলের আলমারি, এটাও সেই বিয়ের, যৌতুকি। কাঠের কুলুঙ্গিতে, শনি-অন্নপুর্না-লক্ষী-কালী-র ফটো। শেষহয়ে যাওয়া দেশলাই-এর বাক্সে গোঁজা পুড়েযাওয়া ধুপকাঠি, ছাই, শুকনো জবা ফুলের মালা দুচারটে। ঘরের ভেতর আড়াআড়ি টানানো, নাইলনের দড়িতে, গাম্‌ছা, শাড়ি, ব্লাউজ, সায়া, ছেলেমেয়ের স্কুলের জামা-প্যান্ট-স্কার্ট-ইজের, অনেকবার কাচায় রংওঠা। মাটিতে একটা জলচৌকিতে ছেঁড়াছেঁড়া মলাটের বই খাতা। জলে ভেজা পেনের কালিতে গোটা গোটা করে লেখা 'শুভদীপ রায়-চতুর্থ শ্রেনী-ক' বা 'শর্মিষ্ঠা রায়-পঞ্চম শ্রেনী-ক'। ঝর্নাদি একা। একটা-একটা ছেলে মেয়ে। তারা দশ-এগারো বছর। স্কুলে যায়। ঝর্নাদি পেডলার। পন্য তার, রান্নার গ্যাসের ওভেন পরিস্কার করার আজব সল্যিউশন। মিউরিয়াটিক অ্যাসিড আর অন্যান্য ক্ষারজাতীয় কেমিক্যাল্‌স মিশিয়ে তৈরী হয়। প্লাস্টিকের বোতলে ভরা হয়, লেবেল-ও লাগান হয় আজগুবি। তারপর, ঝর্নাদির মতো পেডলারদের ব্যাগে ভরে পাঠানো হয় গ্রামেগঞ্জে বিক্রির জন্য। আর গ্যাস ওভেনের পাইপ আর নামী গ্যাস কোম্পানীর নকল বার্নার। ঝর্নাদিদের কাছে থাকে নামী গ্যাস কোম্পানীর ভুয়ো পরিচয়পত্র। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি সারাদিন। ভারীব্যাগ কাঁধে নিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটা গ্রামের পথে। অনর্গল কথায় মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা। সারাদিনের কাজের শেষে কমিশন মেলে বিক্রিবাটার। ছেলেমেয়েদের স্কুলের খরচ জুটেযায় এইভাবে। প্রতিদিন সন্ধ্যারাতে, সারাদিনের খাটুনির শেষে, বাড়ী ফিরে পুকুরে গা ধুতে যায় ঝর্নাদি। সুমনা দেখে জানালা থেকে। ঝর্নাদি-কে দেখে ইর্ষা হয় তার। এবারে তাকে চাকরি খুঁজতে হবে। বাড়ীর কাছেই 'অরবিন্দ বিদ্যাপীঠ'। বিটি পাশ-তো করা-ই আছে।



0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন