সৌকর্য গ্রুপের একমাত্র ওয়েবজিন।

About the Template

মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০১৩

হোলি - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

নানা কথায় হোলি
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



দোল বা হোলি হিন্দুদের এক পবিত্র উৎসব । ভারতের সর্বত্র এই উৎসব পালিত হয় নানান রীতিতে , এমনকি বহির্ভারতে নেপালে বা ভারতীয় বংশদ্ভূতদের মধ্যে হোলি উৎসব পালনের রেওয়াজ আছে । হোলি উৎসবের পেছনে নানান পৌরানিক লোককাহিনি প্রচলিত আছে এর মধ্যে প্রধান ‘হোলিকা দহন’ কাহিনি । এই থেকেই হোলি কথাটির উৎপত্তি । বাংলায় আমরা বলি ‘দোলযাত্রা’ আর পশ্চিম ও মধ্যভারতে ‘হোলি’ । আমাদের অনেক ধর্মীয় উৎসবেই আঞ্চলিক লোক-সংস্কৃতি ও রীতির প্রভাব দেখা যায় । পূর্বভারতে প্রধান ধর্মীয় উৎসব দূর্গা পূজা , পশ্চিমে গুজরাটে ‘নবরাত্রি’ । বাংলার দূর্গা, সিংহবাহনা আর গুজরাতে দুর্গা শেরওয়ালি । বাংলার দোলযাত্রায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব রীতির প্রাধান্য , এখানে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম লীলার বার্তাই সঞ্চারিত হয় । মথুরা বৃন্দাবনের উৎসবেও এই রীতি ।

কিন্তু মধ্যভারত বা পশ্চিমভারতে বিষ্ণু ভক্ত প্রহ্লাদের কাহিনিই প্রাধান্যপায় । সেই পৌরানিক কাহিনিটি এই রকম । দৈত্যরাজ হিরন্যকশিপু ব্রহ্মার বরে বলীয়ান ছিলেন যে , সে যেকোন পশু বা মানুষের দ্বারা অবধ্য । ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হিরন্যকশিপু দেবলোক আক্রমণ করে, দেবলোক তার পরম শত্রু । কিন্তু হিরন্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ ভগবান বিষ্ণুর পরম ভক্ত । দৈত্যকুলে বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদকে হত্যা করার নানান ষড়যন্ত্র করে পিতা হিরন্যকশিপু । কিন্তু ব্যর্থ হয় ।

হিরন্যকশিপুর ভগ্নী হোলিকাও বরপ্রাপ্তা ছিল যে অগ্নি তাকে বধ করতে পারবেনা । সুতরাং হিরন্যকশিপু হোলিকার কোলে বালক প্রহ্লাদকে বসিয়ে আগুন লাগিয়ে দিল । দাউদাউ অগ্নিশিখার মধ্যে প্রহ্লাদ ভগবান বিষ্ণুকে স্মরণ করে । বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ অগ্নিকুন্ড থেকেও অক্ষত থেকে যায় আর হোলিকা পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় । হিরণ্যকশিপুকে ভগবান বিষ্ণু নৃশিংহ অবতার রুপে বধ করেন ।

রঙ উৎসবের আগের দিন ‘হোলিকা দহন’ হয় অত্যন্ত ধুমধাম করে । শুকনো গাছের ডাল , কাঠ ইত্যাদি দাহ্যবস্তু অনেক আগে থেকে সংগ্রহ করে সু-উচ্চ একতা থাম বানিয়ে তাতে অগ্নি সংযোগ করে ‘হোলিকা দহন’ হয় । পরের দিন রঙ খেলা । বাংলাতেও দোলের আগের দিন এইরকম হয় যদিও তার ব্যাপকতা কম – আমরা বলি ‘চাঁচর’ । এই চাঁচরেরও অন্যরকম ব্যাখ্যা আছে । দোল আমাদের ঋতুচক্রের শেষ উৎসব । পাতাঝরার সময় , বৈশাখের প্রতিক্ষা। এই সময় পড়ে থাকা গাছের শুকনো পাতা, তার ডালপালা একত্রিত করে জ্বালিয়ে দেওয়ার মধ্যে এক সামাজিক তাৎপর্য খুঁজে পেতে পারি । বাংলায় দোলের আগের দিন ‘চাঁচর’ উদযাপনকে এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয় ।

অঞ্চল ভেদে হোলি বা দোল উদযাপনের ভিন্ন ব্যাখ্যা কিংবা এরসঙ্গে সংপৃক্ত লোককথার ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু উদযাপনের রীতি এক । ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন পূর্বভারতে আর্যরা এই উৎসব পালন করতেন । যুগেযুগে এর উদযাপন রীতি পরিবর্তিত হয়ে এসেছে । পুরাকালে বিবাহিত নারী তার পরিবারের মঙ্গল কামনায় রাকা পূর্ণিমায় রঙের উৎসব করতেন ।

দোল হিন্দু সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন উৎসব । নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ ও ‘জৈমিনি মিমাংশা’য় রঙ উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায় । ৩০০ খৃষ্টপূর্বাব্দের এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক ‘হোলিকোৎসব’পালনের উল্লেখ পাওয়া যায় । হর্ষবর্ধনের নাটক ‘রত্নাবলী’তেও হোলিকোৎসবের উল্লেখ আছে । এমনকি আলবিরুণীর বিবরণে জানা যায় মধ্যযুগে কোন কোন অঞ্চলে মুসলমানরাও হোলিকোৎসবে সংযুক্ত হতেন । মধ্যযুগের বিখ্যাত চিত্রশিল্পগুলির অন্যতম প্রধান বিষয় রাধা-কৃষ্ণের রঙ উৎসব ।

উদযাপনের রীতি রেওয়াজে ভিন্নতা থাকলেও দোল বা হোলির মূল সুরে কোন ভিন্নতা নেই তা হলো রবীন্দ্রনাথের গানের কথায় -
“রাঙ্গিয়ে দিয়ে যাও যাও যাওগো এবার যাবার আগে
তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে,
তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে,
অশ্রুজলের করুণ রাগে ......
মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ্র জাগে,
তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও
যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে
কাঁদন-বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে” ।।

তবে অন্য অনেক উৎসবের মত হোলিতেও অনেক নষ্টামি দেখা দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়কালে । অন্ধের মত গাছ কাটা হয় । মধ্যভারতে চাকুরী সূত্রে দীর্ঘদিন বসবাসের সুবাদে দেখেছি। দেখেছি রেল কোয়ার্টারের জানালা পর্যন্ত খুলে হোলিকা দহনের আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর বিষাক্ত রঙের কারণে চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়া তো প্রতি বছরই হয় । সেসম্পর্কে আমরা সতর্ক থাকি । কিন্তু সেই সব নষ্টামি হোলি বা দোল উৎসবের যে পবিত্র বার্তা, পারস্পরিক ভালোবাসার যে বার্তা তা কিছুমাত্র লঘু হয়ে যায়না। উৎসবের পবিত্রতার দিকটিই আমাদের গ্রহণীয় ।

1 comments:

  1. কোন জিনিসের খারাপটা আমি দেখি কম। আজ হোলি -অপরকে রাঙিয়ে দাও নিজের মতো করে; আর নিজেও রাঙা মনে রং মেখে নাও মনের মতো করে।

    উত্তরমুছুন